আমার
একটা সত্যিকারের মানুষ বন্ধু আছে। ওই যাহ্, তুই বারণ করেছিলি, তাও তোর কথা লিখতে
বসেছি। কবে থেকেই লিখব ভাবি আর হচ্ছিল না, মানে তুই বেঁচে যাচ্ছিলি আর কী। আচ্ছা,
নাহয় তোর নামটা বাদ দিয়েই লিখছি, তাতে আপত্তি নেই তো? আর থাকলেই বা শুনছে কে?
বিষ্ণুপুরের
রামানন্দ কলেজের জুওলজির ল্যাবে ওর সঙ্গে আমার আলাপ। জানতে চাই তোর নাম কি? এক গাল
হেসে বলে, মানুষ মনে রাখিস, তাহলেই মনে থাকবে। মানুষের কাছাকাছিই ওর নামের
উচ্চারণ, তাই কক্ষনো ভুলিনি নামটা। ছেলেবেলায় পোলিও হয়ে একটা পায়ে জোর কম, ক্রাচ
নিয়ে অবশ্য আমাদের চেয়ে জোরে হাঁটত, বলা যায় দৌড়তই। আর আমাদের মেয়েদের পুরো
দলটাতেই অসম্ভব জনপ্রিয় ছিল। অবশ্য তার জন্য কম পরিশ্রম করতে হয়নি ওকে। পড়া বুঝতে
অসুবিধা হলে, প্র্যাকটিকাল করতে গিয়ে আরশোলার নার্ভ ছিঁড়ে ফেললে কী চারতলা থেকে
একতলায় নেমে স্যারকে ডাকতে সবেতেই আমাদের এই সর্বদা হাসিমুখ মানুষ বন্ধুই ভরসা।
কয়েক মাস
পরে দুজনেই ওই কলেজ ছেড়ে দিই। ও রাণিগঞ্জে ভর্তি হল, আমি কলকাতায়। কিন্তু চিঠিতে
বন্ধুত্ব রয়ে গেল অবিচ্ছিন্ন। একেবারেই চিঠিলেখা টাইপ নয়, আমার পাল্লায় পড়ে বোধহয়
হাসিমুখেই দাঁত কিড়মিড় করে লিখত। তখন ও থাকত উখড়ায়, আমি রূপনারায়ণপুরে। একদিন ওদের
বাড়িতে গিয়েছিলাম, সেও না জানিয়ে হঠাৎ করেই। তখন মোবাইল, ফেসবুক তো দূরের কথা,
ল্যান্ডলাইনেরও তেমন চল নেই। তবে যেটা ছিল, তা হল অমলিন বন্ধুত্ব। যতদূর মনে পড়ে
সেদিন ওর বাড়িতে কেউ ছিল না। দুজনে এন্তার আড্ডা মেরে তারপর আমার মাথায় ঢুকল ওকে
আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসতে হবে। কতবার বোঝাল, বাড়িতে ফিরতে হবে, কেউ নেই, আমারও এক
কথা, তুই গিয়েই চলে আসবি। অগত্যা কী আর করে।
তারপর
চিঠিতেই যোগাযোগ অব্যাহত। আমার বিয়ের সময় আসতে পারেনি। সম্ভবতঃ আমিও ওর বিয়েতে
কোনো কারণে যেতে পারিনি। তবে তার আগেই একবার গিয়েছিলাম, সেও না জানিয়ে অবশ্যই।
আসানসোলের কাছে আমার এক বন্ধুর বিয়েতে সপরিবারে নেমতন্ন ছিল। আমি মেয়ে আর তার
বাবাকে বিয়েবাড়ির ঠিকানায় পাঠিয়ে নিজে মাঝপথে নেমে পড়লাম। এদ্দূর আসছি আর বন্ধুর
সঙ্গে দেখা হবে না, তাও কি হয়? আমাকে দেখে তো ভারি খুশি। নিজের ঘরটাই ছেড়ে দিল,
আমি অধিষ্ঠান করলাম। সেবারে ভীষণ ভালো এবং মাটির মানুষ কাকু-কাকিমার সঙ্গেও আলাপ
হল। তারাও দিব্যি আমার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন। পরেরদিন ওখান থেকেই বিয়েবাড়ি
পৌঁছলাম।
এরপরে
কলকাতাতেও কাজের সূত্রে এলে দেখা হয়েছে। এবার তো অনেকদিন পর রূপনারায়ণপুর যাওয়ায়
দেখা হল। খুব চিন্তা করছিল যে, একা যাচ্ছি, রাত্তিরে যদি কোনো বিপদ হয় তাহলে
দুর্গাপুর থেকে দৌড়ে আসতে পারবে না। দৌড়ে নাহোক বাস বদলে এল অবশ্য। দুজনে মিলে
কল্যাণেশ্বরী আর মাইথন ঘুরে বিস্তর আড্ডা হল। সে গল্প তো আমাদের ছুটি-তে করেইছি।
তাতে অবশ্য নামসহই।
ওই যাহ্,
নামটা জেনে গেল তো সবাই। তা জানুক না, ক’জন এমন মানুষ বন্ধু পায় বলতো? অথবা কেই বা
বন্ধুর এত পাগলামী তেইশ বছর ধরে হাসিমুখে সহ্য করে?
আরাম ও কষ্ট একসাথে, পাওয়া ও না-পাওয়া একসাথে, থিতু ও ভ্রাম্য একইসাথে...কি পরম পাওয়া হোলো, থ্যাঙ্ক ইউ
ReplyDeleteতোমাকেও ধৈর্য্য ধরে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
ReplyDelete