Sunday, August 2, 2015

তোমার নাম জানিনে, সুর জানি


গ্র্যাজুয়েশন শেষে হস্টেলের পাট চুকিয়ে একবছর বাড়িতেই ছিলাম। নানা কারণে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করে ওঠা হয়নি সেইসময়ে। বাড়ি থেকে একঘন্টার দূরত্বে সফটওয়ারের একটা ডিপ্লোমা কোর্স করতে যেতাম। রোজ একই সময়ে বাড়ি থেকে বেরোতাম। একই বাসে উঠতাম। কিছুদিন পর লক্ষ্য করলাম এক তরুণ রোজ আমার জন্য জানলার ধারে তার পাশে সিট রেখে দেয়। সে আমার আগে ওঠে আর পরে নামে। ধীরে ধীরে আলাপ হল। রোজ নানা বিষয়ে গল্প করতে করতে একঘন্টার রাস্তা কোথা দিয়ে দিব্যি কেটে যায়। আন্দাজ করেছিলাম ভদ্রলোক বোধহয় চাকরি করেন। একদিন নাম ধাম জিজ্ঞাসা করতে বললেন, তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। বললাম, বলুন। উনি বললেন, আমরা কেউ কারো নাম, পরিচয়, কোথায় থাকে এসব কিচ্ছু জিজ্ঞাসা করব না। আমি এমনিতেই বেশ রোমান্টিক। বেশ লাগলো প্রস্তাবটা। আর কোনোদিন জানতে চাইনি। উনিও কোনোদিন আমাকে কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করেননি।

কিন্তু রোজই এই পথযাত্রাটুকুর জন্য সকাল থেকে মনটা উৎসুক হয়ে থাকত। যেদিন নিজে কোনো কারণে যেতে পারতাম না বা উনি আসতেন না, সেদিন একটু মনখারাপই লাগত। এছাড়া কিন্তু অন্য কোনোসময় ওনার সঙ্গে দেখা হত না। কেবল একদিন বাদে। সেদিন উনি আমাকে বেশ একটা বিপদ থেকেই বাঁচিয়েছিলেন। মাঝদুপুরে যখন কম্পিউটার সেন্টার থেকে বেরোতাম, জায়গাটা বেশ নির্জনই থাকত। একদিন লক্ষ্য করলাম একজন আমার পিছু নিয়েছে। লোকটির চোখমুখ যেরকম, আমার ওই বয়সে যথেষ্ট আতঙ্কিত হওয়ার মতোই। হয়েওছিলাম। একা প্রায় দৌড়াচ্ছি। বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছেও দেখি কেউ নেই। কী করব ভাবছি। আমার পিছনে যে লোকটা আসছিল সে কিছুটা বয়স্ক তাই গতিতে আমি এগিয়েছি। হঠাৎ দেখি রাস্তার ওপা্রে প্রায় বিপদতারণ মধুসূদনের মতো আমার সেই বন্ধুটি হাজির। চট করে রাস্তা পার হয়ে গল্প জুড়ে দিলাম। আড্ডায় আড্ডায় বাস এসে গেল। তিনিও আমাকে রাস্তা পেরিয়ে বাসে তুলে দিলেন। না, ওনাকে আমি বলিনি যে বিপদে পড়েছিলাম।

পরের বছর বিয়ে করে কলকাতায় চলে আসি। আর কখনোই সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। মুখটাও এখন একেবারে ভুলে গেছি। অর্থাৎ দেখা হলেও চিনতে পারব না আর কোনোদিনও। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে পড়ে তাঁর কথা নানা সময়ে, যখন দেখি মানুষ মানুষের কত সহজে শত্রু  হয়, কত সহজে ভুল বোঝে। ভাবে লাভ-ক্ষতির বিনিময় না থাকলে বুঝি বন্ধুত্ব হয় না।

আসলে কোনো মানুষই হারায় না এ জীবনে, রাখতে চাইলে রয়ে যায় কোথাও না কোথাও।


আচ্ছা, আমাকেও কি মনে আছে তাঁর? মাঝে মাঝে একথাও মনে হয় বৈকি।

6 comments:

  1. সম্প্রতি তোমার লেখাগুলোর মধ্যে, এই লেখাটা সবথেকে ভালো হয়েছে বলে আমার মনে হয়।

    ReplyDelete
  2. আমারও লিখে খুব ভালোলেগেছে।

    ReplyDelete
  3. খুশি হলাম অনুষ্টুপ। ভালো থেকো খুব।

    ReplyDelete
  4. বিশেষ দরকারের সময় হয়তো আবার তার দেখা পাবেন। বন্ধুরা এরকমই, এমনিতে খোঁজ না পেলেও প্রয়োজনে ঠিক পাশে পাবেন।

    ReplyDelete
  5. পাব নিশ্চয়। পাইও তো। দুঃখের দিনে কোনো না কোনো নামে সে
    পাশে থাকে। তার আসলে একটাই নাম - বন্ধু। অন্য নামের প্রয়োজন নেই তাই।

    ReplyDelete