ফেলুদার সঙ্গে কৈলাসে
‘স্তব্ধভাষ রুদ্ধশ্বাস বিমুগ্ধ বিমূঢ় বিস্ময়’ –
কৈলাস মন্দিরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে লালমোহনবাবুর এই কথাটাই মনে পড়ে গেল। বাইরের
বিশাল চত্ত্বর থেকে প্রথমেই চোখে পড়ে সবুজ পাহাড়ের ব্যাকগ্রাউন্ডে জমকালো মন্দির।
হাঁটতে হাঁটতে কাছে পৌঁছাই - চুড়ায় সিংহের থেকে চোখ নামালে মন্দিরের বাইরের
দেওয়ালে নৃত্যরত নটরাজ, গরুড়ের পিঠে বিষ্ণু, নরসিংহ, লিঙ্গোদ্ভব শিব, দিকপাল,
ত্রিবিক্রম, ভূবরাহের বিশালকায় সব মূর্তি। কিন্তু কৈলাস যে কী বিরাট ব্যাপার সেটা
ভিতরে না ঢুকলে ঠিকমত ঠাওর হয় না।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ একক মনোলিথিক এই মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল
সপ্তম শতাব্দীতে রাষ্ট্রকুট (জটায়ুর ভাষায় ‘রাষ্ট্রপুট’) রাজা প্রথম কৃষ্ণের
আমলে। হিন্দু মন্দিরের চিরাচরিত বিন্যাসরীতি - গোপুরম, নাটমন্দির বা মণ্ডপ,
জগমোহন, গর্ভগৃহ এবং শিখর – মেনেই কৈলাস মন্দির
নির্মাণ করা হয়েছিল। “ জায়গাটা তিনশো ফুট
লম্বা, দেড়শো ফুট চওড়া... মন্দিরের হাইট একশো ফুট...দু লক্ষ টন পাথর কেটে সরানো
হয়েছিল... প্রথমে তিনদিকে পাথর কেটে খাদ তৈরি করে তারপর চুড়ো থেকে শুরু করে কাটতে
কাটতে নীচ পর্যন্ত নেমে এসেছিল... দেব দেবী মানুষ জানোয়ার রামায়ণ মহাভারত কিছুই
বাদ নেই এখানে।” – ফেলুদার সঙ্গে দেখতে দেখতে এগোই। মাথায় ঘুরপাক খায়
আওরাঙ্গাবাদ গুহায় জটায়ুর মন্তব্য, “তখনকার
আর্টিস্টদের শুধু আর্টিস্ট হলেই চলত না, বুঝলে হে তপেশ, সেই সঙ্গে গায়ের জোরও
থাকতে হত। হাতুড়ি আর ছেনি দিয়ে পাহাড়ের গায়ে পাথর ভেঙে তৈরি করতে হয়েছে এ সব
মূর্তি - চাট্টিখানি কথা নয়।”
সত্যি, আমারও তো মনে হয় কবি বা শিল্পী নিজের কাজকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হলে
কব্জির জোর দরকার, আর তা যেকোনও অর্থেই।
মন্দিরে ঢুকেই সবচেয়ে আগে চোখে পড়ে গজলক্ষীর বিশাল
মূর্তিটি। লক্ষীর মাথার ওপর দুপাশে দুই হাতি। পরে এই মূর্তিটি অন্য গুহাতেও একাধিকবার
দেখেছি। দুপাশ দিয়েই সিঁড়ি নেমে গেছে দুদিকের উঠোনে। মন্দিরের একপাশ দিয়ে হাঁটতে
শুরু করলে পিছন দিক দিয়ে ঘুরে আবার অন্য পাশ দিয়ে সামনে চলে আসা যায়। দুপাশের
উঠোনেই দুটি বিশালকায় মনোলিথিক হাতি। হাতিদুটোর পাশে কারুকার্যময় ১৪ মিটার উঁচু
দুটি ধ্বজাস্তম্ভ।
তপসের মতো একেকবার ভাববার চেষ্টা করি হাজার দেড়েক বছর আগের
ভারতীয় ভাস্কর্যের এই চূড়ান্ত পরিণত ভাবনাকে, আবার হাল ছেড়ে দিই, “কল্পনা করতে চেষ্টা করলাম, তেরোশো বছর আগে হাতুড়ি আর
ছেনি দিয়ে দাক্ষিণাত্যের একদল কারিগর পাহাড়ের গা কেটে এই মন্দিরটা বার করেছে।
কিন্তু পারলাম না। এ মন্দির যেন চিরকালই ছিল। কিম্বা কোনও আদ্যিকালের যাদুকর কোনও
আশ্চর্য মন্ত্রবলে এক সেকেন্ডে এটা তৈরি করেছে।” - আমারও যে
তখন তপসের মতোই ‘চোখ-ট্যারানো
মন-ধাঁধানো’ হাল।
বাঁদিক দিয়ে হাঁটা শুরু করি। সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাঁদিকের
দেওয়ালে উল্লেখযোগ্য মূর্তির মধ্যে রয়েছে মহিষাসুরমর্দিনী, গরুড়ের পিঠে বিষ্ণু। একটি
অসম্পূর্ণ গুহায় সপ্তমাতৃকা। এরপর একটা ছোট্ট মন্দিরে গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী – তিন নদীর দেবী। এর পাশ দিয়েই উঠে গেছে লঙ্কেশ্বর
গুহায় যাওয়ার সিঁড়ি। এই গুহাতেও ষোলটি পিলার এবং শিবের নানান বড় আকারের মূর্তি
রয়েছে। ছোট আকারের কয়েকটি মিথুন মূর্তিও মন্দিরের দেওয়ালের নীচের দিকে চোখে পড়ে।
উঠোনের দুদিক থেকে দুটো সিঁড়ি উঠে গেছে ৮মিটার উঁচু
নাটমন্দির বা মণ্ডপে। এরই নীচের অংশে সারি দিয়ে হাতি,
সিংহ এবং পৌরাণিক নানা জন্তু-জানোয়ারের মূর্তি। এরাই যেন পিঠে করে বইছে মন্দিরটি।
এখানে বলে রাখি, আমি দুপাশে দুটো ট্যাঁশগরুর মূর্তি দেখেছি – অবিকল এক, শুধু সুকুমার রায় একজোড়া ডানা বসিয়েছিলেন।
মূল মন্দিরের গায়ে বাঁদিকের দেওয়াল জুড়ে মহাভারত আর ভাগবতের আখ্যান। কুরুক্ষেত্র
যুদ্ধের দৃশ্য চোখে পড়ে। ডানদিকের ঊঠোনে নামলে এরই বিপরীতে অন্যপাশের দেওয়ালে
রয়েছে রামায়ণের আখ্যান। রামায়ণের প্যানেলের ঠিক পাশেই সেই বিখ্যাত দৃশ্য – সীতাহরণ ব্যর্থ
করার প্রয়াসে জটায়ুর রাবণকে আক্রমণ। আরেকটু এগোলে মন্দিরের
দেওয়ালের এক গহ্বরে রয়েছে রাবণের কৈলাস নাড়ানোর সেই বিখ্যাত মূর্তিটি। আরো এগোলে
মন্দিরের ওপর দিকে নজরে আসে বালি-সুগ্রীবের লড়াইয়ের আর বালির স্ত্রী রুমার ক্রন্দন
দৃশ্য। গর্ভগৃহের দেওয়ালের ওপর দিকে নানা ভঙ্গিমায় নৃত্যরত অপ্সরাদের দেখা যায়
যেকোন দিক থেকেই।
নাটমন্দিরের দ্বারের দুপাশে দুই দ্বারপাল দণ্ডায়মান। ষোলটি
কলসমাথা বিশালাকার পিলার রয়েছে নাটমন্দিরের অভ্যন্তরে। ইলোরার যে দু-তিনটি মাত্র
গুহায় সামান্য গুহাচিত্র দেখা যায়, কৈলাস তার একটি। নাটমন্দিরের সিলিং-এ
রাষ্ট্রকূট এবং পরবর্তী হোলকারদের সময়কার কিছু চিত্র দেখা যায়। খোদিত নটরাজও। নাটমন্দিরের আগে রয়েছে নন্দী মণ্ডপ –পাথরের সেতু দিয়ে যুক্ত। আর নাটমন্দির পেরিয়ে জগমোহন এবং গর্ভগৃহ। গর্ভগৃহের দ্বারের দুপাশে
গঙ্গা-যমুনা। অন্তরালে বিশালকায় শিবলিঙ্গ।
লঙ্কেশ্বরের গুহার নীচে উঠোন থেকে কয়েকটা সিঁড়ি উঠলে টানা
বারান্দায় একের পর এক বিশালাকার মূর্তি। বারান্দা ধরে দেখতে দেখতে হাঁটলে একেবারে
অন্য দিকের উঠোনের ওপরে পৌঁছে যাওয়া যাবে। এই বারান্দায় মূর্তিগুলির মধ্যে রাব্ণ নিজের ন’টি মাথা শিবকে উৎসর্গ করে শিবপূজা করছে, শিব-পার্বতী পাশা খেলছে, শিব-পার্বতীর
বিবাহ, বীণা হাতে শিব, কল্যানসুন্দর মূর্তি, লিঙ্গোদ্ভব শিব, ত্রিপুরান্তক শিব, ব্রহ্মা, নরসিংহ অবতার, কালীয় কৃষ্ণ প্রভৃতি
উল্লেখযোগ্য।
দক্ষিণ দিকে বারান্দার আগে একটি তিনতলা গুহা আছে যাতে
অনেকগুলি বড় মূর্তি আছে। অক্ষত মূর্তিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য গণেশ এবং ভৈরব
মূর্তি।
কৈলাস থেকে বেরিয়ে মন্দিরের পাশ দিয়ে মাথার দিকে উঠি।
সিনেমায় এখানে ক্লাইম্যাক্সের একটা অংশ ছিল – ফেলুদা তাড়া করেছে মূর্তিচোরদের একজনকে। মন্দিরের
ওপর থেকে দেখি সূর্যের লাল আভা ছড়িয়ে যাচ্ছে দেওয়ালের মূর্তিগুলির গায়ে। ফেলুদার
সঙ্গে কৈলাস দেখা এখনও শেষ হয়নি, কাল যাব পনেরো নম্বর ‘দশাবতার’ গুহায়
‘নন্দী’-র
সন্ধানে...।
অজন্তার মুগ্ধতা পেরিয়ে ইলোরায় পৌঁছেছি ২০১৩ সালের এক শরতের
দিনে। আমরা তিনজনেই। মাথায় ঘুরছে অবশ্যই ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারী’। শুভঙ্কর বোসের মতো এক ব্যাগ বই না
থাক, ‘ফেলুদার সপ্তকাণ্ড’-ও ব্যাগবন্দী হয়ে এসেছে বেনারসের পর ইলোরাতেও। আমাদেরও এখানের ঠিকানা হোটেল ‘কৈলাস’। তবে ব্যয়বহুল হওয়ায় ফেলুদাদের মতো
কটেজ রুম নয়, সেসব পেরিয়ে পিছন দিকের পরপর ডাবল বেডরুমগুলোর একটায়। বারান্দায়
দাঁড়ালে পেছনের দিকের গুহাগুলো দূর থেকে চোখে পড়ে আর পেছনের ঝরনাটাও একটু চেষ্টা
করলেই। অবশ্য মূল গল্পে ফেলুদারা খরচ বাঁচাতে ডাক বাংলোয় ছিল। প্রথমদিন পৌঁছে
দুপুরে হোটেল কৈলাসেই খেয়েছিলাম। ডাইনিং রুমে বসে খোঁজা হচ্ছিল কোন টেবিলে
মামা-ভাগ্নে থুড়ি লালমোহনবাবু আর তপসে বসেছিল, কোন টেবিলে ফেলুদা আর কোন টেবিলে
মিঃ রক্ষিত। তবে থাকার মতোই এখানের খাওয়া-খরচাও বেশ ভালো। রাতে তাই বাইরের একটা
হোটেলে খাই। কৈলাস হোটেলের বাইরে সর্বত্র নিরামিশ আহার। আমার কন্যা বুইয়ের ঠিক পোষায় না। অতএব, মিঃ রক্ষিতের পরামর্শমতো আমরাও ‘আফটার ডিনার ওয়াক আ মাইল’-এ বেরিয়ে পড়ি। অবশ্যই গুহার উদ্দেশ্যে নয়, এবং মাইলখানেক যেতেও হয়না, বেশ কিছুটা হাঁটতেই
একটা দোকানে আইসক্রিমের সন্ধান মেলে।
‘দশাবতার’ গুহা নামে খ্যাত
পনেরো নম্বর গুহাটা পাহাড়ের বেশ কিছুটা ওপরে, সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। দোতলা গুহার
একতলায় মনোলিথিক নন্দীমণ্ডপ, মানে সেই একটা পাহাড় কেটেই করা। নন্দীমণ্ডপ পেরিয়ে
অনেকগুলো থামওয়ালা বারান্দার উত্তর-পশ্চিম কোনে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। গল্পে এই
গুহাতেই ছিল ক্লাইম্যাক্স। আবার বুইয়ের হাতে ধরা ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’-র পাতা ওলটাতে ওলটাতে তপসে আর লালমোহনবাবুর সঙ্গে
সিঁড়ি ভেঙে উঠি – “দেড়তলায় উঠে একটা খোলা জায়গা। সেখানে দেয়ালের গায়ে
দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে। আরও খানিকটা উঠে গিয়ে আমরা তিন দিক বন্ধ একটা প্রকাণ্ড হল
ঘরে পৌঁছলাম। সারি সারি কারুকার্য করা থাম হলের ছাতটাকে মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
উত্তর আর দক্ষিণের দেয়ালে আশ্চর্য সব পৌরাণিক দৃশ্য খোদাই করা।” কৈলাস বাদে এই গুহাটার শিল্প-স্থাপত্য বৈচিত্র্যই
সবচেয়ে আকর্ষণীয় লেগেছে আমার। সিনেমাতেও এই হলটিতে জটায়ু আর তোপসে এসেছিল। নন্দীর
মূর্তিটিকে জড়িয়ে ধরে জটায়ুর সেইসব এক্সপ্রেশন মনে পড়ে আমি আর বুইও পাথরের নন্দীর
গায়ে ছেলেমানুষী খুশিতে হাত বোলাই আর ছবি তুলি।
হল ঘরটায় মোট চুয়াল্লিশটি পিলার আছে। পিলারের গায়ে শৈব
মূর্তি এবং বুদ্ধ মূর্তি উভয় দেখে আন্দাজ করা যায় যে এই গুহাটি হিন্দু আমলে তৈরি
হলেও বৌদ্ধ ধর্মের প্রাবল্যের সময়ে শেষ হয়। আসলে ইলোরার মোট চৌত্রিশটি গুহার মধ্যে
প্রথম বারোটি বৌদ্ধ গুহা, মাঝের ১৩-২৯ ব্রাহ্মণ্য গুহা এবং শেষ ৩০-৩৪ জৈন গুহা।
তবে তথ্যের কচকচানিতে পরে আসছি। আপাতত তেরোশ বছর আগের শিল্প-স্থাপত্যে আর
সত্যজিতের লেখায় ডুব দিই।
হলের দুপাশের দেওয়ালগুলিতে ছোট ছোট খোলা কুঠুরিতে নানা
মূর্তি। দু’দিকেই ছ’টা করে এমন কুঠুরি আছে। উত্তরের দিকের কূঠুরিগুলোয় পশ্চিম থেকে
পূবের দিকে হাঁটলে পরপর চোখে পড়ে - অন্ধকারি, নৃত্যরত শিব, শিবলিঙ্গ, শিব-পার্বতীর
পাশা খেলা, শিব-পার্বতীর বিয়ে, কৈলাস নাড়াচ্ছে রাবণ। হিন্দু গুহাগুলিতে
শিব-পার্বতীর নানা ভঙ্গীমায় মূর্তি এবং রাবণের ওই কৈলাস নাড়ানো একাধিকবারই চোখে
পড়ে। দক্ষিণের দেওয়ালে পশ্চিম থেকে পূবে পরপর মূর্তিগুলি হল, হিরণ্যকশিপুর সঙ্গে
নরসিংহের লড়াই, ত্রিবিক্রমরূপী বিষ্ণু, ভূবরাহ, শিবলিঙ্গ, করিবরদারূপী বিষ্ণু,
বিষ্ণুর অনন্তশয়ান, ছয়হাত নিয়ে গিরিধারী-গোপাল।
হলের একপাশে বড়সড় নন্দীমূর্তিটি – শেষপর্যন্ত যেটা আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু থাকে। নাহ্, শিল্পকর্মের জন্য নয়, স্রেফ ফেলুদার গল্পের
জন্য।
ইলোরার বৌদ্ধ গুহাগুলি তৈরি হয় পঞ্চম থেকে সপ্তম শতাব্দীতে
মহিষমোতির কালুচরী ও বাদামীর চালুক্যদের সময়ে। ৭৫০-৯৭৫ খ্রিঃ রাষ্ট্রকূট রাজবংশের
সময় হয় হিন্দু গুহাগুলি। এগারো-বারো শতাব্দী নাগাদ জৈন মন্দিরগুলো গড়েন
কল্যাণীর চালুক্য ও দেবগিরির (বর্তমান দৌলতাবাদ) যাদবরা। ইলোরা অজন্তার মতো কখনোই
হারিয়ে যায়নি। হিউয়েন সাং ছাড়া আর কারোর লেখায় যেখানে অজন্তার উল্লেখ নেই,সেখানে ইলোরা নিয়ে লিখেছেন আরব ভূগোলবিদ আল মাসুদি,ঐতিহাসিক
ফিরিস্তা,নিকোলাই মানুচ্চি,চার্লস
মালে এমন নামী এবং অনামী পর্যটকেরা বারবার।
অবশ্য সেই তুলনায় বাঙালি পর্যটকের কলমে ইলোরার কাহিনি প্রায় নেই।
হিন্দু গুহাগুলির মধ্যে ১৬ আর ১৫ ছাড়া উল্ল্যেখযোগ্য ১৪, ২১
আর ২৯। গল্পে না থাকলেও সিনেমার শেষদিকে ২৯ নম্বর গুহায় একটি দৃশ্যায়ণ আছে। সে
গল্পে তাই শেষে আসছি।
চোদ্দ নম্বর গুহাটি ‘রাবণ-কা-খাই’ নামে পরিচিত। গুহার
মধ্যে খোলা চত্ত্বর, মণ্ডপ, ষোলোটি পিলার এবং একটি মন্দির রয়েছে। উত্তর দেওয়াল
জুড়ে পশ্চিম থেকে পূবে দুর্গা, গজলক্ষ্মী, ভূবরাহ, বৈকুন্ঠনাথ-এর মূর্তি। দক্ষিণ
দেওয়ালে পশ্চিম থেকে পূবে মহিষাসুরমর্দিনী, শিব-পার্বতীর পাশা খেলা, নৃত্যরত শিব,
রাবণের কৈলাস নাড়ানোর দৃশ্য এবং অন্ধকারি মূর্তি। মন্দিরটির দরজার দুপাশে দুই
দ্বারপাল। ভেতরে মূর্তিটির ভগ্নদশা। মন্দিরের উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালের শেষে গঙ্গা
ও যমুনার মূর্তি। হাতির পিঠে ইন্দ্র, গণেশ, সপ্তমাতৃকা – আরও নানা দেবদেবীর মূর্তিও রয়েছে এই গুহায়।
‘রামেশ্বর’ নামে পরিচিত একুশ
নম্বর গুহাটি। স্থাপত্যের জন্য এই গুহাটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। উত্তর দেওয়ালে বসা
অবস্থায় গণেশ মূর্তি এবং মন্দিরের সামনে উঁচু পাটাতনে নন্দী মূর্তিটি চোখে পড়ে।
মকরের ওপর গঙ্গার বৃহদাকার মূর্তিটিও নজর কাড়ল। ভাবছিলাম, জটায়ু থাকলে নির্ঘাত
একটা প্রণাম ঠুকে বলত - বুঝলেন মশায়, এই হল গঙ্গা, দেখলেই ইয়ে কেমন ভক্তি ভক্তি
লাগে। সামনের দিকে বেশ কয়েকটি পিলার রয়েছে। মাঝের দুটি পিলারে ছয়-সাত দশকের
মধ্যেকার চালুক্যদের লিপি রয়েছে। দক্ষিণ দেওয়ালের উল্লেখযোগ্য মূর্তিগুলির মধ্যে
রয়েছে বীণাধারী শিব, সপ্তমাতৃকা, গণেশ প্রমূখ। পূব দেওয়ালে নটরাজ মূর্তি। ওরই
বাইরের অংশে শিব-পার্বতীর পাশা খেলা। উত্তর দিকের দেওয়ালে শিব পার্বতীর বিয়ে,
কার্ত্তিকেয়। পূব দেওয়ালে মহিষাসুরমর্দিনী। গুহার বাইরের দিকের দেওয়ালে রাবণের
কৈলাস নাড়ানোর সেই চেনা মূর্তিটি।
ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে ঊনত্রিশ নম্বর গুহায় এসে বসে পড়ি।
এখানেই সিনেমায় ফেলুদা মূর্তিচোরদের ধরার শেষ পরিকল্পনা করছিল। জটায়ু, তোপসে আর বোম্বের
প্রাইভেট ডিটেকটিভ জয়ন্ত মল্লিক –
সকলেই হাজির ছিল।
কৈলাস থেকে জৈন গুহাগুলির দিকে যেতে এই গুহাটি পড়বে।
পাহাড়ের গা ঘেঁষে ঝরনার জলের ছিটে গায়ে মেখেও যাওয়া যায়। গুহায় মোট ছাব্বিশটি
পিলার আছে। পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণে গুহার প্রবেশপথ রয়েছে। তবে দক্ষিণের
প্রবেশপথটিই প্রধান। এই প্রবেশপথের দুপাশে সিংহ এবং হাতির মূর্তি আছে। দক্ষিণ
প্রবেশপথের কাছে কয়েকধাপ সিঁড়ি নেমে ঝরনার
জলে সৃষ্ট ধারাটির কাছে পৌঁছানো যায়। দক্ষিণের দরজা দিয়ে ঢুকে পূব দেওয়ালে
শিব-পার্বতীর বিয়ের ভাস্কর্যটি। এর দক্ষিণে বিশালাকার সরস্বতী মূর্তি। পশ্চিমের
দেওয়ালের ওপরের অংশে শিব-পার্বতীর পাশা খেলার দৃশ্য। নীচে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও নন্দী। পশ্চিম প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকে দক্ষিণের দেওয়ালে
রাবণের কৈলাস নাড়ানোর মূর্তি। উত্তরের প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকে পশ্চিমের দেওয়ালে
নটরাজের মূর্তি। গুহার পেছনের দিকে অবস্থিত মন্দিরটির চারপাশই খোলা। সবদিকেই দ্বারপালের
মূর্তি রয়েছে। মন্দিরের ভেতরে শিবলিঙ্গ।
লক্ষ্য করলাম কী গল্পে কী সিনেমায় ফেলুদা শুধুমাত্র হিন্দু
গুহাগুলোতেই গেছে। এটা হয়ত কাকতালীয়। তাই সেই তাল ধরে ১৩-২৯ এই ঘোরাফেরা করলাম।
পনেরো আর ঊনত্রিশ নম্বর গুহা নজর কাড়লেও শেষপর্যন্ত কৈলাসের জবাব নেই। তাই যে দুদিন
ছিলাম রোজই একবার করে কৈলাসে গেছি আর মুগ্ধ হয়েছি।
তবে আমার ধারণা ফেলুদা না গেলে কী হবে, গোয়েন্দাগিরির ফাঁকে
তপসে আর লালমোহনবাবু অন্য গুহাগুলো ঘুরেই নিয়েছে, সে খবর সত্যজিতও রাখেননি। আমরাও
বাদ দিইনা কোনটাই।
কৈলাসের ডানহাতে এগিয়ে গেলে শেষের দিকে বৌদ্ধগুহাগুলি।
এগুলোই সময় বিচারে সবথেকে পুরোনো। আর বামেও একেবারে শেষের দিকে জৈন গুহা্র সারি।
ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাবে সরতে সরতে বুদ্ধধর্মাবলম্বীরা
ইলোরা এবং ঔরঙ্গাবাদে এসে থিতু হয় এবং প্রথম ইলোরার গুহাগুলি তৈরি করেন। যদিও
ইলোরার সবকটি বৌদ্ধগুহার থেকেও ঔরঙ্গাবাদের সাত নম্বর গুহাটি অনেক আকর্ষণীয়
স্থাপত্যের দিক থেকে। ইলোরার বৌদ্ধ গুহাগুলিতে নানা ভঙ্গিমায় বুদ্ধমূর্তিই একমাত্র
দর্শনীয় বিষয়। বুদ্ধ পদ্মাসনে, প্রলম্বপদ আসলে অথবা পদ্মের ওপর দন্ডায়মান।
ধর্মচক্রপ্রবর্তন, ভূমিস্পর্শ এবং ধ্যান – এই তিনটি মুদ্রাই কম বেশি রয়েছে।
প্রথম আর পঞ্চম গুহা সবচেয়ে পুরোনো। এরমধ্যে প্রথম গুহা ধসে
গেছে। অতএব দুনম্বর গুহা থেকেই দেখা শুরু করলাম। দুনম্বর গুহার প্রবেশদ্বারের দুপাশে দুটি বিশালাকার বোধিসত্ত্ব মূর্তি।
ডানদিকে বোধিসত্ত্ব মৈত্রেয়। বোধিসত্ত্বের পাশে, একটু নীচে বুকের ওপর আড়াআড়ি হাত
রাখা আয়ূধপুরুষ মূর্তি। বোধিসত্ত্বের মাথার ওপরে বামন এবং ডাইনের প্যানেলে পরবর্তী
সময়ের বুদ্ধমূর্তি বসা ভঙ্গীমায়। আরও ডানদিকে উইন্ডো প্যানেলে উপর থেকে নীচে
ভদ্রাসনে বসা বুদ্ধমূর্তি দুপাশে বোধিসত্ত্ব। বামদিকে দ্বারপালরূপী বোধিসত্ত্বের
মাথার ওপরেও বামনমূর্তি এবং বাঁপাশের প্যানেলে সেই একইরকম বসা ভঙ্গিমায়
বুদ্ধমূর্তি। গুহায় ঢুকে উত্তর দিকের সামনের দেওয়ালে তারামূর্তি সঙ্গীনীদের নিয়ে।
এই মূর্তির বামে এবং গুহায় ঢুকে ডানদিকে শ্রাবস্তীর অলৌকিক ঘটনার দৃশ্যাবলী। মূল
হলটিতে বারোটি কলসমাথা পিলার রয়েছে। হলের দুপাশের প্রকোষ্ঠগুলিতে বসা ভঙ্গীমায়
বুদ্ধমূর্তি রয়েছে। গর্ভগৃহের দ্বারের দুপাশে দুই বোধিসত্ত্ব আর মাথার ওপর উড়ন্ত
যুগল (flying
couple)। বাঁদিকেরজন অবলোকিতেশ্বর। মাথার
বিশেষধরণের মুকুট এবং হাতে লম্বা ডাঁটির পদ্ম এঁর বৈশিষ্ট্য। গর্ভগৃহের অভ্যন্তরে সিংহ সিংহাসনে বসে আছেন প্রলম্বপদ বুদ্ধমূর্তি
ধর্মচক্রমুদ্রায়।
তপেশ জানতে চায়, শ্রাবস্তীর অলৌকিক ঘটনা – গল্পটা কী? নারায়ণবাবু কেন যে ইলোরা নিয়ে লিখলেন না,
বিড়বিড় করতে করতে পকেট থেকে অ্যান্ড্রয়েড ফোনটা বার করে ইন্টারনেটে খুঁজতে থাকেন
লালমোহনবাবু। এই ফাঁকে বলে রাখি, ইদানীং ফেলুদার থেকে নেটের ওপরেই তাঁর ভরসা বেশি।
যদিও ‘রাষ্ট্রকূট’-কে ‘রাষ্ট্রপুট’ আর না বললেও ফেলুদা সাবধান করেছে, নেটের সব কিন্তু
সত্যি হয় না। বুঝলে তপেশ, এটা ‘টুইন
মিরাকেল’ নামে বিখ্যাত, ফোনের
থেকে চোখ না সরিয়েই বলতে থাকেন লালমোহনবাবু। বুদ্ধ বলেছিলেন, একটা আমগাছের নীচে
অলৌকিক কিছু ঘটনা ঘটাবেন। তাঁর শত্রুরা এটা শুনেই শ্রাবস্তীর সব আমগাছ কেটে
ফেলেছিল। যাইহোক, সময় হলে রাজার বাগানে গিয়ে একটি আম খেয়ে বুদ্ধ বীজটি মাটিতে
পুঁতে দিলে সঙ্গে সঙ্গেই সেটি একটি বৃক্ষ হয়ে যায়। গাছটির একপাশ থেকে তিনি একটি
মণিমুক্তখচিত পথের সৃষ্টি করে নিজের দেহের উর্ধ্বাংশ থেকে আগুন এবং নীম্নাংশ থেকে
জল নির্গত করেন। একইভাবে শরীরের বাম ও ডানদিক থেকেও আগুন আর জল বেরোয়। ষোলদিন ধরে
তিনি এই অলৌকিক ঘটনা দর্শকদের দেখিয়েছিলেন। তবে বুঝলে হে তপেশ, এসব মানুষের মুখে
মুখে ছড়ানো গল্পই, তবে পড়তে বা শুনতে বেশ লাগে – মুঠোফোন পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে মন্তব্য জোড়েন।
পাঁচ নম্বর গুহায় ঢুকে জটায়ু খানিক আশ্চর্য হয়ে বলেন, তপেশ,
গ্যাংটকে গেসলাম যখন, মনাস্ট্রিগুলো ঠিক এরকম ছেল, মনে আছে? সত্যি, লম্বায় প্রায়
৩৫-৩৬ ফুট দীর্ঘ এই গুহাটির পিলারগুলি, এগিয়ে যাওয়া পথের দুপাশের সমান্তরাল দুটি
উঁচু বিম, পিলারের ফাঁকে ফাঁকে পেছনের কুঠুরিগুলো দেখলে তাই মনে হয়। মোট ২৪ টা
পিলার আর ২০ টি কুঠুরি আছে। এত তথ্যের হয়ত দরকার ছিল না, কিন্তু সত্যিকারের
ফেলুদার আবার প্রশ্ন করার অভ্যেস আছে কিনা, তাই তপসেদের সুবিধার জন্য জানিয়ে রাখি।
মূল মন্দিরে ঢোকার মুখে যথারীতি দুপাশে দুই দ্বারপাল। ভেতরে মূল বুদ্ধমূর্তির
ডানহাতে অবলোকিতেশ্বর আর বাঁদিকে মৈত্রেয় বুদ্ধমূর্তি।
আট নম্বর গুহায় ঢুকে বাঁ-হাতে আরেকটি ছোট গুহা (৮ এ) আছে।
এই গুহায় ভদ্রাসনে বসা বুদ্ধমূর্তির দুপাশে দুই বোধিসত্ত্ব আর মাথার ওপর উড়ন্ত
মূর্তি (flying
figure)। গুহায় ঢুকতে বাঁ দিকের দেওয়ালে অবলোকিতেশ্বর ও তারা
মূর্তিদুটি চমৎকার। মূল গুহার প্রদক্ষিণপথটি প্রশস্ত। ডানহাতের দেওয়ালে মহাময়ূরী
মূর্তি। এখানেও মূল মন্দিরে ভদ্রাসনে বসা বুদ্ধমূর্তির দুপাশে দুই বোধিসত্ত্ব।
ননম্বর গুহার ভেতরের বুদ্ধ বা বোধিসত্ত্ব মূর্তি একইধরণের হলেও এই গুহার বাইরের
দৃশ্যে চোখ আটকায়। বারান্দার বাইরের দিকের ওপরে অনেকগুলি বসা ভঙ্গীমায় বুদ্ধমূর্তি
এবং সঙ্গী বোধিসত্ত্বের মূর্তি আছে। খেয়াল করে দেখলে তারা, যক্ষ আর বামন মূর্তিও
চোখে পড়ে। বৌদ্ধগুহাগুলির মধ্যে একমাত্র এই গুহাতেই ছাদের দিকে তাকালে হালকা চিত্রের
আভাস মেলে।
দশ নম্বর গুহা সবচেয়ে বড় টানা চৈত্যহল। এই গুহার নাম
বিশ্বকর্মা। স্থানীয়রা এখনও এখানে পুজো দিতে আসেন। বারান্দার ওপরে গন্ধর্ব,
অপ্সরার উড্ডীয়মান মূর্তি এবং বিভিন্ন পশু মোটিফ বেশ নজর কাড়ে। বারান্দায়
পদ্মপানির মূর্তিটিও উল্লেখযোগ্য। গুহায় বজ্রপানি ও তারার মূর্তিও রয়েছে। তিরিশটা
থাম দিয়ে হলের আকার করা হয়েছে। থামের গায়ে লতাপাতা, মানানসই খাঁজকাটা ছাদ। স্তুপের
সামনের অংশ কেটে বিশালকায় বুদ্ধমূর্তিটি তৈরি হয়েছে। বুদ্ধ সিংহ সিংহাসনে ভদ্রাসনে
বসে। বাঁয়ে অবলোকিতেশ্বর এবং ডানদিকে মঞ্জুশ্রী।
এগার নম্বর গুহাটি একসময় তিনতলা ছিল। এখন নীচের তলাটি
ভগ্নস্তুপ হয়ে যাওয়ায় দো-তাল নামে পরিচিত। দোতলার টানা বারান্দায় তিনটি মণ্ডপ।
তিনটি মণ্ডপেই ভূমিস্পর্শমুদ্রায় বুদ্ধ। দোতলায় কুবেরের মূর্তিটি বৌদ্ধ সময় পেরিয়ে
হিন্দু ধর্মের আভাস বোঝায় হয়ত। তিনতলায় পিলারওয়ালা বারান্দা পেরিয়ে হলে ঢুকলে
বিশালাকার প্রলম্বপদ বুদ্ধমূর্তি। উত্তর এবং দক্ষিণের দেওয়ালে যথাক্রমে তারা ও
অবলোকিতেশ্বর। বারো নম্বর গুহা তিনতলা বৌদ্ধবিহার। নীচের তলায় বুদ্ধ ও অন্যান্য
দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে। দোতলার বিশাল হলের পেছনে পেছনে তেরটা কুঠুরি। পূর্বদিকের
মন্দিরে ভূমিস্পর্শমুদ্রায় বিশালাকার বুদ্ধ। তিনতলায় মূল বুদ্ধের দুপাশে পদ্মপানি
ও বজ্রপানি। হলের পেছনের দেওয়ালে উত্তর দিকে সাত মানুষ বুদ্ধ এবং দক্ষিণে সাত দেব
বুদ্ধ।
আবার কৈলাসে ফিরি। এবং হোটেল কৈলাসেও। পরের দিনের গন্তব্য
শেষপ্রান্তের জৈন গুহাগুলো। দিনের বেলায় কৈলাস দেখে দুপুরে ওই চত্ত্বরেই খাওয়া
সেরে জৈন গুহাগুলোর দিকে এগোই।
কৈলাস তো দেখলেন লালমোহনবাবু, এবারে ছোটা কৈলাস দেখুন – এমন কিছুই নিশ্চয় বলত ফেলুদা জৈনগুহাগুলির বাকিগুলোর
থেকে বেশ কিছুটা আলাদা তিরিশ নম্বর জৈন গুহাটার সামনে দাঁড়িয়ে। আর জটায়ু নির্ঘাত
ঘাবড়ে গিয়ে উল্টোদিকে হাঁটা দিয়ে বলতেন, আর লাসফাসের দরকার নেই মশাই, ওই একটাই
যথেষ্ট। তপসে নিশ্চয় হাত ধরে টেনে এনে আশ্বস্ত করতেন, জৈন গুহা, এখানে ওসব ভয় নেই।
ব্যস, নিশ্চিন্ত, এই বলে ঢুকে পাশেই বারো হাতের দেবী মূর্তি দেখে আবার দাঁড়িয়ে
যেতেন। কী ব্যাপার বলত হে তপেশ, দুর্গার দশ হাত আছে জানি, এনার দেখছি একেবারে এক
ডজন! নীচে আবার সিংহের বদলে গড়ুরও রয়েছে। ওদিক থেকে ফেলুদা বলে উঠত, হাতগুলো
লক্ষ্য করে দেখুন, বারোটার মধ্যে আটটা হাতেই চক্র রয়েছে, তাই এই দেবীর নাম
চক্রেশ্বরী। ইনি সত্যের দেবী। এর উল্টোদিকেই দেখুন মহাবীরের তিনটে মূর্তি আছে
ধ্যানাসনে। এর আগে বুদ্ধকে সিংহ আসনে দেখেছিলেন, এবারে মহাবীর। লালমোহনবাবুও দুগ্গা
দুগ্গা, থুড়ি চক্রেশ্বরী চক্রেশ্বরী করতে করতে নিশ্চয় সামনের জলে হোঁচট খেতেন। মানে লালমোহনবাবু খেতেন কী না জানিনা, আমি বেমালুম
হোঁচট-টোচট সামলে এগোলাম। কৈলাসের মতো এখানেও দ্বারপাল দরজার দুপাশে। আরও ডান ও
বামে দুটি নৃত্যরত মূর্তি। হয়তো হিন্দু দেবতা শিবের কোনও জৈন সংস্করণ। মণ্ডপের
ভেতরে ঢুকে হাঁটতে হাঁটতে বিভিন্ন অংশে পার্শ্বনাথ এবং অন্যান্য তীর্থঙ্করদের
মূর্তি চোখে পড়ে। একেবারে শেষে তিন সিংহের সিংহাসনে বসা মহাবীরের মূর্তিটি পাশের
আরও তীর্থঙ্কর ও দেবীদের নানা ভঙ্গিমার মূর্তি সমেত জটায়ুর ভাষায় জমজমাট। দেখা শেষ
হলে নির্ঘাত জানতে চেয়েছিলেন, বলত হে কার ঘাড়ে এমন মাথা ছিল যে আর একটা কৈলাস
বানাতে গেসল? ঐতিহাসিকেরাও এর উত্তর জানেন কিনা জানিনা।
বত্রিশ আর তেত্রিশ নম্বর গুহা পরপর। তেত্রিশ দোতলা গুহাটি
জগন্নাথ সভা নামে পরিচিত। বত্রিশ ইন্দ্রসভা স্বাভাবিকতই আরও বড়। লক্ষ্যণীয় জৈন
গুহার হিন্দু নাম। বত্রিশ নম্বর গুহায় হিন্দু দেবদেবী মাতঙ্গ বা কুবের আর
সিদ্ধায়িকা বা হারিতির দেখা মেলে। এরা দুজনেই ঐশ্বর্যের দেবতা। তিন ধর্মের শিল্প
কী আশ্চর্যভাবে মিলেমিশে গেছে তা দেখার সেরা জায়গা বোধহয় ইলোরাই। ইলোরার স্থাপত্যে
কলসমাথা থামের মতোই ছাদে লোটাস মোটিফের ছড়াছড়ি। নীচের তলায় সরু গলি দিয়ে গিয়ে মূল
মন্দিরে মহাবীরের কাছে পৌঁছতে হয়। দোতলায় চওড়া বারান্দা আর বারো থামের প্রশস্ত হল।
মহাবীরের মূল মূর্তি, হলে পার্শ্বনাথ আর অন্যান্য তীর্থঙ্করদের মূর্তির থেকেও চোখ
টানে প্রায় নষ্ট হয়ে আসা প্রাচীন চিত্রগুলি। কৈলাস মন্দিরের জন্যই বাণিজ্যপথে থাকা
সত্ত্বেও অজন্তার মতো হারিয়ে যায়নি ইলোরা। কিন্তু যক্ষীর মাথা না ভাঙলে
যক্ষীমূর্তি রয়ে যায় ঠিকই কিন্তু মানুষের সংস্পর্শে আর দখল করার চোরা আগ্রহে
ইলোরার প্রাচীন চিত্রের আজ আর প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই।
এবার ইন্দ্রসভায়। সন্ধ্যে নেমে আসছে দ্রুত, পা চালিয়ে দেখি।
প্রথমে ভুল করে দোতলায় উঠে গিয়েছিলাম। হঠাৎ লন্ঠন হাতে মির্জা ইসমাইল উঠে আসেন।
আমাদের পথ দেখান। দোতলা থেকে একতলায় নামি। উঠোনে মনোলিথিক মণ্ডপ। বাঁদিকে বিশাল
হাতি, ডানদিকে প্রকাণ্ড থাম –
মানসস্তম্ভ।একতলার মূল মন্দিরে সিংহের আসনে মহাবীর। এখানেও প্রাচীন চিত্রের কিছু
আভাস পাওয়া যায়। এদিক সেদিকে বেশ কয়েকটা গুহায় জৈন তীর্থঙ্করদের নানা মূর্তি। দোতলায়
মূল মন্দিরে মহাবীর ও নানা ভঙ্গীতে অন্যান্য তীর্থঙ্করেরা। শেষবিকেলের রোদ বারান্দার জানলার জাল দিয়ে কুবেরের মুখের আভা বদলে দেয়। ইসমাইল
ডাকেন আমাদের, ইধার আইয়ে। কুবেরের পেছন দিয়ে অন্ধকার গুহার ভেতরে যাই। দুলন্ত
লন্ঠনের ক্ষীণ আলো আমাদের পথ দেখায়। চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরের একটা ঘরে ঢুকি। লন্ঠন
তুলে আমাদের দেখান ইসমাইল, ঘরের এপাশে-ওপাশে, বাইরে দরজার দুপাশে, সিলিঙে বেশ কিছু
প্রাচীন চিত্র যা এখনও খানিকটা অক্ষত। প্রায় অন্ধকারে, লন্ঠনের আলোয় ভালো করে
দেখতে পাইনা, তবু দেখি। লন্ঠন উঠিয়ে-নামিয়ে দেখাতে দেখাতে ইসমাইল হিন্দিতে যা
বলেন, তার অর্থ, সবাইকে এখানে নিয়ে আসি না, আপনারা যেভাবে দেখছিলেন, মনে হল
আপনাদের ভালোলাগবে। আমরাও ভালোলাগা জানাই তাঁকে। ছবি দেখতে থাকি।
যে ছবিটায় আমার চোখ আটকায় তা ঘরের একেবারে শেষপ্রান্তে। সন্ন্যাসী
বেশে এক মহাপুরুষ, তার পাশে তুলনায় অনেকটাই ছোট একটি নারী মূর্তি। পুরুষটির দৃষ্টি
সামনের দিকে তবে হয়তো নির্দিষ্ট কিছু দেখছেন না, হয়ত ভাবছেন। নারীর দৃষ্টি
পুরুষটির দিকে, স্নেহময়, কোলে সন্তান কিনা বোঝা যায় না। আমার অজন্তার সতেরো নম্বর
গুহার সেই দৃশ্য মনে পড়ে যায় - বিশালায়তন বুদ্ধ ভিক্ষাপাত্র হাতে দণ্ডায়মান। পীতাভ
রঙের বুদ্ধ যেন অনেকটাই অপার্থিব। পশ্চাৎপট ঘন অন্ধকার। সামনে পুত্রকে একহাতে ধরে
দাঁড়িয়ে আছে যশোধরা। মাতা-পুত্রের ছবিটি অতি ক্ষুদ্র হলেও তার ভাব-ব্যঞ্জনা খুব
স্পষ্ট। যশোধরার চোখে স্বামীর প্রতি প্রেম-অভিমান আর পুত্রের জন্য আশঙ্কা সবই
অপরূপভাবে ফুটে উঠেছে। বুদ্ধের বিশালত্ব বোঝাতেই মাতা-পুত্রের আকার ক্ষুদ্র হয়েছে।
এখানেও সেই একই কারণে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব বোঝাতে, তার আকার নারীর থেকে বড় করা
হয়েছে। তবে কি এই দুই শিল্প সমসাময়িক? জানিনা। যদিও চেহারা কিন্তু আলাদা। শিল্প
যাই বলুক না কেন যশোদা হোক বা যশোধরা নারীর অবহেলার কাহিনিটি একই রয়ে যায়। যশোধরার
গল্পের মতো যশোদার গল্পে পূর্ব জন্মের কোনও অহঙ্কারের কাহিনি আছে কিনা তাও জানা
নেই আমার। যশোধরার মতো পুত্র নয়, মহাবীরের কন্যার জননী যশোদার কি হল জানতে ইচ্ছে
করে আমার। সেই স্মিতমুখী নারীর ছবিটি মনে আঁকা রয়ে যায়। বন্ধ হওয়ার সময় হয়ে এসেছে,
ইসমাইল বিনীতভাবে জানান। আমরাও ফিরে যাব কাল। তাই আর ইসমাইলের গল্পটি শোনা হয়না
আমার।
মনে পড়ে, সকালে আমাদের হাতে ‘ফেলুদার সপ্তকাণ্ড’ দেখে এক পাহারাদার হিন্দিতে জানতে চাইছিলেন, বাঙালি
বাবুরা নারায়ণ সান্যালের বই নিয়ে অজন্তা দেখেন, এখানকার তেমন কিছু নেই? দিনের শেষে
গুহা থেকে ফেরার পথে মনে মনে ধন্যবাদ জানাই স্বর্গীয় নারায়ণবাবুকে, তাঁর বইয়ের
পাতা থেকে মির্জা ইসমাইলকে পাঠানোর জন্যে।
পরদিন সকালে ফেরার আগে কৈলাস মন্দির আর কৈলাস হোটেলের সামনে
আমরা, ফেলুদা অ্যান্ড কোং ছবি তুলি।
ফিরে আসার আগে বুই থুড়ি তপসে জিজ্ঞাসা করল, সবই তো হল
কিন্তু ‘কই লাস’?
বলি দেখলি না, পুরোনো ছবিগুলো কেমন হারিয়ে যাচ্ছে, প্রপার
রেস্টোরেশনের কোনও চেষ্টাই নেই। এ মৃতদেহ তো দেখা যায় না, এ হারিয়ে যায়, বুঝলি
ভুতো?
অদ্বিতীয়া - অক্টোবর ২০১৬
ক্যানভাসে আঁকা দিরাং
কী মিস্টি এ সকাল - লেপ-কম্বলের মায়া ত্যাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে ইয়াক রিসার্চ সেন্টারের চত্ত্বরের
সামনে দাঁড়িয়ে ঠিক এই কথাটাই মনে হচ্ছিল। চত্ত্বর জুড়ে রঙবেরঙের ফুল গাছ, মাথার
ওপর ঝকঝকে নীল আকাশ আর সামনে ঘন সবুজ পাহাড়। সবে একটু একটু নরম রোদ্দুর উঠছে। বেশ
শীত করছে, তাও ঠাণ্ডা হাওয়ায় বুক ভরে শ্বাস নিই, মনটা জুড়িয়ে যায়। ইয়াক রিসার্চ
সেন্টারটা দিরাং বাজার এলাকা থেকে বেশ কিছুটা ওপরে। আঁকাবাঁকা কাঁচা রাস্তাটা উঠে
গেছে আরও উঁচুতে। একটু চড়াই ভাঙ্গলে পাহাড়িয়া স্কুল। কাঠের রেলিং-এ ঘেরা টিনের
চালের বাড়ির গায়ে লেখা – গভর্নমেন্ট
মিডল স্কুল, ইয়ং ভিলেজ, অরুণাচল প্রদেশ। এই সকালে স্কুলের সামনের একটুকরো সবুজ
সমতলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলে বেড়াচ্ছে ঠিক একঝাঁক প্রজাপতির মতোই। ঘন্টা বাজতেই
সারি দিয়ে দাঁড়ায় নীল-সাদা পোষাকে দুষ্টু-মিস্টি মুখগুলো।
কাজিরাঙ্গা, ভালুকপঙ ঘুরে বমডিলা ছুঁয়ে গতকাল বিকেলে দিরাং
পৌঁছেছি। ডিসেম্বরের শেষের জমাট ঠাণ্ডাকে ভুলিয়ে দিচ্ছে অরুণাচলের পাহাড়ের
শান্ত-সবুজ রূপ। সকালেই বেরিয়ে পড়েছি। সবুজ পাহাড় আর সাংতি নদীকে সঙ্গী করে
পাহাড়ের বাঁক ঘুরে ঘুরে এগিয়ে চলা। পথ চলতে চোখে পড়ে টিনের চালে ছাওয়া পাহাড়িয়া
গ্রামের বাড়ির নিত্যদিনের রোজনামচার একঝলক। কেউ কেউ কৌতুহলী চোখে আমাদের দেখে। পাহাড়ি
ফুলে আলো হয়ে আছে বারান্দা, ছোট্ট বাগান। এখনও ততটা বড় হয়নি বা পুরোপুরি পাকেওনি,
তাও কমলালেবুর ভারে নুয়ে পড়েছে গাছের ডাল। রাস্তার ধারে, কাঠের বাড়ির গায়ে একের পর
এক কমলা-সবুজে ঝলমলে গাছের সারি। শিপ ব্রিডিং ফার্ম পেরিয়ে আরও কিছুটা এগোতে একসময়
হঠাৎ করে পাহাড়গুলো দূরে সরে গিয়ে চোখের সামনে মেলে দিল অনেকটা খোলা সমতল। কোথাওবা
দিগন্তজোড়া ক্ষেত – ফসলকাটা হয়ে
গেছে, কোথাওবা ঘাসজমি। বিস্তীর্ণ উপত্যকার বুকে পাথরে পাথরে ধাক্কা খেয়ে আপনমনেই
নাচতে নাচতে চলেছে সাংতির কিশোরী জলধারা। নদীর ওপরে খাশো ব্রীজ পেরিয়ে এসে থামা। পায়ে
পায়ে নেমে আসি জলের ধারে। নদীর পাশের উঁচু-নীচু জমিতে কয়েকটা পাহাড়ি ঘোড়া ঘাস
খাচ্ছে। দূরে সবুজ পাহাড়ে আলো-ছায়ার খেলা – এ যেন
বিদেশি কোন চলচ্চিত্রের দৃশ্য। নদীর জলে পায়ের পাতা ভিজিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকি চুপ
করে – হৃদয়ের উপলব্ধি দিয়ে যতটা
প্রকৃতির কাছাকাছি আসা যায়। নদীর ধার ধরে, মাঠের আল বেয়ে হাঁটতে থাকি একাএকাই...।
ফেরার পথে শিপ ব্রিডিং ফার্ম। গেট পেরিয়ে বেশ খানিকটা চড়াই
ভেঙ্গে ওপরে পৌঁছে পিছন ফিরে মুগ্ধ হই। কোন এক ইরানি চলচ্চিত্রে ঠিক এমনি একটা
দৃশ্য ছিল – সবুজ ঢালু জমি দিয়ে দৌড়ে আসছে
দুই শিশু, পিছনে সবুজ পাহাড়, মাথার ওপর নীল আকাশ। তাকিয়ে দেখি ঢাল বেয়ে উঠে আসছে
মেষপালকেরা তাদের ভেড়ার দল নিয়ে। যেন একটা বিরাট ক্যানভাসের ছবি। একেকটাসময় মনে হয়
আমি যদি ভালো ছবি আঁকতে পারতাম তাহলে বেশ হত। ছোটবেলায় জল রঙে ছবি আঁকতে খুব
ভালোলাগত। রুশ দেশের যে পত্রিকাটির আমরা নিয়মিত গ্রাহক ছিলাম তাতে ভারি সুন্দর
সুন্দর প্রকৃতির ছবি থাকত। সময় পেলে চেষ্টা করতাম আঁকার খাতায় যতটুকু পারি ফুটিয়ে
তুলতে। আজকে আমার চোখের সামনেই প্রকৃতির অপরূপ ক্যানভাস। শুধু আমি আঁকতে ভুলে
গেছি...।
কালচক্র গোম্ফায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা গড়িয়ে এল।
মনাস্ট্রিটি ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। আশপাশটাতেই ঘুরে বেড়ালাম। স্থানীয় লোকজন
অনেকেই নীরবে মনাস্ট্রি প্রদক্ষিণ করে চলে যাচ্ছেন। আবার ঘুরতে ঘুরতেই পিঠে শিশু
বাঁধা মা গল্প জুড়েছেন পাশের সঙ্গীনিটির সঙ্গে। ব্যাট-বল খেলে অথবা স্রেফ দৌড়াদৌড়ি
আর গল্প করেই প্রাঙ্গণটি জমজমাট করে রেখেছে সদা হাস্যময় বালক-বালিকার দল।
ক্যাপ্টেন সতনাম সিং বেশ হাসিখুশি, ভালোমানুষ। আমাদের দেখে
নিজেই আলাপ করতে এগিয়ে আসেন। দিরাং থেকে তাওয়াং-এর পথে কিছুটা এগোলেই পাহাড়ের গায়ে
নয়ুকমাডং ওয়ার মেমোরিয়াল। ১৯৬২ সালের চিন-ভারত যুদ্ধে নিহত শহিদদের স্মৃতিস্তম্ভ। পরদিন
সকালের প্রথম গন্তব্য। খোলা আকাশের নীচে স্মৃতিস্তম্ভকে ঘিরে সাজানো বাগানে
দাঁড়িয়ে নিহত শহিদদের নামের তালিকায় চোখ রাখি। এমন সুন্দর প্রকৃতির মাঝেও মানুষ
মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ করে! কথায় কথায় ক্যাপ্টেন সাহেব গল্প করেন এক বাঙালি ছেলের।
কলকাতারই ছেলে। একসময় তাঁর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে সেই সাহসী যুবক।
পরে কারগিল-এ যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা যায়। সহযোদ্ধার স্মৃতিচারণ করতে করতে
ক্যাপ্টেনের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। শ্রদ্ধা-ভালোবাসার সেই আলো ছড়িয়ে যায় যেন
আমাদের মধ্যেও।
নদী-পাহাড়-জঙ্গল মাখা পথে এগিয়ে চলি চুগ ভ্যালির দিকে। চুগ
গ্রামকে ঘিরে শান্ত উপত্যকা। কাঠের ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়ে ভ্যালির বুকে পা রাখি।
ভ্যালির কোল ঘেঁষে ডিব্রু নদীর শান্তধারা। উঁচু-নীচু ঘাস পাথরের জমিতে হাঁটি। পাহাড়ের
মাথায় কালো মেঘ জমছে। এলোমেলো হাওয়া মুখের ওপর হঠাৎ হঠাৎ ঠাণ্ডা আঙুল বুলিয়ে দেয় – শিউরে উঠি যেন। পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে উঠে গেছে চাষের জমি।
ফসল কাটা হয়ে গেছে। কয়েকটা ঘোড়া আপনমনে সেই ন্যাড়া জমিতে গজিয়ে ওঠা কচি ঘাস
খাচ্ছে। ব্রিজের ডানদিকে বেশ কিছুটা দূরে ভাঙ্গাচোড়া ইঁটের বাড়ি চোখে পড়ে। কৌতুহলে
এগিয়ে গিয়ে দেখি প্রাচীন এক মনাস্ট্রির ভগ্নস্তুপ। দেওয়ালে আঁকা নানারঙের ছবি,
ইয়াকের শিং-এর লিখন, রঙিন কাপড়ের টুকরো দেখে চেনা যায়। নির্জন প্রান্তরের মাঝে
মেঘছায়া আকাশের নীচে প্রাচীন এই মনাস্ট্রির ভগ্নস্তুপ দেখতে দেখতে বেশ অদ্ভুত একটা
অনুভূতি হচ্ছিল।
হট ওয়াটার স্প্রিং ঘুরে দিরাং আপার মনাস্ট্রিতে পৌঁছালাম।
পথে পড়ল দিরাং ট্যুরিস্ট লজ আর হোটেল। এটা মূল জনবসতি থেকে বেশকিছুটা ওপরে। এখান
থেকে পুরো উপত্যকাটা ঠিক ছবির মতো দেখায়। মনাস্ট্রিতে প্রবেশের আগে আগে একপাশে
বাটার ল্যাম্প টেম্পল। কারুকার্যময় মনাস্ট্রির অভ্যন্তরে মুল বুদ্ধমূর্তির ডানপাশে
গুরু পদ্মসম্ভব এবং বাঁদিকে অমিতায়ুস বুদ্ধমূর্তি। সন্ধ্যার প্রার্থনায় বসেছেন দুই
লামা সন্ন্যাসী। ধূপের মিস্টি গন্ধের মাদকতায়, মন্ত্রধ্বনির ভাবগম্ভীর পরিবেশে
মনটাও কেমন আশ্চর্যরকম শান্ত হয়ে আসে। মন্ত্র পড়তে পড়তেই ড্রামের মতো
বাদ্যযন্ত্রটিতে লাঠি দিয়ে আঘাত করেন সন্ন্যাসী। গুরুগম্ভীর দ্রিম দ্রিম শব্দ
মনাস্ট্রির অভ্যন্তরে পাক খেয়ে খেয়ে ছড়িয়ে যায় বাইরের প্রাঙ্গণে। সন্ধ্যা নেমে
আসে।
পরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ি তাওয়াং-এর পথে। আসার সময় বাজার
চত্ত্বরে খাবারের খোঁজে ঢুকতে আবার দেখা হয়ে যায় ক্যাপ্টেন আর তাঁর সঙ্গী জওয়ান
ভাইদের সঙ্গে। আরেকপ্রস্থ আলাপ জমে উঠতে সময় লাগেনা। পথে আসতে আসতে মনে পড়ছিল
সতনাম সিং-এর কথা, জওয়ানদের জীবনকথা...। ওয়ার মেমোরিয়াল পেরিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলে।
নীল আকাশের নীচে পাহাড়ি পথের বাঁকে সেই লেখাটি আবার চোখে পড়ে –
“When
you go home tell them of us and say for your tomorrow we gave our today”
অনেক
পিছনে মেমোরিয়ালের বাগানে হলুদ-কমলা রঙের গাঁদাগুলো মনকেমনের মৃদু বাতাসে দুলতে
থাকে...।
অদ্বিতীয়া - জানুয়ারি ২০১৬
আমার বেনারস
ফেলুদার সঙ্গে কৈলাসে
‘স্তব্ধভাষ রুদ্ধশ্বাস বিমুগ্ধ বিমূঢ় বিস্ময়’ –
কৈলাস মন্দিরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে লালমোহনবাবুর এই কথাটাই মনে পড়ে গেল। বাইরের
বিশাল চত্ত্বর থেকে প্রথমেই চোখে পড়ে সবুজ পাহাড়ের ব্যাকগ্রাউন্ডে জমকালো মন্দির।
হাঁটতে হাঁটতে কাছে পৌঁছাই - চুড়ায় সিংহের থেকে চোখ নামালে মন্দিরের বাইরের
দেওয়ালে নৃত্যরত নটরাজ, গরুড়ের পিঠে বিষ্ণু, নরসিংহ, লিঙ্গোদ্ভব শিব, দিকপাল,
ত্রিবিক্রম, ভূবরাহের বিশালকায় সব মূর্তি। কিন্তু কৈলাস যে কী বিরাট ব্যাপার সেটা
ভিতরে না ঢুকলে ঠিকমত ঠাওর হয় না।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ একক মনোলিথিক এই মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল
সপ্তম শতাব্দীতে রাষ্ট্রকুট (জটায়ুর ভাষায় ‘রাষ্ট্রপুট’) রাজা প্রথম কৃষ্ণের
আমলে। হিন্দু মন্দিরের চিরাচরিত বিন্যাসরীতি - গোপুরম, নাটমন্দির বা মণ্ডপ,
জগমোহন, গর্ভগৃহ এবং শিখর – মেনেই কৈলাস মন্দির
নির্মাণ করা হয়েছিল। “ জায়গাটা তিনশো ফুট
লম্বা, দেড়শো ফুট চওড়া... মন্দিরের হাইট একশো ফুট...দু লক্ষ টন পাথর কেটে সরানো
হয়েছিল... প্রথমে তিনদিকে পাথর কেটে খাদ তৈরি করে তারপর চুড়ো থেকে শুরু করে কাটতে
কাটতে নীচ পর্যন্ত নেমে এসেছিল... দেব দেবী মানুষ জানোয়ার রামায়ণ মহাভারত কিছুই
বাদ নেই এখানে।” – ফেলুদার সঙ্গে দেখতে দেখতে এগোই। মাথায় ঘুরপাক খায়
আওরাঙ্গাবাদ গুহায় জটায়ুর মন্তব্য, “তখনকার
আর্টিস্টদের শুধু আর্টিস্ট হলেই চলত না, বুঝলে হে তপেশ, সেই সঙ্গে গায়ের জোরও
থাকতে হত। হাতুড়ি আর ছেনি দিয়ে পাহাড়ের গায়ে পাথর ভেঙে তৈরি করতে হয়েছে এ সব
মূর্তি - চাট্টিখানি কথা নয়।”
সত্যি, আমারও তো মনে হয় কবি বা শিল্পী নিজের কাজকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হলে
কব্জির জোর দরকার, আর তা যেকোনও অর্থেই।
মন্দিরে ঢুকেই সবচেয়ে আগে চোখে পড়ে গজলক্ষীর বিশাল
মূর্তিটি। লক্ষীর মাথার ওপর দুপাশে দুই হাতি। পরে এই মূর্তিটি অন্য গুহাতেও একাধিকবার
দেখেছি। দুপাশ দিয়েই সিঁড়ি নেমে গেছে দুদিকের উঠোনে। মন্দিরের একপাশ দিয়ে হাঁটতে
শুরু করলে পিছন দিক দিয়ে ঘুরে আবার অন্য পাশ দিয়ে সামনে চলে আসা যায়। দুপাশের
উঠোনেই দুটি বিশালকায় মনোলিথিক হাতি। হাতিদুটোর পাশে কারুকার্যময় ১৪ মিটার উঁচু
দুটি ধ্বজাস্তম্ভ।
তপসের মতো একেকবার ভাববার চেষ্টা করি হাজার দেড়েক বছর আগের
ভারতীয় ভাস্কর্যের এই চূড়ান্ত পরিণত ভাবনাকে, আবার হাল ছেড়ে দিই, “কল্পনা করতে চেষ্টা করলাম, তেরোশো বছর আগে হাতুড়ি আর
ছেনি দিয়ে দাক্ষিণাত্যের একদল কারিগর পাহাড়ের গা কেটে এই মন্দিরটা বার করেছে।
কিন্তু পারলাম না। এ মন্দির যেন চিরকালই ছিল। কিম্বা কোনও আদ্যিকালের যাদুকর কোনও
আশ্চর্য মন্ত্রবলে এক সেকেন্ডে এটা তৈরি করেছে।” - আমারও যে
তখন তপসের মতোই ‘চোখ-ট্যারানো
মন-ধাঁধানো’ হাল।
বাঁদিক দিয়ে হাঁটা শুরু করি। সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাঁদিকের
দেওয়ালে উল্লেখযোগ্য মূর্তির মধ্যে রয়েছে মহিষাসুরমর্দিনী, গরুড়ের পিঠে বিষ্ণু। একটি
অসম্পূর্ণ গুহায় সপ্তমাতৃকা। এরপর একটা ছোট্ট মন্দিরে গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী – তিন নদীর দেবী। এর পাশ দিয়েই উঠে গেছে লঙ্কেশ্বর
গুহায় যাওয়ার সিঁড়ি। এই গুহাতেও ষোলটি পিলার এবং শিবের নানান বড় আকারের মূর্তি
রয়েছে। ছোট আকারের কয়েকটি মিথুন মূর্তিও মন্দিরের দেওয়ালের নীচের দিকে চোখে পড়ে।
উঠোনের দুদিক থেকে দুটো সিঁড়ি উঠে গেছে ৮মিটার উঁচু
নাটমন্দির বা মণ্ডপে। এরই নীচের অংশে সারি দিয়ে হাতি,
সিংহ এবং পৌরাণিক নানা জন্তু-জানোয়ারের মূর্তি। এরাই যেন পিঠে করে বইছে মন্দিরটি।
এখানে বলে রাখি, আমি দুপাশে দুটো ট্যাঁশগরুর মূর্তি দেখেছি – অবিকল এক, শুধু সুকুমার রায় একজোড়া ডানা বসিয়েছিলেন।
মূল মন্দিরের গায়ে বাঁদিকের দেওয়াল জুড়ে মহাভারত আর ভাগবতের আখ্যান। কুরুক্ষেত্র
যুদ্ধের দৃশ্য চোখে পড়ে। ডানদিকের ঊঠোনে নামলে এরই বিপরীতে অন্যপাশের দেওয়ালে
রয়েছে রামায়ণের আখ্যান। রামায়ণের প্যানেলের ঠিক পাশেই সেই বিখ্যাত দৃশ্য – সীতাহরণ ব্যর্থ
করার প্রয়াসে জটায়ুর রাবণকে আক্রমণ। আরেকটু এগোলে মন্দিরের
দেওয়ালের এক গহ্বরে রয়েছে রাবণের কৈলাস নাড়ানোর সেই বিখ্যাত মূর্তিটি। আরো এগোলে
মন্দিরের ওপর দিকে নজরে আসে বালি-সুগ্রীবের লড়াইয়ের আর বালির স্ত্রী রুমার ক্রন্দন
দৃশ্য। গর্ভগৃহের দেওয়ালের ওপর দিকে নানা ভঙ্গিমায় নৃত্যরত অপ্সরাদের দেখা যায়
যেকোন দিক থেকেই।
নাটমন্দিরের দ্বারের দুপাশে দুই দ্বারপাল দণ্ডায়মান। ষোলটি
কলসমাথা বিশালাকার পিলার রয়েছে নাটমন্দিরের অভ্যন্তরে। ইলোরার যে দু-তিনটি মাত্র
গুহায় সামান্য গুহাচিত্র দেখা যায়, কৈলাস তার একটি। নাটমন্দিরের সিলিং-এ
রাষ্ট্রকূট এবং পরবর্তী হোলকারদের সময়কার কিছু চিত্র দেখা যায়। খোদিত নটরাজও। নাটমন্দিরের আগে রয়েছে নন্দী মণ্ডপ –পাথরের সেতু দিয়ে যুক্ত। আর নাটমন্দির পেরিয়ে জগমোহন এবং গর্ভগৃহ। গর্ভগৃহের দ্বারের দুপাশে
গঙ্গা-যমুনা। অন্তরালে বিশালকায় শিবলিঙ্গ।
লঙ্কেশ্বরের গুহার নীচে উঠোন থেকে কয়েকটা সিঁড়ি উঠলে টানা
বারান্দায় একের পর এক বিশালাকার মূর্তি। বারান্দা ধরে দেখতে দেখতে হাঁটলে একেবারে
অন্য দিকের উঠোনের ওপরে পৌঁছে যাওয়া যাবে। এই বারান্দায় মূর্তিগুলির মধ্যে রাব্ণ নিজের ন’টি মাথা শিবকে উৎসর্গ করে শিবপূজা করছে, শিব-পার্বতী পাশা খেলছে, শিব-পার্বতীর
বিবাহ, বীণা হাতে শিব, কল্যানসুন্দর মূর্তি, লিঙ্গোদ্ভব শিব, ত্রিপুরান্তক শিব, ব্রহ্মা, নরসিংহ অবতার, কালীয় কৃষ্ণ প্রভৃতি
উল্লেখযোগ্য।
দক্ষিণ দিকে বারান্দার আগে একটি তিনতলা গুহা আছে যাতে
অনেকগুলি বড় মূর্তি আছে। অক্ষত মূর্তিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য গণেশ এবং ভৈরব
মূর্তি।
কৈলাস থেকে বেরিয়ে মন্দিরের পাশ দিয়ে মাথার দিকে উঠি।
সিনেমায় এখানে ক্লাইম্যাক্সের একটা অংশ ছিল – ফেলুদা তাড়া করেছে মূর্তিচোরদের একজনকে। মন্দিরের
ওপর থেকে দেখি সূর্যের লাল আভা ছড়িয়ে যাচ্ছে দেওয়ালের মূর্তিগুলির গায়ে। ফেলুদার
সঙ্গে কৈলাস দেখা এখনও শেষ হয়নি, কাল যাব পনেরো নম্বর ‘দশাবতার’ গুহায়
‘নন্দী’-র
সন্ধানে...।
অজন্তার মুগ্ধতা পেরিয়ে ইলোরায় পৌঁছেছি ২০১৩ সালের এক শরতের
দিনে। আমরা তিনজনেই। মাথায় ঘুরছে অবশ্যই ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারী’। শুভঙ্কর বোসের মতো এক ব্যাগ বই না
থাক, ‘ফেলুদার সপ্তকাণ্ড’-ও ব্যাগবন্দী হয়ে এসেছে বেনারসের পর ইলোরাতেও। আমাদেরও এখানের ঠিকানা হোটেল ‘কৈলাস’। তবে ব্যয়বহুল হওয়ায় ফেলুদাদের মতো
কটেজ রুম নয়, সেসব পেরিয়ে পিছন দিকের পরপর ডাবল বেডরুমগুলোর একটায়। বারান্দায়
দাঁড়ালে পেছনের দিকের গুহাগুলো দূর থেকে চোখে পড়ে আর পেছনের ঝরনাটাও একটু চেষ্টা
করলেই। অবশ্য মূল গল্পে ফেলুদারা খরচ বাঁচাতে ডাক বাংলোয় ছিল। প্রথমদিন পৌঁছে
দুপুরে হোটেল কৈলাসেই খেয়েছিলাম। ডাইনিং রুমে বসে খোঁজা হচ্ছিল কোন টেবিলে
মামা-ভাগ্নে থুড়ি লালমোহনবাবু আর তপসে বসেছিল, কোন টেবিলে ফেলুদা আর কোন টেবিলে
মিঃ রক্ষিত। তবে থাকার মতোই এখানের খাওয়া-খরচাও বেশ ভালো। রাতে তাই বাইরের একটা
হোটেলে খাই। কৈলাস হোটেলের বাইরে সর্বত্র নিরামিশ আহার। আমার কন্যা বুইয়ের ঠিক পোষায় না। অতএব, মিঃ রক্ষিতের পরামর্শমতো আমরাও ‘আফটার ডিনার ওয়াক আ মাইল’-এ বেরিয়ে পড়ি। অবশ্যই গুহার উদ্দেশ্যে নয়, এবং মাইলখানেক যেতেও হয়না, বেশ কিছুটা হাঁটতেই
একটা দোকানে আইসক্রিমের সন্ধান মেলে।
‘দশাবতার’ গুহা নামে খ্যাত
পনেরো নম্বর গুহাটা পাহাড়ের বেশ কিছুটা ওপরে, সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। দোতলা গুহার
একতলায় মনোলিথিক নন্দীমণ্ডপ, মানে সেই একটা পাহাড় কেটেই করা। নন্দীমণ্ডপ পেরিয়ে
অনেকগুলো থামওয়ালা বারান্দার উত্তর-পশ্চিম কোনে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। গল্পে এই
গুহাতেই ছিল ক্লাইম্যাক্স। আবার বুইয়ের হাতে ধরা ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’-র পাতা ওলটাতে ওলটাতে তপসে আর লালমোহনবাবুর সঙ্গে
সিঁড়ি ভেঙে উঠি – “দেড়তলায় উঠে একটা খোলা জায়গা। সেখানে দেয়ালের গায়ে
দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে। আরও খানিকটা উঠে গিয়ে আমরা তিন দিক বন্ধ একটা প্রকাণ্ড হল
ঘরে পৌঁছলাম। সারি সারি কারুকার্য করা থাম হলের ছাতটাকে মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
উত্তর আর দক্ষিণের দেয়ালে আশ্চর্য সব পৌরাণিক দৃশ্য খোদাই করা।” কৈলাস বাদে এই গুহাটার শিল্প-স্থাপত্য বৈচিত্র্যই
সবচেয়ে আকর্ষণীয় লেগেছে আমার। সিনেমাতেও এই হলটিতে জটায়ু আর তোপসে এসেছিল। নন্দীর
মূর্তিটিকে জড়িয়ে ধরে জটায়ুর সেইসব এক্সপ্রেশন মনে পড়ে আমি আর বুইও পাথরের নন্দীর
গায়ে ছেলেমানুষী খুশিতে হাত বোলাই আর ছবি তুলি।
হল ঘরটায় মোট চুয়াল্লিশটি পিলার আছে। পিলারের গায়ে শৈব
মূর্তি এবং বুদ্ধ মূর্তি উভয় দেখে আন্দাজ করা যায় যে এই গুহাটি হিন্দু আমলে তৈরি
হলেও বৌদ্ধ ধর্মের প্রাবল্যের সময়ে শেষ হয়। আসলে ইলোরার মোট চৌত্রিশটি গুহার মধ্যে
প্রথম বারোটি বৌদ্ধ গুহা, মাঝের ১৩-২৯ ব্রাহ্মণ্য গুহা এবং শেষ ৩০-৩৪ জৈন গুহা।
তবে তথ্যের কচকচানিতে পরে আসছি। আপাতত তেরোশ বছর আগের শিল্প-স্থাপত্যে আর
সত্যজিতের লেখায় ডুব দিই।
হলের দুপাশের দেওয়ালগুলিতে ছোট ছোট খোলা কুঠুরিতে নানা
মূর্তি। দু’দিকেই ছ’টা করে এমন কুঠুরি আছে। উত্তরের দিকের কূঠুরিগুলোয় পশ্চিম থেকে
পূবের দিকে হাঁটলে পরপর চোখে পড়ে - অন্ধকারি, নৃত্যরত শিব, শিবলিঙ্গ, শিব-পার্বতীর
পাশা খেলা, শিব-পার্বতীর বিয়ে, কৈলাস নাড়াচ্ছে রাবণ। হিন্দু গুহাগুলিতে
শিব-পার্বতীর নানা ভঙ্গীমায় মূর্তি এবং রাবণের ওই কৈলাস নাড়ানো একাধিকবারই চোখে
পড়ে। দক্ষিণের দেওয়ালে পশ্চিম থেকে পূবে পরপর মূর্তিগুলি হল, হিরণ্যকশিপুর সঙ্গে
নরসিংহের লড়াই, ত্রিবিক্রমরূপী বিষ্ণু, ভূবরাহ, শিবলিঙ্গ, করিবরদারূপী বিষ্ণু,
বিষ্ণুর অনন্তশয়ান, ছয়হাত নিয়ে গিরিধারী-গোপাল।
হলের একপাশে বড়সড় নন্দীমূর্তিটি – শেষপর্যন্ত যেটা আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু থাকে। নাহ্, শিল্পকর্মের জন্য নয়, স্রেফ ফেলুদার গল্পের
জন্য।
ইলোরার বৌদ্ধ গুহাগুলি তৈরি হয় পঞ্চম থেকে সপ্তম শতাব্দীতে
মহিষমোতির কালুচরী ও বাদামীর চালুক্যদের সময়ে। ৭৫০-৯৭৫ খ্রিঃ রাষ্ট্রকূট রাজবংশের
সময় হয় হিন্দু গুহাগুলি। এগারো-বারো শতাব্দী নাগাদ জৈন মন্দিরগুলো গড়েন
কল্যাণীর চালুক্য ও দেবগিরির (বর্তমান দৌলতাবাদ) যাদবরা। ইলোরা অজন্তার মতো কখনোই
হারিয়ে যায়নি। হিউয়েন সাং ছাড়া আর কারোর লেখায় যেখানে অজন্তার উল্লেখ নেই,সেখানে ইলোরা নিয়ে লিখেছেন আরব ভূগোলবিদ আল মাসুদি,ঐতিহাসিক
ফিরিস্তা,নিকোলাই মানুচ্চি,চার্লস
মালে এমন নামী এবং অনামী পর্যটকেরা বারবার।
অবশ্য সেই তুলনায় বাঙালি পর্যটকের কলমে ইলোরার কাহিনি প্রায় নেই।
হিন্দু গুহাগুলির মধ্যে ১৬ আর ১৫ ছাড়া উল্ল্যেখযোগ্য ১৪, ২১
আর ২৯। গল্পে না থাকলেও সিনেমার শেষদিকে ২৯ নম্বর গুহায় একটি দৃশ্যায়ণ আছে। সে
গল্পে তাই শেষে আসছি।
চোদ্দ নম্বর গুহাটি ‘রাবণ-কা-খাই’ নামে পরিচিত। গুহার
মধ্যে খোলা চত্ত্বর, মণ্ডপ, ষোলোটি পিলার এবং একটি মন্দির রয়েছে। উত্তর দেওয়াল
জুড়ে পশ্চিম থেকে পূবে দুর্গা, গজলক্ষ্মী, ভূবরাহ, বৈকুন্ঠনাথ-এর মূর্তি। দক্ষিণ
দেওয়ালে পশ্চিম থেকে পূবে মহিষাসুরমর্দিনী, শিব-পার্বতীর পাশা খেলা, নৃত্যরত শিব,
রাবণের কৈলাস নাড়ানোর দৃশ্য এবং অন্ধকারি মূর্তি। মন্দিরটির দরজার দুপাশে দুই
দ্বারপাল। ভেতরে মূর্তিটির ভগ্নদশা। মন্দিরের উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালের শেষে গঙ্গা
ও যমুনার মূর্তি। হাতির পিঠে ইন্দ্র, গণেশ, সপ্তমাতৃকা – আরও নানা দেবদেবীর মূর্তিও রয়েছে এই গুহায়।
‘রামেশ্বর’ নামে পরিচিত একুশ
নম্বর গুহাটি। স্থাপত্যের জন্য এই গুহাটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। উত্তর দেওয়ালে বসা
অবস্থায় গণেশ মূর্তি এবং মন্দিরের সামনে উঁচু পাটাতনে নন্দী মূর্তিটি চোখে পড়ে।
মকরের ওপর গঙ্গার বৃহদাকার মূর্তিটিও নজর কাড়ল। ভাবছিলাম, জটায়ু থাকলে নির্ঘাত
একটা প্রণাম ঠুকে বলত - বুঝলেন মশায়, এই হল গঙ্গা, দেখলেই ইয়ে কেমন ভক্তি ভক্তি
লাগে। সামনের দিকে বেশ কয়েকটি পিলার রয়েছে। মাঝের দুটি পিলারে ছয়-সাত দশকের
মধ্যেকার চালুক্যদের লিপি রয়েছে। দক্ষিণ দেওয়ালের উল্লেখযোগ্য মূর্তিগুলির মধ্যে
রয়েছে বীণাধারী শিব, সপ্তমাতৃকা, গণেশ প্রমূখ। পূব দেওয়ালে নটরাজ মূর্তি। ওরই
বাইরের অংশে শিব-পার্বতীর পাশা খেলা। উত্তর দিকের দেওয়ালে শিব পার্বতীর বিয়ে,
কার্ত্তিকেয়। পূব দেওয়ালে মহিষাসুরমর্দিনী। গুহার বাইরের দিকের দেওয়ালে রাবণের
কৈলাস নাড়ানোর সেই চেনা মূর্তিটি।
ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে ঊনত্রিশ নম্বর গুহায় এসে বসে পড়ি।
এখানেই সিনেমায় ফেলুদা মূর্তিচোরদের ধরার শেষ পরিকল্পনা করছিল। জটায়ু, তোপসে আর বোম্বের
প্রাইভেট ডিটেকটিভ জয়ন্ত মল্লিক –
সকলেই হাজির ছিল।
কৈলাস থেকে জৈন গুহাগুলির দিকে যেতে এই গুহাটি পড়বে।
পাহাড়ের গা ঘেঁষে ঝরনার জলের ছিটে গায়ে মেখেও যাওয়া যায়। গুহায় মোট ছাব্বিশটি
পিলার আছে। পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণে গুহার প্রবেশপথ রয়েছে। তবে দক্ষিণের
প্রবেশপথটিই প্রধান। এই প্রবেশপথের দুপাশে সিংহ এবং হাতির মূর্তি আছে। দক্ষিণ
প্রবেশপথের কাছে কয়েকধাপ সিঁড়ি নেমে ঝরনার
জলে সৃষ্ট ধারাটির কাছে পৌঁছানো যায়। দক্ষিণের দরজা দিয়ে ঢুকে পূব দেওয়ালে
শিব-পার্বতীর বিয়ের ভাস্কর্যটি। এর দক্ষিণে বিশালাকার সরস্বতী মূর্তি। পশ্চিমের
দেওয়ালের ওপরের অংশে শিব-পার্বতীর পাশা খেলার দৃশ্য। নীচে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও নন্দী। পশ্চিম প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকে দক্ষিণের দেওয়ালে
রাবণের কৈলাস নাড়ানোর মূর্তি। উত্তরের প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকে পশ্চিমের দেওয়ালে
নটরাজের মূর্তি। গুহার পেছনের দিকে অবস্থিত মন্দিরটির চারপাশই খোলা। সবদিকেই দ্বারপালের
মূর্তি রয়েছে। মন্দিরের ভেতরে শিবলিঙ্গ।
লক্ষ্য করলাম কী গল্পে কী সিনেমায় ফেলুদা শুধুমাত্র হিন্দু
গুহাগুলোতেই গেছে। এটা হয়ত কাকতালীয়। তাই সেই তাল ধরে ১৩-২৯ এই ঘোরাফেরা করলাম।
পনেরো আর ঊনত্রিশ নম্বর গুহা নজর কাড়লেও শেষপর্যন্ত কৈলাসের জবাব নেই। তাই যে দুদিন
ছিলাম রোজই একবার করে কৈলাসে গেছি আর মুগ্ধ হয়েছি।
তবে আমার ধারণা ফেলুদা না গেলে কী হবে, গোয়েন্দাগিরির ফাঁকে
তপসে আর লালমোহনবাবু অন্য গুহাগুলো ঘুরেই নিয়েছে, সে খবর সত্যজিতও রাখেননি। আমরাও
বাদ দিইনা কোনটাই।
কৈলাসের ডানহাতে এগিয়ে গেলে শেষের দিকে বৌদ্ধগুহাগুলি।
এগুলোই সময় বিচারে সবথেকে পুরোনো। আর বামেও একেবারে শেষের দিকে জৈন গুহা্র সারি।
ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাবে সরতে সরতে বুদ্ধধর্মাবলম্বীরা
ইলোরা এবং ঔরঙ্গাবাদে এসে থিতু হয় এবং প্রথম ইলোরার গুহাগুলি তৈরি করেন। যদিও
ইলোরার সবকটি বৌদ্ধগুহার থেকেও ঔরঙ্গাবাদের সাত নম্বর গুহাটি অনেক আকর্ষণীয়
স্থাপত্যের দিক থেকে। ইলোরার বৌদ্ধ গুহাগুলিতে নানা ভঙ্গিমায় বুদ্ধমূর্তিই একমাত্র
দর্শনীয় বিষয়। বুদ্ধ পদ্মাসনে, প্রলম্বপদ আসলে অথবা পদ্মের ওপর দন্ডায়মান।
ধর্মচক্রপ্রবর্তন, ভূমিস্পর্শ এবং ধ্যান – এই তিনটি মুদ্রাই কম বেশি রয়েছে।
প্রথম আর পঞ্চম গুহা সবচেয়ে পুরোনো। এরমধ্যে প্রথম গুহা ধসে
গেছে। অতএব দুনম্বর গুহা থেকেই দেখা শুরু করলাম। দুনম্বর গুহার প্রবেশদ্বারের দুপাশে দুটি বিশালাকার বোধিসত্ত্ব মূর্তি।
ডানদিকে বোধিসত্ত্ব মৈত্রেয়। বোধিসত্ত্বের পাশে, একটু নীচে বুকের ওপর আড়াআড়ি হাত
রাখা আয়ূধপুরুষ মূর্তি। বোধিসত্ত্বের মাথার ওপরে বামন এবং ডাইনের প্যানেলে পরবর্তী
সময়ের বুদ্ধমূর্তি বসা ভঙ্গীমায়। আরও ডানদিকে উইন্ডো প্যানেলে উপর থেকে নীচে
ভদ্রাসনে বসা বুদ্ধমূর্তি দুপাশে বোধিসত্ত্ব। বামদিকে দ্বারপালরূপী বোধিসত্ত্বের
মাথার ওপরেও বামনমূর্তি এবং বাঁপাশের প্যানেলে সেই একইরকম বসা ভঙ্গিমায়
বুদ্ধমূর্তি। গুহায় ঢুকে উত্তর দিকের সামনের দেওয়ালে তারামূর্তি সঙ্গীনীদের নিয়ে।
এই মূর্তির বামে এবং গুহায় ঢুকে ডানদিকে শ্রাবস্তীর অলৌকিক ঘটনার দৃশ্যাবলী। মূল
হলটিতে বারোটি কলসমাথা পিলার রয়েছে। হলের দুপাশের প্রকোষ্ঠগুলিতে বসা ভঙ্গীমায়
বুদ্ধমূর্তি রয়েছে। গর্ভগৃহের দ্বারের দুপাশে দুই বোধিসত্ত্ব আর মাথার ওপর উড়ন্ত
যুগল (flying
couple)। বাঁদিকেরজন অবলোকিতেশ্বর। মাথার
বিশেষধরণের মুকুট এবং হাতে লম্বা ডাঁটির পদ্ম এঁর বৈশিষ্ট্য। গর্ভগৃহের অভ্যন্তরে সিংহ সিংহাসনে বসে আছেন প্রলম্বপদ বুদ্ধমূর্তি
ধর্মচক্রমুদ্রায়।
তপেশ জানতে চায়, শ্রাবস্তীর অলৌকিক ঘটনা – গল্পটা কী? নারায়ণবাবু কেন যে ইলোরা নিয়ে লিখলেন না,
বিড়বিড় করতে করতে পকেট থেকে অ্যান্ড্রয়েড ফোনটা বার করে ইন্টারনেটে খুঁজতে থাকেন
লালমোহনবাবু। এই ফাঁকে বলে রাখি, ইদানীং ফেলুদার থেকে নেটের ওপরেই তাঁর ভরসা বেশি।
যদিও ‘রাষ্ট্রকূট’-কে ‘রাষ্ট্রপুট’ আর না বললেও ফেলুদা সাবধান করেছে, নেটের সব কিন্তু
সত্যি হয় না। বুঝলে তপেশ, এটা ‘টুইন
মিরাকেল’ নামে বিখ্যাত, ফোনের
থেকে চোখ না সরিয়েই বলতে থাকেন লালমোহনবাবু। বুদ্ধ বলেছিলেন, একটা আমগাছের নীচে
অলৌকিক কিছু ঘটনা ঘটাবেন। তাঁর শত্রুরা এটা শুনেই শ্রাবস্তীর সব আমগাছ কেটে
ফেলেছিল। যাইহোক, সময় হলে রাজার বাগানে গিয়ে একটি আম খেয়ে বুদ্ধ বীজটি মাটিতে
পুঁতে দিলে সঙ্গে সঙ্গেই সেটি একটি বৃক্ষ হয়ে যায়। গাছটির একপাশ থেকে তিনি একটি
মণিমুক্তখচিত পথের সৃষ্টি করে নিজের দেহের উর্ধ্বাংশ থেকে আগুন এবং নীম্নাংশ থেকে
জল নির্গত করেন। একইভাবে শরীরের বাম ও ডানদিক থেকেও আগুন আর জল বেরোয়। ষোলদিন ধরে
তিনি এই অলৌকিক ঘটনা দর্শকদের দেখিয়েছিলেন। তবে বুঝলে হে তপেশ, এসব মানুষের মুখে
মুখে ছড়ানো গল্পই, তবে পড়তে বা শুনতে বেশ লাগে – মুঠোফোন পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে মন্তব্য জোড়েন।
পাঁচ নম্বর গুহায় ঢুকে জটায়ু খানিক আশ্চর্য হয়ে বলেন, তপেশ,
গ্যাংটকে গেসলাম যখন, মনাস্ট্রিগুলো ঠিক এরকম ছেল, মনে আছে? সত্যি, লম্বায় প্রায়
৩৫-৩৬ ফুট দীর্ঘ এই গুহাটির পিলারগুলি, এগিয়ে যাওয়া পথের দুপাশের সমান্তরাল দুটি
উঁচু বিম, পিলারের ফাঁকে ফাঁকে পেছনের কুঠুরিগুলো দেখলে তাই মনে হয়। মোট ২৪ টা
পিলার আর ২০ টি কুঠুরি আছে। এত তথ্যের হয়ত দরকার ছিল না, কিন্তু সত্যিকারের
ফেলুদার আবার প্রশ্ন করার অভ্যেস আছে কিনা, তাই তপসেদের সুবিধার জন্য জানিয়ে রাখি।
মূল মন্দিরে ঢোকার মুখে যথারীতি দুপাশে দুই দ্বারপাল। ভেতরে মূল বুদ্ধমূর্তির
ডানহাতে অবলোকিতেশ্বর আর বাঁদিকে মৈত্রেয় বুদ্ধমূর্তি।
আট নম্বর গুহায় ঢুকে বাঁ-হাতে আরেকটি ছোট গুহা (৮ এ) আছে।
এই গুহায় ভদ্রাসনে বসা বুদ্ধমূর্তির দুপাশে দুই বোধিসত্ত্ব আর মাথার ওপর উড়ন্ত
মূর্তি (flying
figure)। গুহায় ঢুকতে বাঁ দিকের দেওয়ালে অবলোকিতেশ্বর ও তারা
মূর্তিদুটি চমৎকার। মূল গুহার প্রদক্ষিণপথটি প্রশস্ত। ডানহাতের দেওয়ালে মহাময়ূরী
মূর্তি। এখানেও মূল মন্দিরে ভদ্রাসনে বসা বুদ্ধমূর্তির দুপাশে দুই বোধিসত্ত্ব।
ননম্বর গুহার ভেতরের বুদ্ধ বা বোধিসত্ত্ব মূর্তি একইধরণের হলেও এই গুহার বাইরের
দৃশ্যে চোখ আটকায়। বারান্দার বাইরের দিকের ওপরে অনেকগুলি বসা ভঙ্গীমায় বুদ্ধমূর্তি
এবং সঙ্গী বোধিসত্ত্বের মূর্তি আছে। খেয়াল করে দেখলে তারা, যক্ষ আর বামন মূর্তিও
চোখে পড়ে। বৌদ্ধগুহাগুলির মধ্যে একমাত্র এই গুহাতেই ছাদের দিকে তাকালে হালকা চিত্রের
আভাস মেলে।
দশ নম্বর গুহা সবচেয়ে বড় টানা চৈত্যহল। এই গুহার নাম
বিশ্বকর্মা। স্থানীয়রা এখনও এখানে পুজো দিতে আসেন। বারান্দার ওপরে গন্ধর্ব,
অপ্সরার উড্ডীয়মান মূর্তি এবং বিভিন্ন পশু মোটিফ বেশ নজর কাড়ে। বারান্দায়
পদ্মপানির মূর্তিটিও উল্লেখযোগ্য। গুহায় বজ্রপানি ও তারার মূর্তিও রয়েছে। তিরিশটা
থাম দিয়ে হলের আকার করা হয়েছে। থামের গায়ে লতাপাতা, মানানসই খাঁজকাটা ছাদ। স্তুপের
সামনের অংশ কেটে বিশালকায় বুদ্ধমূর্তিটি তৈরি হয়েছে। বুদ্ধ সিংহ সিংহাসনে ভদ্রাসনে
বসে। বাঁয়ে অবলোকিতেশ্বর এবং ডানদিকে মঞ্জুশ্রী।
এগার নম্বর গুহাটি একসময় তিনতলা ছিল। এখন নীচের তলাটি
ভগ্নস্তুপ হয়ে যাওয়ায় দো-তাল নামে পরিচিত। দোতলার টানা বারান্দায় তিনটি মণ্ডপ।
তিনটি মণ্ডপেই ভূমিস্পর্শমুদ্রায় বুদ্ধ। দোতলায় কুবেরের মূর্তিটি বৌদ্ধ সময় পেরিয়ে
হিন্দু ধর্মের আভাস বোঝায় হয়ত। তিনতলায় পিলারওয়ালা বারান্দা পেরিয়ে হলে ঢুকলে
বিশালাকার প্রলম্বপদ বুদ্ধমূর্তি। উত্তর এবং দক্ষিণের দেওয়ালে যথাক্রমে তারা ও
অবলোকিতেশ্বর। বারো নম্বর গুহা তিনতলা বৌদ্ধবিহার। নীচের তলায় বুদ্ধ ও অন্যান্য
দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে। দোতলার বিশাল হলের পেছনে পেছনে তেরটা কুঠুরি। পূর্বদিকের
মন্দিরে ভূমিস্পর্শমুদ্রায় বিশালাকার বুদ্ধ। তিনতলায় মূল বুদ্ধের দুপাশে পদ্মপানি
ও বজ্রপানি। হলের পেছনের দেওয়ালে উত্তর দিকে সাত মানুষ বুদ্ধ এবং দক্ষিণে সাত দেব
বুদ্ধ।
আবার কৈলাসে ফিরি। এবং হোটেল কৈলাসেও। পরের দিনের গন্তব্য
শেষপ্রান্তের জৈন গুহাগুলো। দিনের বেলায় কৈলাস দেখে দুপুরে ওই চত্ত্বরেই খাওয়া
সেরে জৈন গুহাগুলোর দিকে এগোই।
কৈলাস তো দেখলেন লালমোহনবাবু, এবারে ছোটা কৈলাস দেখুন – এমন কিছুই নিশ্চয় বলত ফেলুদা জৈনগুহাগুলির বাকিগুলোর
থেকে বেশ কিছুটা আলাদা তিরিশ নম্বর জৈন গুহাটার সামনে দাঁড়িয়ে। আর জটায়ু নির্ঘাত
ঘাবড়ে গিয়ে উল্টোদিকে হাঁটা দিয়ে বলতেন, আর লাসফাসের দরকার নেই মশাই, ওই একটাই
যথেষ্ট। তপসে নিশ্চয় হাত ধরে টেনে এনে আশ্বস্ত করতেন, জৈন গুহা, এখানে ওসব ভয় নেই।
ব্যস, নিশ্চিন্ত, এই বলে ঢুকে পাশেই বারো হাতের দেবী মূর্তি দেখে আবার দাঁড়িয়ে
যেতেন। কী ব্যাপার বলত হে তপেশ, দুর্গার দশ হাত আছে জানি, এনার দেখছি একেবারে এক
ডজন! নীচে আবার সিংহের বদলে গড়ুরও রয়েছে। ওদিক থেকে ফেলুদা বলে উঠত, হাতগুলো
লক্ষ্য করে দেখুন, বারোটার মধ্যে আটটা হাতেই চক্র রয়েছে, তাই এই দেবীর নাম
চক্রেশ্বরী। ইনি সত্যের দেবী। এর উল্টোদিকেই দেখুন মহাবীরের তিনটে মূর্তি আছে
ধ্যানাসনে। এর আগে বুদ্ধকে সিংহ আসনে দেখেছিলেন, এবারে মহাবীর। লালমোহনবাবুও দুগ্গা
দুগ্গা, থুড়ি চক্রেশ্বরী চক্রেশ্বরী করতে করতে নিশ্চয় সামনের জলে হোঁচট খেতেন। মানে লালমোহনবাবু খেতেন কী না জানিনা, আমি বেমালুম
হোঁচট-টোচট সামলে এগোলাম। কৈলাসের মতো এখানেও দ্বারপাল দরজার দুপাশে। আরও ডান ও
বামে দুটি নৃত্যরত মূর্তি। হয়তো হিন্দু দেবতা শিবের কোনও জৈন সংস্করণ। মণ্ডপের
ভেতরে ঢুকে হাঁটতে হাঁটতে বিভিন্ন অংশে পার্শ্বনাথ এবং অন্যান্য তীর্থঙ্করদের
মূর্তি চোখে পড়ে। একেবারে শেষে তিন সিংহের সিংহাসনে বসা মহাবীরের মূর্তিটি পাশের
আরও তীর্থঙ্কর ও দেবীদের নানা ভঙ্গিমার মূর্তি সমেত জটায়ুর ভাষায় জমজমাট। দেখা শেষ
হলে নির্ঘাত জানতে চেয়েছিলেন, বলত হে কার ঘাড়ে এমন মাথা ছিল যে আর একটা কৈলাস
বানাতে গেসল? ঐতিহাসিকেরাও এর উত্তর জানেন কিনা জানিনা।
বত্রিশ আর তেত্রিশ নম্বর গুহা পরপর। তেত্রিশ দোতলা গুহাটি
জগন্নাথ সভা নামে পরিচিত। বত্রিশ ইন্দ্রসভা স্বাভাবিকতই আরও বড়। লক্ষ্যণীয় জৈন
গুহার হিন্দু নাম। বত্রিশ নম্বর গুহায় হিন্দু দেবদেবী মাতঙ্গ বা কুবের আর
সিদ্ধায়িকা বা হারিতির দেখা মেলে। এরা দুজনেই ঐশ্বর্যের দেবতা। তিন ধর্মের শিল্প
কী আশ্চর্যভাবে মিলেমিশে গেছে তা দেখার সেরা জায়গা বোধহয় ইলোরাই। ইলোরার স্থাপত্যে
কলসমাথা থামের মতোই ছাদে লোটাস মোটিফের ছড়াছড়ি। নীচের তলায় সরু গলি দিয়ে গিয়ে মূল
মন্দিরে মহাবীরের কাছে পৌঁছতে হয়। দোতলায় চওড়া বারান্দা আর বারো থামের প্রশস্ত হল।
মহাবীরের মূল মূর্তি, হলে পার্শ্বনাথ আর অন্যান্য তীর্থঙ্করদের মূর্তির থেকেও চোখ
টানে প্রায় নষ্ট হয়ে আসা প্রাচীন চিত্রগুলি। কৈলাস মন্দিরের জন্যই বাণিজ্যপথে থাকা
সত্ত্বেও অজন্তার মতো হারিয়ে যায়নি ইলোরা। কিন্তু যক্ষীর মাথা না ভাঙলে
যক্ষীমূর্তি রয়ে যায় ঠিকই কিন্তু মানুষের সংস্পর্শে আর দখল করার চোরা আগ্রহে
ইলোরার প্রাচীন চিত্রের আজ আর প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই।
এবার ইন্দ্রসভায়। সন্ধ্যে নেমে আসছে দ্রুত, পা চালিয়ে দেখি।
প্রথমে ভুল করে দোতলায় উঠে গিয়েছিলাম। হঠাৎ লন্ঠন হাতে মির্জা ইসমাইল উঠে আসেন।
আমাদের পথ দেখান। দোতলা থেকে একতলায় নামি। উঠোনে মনোলিথিক মণ্ডপ। বাঁদিকে বিশাল
হাতি, ডানদিকে প্রকাণ্ড থাম –
মানসস্তম্ভ।একতলার মূল মন্দিরে সিংহের আসনে মহাবীর। এখানেও প্রাচীন চিত্রের কিছু
আভাস পাওয়া যায়। এদিক সেদিকে বেশ কয়েকটা গুহায় জৈন তীর্থঙ্করদের নানা মূর্তি। দোতলায়
মূল মন্দিরে মহাবীর ও নানা ভঙ্গীতে অন্যান্য তীর্থঙ্করেরা। শেষবিকেলের রোদ বারান্দার জানলার জাল দিয়ে কুবেরের মুখের আভা বদলে দেয়। ইসমাইল
ডাকেন আমাদের, ইধার আইয়ে। কুবেরের পেছন দিয়ে অন্ধকার গুহার ভেতরে যাই। দুলন্ত
লন্ঠনের ক্ষীণ আলো আমাদের পথ দেখায়। চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরের একটা ঘরে ঢুকি। লন্ঠন
তুলে আমাদের দেখান ইসমাইল, ঘরের এপাশে-ওপাশে, বাইরে দরজার দুপাশে, সিলিঙে বেশ কিছু
প্রাচীন চিত্র যা এখনও খানিকটা অক্ষত। প্রায় অন্ধকারে, লন্ঠনের আলোয় ভালো করে
দেখতে পাইনা, তবু দেখি। লন্ঠন উঠিয়ে-নামিয়ে দেখাতে দেখাতে ইসমাইল হিন্দিতে যা
বলেন, তার অর্থ, সবাইকে এখানে নিয়ে আসি না, আপনারা যেভাবে দেখছিলেন, মনে হল
আপনাদের ভালোলাগবে। আমরাও ভালোলাগা জানাই তাঁকে। ছবি দেখতে থাকি।
যে ছবিটায় আমার চোখ আটকায় তা ঘরের একেবারে শেষপ্রান্তে। সন্ন্যাসী
বেশে এক মহাপুরুষ, তার পাশে তুলনায় অনেকটাই ছোট একটি নারী মূর্তি। পুরুষটির দৃষ্টি
সামনের দিকে তবে হয়তো নির্দিষ্ট কিছু দেখছেন না, হয়ত ভাবছেন। নারীর দৃষ্টি
পুরুষটির দিকে, স্নেহময়, কোলে সন্তান কিনা বোঝা যায় না। আমার অজন্তার সতেরো নম্বর
গুহার সেই দৃশ্য মনে পড়ে যায় - বিশালায়তন বুদ্ধ ভিক্ষাপাত্র হাতে দণ্ডায়মান। পীতাভ
রঙের বুদ্ধ যেন অনেকটাই অপার্থিব। পশ্চাৎপট ঘন অন্ধকার। সামনে পুত্রকে একহাতে ধরে
দাঁড়িয়ে আছে যশোধরা। মাতা-পুত্রের ছবিটি অতি ক্ষুদ্র হলেও তার ভাব-ব্যঞ্জনা খুব
স্পষ্ট। যশোধরার চোখে স্বামীর প্রতি প্রেম-অভিমান আর পুত্রের জন্য আশঙ্কা সবই
অপরূপভাবে ফুটে উঠেছে। বুদ্ধের বিশালত্ব বোঝাতেই মাতা-পুত্রের আকার ক্ষুদ্র হয়েছে।
এখানেও সেই একই কারণে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব বোঝাতে, তার আকার নারীর থেকে বড় করা
হয়েছে। তবে কি এই দুই শিল্প সমসাময়িক? জানিনা। যদিও চেহারা কিন্তু আলাদা। শিল্প
যাই বলুক না কেন যশোদা হোক বা যশোধরা নারীর অবহেলার কাহিনিটি একই রয়ে যায়। যশোধরার
গল্পের মতো যশোদার গল্পে পূর্ব জন্মের কোনও অহঙ্কারের কাহিনি আছে কিনা তাও জানা
নেই আমার। যশোধরার মতো পুত্র নয়, মহাবীরের কন্যার জননী যশোদার কি হল জানতে ইচ্ছে
করে আমার। সেই স্মিতমুখী নারীর ছবিটি মনে আঁকা রয়ে যায়। বন্ধ হওয়ার সময় হয়ে এসেছে,
ইসমাইল বিনীতভাবে জানান। আমরাও ফিরে যাব কাল। তাই আর ইসমাইলের গল্পটি শোনা হয়না
আমার।
মনে পড়ে, সকালে আমাদের হাতে ‘ফেলুদার সপ্তকাণ্ড’ দেখে এক পাহারাদার হিন্দিতে জানতে চাইছিলেন, বাঙালি
বাবুরা নারায়ণ সান্যালের বই নিয়ে অজন্তা দেখেন, এখানকার তেমন কিছু নেই? দিনের শেষে
গুহা থেকে ফেরার পথে মনে মনে ধন্যবাদ জানাই স্বর্গীয় নারায়ণবাবুকে, তাঁর বইয়ের
পাতা থেকে মির্জা ইসমাইলকে পাঠানোর জন্যে।
পরদিন সকালে ফেরার আগে কৈলাস মন্দির আর কৈলাস হোটেলের সামনে
আমরা, ফেলুদা অ্যান্ড কোং ছবি তুলি।
ফিরে আসার আগে বুই থুড়ি তপসে জিজ্ঞাসা করল, সবই তো হল
কিন্তু ‘কই লাস’?
বলি দেখলি না, পুরোনো ছবিগুলো কেমন হারিয়ে যাচ্ছে, প্রপার
রেস্টোরেশনের কোনও চেষ্টাই নেই। এ মৃতদেহ তো দেখা যায় না, এ হারিয়ে যায়, বুঝলি
ভুতো?
অদ্বিতীয়া - অক্টোবর ২০১৬
অদ্বিতীয়া - অক্টোবর ২০১৬
ক্যানভাসে আঁকা দিরাং
কাজিরাঙ্গা, ভালুকপঙ ঘুরে বমডিলা ছুঁয়ে গতকাল বিকেলে দিরাং
পৌঁছেছি। ডিসেম্বরের শেষের জমাট ঠাণ্ডাকে ভুলিয়ে দিচ্ছে অরুণাচলের পাহাড়ের
শান্ত-সবুজ রূপ। সকালেই বেরিয়ে পড়েছি। সবুজ পাহাড় আর সাংতি নদীকে সঙ্গী করে
পাহাড়ের বাঁক ঘুরে ঘুরে এগিয়ে চলা। পথ চলতে চোখে পড়ে টিনের চালে ছাওয়া পাহাড়িয়া
গ্রামের বাড়ির নিত্যদিনের রোজনামচার একঝলক। কেউ কেউ কৌতুহলী চোখে আমাদের দেখে। পাহাড়ি
ফুলে আলো হয়ে আছে বারান্দা, ছোট্ট বাগান। এখনও ততটা বড় হয়নি বা পুরোপুরি পাকেওনি,
তাও কমলালেবুর ভারে নুয়ে পড়েছে গাছের ডাল। রাস্তার ধারে, কাঠের বাড়ির গায়ে একের পর
এক কমলা-সবুজে ঝলমলে গাছের সারি। শিপ ব্রিডিং ফার্ম পেরিয়ে আরও কিছুটা এগোতে একসময়
হঠাৎ করে পাহাড়গুলো দূরে সরে গিয়ে চোখের সামনে মেলে দিল অনেকটা খোলা সমতল। কোথাওবা
দিগন্তজোড়া ক্ষেত – ফসলকাটা হয়ে
গেছে, কোথাওবা ঘাসজমি। বিস্তীর্ণ উপত্যকার বুকে পাথরে পাথরে ধাক্কা খেয়ে আপনমনেই
নাচতে নাচতে চলেছে সাংতির কিশোরী জলধারা। নদীর ওপরে খাশো ব্রীজ পেরিয়ে এসে থামা। পায়ে
পায়ে নেমে আসি জলের ধারে। নদীর পাশের উঁচু-নীচু জমিতে কয়েকটা পাহাড়ি ঘোড়া ঘাস
খাচ্ছে। দূরে সবুজ পাহাড়ে আলো-ছায়ার খেলা – এ যেন
বিদেশি কোন চলচ্চিত্রের দৃশ্য। নদীর জলে পায়ের পাতা ভিজিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকি চুপ
করে – হৃদয়ের উপলব্ধি দিয়ে যতটা
প্রকৃতির কাছাকাছি আসা যায়। নদীর ধার ধরে, মাঠের আল বেয়ে হাঁটতে থাকি একাএকাই...।
ফেরার পথে শিপ ব্রিডিং ফার্ম। গেট পেরিয়ে বেশ খানিকটা চড়াই
ভেঙ্গে ওপরে পৌঁছে পিছন ফিরে মুগ্ধ হই। কোন এক ইরানি চলচ্চিত্রে ঠিক এমনি একটা
দৃশ্য ছিল – সবুজ ঢালু জমি দিয়ে দৌড়ে আসছে
দুই শিশু, পিছনে সবুজ পাহাড়, মাথার ওপর নীল আকাশ। তাকিয়ে দেখি ঢাল বেয়ে উঠে আসছে
মেষপালকেরা তাদের ভেড়ার দল নিয়ে। যেন একটা বিরাট ক্যানভাসের ছবি। একেকটাসময় মনে হয়
আমি যদি ভালো ছবি আঁকতে পারতাম তাহলে বেশ হত। ছোটবেলায় জল রঙে ছবি আঁকতে খুব
ভালোলাগত। রুশ দেশের যে পত্রিকাটির আমরা নিয়মিত গ্রাহক ছিলাম তাতে ভারি সুন্দর
সুন্দর প্রকৃতির ছবি থাকত। সময় পেলে চেষ্টা করতাম আঁকার খাতায় যতটুকু পারি ফুটিয়ে
তুলতে। আজকে আমার চোখের সামনেই প্রকৃতির অপরূপ ক্যানভাস। শুধু আমি আঁকতে ভুলে
গেছি...।
কালচক্র গোম্ফায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা গড়িয়ে এল।
মনাস্ট্রিটি ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। আশপাশটাতেই ঘুরে বেড়ালাম। স্থানীয় লোকজন
অনেকেই নীরবে মনাস্ট্রি প্রদক্ষিণ করে চলে যাচ্ছেন। আবার ঘুরতে ঘুরতেই পিঠে শিশু
বাঁধা মা গল্প জুড়েছেন পাশের সঙ্গীনিটির সঙ্গে। ব্যাট-বল খেলে অথবা স্রেফ দৌড়াদৌড়ি
আর গল্প করেই প্রাঙ্গণটি জমজমাট করে রেখেছে সদা হাস্যময় বালক-বালিকার দল।
ক্যাপ্টেন সতনাম সিং বেশ হাসিখুশি, ভালোমানুষ। আমাদের দেখে
নিজেই আলাপ করতে এগিয়ে আসেন। দিরাং থেকে তাওয়াং-এর পথে কিছুটা এগোলেই পাহাড়ের গায়ে
নয়ুকমাডং ওয়ার মেমোরিয়াল। ১৯৬২ সালের চিন-ভারত যুদ্ধে নিহত শহিদদের স্মৃতিস্তম্ভ। পরদিন
সকালের প্রথম গন্তব্য। খোলা আকাশের নীচে স্মৃতিস্তম্ভকে ঘিরে সাজানো বাগানে
দাঁড়িয়ে নিহত শহিদদের নামের তালিকায় চোখ রাখি। এমন সুন্দর প্রকৃতির মাঝেও মানুষ
মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ করে! কথায় কথায় ক্যাপ্টেন সাহেব গল্প করেন এক বাঙালি ছেলের।
কলকাতারই ছেলে। একসময় তাঁর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে সেই সাহসী যুবক।
পরে কারগিল-এ যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা যায়। সহযোদ্ধার স্মৃতিচারণ করতে করতে
ক্যাপ্টেনের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। শ্রদ্ধা-ভালোবাসার সেই আলো ছড়িয়ে যায় যেন
আমাদের মধ্যেও।
নদী-পাহাড়-জঙ্গল মাখা পথে এগিয়ে চলি চুগ ভ্যালির দিকে। চুগ
গ্রামকে ঘিরে শান্ত উপত্যকা। কাঠের ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়ে ভ্যালির বুকে পা রাখি।
ভ্যালির কোল ঘেঁষে ডিব্রু নদীর শান্তধারা। উঁচু-নীচু ঘাস পাথরের জমিতে হাঁটি। পাহাড়ের
মাথায় কালো মেঘ জমছে। এলোমেলো হাওয়া মুখের ওপর হঠাৎ হঠাৎ ঠাণ্ডা আঙুল বুলিয়ে দেয় – শিউরে উঠি যেন। পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে উঠে গেছে চাষের জমি।
ফসল কাটা হয়ে গেছে। কয়েকটা ঘোড়া আপনমনে সেই ন্যাড়া জমিতে গজিয়ে ওঠা কচি ঘাস
খাচ্ছে। ব্রিজের ডানদিকে বেশ কিছুটা দূরে ভাঙ্গাচোড়া ইঁটের বাড়ি চোখে পড়ে। কৌতুহলে
এগিয়ে গিয়ে দেখি প্রাচীন এক মনাস্ট্রির ভগ্নস্তুপ। দেওয়ালে আঁকা নানারঙের ছবি,
ইয়াকের শিং-এর লিখন, রঙিন কাপড়ের টুকরো দেখে চেনা যায়। নির্জন প্রান্তরের মাঝে
মেঘছায়া আকাশের নীচে প্রাচীন এই মনাস্ট্রির ভগ্নস্তুপ দেখতে দেখতে বেশ অদ্ভুত একটা
অনুভূতি হচ্ছিল।
হট ওয়াটার স্প্রিং ঘুরে দিরাং আপার মনাস্ট্রিতে পৌঁছালাম।
পথে পড়ল দিরাং ট্যুরিস্ট লজ আর হোটেল। এটা মূল জনবসতি থেকে বেশকিছুটা ওপরে। এখান
থেকে পুরো উপত্যকাটা ঠিক ছবির মতো দেখায়। মনাস্ট্রিতে প্রবেশের আগে আগে একপাশে
বাটার ল্যাম্প টেম্পল। কারুকার্যময় মনাস্ট্রির অভ্যন্তরে মুল বুদ্ধমূর্তির ডানপাশে
গুরু পদ্মসম্ভব এবং বাঁদিকে অমিতায়ুস বুদ্ধমূর্তি। সন্ধ্যার প্রার্থনায় বসেছেন দুই
লামা সন্ন্যাসী। ধূপের মিস্টি গন্ধের মাদকতায়, মন্ত্রধ্বনির ভাবগম্ভীর পরিবেশে
মনটাও কেমন আশ্চর্যরকম শান্ত হয়ে আসে। মন্ত্র পড়তে পড়তেই ড্রামের মতো
বাদ্যযন্ত্রটিতে লাঠি দিয়ে আঘাত করেন সন্ন্যাসী। গুরুগম্ভীর দ্রিম দ্রিম শব্দ
মনাস্ট্রির অভ্যন্তরে পাক খেয়ে খেয়ে ছড়িয়ে যায় বাইরের প্রাঙ্গণে। সন্ধ্যা নেমে
আসে।
পরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ি তাওয়াং-এর পথে। আসার সময় বাজার
চত্ত্বরে খাবারের খোঁজে ঢুকতে আবার দেখা হয়ে যায় ক্যাপ্টেন আর তাঁর সঙ্গী জওয়ান
ভাইদের সঙ্গে। আরেকপ্রস্থ আলাপ জমে উঠতে সময় লাগেনা। পথে আসতে আসতে মনে পড়ছিল
সতনাম সিং-এর কথা, জওয়ানদের জীবনকথা...। ওয়ার মেমোরিয়াল পেরিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলে।
নীল আকাশের নীচে পাহাড়ি পথের বাঁকে সেই লেখাটি আবার চোখে পড়ে –
“When
you go home tell them of us and say for your tomorrow we gave our today”
অনেক
পিছনে মেমোরিয়ালের বাগানে হলুদ-কমলা রঙের গাঁদাগুলো মনকেমনের মৃদু বাতাসে দুলতে
থাকে...।
অদ্বিতীয়া - জানুয়ারি ২০১৬
আমার বেনারস
‘দশাশ্বমেধ ঘাটে বিজয়াদশমী দেখেছেন কখনও?’
‘উহুঁ’
‘ওঃ – সে যা ব্যাপার না। সে এক, যাকে বলে জমজমাট
ব্যাপার। সে মশাই আপনি না দেখলে ইয়েই করতে পারবেন না।’... ‘দশাশ্বমেধ ঘাটের ভাসান দেখে চোখ-কান ধাঁধিয়ে গেসল।’
কথাটা হচ্ছিল লালমোহনবাবু আর ফেলুদার মধ্যে। আমরা যে কখন ঢুকে পড়লাম কে জানে!
টের পেলাম নবমীর সকালে যখন নো এন্ট্রির অটোয় বসে প্রচুর চক্কর খেতে খেতে
লালমোহনবাবুর ভাষায় ‘জমজমাট’ বেনারসের ততোধিক জমজমাট গোধুলিয়ায় এসে পৌঁছালাম। দশ মিনিট
দূরেই লাক্সায় গঙ্গা ট্যুরিস্ট লজ, আমাদের গন্তব্য।
পুজোয়
কলকাতার ভিড় থেকে পালিয়ে বেড়াতে যাওয়া মানেই সমুদ্র, পাহাড়, অরণ্য – কিছুটা নির্জনতা খোঁজা।
কিন্তু জনঅরণ্যেও যে হারিয়ে যাওয়া যায় সে এক কাশীতে না এলে বোঝা যেত না। বেনারসের
একটা নিজস্ব চরিত্র আছে, রূপ-রস-গন্ধ। অন্য কোথাও বেড়াতে গেলে ভিড়টা অসহ্য ঠেকে,
অথচ নানামানুষের এই জনস্রোতটাই বেনারসের প্রাণ।
এবার
পুজো বেশ আগে। আজ সেপ্টেম্বরের সাতাশ। উরেব্বাস, ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর আর কাকে বলে!
বাইরে বেরোলেই স্রেফ বেগুনপোড়া। সত্যি, ২০০৯-এর পুজোয় এলে ফেলুদাকে চাদরমুড়ি দিয়ে
নয়, স্রেফ ছাতা মাথায় দিয়ে ঘামতে ঘামতে গোয়েন্দাগিরি করতে হত। রোদ পড়লে বিকেলবেলায়
দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে বেরিয়ে পড়ি সদলবলে। রাস্তায় অসংখ্য মানুষ, ততোধিক যানবাহন – রিকশা, অটো, স্কুটার,
মোটরসাইকেল, তার ওপরে বিশাল বিশাল ষাঁড় আর গরু – যে যার মতো চলেছে। আমরাও
পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলি।
গোধুলিয়া
থেকে দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে যেতে টিপিক্যাল কতগুলো গন্ধ নাকে আসে – এটাও বেনারসের বৈশিষ্ট্য।
ফেলুদার ভাষাতেই বলি, ‘বিশ্বনাথের গলির ধূপধুনো গোবর শ্যাওলা লোকের ঘাম মেশানো
গন্ধ, আবার গলি ছেড়ে বাইরে এসে বড় রাস্তা দিয়ে ঘাটের দিকে হাঁটার সময় কিছুক্ষণ
একটা নিউট্রাল গন্ধহীন অবস্থা, আবার ঘাটের সিঁড়ি যেই শুরু হল অমনি ধাপে ধাপে একটা
উগ্র গন্ধ ক্রমে বেড়ে গিয়ে প্রায় পেটের ভাত উলটে আসার অবস্থা। সেটা যে ওই বোকা
পাঁঠাগুলোর গা থেকে বেরচ্ছে সেটা যে না জানে তার বুঝতে কিছুটা সময় লাগবে। তারপর
ছাগলগুলোকে পিছনে ফেলে একটু এগোলেই পাবেন একটা গন্ধ যাতে জল মাটি তেল ঘি ফুল চন্দন
ধূপ ধুনো সব একসঙ্গে মিশে রয়েছে।’ ঘাটের কাছে অবশ্য বোকা পাঁঠা
তেমন নজরে পড়ল না, তাই সেই বিকট গন্ধটাও নেই, তবে বেনারসের যে সত্যিই নিজস্ব
অদ্ভুত সব গন্ধ আছে তা ঘাট আর অলিগলিগুলোতে খানিক ঘুরলেই বেশ ঠাওর হয়।
দশাশ্বমেধ
ঘাটের বর্ণনা দিতে বসে আমিও লালমোহনবাবুর মতো ‘জমজমাট’-এ আটকে যাচ্ছি। তোপসের মতো
গুনিনি অবশ্য, তবে এত বিচিত্র মানুষ এতরকম কাজে ব্যস্ত যেন অজস্র টুকরো টুকরো ছবি গেঁথে
আস্ত একটা ছবি গড়ে উঠছে। ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে একেবারে জল অবধি নেমে আসা যায়। জলের
কাছে ঘাটের ওপর নিচু নিচু তক্তা পাতা। তক্তার উপরে, আশপাশে ইতস্তত বড়ো বড়ো ছাতার
আড়ালে সাধু-সন্ন্যাসী, পুণ্যার্থী থেকে নিছক পর্যটক সবাই রোদের থেকে মাথা বাঁচাচ্ছেন।
ঘাটের সামনে আরতির বেদিগুলোর উপরে হলুদ রঙের পতাকা উড়ছে। অনেকেই স্নান করছেন জলে।
ভিজে ঘাটের ওপর আরাম করে শুয়ে একটা বড়োসড়ো গোরু। ঘাটে একটা বুরুজের তলায় প্রাচীন শিবমন্দির।
বুরুজের মাথায় দু-তিনজন শুয়ে-বসে রয়েছে। কয়েকধাপ সিঁড়ি উঠে রেলিঙে ঘেরা কিছুটা
জায়গা রয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়েও গঙ্গার শোভা দেখা যায়। কানে ভেসে আসে হরিহরের
কথকতা...।
দশাশ্বমেধের
লাগোয়া বাঁয়ে রাজেন্দ্রপ্রসাদ ঘাট। এখানে বড়ো বড়ো থামের গায়ে হাতে আঁকা মা গঙ্গা,
শিবের ছবি। ঘাটগুলোর এখানে সেখানে নানান বিজ্ঞাপন আঁটা – ভোদাফোন, কোকাকলা, পিঙ্কি
সিল্ক আরও কত কী। ঘাটের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে উত্তরদিকে তাকালে রেলের ব্রিজটা দেখা যায়।
পূর্বদিকে নদীর ওপারে রামনগর ফোর্ট। ১৭ শতকের রাজবাড়ি। বর্তমানে মিউজিয়াম।
রাজেন্দ্রপ্রসাদ ঘাটের ঠিক পরেই মানমন্দির ঘাট। ঘাটের ওপরেই মানমন্দির। তার ছাদে চারশো বছর আগে রাজা জয়সিংহের তৈরি
যন্তর-মন্তর। এইখানেই আশপাশে কোথাও ঘোষালদের বাড়িটা... চোখে দেখে আন্দাজ করার
চেষ্টা করি।
মানমন্দিরের
দোতলার জানলা দিয়ে নীচে তাকালে নদীর বুকে নৌকোর মেলা। জলে ইতস্তত ভেসে থাকা
নৌকোগুলো দেখতে ভারি চমৎকার লাগে। ছাদে এতকাল আগের সূর্যঘড়ি থেকে শুরু করে
সিমেন্টের তৈরি জ্যোতির্বিজ্ঞানের হরেক যন্ত্রপাতিগুলো দেখলে সত্যিই অবাক হতে হয়।
তবে এখানে বাঁদরের উৎপাত মারাত্মক। আমাদের সিচুয়েশনটা অনেকটা ওদের এলাকায়
বহিরাগতের মতো। চান্স পেলেই দিব্যি দাঁত খিঁচোচ্ছে। ফেলুদার গল্পে দুর্গামন্দিরে
বাঁদরের উৎপাতের কথা পড়েছিলাম। বরং সেখানেই তাদের দর্শন পাইনি। আর এখানে একেকজন
একাই একশো। দু-চারবার কোণঠাসা হয়ে আমারও স্রেফ জটায়ুর মতই মনে হচ্ছিল – ‘ব্যাসদেব, থুড়ি বাল্মীকিদেব
যে কেন জানোয়ারটাকে জাতে তুলেছেন তা আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম না। যারা লাঠির খোঁচা
না খেয়ে নাচতে পারেনা তারা করবে সেতুবন্ধন? ছোঃ!’ আর সেই লাঠিই শেষপর্যন্ত আমাদের সহায় হল। পড়ে থাকা একটা
বংশদণ্ড হাতে নিয়ে বীরের মতো এগিয়ে যায় বীরেন। আমরা পিছু নিই। এর মধ্যেই একটা অদ্ভুত
ঘটনা ঘটল। দীপের ক্যামেরা তাক করা দেখে একটা বাচ্চা বাঁদর ভিরমি খেয়ে কার্নিস থেকে
নীচে উলটে পড়ছিল আরকী। মা বাঁদরটা মুহূর্তে লাফ দিয়ে একেবারে বাউন্ডারিতে ক্যাচ
লোফার মতো শূন্যে লুফে নিল বাচ্চাটাকে। সত্যি, একেই বলে মা। অত উঁচু থেকে পড়লে হয়ত
মারাই যেত বাচ্চাটা, কে জানে! তবে ক্যাচ লোফার দিক থেকে ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিমের
যেকোন ফিল্ডারকে ও যে হার মানাত সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
‘বুঝলি, সিনেমায় এই মানমন্দিরের ছাদেই বিকাশকে
ধরেছিল ফেলুদা।’ – গলার আওয়াজ পেয়ে পিছন ফিরে দেখি বু বেশ মন দিয়ে বোঝাচ্ছে
বুইকে। আমার মেয়ের আবার বার্বি পছন্দ। ফেলুদা বেশ কয়েকটা পড়েছে, তবে সিনেমা দেখার
আগ্রহটা এখনও হয়নি। তাই বু-র সঙ্গে ঠিক পাল্লাটা দিতে পারছেনা।
একেবারে
ওপরের ছাদটায় উঠে ডায়েরিটা নিয়ে একটা কোণে বসে পড়ি। টুসি ভিডিও ক্যামেরায় ছবি তুলতে
মগ্ন হয়ে আছে। রেলিং-এর ফাঁক দিয়ে নীচের দিকে তাকাই...এই যে একেকটা মুহূর্ত...সামনে
গঙ্গা, নৌকোর সারি, ঘাটে ব্যস্ত মানুষজন, ফেলুদা, তোপসে, জটায়ু, অপু, হরিহর,
সর্বজয়া...সবমিলিয়ে একটা ছবি...কল্পনা বাস্তব মিলে মিশে এক হয়ে যায়। এর ভিতরেও
রয়েছি আমি, আবার যেন নিছক দর্শক।
বেনারসের
ঘাটগুলো সব গায়ে গায়ে। যেন একটা ঘাটেরই এক্সটেনশন, শুধু নামগুলো বদলে বদলে গেছে। দশাশ্বমেধ
ঘাটের দক্ষিণে ঠিক পরের ঘাটটাই মুনশিঘাট, লাগোয়া রাজাঘাট। মুনশিঘাট দিয়ে ওপরে উঠতে
গেলে অনেকগুলো সিঁড়ি ভাঙতে হয়। সিঁড়ি ভেঙে উঠে বাঁয়ের বাড়িটাই দ্বারভাঙার রাজবাড়ি,
সিনেমায় যেটা মছলিবাবার আড্ডা। এখানেই ফেলুদা লুকিয়ে এসে মছলিবাবার বাক্স থেকে
রিভলবার আর ছদ্মবেশ উদ্ধার করেছিল। আগেরবার এসে বাড়িটায় ঢুকেছিলাম, বীরেন বলে।
আমরাও খুঁজে-পেতে দরজার দিকে যাই। দোরগোড়াতেই শুনতে পাই, ঝাঁ-চকচকে আধুনিক হোটেল
হতে চলেছে এই বাড়ি, চলছে ভাঙাচোরা-মেরামতির কাজ, ভিতরে ঢোকবার অনুমতি নেই। মনটা
খারাপ হয়ে যায়। এর আগে দু-চারজন বয়স্ক মানুষকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে অনেকদিন আগে
এখানে একটা বাংলা সিনেমার শুটিং হয়েছিল...। নাহ্, ঠিক কোথায় ‘লাগা চুনরিমে দাগ’ সিনেমায় রানি মুখার্জি
নেচেছিলেন তা অনেকেই দেখিয়ে দিলেন, কিন্তু হায় সত্যজিত!
আমরা
অবশ্য হাল ছাড়ি না, নিজেরাই খুঁজে বার করি কোন গলিটা দিয়ে ফেলুদা হেঁটে গিয়েছিল।
বীরেনতো পরে একদিন দীপকে সেই গলি দিয়ে হাঁটিয়ে দিব্যি একটা শুটই করে ফেলল। আমাদের
মধ্যে রীতিমতো তর্ক জমে ওঠে - তোপসে আর লালমোহনবাবু সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে এই
বুরুজটায় বসেছিল, না কি ওইটায়...। বেনারসের ঘাটে মাঝে মাঝেই একরকম আটকোনা বুরুজ
রয়েছে। যার ওপর ভোরবেলায় পায়রারা দলবেঁধে দানা খায়, পান্ডারা বসে, পালোয়ানেরা
মুগুর ভাঁজে, সাধারণ লোকে শুয়ে-বসে গঙ্গার শোভা দেখে। এখানেই মছলিবাবা দর্শন দিতেন
– মুনশিঘাটের একজায়গায় আঙুল
দেখিয়ে বেশ কনফিডেন্টলি ঢিল ছুঁড়ি। কী আশ্চর্য! বাকিরাও একমত। কানে যেন কোথা থেকে
ভেসে আসে, ‘মোহে লাগি লগন গুরু চরনন কী’। জায়গাটার একপাশে এখন একটা
শিবমন্দির হয়েছে। তার চাতালে ঊঠে বসে বীরেন। সামনে রাখা একটা ভাঙা নৌকোয় চড়ে বসি
আমি, বুই আর বু। শুকনো ডাঙায় নৌকোয় উঠে কল্পনার নৌকো ভাসিয়ে দেয় ছোটোরা। টুসি আর
দীপ ছবি তুলছিল। ওরা ফিরে এলে মগনলাল মেঘরাজের বজরা ঠিক কোনখান দিয়ে এসে ঘাটে
লেগেছিল তাই নিয়ে আমাদের আবার আরেকদফা রিসার্চটা জমে ওঠে।
একটুক্ষণ
আড্ডা দিয়ে দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে ফিরে চলি। সব ঘাটেই মাঝিরা ডাকাডাকি করছে নৌকোর
ট্রিপের জন্য। পরে একদিন ভালো করে ঘোরা যাবে, আজ বিকেলে অল্প করেই হয়ে যাক। সত্যি,
বেনারসে এসেও নৌকোয় চাপার মজাটা থেকেই বেচারা ফেলুদা-তোপসেরা বঞ্চিত – কী গল্পে, কী সিনেমায়।
গঙ্গায় ভেসে পড়ে বেশ খারাপই লাগছিল, বিশেষ করে জটায়ুর কথা ভেবে। দিগন্তবিস্তৃত গঙ্গার
বুকে বসে ঘাটের বয়ে যাওয়া জীবনের দিকে তাকিয়ে কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল।
দুনিয়াটা বদলে গেলেও কাশী, কাশীই থাকবে। না, এটা অভয় চক্রবর্তীর কথা নয়। একেবারে
সত্যি সত্যিই মনে হল – বিভূতিভূষণের বেনারস, সত্যজিতের বেনারস, আমার দেখা পাঁচবছর
আগের বেনারস, আজকের বেনারস কোথায় যেন একইরকম রয়ে গেছে। হয়তো অনেকবছর পর এই অনুভূতিটা
আমার মেয়েরও হবে। কে জানে!
মণিকর্ণিকা
ঘাটের দিকে নৌকো ভেসে চলে। মাঝি হিন্দিতে গল্প শোনায়, দুর্গার মণি আর কুণ্ডল পড়ে
গিয়েছিল, কিছুতেই আর খুঁজে পাননা...। ওপরে-নিচে মিলিয়ে চার-পাঁচটা চিতা জ্বলছে।
শোকসন্তপ্ত মানুষগুলোর মধ্যে কোথাও হয়তো আছে অপু আর সর্বজয়াও... কী জানি... চিতার
আগুন-ধোঁয়া, গঙ্গার বুকে সন্ধ্যার রাঙা আলো নিবে আসা, মাঝির গলার একঘেঁয়ে সুর – সবমিলিয়ে মনটা কেমন একটা
হয়ে যায়। শ্মশানের একটু ওপরে একটা ছোট ঘেরা জায়গায় আগুন জ্বলছে – গল্পকথার সেই অনির্বান
অগ্নিশিখা। একটুদূরে একপাশে এক সাধুবাবা উদাসীন দৃষ্টিতে বসে রয়েছেন। আগুনের আভা
পড়ছে তাঁর মুখের রেখার আঁকিবুকিতে। মাঝির গলা কানে আসে, ওই যে আগুন দেখছে, দেবী
দুর্গার ক্রোধ থেকে ওই আগুনের সৃষ্টি। এই আগুন কখনো নেবে না। ওখান থেকেই সব চিতায়
আগুন দেওয়া হয়...। শ্মশানঘাটের ঠিক পরেই জলে অর্ধেক ডোবা হেলে পড়া মন্দিরটা। এই
মন্দিরটারও একটা গল্প আছে। মন্দির তৈরি করে পুত্র বলেছিল, মাতৃঋণ শোধ করলাম। সঙ্গে
সঙ্গে মন্দিরটি হেলে গিয়ে জলে ডুবে যায়।
ললিতা
ঘাটের ঠিক ওপরেই বৌদ্ধ মনাস্ট্রির আদলে ভারি সুন্দর একটা নেপালি মন্দির আছে। ঘাটের
ঠিক সামনে দেখি বড়োসড়ো একটা খালি বজরা দাঁড়িয়ে আছে। আরে, এ তো মগনলালের বজরা, আমরা
চেঁচিয়ে উঠি। দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে ফিরে আসতেই দেখি গঙ্গার তীরে সন্ধ্যা আরতির
আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। লোকজনের ভিড়ও বাড়ছে ঘাটে।
সন্ধের
গঙ্গার বুকে ফুল-প্রদীপের ভেলা ভাসে। ছোটো শালপাতার পাত্রে অল্প ফুল আর প্রদীপের
পসরা নিয়ে ঘাটের ওপর বসেছে দোকানিরা। নৌকোয় ওঠার আগে বু আর বুইয়ের জন্যও কেনা
হয়েছিল। ফেরার পথে নৌকো থেকে হাত বাড়িয়ে জলে ভাসায় ওরা। হাওয়ায় প্রদীপ নিবে যায়।
তবু ভারি খুশি দুজনে।
আরতি
দর্শনের আগে অনেকেই স্নান করতে নেমেছেন জলে। নারী-পুরুষ সবাই বাবা বিশ্বনাথের নাম
নিয়ে ঝুপ ঝুপ করে ডুব দিচ্ছেন। ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে আরতি দেখি। ফেলুদার সময়
অবশ্য বেনারসের গঙ্গাতীরে আরতি হত না। পরে হরিদ্বা্রের আদলে এখানে আরতি চালু হয়।
সোনালি রঙের পাঞ্জাবি, সাদা ধুতি আর সাদা উত্তরীয়তে সেজে গঙ্গার তীরে সার ধরে নির্দিষ্ট
দূরত্বে দাঁড়িয়ে আরতি শুরু করেন পুজারিরা। একহাতে ঘন্টা আর অন্যহাতে প্রথমে ধূপ ও
পরে প্রদীপ নিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে খানিক নাচের ভঙ্গিতে আরতি চলে। গঙ্গার
বুকে-পাড়ে পুণ্যার্থী, দর্শনার্থী আর কৌতুহলী মানুষের জনারণ্য। নদীর বুক থেকে এই
আরতি দেখতে বেশ ভালোলাগে। যদিও আমার পুরো ব্যাপারটাকে বড়ো বেশি সাজানো-গোছানো কৃত্রিম
বলে মনে হল – স্রেফ ট্যুরিস্ট অ্যাট্রাকশনের একটা ইভেন্ট।
বিশ্বনাথের
গলির চত্বরটায় বেশ কয়েকটা মসলার দোকান আছে। বেনারস মানেইতো পান, মশলা, আতর, মালাই,
রাবড়ি, পুরি, কচুরি। দাশগুপ্তর জর্দার দোকান থেকে দু-তিনরকম মসলা কেনা হল। বেনারসে
নানারকম পাথরের খুব সুন্দর সুন্দর মালা পাওয়া যায়। বিকেলে ঘাটে বিক্রি হতে দেখেছি।
তবে দশাশ্বমেধে ঢোকার কিছুটা আগে রাস্তার ধারে যে বড়ো দোকানগুলো আছে সেগুলোতে স্টক
প্রচুর। গোধুলিয়া মোড়ের মাথায় পরপর কতগুলো মালাইয়ের দোকান। সদলবলে ঢুকে পড়ি একটায়
কেশরিয়া মালাইয়ের স্বাদ নিতে। নবমীর রাতে কলকাতার পুজোর মতোই ভিড়ে ঠাসা রাস্তা।
ভিড় কাটিয়ে হোটেলের দিকে এগোই।
কাশীর
রাস্তাঘাট ঠিক যেন গোলকধাঁধাঁ। যত মানুষ, তত গলি, আর তার চেয়েও বেশি দোকানপাট।
হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ,জৈন, বিদেশি, সাধু, পর্যটক, ভিখারি – বিচিত্র মানুষের ভিড়ে যেন
ছোটখাট একটা ভারতবর্ষই। ‘বেনারসের একটা ভেল্কি আছে যার ফলে শহরটা নোংরা হয়েও ঐতিহ্যে
ঝলমল করতে থাকে। যারা এখানে বসবাস করে তারা দিন গুজরানের চিন্তায় আর এসব কথা
ভাববার সময় পায়না, কিন্তু যারা কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে আসে তারা এইসব ভেবেই মশগুল
হয়ে থাকে’ – দশমীর সকালে ভিড়ে ঠাসা বেনারসের রাস্তায় মানুষ, গোরু,
ষাঁড়, সাইকেল, মোটরসাইকেল বাঁচিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফেলুদার কথাটাই মনে হচ্ছিল। তাওতো
এখনো তেমন বেলাই হয়নি।
বেনারসের
অলিগলিতে না ঘুরলে এখানকার মেজাজটা ঠিক টের পাওয়া যায়না। প্রায়-অন্ধকার সংকীর্ণ
রাস্তা, দুধারে অজস্র দোকানপাট, মাঝেমধ্যে প্রাচীন মন্দির, কাদা প্যাচপ্যাচে
রাস্তায় ব্যস্ত মানুষজন, বিদেশিদের ঘরাফেরা। এর মধ্যেই স্কুটার, মোটরসাইকেলের পাশ
কাটানো, গলিজুড়ে নির্ভিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা বিশালকার ষাঁড় (পাশ কাটিয়ে চলতে
গেলে লেজের ঝাপট খাওয়ার চান্স আছে), গোরু, গোবর আর গলির একেক অংশে একেকরকম বিচিত্র
গন্ধ। রাস্তার দুদিকের দেয়ালে মাঝে মাঝে হাতে আঁকা হাতি, ঘোড়া, বাঘ, টিয়া,
ঘোড়সওয়ারের ছবি, কোথাওবা বিজ্ঞাপন আঁটা। দুপাশের বাড়িগুলোর অধিকাংশই বেশ প্রাচীন।
মনে হচ্ছিল যেন ফিরে গেছি অনেকবছর আগে... যেন এতবছর পরেও কাশী সেই একই আছে... কোন
গলির মুখে হয়তো দেখা হয়ে যেতে পারে বালক অপুর সঙ্গেও।
বিশ্বনাথের
গলিতে ঢোকার মুখে খাবারের দোকানগুলো পেরোলে কাঠের খেলনা, পিতল, পাথরের জিনিসপত্রের
হরেক দোকান। গলির দুপাশেও পসরা নিয়ে বসেছে দোকানিরা। তেমনই একটা দোকানে রাখা
গামলার জলে ঘুরছে খেলনা জাহাজ। সিনেমাতে ঠিক এরকম একটা শট আছে, বলে উঠি। গলির আরও
ভিতরে ফুল, সিঁদুর, পুজোর সাজিওলা দোকানগুলো। মানুষের ভিড়, পান্ডা আর দোকানদারদের
হাঁকাহাঁকি। ভিড়ের ঠেলা খেতে খেতে এগিয়ে চলা। মন্দিরের সোনার চুড়ো সকালবেলার রোদে
ঝলমল করছে। কাছাকাছি পৌঁছে একটা দোকানে জুতো জমা রেখে ফুলের সাজি নিয়ে মন্দিরের
দিকে এগোই। ঈশ্বর বিশ্বাস আমার নেই। কিন্তু ভারতবর্ষকে প্রকৃত জানতে হলেতো তার মতো
করেই জানতে হবে। মন্দিরচত্বরে নিরাপত্তারক্ষীদের বেশ কড়াকড়ি। এখানে লাইনটা অনেকটা
সুশৃঙ্খ্লভাবে এগোয়। পায়ে পায়ে পৌঁছে যাই মন্দিরের অন্দরে। হাতের সাজি দিতে না দিতেই
ছোঁ মেরে নিয়ে নেয় বিশ্বনাথের সেবায়েত পান্ডাঠাকুর। অল্প ফুল আর প্রসাদের একটা
প্যাকেট ফেরত আসে। ধ্যাবড়া একটা সিঁদুরের টিপ লেপে যায় কপালে। তবে এরমধ্যেই
বাচ্চাদের ডেকে নিয়ে ফুল-পাতা মোড়া বিশ্বনাথকে স্পর্শ করিয়ে দেন পান্ডাঠাকুর। পিছন
থেকে ঠেলা খাই। পান্ডাও তাড়া দেন, এগোন, এগোন, দাঁড়াবেন না। সামনে প্রণামির থালায়
টাকাপয়সা জমতে থাকে।
বিশ্বনাথের
মন্দিরের স্থাপত্য সৌন্দর্যও দেখার মতো। পাশেই ঔরঙ্গজেবের মসজিদ। মসজিদ পেরিয়ে
মস্তবড় চাতাল, একপাশে জ্ঞানের কূপ জ্ঞানবাপী। এই কূপকে ঘিরেও নানান গল্প আছে।
চাতালে পুজোর ফুল, সিঁদুরের পসরা নিয়ে দোকানিরা বসে রয়েছে। বাঁহাতে কয়েকধাপ সিঁড়ি
দিয়ে উঠে একটা বারান্দাওলা ঘর। বারান্দায় মস্তবড়ো একটা কাকাতুয়া দাঁড়ে বসে গোল গোল
চোখে আমাদের দেখছে। এই জ্ঞানবাপীতেই মগনলালের লোক অপেক্ষা করছিল ফেলুদার জন্য।
ফেলুদার পিছন পিছন আমরাও এগোই। নাহ্, মগনলালের বাড়ির দিকে নয়। অলি গলি চলি রাম করে
পৌঁছে গেলাম ললিতা ঘাটে। এর মধ্যে অবশ্য একটা ব্রেক নিয়ে কচুরি-তরকারি-মিষ্টি দিয়ে
সকালের জলখাবার সারা হয়েছে। আসার পথে বেশ কয়েকটা জামাকাপড়ের দোকান নজরে পড়ল।
হিপিরা যেমন ঢোলা পাজামা টাইপের প্যান্ট আর ঢোলা হাতকাটা জামা পরে, সেরকম প্রচুর
বিক্রি হচ্ছে। তবে এই জামাতো এখন ইউনিভার্সাল, মেয়ের জন্যও একটা কিনে ফেলি। আর
ব্যাগের দোকানে নানা-রকমের কাপড়ের ঝোলা আর বাহারি ব্যাগ। ললিতা ঘাটের নেপালি
মন্দিরের জায়গাটা বেশ নির্জন। ভারি ভালো লাগল। মন্দিরের চাতালে ছায়া দেখে বসে পড়ি।
বেশ কড়া রোদ্দুর উঠেছে। গঙ্গার দিক থেকে ঝিরঝিরে হাওয়া বইছে। জলের ওপর রোদ পড়ে
ঝিলমিল করছে।
আজ
বিজয়াদশমী। শেষবিকেল থেকেই হোটেলের সামনে দিয়ে একের পর এক ভাসান যাচ্ছে। রাস্তাটা
মানুষে মানুষে একেবারে ছয়লাপ। একটু সন্ধে করেই বেরোলাম দশাশ্বমেধ ঘাটে ভাসান দেখার
জন্য। প্রচণ্ড ভিড়ে ধাক্কা না খেয়ে চলাটাই শক্ত। হেদুয়ার বাড়ির সামনে দিয়ে ভাসান
যাওয়ার কথা মনে পড়ছিল। এখানে ভাসানের দৃশ্যটা আরও ঝলমলে আর জমকালো। লালমোহনবাবুর
ভাষায় বললে, চোখ-কান আমার ধাঁধিয়ে গেসলই বটে। মেয়ের হাত ধরে মুগ্ধ দৃষ্টিতে ঠাকুর
বিসর্জনের এই ‘জমজমাট’ দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে গেছি...।
হঠাৎ তাকিয়ে দেখি বাকিরা কেউ নেই। এদিকে মোবাইলে টাওয়ারও পাচ্ছি না। কী ঝামেলা! কী
আর করি ভিড়ের স্রোতে ভেসেই পৌঁছে গেলাম গোধুলিয়া। ভাবলাম একান্তই যদি খুঁজে না পাই
তাহলে আবার হোটেলেই ফিরে যাব। ঠিক তখনি দেখি ভীষণ গম্ভীর মুখ করে দীপ আমাদের
খোঁজাখুঁজি করছে। যাই হোক মধুরেণ মানে রাবড়ির ভাঁড় হাতে নিয়ে সমাপয়েত হল – কিঞ্চিৎ কথা কাটাকাটির পর।
আসলে ওদের ধারণা যে আমরা দুজন হারিয়ে গিয়েছিলাম। আমার ধারণাটা অবশ্য ঠিক উলটো।
আমরা ঠিকই যাচ্ছিলাম, ওরাই চারজনে হারিয়ে গিয়েছিল। দলে কম বলে আমরা হারিয়ে গেছি তা
মেনে নিতে হবে, এ আবার কী কথা! জীবনে সবকিছুইতো আপেক্ষিক, ম্যয় হারিয়ে যাওয়াটাও।
লালমোহনবাবু থাকলে নিশ্চয় আমাকেই সাপোর্ট করতেন। আমি এক্কেবারে স্যিওর।
দশাশ্বমেধের
দিকে যত এগোচ্ছি ভিড় ততই বাড়ছে। ভিড়ের মধ্যেই স্কুটার, মটোরসাইকেলের আরোহিরা হর্ন
দিয়ে দিয়ে এগনোর চেষ্টা করছে। ভাগ্যিস ষাঁড় আর গোরুগুলো সন্ধ্যেবেলায় বিশ্রাম নেয়।
নইলে আর রক্ষে ছিল না। তবে শেষপর্যন্ত ঘাট অবধি আর যাওয়া হল না। এই ভিড়ে বাচ্চা-বড়
সকলেরই বেশ কাহিল অবস্থা। তাই ফিরে যাওয়াই ঠিক হল। তবে দশাশ্বমেধ ঘাটের বিসর্জনটা
একেবারে মিস করিনি – সেই দারুণ অভিজ্ঞতা হল পরেরদিন।
একটা কথা
আছে – বেনারসকা সুবা ঔর লখনউকা সাম। সত্যি ভোরবেলায় দশাশ্বমেধ ঘাটে না এলে এই অনুভূতিটা
ঠিক বুঝতে পারতাম না। এত ভোরেও অনেকে স্নান করছেন। স্নানটান সেরে যত্ন করে কপালে
তিলক কাটছে বোষ্টুমি, ঘাটের কাছাকাছিই একটা নৌকোয় এক বালিকার মানতের চুল কামানো
হচ্ছে। ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে ঊঠে যাচ্ছেন শিববেশী সাধু। ঘাটের কাছে কোমর জলে দাঁড়িয়ে
দুই বিদেশিনি এ-ওর দিকে জল ছুঁড়ে হেসে গড়িয়ে পড়ছেন। এঁরা চিনা বা জাপানি। ঘাটের
ওপরে হাতে-পিঠে বিচিত্র উল্কি আঁকা দুই আমেরিকান মহিলা। একটা বুরুজের মাথায় পায়রার
ঝাঁক দানা খাচ্ছে – জয়বাবা ফেলুনাথের প্রথম আর শেষ দৃশ্যের কথা মনে পড়িয়ে দিল।
আমাদের আগেই বেশ কয়েকটা নৌকো যাত্রী নিয়ে ভেসে পড়েছে। আমাদেরও আজ নৌকোভ্রমণ,
মণিকর্ণিকা থেকে তুলসীঘাট পর্যন্ত।
ভাসানের
রেশ এখনও কাটেনি। সকালবেলাতেই বিসর্জনের কাঁসর-ঘন্টা বাজিয়ে বেশ কয়েকটা
দুর্গাপ্রতিমা এসে পৌঁছেচে ঘাটে। মা দুর্গার মুখে ভোরের হলুদ আভা কেমন একটা
মায়াময়তার সৃষ্টি করেছে। যেন মাটির প্রতিমা নয় আমাদের ঘরের সেই চির পরিচিত মেয়েটা
চলল অজানা জীবনের দিকে। কেমন মনখারাপ হয়ে গেল। গতকালের বিসর্জনের ইতস্তত কাঠামো,
মালা, ফুল এখনও জলের এদিকে-ওদিকে ভাসছে; ঘাটের কিনারায় আটকে রয়েছে। সেগুলোকে ঘিরে
অর্ধনগ্ন শিশুর দল। বড়সড়ো একটা সিংহের মাথা ঠিক আমাদের নৌকোর পাশেই। কে জানে, ওটাই
ঘোষালবাড়ির সিংহটা কী না, যার মুখের মধ্যে গণেশের মূর্তিটা আটকেছিল ক্যাপ্টেন
স্পার্ক থুড়ি রুকু! সপরিবারে মা দুর্গাকে ঘাট থেকে তোলা হচ্ছে নৌকোয়। সেই নৌকো
কিছুটা জলের গভীরে নিয়ে গিয়ে একে একে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রতিমাগুলো। আফ্রিকার
রাজাকে সঙ্গে নিয়ে আটলান্টিসে চললেন মা দুর্গা। আমরাও ভেসে পড়ি গঙ্গায়।
বি দ্রঃ বাড়ি ফিরে এসে ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ আর ‘সোনার কেল্লা’ দেখার পর এখন শুধু একের পর এক ফেলুদাই পড়ে চলেছে বুই। আর
থেকে থেকেই ফেলুদাকে নিয়ে যা পরীক্ষা নিচ্ছে তাতে আমাদের একেবারে নাজেহাল অবস্থা।
'ট্রাভেল ছুটি'
গডউইনের সমাধির খোঁজে
“আমরা তিনজন ঘাস-গজিয়ে যাওয়া
বাঁধানো রাস্তাটা দিয়ে এগিয়ে গেলাম। দু’দিকে সমাধির সারি – তার এক-একটা বারো-চোদ্দ হাত
উঁচু। ডাইনে কিছু দূরে একটা সমাধি প্রায় তিনতলা বাড়ির সমান উঁচু। ফেলুদা বলল, ‘ওটা খুব সম্ভবত পন্ডিত
উইলিয়াম জোনস-এর সমাধি, ওর চেয়ে উঁচু সমাধি নাকি কলকাতায় আর নেই।’
প্রত্যেকটা সমাধির গায়ে সাদা কিম্বা কালো মার্বেল ফলকে মৃতব্যক্তির নাম,
জন্মের তারিখ, আর মৃত্যুর তারিখ, আর সেই সঙ্গে আরও কিছু লেখা। কয়েকটা বড় ফলকে
দেখলাম অল্প কথায় জীবনী পর্যন্ত লেখা রয়েছে। বেশির ভাগ সমাধিই চারকোনা থামের মতো,
নীচে চওড়া থেকে উপরে সরু হয়ে উঠেছে। ... ‘এই স্তম্ভগুলোর ইংরিজি নামটা জেনে রাখ তোপসে।
একে বলে ওবেলিক্স।’ ডান-দিক চোখ ঘোরাচ্ছি আর ফলকের নামগুলো বিড়বিড় করছি – জ্যাকসন, ওয়টস্, ওয়েলস্,
লারকিনস, গিবনস, ওল্ডহ্যাম...। মাঝে মাঝে দেখছি পাশাপাশি একই নামের বেশ কয়েকটি
সমাধি রয়েছে – বোঝা যাচ্ছে সবাই একই পরিবারের লোক। সবচেয়ে আগের তারিখ যা
এখনপর্যন্ত চোখে পড়েছে তা হল ২৮ জুলাই ১৭৭৯। তার মানে ফরাসি বিপ্লবেরও বারো বছর
আগে।
রাস্তার শেষ মাথায় পৌঁছে বুঝতে পারলাম গোরস্থানটা কত বড়। পার্ক স্ট্রিটের
ট্র্যাফিকের শব্দ এখানে ক্ষীণ হয়ে এসেছে।”
- সত্যি,
মেঘলা ভিজে ভিজে দুপুরে পার্কস্ট্রিটের এই সমাধিচত্ত্বরের অনেকটা ভেতরে সিমেন্টের
বেঞ্চিতে বসে বুকলেটের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ঠিক আর বর্তমান কলকাতায় আছি বলেই মনে
হচ্ছিল না। কবরখানা এখন অনেক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সাজানো-গোছানো – তবু যেন মেঘলা দুপুরে
ইতিহাস ছুঁয়ে যাচ্ছিল আমাদের।
‘গোরস্থানে সাবধান’, বুইয়ের হাতে – ওর জন্যই আরও বেশি করে
এখানে আসা। টমাস গডউইনের সমাধিটা খুঁজে বের করবেই। এত বড় হয়ে গেল তাও কিছুতেই
বিশ্বাস করে না যে গল্পটা আসলে গল্পই। একেকটা পরিবেশে অবশ্য সত্যি নিজেদেরও যেন
অন্যরকম বিশ্বাস করতে ইচ্ছাও করে।
বেলা একটা নাগাদ পৌঁছেছি। ঢুকেই ও বলল, সোজা একেবারে শেষে পৌঁছে বাঁয়ে – মানে এগুলো বেশ মুখস্তই
থাকে পাতার পর পাতা! আমরাও তিনজন – সেই একই পথে এগোই। তবে এখন আর ঘাসে ঢাকা পথ নয় – পরিষ্কার। বর্ষায় শ্যাওলা
গজিয়ে উঠছে দেখে নিয়মিত ব্লিচিং দেওয়া হয়, বালিও ছড়ানো রয়েছে।
এরমধ্যে বারদুয়েক পুরো চত্ত্বরটা ঘোরা হয়ে গেছে। প্রাচীন রোমান এবং গ্রীক
স্থাপত্যের আদলে অসংখ্য কুপোলা, ওবেলিক্স, পিরামিড ও মুসোলিয়া। আমি কিন্তু প্রাচীন
হিন্দু মন্দির আর মুসলমান স্থাপত্যের আদলও খুঁজে পাচ্ছিলাম। প্রাচ্যবিদ এবং পার্ক
স্ট্রিটে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রথম প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম জোনসের সাদা রঙের সবথেকে
উঁচু কবরটি বারবারই চোখে পড়ছিল। ঘুরতে ঘুরতে রাউডন স্ট্রিটের দিকে পশ্চিম চত্ত্বরে
খুঁজে পাওয়া গেল পাতাবাহার গাছে ঘেরা হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও-র সমাধি – ‘টিচার, পোয়েট, প্যাট্রিয়ট
অ্যান্ড মেন্টর অব ইয়ংবেঙ্গল’। ছোটবেলায় ইতিহাসের পাতায় পড়া ডিরোজিওর জীবন ও ভাবনা আমার
মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। আমার মেয়ে এখন সেই বয়সে পৌঁছেচে। এতবছর পর ওকে সঙ্গে নিয়ে
সেই মানুষটির সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে মেঘলা মনকেমন করা দুপুরে সত্যি অদ্ভুত একটা
অনুভূতি হচ্ছিল।
এই চত্ত্বরেই কিছুটা আগে রাস্তার ধারে বাঁয়ে মেজর জেনারেল চার্লস স্টুয়ার্টের
হিন্দু মন্দির আকৃতির সমাধিটি চোখে পড়ে। এও আরেক অন্যরকম চরিত্র। ‘হিন্দু’ স্টুয়ার্ট শুধু যে
ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন তাই নয়, হিন্দুধর্মের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান দীর্ঘ পঞ্চাশ
বছর ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছিলেন। প্রতিদিন সকালে উঠে গঙ্গাস্নানে যেতেন এবং
বিভিন্ন ঠাকুর-দেবতার পুজো করতেন। মহিলাদের শাড়ি পরাও তাঁর খুব পছন্দ ছিল।
স্টুয়ার্ট তাঁর বইতে ভারতীয় সভ্যতার কথা খুবই শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। তিনি
মনে করতেন ব্রিটিশদের উচিত এই সভ্যতাকে সঠিকভাবে বোঝার চেষ্টা করা। স্টুয়ার্টের
সমাধিটিও অন্যান্য সমাধিগুলির থেকে স্থাপত্যে ভিন্ন। খানিক নষ্ট হয়ে গেলেও সমাধিতে
খোদিত দেবদেবীর মূর্তি, পদ্ম ও অন্যান্য কারুকাজ হিন্দু মন্দিরের কথা মনে করিয়ে
দেয়। অথচ এর মাত্র কয়েকবছর পর আর এক ভারতপ্রেমিক ডেভিড হেয়ারের কবর এখানে দেওয়া
যায়নি ইউরোপীয় কমিউনিটির আপত্তিতেই। - এমনই কত কাহিনি, কত অশ্রু জড়িয়ে আছে একেকটা
সমাধির সঙ্গে। শুধু টমাস গডউইনের সমাধিটাই কোথাও নেই – আমরা তিনজনেই এখন খুঁজছি
কীনা...
কখনও বাঁধানো রাস্তা দিয়ে কখনওবা ভিজে ঘাস মাড়িয়ে চলি। কোথাও কোথাও বেশ
খানিকটা খোলা ঘাসজমির মধ্যে এখানেওখানে ছড়িয়ে আছে কবরগুলো, কোথাওবা বড় বড় গাছের
সারির মাঝে মাঝে। মেঘলা দুপুরে গাছের ছায়ায় নিস্তব্ধতা যেন আরও ঘন হয়ে আসে।
কোথাওবা গাছপালায় ঘেঁষাঘেঁষি-ঠেসাঠেসি করে কেমন একটা আধো অন্ধকার থমথমে, গা ছমছমে
ভাব – বুইয়ের ভাষায় ডেথলি না না, ডেডলি...। লালমোহনবাবু থাকলেও কি তাই বলতেন? কে
জানে! আমরা ছাড়াও দর্শক আর অল্প কয়েকজন, তারমধ্যে একদল বিদেশি – স্পেন থেকে এসেছে। এখানে
সারাবছরে প্রায় আটশো-হাজার দর্শনার্থী হয়। কেউবা আসেন পূর্বপুরুষের স্মৃতি খুঁজতে,
কেউবা নিছক ইতিহাসের পাতা ওল্টাতেই।
১৭৬৭ সালে দক্ষিণ পার্ক স্ট্রিট সিমেটারি বা ‘দ্য গ্রেট সিমেটারি’ চালু হয়। ১৮৩০ সালে শেষ
সমাধিটি উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। সবচেয়ে পুরনো সমাধিটি সারা পিয়ারসনের, ৮ সেপ্টেম্বর, ১৭৬৮
তারিখের। ১৯৭৮ সালে কবরখানাটির সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়। দেড়শো বছরের অবহেলায় তখন পুরো
জায়গাটা জঙ্গলাকীর্ণ – সাপখোপ, কুকুর আর চোর-ডাকাতের আড্ডা। ‘গোরস্থানে সাবধান’ পড়তে গিয়ে কিন্তু সেই পুরনো
কবরখানার জঙ্গলে ঢাকা ভগ্ন চেহারাটাই চোখে ভেসে ওঠে। খুব সম্ভব কাহিনির সময়
আটাত্তরের এদিক-ওদিক।
ডাকসাইটে সুন্দরী শ্রীমতি এলিজাবেথ জেন বারওয়েলের সমাধিটি চওড়ায় বেশ বড় – পশ্চিমদিক ঘেঁষে। বিয়ের আগে
মিস স্যান্ডারসন বহু ইংরেজ পুরুষের হার্ট থ্রব ছিলেন। একবার এক বলনাচের আসরের আগে
তাঁর প্রণয়প্রার্থী যুবকদের সকলকেই গোপনে তিনি কী রঙের পোষাক পরে আসবেন তা
জানিয়েছিলেন। সেদিনের আসরে দশ-বারোটি যুবক এলিজাবেথের পোশাকের সঙ্গে মানানসই সবুজ
রঙের পোষাকে হাজির হন। শোনা যায় মুগ্ধ অনুগামীদের কাউকেই ফিরিয়ে দেননি এলিজাবেথ,
নেচেছিলেন সকলের সঙ্গেই। নাচের আসর ভাঙ্গলে সেইসব যুবকেরা এলিজাবেথের পালকির দু’পাশে দুটি সারিতে গান গাইতে
গাইতে তাঁকে এগিয়ে দেন।
সেইসময়ের বহু ইংরেজ মহিলার মতো অল্পবয়সেই মারা যান এলিজাবেথ। সমাধিগুলির তারিখ
পড়লেও একটা কথা বেশ বোঝা যায় যে কলোনী স্থাপনের শুরুতে শুধু যুদ্ধ-বিগ্রহ নয়,
প্রতিকূল অচেনা পরিবেশ, দুর্ঘটনা এবং সর্বোপরি নানান রোগ-ব্যাধি কেড়ে নিয়েছিল অনেক
জীবনই। দশ-বারো-চোদ্দ, এমনকী তার চেয়েও ছোট অনেক শিশুরই নীচু নীচু সমাধিগুলি ছড়িয়ে
ছিটিয়ে রয়েছে বড় বড় সমাধির ফাঁকে ফাঁকে।
This lovely bud so young and fair
This lovely bud so young and fair
Called hence by early doom,
Just came to show, how sweet a flower,
In paradise will bloom.
-তারপর
কত শীত, কত বসন্ত কেটে গেছে, কিন্তু পিতৃ-মাতৃ হৃদয়ের সেই ব্যাকুলতা আজও মুছে দিতে
পারেনি কালের আঁচড়।
নানান পেশার, নানান জগতের কত মানুষ এখানে চিরশয্যায় শুয়ে রয়েছেন – বিচারক জন হাইড (১৭৯৬),
স্যার জন রয়েড(১৮১৭) [এঁর নামেই রয়েড স্ট্রিট], মেরি বাওয়ার [নবাব সিরাজদৌল্লার
ফোর্ট উইলিয়াম ধ্বংসের সময় ইনি দুর্গ থেকে পালাতে পেরেছিলেন], ব্রিটিশ নৌবাহিনির
ক্যাপ্টেন এডোয়ার্ড কুক, রাজা দ্বিতীয় চার্লসের প্রপৌত্রী লেডি আনে মসন (১৭৭৫) ও
তাঁর স্বামী লেফটেন্যান্ট কর্ণেল জর্জ মসন, বর্তমান সেন্ট থমাস স্কুলের একদা
প্রধানশিক্ষক রেভারেন্ড ডঃ জন ক্রিশ্চিয়ান ডিমার। এমন আরও কত বিচিত্র মানুষ, কত
বিচিত্র তাঁদের কাহিনি। ব্রিটিশদের পাশাপাশি রয়েছে অনেক আর্মেনিয়ান কবরও।
সতেরো বছরের উচ্ছ্বল তরুণী রোজ আয়েলমার ভালোবেসেছিল কবি লান্ডোরকে। কবির সঙ্গে
ঘুরে বেড়িয়েছে ওয়েলসের পাহাড় আর সমুদ্রতীর। ভারতবর্ষে পৌঁছানোর মাত্র একবছরের
মধ্যেই কলেরায় প্রাণ হারান রোজ। প্রিয়তমার স্মৃতির উদ্দেশ্যে লেখা বিরহী লান্ডোরের
কবিতাটি রয়েছে রোজের সমাধিফলকে। মুল প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকে একটু এগোলেই বাঁহাতে
ক্যাপ্টেন কুক আর রোজ আয়েলমারের সমাধিদুটি চোখে পড়ে।
ইতিহাসের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই মিশে যায় মানুষের কল্পনা। কারখানার পুবে লোয়ার সার্কুলার
রোডের দিকে এম ডেনিসনের কবরটির পরিচিতি ‘ব্লিডিং গ্রেভ’ বলে। সময়ে সময়ে এই কবর থেকে
নাকি রক্তের মতো লাল রঙের কোন তরল বেরিয়ে আসে। ভাগ্যিস্, লালমোহনবাবু শোনেননি,
নইলে শুধুই ‘গেরোস্থান’ না বলে আঁতকে উঠে আরও কত কী যে বলতেন, কে জানে!
কত অজানা গল্পইতো জানা গেল এই ঘুমন্তপুরীতে হাঁটতে হাঁটতে। কিন্তু গডউইনের
সমাধিতো কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না – বুইয়ের মনটা আকাশের মতই মেঘলা। ঘুরতে ঘুরতে
শেষে পশ্চিমদিকের একটা কোণ কিছুটা চেনা চেনা লাগে। নাইবা লেখা থাকুক টমাস গডউইনের
নাম – আসলে চ্যাপ্টা সমাধিটার ওপরটা কালো হয়ে গেছে, কোন নামই আর পড়া যাচ্ছেনা। কাছে
বেশ বড় বড় কয়েকটা গাছও রয়েছে। দিব্যি ভেবে নেওয়া যায় এটাই টমাস গডউইনের সমাধি, আর
এখানেই সমাধির গভীরে মাটির অনেকটা নীচে রয়েছে সেই বিখ্যাত ‘পেরিগাল রিপিটার’ – গল্পটা তাহলে এখান থেকেই
শুরু হোক... ।
'আমাদের ছুটি'
বকখালি ভ্রমণ ও একটি রচনা লেখার গল্প
গোপালের ভ্যানরিক্সায় সওয়ারি আমরা তিনজন। এখনো রোদ ওঠেনি
তেমন...অল্প অল্প হাওয়া দিচ্ছে। বকখালি গ্রামের মধ্যে দিয়ে ইঁটের রাস্তা ধরে
লাফাতে লাফাতে ভ্যানটা চলেছে। রাস্তার দু’পাশে
মাটির বাড়ি – বনতুলসীর বেড়া
দেওয়া। নিকোনো উঠোনে বিছানো রয়েছে মাছধরার জাল। উঠোনের ধারে লাল জবা আর কল্কে গাছে
সাদা-হলুদ ফুল ফুটে রয়েছে। আর ওদের মাথা ছাড়িয়ে উঠে গেছে নারকেল গাছগুলো। রাস্তা
কোথাও কোথাও এতটাই ভেঙ্গে গেছে যে নেমে পড়তে হচ্ছে ভ্যানরিক্সা থেকে। আরও কিছুটা
এগোতেই পথের পাশে একের পর এক মাছের ভেড়ি চোখে পড়ছিল। চেনাগাছগুলো ক্রমশ হারিয়ে
যাচ্ছে অচেনা ম্যানগ্রোভের জঙ্গলে। গোপালের কাছে বনের পাঠ নিই – চিনতে চিনতে চলি হেঁতাল, গরান,
বানি, গেঁও, গামা, বের বাবলাদের। গরান আর হেঁতালের ঝোপের পাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে
আছে বের বাবলা। এর চেহারা অনেকটা সুন্দরীর মতো। হেঁতালের স্থানীয় নাম ‘বকরা’ – যার
থেকে উৎপত্তি বকখালি নামের। ছোট্ট ছোট্ট ফলেভরা বো-এর কুলগাছ। পথের ধারে লাল
ভ্যারেন্ডা আর মনসার ঝোপ। ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের ফাঁকে কোথাওবা উঁকি মারছে চেনা নিম
আর খেজুর গাছ। ইঁটের পথ শেষ হয়ে মাটির আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে এগোয় ভ্যান। এইপথেই
আরও বেশ কিছুটা এগিয়ে কিরণ সৈকত, আমরা অবশ্য অতটা যাবনা। ভ্যান থেকে নেমে হাঁটতে
হাঁটতে এগিয়ে যাই জলের ধারে।
গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপের একটা বড় অংশ হেনরি আইল্যান্ড।
নামকরণ হয়েছিল এক ব্রিটিশ সার্ভেয়ারের নামে। সুন্দরবনের পশ্চিমপ্রান্তে সমুদ্রের
তীরে ম্যানগ্রোভ অরণ্যে ছাওয়া এই এলাকায় অনেকদিন আগে নাকি বাঘের দেখাও পাওয়া যেত।
নদী আর তাদের শাখানদীরা জলের জাল বুনেছে এই ভূমিতে। ১৯৮০ সালে পশ্চিমবঙ্গের মৎস্য
দপ্তর সমুদ্র লাগোয়া এই অঞ্চলটিকে ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে গড়ে তোলে। ভ্যানরিক্সায়
আসতে আসতেই ফিসারিজ-এর ট্যুরিস্ট বাংলো চোখে পড়েছিল।
জল-জঙ্গলের কোলের কাছে দাঁড়িয়ে গোপালের অথবা গোপালদের গল্প
শুনি। ওই যে মাটির বাড়িগুলো পথে দেখতে দেখতে এলাম ওরকমই কোন মাটির দাওয়ায় হয়তো এখন
মাছ ধরার জাল শুকাচ্ছে গোপালের বউ আর তার বুড়ি মা, উঠোনে খেলে বেড়াচ্ছে গোপালের
ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। আরেকটু বড় হলে মেয়ে হাত লাগাবে মায়ের সঙ্গে আর ছেলে জাল নিয়ে
বাপের মতোই নেমে পড়বে সমুদ্রে অথবা শিখে নেবে ভ্যান চালানোর কাজ।
কী যেন ভাবছিলাম...মনটা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ
গোপালের ডাকে সম্বিত ফিরে দেখি কখন জঙ্গলে ঢুকে ভেঙ্গে এনেছে ঝলমলে হলুদ ফুলে ভরা
একটা ল্যাটা গাছের ডাল, বনঝাউয়ের ডালের টুকরো আর গরানের ফলের ঝাড়। গাছগুলো ভাঙ্গার
কথা বারণ করতে গিয়েও থেমে গেলাম...ফুলগুলোর মতোই ঝলমল করছে ওর হাসিভরা দু’চোখ। এই প্রকৃতির ও অনেক কাছের মানুষ। হাত বাড়িয়ে
গ্রহণ করি প্রকৃতির উপহার। এবার ফিরতে হবে।
এটা প্রায় বছর ছয়েক আগের গল্প। মেয়ে তখন অনেকটাই ছোট। গরমের
ছুটিতে ওর হোমওয়ার্ক ছিল গ্রামে বেড়াতে গিয়ে সেই বর্ণনা লিখে ফেলা। ওকে নিয়ে এটাই
মুশকিল যে রচনা জিনিসটা যে বানিয়ে লিখতে হয় সেটা কিছুতেই মানবেনা। স্কুল থেকে
ফিরেই বলল, আমাকে হয় কোন গ্রামে বেড়াতে নিয়ে চল, নইলে আমি ওই রচনা লিখছিনা। কী
ঝামেলারে বাবা...কে যাবে এই ঘোর গরমে বাংলার গ্রামে! সমাধান করল দীপ। একটা রবিবার
ভোরে ভূতল নিগমের বাসে উঠে পড়ি তিনজনে। গন্তব্য কাকদ্বীপ, নামখানা পেরিয়ে বকখালি।
পথে কলকাতায় জন্ম ইস্তক বড় হওয়া আমাদের সাতবছরের মেয়েকে দেখাতে দেখাতে চলি খড়,
টিন, টালিতে ছাওয়া মাটির বাড়ি, উঠোনে খেলে বেড়ানো মুরগীর বাচ্চা, কলাগাছ, পুকুর,
ধানক্ষেত, মফস্বলের বাজার...।
গাড়ি পৌঁছালো নামখানা। এখানেই বার্জে চড়ে পেরোতে হবে
হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদী। শুধু আমরাই নই, আস্ত বাসটাই অন্য আরও গাড়ির সঙ্গে উঠে যাবে
লঞ্চে! প্রথমবার এই অভিজ্ঞতায় কে বেশি উত্তেজিত আমি না আমার মেয়ে তা বলা বেশ কঠিন।
পরে আন্দামান বেড়াতে গিয়ে এরকম অভিজ্ঞতা একাধিকবার হয়েছিল কিন্তু প্রথমবারের মতো
অমন উত্তেজনা আর কখনো হয়নি।
সরকারি ট্যুরিস্ট লজটা সমুদ্রের বেশ কাছে। তবে প্রায় ঢোকার পরপরই
বিপত্তি - কোথা থেকে একটা গোদা বাঁদর এসে টেবিল থেকে আমার সাইড ব্যাগটাই তুলে
নিচ্ছিল। অনেককষ্টে তার হাত থেকে ওটা উদ্ধার করা হল। সে আরেক গল্প।
বকখালির সমুদ্র একটু ভেতরে। স্নানের জন্য বেশ ভালো। প্রশস্ত
সৈকতে হাঁটতে বা বসে থাকতেও বেশ ভালোলাগে। সমুদ্রের ধারে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলা
টানা বসার জায়গাও রয়েছে। তবে সেইসময় রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে সমুদ্রের তীরে যা
জঞ্জালের স্তুপ দেখেছিলাম সেটা খুব বিশ্রী লেগেছিল। স্নান করে উঠে সবচেয়ে ভালোলাগে
সমুদ্রের ধারের ঝুপড়ি হোটেলগুলোর ডালভাত, মাছতরকারির স্বাদ – খিদের মুখে একেবারে অমৃত। বিকেলবেলায় সৈকতের
কাছের ঝুপড়ি চায়ের দোকানগুলোয় বসে সমুদ্রের ঠাণ্ডা হাওয়া আর গরম চা দুটোই দারুণ।
মেঘ সরলে রাতের সমুদ্র জ্যোৎস্নায় ভাসে...হু হু হাওয়া উড়িয়ে দেয় চুল।
সোমবার সকালে হেনরী আইল্যান্ড আর বনবিভাগের কুমির প্রকল্প
ঘুরে আসার পর দুপুরে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের গন্তব্য ফ্রেজারগঞ্জ আর বেনফিসের
ফিসিং হারবার। দূর থেকেই বড় বড় উইন্ডমিলগুলো স্বাগত জানায়। সমুদ্রতটের ঠিক আগেই
আগাছা আর জঙ্গলে ঘেরা সাহেবী আমলের বাংলো টাইপের কয়েকটা ভাঙ্গা বাড়ি। এরই আশেপাশে
কোথাও বাংলার একসময়ের লেফটেন্যান্ট গভর্ণর অ্যান্ড্রু ফ্রেজারের বাংলোবাড়িটি ছিল,
কালের অতলে যা হারিয়ে গেছে সমুদ্রগর্ভে। ফ্রেজার সাহেবের নাম থেকেই এই জায়গার নাম
হয়েছিল ফ্রেজারগঞ্জ। সন্ধের মুখে যখন ফ্রেজারগঞ্জের সমুদ্রতটে পৌঁছালাম তখন নির্জন
সৈকতে শুধু হু হু করে হাওয়া বইছে আর একাকী দাঁড়িয়ে আছে মাছধরার একটা নৌকো। অন্ধকার
নামার আগেই পৌঁছাতে হবে বেনফিসের হারবারে, আবার ভ্যানে উঠে বসি।
জলের মধ্যে সারসার দাঁড়িয়ে আছে মাছধরার নৌকা। কেউবা ফিরে
এসেছে একটু আগেই, কারোরবা চলছে কাল সকালে বেরিয়ে পড়ার প্রস্তুতি। আঁশটে গন্ধে
হারবারের বাতাসটা ভারী হয়ে আছে। এখান থেকে ছোট নৌকো ভাড়া নিয়ে বঙ্গোপসাগরের বুকে
জম্বু দ্বীপ থেকেও বেড়িয়ে আসা যায়। হারবারের দুপাশে বানিগাছের জঙ্গল। মাটির মধ্যে
থেকে উঁকি মারছে ম্যানগ্রোভের অজস্র শ্বাসমূল। হারবারের নীচে সিমেন্টের থামের গায়ে
মরা সামুদ্রিক পোকা জমে তৈরী হয়েছে প্রকৃতির কারুকার্য। ভ্যানচালক বললেন এইগুলো
ভেঙ্গে নিয়ে তৈরি করা হয় চুন। সত্যি কতরকম জীবিকায় বেঁচে থাকার লড়াই করে মানুষ, আর
কতরকমভাবেইনা হাত বাড়িয়ে দেয় প্রকৃতি।
পরদিন ফেরার পথে বাসে বসে টুকরো টুকরো ভ্রমণস্মৃতি ফিরে
ফিরে আসছিল। মনে হল আপাতদৃষ্টিতে পরিষ্কার রাস্তাঘাট আর ঝাঁ চকচকে হোটেলের সারির
মাঝে কোথাও যেন লেগে আছে একটা অবহেলার সুর। নোংরা জমে থাকা বেলাভূমিতে, হেনরি
আইল্যান্ডে যাওয়ার ভাঙ্গা রাস্তায়, ঝুপড়ি দোকান আর নীচু নীচু মাটির বাড়িতে কিম্বা
ফ্রেজারগঞ্জের আগাছা ঢাকা ভাঙ্গা বাংলোবাড়িগুলো আর গোপাল দাসদের কন্ঠস্বরে পাওয়া
যায় সেই বেদনার আভাস।
'আমাদের ছুটি'
জলসই
দূরে রেড ক্রেস্টেড পোচার্ডের একটা বড় ঝাঁক জলের ওপর
ছড়িয়ে বসেছিল। মনে হচ্ছিল কালো জলের ওপর কে যেন হাল্কা রঙের একটা চাদর বিছিয়ে
রেখেছে। সাদা-কালোয় মেশানো শরীর আর ডানা, লালচে হলুদ
রঙের ঠোঁট আর পা নিয়ে অনেকটা বড়সড় হাঁসের মত চেহারা। মোটরবোটের একটানা বিশ্রি আওয়াজটা
কাছে আসতেই চাদরে টান পড়ল। আওয়াজ থেমে গেলেও ওরা টের পাচ্ছিল আমাদের উপস্থিতি।
চঞ্চল হয়ে উঠছিল। মাঝে মাঝেই ঝাঁক থেকে কয়েকটা পাখি উড়ে গিয়ে আকাশে চক্কর খেয়ে
আবার ঘুরে এসে বসছিল। মোটরবোটের মুখটা ঘুরিয়ে আবার রওনা দিতেই বুড়ো আংলার হাঁসের
দলের মত ঠিক যেন রিদয়কে নিয়ে একঝাঁকে উড়ে গেল পাখিগুলো।
শীতের সময় সুদূর
সাইবেরিয়া, ইরান, মধ্য
এশিয়ার নানান দেশ থেকে ফ্লেমিংগো, পেলিকান, সোনালি টিট্টিভ, সিন্ধু ঈগল প্রভৃতি হাজারো পাখি ভিড়
জমায় চিল্কার বুকে। একত্রিশে ডিসেম্বর বিকেলে হাল্কা শীতের আমেজ গায়ে মেখে আমরাও
যেন পরিযায়ীর দল, ভেসে পড়েছি চিল্কায়।
উঁচু পাড়ের গায়ে
অগভীর জলে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে নৌকো আর মোটরবোটগুলো। ঘাসজমিতে আর জলের মধ্যে জেগে
থাকা মাছধরার জালের গায়ে ইতিউতি বসে স্থানীয় আর অতিথি পাখিরা। কোথাও দল বেঁধে, কোথাওবা
একলাই। ভোরবেলায় এরা দলে আরও ভারি ছিল। জলাজমির ঘাসে মুখ ঢুকিয়ে শিকার খোঁজে বক আর
মাছরাঙার দল। কমন স্যান্ডপাইপারের কাজলটানা চোখদুটো দেখতে ভারি ভালোলাগে।
সমুদ্রের কোলঘেঁষা
বলেই হয়তো চিল্কার জলে কোথাও একটা সীমাহীনতার ছোঁয়া রয়েছে, অথচ
পাড়, জলের বুকে জেগে থাকা টিলাগুলো সবই সীমানির্দেশ করে।
জলের ধারে রম্ভা পান্থনিবাসের বারান্দায় বসেই হ্রদের বুকে ওয়াচটাওয়ারটা নজরে পড়ে।
টাওয়ারটা দেখতে মন্দিরের মাথার মত। জলের মধ্যে ছোট্ট একটা ঘর, মোটরবোট থেকে সিঁড়ির প্রথম ধাপে নেমে আরও দুটো সিঁড়ি ভেঙে ঘরের মধ্যে
যাওয়া যায়। ওয়াচটাওয়ার থেকে কিছুটা এগিয়ে একটা টিলার গায়ে থামল মোটরবোট। টিলার
ওপরে গুহায় শিবমন্দির। এবড়ো খেবড়ো পথে টিলার গা বেয়ে উঠে যায় দলের বাকিরা। জলের
বুকে নৌকায় একা বসে থাকি। শেষ বিকেলের আলোয় দিগন্ত আর জলরাশি রাঙা হয়ে ওঠে।
দূরে টিলার মাথায়
ধিরে ধিরে ঢলে পড়ে বছর শেষের সূর্য। মায়াবী হয়ে ওঠে চারিদিক। একা একা মাথা তুলে
দাঁড়িয়ে থাকা ওয়াচটাওয়ারের চারপাশে জল চিকচিক করে ওঠে। পাখির দল কোথাও জলের মধ্যে
জেগে থাকা জালের গায়ে বিশ্রাম নেয়, কেউবা উড়ে চলে
দিগন্তে।
রম্ভা থেকে
গোপালপুরের রাস্তাটা সবটা খুব ভালো না হলেও এই অটোপথ বেশ ভালোলাগছিল। রম্ভা থেকে
বরকুল বেড়ানোর সময়ই অটোচালক রত্ন-র সঙ্গে আমাদের বেশ আলাপ হয়ে গিয়েছিল। তার
জোরাজুরিতেই ছোট্ট অটোতে যাবতীয় ব্যাগব্যাগেজ ঠেসে বেরিয়ে পড়েছিলাম গোপালপুরের
দিকে। জায়গায় জায়গায় পাহাড়ি এলাকার মতো। উঁচু উঁচু টিলা কেটে চওড়া রাস্তা এগিয়েছে।
পথের গা ঘেঁষে ছুটে যায় ট্রেন। আবার নীচু জমি জল-কাদা, ক্ষেতের
পাশ দিয়ে নাচতে নাচতে চলে অটো। মনের আনন্দে একের পর এক গান গেয়ে চলে আমাদের দশ
বছরের আর বন্ধুর আট বছরের মেয়ে। গান শেষ হতে না হতেই অটো এসে থামে ছোট্ট শহর
পেরিয়ে একেবারে সমুদ্রের কাছে।
সমুদ্র বোধহয় ঠিক
রূপসী নারীর মতো। তাকে যতই দেখা যায় আশ মেটেনা কিছুতেই। এত উচ্ছ্বল অথচ এত শান্ত।
গোপালপুরে এসে বারবার আন্দামানের সমুদ্রের কথা মনে পড়ছিল। সাগরের অত রূপ আর কোথাও
দেখিনি। ওখানে সে যেন রাজরানী। নীল-সবুজ বেনারসীতে চিরযৌবনা। আর এখানে যেন পাশের
বাড়ির আটপৌরে বধূটি। আধখোলা ঘোমটার ফাঁকে শান্তসুন্দর মুখেই কখনও খেলে বেড়ায় রাগের
ভ্রুকূটি।
হোটেলের ঘরের ঠিক
সামনে কয়েকধাপ সিঁড়ি নেমে গেলেই একেবারে বালিতে। সমুদ্রসৈকতটা বেশ চওড়া। বেলা
এগারটা-বারটা বাজে। জানুয়ারির প্রথমদিন। রোদ কিন্তু বেশ চড়া। দুপুরের ঝকঝকে রোদ
নীল জলে পড়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। বেলাভূমিতে তেমন ভিড় নেই। সমুদ্রস্নানে ব্যস্ত
কয়েকজন। বালিতে অলসভঙ্গীতে শুয়ে-বসে আরও জনা কয়েক। দূরে জেলেরা জাল গোটাচ্ছে। জলে
পা ভিজিয়ে হেঁটে বেড়াই সৈকতে। বেলাভূমিতে জাল ছড়িয়ে বসেছে জেলেরা। জালের গায়ে
ছোটবড় অজস্র কাঁকড়া। কোনো কোনোটার পেটে আবার হলুদ বা কালো রঙের একগুচ্ছ ডিম।
জালেরে ফাঁকে ফাঁকে আটকে রয়েছে কয়েকটা স্টারফিশ আর জীবন্ত ঝিনুক।
গোপালপুর শহরটা
পুরীর মত জমজমাট নয়, আবার চাঁদিপুরের মত একেবারে নির্জনও
না। বেশ মধ্যবিত্ত মেজাজ। বাজার এলাকাটা সমুদ্র থেকে খানিক দূরে। সমুদ্রের ধারে
হোটেল আর রেস্টুরেন্ট ইতস্ততঃ ছড়ানো। ওড়িশার সাইক্লোনে গোপালপুরের কয়েকটা হোটেল
বেশ ভেঙে গিয়েছিল। ভাঙা হোটেলের কাঠামোর গায়ে জমে উঠেছে বালির স্তুপ। জঙ্গল হয়ে
গেছে আপন নিয়মেই। সমুদ্রের পাড়ে বিকেল-সন্ধেয় এই ভাঙা বাড়িগুলো কেমন রহস্যময়তার
সৃষ্টি করে। উঁচু পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্রের ধারে একটা চাতালের ওপর বালিতে
বানানো জগন্নাথের মূর্তি নজরে পড়ে। কে জানে কোন শিল্পীর সৃষ্টি!
হোটেলের সামনেই
রাস্তার এপারে-ওপারে গোটা তিনেক গিফট শপ। আরও খানিকটা এগিয়ে বাঁহাতে লাইটহাউস।
সূর্য পশ্চিমে ঢলছে। পায়ে পায়ে পৌঁছে যাই লাইটহাউসে। ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসি
ওপরে। অসাধারণ প্যানোরামিক ভিউ। দিগন্তবিস্তৃত নীল সমুদ্রে সাদা ঢেউ ভাঙছে। হলুদ
বালিতে কমলা-হলুদ গার্ডেন ছাতার নিচে লাল রঙের চেয়ারের সারি আর রঙিন পোষাকে
পর্যটকের দল। অস্তরাগের মায়াবি আলোয় অপরূপ হয়ে ওঠে দিগন্ত। অন্ধকার নেমে আসে।
লাইটহাউস থেকে নেমে
হাঁটতে হাঁটতে ফিরে আসি সৈকতে। গরম কফির কাপ হাতে বসে পড়ি সৈকতের ধারের বাঁধানো
সিঁড়িতে। সমুদ্রের হাওয়ায় এখন একটা ঠাণ্ডা আমেজ। লাইটহাউসের আলো হারিয়ে যায় সাগরের
বুকে। রাত বাড়তে থাকে......।
ভোর বেলার সমুদ্র
ভারী নরম। সূর্যের মিঠে আলো লাগে চোখেমুখে। পায়ের পাতা ছুঁয়ে যায় জল। সৈকতে
সমুদ্রের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে লাল-নীল-সবুজ মাছ ধরার নাও। সাগরের বুকে ভেসে যায়
আদরের নৌকো। রাত থাকতেই জেলেদের যে দলগুলো সমুদ্রে বেরিয়েছিল তাদের কেউ কেউ ফিরে
এসেছে। তাদের জালে মাছ আর কাঁকড়ার স্তুপ। অদ্ভুত দেখতে একটা সাপও উঠেছে জালে।
মুখটা অনেকটা মাছের মতন। সাপটাকে ছাড়িয়ে টুকরো টুকরো করে জালে গেঁথেছে। ওটাই এবার
টোপ হবে। বালির ওপর হাঁটতে হাঁটতে দেখি দুজনে মিলে কাঁধে কী যেন ঝুলিয়ে হেঁটে
আসছে। কাছে আসতে দেখি ওরেবাবা এযে বিশাল এক শঙ্কর মাছ। মাছটাই একমানুষ সমান।
লেজটাতো আরও বড়। রোদ উঠে গেছে। সৈকতে ফ্লাইং ডিস্ক ছুঁড়ে খেলছে আমাদের দুই বালিকা।
এবার জলে নামার পালা, ডাক দিই ওদের।
বিকেলে সৈকত ধরে সাগরের গা ছুঁয়েছুঁয়ে হাঁটা। জেলেরা
জাল বুনছে বেলাভূমির ধারে। মেয়ের সাথে ছুটে ছুটে ঝিনুক কুড়োই। হোটেল থেকে নেমে
বাঁদিকে পায়েপায়ে অনেকটা চলে এসেছি। পিছনে তাকালে চোখ আটকায় লাইটহাউসে। আরও এগিয়ে
একজায়গায় দেখি তিরতিরে জলধারা মিলিয়ে গেছে সাগরের বুকে। ঠিক যেন মোহনা। জল ভেঙে
ওপার থেকে ফিরছে বিদেশিনী। সমুদ্রের বুকে সন্ধ্যা নেমে আসে….।
'আমাদের ছুটি'
[“ফেলুদা বলে, ‘নতুন চরিত্র যখন আসবে, তখন
গোড়াতেই তার একটা মোটামুটি বর্ণনা দিয়ে দিবি। তুই না দিলে পাঠক নিজেই একটা চেহারা
কল্পনা করে নেবে; তারপর হয়তো দেখবে যে তোর বর্ণনার সঙ্গে তার কল্পনার অনেক তফাত।’...” – তাই আমিও দিয়ে রাখলাম।]
'আমাদের ছুটি'
দেবদাসী সুতনুকা ও কোণারকের সূর্যমন্দির
দেবদাসীটির কী নাম ছিল, সুতনুকা?
কে জানে! পাখোয়াজ, মাদল, বাঁশী, খঞ্জনী,
করতাল, ঝাঁঝর হাতে কোনজন সে? গাইডের মুখে শোনা গল্পটির নায়িকা ওরা যে কেউই হতে
পারে, অথবা ওদের সকলেরই হয়তো এমন কোন গল্প ছিল – ইতিহাসে
নয়, কল্পনার গহীনে ডুবে যেতে যেতে দেখতে পাই প্রায় দেড়-দুহাজার বছর আগের দুই
তরুণ-তরুণীকে। নায়ক শিল্পী। রাজার আদেশে কোণারকের সূর্যমন্দিরের গায়ে অপূর্ব
ভাস্কর্য ফুটিয়ে তোলে সে। কিন্তু তার মন পড়ে থাকে বহুদূর গ্রামে তার ছেলেবেলার
সাথী, তার প্রেয়সী, তার ভাবী বধূটির কাছে। মন্দিরের মূর্তির মুখেও ফুটে ওঠে তার
প্রিয় নারীটির আদল। রাজা সেই মূর্তি দেখে মুগ্ধ হন। কে এই নারী? রাজার কাছে সত্য
গোপন করে না শিল্পী। রাজা লোক পাঠিয়ে গ্রাম থেকে তুলে আনেন সেই অপরূপাকে। শিল্পীর
উপযুক্ত নয় সে, তাকে হতে হবে দেবদাসী – দেবভোগ্যা,
রাজভোগ্যা। তারপরে সেই হতভাগা শিল্পীর কী হল কে জানে, ইতিহাস বা গল্পকথা কেউই তাকে
মনে রাখেনি। শুধু তার অনুপম সৃষ্টি আজও মুগ্ধ করে রসিক দর্শককে।
শীতের এক দুপুরে ভুবনেশ্বর থেকে
কোণারকে এসে পৌঁছেছি। এর আগে পুরী বেড়াতে এসে সারাদিনের ট্যুরে একাধিকবার
কোণারকে এসেছি। কিন্তু সেতো শুধু ছুঁয়ে যাওয়া। এবারে এসেছি দুদিন থাকব বলে, নীরব
পাথরের ভাস্কর্যে ফুটিয়ে তোলা অকথিত কাহিনির খোঁজে। বিকেলে সকলে মিলে বেরিয়ে পড়ি।
সন্ধ্যারাগের আলোয় অপরূপ এই মন্দির দেখব। এখনতো রাতেও আলোর
ব্যবস্থা হয়ে মন্দিরের ভেতরেই। সেই আলোতেও খুব অদ্ভুত লাগে সমস্ত পরিবেশ।
ওড়িশার মন্দির ভাস্কর্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন
নিঃসন্দেহে কোণারকের সূর্যমন্দির। পুরী থেকে
৩৫ কিলোমিটার ও ভুবনেশ্বর থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই মন্দিরের নাম
রয়েছে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের
তালিকাতেও। ওড়িষার মন্দির শিল্পের প্রায় একহাজার বছরের স্থাপত্যের ইতিহাসের শেষ পর্যায়ে
অসাধারণ এই মন্দিরটি নির্মিত হয়। মন্দিরটি ঠিক কবে তৈরি হয়েছিল আর কেইবা ছিলেন এর
স্রষ্টা তা নিয়ে ইতিহাসে, পুরাণে, গল্পকথায় নানান কাহিনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। পুরাণ মতে, কৃষ্ণপুত্র শাম্ব পিতার অভিশাপে কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত
হওয়ার পর চন্দ্রভাগা নদীর তীরে সূর্যের আরাধনা করেন। বারো বছর সাধনা করার পর তাঁর
রোগমুক্তি হয়। এরপর শাম্ব একটি সূর্যমন্দির নির্মাণ করেন। ইতিহাস বলছে, গঙ্গরাজবংশের রাজা নরসিংহদেব লাঙ্গুলীয় পুরন্দর
কেশরী (১২৩৮-৬৪)-র আমলেই বর্তমান মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল। তবে এর প্রায় তিনশ বছর পরে মুঘল সম্রাট আকবরের সভাসদ আবুল-ফজলের আইন-ই-আকবরী
গ্রন্থে কোণারকের সূর্যমন্দিরের যে উল্লেখ পাওয়া যায় তাতে মনে হয় মন্দিরটি আরও
প্রাচীন। সম্ভবত পুরনো মন্দিরের ওপর নরসিংহদেব নতুন মন্দিরটি তৈরি করিয়েছিলেন।
পরদিন খুব ভোরে পৌঁছাই মন্দির চত্ত্বরে। ভেবেছিলাম ভোরের মায়াবী আলোর নির্জনতায় ডুব দেব
ভাস্কর্যের সেই অপরূপতায়। কিন্তু শীতের ছুটির দিনে কলকাতার নিকো পার্ক কিম্বা
চিড়িয়াখানার দর্শকের মতোই স্থানীয় মানুষের বিপুল ভিড় মন্দির চত্ত্বরে – মন্দির যাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহের বিষয় নয়, খানিকক্ষণ মজা আর হইচই করা,
মোবাইলে ছবি তোলা – এসবের জন্যেই আসা। আশ্চর্য
হয়ে ভাবি ভারতবর্ষ বলেই এটা সম্ভব। পশ্চিমের কোন দেশ তাদের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারকে
এভাবে নষ্ট হতে দিত না। মূল মন্দিরের জগমোহনের যে অংশটি এখনও বেঁচে রয়েছে সেটি রেলিং
ঘেরা হলেও, তার বাইরের অংশটিতে অজস্র ছোট ছোট ভাস্কর্য আছে যেগুলো হাতে ছোঁয়া যায়,
ফলে মানুষের স্পর্শে, ঘামে ক্রমশঃ ক্ষয়ে আসছে সেগুলি। আবার আমরা যারা লিখি বা ছবি
তুলি, ছবি আঁকি, শ্রদ্ধা করি এই শিল্পকর্মকে সেই মানুষগুলোর জন্যও আমজনতার সঙ্গে
একই ব্যবহার এটাও ভাবতে খারাপ লাগে। মন্দিরের পেছনের দেওয়ালের গাত্রে গাছের তলায়
দাঁড়ানো স্বামী-স্ত্রীর যে মূর্তিটির ঠোঁটের কোণায় হাজার বছর ধরে প্রেমময় হাসির
রেশটি লেগে আছে - ইচ্ছে করে একটু কাছে গিয়ে দেখে আসতে, সেই অনন্ত হাসির রহস্যটি
খুঁজে বের করতে। কিন্তু উপায় কী।
যথাসম্ভব ভিড় এড়িয়ে মন্দির দেখতে
শুরু করি - কলিঙ্গ স্থাপত্যের রীতি অনুযায়ী ওড়িশার মন্দিরগুলির চারটি অংশ - ভোগমণ্ডপ,
নাটমন্দির, জগমোহন ও দেউল। কোণারকের মন্দিরের ক্ষেত্রে এই নিয়ম পুরোপুরি মানা
হয়নি। এখানে নাটমন্দির নেই। দেউল ও জগমোহন মিলিয়ে একটা ইউনিট হিসেবে তৈরি হয়েছিল। এখন
আমরা কোণারকে যে মন্দিরটি দেখতে পাই সেটি মন্দিরের জগমোহন ও ভোগমণ্ডপ অংশ। মূল
মন্দির বা রেখ দেউল বহু শতাব্দী আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে মুসলমান
শাসকদের আক্রমনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মূল মন্দিরটি। ক্রমশঃ কালের গহ্বরে তা বিলীন হয়ে
যায়। ১৮২৫ সালে এস্টারলিং-এর বর্ণনায় রেখ দেউলের ভগ্নাবশেষের উল্লেখ পাওয়া যায়।
১৮৩৭ সালে জেমস ফার্গুসনের হাতে আঁকা ছবিতে রেখ দেউলের একটা অংশ দেখা যায় যার
উচ্চতা ছিল ১৪০-১৫০ ফুট। অর্থাৎ বর্তমান
জগমোহনের চেয়েও উঁচু। মূল মন্দিরের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত সূর্যপত্নী মায়াদেবীর
মন্দিরটিও অনেকটাই ভেঙ্গে গেছে।
কোণারক
মন্দিরের প্রকৃত সংরক্ষণ শুরু হয় ১৯০১ সালে, লর্ড কার্জনের আমলে। পুরাতত্ত্ববিদ জন
হান্টারের নেতৃত্বে রথের চাকা আর রথের ঘোড়া বালি সরিয়ে বের করে আনা হয়। জগমোহনের
ভেতরটাও এই সময়েই বালি দিয়ে বুজিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
রথারূঢ় সূর্য কোণারকের মন্দিরের উপাস্য দেবতা। মন্দিরটিও
রথের আদলেই গড়ে তোলা হয়েছিল। সূর্যদেবতার মূল মূর্তিটি মুসলিম আক্রমনের সময়েই তৎকালীন
সম্রাট মুকুন্দদেব পুরীর মন্দিরে নিয়ে যান। রথের দুটি অংশ - মূল অংশ অর্থাৎ যেখানে রথী বসেন, তা হল
বড়দেউল। আর সারথির অংশটাই জগমোহন। সূর্যের এই রথের মোট ৭ টি অশ্ব- সপ্তাহের সাতবার নির্দেশ
করে। একেকদিকে ১২ টি করে মোট চব্বিশটি চক্র। এক একটি চক্র এক এক পক্ষকাল। বিশালাকার
এই রথটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৬৬ মি, প্রস্থে সবচেয়ে চওড়া অংশে ৩০.৫ মি। জগমোহনের উচ্চতা
৩৯ মি। মূল মন্দিরটির উচ্চতা ছিল অন্ততঃ ৭৭ মি।
জগমোহনের পূর্বদিকে সিঁড়ির দুপাশে দুটি করে মোট চারটি চক্র
আছে। দক্ষিণ দিকে ছিল চারটি রথাশ্ব। তার ভিতর দুটির মাথা আছে- দ্বিতীয়টির অনেকটাই
এখনও অক্ষত আছে। চক্রগুলি মোটামুটি একই রকম, যদিও ভিতরের কারুকাজ আলাদা। রথচক্রগুলির ব্যাস ২.৭৪মি, এতে
আটটি বড় স্পোক এবং আটটি ছোট স্পোক আছে। বড় স্পোকগুলির মাঝে মোট আটটি এবং চক্রের
মাঝে একটি গোলাকার অংশ রয়েছে। তাতে স্ত্রী, পুরুষ, মিথুনচিত্র, দেবদেবীর মূর্তি খোদিত
রয়েছে।
দেয়াল
গাত্রে সবার নীচে উপান অংশে আছে হাতির সারি, শিকারের দৃশ্য, শোভাযাত্রার দৃশ্য। হাতির
নানা দৃশ্যই প্রধান। হাজারেরও ওপরে হাতির মূর্তিতে কোথাও ফুটে উঠেছে দলবদ্ধ
বনহস্তীর জীবনযাত্রা, হাতিদের যুদ্ধ, হাতি শিকার কাহিনি এমন নানা ঘটনা। উপানের
ওপরের অংশের ভিতর পাটায় জীবজন্তুর চিত্র ও নানান নকশা কাটা। তলজঙ্ঘাতে কিছু দূরে
স্তম্ভের কুলুঙ্গিতে নানান দৃশ্য। দুটি স্তম্ভের মাঝে কখনও দুটি বা তিন-চারটি খাড়া পাথর। এই
খাড়া পাথর গুলিতেও নানা ভাস্কর্যের নিদর্শন- মিথুনমূর্তি, অলসকন্যা, বিরাল অথবা
নাগমূর্তি। তলজঙ্ঘার ওপরে বন্ধনের অংশটি নানান নকশা কাটা। উপর জঙ্ঘাতে, নিচের
তলজঙ্ঘার স্তম্ভের ওপর আবার একটি করে পদ্মশীর্ষ অর্ধস্তম্ভ, তলজঙ্ঘার মূর্তিগুলির
ঠিক ওপর ওপর এখানেও একসারি মূর্তি রয়েছে।
ওপর
জঙ্ঘার ওপরে বড়ণ্ডি অংশও অক্ষত নেই। এর কিছুটা ঝোলা বারান্দার মত অংশ বাইরে বেরিয়ে
আছে। তার গায়ে অপরূপ নকশাকাটা। জগমোহনের তিনদিকে তিনটি দরজা। পূর্বদিকে সিংহদ্বার।
তিন দরজার পর বিস্তৃত চাতাল শেষে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে। চতুর্থদিক অর্থাৎ
পশ্চিমদিকে বড় দেউলে যাওয়ার দরজা।
জগমোহনটি
পঞ্চরথ পীড় দেউল বা ভদ্রদেউল। বাড় অংশে পাঁচ ভাগ- পা-ভাগ, তল জঙ্ঘা, বন্ধন, উপর
জঙ্ঘা এবং বরণ্ডি। পা-ভাগের
ওপরে তল-জঙ্ঘায় দুই জোড়া করে অর্ধস্তম্ভের মাঝে মাঝে কুলুঙ্গি করা হয়েছে। তাতে
অপেক্ষাকৃত বড় মূর্তিগুলি ছিল, যার বেশীরভাগই এখন আর নেই। অলসকন্যা, মিথুনমূর্তি
এখনও কিছু কিছু আছে, আর রয়েছে রাহাপাগের উল্লম্বনরত বিড়াল, কোনাপাগ ও অনুরথ পাগের
খাঁজে গজবিড়াল ও রাক্ষস বিড়ালের মূর্তিগুলি। উপর জঙ্ঘার পরিকল্পনা তলজঙ্ঘার মতই। সবার ওপরে বড়ণ্ডিতেও
নানান নকশা রয়েছে।
বড় দেউলের তিনদিকে সূর্যদেবের তিন মূর্তি - দক্ষিণে দণ্ডায়মান
পূষা, পশ্চিমে সূর্যদেব ও উত্তরে অশ্বপৃষ্ঠে হরিদশ্ব। জগমোহনের পূর্বদ্বারের সামনে ছিল একটি ধ্বজস্তম্ভ। তার
শীর্ষে ছিল সূর্যসারথি অরুণের মূর্তি। এই মূর্তিটি এখন পুরীর মন্দিরে আছে।
জগমোহনের তিন দ্বারের সামনে সোপানের কাছে ও মন্দিরের
চত্ত্বরের ভিতরেই প্রকাণ্ড পাদপীঠের ওপর রয়েছে তিনজোড়া বিশালকায় মূর্তি।
উত্তরদ্বারের দিকে দুটি হাতি, দক্ষিণদ্বারে দুটি অশ্ব এবং পূর্বদ্বারে
হস্তিদলনকারী শার্দুল মূর্তি।
পীর দেউলের গন্ডিতে তিন পোতাল। প্রথম পোতালের চাতালের
চারদিকে চারটি করে মোট ষোলটি কন্যামূর্তি। আর রাহা অবস্থানে ঝুঁকে থাকা আটটি
নৃত্যশীল ভৈরবমূর্তি। দ্বিতীয়
পোতালেও ষোলটি কন্যামূর্তি। তৃতীয় পোতালে রয়েছে করালদ্রংস্ট্রা সিংহ। তার ওপরে
ঘন্টা-শ্রী, আমলক প্রভৃতি। কন্যামূর্তিগুলি সম্ভবত নৃত্যরতা দেবদাসীদের। কঙ্কন, কেয়ূর, শতনরী, কর্ণাভরণ
মুকুট - অলঙ্কারে শোভিত দেবদাসীরা গীতবাদ্যে মত্ত, কেউবা দর্পনহাতে ব্যস্ত
প্রসাধনে। আজ আর মন্দিরের ওই অংশের কাছে দর্শকদের যাওয়ার অনুমতি নেই। তাই অনেক
নীচে দূর থেকেই খুঁজতে থাকি বিলীয়মান কালের তরুণ শিল্পীর সৃষ্টি সেই নারীটিকে যার
মুখের হাসি আর চোখের কোলের জল মুছে দিতে পারেনি সময়ও।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ শ্রী নারায়ণ সান্যাল
'পথ' পত্রিকা - ২০১৫
রণথম্ভোর ভ্রমণ ও একটি অসম্পূর্ণ রহস্য কাহিনি
দময়ন্তী দাশগুপ্ত
‘আপলোগ
আগ্রা সে আয়েঁ হ্যায়?’
পিছন থেকে লালমোহনবাবুর মতো টোনে যে ভদ্রলোকটি প্রশ্নটা
করলেন ফিরে দেখলাম চরিত্রটাও সত্যজিতের কোন গল্প থেকেই যেন উঠে এসেছে। মাঝারি
উচ্চতা, একটু ভারীর দিকেই চেহারা, বয়স পঞ্চাশের কোঠার মাঝামাঝি হবে। শার্ট আর
জিনসের প্যান্ট পরা, ওপরে গাঢ় নীল রঙের পুলোভার, বাদামী রঙের একটা মাফলারে
গলা-মাথা ঢাকা, হাসিমুখ, গলায় মাফলারের ওপরে ক্যাননের ক্যামেরা ঝুলছে। বাহারি একটা
লাঠির ওপর ভর দিয়ে সামান্য ডানদিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে।
বীরেন উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ,
আগ্রা থেকেই, তবে আমরা আসার পথে ভরতপুর ঘুরে এসেছি। আপনি?’
‘আপনারা
বাঙালি!? বাঃ, তাহলেতো খুব ভালোই হল। এত
বিদেশি আর নন বেঙ্গলি যে কথা বলে সুখ নেই মশাই। আমিতো আবার একা মানুষ। আমিও ভরতপুর
থেকেই। ওফ্... পাখি দেখলেন – এতরকম পাখি আমিতো
জন্মেও দেখিনি! (দীপের ক্যামেরার দিকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে) আমার ক্যামেরাটা
একবার দেখবেন দাদা, একটু প্রবলেম হচ্ছে। আপনাদের কোন ঘরটা? ও, ওপরে? আমার পাশেই
তাহলে। আমাকেতো প্রথমে ঘর নিয়ে ঝামেলা করছিল, তারপর যাইহোক দিয়েছে। বিকেলে সাফারিতে
বেরোচ্ছেন নাকি? আমার আজকে কমপ্লিট রেস্ট, কাল সকালে যাব। আছেন কতদিন?’...
কথোপকথন শুনতে শুনতে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে থাকি। ঘন্টা তিনেক
হল রণথম্ভোরে এসে পৌঁছেছি। আমাদের হোটেলটা মূল শহর এলাকা থেকে একটু দূরে বেশ
ফাঁকার মধ্যে। সামনের কালো পিচের রাস্তা দিয়ে হেলতেদুলতে চলেছে উটে টানা মালবাহী
গাড়ি। হোটেলের দোতলায় ছাদ লাগোয়া দুটো ঘর – একটায়
আমরা, অন্যটা সকালে এসে খালি দেখেছিলাম। বুঝলাম ওটাতেই এখন বাদামী মাফলার ভদ্রলোক
রয়েছেন। রাজশেখর আর বীরেনরা নীচের দুটো পাশাপাশি ঘরে। এদের কুক অসুস্থ, কাছেই অন্য
একটা হোটেলের চমৎকার ফুলের বাগানে বসে দুপুরের খাওয়া সেরে ফিরলাম। এখনই বিকেলের সাফারিতে
বেরোব। বু, বুই, মিওন – দলের ছোট তিন
সদস্য খুব উত্তেজিত, যদি বাঘ দেখতে পাওয়া যায়!
আড়াইটে নাগাদ হোটেলের সামনেই গাড়ি হাজির। বড়সড় কুড়ি সিটের
ক্যান্টার। প্রায় ভর্তি হয়েই এসেছে, আমরা উঠে বসতে বাকিটুকু ভরে গেল। স্কুলের
ছেলেমেয়েদের একটা বড় দল রয়েছে। তাদের প্রবল হইচইতে বেশ আশঙ্কিত হয়ে উঠলাম। বেচারা
শান্তিপ্রিয় বাঘেদের দেখা মিলবে না তাতো বেশ বুঝতেই পারছি, বনের অন্য জন্তুরাও
থাকলে হয়! মুশকিল এটাই যে হিন্দি-ইংরেজি, নরমে-গরমে কোনভাবে বোঝানোতেই এরা কান
দেয়না। এত বড় দল যে একজন থামলে অন্য দুজন কথা বলে ওঠে। গাইডের ধমকে সবেমাত্র চুপ
করেছিল হঠাৎ একদল হরিণ দেখে হিন্দিতে সমস্বরে চিৎকার –‘হিরন, হিরন’... আমরা প্রমাদ গণি।
ইন্টারনেটে জঙ্গল সাফারি বুক করা ছিল আগেই। শুনেছিলাম জোন
তিন আর পাঁচ-এ জন্তুজানোয়ার দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আমাদের ভাগ্যে জোন
নাম্বার টু। মূল গেটের কাছেই প্রাচীন বৃদ্ধ এক বটগাছ তার অজস্র ঝুরি নামিয়ে
বাতাসের দোলায় ফিসফিসিয়ে আমাদের স্বাগত জানায়, যেন গল্প শোনায় পুরোনো দিনের। প্রাচীন
অরণ্য, ভেঙ্গে যাওয়া দুর্গের ধ্বংসাবশেষ – চোখের
সামনে যেন খুলে যায় অনেক বছর আগের ইতিহাসের কোন এক অদেখা পাতা। রণথম্ভোর দুর্গের
ভাঙ্গা প্রাকার আর বিশাল দরজা পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ে ক্যান্টার।
সব অরণ্যেরই একটা নিজস্ব ব্যক্তিত্ব আছে। পাহাড় বা সমুদ্রের
মত জঙ্গলের কাছে গেলেও নিজেদেরকে তার তুলনায় অনেক ক্ষুদ্র লাগে। পিছনের সিট থেকে
উঠে সামনে গাইডের অন্যপাশটায় এসে দাঁড়াই। আরও কয়েকটা ক্যান্টার রয়েছে আগে-পিছে।
এখন সবাই চুপ। কে জানে হয়তো অরণ্যের বিশালতার ছোঁয়া অন্যদের মনেও লেগেছে কীনা!
এখানে জঙ্গলের চরিত্র আমার চেনা ডুয়ার্স কিম্বা আসামের থেকে একেবারেই আলাদা। বড়বড়
সবুজ গাছ কিম্বা এলিফ্যান্ট গ্রাসের নিবিড় প্রাচীন গন্ধমাখা অরণ্য নয়। এ অরণ্য
রুক্ষ্ম। শুরুর দিকে বট-পিপুলের প্রাচূর্য থাকলেও মূলতঃ ঘাস জঙ্গল। মাঝারি উচ্চতার
কুশ ঘাস মাথা তুলেছে সর্বত্র। তারই ফাঁকে ফাঁকে অজস্র ধোক (Dhok) গাছ ছোট ছোট লালচে পাতা আর
কাঁটাভরা ডাল নিয়ে মাথা নুইয়ে দিয়েছে। রাস্তার ধারের গাছগুলো হাত বাড়িয়ে যেন
আমাদেরও ছুঁতে চাইছে। চট করে মাথা সরিয়ে না নিলে লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মাঝে
মাঝে চোখে পড়ছিল খেজুর গাছ। বের, চিলা, আম, খয়ের চেনা-অচেনা আরও নানা গাছও। একেকবার
মনে হচ্ছিল এই জঙ্গল থেকে শুধু বাঘ কেন ঘোড়ায় চেপে যদি ডাকাতদলও বেরিয়ে আসে তাহলেও
অবাক লাগবে না।
জঙ্গলে ঢোকার আগেই বাহারি শিংওয়ালা হরিণের দল দেখেছিলাম – গাইড ফিসফিস করে জানিয়েছিল যে
এরা বাঘের প্রিয় খাবার। এবারে কিছুটা ঢুকতেই চোখে পড়ল একদল চিতল হরিণ ঘাস খাওয়ার
ফাঁকে কৌতুহলী চোখ তুলে আমাদের দেখছে। আরও কিছুটা এগোতে এবার একদল চিঙ্কারা। ময়ুরেরা
ঘুরে বেড়াচ্ছে আপনমনে। স্কুলের ছেলেমেয়েদের দলটা এখন বেশ চুপচাপ – সবাই সন্ধানী চোখে দেখছে
এদিক-ওদিক। হঠাৎ পাখি ডেকে ওঠে অদ্ভুত সুরে, চঞ্চল হয় বাঁদরের দল, একমুহূর্তে গোটা
জঙ্গল কেমন থমথমে হয়ে যায়, কানখাড়া করে সতর্ক হরিণের দল, আমরাও চুপচাপ বসে থাকি
থেমে থাকা ক্যান্টারে – শুধুই
অপেক্ষা...। নাহ্, জঙ্গল আবার স্বাভাবিক হয়ে ওঠে, পাখি ডাকে তার নিজস্ব ছন্দে,
হরিণেরা ঘাসে মুখ ডোবায়। ক্যান্টার এসে থামে একটা উঁচু জায়গায়। নীচে একটা সরু খাল।
জলের ধারে পাথরের মূর্তির মত শুয়ে রয়েছে কয়েকটা কুমীর। বেশ খানিকক্ষণ অরণ্যের রূপ,
রঙ, গন্ধ অনুভব করি। ডানদিকে দূরে টিলার ওপরে দেখা যায় দুর্গ প্রাচীর। জঙ্গলের
মাথায় আবির ছড়িয়ে সূর্য অস্ত যায় ধীরে ধীরে। ফেরার পথেও হরিণ-ময়ুর অনেকই চোখে পড়ে,
দেখা মেলে একটা বুনো শুয়োরেরও। তবে বাঘের দেখা নেই, কোথাও যেন সবাই একটু হতাশ। ছোটদেরতো
রীতিমত মনখারাপ। ফিরে আসতে আসতে সন্ধ্যা তার হিম ঠাণ্ডা নিয়ে নেমে আসে।
‘কেমন
ঘুরলেন? দেখতে পেলেন কিছু? পাঁচ নম্বর জোনে বাঘ দেখা গেছে জানেন? আপনারা গেছিলেন
নাকি?’ – বাকিদের বাদামী মাফলারের বাউন্সারের মুখে
ফেলে রেখে আমি সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতলায় উঠে যাই।
বিকেলে হোটেল থেকে খানিক এগিয়ে স্যুভেনিরের দোকানগুলোয় ঢুঁ
মারি। দোকানে ঢুকে চোখ আটকায় হাতে আঁকা বাঘের ছবিগুলোতে। এত নিঁখুত যেন জীবন্ত মনে
হয়। হোটেলের সব ঘরেও রয়েছে বাঘের এক বা একাধিক ছবি। শিল্পীদের হাত চমৎকার – বিদেশি পর্যটকদের কাছে রণথম্ভোর
স্কুল অফ আর্ট-এর কদর খুব। পাগমার্ক আঁকা গেঞ্জি, রণথম্ভোর ন্যাশনাল পার্ক লেখা
টুপি ইত্যাদি টুকটাক কেনাকাটা হয়।
পরদিন ভোরে আবার জঙ্গল সাফারি। এবারেও জোন টু, তবে একটু
অন্য পথে এগোনো। পাখির কিচিরমিচির আর সূর্যের প্রথম আলোয় অরণ্যে সোনারঙের ভোর হয়। জানুয়ারি
মাসের সকালের প্রবল শীতে হাত-পা জমে যাচ্ছে, জ্যাকেট-টুপি ভেদ করে হাড় কাঁপিয়ে
দিচ্ছে ঠাণ্ডা হাওয়া। ক্যান্টারের সামনে দিয়েই দৌড়ে রাস্তা পেরোয় হরিণ। পথের পাশ
দিয়ে হেঁটে যায় ময়ুর। পথের শেষে একজায়গায় গাড়ি থামলে দেখি খাবারের আশায়
ক্যান্টারের গায়ে উড়ে আসছে পাখির দল। হাতে করে দানা নিয়ে পাখিকে খাওয়ানো – বাঘের দেখা না পেলেও এবারে কিন্তু
ছোট-বড় সবাই খুব খুশি।
জঙ্গল থেকে ফিরে গন্তব্য রণথম্ভোর দুর্গ। হাতে সময় কম। আজই
এখান থেকে জয়পুরের দিকে রওনা দেব। চট করে চা-জলখাবার খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়ি।
এখনও কাঠামো দেখলে বোঝা যায় যে একসময় বেশ শক্তপোক্ত দুর্গ
ছিল রণথম্ভোর। এটি শাকম্ভরির চাহমানা সাম্রাজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল।
আনুমানিক পঞ্চাশ শতকে মহারাজা জয়ন্ত এই দুর্গ নির্মাণ করেন। ১২ শতকে পৃথ্বীরাজ
চৌহানের কাছে হেরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত দুর্গটি যাদবদের দখলে ছিল। তবে এই দুর্গের
সবচেয়ে শক্তিশালী অধিপতি ছিলেন হাম্বির দেও (১২৮২-১৩০১ শতাব্দী)। হাম্বির
শিল্প-সংস্কৃতির একজন উল্লেখযোগ্য পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ১৩০১ সালে আলাউদ্দিন খিলজির
বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন হাম্বির। মনে পড়ে গেল ছেলেবেলায় পড়া
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাজকাহিনী’-র গল্প – একমুহূর্তে ফিরে গিয়েছিলাম সেই কল্পজগতে – পাহাড়ের ওপরে রাজপুত কেল্লা, বীর
রাজপুতদের যুদ্ধ, রাজপুত সুন্দরীদের জহর ব্রত...। এরপরে এই দুর্গ দিল্লির
সুলতানদের হস্তগত হয়। পরবর্তীকালে রানা সঙ্ঘ দুর্গের পুনরুদ্ধার (১৫০৯-১৫২৭) করলেও
শেষপর্যন্ত তা মুঘলদের করায়ত্ব হয়।
ইতিহাসের পাতা থেকে মুখ তুলে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে দেখতে থাকি
জঙ্গলের মাঝে এই বিশাল দুর্গকে। সত্যি তাজমহল, আকবরের দুর্গ, ফতেপুর সিক্রি, কী এই
রণথম্ভোর দুর্গ গত কয়েকদিনে একের পর এক দেখতে দেখতে এটাই মনে হচ্ছিল যে কীসব
অসাধারণ স্থাপত্য তৈরি করে গেছেন সেকালের মানুষেরা যা আজকে আমরা ভাবতেই পারব না।
রণথম্ভোর দুর্গের মোট সাতটি দরজা ছিল – নওলাখা
পোল, হাতিয়া পোল, গণেশ পোল, আন্ধেরি পোল, সুরজ পোল, দিল্লি পোল এবং সাত পোল। একসময়
সৈন্যদের হাতি-ঘোড়াও উঠত এই সিঁড়ি দিয়ে। স্বয়ং রাজা হাতির পিঠে চেপে যে দরজা দিয়ে
দুর্গে প্রবেশ করতেন তারই নাম হাতিয়া পোল। দুর্গের ভেতরে রয়েছে হাম্বিরের প্রাসাদ,
রানির প্রাসাদ, হাম্বিরের বড় ও ছোট কাছাড়ি, বাদল মহল, বত্রিশ খাম্বা ছত্রি,
ঝানওয়ারা-ভানওয়ারা (শস্যগুদাম), মসজিদ ও দরগা, হিন্দু ও জৈন মন্দির প্রভৃতি নানান দ্রষ্টব্য।
যদিও কালের নিয়মে অধিকাংশই এখন ভগ্নপ্রায়।
দুর্গের সামনে পৌঁছে দেখি সর্বত্র ছোট-বড় নানা আকারের নানা
ভঙ্গিমায় অজস্র হনুমান। এর আগে জঙ্গল সফরের সময় বারবারই এদের দেখা মিলেছে বটে
কিন্তু তাই বলে এত! চওড়া সিঁড়ি ভেঙ্গে ধীরে ধীরে উঠি। দুর্গের ভাঙ্গা প্রাকারের
গায়ে গজিয়ে উঠেছে গাছ, পাথরের ফাটলে দুলছে বটের ঝুরি। সিঁড়ির ধাপে, দুর্গের খোলা
চত্ত্বরে, আনাচেকানাচে সর্বত্রই বানর বাহিনীর আধিপত্য। বুঝলাম এই শতাব্দীতে
দুর্গটা ওদের দখলেই আছে।
কিছুটা ওপরে উঠে প্রাচীরের গায়ের কাছ থেকে নীচের দিকে
তাকিয়ে মুগ্ধ হই – পুরো অরণ্যপাঠ
আমার চোখের সামনে। রণথম্ভোর জঙ্গলে তিনটি বিশাল পুষ্করিনী বা তালাও আছে। এরমধ্যে টলটলে
জলের পদম তালাও দুর্গের একেবারে কাছে। একসময় এটি নাকি পদ্মফুলে ভরে থাকত তাই এই
নাম। গাছপালার ফাঁকে দূরে অন্য একটি জলাশয়ও নজরে পড়ে। সম্ভবত এটাই রাজাবাগ তালাও।
মালিক তালাওটি জঙ্গলের আরও গভীরে।
সিঁড়ি দিয়ে বেশ কিছুটা উঠে একটা চত্ত্বর মত। সেখানে দুর্গের
একটা ম্যাপও রয়েছে। দেখলাম আমাদের হাতে যা সময় আছে তাতে দুর্গের চারভাগের একভাগ
ঘোরাও সম্ভব নয়। আসলে পুরো দুর্গ দেখতে হয়তো কয়েকদিন লেগে যাবে। সব অংশে এখন আর
কেউ যায় কীনাও কে জানে! সিঁড়ি ভেঙ্গে একটু ওপরে একটা খোলা চত্ত্বরে গিয়ে দাঁড়াই।
এটা দুর্গের ভিতরের অংশে। এখান থেকে বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা দুর্গটা সম্বন্ধে
কিছুটা আন্দাজ করা যায়, যদিও তাও বোধহয় সবটা নজরে আসে না। যতদূর
চোখ যায় ঝোপ-ঝাড়-জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে দুর্গের ঘর-বাড়ি, ভগ্নস্তুপ খানিক দৃশ্যমান
খানিক অদৃশ্য – সবমিলিয়ে বেশ একটা গা ছমছমে ব্যাপার। মনে হল বেশ জমাটি একটা রহস্য
গল্প তৈরি হতে পারে এই পরিবেশে, এমনকী দু’একটা খুন-টুন থাকলেও আশ্চর্যের নয়।
রহস্যটা মনের মধ্যে জমে উঠছিল বেশ ক্ষীরের মতোই, হঠাৎ পিছন
থেকে ছোট্ট মিওন চেঁচিয়ে ওঠে – ‘ফেলুদা, সেই লোকটা’ – তাকিয়ে দেখি বাদামী মাফলার দুর্গের ভিতরের দিকে দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে...।
‘ট্রাভেল ছুটি’ - ২০১৩
No comments:
Post a Comment