Friday, April 29, 2016

গ্রেভইয়ার্ড

অনেকদিনের পুরোনো লাইব্রেরি, যেখানে নিয়মিত বিশেষ কেউ যায় না, টিমটিম করে আলো জ্বলে, একজন লাইব্রেরিয়ান একা বসে খবরের কাগজের পাতা ওলটান আর তার মাথার ওপর অনেকদিনের পুরোনো পাখাটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে ঘুরতে থাকে, কেমন একটা কবরখানার স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। চতুর্দিকে বড় বড় পুরোনো কাঠ আর কাঁচের আলমারি, কাঁচগুলো একটু ঘসা ঘসা হয়ে এসেছে, তার ভেতরে অজস্র বই, পুরোনো নথিপত্র ঠাসাঠাসি করে রাখা, যেন সামথিং বারিড ইনসাইড এমনই অনুভূতি হয়। অনেক অনেক মৃত কাগজ, মৃত শব্দের ভারে চেপে নিথর বসে রয়েছে। পুরোনো, খুব পুরোনো একটা গন্ধ লেগে রয়েছে বাতাসের গায়ে।

সেইখানে কাগজ-কলম নিয়ে বসে পুরোনো বই, নথিপত্রের পাতা ঘেঁটে একটা-দুটো করে শব্দ লিখছি কাগজে, খাতায়। শব্দগুলো প্রাণ পেয়ে যেন নড়েচড়ে উঠছে। আরও লিখে যাচ্ছি, প্রাচীন কাহিনি নতুন করে, প্রাচীন সব লেখকের নাম উঠে আসছে জীবন্ত শব্দে...।

অতীতের সঙ্গে, মৃতের সঙ্গে জীবিতের যোগসূত্র স্থাপিত হচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া নামেরা বেঁচে উঠছে শব্দ আঁকড়ে ধরে। প্রাচীন আলমারির ভেতর থেকে ভেসে আসা দীর্ঘশ্বাস যেন বলছে অনাগত দিনের মানুষ তোমার জন্যই আমরা অপেক্ষা করছিলাম। ছেলেবেলায় পড়া বিভূতিভূষণের ডায়েরির পাতা মনে পড়ছে।

একশো বছর পর আমিও অমনি কোথাও মৃত শব্দের আখরে চাপা পড়ে যাব। তখনও হয়ত কেউ আসবে মৃত আর জীবিতের যোগসূত্র স্থাপন করতে...। প্রাচীন গন্ধ মাখা ঘরে ধুলো সরিয়ে ভেঙে ভেঙে আসা পাতা ওলটাবে...


আর আমি নিঃশব্দে অপেক্ষা করব আর একবার বেঁচে ওঠার জন্য...

কিশোর সাহিত্য

ইংরেজিতে কিশোর থুড়ি ইয়ং অ্যাডাল্ট সাহিত্যের রমরমাটা ইদানীংকালে হয়ত হ্যারি পটারকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেটার ফর্মটা আরও কম্প্যাক্ট হয়েছে, পরপর দুটো বই পড়ে বেশ বুঝতে পারলাম। বইদুটোই আমাকে বেশ আচ্ছন্ন করেছে নীল গেইমান-এর গ্রেভইয়ার্ড বুক আর ক্রিস ওয়েস্টউডের মিনিস্ট্রি অফ প্যান্ডিমোনিয়াম। সবচেয়ে আশ্চর্যের হচ্ছে ভাবনার বৈচিত্র্য। বেসিক থিম মূলতঃ এক। খারাপ এবং ভালোর লড়াই এবং তাতে ভালোর আপাত জয়। কিন্তু পটভুমিকা এত বিচিত্র এবং এতরকম তার অন্তরার্থ...। মহাকাশ থেকে কবরখানা সর্বত্রই যে অল্পবয়সী মন ঘুরে বেড়াতে পারে, অর্থ খুঁজতে পারে জীবন এমন কী মৃত্যুরও সেইটা খুব মনে হয়। কিশোর মনের চাহিদা এবং বিস্তৃতি উভয়ের জন্যই ভালো। আমারই এই বয়সে পড়ে আশ্চর্য সব অনুভূতি হচ্ছে। বইগুলো ভাবায়।

বাংলা কিশোর সাহিত্য কোনওদিনও এর ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেনি। হ্যারি পটারের সঙ্গে কেউ কেউ অকারণেই সুকুমার রায়ের তুলনা করে বাংলা কিশোর সাহিত্যের পিঠ চাপড়ানোর চেষ্টা করেছেন। তবুও একমাত্র সুকুমার রায়ই কিছু ইউনিক ভাবনা ভাবতে পেরেছেন। সারা বিশ্বের কিশোর সাহিত্য যখন আলাদা একটা জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে তখন বাংলা কিশোর সাহিত্য মোটের ওপর সেই থোড় বড়ি খাড়াতেই আটকে গেছে। এখানের কিশোর সাহিত্যের বেশ বড় অংশ জুড়েই থাকে খুব কাঁচা গোয়েন্দা কাহিনি।

ইয়ং অ্যাডাল্ট বইগুলোর কমন বিষয় হল, নায়ক এক বা একাধিক সাধারণ ছেলে বা মেয়ে। কিন্তু তার মধ্যে কিছু অসামান্য ক্ষমতা আছে। তার জীবনে কিছু দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা আছে। অনেকক্ষেত্রেই বাবা-মা দুজনেই বা কোনও একজন নেই। আর্থিক অবস্থাও খুব সাধারণ বা খারাপ। কিন্তু এক বা একাধিক অসম্ভব ভালো বন্ধু আছে। এছাড়া ওই ভালো-মন্দের লড়াইয়ে ভালোর জিত সে তো আছেই। এতদিন যেটা আপত্তিকর লাগত যে, বেশ কিছু বইতেই এই অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরাই হাতে আগ্নেয়াস্ত্র বা অন্য কোনও অস্ত্র নিয়ে লড়াই করছে এবং তাতে জিতেও যাচ্ছে। এই ব্যাপারটা অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের মাথায় ঢুকে যাওয়াটা মোটেই ভালো নয়। তার ফল খুব খারাপই হয়। কিন্তু শেষ যে বইদুটোর কথা বললাম, বিশেষতঃ শেষটায় লেখক দেখিয়েছেন যে মানুষের মন, ইচ্ছাশক্তি, ভালো ভাবনা খারাপকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এটা  যে কোনও অস্ত্রের থেকেও এর শক্তি অনেক বড়। লুসি আর স্টিফেন হকিং-এর জর্জকে নিয়ে লেখা সিরিজটারও মূল বক্তব্য কিছুটা এটাই। লেখকের এই আইডিয়াটা খুবই গ্রহণযোগ্য এবং আধুনিক প্রজন্মের কাছে ভীষণ জরুরি।

আসলে বাংলা কিশোর সাহিত্যে কিশোর-কিশোরীদের হয় আমরা শিশু হিসেবে ভেবে নিই, অথবা বড় হওয়া মানে ইদানীংকালে টিন এজ লাভ স্টোরির নায়ক-নায়িকা হতে পারে এই পর্যন্ত। কিন্তু সে একটি মানুষ, এভাবে ভাবতে চাইনা। তাই গল্পের ফর্মে এবং পটভূমিতে বৈচিত্র্য আসে না। তবে বিদেশি গল্পের নকল করতে গেলে আরও সর্বনাশ। যেমন এনিড ব্লাইটন-এর ফেমাস ফাইভের অতি বাজে নকল পাণ্ডব গোয়েন্দা। যে ছেলেমেয়েরা একবার বিদেশি এইসব কাহিনির রসাস্বাদন করেছে তার কাছে একেবারেই বোকার মতো ঠেকবে।

বাংলা সাহিত্য যতই সমৃদ্ধ বলে অহংকার করি না কেন, বিস্তৃত প্লট, লেখার বৈচিত্র্য কোনওকিছুতেই বিশ্ব সাহিত্যের কোনও ধারারই ধারে কাছে আসে না বলে আমার মনে হয়। তবে কতটুকুই বা পড়েছি আমি। তবু তুলনা মনে এসেই যায়। প্রবন্ধ, কবিতা এবং ঘর-সমাজ বিষয়ক কিছু গল্প-উপন্যাস ছাড়া। আর সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্য।


ছোটবেলায় মেয়ের হাতে বই তুলে দিতাম। এখন নতুন নতুন বইয়ের খোঁজ ওই আমায় দেয়। এই দুটো বই-ই ও আমায় পড়িয়েছে। ওদের ভালোলাগছে এসব, এইটা জেনেও ভালোলাগে। এইসব বই ওরা আলোচনা করছে, নিজেরাও ভাবছে। এটা পরোক্ষভাবে আগামীদিনে বাংলা কিশোরসাহিত্যকেও হয়ত পুষ্ট করবে। আমাদের কম বয়সে কত কম পড়ার সুযোগ পেয়েছি। এত ভার্সেটাইল লেখা কল্পনাশক্তিকেও রসদ যোগায়।

Thursday, April 28, 2016

অপেক্ষা

কবে বৃষ্টি আসবে?
আমার রুখু শরীরের ফুটিফাটা দাগ বুজিয়ে দিয়ে
গড়িয়ে যাবে জলের আদর, সোঁদা গন্ধের নেশা ছড়িয়ে।
তারপর নতুন ধানের বীজ শরীরের গভীরে...।
কবে বৃষ্টি নামবে বলতো?

অপেক্ষায় আছি।

ভোট

কারা যেন রাস্তা দিয়ে ফেরিওলার মতো জোরগলায় হেঁকে গেল
সব বদলে যাবে, সবকিছু... শুধু বেছে নিতে হবে আমাদেরই।

সব বদলে যাবে? সবকিছু!

কারখানার কলে বাপটার পা কাটা পড়েছিল, ছেলেটা চাকরি পেল তো কারখানাই গেল বন্ধ হয়ে।
ওই যে মাথার ওপর ভাঙা চালের ফুটোফাটা দিয়ে ঘরে জল নামছে...

এইসব বদলে যাবে?

সব বদলে যাবে! পাকা ঘর, ঘরে খাট-পালঙ্ক, দুবেলা সাদা জুঁইয়ের মতো পেটভরা ভাত, ছেলেটার লেখাপড়া, চাকরি, মেয়েটাকেও ইস্কুলে পাঠাবো তাহলে...

সব বদলে যাবে?

পাশের বাড়ির জোয়ান মানুষটাকে মাঝরাত্তিরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছেলে পড়াত। আজও ফিরে আসেনি।
বউটার একঘেয়ে কান্নার আওয়াজ রাত হলেই যেন বাড়তে থাকে।

এইসব নাকি বদলে যাবে!

কারা রোজ চিৎকার করে বলে, বলে যায় সরুমোটা নানারকম আওয়াজে, সব বদলে যাবে, সব...। শুধু আমাদেরই বেছে নিতে হবে...।

ওবাড়ির মেয়েটা গায়ে আগুন দিয়ে মরেছিল, সাত জন একে একে ধর্ষণ করেছিল তাকে।
বাবা নাকি বিরোধী পক্ষের লোক, এমনটাই জনশ্রুতি। মুচলেকা দিয়ে এসেছে সে, ব্যাপারটা নিতান্তই পারিবারিক। মরে যাওয়া মেয়ের থেকে নিজের বেঁচে থাকার প্রয়োজনটা ঢের বেশি তার কাছে।

এইসব বদলে যাবে!

রাতের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া লাসের মিছিল, ঘরে ও মাঠে চাপ চাপ রক্ত মুছে যাবে। মুছে যাবে দাগ বারুদের কারখানায় ঝলসে যাওয়া শিশুটির দেহ থেকেও!
মুছে যাবে খিদে বা নগ্নতার মতো আরও কিছু তুচ্ছতা। এমনই প্রতিশ্রুতি আছে।

অতএব পা টেনে টেনে আরেকবার লাইনে দাঁড়াই লাইনে দাঁড়ানোই যখন আমাদের এক এবং একমাত্র গণতান্ত্রিক অধিকার।

একমাত্র গণতান্ত্রিক অধিকার, যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমার বা আমার ঘরে ঢুকে নবজাতকের গলা টিপে ধরে কোনও ফেরিওলার দল ক্ষমতার জোরে চেঁচিয়ে উঠে বলছে, খবরদার বাড়ি থেকে এক পা বেরিয়েছ কী...।

যতক্ষন পর্যন্ত না দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তুমি বা আমি অন্তত কেউ একজন অথবা দুজনেই ঘুরে দাঁড়াব।


ততোদিন প্রতিশ্রুতির ফেরিওলার ডাক আর আমাদের দীর্ঘ লাইন চলতেই থাকুক।

লিখতে লিখতে লিখতে লিখতে...

বেলার দিকটায় রোজ ঝিমুনি লাগে, একেকদিন চোখটা লেগেও যায়। হ্যাঁ, এইসময়ে ঘুম বলতে নেই, ওটা চোখ লাগাই। না হলে বড্ড বিবেকে লাগে হুস হুস করে চলে যাওয়া সময়ের জন্য। পরে চোখ খুলে বিরক্ত লাগলে নিজেকেই আশ্বাস দিই, ও রাতের ওষুধের যোগফল বলে। যদিও গরমের বেলায় পর্দাটানা পাখা চলা ঘরে ঝিমুনি কারোর পক্ষেই খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। পাখার আওয়াজই বেশ একটা ঘুম পাড়ানি গানের মতো।

যাইহোক, আজকেও স্নান করে টিফিন খেয়ে বইয়ের সেকেন্ড প্রুফ দেখতে দেখতে কখন চোখ লেগে গিয়েছিল। আর অমনি...নাহ্‌, রুমালটা ম্যাও করে ওঠেনি। করতেই পারত অবশ্য, যা গরম পড়েছে...।

আর অমনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। স্বপ্ন দেখার একটা বাজে রোগ আমার চিরকালের। ঘুমিয়ে, জেগে সবরকম অবস্থাতেই আমি নানা ধরণের স্বপ্ন দেখি। মজার স্বপ্ন, ভয়ের স্বপ্ন, আতঙ্কের স্বপ্ন, কোনও মানে হয় না স্বপ্ন, অন্যরকম দিনের স্বপ্ন ইত্যাদি ইত্যাদি। মাঝে মাঝে ধারাবাহিক স্বপ্নও দেখেছি। ধারাবাহিক স্বপ্ন আবার দুধরণের হয় একই সময়ে বারবার ঘুম ভেঙে, আবার ঘুমিয়ে পড়ে ঠিক আগের শেষ জায়গা থেকে শুরু করা, আর নয়তো পরেরদিন ঘুমালে ঠিক শেষ অংশ থেকে আবার দেখা। ধারাবাহিক স্বপ্ন অধিকাংশই ভয়ের হয়। আজকের স্বপ্নটা অবশ্য একেবারে আলাদা।

অনেকদিনধরে মাথায় একটা উপন্যাসের প্লট রয়েছে। কিন্তু আমার মানসিকতায় উপন্যাস লেখা খুব শক্ত। আমি গল্পই লিখি খুব ছোট ছোট। ভ্রমণকাহিনি যা খানিক বড়। মানে বেড়ানোটা যদি বড় হয়, তাকে তো আর ছোট করতে পারিনা। তাও কখনও করি অবশ্য, একেকটা জায়গা নিয়ে টুকরো লেখা। নিজের লেখার ব্যাপারে ধৈর্য আর মনঃসংযোগ দুটোরই বড্ড অভাব আমার। গবেষণাটা স্রেফ অন্যদের নিয়ে করেছি বলেই কিছুটা যাও লিখতে পেরেছি। আসলে ফিচার রাইটিংটাই আমার ভালো আসে মানে এমন অর্থহীন গোছের টুকরো লেখা।

যেটা বলছিলাম, অন্য অন্য লেখা লিখি, অন্যের লেখা এডিট করি, আর মনে মনে কোনও একদিন লিখব বলে উপন্যাসটার টুকরো ভাবনা জড়ো করি, ওলটপালট করি, ভাবনায় বদল আনি। তো আজকের স্বপ্নে দেখি সেই উপন্যাসটাই হাজির হয়েছে! সাধারণত যেটা হয়, স্বপ্নের দেখাটা কিছুটা বাধ্যতামূলক। মানে ভালো না লাগলেও দেখতেই হবে যেভাবে হচ্ছে। কিছুতেই বদলানো যাবেনা। অন্তত এযাবত আমার ধারণাটা তাই ছিল। আজ দেখলাম, স্বপ্নের ভেতরেও আমি আছি, বাইরেও। আসলে কোনও বই পড়লে বা গল্প লিখলে কোনও না কোনও চরিত্রের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আমরা পড়ি বা লিখি। নিজের সঙ্গে সেই চরিত্রের কিছুটা বা একেবারে মিল না থাকলেও কিছুক্ষনের জন্য যেন ওই চরিত্রে অভিনয় করতে থাকি। তাই স্বপ্নের গল্পটার ভেতরে আমার একটা চরিত্র ছিল। আর বাইরেও আমার একটা চরিত্র ছিল। যেন স্বপ্নটাকে আমি ডিরেক্ট করছিলাম। কোনও জায়গা পছন্দ না হলে বা কোনও অপ্রয়োজনীয় চরিত্র ঢুকে পড়লে সেই জায়গাগুলো বাদ দিয়ে আবার নতুন করে দেখছিলাম। অর্থাৎ স্বপ্নটাকে আমি আমার ইচ্ছামতো বানিয়ে তুলছিলাম কেটে, ছেঁটে, বদলিয়ে। মাঝে মাঝে থামার মতোই যেন ঘুমটা ভেঙে যাচ্ছিল, আবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ে পরের অংশ দেখতে শুরু করছিলাম। অর্থাৎ এটাও ধারাবাহিক ছিল।

ঘুমটা যখন পুরোপুরি ভেঙে গেল তখন বুঝলাম, আসলে আমি স্বপ্নটা লিখছিলাম। লিখছিলাম, মুছছিলাম, এডিট করছিলাম, বদলাচ্ছিলাম। কিন্তু আসলে আমি লিখছিলামই। তবে স্বপ্ন নিয়ে এই লেখার পাঠকেরা ভাববেন না যে এরফলে আমার উপন্যাসটা বেশ কয়েক পাতা এগিয়ে গেল। আসলে পুরোপুরি ঘুম ভাঙার পরই বিষয়বস্তুগুলো কেমন ভাসা ভাসা হয়ে গেল। যতো সময় যাচ্ছে, ততোই আরও মুছে যাচ্ছে সেগুলো।

অতএব বিস্তর লিখেও আমি আসলে যে তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে গেলাম।


Wednesday, April 27, 2016

বিকল্প

পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল,সিপিএম,কংগ্রেস,বিজেপি বাদ দিয়ে বিকল্প শক্তি গড়ে তোলাটা খুব জরুরি।

সাধারণ মানুষ একবার চেষ্টা করেছিল,সেবারে বিশ্বাসের জায়গাটা ভুল হয়েছিল।

আবার পারবে নিশ্চয়।

আসলে বিশ্বাসের কোনও শক্ত ভূমিই নেই তাদের কাছে।

শিক্ষিতদের মতো কম খারাপের (কী করে মাপা যায়?) ক্ষমতায় আসার যুক্তিটা তাদের জীবনে চলবে না। তাদের কাছে সবই ওই জলন্ত কড়াই থেকে উনুনের আগুনে পড়ার মতো।

শুধু বুদ্ধিজীবিদের সরে দাঁড়াতে হবে। সাধারণ মানুষের লড়াই তাঁদের নিজেদের টি আর পি বাড়ানোর জায়গা নয়। তাঁরা সত্যিকারের চাইলে অনেকদিন আগেই পথে নামতে পারতেন, নন্দীগ্রাম পর্যন্ত অপেক্ষা না করে।


মনে রাখতে হবে,রাস্তা কারোর একার নয়। বরং তাকেই একদিন রাস্তা ছাড়তে হয়;যার স্পর্ধা আকাশ ছুঁয়ে যায়।

Monday, April 25, 2016

ঘাটে বসে আছি আনমনা...

ছোটবেলায় বড় হওয়া ব্যাপারটা থাকে কেমন অন্য তীর দেখতে না পাওয়ার মতো অসীম। বেলা যত গড়িয়ে আসে, ওপাড়ের তটভূমি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ততো পেছনপানে নজর যায়। একেই বোধহয় বড় হওয়া বলে, অথবা বুড়ো হওয়া।

হার্পার লি-র টু কিল এ মকিং বার্ড-এ একটা কথা আছে, যতক্ষণ না অন্যের জুতোয় পা গলানো যায়, অন্যের শরীরটার ভেতরে ঢুকে না হাঁটা যায়, ততক্ষণ সেই অন্য জনকে ঠিক বোঝা সম্ভব নয়। আর নিজের ক্ষেত্রে বোধহয় যতক্ষণ না নিজের দেহ থেকে বেরিয়ে এসে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে না দেখা যায়, ততক্ষণ।

একেকদিন নিজেকে এভাবে দেখতে ভালোলাগে। যখন মায়ের আঁচলের কথা খুব মনে পড়তে থাকে।
অথবা, ক্যামেরার ফ্রেমের বাইরে চলে গেল যেসব মুখগুলো তারাও কি কিছু রেখে যায়?

ভালোবাসা কোনও এক অনন্ত অনুভূতির মতো। অথচ কখনও তুচ্ছতায় তীব্রভাবে ব্যথিত হয়ে উঠি।
বেদনা ও সুখ আসলে সমান্তরাল সরলরেখা যারা পরস্পরকে ছুঁতে চায় অবিরত।

দুপুরের মহুয়া ফুল না রাতের কামিনী কার গন্ধ বেশি নেশা বা বিষণ্ণতা ধরানো বোঝা যায়না তখন।
যেমন বেশিরভাগ অঙ্ক আমি কোনওদিন মেলাতে পারিনি পরীক্ষার খাতায়।

শেষপর্যন্ত আমি যে বইয়ের চরিত্র তা খুঁজতে থাকি।

টুকরোগুলো জুড়তে জুড়তে কখন যেন আস্ত একটা জীবন হয়ে ওঠে...

আর আমি বসে থাকি একটা শান্ত পরিপাটি বিকেলের অপেক্ষায় যখন আমার স্বজনেরা ঘরে ফিরে আসবে।

মায়ের জ্বালানো ধুনোর গন্ধ আর শাঁখের আওয়াজ ভেসে আসবে ছেলেবেলার পর্দার ওপার থেকে।


এবং সাদা শাড়িতে কোনও জলের দাগ লেগে থাকবে না।

Sunday, April 24, 2016

তোমরা-আমরা

খেতে বসে কথায় কথায় বাবা বলছিল, আমাদের আগের জেনারেশনের ভাবনাচিন্তা আমরা বুঝতে পারতাম। আমরাই বোধহয় শেষ যে সেসব অনুভব করছি, তোরা একেবারেই অন্যরকম আমাদের থেকে।

ডানহাতে ভাত, বাঁ হাতে মোবাইল সতেরো বছরের মেয়ের ঝটিতি উত্তর, সেটা তো স্বাভাবিক। তোমরা আগের শতাব্দীর শেষে জন্মেছ আর আমরা এই শতাব্দীর মানুষ।

বাবা স্বীকার করে নিয়ে বলে, সত্যিই তো, আমাদের একশো বছরের লোকজনের ভাবনাচিন্তা আমরা বুঝতে পারি, তার আগের নয়।

বিষয়টা শুরু হয়েছিল, শাক খাব না দিয়ে।


শাকভাত মাখতে মাখতে আমিও ভাবছিলাম, ঠিকই তো মেয়ের সঙ্গে আসলে আমাদের জেনারেশন গ্যাপ নয়, আস্ত একটা সেঞ্চুরির গ্যাপ রয়েছে। ওর ধ্যানধারণা আলাদা হবে সেটাই তো স্বাভাবিক।

একলা থাকার খুব দুপুরে

দুপুরের এই গণগণে রোদ্দুরটার মধ্যে একটা হু হু মনখারাপ লুকিয়ে থাকে। এই মনখারাপটা খুব চট করে টের পাওয়া যায় না শীতের বিকেলের মতো। খানিকটা লু বা গরম ধুলো বয়ে যাওয়ার মতো লাগে ভেতরে ভেতরে। ছেলেবেলার এমনি গরমের দুপুরে ঘুঘুর একটানা ডাক কিম্বা হঠাৎ করে কাকের আর্ত চিৎকার সেই অনুভূতিটাকে আরও বিষন্নতার দিকে নিয়ে যেত।

এইরকম গরমের দুপুরে একা একা থাকলে কত মুহূর্ত, কত মুখ, বইয়ের পাতার কত চরিত্র মনে ভিড় করে আসে। নিশ্চিন্দিপুরের গ্রামের বালক অপুর বাঁশের কঞ্চি হাতে ঘুরে বেড়ানো কী দুর্গার ছেঁড়া আঁচলে কাঁচা আম কুড়িয়ে বাঁধার দৃশ্য সত্যি বলে মনে হয়। বৃষ্টি পড়লে পুরোনো যে স্মৃতি যে মনকেমন ভেসে আসে সে আবার ভিজে ভিজে। গরমের দুপুরের স্মৃতি কিছুটা রুক্ষ্ম, উদ্‌ভ্রান্ত।

সেই যে বুড়ো লোকটা আমাদের কাছ থেকে পুরোনো খবরের কাগজ কিনত, অনেকদিন আসেনি এরমধ্যে, শুনলাম অসুখ করে দেশে গিয়ে মরে গেছে। এমনি কত রোদের দুপুরে বারান্দার নীচ থেকে ওর চেনা গলার ডাক ভেসে আসত, কাগজওলা...কাগজ...লোহা বেচবে...। একদিন কী কারণে যেন এমন দুপুরে লেকটাউনের একেবারে শেষের দিকে একটা চওড়া গলি দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখলাম নির্জন রাস্তায় ও হাঁকতে হাঁকতে যাচ্ছে মাঝে মাঝে ওপরের দিকে তাকাতে তাকাতে, কেউ যদি ডাকে।

মাঝে একবার অনেকদিন আসেনি, ভাবছিলাম শরীর-টরির খারাপ হয়নি তো? হঠাৎ করেই আবার হাজির। ভারী খুশি খুশি ভাব। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, রাজস্থান বেড়ানোর সখ ছিল অনেকদিনের। এদ্দিনে খানিক টাকা জমিয়ে আর ছেলের কাছ থেকে আরও কিছু নিয়ে বেড়িয়ে এসেছেন রাজস্থান। বললাম, বেশ করেছেন, কিন্তু এরপরে আর কোথাও গেলে খবর দিয়ে যাবেন।

নাহ্‌, এবারেও খবর না দিয়েই চলে গেল কোথাও।

এই দুপুর রোদ্দুরে দূর থেকে কাগজ, কাগজওলা... ডাক ভেসে এলেই হয়তো কখনও মনে পড়বে ওকে।

খুব গরমের দুপুরের মনখারাপের কোনও এক স্মৃতি হয়ে...।


Friday, April 22, 2016

ঋণ

কিছুই কি প্রাপ্য ছিল এ জীবনে?/ তবু ঘাস, মাটি, জল, আলো, হাওয়া পেয়েছি মায়ের স্নেহের মতো; নীলাকাশ, ভোরের শিশির, জ্যোৎস্না, সবুজ বনানি কত মায়া এঁকে রেখে যায় প্রতিক্ষণে। কিছু কি প্রাপ্য হয় এ জীবনে? যা পাই, যেটুকু পাই, মুঠো ভরি, কোঁচড় ভরে রাখি, ভরে রাখি হৃদয়ের গোপন ভাঁড়ারে।/ কিছু তো প্রাপ্য ছিল না, তবু কত হাসি মুখ, দুচোখের উষ্ণতা রয়ে গেছে স্মৃতির কোটর ভরে।/ প্রাপ্য ছিল না তবু পেয়ে গেছি আরও যাহা কিছু, সেই সবও নতজানু হয়ে মাথা পেতে নিই - এক জীবনের যত ভুল, বেদনা, ব্যর্থতা, না পাওয়া।/ প্রাপ্য ছিল না তবু এ জীবনে তোমাকেও পেয়েছি বারংবার।

বাঙালি মেয়ে ও বাঙলার ডাকাত

বাংলাদেশের মেয়েরা একসময় নিয়মিত লাঠি, ছোরা খেলত। একা বাড়ির বউ একদল ডাকাত ঠেকিয়েছে বা তাড়িয়েই দিয়েছে বলে বা কৌশলে সে নজিরও অনেক ছিল। ডাকাতরা স্বাভাবিকভাবে সেসবেই অনেক দক্ষ ছিল তা সত্ত্বেও।

ছোটবেলা থেকেই এসবের চর্চা করলে মনের জোরও অনেক বেড়ে যায়। আমার মনে হয় আত্মবিশ্বাস এবং শরীরচর্চা বাড়িয়ে গুন্ডাদের রুখে দেওয়া এবং নিজেদের সম্মান রাখার কাজ চাইলে এখনও বাঙালি মেয়ে পারে। লেখাপড়ার পাশাপাশি এই সব শিক্ষাও জরুরি এবং বাধ্যতামূলক করা উচিত।

বছরে একবার শক্তিময়ী রূপে ধুমধাম করে পুজো করার চেয়েও মেয়েকে শক্তিময়ী করে গড়ে তোলাটা জরুরি। আর  ঠিক তেমনি আমি কী পোশাক পড়ব আর কী নেশা করব সেটা নিয়ে যেমন অন্যের মাথা গলানোর দরকার নেই, নিজেকে বাঁচাতেও নিজে পারব সেই জায়গায় যেন পৌঁছাতে পা্রি।

আমাদের প্রজন্মে আমরা অনেকেই এই সুযোগগুলো পাইনি। আগামী প্রজন্ম যেন এই ভুলটা না করে।

বাঙালি মেয়ে কোমর বাঁধলে বাঙলা থেকে আজও ডাকাত তাড়াতে পারে বৈকী।

Wednesday, April 13, 2016

মধ্যবিত্ত জীবন

এভাবেই কেটে যায় মধ্যবিত্ত জীবন ধূ ধূ গরমের দুপুরে একটানা পাখার আওয়াজের মতো।/ মাঝে মাঝে দোলা দিয়ে যায় কিছু আর্তনাদ ব্রীজ ভাঙে অথবা লাল-নীল পতাকার লড়াই
ভোট বল যাকে।/

যার যায়, তারই তো যায় একমাত্র রোজগেরে চাপা পড়ে ব্রীজের তলায়, / যার ছেলে খুন হয় ঘরে মাঠে, রাস্তার বাঁকে,/ রক্তাক্ত ধর্ষিত লাস হয়ে যার মেয়ে পথে পড়ে থাকে।/ যার যায় তারই তো যায়, অন্যেরা চিৎকারে কেবলি গলা ফাটায়।/ তারপরে সব চুপচাপ।/

অথচ সবারই আশ্বাস ছিল ভোটে জিতলে বাঁচাবে তাহাকে!/

বহুকালের পুরোনো পাখার মতো একঘেয়ে আওয়াজে দগ্ধ দিন কাটে,/ দিন কাটে ঘরে বা অফিসের যান্ত্রিক শীতলতার মাপে মাপে,/ রৌদ্রে ঘামে ভিড়ে চৈত্র সেলের বাজারের শেষ ডাকে।/ দিন কাটে।/


কেটে যায় ঝিমধরা মধ্যবিত্ত জীবন নুনে-ভাতে।

Saturday, April 9, 2016

দীর্ঘজীবী

ধর্মের জন্য হত্যা নতুন কোনও কাহিনি নয়। ইতিহাস ঘাঁটলেই দেশে-বিদেশে এর বহু নজীর পাওয়া যাবে। আসলে এ এক ধরণের কন্ঠরোধের চেষ্টা, চেষ্টা ক্ষমতা দখলের।

আসলে ধর্ম হল একটা চেতনাবোধ, এমন একটা অনুভব যা সহজে অনেক মানুষের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। ধর্ম মানুষ মারবার হাতিয়ার কোনদিনই নয়। হিন্দু ধর্মের মতো অতি প্রাচীন ধর্মে আদপে কোথাও কোনও গোঁড়ামি ছিল না। সমাজকে একটা নির্দিষ্ট চেহারা দিতেই এর জন্ম।

ধর্ম যখন ক্রমশঃ গোঁড়ামির দিকে যায় তখন তার থেকেই সৃষ্টি হয় আরও উদার ধর্মীয় মনোভাব। আসলে মানুষের সাধারণ স্বভাব কিন্তু অন্যকে ভালোবাসা। না-ভালোবাসাটা সম্পূর্ণ আরোপিত, কিছু স্বার্থান্যেষী মানুষের সৃষ্ট। বৌদ্ধ, জৈন, বৈষ্ণব ধর্ম বা ফকিরি আন্দোলন এইসবই সেই কথা বলে। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন বুদ্ধ, চৈতন্যেরা। সে যুগে ফেসবুক বা অন্যান্য আন্তর্জাল মাধ্যম তো ছিল না, তাই নতুন ধর্মের সৃষ্টি করতে হয়েছে নিজেদের প্রতিবাদ জানানোর জন্য। একই কারণে অনেক পরে সৃষ্টি হয়েছে ইয়ং বেঙ্গলদের আন্দোলনও।

আগে ধর্মের নামে নিয়মিতভাবেই নরহত্যা হত। ধর্ম ও সমাজের নামে হত সতীদাহ। তার বিরুদ্ধেও কম আন্দোলন হয়নি। শুধুমাত্র কলকাতা শহরে ১৮১৫ থেকে ১৮১৭ এই তিনবছরে সরকারি হিসেবে মোট ১,৫২৮১১ গুলি সতীদাহ হয়েছিল। অন্যদিকে বেগম রোকেয়া তাঁর অবরোধবাসিনী গ্রন্থে এক মর্মান্তিক ঘটনার কথা লিখেছেন, আমার দূর-সম্পর্কীয়া এক মামী-শ্বাশুড়ী ভাগলপুর হইতে পাটনা যাইতেছিলেন, সঙ্গে মাত্র একজন পরিচারিকা ছিল। কিউল ষ্টেশনে ট্রেন বদল করিতে হয়। মামানী সাহেবা অপর ট্রেনে উঠিবার সময় তাঁহার প্রকাণ্ড বোরকায় জড়াইয়া ট্রেন ও প্লাটফরমের মাঝখানে পড়িয়া গেলেন। ষ্টেশনে সে সময় মামানীর চাকরাণী ছাড়া অপর কোন স্ত্রীলোক ছিল না। কুলিরা তাড়াতাড়ি তাঁহাকে ধরিয়া তুলিতে অগ্রসর হওয়ায় চাকরাণী দোহাই দিয়ে নিষেধ করিল খবরদার! কেহ বিবি সাহেবার গায়ে হাত দিও না। সে একা অনেক টানাটানি করিয়া কিছুতেই তাঁকে তুলিতে পারিল না। প্রায় আধ ঘন্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর ট্রেন ছাড়িয়া দিল।
ট্রেনের সংঘর্ষে মামানী সাহেবা পিষিয়া ছিন্নভিন্ন হইয়া গেলেন, তখন কোথায় তাঁহার বোরকা-আর কোথায় তিনি! স্টেশন ভরা লোক সবিস্ময়ে দাঁড়াইয়া এই লোমহর্ষণ ব্যাপার দেখিল, - কেহ তাঁহার সাহায্য করিতে অনুমতি পাইল না। পরে তাঁহার চূর্ণপ্রায় দেহ একটা গুদামে রাখা হইল; তাঁহার চাকরাণী প্রাণপনে বিনাইয়া কাঁদিল আর তাঁহাকে বাতাস করিতে থাকিল। এই অবস্থায় এগার ঘন্টা অতিবাহিত হইবার পর তিনি দেহত্যাগ করিলেন। কী ভীষণ মৃত্যু!

এরপরেও রামমোহনেরা আন্দোলন করেন, কলম ধরেন রোকেয়া। সতীদাহ আইনত বন্ধ হয়। শিক্ষার প্রসারে কিছুটা বদলিয়েছে মুসলিম সমাজও।

তবে আজও কন্যা, স্ত্রী, নারী হত্যা হয়, ভিন্ন নামে, ধর্মের ভিন্ন ব্যাখ্যায়।

আজও মরে প্রতিবাদী মানুষ, যেভাবে মরেছিলেন চৈতন্য।

শেষপর্যন্ত তবু প্রতিবাদেরা চিরকাল দীর্ঘজীবীই হয়।


কন্ঠস্বর?

কাঙাল হরিনাথের কথা আগেও পড়েছি। কিন্তু সাংবাদিকতার জগতে তাঁর এই লড়াইয়ের ইতিহাস আমার সেভাবে জানা ছিল না। পড়তে পড়তে মনে হয়েছে এখনও আঞ্চলিক নানা পত্রিকা বেরোয়। কিন্তু সেইসব পত্রিকায় সাহিত্যের নানা দিক যেভাবে ধরা পড়ে সেভাবে পড়ে না সমাজের অন্ধকার দিকগুলো। কিছু কিছু কাগজ বা পত্রিকা হয়ত তাদের সামান্য উদ্যোগে কিছুদিন কাজ করে, তারপরে বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ আর্থিক না রাজনৈতিক আমার জানা নেই। আসলে এখন হরিনাথ জন্মালে কবেই তাঁর লাশশুদ্ধু গুম হয়ে যেত। কিন্তু সত্যিই কি হরিনাথরা মরে, মরে যায়? তাহলে কেন একের পর এক নিষ্পাপ মানুষ হত হচ্ছেন ধর্মান্ধদের হাতে। তাতেও কি বন্ধ করা যাচ্ছে প্রতিবাদের কন্ঠস্বর? হরিনাথেরা আসলে বারবার জন্মান। বারবার নিহত হন। মানুষের জন্যই জন্ম নেন আর মানুষই তাকে হত্যা করে। কী আশ্চর্য!

গ্রাম এবং মফঃস্বলের চেহারা কিন্তু এত বছরেও কিচ্ছু বদলায়নি। হ্যাঁ, প্রোমোটারের হাতে পরে বিস্তর ফ্ল্যাট গজিয়েছে। গজায়নি হাসপাতাল বা স্কুল। এই তো এতবছর পর রূপনারায়ণপুর গেলাম। দেখলাম অর্ধেকটা পরিত্যক্ত অঞ্চলের মতো আর বাকি অর্ধেকটায় উন্নয়নের ফ্ল্যাটবাড়ি। অথচ সেই ফ্ল্যাটেরই গায়ে আজও লেগে আছে বাউড়ি পাড়া। তাদের উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে শুধু পোশাকেই। এক বৌদি বললেন, দেখ না, একটা অসুখবিসুখ হলে হয় আসানসোল ছুটতে হবে নয় দুর্গাপুর। আমি তো ছেলেকে বলেছি, কোথথাও নিয়ে যাবিনা, শেষে রাস্তায় মরি আর কী। বাড়িতেই ওই মুখে চাট্টি গঙ্গাজল দিয়ে দিবি ব্যস। এক দাদা বললেন, কেবলস স্কুলের তো টিমটিমে দশা, মাইনে পাই না মাসের পর মাস। যে সব বাইরের ছেলেমেয়েরা স্কুলে ভর্তি হয় তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলছে কেবলস। কিন্তু আমাদের ভাগ্যে মা ভবাণী। ওই তো একটামাত্র ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল।

সর্বত্র এটাই সত্য। এরমধ্যে বেড়েছে নারী নির্যাতনের মতো ঘটনা। কয়েকদিন আগে রূপনারায়ণপুরে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে শুনে কী বিষম আশ্চর্য হয়েছি। আমি রাত নটা, সাড়ে নটার সময় লোয়ার কেশিয়া থেকে একা সাইকেল চালিয়ে রূপনারায়ণপুর বাজারের কাছে বাড়িতে ফিরতাম। দুবছরে একবার মাত্র একটা স্কুটার যেতে যেতে বোধহয় গান গেয়েছিল। ওটা সাইকেলে কেউ হলেই নির্ঘাত আমার হাতে মার খেত। স্কুটার তো হুস করে পালিয়ে গেল। কতদিন একা একা ধানক্ষেতে ঘুরে সূর্যাস্ত দেখেছি। কখনও সঙ্গে দেবী বা লুসি থাকত। কখনও বিপদের কথা মনেই আসেনি। একদিন এক চাষা শ্রেণীর লোক আমাকে সাবধান করেছিলেন, তো তাঁর ওপরেই রেগে উঠেছিলাম। আজ কেউ ওভাবে ঘুরতে সাহসই পাবে না। সম্ভবও নয় আজকের পরিস্থিতিতে। তখনও ওই অঞ্চলে কয়লা মাফিয়া বা ওই শ্রেণীর লোকজন ছিল। কিন্তু এরকম ঘটনা সেভাবে শুনিনি।

রূপনারায়ণপুরে গিয়েই আরও মনে হচ্ছিল গ্রাম বা মফঃস্বলের অবস্থা খুব খারাপ হয়েছে। কিন্তু কোনও কন্ঠস্বর উঠছে না। কেন?


মানুষের কলম এবং সাহসই কিন্তু শেষপর্যন্ত কিছু পরিবর্তন আনতে পারে, সে যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন। আমার সে বিশ্বাস এখনও আছে।

Friday, April 8, 2016

কাঙাল হরিনাথ ও তাঁর গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা –এই রূপকথা আজ কেন আর সত্যি হয় না?

পুরোনো পত্রপত্রিকা এবং সেইসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করাটা আমার একটা স্বভাবে দাঁড়িয়েছে। গতকাল সারাদিন ধরে যে দুটো বই পড়লাম তার মধ্যে মুনতাসির মামুদ সম্পাদিত দুই শতকের বাংলা সংবাদ-সাময়িকপত্র-এর লেখাগুলি ভারী চমৎকার লাগল। এই বইয়ে আবুল আহসান চৌধুরী লিখিত উনিশ শতকের গ্রাম নির্ভর সংবাদ-সাময়িকপত্র লেখাটিতে কাঙাল হরিনাথ সম্পাদিত গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা-র কথা পড়তে গিয়ে মনে হল আজকের দিনেও এমন পত্রিকা এবং তার এমন সম্পাদক বিরল। ক্ষমতার আসনের নামগুলো শুধু বদলে গেছে। বদলায়নি মফঃস্বল আর গ্রাম-বাংলার এই চিত্র। আজকের দিনেও এমন একজন হরিনাথ মজুমদারের এই মুহূর্তে বড় প্রয়োজন। আর তাই আমার পড়ার মুগ্ধতাটুকু ভাগ করে নিতে ইচ্ছে হল। তথ্যের পুরোটাই ওই লেখাটি থেকে নেওয়া। কিছু বাক্যের অদলবদল বা যোগবিয়োগ করেছি মাত্র।

ঊনবিংশ শতকে তুলনায় বড় এবং জনপ্রিয় অনেক পত্রপত্রিকাই যেখানে ইংরেজ সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, সেখানে বাংলাদেশের এক অখ্যাত গ্রামে বসে জনৈক হরিনাথ মজুমদার তাঁর প্রতিষ্ঠিত এবং সম্পাদিত গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় জমিদার এবং ইংরেজ সরকারের শোষনকারী এবং অত্যাচারী প্রকৃত চেহারাটা তুলে ধরতেন তাঁর স্বল্প আর্থ-সামাজিক ক্ষমতার মধ্যেই। এই পত্রিকাটি ১৮৬৩ সালের এপ্রিল মাসে কুমারখালি গ্রাম থেকে প্রকাশিত হয়। হরিনাথ মজুমদার বা কাঙাল হরিনাথের সাহিত্য এবং সমাজসেবীর বিস্তৃত পরিচয় ছাপিয়ে ওঠে তাঁর এই সাময়িকপত্র সম্পাদনার লড়াই। প্রাথমিকভাবে তিনি ঈশ্বরগুপ্ত সম্পাদিত সংবাদ প্রভাকর-এর সংবাদদাতা হিসেবে কিছুদিন কাজ করেছিলেন। গ্রামবার্ত্তা প্রকাশের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে হরিনাথ তাঁর দিনলিপিতে লিখছেন,আমি ইতিপূর্বে নীলকুঠিতে ও মহাজনদিগের গদিতে ছিলাম, জমিদারের সেরেস্তা দেখিয়াছিলাম এবং দেশের অন্যান্য বিষয় অনুসন্ধান করিয়া অবগত হইয়াছিলাম; সেখানে যত প্রকার অত্যাচার হয়, তাহা আমার হৃদয়ে গাঁথা ছিল। দেশীয় সংবাদপত্রের অনুবাদক রবিন্সন সাহেব যখন অনুবাদ-কার্য্যালয় খুলিলেন, আমিও সেই সময় গ্রামবার্ত্তা প্রকাশ করিলাম। তিনি আরও লিখেছেন, গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা সংবাদপত্রিকার দ্বারা গ্রামের অত্যাচার নিবারিত ও নানা প্রকারে গ্রামবাসীদের উপকার সাধিত হইবে...

পত্রিকাটি প্রকাশের পর উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য নিয়ে সম্পাদক লিখছেন, এ পর্য্যন্ত বাঙ্গলা সংবাদপত্রিকা যতই প্রচারিত হইতেছে তাহা কেবল প্রধান প্রধান নগর ও বিদেশীয় সম্বাদাদিতেই পরিপূর্ণ। গ্রামীয় অর্থাৎ মফঃস্বলের অবস্থাদি কিছুই প্রকাশিত হয় না। তজ্জন্য গ্রামবাসীদিগের কোন প্রকার উপকার দর্শিতেছে না। যেমন চিকিৎসক রোগীর অবস্থা সুবিদিত না হইলে তাহার প্রতিকারে সমর্থ হন না, তদ্রূপ দেশহিতৈষী মহোদয়গণ গ্রামের অবস্থা, ব্যবসায় রীতি, নীতি, সভ্যতা, গ্রামীয় ইতিহাস, মফঃস্বল-রাজকর্ম্মচারীগণের বিচার, এবং আশ্চর্য্য ঘটনাদি প্রকাশিত হয় তাহাই এই পত্রিকারপ্রধানোদ্দেশ্য”। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এই পত্রিকা মাসিক, পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক হিসেবে কয়েক পর্যায়ে মোট বাইশ বছর চলেছিল।

কৃষক-তাঁতি, রায়ত-প্রজাসহ শ্রমজীবী মানুষের সমস্যা ও অধিকার সম্পর্কে গ্রামবার্ত্তা সচেতন ও সক্রিয় ছিল। এদের দুঃখ-দুর্দশার কথা বলতে কোনও দ্বিধা বা শঙ্কাবোধ করত না। এসব বর্ণনায় রায়ত-প্রাজাদের প্রতি সহানুভূতি, জমিদারের শোষণ-নিগ্রহের স্বরূপ উন্মোচন এবং সরকারি ভূমিকার সমালোচনারও ঈঙ্গিত থাকত। অনেকক্ষেত্রেই সরকারের দায়িত্ববোধের ঔদাসীন্য সম্পর্কে বেদনা এবং অভিযোগ জানিয়ে কর্তব্যবোধ জাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে। দেশীয় শোষক-জমিদার বা বাক্‌-সর্বস্ব তথাকথিত দেশদরদির সমালোচনা বা নিন্দাও করা হয়েছে প্রকাশ্যে।

দেশ নষ্ট কপটে, প্রজা মরে চপটে, কি করবে রিপোর্টে শীর্ষক এক প্রতিবেদনে নিরুপায় কৃষক-প্রজার দুঃখ-দুরবস্থার প্রধান কারণ হিসেবে পুলিশ, গো-খোঁয়াড়, আদালত, জমিদার ও মহাজনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, - সর্বক্ষণই যাদের ...প্রজার শোণিত পান করিতে...লালা ক্ষরিতেছে। পুলিশ সম্পর্কে পত্রিকার মন্তব্য, বিকারগ্রস্ত রোগীর হিক্কা উপসর্গের ন্যায়, পুলিশ প্রজার উপসর্গ হইয়াছে। আদালতের আমলাদিগের হাত পাতা রোগ এর কারণে মূলত দরিদ্র প্রজারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। এরপর আছে জমিদারের শোষণ-কৌশল-অবাধ প্রজাপীড়নের প্রয়োজনে রাজকর্মচারি, পুলিশ ও আদালতকে উৎকোচ দিয়ে বশে রাখা। সরকার-প্রণীত বিধি-আইনও প্রজার রক্ষাকবচ না হয়ে বরং তার অস্তিত্ব সংকটের সহায়ক হয়েছে। এইসব বিষয়ে আলোচনা করে গ্রামবার্ত্তা পরামর্শ দিয়েছে,...যদি প্রজা রক্ষা ও প্রজার প্রতি অত্যাচার নিবারণ করিতে গবর্মেন্ট আন্তরিক সংকল্প করিয়া থাকেন, তবে প্রজাগণ কি কারণে অত্যাচারিত হইতেছে অগ্রে তাহার গোপনানুসন্ধান করুন, পরে যে নিয়ম করিবেন তাহাতেই কার্য্য হইবে। অন্যথায় কেবল আড়ম্বর।

দেশীয় শিল্পের উন্নতি ও বিকাশে সবসময়েই কামনা করেছে গ্রামবার্ত্তা। পাবনার প্রজা বিদ্রোহেও গ্রামবার্ত্তার সমর্থন প্রজাদের দিকেই ছিল। রায়ত-প্রজাদের ওপর জমিদারের অন্যায় অত্যাচারই এর কারণ বলে তিনি এর ব্যাখ্যা করেছিলেন। বাংলাদেশের জমিদার-সম্প্রদায়ের প্রজাহিতকর কর্মোদ্যোগের অন্তরালে ছিল তাঁদের শোষণ সম্পর্কে অন্যের দৃষ্টি-বিভ্রান্তির চেষ্টা এবং রাজ-সম্মানলাভের আকাঙ্খা। জমিদারের স্বরূপ উন্মোচনে গ্রামবার্তা জানিয়েছে, জমিদারদিগের দ্বারা যত বিদ্যালয় স্থাপিত হইয়াছে, রাজদ্বারে সম্মান লাভেচ্ছাই তাহার অধিকাংশের কারণ।...মফস্বলের এক একজন জমিদার দাতব্য ডিস্‌পেনসারি ও বিদ্যালয়াবরণ দিয়া, আমেরিকা দেশের ভাম্পাইয়ার বাদুড়ের ন্যায় প্রজার রক্তপান করেন। হাকিমেরা মফস্বলে আসিয়া স্কুল ও ডিস্‌পেনসারি দেখিয়া ভুলিয়া যান, প্রজার ক্রন্দন কিছুই শুনেন না।...যোড়াসাঁকোনিবাসী শ্রদ্ধাস্পদ জমিদার শ্রীযুক্ত বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এদেশের অদ্বিতীয় ধার্ম্মিক।...সম্প্রতি একটা কথা শুনিয়া দুঃখিত ও বিস্মিত হইয়াছি। তিনি শিলাইদহের স্কুল হইতে ইংরেজী শিক্ষা উঠাইয়া দিয়াছেন।কৃষক-প্রজার সন্তান ইংরেজি শিক্ষা লাভ করে যাতে অধিকার-সচেতন হয়ে উঠতে না পারে ও অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিকারের সাহস ও সুযোগ না পায়, সে-জন্যই জমিদার তাঁর স্বার্থবুদ্ধির কারণেই যে জনকল্যাণবিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এই ইঙ্গিত এখানে অস্পষ্ট নয়।

হরিনাথের গ্রামবার্ত্তা রাজশক্তিরও দ্বিধাহীন সমালোচনা করত। পল্লীবাসীর নিদারুণ জলকষ্টে সরকারের উদ্যোগহীনতাকে তীব্র ভর্ৎসনা করে লেখে, এতৎ প্রবন্ধে কর্ত্তৃপক্ষ-সমীপে এই মাত্র বক্তব্য, গবর্ণর জেনারেল প্রভৃতির সিমলার বিহারের নিমিত্ত প্রতি বর্ষে রাজকোষ হইতে সাড়ে চারি লক্ষ টাকা ব্যয় হয়, গ্রাম ও পল্লীবাসীর দরিদ্র প্রজাদিগের নিমিত্ত কিঞ্চিৎ ব্যয় কি রাজধর্ম বিরুদ্ধ! প্রশাসন-যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের ত্রুটি-বিচ্যুতি-স্খলনকেও গ্রামবার্ত্তা রেহাই দেয়নি। পাবনার ইংরেজ ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট একবার এক দরিদ্র বিধবার একটি দু্গ্ধবতী গাভী জবরদস্তি করে কেড়ে নিলে, হরিনাথ তার পত্রিকায় গরুচোর ম্যাজিস্ট্রেট নামে সংবাদ প্রকাশ করেন। প্রকৃতপক্ষে রাজকর্ম্মচারীদের অসচ্চরিত্রতাই প্রজাদের মনোভঙ্গের কারণ বলে গ্রামবার্ত্তা মনে করেছে।

জীবনের ঝুঁকি নিয়েও হরিনাথ নির্ভীক ও সৎ সাংবাদিকতার একটি আদর্শ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শাসক-সরকার, আমলা, পুলিশ-গোরাপল্টন, নীলকর, জমিদার মহাজন প্রমুখ কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করার জন্য তাঁকে যথেষ্ট ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে। শুধুমাত্র পীড়িত-অপদস্থ-বিপন্নই নয়, কোনও কোনও সময়ে তাঁর জীবন-সংশয়ও দেখা দিয়েছে। নির্ভীক ভূমিকার জন্যে তাঁকে জেলার ম্যাজিস্ট্রেট এবং পরগণার জমিদার উভয়েরই বিরাগভাজন হতে হয়। কিন্তু সাহস ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে এইসব প্রতিকূলতার মোকাবিলা করেছেন, কিন্তু কর্তব্যকর্ম থেকে কখনও বিচ্যুত হননি। তাঁর নিজের কথায়, আমরা এতদিন সহ্য করিয়াছি, আর করিতে পারি না। সকল কথা প্রকাশ করিয়া কর্ত্তব্য সম্পাদন করিতে ত্রুটি করিব না। ইহাতে মারিতে হয় মার কাটিতে হয় কাট, যাহা করিতে হয় কর, প্রস্তুত আছি।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের জমিদারি ছিল কুষ্টিয়ার নিকটবর্তী বিরাহিমপুর পরগণায়। শিলাইদহে ছিল তার সদর দফতর। ঠাকুর-জমিদার এলাকায় প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমল থেকেই প্রজা-পীড়নের অভিযোগ ছিল। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় এই পীড়ন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। খাজনা বৃদ্ধি, নানারকম কর আরোপ, জুলুম করে প্রজার ভিটেমাটি উচ্ছেদ, অনাবৃষ্টি-অতিবৃষ্টিতে বিপন্ন রায়ত-প্রজার থেকে বলপূর্বক খাজনা আদায় ইত্যাদি ঘটনার কথা হরিনাথ নির্ভীকভাবে গ্রামবার্ত্তায় প্রকাশ করতেন। এর পাশাপাশি জমিদারের অনীহা এবং ঔদাসীন্যের সংবাদও প্রকাশিত হত। গ্রামবার্ত্তার এই জমিদার-স্বার্থবিরোধী ও তাঁদের চরিত্রের স্বরূপ উন্মোচনকারী ভূমিকা অনুমোদন করা ঠাকুর-জমিদারের পক্ষে সংগত কারণেই সম্ভব হয়নি। ঠাকুর-জমিদারের পক্ষ থেকে প্রথম পর্যায়ে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে হরিনাথকে বশ করার চেষ্টা করা হয়। এই চেষ্টা ব্যর্থ হলে লাঠিয়াল লাগিয়ে খুন করার চেষ্টা হয়। জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীর হাত থেকে বিপন্ন বন্ধুকে রক্ষার জন্যে তাঁর দলবল নিয়ে এগিয়ে আসেন বাউল সাধক লালন ফকির।

হরিনাথের সাহিত্য-শিষ্য অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়কে লেখা একটি চিঠিতে হরিনাথ লিখেছিলেন, জমিদারেরা প্রজা পরিত্যাগ করিয়া আমার প্রতি যতদূর সাধ্য অত্যাচার করেন। কিন্তু উপকৃত পল্লীবাসী হরিনাথের বিপদ ও সংকটে নিস্পৃহ ও উদাসীন থাকায় মর্মাহত হরিনাথ ওই পত্রেই আক্ষেপ করে লিখেছিলেন,জমিদারেরা যখন আমার প্রতি অত্যাচার করে, এবং আমার নামে মিথ্যা মোকদ্দমা উপস্থিত করিতে যত্ন করে, আমি তখন গ্রামবাসী সকলকে ডাকিয়া আনি এবং আত্মাবস্থা জানাই। গ্রামের একটি কুকুর কোন প্রকারে অত্যাচারিত হইলেও গ্রামের লোকে তাহার জন্য কিছু করে, কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, ও আমার এতদূরই দুর্ভাগ্য যে, আমার জন্য কেহ কিছু করিবেন, এরূপ একটি কথাও বলিলেন না। যাঁহাদের নিমিত্ত কাঁদিলাম, বিষাদ মাথায় করিয়া বহন করিলাম, তাঁহাদিগের এই ব্যবহার!

সমাজে যে এই পত্রিকার একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল তা সম্পাদকের নিজের বক্তব্যেই আমরা জানতে পারি, ...পূর্ব্বের অনেক ধনবানাদি সবল লোকেরা দূর্ব্বলের প্রতি প্রকাশ্যরূপে সহসা যে প্রকার অত্যাচার করিতেন, এক্ষণে যে তদ্রূপ করিতে সাহসী হইতেছেন না...গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকাই তাহার কারণ। জলধর সেন এই পত্রিকাটি সম্বন্ধে লিখেছেন, নদীখাল প্রভৃতি পয়ঃপ্রণালী সংস্কারপূর্ব্বক জলকষ্ট নিবারণ, পুলিশ-বিভাগের সংস্কার, গো-ধন রক্ষা, রেলপথ দ্বারা জল নিঃসরণের পথ বন্ধ হওয়ায় এদেশ যে অস্বাস্থ্যকর ও ম্যালেরিয়ার আকরভূমি হইতেছে, পোষ্টাফিসের মনিওর্ডার প্রথা প্রচলন প্রভৃতি অনেক প্রয়োজনীয় বিষয় সম্বন্ধে হরিনাথ লেখনী পরিচালনা করিয়া রাজা ও প্রজা উভয়েরই হিতাকাঙ্খী বলিয়া পরিচিত হইয়াছিলেন। জলধর সেনের এই মন্তব্যটিও যেন টেকনিকালি কারেক্ট বা নিজের গা বাঁচিয়ে লেখা। সেইসময়ের শিক্ষিত বাঙালির একটা বড় অংশই তা করতেন। গ্রামবার্ত্তা থেকে ইংরেজিতে খবরগুলির অনুবাদ করে ইংরেজ সরকারের গোচরে আনতেন বাংলা গবর্ণমেন্টের বাংলা সংবাদপত্রের অনুবাদক মিঃ রবিন্সন।

যাইহোক চোখ থাকতে চোখের মর্যাদা যেমন মানুষ বোঝে না, ঠিক তেমনি পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর হাহাকার পড়েছিল সেই গ্রামবাসীদের মধ্যেই, যাঁরা হরিনাথ বা তাঁর পত্রিকা কারোরই পাশে দাঁড়াননি। বোধহয় নিশ্বাস ছেড়ে বেঁচেছিলেন ইংরেজ সরকার বাহাদুর আর ঠাকুর-জমিদারের মতো মানুষেরা। মীর মশাররফ হোসেন-এর হিতকরী পত্রিকায় পল্লীবাসী প্রজার পরিচয়ে প্রকাশিত একটি চিঠিই বরং হরিনাথের গ্রামবার্ত্তার প্রকৃত রূপটিকে আরও স্পষ্ট করেছে।

আজ কয়েক বৎসর হইল গ্রামবার্ত্তার কন্ঠ নীরব হইয়াছে। গ্রামবার্ত্তার সতেজ লেখনি প্রভাবে এ অঞ্চলের পুলিশ, বিচারক, হাকিম, মিউনিসিপ্যাল কমিশনার, জমিদার প্রভৃতির অত্যাচার শান্তভাব ধারণ করিয়াছিল। গ্রামবার্ত্তার জীবন এই সমস্ত অত্যাচার কাহিনী প্রকাশ করিয়া অনেক সময় নানা বিপদে পড়িতে হইয়াছিল যে তাহার আর উল্লেখের প্রয়োজন নাই; এ প্রদেশের সকলেরই অন্তরে তাহা জাগরিত রহিয়াছে। ...তাই আমাদের নিবেদন গ্রামবার্ত্তার কন্ঠ নীরবের পর যখন হিতকরীর অভ্যুদয় হইয়াছে, তখন আমরা পল্লীবাসী আমাদের দুঃখের কথা গ্রামবার্ত্তায় যেমন তীব্রভাবে আলোচিত হইয়া রাজার গোচর করিত, সেইরূপ আলোচিত হইয়া আমাদের দুঃখ  দূর করিতে চেষ্টা করুন। ...পূর্ব্বে যখনই দুঃখ পাইতাম তখনই গরীবের দুঃখের দুঃখী, কান্নাই সমভাগী গ্রামবার্ত্তার দ্বারে গিয়া কতবার কাঁদিতাম। সকরুণ স্বরে আমাদের জন্যে কত কান্নাই সম্পাদক রাজার নিকট, জমিদারের নিকট না কাঁদিয়াছেন; কিন্তু এখন কাহার কাছে যাইব?


নাহ্‌, গ্রামবার্ত্তার অভাব সেকালে কেন, আজও আর কেউ পূরণ করতে পারেনি। অথচ কত সমসাময়িক রয়ে গেছে গ্রাম বাংলা আর মফঃস্বলের সব সমস্যাই।

অধিকন্তু

ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাঙালি মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার হার যখন বাড়তে শুরু করল এবং তাঁরা ক্রমশ নিজেদের জন্য নিজেরাও কলম ধরলেন তখন অন্যান্য নানা বিষয়ের মতোই একটা বিষয় নিয়ে তাঁদের দীর্ঘ লড়াই করতে হয়েছিল, তা ছিল নামের সঙ্গে পদবী যোগ করা। কারণ পদবী তখন পর্যন্ত একমাত্র পুরুষেরাই ব্যবহার করতে পারতেন। মেয়ে সন্তানই যেখানে কাম্য ছিল না, সেখানে খেঁদি বা আন্নাকালীদের নামটুকু পাওয়াই অনেক ছিল। স্বর্ণকুমারী কী গিরীন্দ্রমোহিনী এত সব নামের বাহার একটু শিক্ষিত উচ্চবিত্ত পরিবার না হলে জুটত না। লেখার ক্ষেত্রেও অনেকদিনই মেয়েদের নাম হয় একেবারেই লেখা হত না, নাহলে জনৈক বঙ্গমহিলা কী আমাদিগের এক ভগিনী কী বড়জোর সূচিপত্রে কোনওভাবে আলাদা করে চিহ্নিত করা থাকত মেয়েদের লেখা বলে। সেদিক থেকে বামাগণের রচনা বিভাগ খুলে এবং তাঁদের নামসহ লেখা প্রকাশ করে বেশ উল্লেখযোগ্য কাজ করেছিল বামাবোধিনী পত্রিকা। আবার অনেক পুরুষ লেখকও বোধহয় চট করে পাঠকের চোখে পড়বার আশায় নারীর ছদ্মনামে লিখতেন।

পদবী ব্যবহার নিয়ে যে দ্বিধা বা নিষেধ ছিল তা পত্রিকাগুলিতে লেখিকাদের নাম দেখলেই বোঝা যায়। উচ্চবিত্ত ঘরের মেয়েরা সাধারণত নামের শেষে দেবী, এবং তুলনায় নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়েরা নামের শেষে দাসী ব্যবহার করতেন।এখানে নিম্নবিত্ত মানে শিক্ষা এবং আর্থিক ক্ষেত্রে নয়, সামাজিক অবস্থানে।শিক্ষিত পরিবার না হলে মেয়েদের মধ্যে লেখালেখির চলও তেমন থাকত না। বামাবোধিনী পত্রিকায় জনৈক লক্ষ্মীমণিকে তাঁর লেখা কবিতা বা প্রবন্ধের তলায় লক্ষ্মীমণি বর্ধমান, শ্রী লক্ষ্মীমণি, লক্ষ্মীমণি দেবী, লক্ষ্মীমণি বসু প্রভৃতি একাধিক নামে উল্লেখ করা হয়েছে। এরকম অন্যান্য লেখিকাদের ক্ষেত্রেও ঘটেছে।

অর্থাৎ মোদ্দা কথা হল এই যে নামের শেষে পদবীটা পুরুষতান্ত্রিক নিয়মের বিরুদ্ধে খেটেখুটে লড়াই করে আদায় করা।

কিন্তু এখন আবার অনেক মহিলাই নামের শেষে পদবীটা পুরুষতান্ত্রিকতা বলে রাখতে চাননা। আবার কেউ কেউ স্বচ্ছন্দ বোধ করেন বলে ছোটবেলা থেকে যে পদবীটা ব্যবহার করে এসেছেন, সেইটাই রাখেন। কেউ বা বিয়ের পর স্বামীর পদবী ব্যবহার করেন। কেউবা দুটো পদবীই ব্যবহার করে নামকে অযথা ভারাক্রান্ত করে ফেলেন সময়ে সময়ে।

অর্থাৎ পদবী নিয়ে বাঙালি মেয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি। এবং পদবী থাকাটা পুরুষতান্ত্রিক বা না থাকাটা সেটাও নিয়েও নয়।

আমার মনে হয় এত না ভেবে, নিজের কানে যেটা ভালোলাগছে সেটাই নিজের নাম ও পরিচ্ছদ হওয়া উচিত। হ্যাঁ, পদবী খানিক নামের পরিচ্ছদই বটে।

বাঙালির পদবীর ইতিহাস ঘেঁটে কোনওদিনই আমাদের লাভ নেই। কারণ ঊনবিংশ শতকের আগে সে ইতিহাসে আমরা কোথাও ছিলাম না। আর তাই এখনও মাথা না ঘামানোই ভালো। অন্ততঃ এই নিয়ে মেয়েদের লড়াইয়ের ইতিহাসটা জানার পর একথাই আমার মনে হয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক মনে করলে বাবা ও স্বামী উভয়ের পদবীই তাই, আবার না মনে করলে কোনটাই কিছু না। আর দীর্ঘদিনধরে মেয়েরা সবরকমের পদবীই ব্যবহার করে আসছেন, তাই সবেতেই আমাদের একটা অধিকার তো বর্তায়।


পূর্বসূরীদের অধিকার আদায়ের উত্তরাধিকার তো বটেই।