Sunday, May 21, 2017

অপেক্ষা


প্রহর গুণি প্রহর গুণি

ছন্দ ছেঁড়া বাক্য হারা -

প্রহর গুণি প্রহর গুণি

ট্রেন আসে না ট্রেন আসে না।

একটুকরো সময় যেন

থমকে থাকে পথের মাঝে,

ক্লান্ত দুপুর ক্লান্ত বিকেল

ক্লান্ত দিবস ফুরোয় সাঁঝে।

তবুও শুধুই প্রহর গুণি,

জীবন মানে প্রহর গোণা -

জীবন কাটে অপেক্ষাতেই -

আজও তো সেই ট্রেন আসে না।

ট্রামরাস্তা


ট্রামটা ধর্মতলার কাছাকাছি পৌঁছেচে। এতক্ষণ গরমের দুপুরের হালকা ভিড়ে বেশ টুংটাং মেজাজে চলছিল। ড্রাইভারের একটা বসার সিট আছে। সাধারণত থাকে না। ট্রাম স্টপেজে থামলে তিনিও একটুখানি বসে নেন। তারপর আবার উঠে পড়েন। পায়ের কাছে রয়েছে বেল। কেমন একটা নাচের ভঙ্গীতে মাঝে মাঝে পা ঠোকেন আর টুংটাং বেজে ওঠে অমনি।

ভীড়ের মুখে অসহায় অসহিষ্ণু মুখ তাঁর। ট্রাম তার নিজের লাইন ছেড়ে কোথ্‌থাও যেতে পারে না। অথচ তার লাইনে উঠে আসে বাস অটো বাইক সব্বাই। বারবার পা ঠোকেন ড্রাইভার। নির্লিপ্ত মুখে ট্রামলাইন পেরিয়ে যায় পথচারী, দিচক্রযান, চারচাকারাও। তাকে কেউ রাস্তা ছাড়ে না।

বেশ কিছুদিন আগের কথা। মেয়ের পরীক্ষার শেষদিনে ওকে স্কুলে দিয়ে আমরা ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে ট্রামসফরে বেরিয়েছিলাম।

ড্রাইভারের পেছনের সিট থেকে দেখছিলাম...

খানিক বাদে একটু হালকা হলে বেশ কয়েকবার বেল দিয়ে বিরক্ত জনস্রোত সরিয়ে ট্রাম আবার এগিয়ে চলে তার শেষ গন্তব্যে।

স্মৃতিবিজড়িত!










কালিম্পং-এ ঠাকুর পরিবারের স্মৃতিবিজড়িত তিনটি বাড়ি আছে - মর্গান হাউস, গৌরীপুর হাউস আর চিত্রভানু। এরমধ্যে মর্গান হাউস ও গৌরীপুর হাউসে রবি ঠাকুর থেকেছেন পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে। চিত্রভানু প্রতিমা দেবীর বাড়ি (আনন্দবাজার যতই এটাকে হঠাৎ খুঁজে পাওয়া রথীন্দ্রনাথের বাড়ি বলে প্রচার করুক না কেন) চিত্রভানুর নির্মাণের সময় নামের নীচেই লেখা আছে - ২২ শ্রাবণ, ১৩৫০ বা ৮ আগস্ট, ১৯৪৩।

তিনটি বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে যেটা মনে দাগ কেটেছে তা হল জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা গৌরীপুর হাউস। ১৩৪৫ সালের ২৫ বৈশাখ কবি এখান থেকে দূরভাষে আকাশবাণীতে 'জন্মদিন' কবিতাটি পাঠ করেন। রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতার জন্ম এই বাড়িতে। চিঠিপত্রও রয়েছে এই ঠিকানায় নামাঙ্কিত। এতসব স্মৃতিবিজড়িত।

বাড়িটা সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সাইট সিয়িং এর তালিকায় না থাকায় ড্রাইভার গাঁইগুঁই করবেন হয়তো। এটা দূরপিনদাঁড়া ভিউ পয়েন্টের দিকে যেতে ক্রকেটি হাউসের (এখানে একসময় খ্যাতনামা রাশিয়ান শিল্পী নিকোলাস রোয়েরিখের স্ত্রী হেলেনা রোয়েরিখ পুত্র ইউরিকে নিয়ে বসবাস করতেন। লেখিকা হেলেনা এখানেই মারা যান) একেবারে গা ঘেঁষে যে রাস্তাটা নেমে গেছে সেই পথে কয়েক পাক নীচের দিকে নামলেই পৌঁছে যাওয়া যায়। ওপর থেকেই বাড়িটির জরাজীর্ণ টিনের ছাদ, ফায়ার প্লেসের ধোঁয়ার নল চোখে পড়ে। তবে নীচে নেমে অতি কষ্টে বাড়ির সামনে পৌঁছলে মনখারাপ হয়ে যায়।

একে তো বাড়িটির সংরক্ষণের কোনো চেষ্টা আদৌ হয়নি। তার ওপর সম্প্রতি বাড়িটির ঠিক উল্টোদিকে একটি পলিটেকনিক তৈরি হচ্ছে। তারই মিস্ত্রীরা বাড়িটাকে থাকার জন্য আর জিনিসপত্র রাখায় ব্যবহার করছে। আপাতত ব্যবহার করা হচ্ছে বলে একটা নোটিসও লটকিয়ে দেওয়া আছে। বাড়ির সামনে খোয়া আর বালির পাহাড়। এদিকে ওদিকে আরও জিনিস, জামাকাপড়। একটা বাদে বাকি সব দরজায় তালা দেওয়া। সেও বুঝলাম ওদেরই দেওয়া। দোতলার বারান্দায় শাড়ি ঝুলছে যে।

খোয়ার পাহাড় পেরিয়ে একমাত্র খোলা ফাঁকা ঘরে ঢুকি। পুরোনো দিনের ফায়ারপ্লেসটুকুই যা আছে। অন্য ঘরগুলোর দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে মিস্ত্রিদের জিনিসই চোখে পড়ে।

ফেরার পথে রাস্তা দিয়ে দোতলার লেভেল সমান উঠে এসে আবার ইটপাথর পেরিয়ে শর্টকাটে দোতলার জীর্ণ বারান্দায় ঢোকার একটা চেষ্টা করতে গিয়ে মেয়ে আর তার বাবার কাছে কী ছেলেমানুষি হচ্ছে বলে বকুনি খেয়ে খান্ত দিই অবশেষে।

এর আগে গিয়েছিলাম মর্গান হাউস। তিনটি বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে মেনটেনড। কারণটা সকলেই জানেন, এটি সরকারি লজ হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং ভাড়াও ভয়ানক বেশি। বাইরে মুখ্যমন্ত্রীর চেনা হাসিমুখ ছবি। ভেতরে ঢোকার ইচ্ছে হয় না। বাইরে থেকেই দেখি। অথচ ইচ্ছে ছিল খুব। কোথায় রবিমামা বসে নানাকিছু পড়ে শোনাতেন, লিখেছিলেন সরলা। স্বর্ণকুমারীর লেখাতেও এই বাড়ির উল্লেখ আছে। সেইসব স্মৃতিবিজড়িত। কিন্তু... দীর্ঘশ্বাস ফেলি।

পাইন ভিউ নার্সারির ঠিক বিপরীতে প্রতিমা দেবীর বাড়িটির ঠিক কী অবস্থা বলব ভেবে পাচ্ছি না। সেই টিনের চাল আর ফায়ারপ্লেসের নলওলা কান্ট্রি হাউসের মতো চমৎকার দেখতে বাড়িটা। চিত্রভানুর সামনের অংশে আর্ট ক্রাফট সেন্টার। ওয়েল মেনটেনড মনে হল। ফুলগাছে ভরা বাগান। তবে বাড়ির ভেতর ঢোকা নিষেধ। অফিসঘর। একপাশে প্রতিমাদেবীর একটা ছবি ঝুলছে বটে। দেওয়ালে লাগানো ম্যাটগুলোও পুরোনো আমলের বলে মালুম হল। ওইটুকুই যা স্মৃতিবিজড়িত আর কী। বাড়ির পেছনের অংশে একটি নোটিস লটকানো - ভূমিকম্পের পর থেকে দর্শকদের ঢোকা বারণ হয়েছে। ওপরে তাকিয়ে দেখি ভেঙে পড়া দোতলার দেওয়ালের গায়ে গাছ গজিয়েছে, ভেতরে যেটুকু চোখ যায় হাল ভালো না। ছাদেও গাছ গজিয়েছে। এই অংশটা সারানো হল না কেন কিছুতেই মাথায় ঢোকে না।

ফেরার পথে মংপুতে। কেমন আছে আর এক স্মৃতিবিজড়িত?

সারানো হচ্ছে। কিন্তু কেন একেবারে আগাপাশতলা সারাচ্ছে তা বুঝলাম না। ২০১৬ সালের ছবি দেখলাম ড্রাইভারের ক্যামেরায়। ভাঙাচোরা কিছু তো চোখে পড়ল না। যাইহোক। তবে গৌরীপুর হাউস আর প্রতিমা দেবীর বাড়ির ভাঙা অংশ সারানোটা জরুরি ছিল বরং।

ওগো পাইন তোমায় দেখাচ্ছে কী ফাইন!





দার্জিলিং যাইনি। -

"যাবে তো যাও নীলপাহাড়ি

সেথায় নড়ে সবুজ দাড়ি..."

- তা পথে নীলপাহাড়ি দেখলাম, রংলি রংলিওট চা বাগানও।

তবে সবুজ দাড়িটাড়ি বাপু চোখে পড়েনি। বদলে একটা নীল-সবুজ ঝলমলে ময়ূর।

নিস্তব্ধ রাত্তিরে কুকুরের ডাক ছিল বটে, তবে কক্ষনো হাঁড়িচাচায় গান ধরেনি। আর হোম স্টের মাথায় পূর্ণিমার চমৎকার চাঁদের গা দিয়ে কালো মেঘ ভেসে যাওয়ায় যখন সাইকো সিনেমার একটা শট মনে পড়ছিল, আমি আর মেয়ে ওয়্যার উলফের ডাক ডাকার একটা চেষ্টা করছিলাম জোরসে।

রাত্তিরে খেয়ে ওঠার সময় সিঁড়িতে কী একটা ভয়ানক ঠক ঠক করছিল ঠিকই, কিন্তু গোটা হোম স্টেতে সেদিন রাতে শুধু আমরা তিনজনে থাকলেও কুন্ডু মশাই মোটেও মুণ্ডু নাচাতে আসেননি। সেটা মেসির জন্য কিনা তা অবশ্য বলতে পারব না।

ওমা, মেসি কে তাও বলিনি বুঝি! বাদামী রঙের মস্ত বড় আদুরে কুকুরটা। ওই ওদেরই পোষ্য। সারারাত আমাদের ঘরের সামনে শুয়ে থাকল সে।

সকালে বৃষ্টি কাটতে চা বাগান আর পাইন গাছের ভেতর দিয়ে পাকদণ্ডী বেয়ে ঘুরে এলাম পায়ে হেঁটে। হ্যাঁ, মেসিই তো পথ দেখিয়ে শর্টকাট চিনিয়ে নিয়ে এল।

কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা হল না, তা হোক, সত্যিই তিনচুলে বেশ ফাইন।

জন্মদিন


রবিঠাকুর, প্রতি বৈশাখে তোমারও বয়স বাড়ে আমার সাথে।

মৃত্যুর পরে অনন্তকাল বেঁচে থাকো তুমি আর আমি হাঁটতে থাকি

গোধূলিবেলার  দিকে।

তোমার জন্মদিনে এখনও সূর্যোদয়ের রঙ আর আমার সূর্যাস্তের।

তবু সেই কোন ছোটবেলা থেকে তোমার হাত ধরে বড় হতে হতে

এখনো তোমাকেই খুঁজে বেড়াই দু:খে সুখে।

মাঝবেলার রোদ্দুরে ছায়া দাও তুমিই।

যাবার দিনেও হাত পাতব তোমার ওই শেষ পাড়ানির কড়ি

গানটুকুর জন্য।

তারপরে আবার বৈশাখ আসবে। তোমার জন্মদিন।

তখন আমায় নাই বা মনে রাখলে।

আমাদের ছুটি - ২৩শ সংখ্যা