আত্রেয়ীর ঈশ্বর ও ভয়ের ফেরিওলারা
ফেরিওলার ডাক ইদানীং বদলে গেছে খোদ
কলকাতায় অথবা তার গা ঘেঁষা শহরের বাড়তে থাকা অংশটায়। ঘরের ভেতর থেকেই রোজের কাজের
ফাঁকে ফাঁকে বদলে যাওয়া নতুন ডাকে আর চাহিদায় ক্রমে অভ্যস্ত হয়ে আসে আত্রেয়ী। ‘কাগজ, কাগজওলা, লোহা...’ শেষটায় অস্পষ্ট হয়ে
আসে সুর। এদের ডাকটা জরুরি, কয়েকমাস অন্তর কাগজ আর ভাঙাচোরা বেচতে। আত্রেয়ী যাকে
কাগজ বেচে, বেশ বয়স্ক লোক। সে প্রতিবারই আশ্বাস দেয়, দামে ওজনে তাকে ঠকাচ্ছে না,
আর প্রতিবারই আত্রেয়ীর ধারণা ও ঠকে এবং তারপরে কোন মাসে আবার আসবে তা বলেও দেয়।
শীতের সময় মায়ের কাছ থেকে চেয়ে এনে বাবার গরম জামা দিয়ে বলে, ঠাণ্ডায় কিছু গায়ে
দাওনি কেন? আবার পরের শীতে তার গায়ে কিছু দেখতে পায় না।
‘যা নেবে তাই’ বাড়তে বাড়তে এখন তিরিশ টাকায় পৌঁছেচে। একদিন চল্লিশ টাকার হাঁক শুনেই
তাড়াতাড়ি তিরিশ টাকার কাছে আরও কটা পাপোশ কিনে রাখে সে – হাতিবাগানে এই পাপোশই কত বেশি চায়। যদিও বাথরুমের
সামনে রাখা নতুন পাপোশে পা মুছতে মুছতে ওর বহু পুরোনো বর বলে, ‘এত ছোট পাপোশে আমার যে পা-ই আঁটে না’। ভারী কিন্তু কিন্তু
মুখ করে থাকে আত্রেয়ী। চল্লিশ পেরিয়েও ওর বাস্তব বুদ্ধি বেশ কম সেটা পদে পদে টের
পায়। পারতপক্ষে ও নিজে কিছুই প্রায় কেনেনা। আর কিনে ফেললেও আলোককে দাম বলতে চায়
না। মাঝেমাঝেই তাই সংসারের যাবতীয় কিছু কিনতে থাকা আলোকের আক্ষেপ শুনতে হয়, ‘এসব মেয়েদের কাজ। আমিও কি কিছু বুঝি নাকি? কিনবে, কিনতে কিনতেই শিখবে’। নাহ্, কিছুতেই সংসারের কিছু শিখে উঠতে পারেনি আত্রেয়ী। আঠেরো বছর সংসার
করার পরও সে যেন কিশোরী অথবা বালিকাই রয়ে গেছে তার ভাবনায় আর আশ্চর্য হওয়ায়।
‘একদাম একশো টাকা’-ও যায় মাঝেমধ্যেই, এদের পসরার বৈচিত্র্য বেশি। রেকর্ড করা অ্যানাউন্সমেন্টের
ধরণ অনেকটা এফ এম রেডিওর আর জে-দের মতো। সেদিন আবার নতুন এক হরেক মালের গাড়ি এল – ‘জালাল শেখের হরেক মালের প্রচার গাড়ি’। দশ টাকা
থেকে দুশো টাকার হরেক মাল। ভাঙাচোরার
বিনিময়েও নেওয়া যাবে বা টাকায়। এছাড়া মাঝে মাঝে আসে বড় ভ্যানে করে চাদর, বেডকভার। ‘ব্যাগের চেন সারাবে, প্যান্টের চেন সারাবে, জ্যাকেটের চেন সারাবে’ - এরাও বেশ কাজের। ‘কভারওলা’ হাঁকতে হাঁকতে চলে যায়, ‘ডাইনিং টেবিলের কভার,
কম্পিউটার কভার, আলমারীর কভার...’।‘দাদ, হাজা, চুলকানি’-র মহৌষধি থেকে ব্যথার মলম, ওদিকে ইঁদুর, আরশোলা,
পোকা আর উইয়ের ওষুধ। ‘ঝুলঝাড়ু...উ...উ...’ ডাক
দিয়ে যায় কোনওদিন। ‘কুলের
টক, কুলের টক’ ডাক শুনে একদিন ভারী আশ্চর্য হয়ে বারান্দায় গিয়ে
ফুলের টব নিয়ে এক ঠেলাকে যেতে দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল ও। আশ্চর্য হওয়ারও তো একটা
সীমা থাকবে, তাইনা?
ইদানীং মাছওলা একজন প্রায় রোজই
যায়। সে আবার সুরে-ছন্দে মাছ বিক্রি করে –‘তেলাপিয়া, ট্যাংরা আর
অল্পই আছে, না কোনো গল্প হবে না’। আত্রেয়ী এর ডাকটা
বেশ মন দিয়ে শোনে। যদিও কেনেনা একদিনও। এমন কী বাড়িতে মাছ না থাকলে বা মাছ কেনা
জরুরি হলেও। বরং আলোককে ফোন করে বলে, আজ অফিস থেকে ফেরার সময় মাছ এনো। ওর কেন জানি
ঠিক সাহস হয়না, কেন জানি মনে হয় বিশ্বের সকল লোক কেবল ওকেই ঠকায়, অথচ ও সব্বাইকে
বিশ্বাস করে। এবং সত্যিই বিশ্বাস করে আর বিশ্বাস করে ঠকেও বৈকি, সে দুটো ইমিটেশন কানের
দুলই হোক কী সখ করে দোকানে ঝুলতে দেখে হঠাৎ পছন্দ করে ফেলা মেয়ের জ্যাকেটই হোক। এই
তো সেদিন হেদুয়া থেকে হাতিবাগানের দিকে হাঁটতে হাঁটতে একটা দোকানে গোলাপী রঙের
একটা নরম জ্যাকেট ঝুলতে দেখে ওর মনে হল, এইটা বাবুইকে ভারী ভালো মানাবে। দোকানদারও
খদ্দেরের রকম দেখেই হেঁকে বসে, ‘সাড়ে চারশো’। তার বক্তব্য, দাম তো পাঁচশো-র ওপর ছিল, আপনাকে দেখেই কমিয়ে দিয়েছি, আর দরদাম
করবেন না। আত্রেয়ী বোঝে দামটা ওকে দেখেই অন্ততঃ একশো কী দেড়শো টাকা বেড়ে গেল। তবু
কেমন যেন মায়া লাগে, গোলাপী নরম কাপড়টায় হাত বুলিয়ে। সঙ্গে টাকা ছিল না বেশি,
অধিকাংশ সময়েই থাকে না, তাই দোকানদারের পরামর্শে একশো টাকা দিয়ে বুক করে আসে
জ্যাকেটটা, মেয়েকে নিয়ে এসে মাপমতো হলে নেবে, নাহলে অন্যকিছু।
ব্যাগে একটা ডেবিট কার্ড থাকে
আত্রেয়ীর, কিন্তু আজ পর্যন্ত একা একা এটিএম-এ গিয়ে ও টাকা তোলেনি। ওর একটা মানসিক
অসুবিধা হয়। মনে হয় ভুল হবে, মনে হয় টাকা যদি ঠিক না বেরোয়, যদি টাকাটা মার যায়,
অথবা আদপে হয়ত কিছুই ভাবে না, কিন্তু ওর একটা ভয় করে। যেমন ভয় করে এসকালেটারের
সিঁড়িতে পা রাখতে, যেন পড়ে যাবে ও হুড়মুড়িয়ে, ঠিক যেমনভাবে ছোটবেলায় রোজ স্বপ্নে
একটা অন্ধকার দরজার ওপারে পা দিয়ে ও পড়ে যেতে থাকত গভীর অন্ধকারে, রোজ, প্রতিদিন,
অথবা এসবই ভাবে না, শুধু ভয় করে ওর। বিশ্বাস ভাঙার কাঁচের ঝনঝন শব্দের মতো একটা ভয় ওকে কুড়ে
কুড়ে খায় প্রতিনিয়ত। অথচ ওর চারপাশে খুব অল্প হলেও একটা বিশ্বাস আর ভালোবাসার
বৃত্ত আছে। কিন্তু সেই বৃত্তও এতবছরেও ওর ছোটবেলার সেই ভয়কে কাটাতে পারেনি।
হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে ভাবতে খানিক ইতস্ততঃ
করে আলোককে ফোন করে জ্যাকেট বৃত্তান্ত বলে সে। আলোক তার সেই স্নেহময় হাসি হেসে
(ফোনেও সেই হাসি দিব্যিই বুঝতে পারে আত্রেয়ী) বলে, ‘কিনে
নিলে না কেন?’ ও বলে, আরও কিছু কেনার ছিল, তাছাড়া বাবুইকে না পরিয়ে
দেখে...। তুমি বরং বাবুইকে নিয়ে এসে দেখে কিনে নিও, যদি ওর পছন্দ না হয়, তাহলে
অন্য কিছু। ‘কেন, তোমার তো পছন্দ হয়েছে’, আলোক
বলে। না, ও বড় হয়েছে তো, আর দামটাও মনে হচ্ছে বেশি বলছে, তুমি একবার দরাদরি করে
যদি...। আলোক আশ্বাস দেয়, ‘দেখলে না, ধর্মতলার
দোকানগুলোতেও তো সাড়ে সাতশো-আটশো বলছিল, ওই দাম নেবেই’।
আত্রেয়ী তাও বলে, তাহোক, তুমি এসে দেখে নিও। আলোক স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে বলে, ‘আচ্ছা, আচ্ছা’। দুদিন পরে মেয়ে বাবার সঙ্গে গিয়ে ওই জ্যাকেটই কিনে
আনে। পঞ্চাশ টাকা কম হয়েছে, আলোক জানায়, ওটা একশো টাকা কম হলে নাকি ঠিক হতো।
আত্রেয়ী নিজের মনেই ভাবে, জানতাম। আচ্ছা, আমার মুখে কি বড়লোক লেখা আছে, না বোকা, কোনটা?
নাহলে ঠকায় কেন, ভেবে পায় না সে এবারেও।
বেশ কয়েকবছর হল, নতুন একটা হাঁক
শোনা যায়, ‘পুরানা কমপিউটার বেচবে, পুরানা মনিটার, সিপিইউ, পুরানা
মোবাইল, গিজার, পুরানা টিভি...’। যখন প্রথম প্রথম
কমপিউটার এল, তখনই আত্রেয়ীর মা একদিন মজা করে বলেছিল, দেখিস ক’দিন পরে পুরোনো কমপিউটার বিক্রি যাবে। যেমন, এখন আত্রেয়ী তার সদা মোবাইলে
ব্যস্ত ক্লাস টেনে পড়া মেয়েকে বলে, এরপরে দেখিস দেওয়ালে দেওয়ালে কাগজ সাঁটা থাকবে,
গোপনে ইন্টারনেটের নেশা ছাড়ানো হয়, যোগাযোগ করুন নীচের নম্বরে। তবে গোপনে নয়
ইদানীং অল্পবয়সীদের এই নেশা ছাড়াতে অনেক বাবা-মাকেই কাউন্সেলিং করাতে হচ্ছে
ছেলেমেয়েকে। বাবুইকেও করাতে হবে, মাঝে মাঝেই মোবাইলটা কেড়ে নিতে নিতে আত্রেয়ী
আক্ষেপ করে। আসলে বাবুইয়েরও বন্ধু নেই স্কুলে, পাড়ায়, যেমন ওর ছিল না ছোটবেলায়।
তবু তো ভালো, বাবুইকে গাছ আর পাখিদের সঙ্গে কিম্বা ডায়েরিতে কাল্পনিক বন্ধুর সঙ্গে
কথা বলতে হয় না। আসলে কোনটা ভালো তা ঠিক ঠাওর করতে পারে না আত্রেয়ী। না, এত বছরেও
না। বন্ধু না থাকা, কাল্পনিক বন্ধু বানিয়ে নেওয়া, অথবা বাবুইয়ের মতো ইন্টারনেটে
আলাপ হওয়া অজানা মানুষকে বন্ধু ভাবা। ওর সেই ভয় আবার চেপে ধরে, বাবুইকেও সবাই
ঠকিয়ে দেবে না তো? ওর ছোট্ট বাবুইকে?
শীতের দিনে হাঁক আসে, ‘বালাপোশ বানাবে? বালিশ, তোষক বানাবে?’ সেই ছেলেবেলার চেনা
ডাক আর ধুনুরির যন্ত্রের চেনা আওয়াজ। বিয়ের পর পর তখনও কলকাতায় কাবুলিওলা টাইপের
ঝোলা কাঁধে নিয়ে গরম জামা, শাল, চাদর, শাড়ি বেচতে আসত কাশ্মিরী শালওয়ালা। চারপাশে
ছাতার মতো ম্যল আর বিগ বাজারের ঠেলায় তারাও এখন নিরুদ্দেশ। তবে একটু সস্তার গালিচা
বা কার্পেট বেচতে এখনও কেউ কেউ আসে। হাওয়াই চটিওলা আর মোজাওলাদেরও দেখা মেলে
শীতকালে। হঠাৎ একদিন সকালে বাঁদরখেলার মতো ডুগডুগি বাজিয়ে হেঁকে যায়, ‘আছে মাসি, বৌদি ছেঁড়াচুল?’ আত্রেয়ী ভাবে
শীতকালে চুল বেশি ওঠে তাই বুঝি, অন্যসময়ে তো দেখি না। অনেকদিনপর একটা বাঁদরখেলাও
এসেছিল। বাবুইয়ের ছোটবেলাতেও এদের বেশ দেখা পাওয়া যেত। এখন জন্তুজানোয়ার পোষার
আইনকানুন বদল হওয়ায় সার্কাসে যেমন বাঘ-সিংহের খেলা আর নেই, তেমনি বাঁদরওলাদেরও
দেখা যায় না। অনেকক্ষণ ধরে বাঁদর ও বাঁদরী – শাহরুখ আর কাজল
লাফিয়ে নেচে ঘুরে খেলা দেখাল। মেয়ের সঙ্গে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে
ছেলেবেলার মতো খুশি হয়ে উঠছিল আত্রেয়ী। খেলা শেষ হলে মেয়ের হাতে দশ টাকা দিয়ে
আত্রেয়ী বলে, যা দিয়ে আয়। মেয়েও খুশি বাঁদরের হাতে টাকা দেবে বলে।
ফলওয়ালাদের পসরা বদলে যায় ঋতুতে
ঋতুতে - গরমে আম, জাম প্রায় বছরভর কলা আর পেয়ারা, শীতের দিকে কমলালেবু, বড় বড়
নারকেলি কুল, শাঁকালু, সবেদা, আপেল, শীতের শেষে আঙুরের ছড়াছড়ি। গরমে ডাবওলার ডাক
শোনা যায় আর শীতে তা বদলে যায় আখের রসে। হঠাৎ একদিন ভরদুপুরে এক গলির মধ্যে একজনকে ‘বেলফুল’ হাঁকতে শুনে ভারী আশ্চর্য হয়েছিল সে। এখন তো
বাজারে-বাসস্ট্যান্ডে ফুলের দোকান বা মাটিতে প্লাস্টিক বিছিয়ে ফুল বিক্রির চল। সেই
লোকটার সাইকেলে একটা বড় ঝোলা ছাড়া যদিও আর কিচ্ছু নজরে পড়েনি আত্রেয়ীর।
দুপুরবেলায় একেকদিন হেঁকে যায় ‘রসগোল্লা’। সন্ধের পর কোনও কোনওদিন ঝুনঝুনি বাজিয়ে যায়
চানাচুরওলা। গরম চানাচুর আগে মাঝে মাঝে মেয়ের বায়নায় কিনত আত্রেয়ী। ধোসাওলা আবার
টুংটাং বাজিয়ে ‘ধোসা, ইডলি’ বলে সুর করে হাঁক
দিয়ে দিয়ে এমন সময় যায় যে অধিকাংশ দিন তখন বিকেলের টিফিন খাওয়া হয়ে যায়। তবে
দোকানের ধোসা খেতে ঢের ভালো। তাই সময়ে এলেও খুব কমই এর কাছ থেকে ধোসা কেনে
আত্রেয়ী। গরমে অনেকদিন আইস্ক্রিমওলার ডাকও শোনা যায়। তবে বাড়িতে বসে অধিকাংশ ডাকই
শোনে আত্রেয়ী, নিজে তাদের পারতপক্ষে ডাকে না খুব দরকার ছাড়া।
তবু বুড়ো কাগজওলার মতোই আত্রেয়ীর
নিয়মিত আরেকজন পাওনাদার আছে। সে হাঁকে না, দরজায় এসে কড়া নেড়ে ডাকে, ‘বৌদি...’।
আগে একটা বিশেষ কোম্পানীর স্যানিটারি ন্যাপকিন বেচতো। এখনও বেচে, তবে আত্রেয়ী আর
কেনে না। যে জিনিসটা ও ব্যবহারই করতে পারবে না, সেটা কী করে কেনে? সে নাহোক,
প্রতিবারই এই বউটির ঝুলি থেকে কিছু না কিছু বেরোয়, সব সস্তা! একটা শ্যাম্পুর সঙ্গে
একটা শ্যাম্পু ফ্রি, বডিলোশন -বড় কিনলে ছোট্ট একটা ফ্রি, বডি স্প্রে, কাপড় কাচার
সাবান, ফিনাইল কী নিদেনপক্ষে ধূপ। আত্রেয়ী জানে এর কোনোটাও না হলেও তার দিনযাপনে
বিন্দুমাত্র ফারাক হতো না, তবু কিছু না কিছু কেনে, কিনতেই হয়। কারণ সব বৌদির মতো
এই বৌদিও না কিনলে বৌটির যে দিন চলে না। একেকবার মাসের শেষে এলে আত্রেয়ীর ভারী
মুশকিল হয়। একে টাকাপয়সার ব্যাপারটাই এত বয়সেও তার মাথায় ঢোকে না, তবু মাসের
শুরুতে আলমারীতে টাকা থাকে, মাসের শেষে একেকবার মেয়ের জমানো টাকাতেও হাত পড়ে আর
তাকেই বকুনি খেতে হয় মেয়ের কাছে। তাই বলে, এবারটা পারছিনা, তোমায় বলি, মাসের শেষে
এসো না। বউটি মিস্টি নরম গলা ঘন করে বলে, ‘পারবে পারবে’, আর ততো অসহায় লাগে আত্রেয়ীর। শেষে একেবারেই না হলে বলে, ‘তাহলে দু’ তারিখে আসি বৌদি?’ বৌদি
বিপন্ন গলায় বলে, না না, আর দু’চারদিন পরে এসো। এখন
সব রয়েছে আমার, কিচ্ছু লাগবে না। তবু সে আসে, নিয়ম করে, প্রতিমাসে, যেন আত্রেয়ীর
আর জন্মের খাতক। আত্রেয়ী ধার শোধে, শুধেই যায় বছরভর।
কখনও স্টিলের বাসনওয়ালা যায়। ও
কেনেনা। পুরোনো জামাকাপড়ের বদলেও বাসন কেনেনা আত্রেয়ী। স্টিলের বাসন যা আছে তাই
যথেষ্ট, কিনলে দোকান থেকে মাইক্রোওয়েভ প্রুফ বাসন কেনাই ভালো। ভাঙা চশমার বদলে
বাসন! এই ডাকটা শুনেও খুব আশ্চর্য হয়েছিল সে। বারান্দায় বেরিয়ে দেখে বয়স্ক এক
মহিলার পিঠে কালো একটা ব্যাগ আর দুহাতে দুটো বালতি ভর্তি স্টিলের বাসন। কালো
ব্যাগে সত্যি সত্যিই পুরোনো চশমা আছে কিনা সেটা অবশ্য বুঝে উঠতে পারেনি বেশ খানিক
অপেক্ষা করেও।
পুরোনো জামাকাপড় কিনবে বলে যেই
যাকনা কেন, তাকে বেচতে গেলে শেষপর্যন্ত অর্ধেক পুরোনো জিনিস রয়েই যায়। বাবুইয়ের
পুরোনো জামা - নেবে না। আত্রেয়ীর পুরোনো ম্যাক্সি, সালোয়ার কামিজ - তাও না। আলোকের
ছেঁড়া জিনস - চলবে না। ‘মা, তোমার কাপড় নেই, ধুতি? দাদার ভালো জামাপ্যান্ট
কিছু নেই?’ শেষপর্যন্ত আত্রেয়ীর অল্প পড়া কিছু শাড়ি বার করে দিতে হয়।
শাড়ি ও প্রায় পড়েই না। যেকটা আছে তার সবই হয় সখে কেনা, নাহয় স্মৃতির গন্ধ মাখানো।
না পড়লেও যেগুলো দেওয়া যায় না। আলমারীর কোথাও বুকের ভাঁজে রেখে দিতে হয়। এমন কী
ছেলেবেলায় যে শাড়িটা পড়ে ক্লাস ওয়ানে লালপরী সেজেছিল, সেটাও আছে রাখা, ভাঁজে
ন্যাপথলিনে। বাবা যেটা ছোটবেলায় কিনে দিয়েছিল, ওইটা তো মায়ের শাড়ি, ও কি আর দেওয়া
যায়? দুজনে মিলে কেনা বিয়ের সময়ের তিন-চারটে শাড়ি। তখন আর কতই মাইনে পেত আলোক।
তাঁতের সাধারণ শাড়ি। তা হোক, শাড়িগুলো থাক। বিয়ের বালুচরী শাড়িটা, চাদর। এইসবেই তো
ওর আলমারী ভরে থাকে। তাছাড়া শাড়ি ও খুব একটা নিজে কেনেও না, ফলে প্রায় সব শাড়িতেই
আলোকের পছন্দ লেগে থাকে। আত্রেয়ী বলে, ওর আলমারীর নাম ‘কিছু
ফেলতে পারি না’।
শেষপর্যন্ত দু-একটা ধুত্তোর বলে
বার করে দিতেই হয়। এই তো দুদিন আগে ও বেশ অবাক হয়েই পুরোনো জামাকাপড় হাঁকা লোকটাকে
জিজ্ঞাসাই করে ফেলল, আচ্ছা, আজকের দিনে ধুতি কে পড়ে বলতো? আমরাও কি আর শাড়ি পরি,
সে ওই অবরেসবরে। আর শাড়ি থাকলে আগে তো মাসিকেই দেব, বলে পুরোনো জামাকাপড়ের
কুরুক্ষেত্রের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ওর সারাক্ষণের সঙ্গী যে মহিলা কাজ করতে এসে
বহুকাল প্রায় বাড়ির একজন হয়ে উঠেছে সেই লক্ষ্মীদিকে দেখায়। অতসত বোঝে না কাপড়ওলা।
সে একবার আত্রেয়ীর গেঞ্জি-প্যান্ট পরা চেহারার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে ‘ঠিক, ঠিক’ বলে, তারপর সেই মাসির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘মায়ের শাড়ি নেই’? আত্রেয়ী ভাবে, এতো আচ্ছা জ্বালা, ফের প্রশ্ন করে,
প্যান্টগুলো নেবে না কেন? কাপড়ওলার অম্লানবদনে উত্তর, ‘ও তো
ছেঁড়া’। আত্রেয়ী এবার বিরক্ত হয়, নতুন জামাকাপড় তোমায় দেব নাকি?
তবে পুরোনো জামাকাপড় বল কেন? কাপড়ওলা এবার কিঞ্চিৎ বিব্রত স্বরে বলে, ‘আমি কি নতুন জামাকাপড় চাচ্ছি? ছেঁড়া-ফাটা হলে মালিক নেবে না। শাড়ি কাপড় না হলে
মালিক নেবে না, আমি কী করব?’ অতএব আত্রেয়ীকে সেই
নিজের শাড়ি, মৃত শাশুড়ির শাড়ি বের করে দিতে হয়, এবং কাপড়ওলা খুশি মনে চলে গেলে
বারান্দায় গিয়ে দেখে বাতিল জামাকাপড়ের অর্ধেকেরও বেশি এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। বেচারা
আত্রেয়ী তখন বিপন্ন গলায় হাঁক পারে, ও লক্ষ্মীদি, আমার যে কিছুই হল না।
ছেলেবেলায় মায়ের মুখে শোনা টলস্টয়ের
একটা গল্প খুব প্রিয় আত্রেয়ীর। গল্পের প্রথম বাক্য, মার্টিন নামে এক মুচি ছিল। গল্পটা
হল, মার্টিন ঈশ্বরে বিশ্বাস করত আর ঈশ্বর কেন দেখা দেয়না তাকে, এই নিয়ে ভারী মনখারাপ
করে থাকত। শেষে একদিন সে শুনতে পেল, ঈশ্বর তাকে বলছে, আমি আগামীকাল তোমার কাছে
আসব। পরেরদিন প্রবল বরফবৃষ্টির মধ্যে ঝাড়ুদার স্তেপানিচ, বাচ্চা কোলে একটি বউকে আর
এক বৃদ্ধাকে আশ্রয়, খাবার আর নিজের গরম চাদর দিয়েছিল মার্টিন। তবু ঈশ্বর আসেনি।
সেদিন রাতে যিশুর কাছে আবার কাঁদলে, বাইবেলের একটা পাতা খুলে যায়, তাতে লেখা, আমি
ক্ষুধার্ত ছিলাম, তুমি আমাকে অন্ন দিয়েছিলে, আমি শীতার্ত ছিলাম, তুমি আমাকে বস্ত্র
দিয়েছিলে, আমি তোমার আশ্রয়প্রার্থী ছিলাম, তুমি আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলে। আমি তো
তোমার ঘরে গিয়েছিলাম, তুমিই আমায় চিনতে পারনি। এই গল্পটা মাঝেমাঝেই ছেলেবেলায় সে বায়না
করে শুনতো। ছোট থেকেই ভারী অসুস্থ সে। অসুখের দিনগুলোতে এই গল্পটা ওর মনে শক্তি
জোগাতো। গল্পটা শুনলেই অপূর্ব একটা অনুভূতিতে মন ভরে উঠত ওর। এখনও গল্পের শেষের সেই
অনুভূতি ফিরে ফিরে আসে ওর মনে। এখনও অসুখ করলে মায়ের গলা ভেসে আসে কানে – ‘মার্টিন নামে এক মুচি ছিল’।
আত্রেয়ী ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না।
মানুষে ওর অগাধ বিশ্বাস। এই বিশ্বাসটা খানিক উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া, ঈশ্বরে না-বিশ্বাসটা
একান্তই নিজের। আত্রেয়ীর মাও খুব মানুষকে বিশ্বাস করেন। আলোক ওকে একবার বলেছিল,
আমি বোকার মতো মানুষকে বিশ্বাস করি না, সে আমাকে ঠকাবে জেনেই বিশ্বাস করি।
বিশ্বাসের এই গাছটা তাই সারাজীবন ডালপালা মেলেছে আত্রেয়ীর ভেতরে। বিশ্বাস নিজেকে ভাঙতে
ভাঙতে আর গড়তে গড়তে তার গভীরে বিছিয়ে দিয়েছে শিকড়বাকড়। মানুষকে তাই বিশ্বাস করে ও।
আর সেই বিশ্বাস সত্যি করতে খুব প্রয়োজনের সময় ওকে নিখরচায় গাড়িতে লিফট দেয় কোনও
অপরিচিত। ট্যাক্সির আকালের কলকাতাতেও ফাঁকা পথে রাত গভীরে হাঁটতে হাঁটতে পেয়ে যায়
ট্যাক্সিসমেত কোনও সহৃদয় চালকের দেখা। জীবনের খুব কঠিন দিনে কোথা দিয়ে না কোথা
দিয়ে এসে বন্ধুরা বলে, আছি তো, লড়ে যা তুই। এদেরকেই আত্রেয়ী বলে, মানুষ অথবা ওর
ঈশ্বরই। আত্রেয়ীর বাইপোলার সিনড্রোম যখন খুব বেড়ে যায়, লক্ষ্মীদি এসে হাতের কাজ
কেড়ে নিয়ে বলে, কাজ করতে পারছ না তো একা একা দাঁড়িয়ে কাঁদছ কেন বৌদি? কাঁদলে না
তোমার শরীর খারাপ বেড়ে যায়, একদম কাঁদবে না। আর বাবুইকে একদম বকবে না। অত
চেঁচামেচি করলে তোমারই শরীর খারাপ হয়। ঘুমের মধ্যে টের পায় বাবুই এসে ওর মাথায় হাত
বুলিয়ে দিচ্ছে। তখন আর ভয় করে না ওর।
ল্যাপটপটা নিয়ে লিখতে বসেছিল
আত্রেয়ী। এটাই ওর নেশা, এটাই ওর আশ্রয়। হঠাৎ একটা চিৎকার, একটা ডাক কানে এল ওর।
মাত্র কয়েকবছর হল উত্তর কলকাতার পুরোনো বাড়ি ছেড়ে এই ফ্ল্যাটে এসেছে ওরা। তখন
পাড়াটা চেহারা আর স্বভাবে একেবারে অন্যরকম ছিল। কয়েকটা পাকাবাড়ি আর খানকতক টালির
চালের বাড়ির মাঝে ওদেরটাই এক চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি। যার দোতলাটা কিনে নিয়ে এসেছিল
ওরা। তখন আলোকের বন্ধুবান্ধব কেউ কেউ বলেছিল, ‘একদম
টালির চালের বাড়ির গায়ে ফ্ল্যাট কিনলি!’ আলোক বলেছিল, ‘কী আর করা যাবে, কমদামে বড় ফ্ল্যাট হল’। তাছাড়া এপাড়ায়
থাকাটার মধ্যে কেমন একটা মধ্যবিত্ততার গন্ধ মাখা, সেটাও আসলে ছাপোষা আলোক-আত্রেয়ীর
ভালোলেগেছিল। অথচ এই ক’বছরেই একের পর এক টালির চালের বাড়ি ভেঙে পাকা বাড়ি
উঠেছে, পাকা বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাটবাড়ি। আর পাড়া পাড়া ভাবটা কমে গিয়ে বেড়েছে
খিস্তি-খেউড় প্রকাশ্য পথে। প্রথমে তাই মন দেয়নি আত্রেয়ী। তারপরে লেখা থামিয়ে
বারান্দার দরজা খুলে উঁকি মারে। মাঝবয়সী দুটো বউ, হাতে অল্প কয়েকটা জামাকাপড়, ‘আমাদের কিছু জামাকাপড় দাও গো..., ও মা, বৌদিরা, আমাদের ঘর ভেসে গেছে...’ - দু’হাত
মাথার ওপরে তুলে অনেকটা গৌরাঙ্গ ভঙ্গীতে চাইছে। এর আগে কখনও এমন অভিজ্ঞতা হয়নি
আত্রেয়ীর। সুন্দরবনের আয়লা-র সময় ওর পরিচিত-অপরিচিত অনেকে এসে গাঁঠরি বেঁধে পুরোনো
কাপড়জামা নিয়ে গেছে বন্যাবিধ্বস্তদের জন্য। কিন্তু ঘর-গেরস্থালী ভেসে যাওয়া কাউকে
কখনও বিলাপ করে জামা ভিক্ষা করতে দেখেনি ও। সাধারণতঃ বাবা-মায়ের ক্যান্সার, কারখানা
বন্ধ - এমন একাধিক লোক বা একা কেউ কেউ আসে বটে। এছাড়া, বাবা লোকনাথ ধরণের কেউ
কেউও। কিন্তু জামাকাপড় তো কেউ ভিক্ষা করে না!
লক্ষ্মীদি বাড়ি নেই, একা
দুপুরবেলায়, একটু দোনামোনা করে আত্রেয়ী। ওর একটু ভয় করে। ওরা দু’জন আর ও একা। যেমন, ভয় লেগেছিল পার্কসার্কাস মোড়ে এক অচেনা ভদ্রলোক হাত
দেখাতেই ওকে একা লিফট দিয়েছিলেন, সেইসময়। খানিকটা সেই ভয় নিয়েই ও একজনকে ডাক দেয়।
পুরোনো জামাকাপড়ের পোঁটলাগুলো বারান্দা থেকে দরজার কাছে এনে সেই ভয়ে ভয়েই দরজাটা
সামান্য ফাঁক করে। বউটি ওকে দেখে হাঁউমাউ করে ওঠে, ‘ওমা,
কিছু কাপড়জামা দাও মা, বাচ্চার কাপড়, শাড়ি’। একজন দেখে সাহস
বাড়ে আত্রেয়ীর, গায়ের জোর না থাক, মনে তার ঢের জোর। শাড়ি শুনে আবার আতঙ্কিতও হয়,
তবে এ অন্য আতঙ্ক। জিজ্ঞাসা করে, তোমার বাড়ি কোথায়? বউটি বলে, ‘সুন্দরবন, ঘর ভেসে গেছে মা’। জামাকাপড়ের পোঁটলা
খুলে আত্রেয়ী বলে, নিয়ে যাও। নিজের পরার শাড়িই এনে দেয়, পুরোনো সোয়েটার, গরম শাল।
বৌটি সব গুছিয়ে নিতে নিতে সেই দু’হাত তুলেই আশীর্বাদ
করে তাকে – ‘ছেলেমেয়ে ক’টা মা? একটা? ভালো
থেকো মা, ভালো থেকো, স্বামী-সন্তান নিয়ে’। এই বউটি নামে সিঁড়ি
বেয়ে, একই সিঁড়ি বেয়ে অন্য বউটি ওঠে, ‘ওমা আমায় কিছু দিলে
না মা’। মায়ের তখন আবার সেই বিপন্ন অবস্থা। আত্রেয়ী মনখারাপের
গলায় বলে, এক্ষুনি তো কিছু নেই গো, ওটাই ভাগ করে নাও না দুজনে। প্রথম বউটি চোখের
ইশারায় আর জোরে মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘না, না’। আত্রেয়ী বিপন্ন গলায় বলে, আর কিছু এক্ষুনি নেই তো, তুমি কয়েকমাস পরে এসো।
দ্বিতীয় বউটি বলে, ‘তুমি ওকে দিলে মা, আমাকে কিছু দিলে না, আমাকে কিছু
দাও’। আত্রেয়ী হাহাকারের সুরে না, না করে দরজা বন্ধ করে দেয়
ওদের মুখে।
আত্রেয়ী নিজের টেবিলে ফিরে আসে।
আত্রেয়ী একা বসে থাকে ল্যাপটপ কোলে করে। ফেসবুকে স্ট্যাটাস লেখে, আসলে আমরা কেউ
কারোর জন্য কোনদিন কিচ্ছু করতে পারি না। আয়নায় মুখ দেখলে দেখি, হয় এক স্বার্থপর,
নাহয় এক ভিখারি।
মোবাইলের নোটে নিজের কাছেই ডায়েরি,
কবিতা লেখে আত্রেয়ী রোজ। টুকরো টুকরো ভাবনা, টুকরো টুকরো লেখা। মোবাইলে নোট লিখতে
থাকে আত্রেয়ী, সত্যি, আমার কি দেওয়ার মতো কিছুই ছিল না? আমার কি কোনও জামাকাপড়ই
ছিল না? তাহলে দিতে পারলাম না কেন? কেন?
পরেরদিন ঠিক দুপুরে আবার সেই ডাক
কানে আসে ওর। ‘ও মা, ও বৌদি, কিছু জামাকাপড় দাও না, ঘর ভেসে গেছে’। আত্রেয়ী উঠে আর দেখতে যায় না, প্রথম, দ্বিতীয় নাকি তৃতীয় অন্য কেউ।
আত্রেয়ীর ভয় করে।
- কান্তরেণু, ২০১৭
ফাঁসি
‘মা,
ধর্ষণ মানে কী’ – তিন্নির দু’ বছরের বড় দাদা, ন’ বছরের তাতাই মাকে জিজ্ঞাসা করে। প্রশ্নটা
শুনে খুন্তি নাড়া মায়ের হাতটা একটুক্ষণের জন্যে থেমে যায়। তাতাই প্রশ্নের
পুনরাবৃত্তি করে...মা ভাবেন...। তাতাই বিরক্ত হয়ে ওঠে – ‘উত্তর
দিচ্ছ না কেন, তখন থেকে জিজ্ঞাসা করছি’। মা
বলেন, ‘কোথায় পেলি এসব কথা?’
-‘কেন খবরের কাগজে’, তাতাই জবাব দেয়।
-‘সত্যি খবরের
কাগজগুলো আজকাল যা-তা হয়েছে, এইসব ঘটনাকে মুখরোচক গল্প করে ছাপে’- গজগজ
করেন তিন্নি-তাতাইয়ের মা শ্রীময়ী।
-‘বললে না তো’ – ফের মাকে ধরে নাড়া দেয় তাতাই।
-‘ওই তো কোনও ছেলে
কোনও মেয়েকে খুব মারলে তাকে ধর্ষণ বলে’। – এড়িয়ে যেতে চান শ্রীময়ী। তাতাই এবার
একটু চিন্তান্বিত কন্ঠে বলে, ‘আচ্ছা
মা, আমি যে বোনকে মারি সেটাও কি ধর্ষণ? আমারও কি জেল হবে, ফাঁসি হবে?’
-‘কী আবোলতাবোল
বকছিস?’ – রেগে
ওঠেন শ্রীময়ী। -‘এটা বড়দের
ব্যাপার’।
মায়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে তাতাই ফের প্রশ্ন করে, ‘তুমি আর বাবা যে সেদিন ঝগড়া
করছিলে, বাবা তোমাকে মারল কত জোরে – সেটা
ধর্ষণ মা?’
ছেলের প্রশ্নে এবার ভারি বিপাকে পড়েন শ্রীময়ী। ন’ বছরের ছেলের কাছে ধর্ষণের সংজ্ঞা
ঠিক কী হতে পারে খুঁজে পান না তিনি।
-‘দূর বোকা,
বাবা-মার মধ্যে তো অমন একটু ঝগড়া হয়েই থাকে, ও কিছু না। অচেনা কোনও ছেলে যদি অচেনা
কোনও মেয়েকে মারে তাহলে তাকে ধর্ষণ বলে। এখন যা তো এখান থেকে, তোর কথা শুনতে শুনতে
তরকারিটাই তলায় লেগে গেল’।
এবারে ‘ধর্ষণ’-এর কোনো সংজ্ঞা অথবা ব্যাখ্যা
হয়ত তাতাইয়ের বোধগম্য হয়। প্রসঙ্গ বদলায় সে – ‘ধর্ষণ
করলেই ফাঁসি হয় মা? ফাঁসি তো যাঁরা বীর, যাঁরা দেশের জন্য লড়াই করেন তাঁদের হয়।
ইতিহাসের আর গল্পের বইতে তো তাই আছে। তাহলে ধনঞ্জয়ের ফাঁসি হল কেন?’
ছেলের প্রশ্নের উত্তর হাতড়ে বেড়ান শ্রীময়ী। উফ্, কেন যে
কাগজগুলোয় ধনঞ্জয়কে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করছে, আপনমনেই গজগজ করেন তিনি।তাতাই আবার
মায়ের আঁচল ধরে টান দেয়, ‘কী হল,
বলো না –
-‘ইংরেজরা যখন
এদেশ শাসন করত তখন তারা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের খারাপ লোক বলে ভাবত, তাই তাদের ফাঁসি
দিত। তবে সব দেশেই যারা সত্যিকারের খারাপ লোক তাদের শাস্তি দেয়। এবার থাম তো। এসব
কথা বাবাকে জিজ্ঞাসা করিস না কেন বল তঁ? বাবা আমার চেয়ে ঢের বেশি জানে’।
-ধুত্, তুমি তো তাও কত কথা বলো, বাবা কোনও প্রশ্নের উত্তরই
দেয়না। শুধু বলে, তাতাই, এসব বড়দের ব্যাপার, আগে বড় হও, তারপরে সব জানতে-বুঝতে
পারবে। এখন নিজের পড়াশোনা কর’। তাতাই
বাবাকে নকল করে। শ্রীময়ী হেসে গড়িয়ে পড়েন। -‘জানো মা, বাবা ভাবে আমি কিচ্ছু জানি না,
কিচ্ছু বুঝি না। মোটেও তা না, আমি সব বুঝতে পারি’।
-‘ওরে আমার
বোঝনদার ছেলে, যাও, এখন বই-খাতা গুছিয়ে নাও, স্কুলের সময় হয়ে যাচ্ছে। আমি রান্নাটা
শেষ করি, তোর সাথে শুধু বকবক করলেই কি চলবে?’
শনিবার দুপুরটা তিন্নি আর তাতাইয়ের একা একাই কাটে। ওদের
স্কুল ছুটি থাকলেও বাবা-মায়ের অফিস ছুটি থাকে না। ওরা দুজন আর পলিমাসি। পলিমাসি
ওদের বাড়িতে কাজ করে। দিনরাত থাকে। দুপুরের সব টিভি সিরিয়াল পলিমাসির মুখস্থ।
অন্যদিন বাড়ির চারজনই স্কুল আর অফিসে বেরিয়ে গেলে হাতের কাজ সেরে সে টিভির সামনে
বসে পড়ে। শনিবারদিনটায় ওদের দুজনকে নিয়েই হিমসিম খেয়ে যায় সে। এগারোটা থেকেই
স্নানের তাড়া দিতে শুরু করলে হয়তো দেড়টায় গিয়ে শেষ হয়। তিন্নিকে কোনওমতে হাতের
কাছে পাওয়া গেলেও তাতাই তিনটে সিঁড়ি লাফিয়ে উঠে বাউন্ডারির বাইরে চলে যায়। অনেক দৌড়াদৌড়ি
করে দুটো-আড়াইটে নাগাদ ভাই-বোনের খাওয়ার পাট চুকলে পলিমাসি তার কানাউঁচু থালায়
ভাত-তরকারি নিয়ে টিভির সামনে বসে পড়ে। চেনা সিরিয়াল অথবা কোন কোনও শনিবারে বাংলা
বা হিন্দি সিনেমাও। দেখতে দেখতে হাতের এঁটো শুকিয়ে খড়খড়ে হয়ে আসে। দোতলায়
তিন্নি-তাতাইয়ের হট্টগোলও আর কানে আসে না। মাঝে মাঝেই শনিবার দুপুরে পাশের বাড়ির ছ’বছরের শুভও জুটে যায় ওদের সঙ্গে। যেদিন
যেদিন তার ছুটি থাকে। সেদিন বাড়িতে কাক-চিল বসতেও ভয় পায়।
‘ধনঞ্জয়ের ফাঁসি’ – খেলার বুদ্ধিটা
তাতাইয়ের মাথাতেই এসেছিল। ন’বছরের তাতাই তার
সদ্য আরব্ধ জ্ঞান সাত এবং ছ’বছরের তিন্নি ও
শুভর কাছে বিতরণ করছিল – ধর্ষণ কাকে বলে,
ফাঁসি কেন হয়...। নতুন খেলার প্রস্তাবে দারুণ আনন্দে রাজি হয়ে যায় ছয় এবং সাতও।
নীচু খাটের ওপর টুলে চড়ে পাখায় মায়ের গামছাটাও বেঁধেছিল তাতাই-ই...শুভ মহা আনন্দে
জল্লাদের ভূমিকা নেয়...অর্থাৎ তিন্নি যখন হাতে বাঁধা মিকি মাউস ঘড়ি দেখে পাখির মতো
দেখতে খেলনা বাঁশিটা বাজাবে তখন তাতাইয়ের পায়ের তলা থেকে টুলটা সরিয়ে নেবে
শুভ...তাতাইও গামছায় বাঁধা ফাঁসে ঝুলে পড়বে।
ঘটনাগুলোও ঠিক তাই তাই ঘটেছিল।
তাতাইয়ের তীব্র ছটফটানি, ঝুলে পড়া জিব, তিন্নি আর শুভর
চিৎকার...খেলা বদলে যায় আতঙ্কে।
পলিমাসির চিৎকারে পাড়ার লোক জড়ো হয়। তাতাইয়ের প্রায়
নিস্পন্দ দেহ নামানো হয়। পুলিশ-অ্যাম্বুলেন্স আসে। শুভকে বাড়ির লোকজন আগেই নিয়ে
গিয়েছিল। বাবা-মাও হাসপাতালে গেছে তাতাইয়ের সঙ্গে, খবর পেয়ে আরও অন্যরাও। েকা ঘরে
পলিমাসিকে জড়িয়ে ধরে তিন্নি। পলিমাসি তিন্নির মাথায় হাত বোলায়। তিন্নি ফুঁপিয়ে
কেঁদে ওঠে, - ‘পলিমাসি, দাদা কি
মরে যাবে? আমি তো মারিনি দাদাকে...শুভও মারেনি...আমরা তো শুধু খেলছিলাম...নতুন
খেলা...দাদা বলল কাগজে পড়েছে...। কেন তবে দাদা মরে যাবে? কার জন্য, কে সেই দুষ্টু
লোক, বলো না পলিমাসি?’ পলিমাসি চোখ মোছে...তিন্নির
প্রশ্নের উত্তর হাতড়ায়...।
আত্রেয়ীর ঈশ্বর ও ভয়ের ফেরিওলারা
ফেরিওলার ডাক ইদানীং বদলে গেছে খোদ
কলকাতায় অথবা তার গা ঘেঁষা শহরের বাড়তে থাকা অংশটায়। ঘরের ভেতর থেকেই রোজের কাজের
ফাঁকে ফাঁকে বদলে যাওয়া নতুন ডাকে আর চাহিদায় ক্রমে অভ্যস্ত হয়ে আসে আত্রেয়ী। ‘কাগজ, কাগজওলা, লোহা...’ শেষটায় অস্পষ্ট হয়ে
আসে সুর। এদের ডাকটা জরুরি, কয়েকমাস অন্তর কাগজ আর ভাঙাচোরা বেচতে। আত্রেয়ী যাকে
কাগজ বেচে, বেশ বয়স্ক লোক। সে প্রতিবারই আশ্বাস দেয়, দামে ওজনে তাকে ঠকাচ্ছে না,
আর প্রতিবারই আত্রেয়ীর ধারণা ও ঠকে এবং তারপরে কোন মাসে আবার আসবে তা বলেও দেয়।
শীতের সময় মায়ের কাছ থেকে চেয়ে এনে বাবার গরম জামা দিয়ে বলে, ঠাণ্ডায় কিছু গায়ে
দাওনি কেন? আবার পরের শীতে তার গায়ে কিছু দেখতে পায় না।
‘যা নেবে তাই’ বাড়তে বাড়তে এখন তিরিশ টাকায় পৌঁছেচে। একদিন চল্লিশ টাকার হাঁক শুনেই
তাড়াতাড়ি তিরিশ টাকার কাছে আরও কটা পাপোশ কিনে রাখে সে – হাতিবাগানে এই পাপোশই কত বেশি চায়। যদিও বাথরুমের
সামনে রাখা নতুন পাপোশে পা মুছতে মুছতে ওর বহু পুরোনো বর বলে, ‘এত ছোট পাপোশে আমার যে পা-ই আঁটে না’। ভারী কিন্তু কিন্তু
মুখ করে থাকে আত্রেয়ী। চল্লিশ পেরিয়েও ওর বাস্তব বুদ্ধি বেশ কম সেটা পদে পদে টের
পায়। পারতপক্ষে ও নিজে কিছুই প্রায় কেনেনা। আর কিনে ফেললেও আলোককে দাম বলতে চায়
না। মাঝেমাঝেই তাই সংসারের যাবতীয় কিছু কিনতে থাকা আলোকের আক্ষেপ শুনতে হয়, ‘এসব মেয়েদের কাজ। আমিও কি কিছু বুঝি নাকি? কিনবে, কিনতে কিনতেই শিখবে’। নাহ্, কিছুতেই সংসারের কিছু শিখে উঠতে পারেনি আত্রেয়ী। আঠেরো বছর সংসার
করার পরও সে যেন কিশোরী অথবা বালিকাই রয়ে গেছে তার ভাবনায় আর আশ্চর্য হওয়ায়।
‘একদাম একশো টাকা’-ও যায় মাঝেমধ্যেই, এদের পসরার বৈচিত্র্য বেশি। রেকর্ড করা অ্যানাউন্সমেন্টের
ধরণ অনেকটা এফ এম রেডিওর আর জে-দের মতো। সেদিন আবার নতুন এক হরেক মালের গাড়ি এল – ‘জালাল শেখের হরেক মালের প্রচার গাড়ি’। দশ টাকা
থেকে দুশো টাকার হরেক মাল। ভাঙাচোরার
বিনিময়েও নেওয়া যাবে বা টাকায়। এছাড়া মাঝে মাঝে আসে বড় ভ্যানে করে চাদর, বেডকভার। ‘ব্যাগের চেন সারাবে, প্যান্টের চেন সারাবে, জ্যাকেটের চেন সারাবে’ - এরাও বেশ কাজের। ‘কভারওলা’ হাঁকতে হাঁকতে চলে যায়, ‘ডাইনিং টেবিলের কভার,
কম্পিউটার কভার, আলমারীর কভার...’।‘দাদ, হাজা, চুলকানি’-র মহৌষধি থেকে ব্যথার মলম, ওদিকে ইঁদুর, আরশোলা,
পোকা আর উইয়ের ওষুধ। ‘ঝুলঝাড়ু...উ...উ...’ ডাক
দিয়ে যায় কোনওদিন। ‘কুলের
টক, কুলের টক’ ডাক শুনে একদিন ভারী আশ্চর্য হয়ে বারান্দায় গিয়ে
ফুলের টব নিয়ে এক ঠেলাকে যেতে দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল ও। আশ্চর্য হওয়ারও তো একটা
সীমা থাকবে, তাইনা?
ইদানীং মাছওলা একজন প্রায় রোজই
যায়। সে আবার সুরে-ছন্দে মাছ বিক্রি করে –‘তেলাপিয়া, ট্যাংরা আর
অল্পই আছে, না কোনো গল্প হবে না’। আত্রেয়ী এর ডাকটা
বেশ মন দিয়ে শোনে। যদিও কেনেনা একদিনও। এমন কী বাড়িতে মাছ না থাকলে বা মাছ কেনা
জরুরি হলেও। বরং আলোককে ফোন করে বলে, আজ অফিস থেকে ফেরার সময় মাছ এনো। ওর কেন জানি
ঠিক সাহস হয়না, কেন জানি মনে হয় বিশ্বের সকল লোক কেবল ওকেই ঠকায়, অথচ ও সব্বাইকে
বিশ্বাস করে। এবং সত্যিই বিশ্বাস করে আর বিশ্বাস করে ঠকেও বৈকি, সে দুটো ইমিটেশন কানের
দুলই হোক কী সখ করে দোকানে ঝুলতে দেখে হঠাৎ পছন্দ করে ফেলা মেয়ের জ্যাকেটই হোক। এই
তো সেদিন হেদুয়া থেকে হাতিবাগানের দিকে হাঁটতে হাঁটতে একটা দোকানে গোলাপী রঙের
একটা নরম জ্যাকেট ঝুলতে দেখে ওর মনে হল, এইটা বাবুইকে ভারী ভালো মানাবে। দোকানদারও
খদ্দেরের রকম দেখেই হেঁকে বসে, ‘সাড়ে চারশো’। তার বক্তব্য, দাম তো পাঁচশো-র ওপর ছিল, আপনাকে দেখেই কমিয়ে দিয়েছি, আর দরদাম
করবেন না। আত্রেয়ী বোঝে দামটা ওকে দেখেই অন্ততঃ একশো কী দেড়শো টাকা বেড়ে গেল। তবু
কেমন যেন মায়া লাগে, গোলাপী নরম কাপড়টায় হাত বুলিয়ে। সঙ্গে টাকা ছিল না বেশি,
অধিকাংশ সময়েই থাকে না, তাই দোকানদারের পরামর্শে একশো টাকা দিয়ে বুক করে আসে
জ্যাকেটটা, মেয়েকে নিয়ে এসে মাপমতো হলে নেবে, নাহলে অন্যকিছু।
ব্যাগে একটা ডেবিট কার্ড থাকে
আত্রেয়ীর, কিন্তু আজ পর্যন্ত একা একা এটিএম-এ গিয়ে ও টাকা তোলেনি। ওর একটা মানসিক
অসুবিধা হয়। মনে হয় ভুল হবে, মনে হয় টাকা যদি ঠিক না বেরোয়, যদি টাকাটা মার যায়,
অথবা আদপে হয়ত কিছুই ভাবে না, কিন্তু ওর একটা ভয় করে। যেমন ভয় করে এসকালেটারের
সিঁড়িতে পা রাখতে, যেন পড়ে যাবে ও হুড়মুড়িয়ে, ঠিক যেমনভাবে ছোটবেলায় রোজ স্বপ্নে
একটা অন্ধকার দরজার ওপারে পা দিয়ে ও পড়ে যেতে থাকত গভীর অন্ধকারে, রোজ, প্রতিদিন,
অথবা এসবই ভাবে না, শুধু ভয় করে ওর। বিশ্বাস ভাঙার কাঁচের ঝনঝন শব্দের মতো একটা ভয় ওকে কুড়ে
কুড়ে খায় প্রতিনিয়ত। অথচ ওর চারপাশে খুব অল্প হলেও একটা বিশ্বাস আর ভালোবাসার
বৃত্ত আছে। কিন্তু সেই বৃত্তও এতবছরেও ওর ছোটবেলার সেই ভয়কে কাটাতে পারেনি।
হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে ভাবতে খানিক ইতস্ততঃ
করে আলোককে ফোন করে জ্যাকেট বৃত্তান্ত বলে সে। আলোক তার সেই স্নেহময় হাসি হেসে
(ফোনেও সেই হাসি দিব্যিই বুঝতে পারে আত্রেয়ী) বলে, ‘কিনে
নিলে না কেন?’ ও বলে, আরও কিছু কেনার ছিল, তাছাড়া বাবুইকে না পরিয়ে
দেখে...। তুমি বরং বাবুইকে নিয়ে এসে দেখে কিনে নিও, যদি ওর পছন্দ না হয়, তাহলে
অন্য কিছু। ‘কেন, তোমার তো পছন্দ হয়েছে’, আলোক
বলে। না, ও বড় হয়েছে তো, আর দামটাও মনে হচ্ছে বেশি বলছে, তুমি একবার দরাদরি করে
যদি...। আলোক আশ্বাস দেয়, ‘দেখলে না, ধর্মতলার
দোকানগুলোতেও তো সাড়ে সাতশো-আটশো বলছিল, ওই দাম নেবেই’।
আত্রেয়ী তাও বলে, তাহোক, তুমি এসে দেখে নিও। আলোক স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে বলে, ‘আচ্ছা, আচ্ছা’। দুদিন পরে মেয়ে বাবার সঙ্গে গিয়ে ওই জ্যাকেটই কিনে
আনে। পঞ্চাশ টাকা কম হয়েছে, আলোক জানায়, ওটা একশো টাকা কম হলে নাকি ঠিক হতো।
আত্রেয়ী নিজের মনেই ভাবে, জানতাম। আচ্ছা, আমার মুখে কি বড়লোক লেখা আছে, না বোকা, কোনটা?
নাহলে ঠকায় কেন, ভেবে পায় না সে এবারেও।
বেশ কয়েকবছর হল, নতুন একটা হাঁক
শোনা যায়, ‘পুরানা কমপিউটার বেচবে, পুরানা মনিটার, সিপিইউ, পুরানা
মোবাইল, গিজার, পুরানা টিভি...’। যখন প্রথম প্রথম
কমপিউটার এল, তখনই আত্রেয়ীর মা একদিন মজা করে বলেছিল, দেখিস ক’দিন পরে পুরোনো কমপিউটার বিক্রি যাবে। যেমন, এখন আত্রেয়ী তার সদা মোবাইলে
ব্যস্ত ক্লাস টেনে পড়া মেয়েকে বলে, এরপরে দেখিস দেওয়ালে দেওয়ালে কাগজ সাঁটা থাকবে,
গোপনে ইন্টারনেটের নেশা ছাড়ানো হয়, যোগাযোগ করুন নীচের নম্বরে। তবে গোপনে নয়
ইদানীং অল্পবয়সীদের এই নেশা ছাড়াতে অনেক বাবা-মাকেই কাউন্সেলিং করাতে হচ্ছে
ছেলেমেয়েকে। বাবুইকেও করাতে হবে, মাঝে মাঝেই মোবাইলটা কেড়ে নিতে নিতে আত্রেয়ী
আক্ষেপ করে। আসলে বাবুইয়েরও বন্ধু নেই স্কুলে, পাড়ায়, যেমন ওর ছিল না ছোটবেলায়।
তবু তো ভালো, বাবুইকে গাছ আর পাখিদের সঙ্গে কিম্বা ডায়েরিতে কাল্পনিক বন্ধুর সঙ্গে
কথা বলতে হয় না। আসলে কোনটা ভালো তা ঠিক ঠাওর করতে পারে না আত্রেয়ী। না, এত বছরেও
না। বন্ধু না থাকা, কাল্পনিক বন্ধু বানিয়ে নেওয়া, অথবা বাবুইয়ের মতো ইন্টারনেটে
আলাপ হওয়া অজানা মানুষকে বন্ধু ভাবা। ওর সেই ভয় আবার চেপে ধরে, বাবুইকেও সবাই
ঠকিয়ে দেবে না তো? ওর ছোট্ট বাবুইকে?
শীতের দিনে হাঁক আসে, ‘বালাপোশ বানাবে? বালিশ, তোষক বানাবে?’ সেই ছেলেবেলার চেনা
ডাক আর ধুনুরির যন্ত্রের চেনা আওয়াজ। বিয়ের পর পর তখনও কলকাতায় কাবুলিওলা টাইপের
ঝোলা কাঁধে নিয়ে গরম জামা, শাল, চাদর, শাড়ি বেচতে আসত কাশ্মিরী শালওয়ালা। চারপাশে
ছাতার মতো ম্যল আর বিগ বাজারের ঠেলায় তারাও এখন নিরুদ্দেশ। তবে একটু সস্তার গালিচা
বা কার্পেট বেচতে এখনও কেউ কেউ আসে। হাওয়াই চটিওলা আর মোজাওলাদেরও দেখা মেলে
শীতকালে। হঠাৎ একদিন সকালে বাঁদরখেলার মতো ডুগডুগি বাজিয়ে হেঁকে যায়, ‘আছে মাসি, বৌদি ছেঁড়াচুল?’ আত্রেয়ী ভাবে
শীতকালে চুল বেশি ওঠে তাই বুঝি, অন্যসময়ে তো দেখি না। অনেকদিনপর একটা বাঁদরখেলাও
এসেছিল। বাবুইয়ের ছোটবেলাতেও এদের বেশ দেখা পাওয়া যেত। এখন জন্তুজানোয়ার পোষার
আইনকানুন বদল হওয়ায় সার্কাসে যেমন বাঘ-সিংহের খেলা আর নেই, তেমনি বাঁদরওলাদেরও
দেখা যায় না। অনেকক্ষণ ধরে বাঁদর ও বাঁদরী – শাহরুখ আর কাজল
লাফিয়ে নেচে ঘুরে খেলা দেখাল। মেয়ের সঙ্গে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে
ছেলেবেলার মতো খুশি হয়ে উঠছিল আত্রেয়ী। খেলা শেষ হলে মেয়ের হাতে দশ টাকা দিয়ে
আত্রেয়ী বলে, যা দিয়ে আয়। মেয়েও খুশি বাঁদরের হাতে টাকা দেবে বলে।
ফলওয়ালাদের পসরা বদলে যায় ঋতুতে
ঋতুতে - গরমে আম, জাম প্রায় বছরভর কলা আর পেয়ারা, শীতের দিকে কমলালেবু, বড় বড়
নারকেলি কুল, শাঁকালু, সবেদা, আপেল, শীতের শেষে আঙুরের ছড়াছড়ি। গরমে ডাবওলার ডাক
শোনা যায় আর শীতে তা বদলে যায় আখের রসে। হঠাৎ একদিন ভরদুপুরে এক গলির মধ্যে একজনকে ‘বেলফুল’ হাঁকতে শুনে ভারী আশ্চর্য হয়েছিল সে। এখন তো
বাজারে-বাসস্ট্যান্ডে ফুলের দোকান বা মাটিতে প্লাস্টিক বিছিয়ে ফুল বিক্রির চল। সেই
লোকটার সাইকেলে একটা বড় ঝোলা ছাড়া যদিও আর কিচ্ছু নজরে পড়েনি আত্রেয়ীর।
দুপুরবেলায় একেকদিন হেঁকে যায় ‘রসগোল্লা’। সন্ধের পর কোনও কোনওদিন ঝুনঝুনি বাজিয়ে যায়
চানাচুরওলা। গরম চানাচুর আগে মাঝে মাঝে মেয়ের বায়নায় কিনত আত্রেয়ী। ধোসাওলা আবার
টুংটাং বাজিয়ে ‘ধোসা, ইডলি’ বলে সুর করে হাঁক
দিয়ে দিয়ে এমন সময় যায় যে অধিকাংশ দিন তখন বিকেলের টিফিন খাওয়া হয়ে যায়। তবে
দোকানের ধোসা খেতে ঢের ভালো। তাই সময়ে এলেও খুব কমই এর কাছ থেকে ধোসা কেনে
আত্রেয়ী। গরমে অনেকদিন আইস্ক্রিমওলার ডাকও শোনা যায়। তবে বাড়িতে বসে অধিকাংশ ডাকই
শোনে আত্রেয়ী, নিজে তাদের পারতপক্ষে ডাকে না খুব দরকার ছাড়া।
তবু বুড়ো কাগজওলার মতোই আত্রেয়ীর
নিয়মিত আরেকজন পাওনাদার আছে। সে হাঁকে না, দরজায় এসে কড়া নেড়ে ডাকে, ‘বৌদি...’।
আগে একটা বিশেষ কোম্পানীর স্যানিটারি ন্যাপকিন বেচতো। এখনও বেচে, তবে আত্রেয়ী আর
কেনে না। যে জিনিসটা ও ব্যবহারই করতে পারবে না, সেটা কী করে কেনে? সে নাহোক,
প্রতিবারই এই বউটির ঝুলি থেকে কিছু না কিছু বেরোয়, সব সস্তা! একটা শ্যাম্পুর সঙ্গে
একটা শ্যাম্পু ফ্রি, বডিলোশন -বড় কিনলে ছোট্ট একটা ফ্রি, বডি স্প্রে, কাপড় কাচার
সাবান, ফিনাইল কী নিদেনপক্ষে ধূপ। আত্রেয়ী জানে এর কোনোটাও না হলেও তার দিনযাপনে
বিন্দুমাত্র ফারাক হতো না, তবু কিছু না কিছু কেনে, কিনতেই হয়। কারণ সব বৌদির মতো
এই বৌদিও না কিনলে বৌটির যে দিন চলে না। একেকবার মাসের শেষে এলে আত্রেয়ীর ভারী
মুশকিল হয়। একে টাকাপয়সার ব্যাপারটাই এত বয়সেও তার মাথায় ঢোকে না, তবু মাসের
শুরুতে আলমারীতে টাকা থাকে, মাসের শেষে একেকবার মেয়ের জমানো টাকাতেও হাত পড়ে আর
তাকেই বকুনি খেতে হয় মেয়ের কাছে। তাই বলে, এবারটা পারছিনা, তোমায় বলি, মাসের শেষে
এসো না। বউটি মিস্টি নরম গলা ঘন করে বলে, ‘পারবে পারবে’, আর ততো অসহায় লাগে আত্রেয়ীর। শেষে একেবারেই না হলে বলে, ‘তাহলে দু’ তারিখে আসি বৌদি?’ বৌদি
বিপন্ন গলায় বলে, না না, আর দু’চারদিন পরে এসো। এখন
সব রয়েছে আমার, কিচ্ছু লাগবে না। তবু সে আসে, নিয়ম করে, প্রতিমাসে, যেন আত্রেয়ীর
আর জন্মের খাতক। আত্রেয়ী ধার শোধে, শুধেই যায় বছরভর।
কখনও স্টিলের বাসনওয়ালা যায়। ও
কেনেনা। পুরোনো জামাকাপড়ের বদলেও বাসন কেনেনা আত্রেয়ী। স্টিলের বাসন যা আছে তাই
যথেষ্ট, কিনলে দোকান থেকে মাইক্রোওয়েভ প্রুফ বাসন কেনাই ভালো। ভাঙা চশমার বদলে
বাসন! এই ডাকটা শুনেও খুব আশ্চর্য হয়েছিল সে। বারান্দায় বেরিয়ে দেখে বয়স্ক এক
মহিলার পিঠে কালো একটা ব্যাগ আর দুহাতে দুটো বালতি ভর্তি স্টিলের বাসন। কালো
ব্যাগে সত্যি সত্যিই পুরোনো চশমা আছে কিনা সেটা অবশ্য বুঝে উঠতে পারেনি বেশ খানিক
অপেক্ষা করেও।
পুরোনো জামাকাপড় কিনবে বলে যেই
যাকনা কেন, তাকে বেচতে গেলে শেষপর্যন্ত অর্ধেক পুরোনো জিনিস রয়েই যায়। বাবুইয়ের
পুরোনো জামা - নেবে না। আত্রেয়ীর পুরোনো ম্যাক্সি, সালোয়ার কামিজ - তাও না। আলোকের
ছেঁড়া জিনস - চলবে না। ‘মা, তোমার কাপড় নেই, ধুতি? দাদার ভালো জামাপ্যান্ট
কিছু নেই?’ শেষপর্যন্ত আত্রেয়ীর অল্প পড়া কিছু শাড়ি বার করে দিতে হয়।
শাড়ি ও প্রায় পড়েই না। যেকটা আছে তার সবই হয় সখে কেনা, নাহয় স্মৃতির গন্ধ মাখানো।
না পড়লেও যেগুলো দেওয়া যায় না। আলমারীর কোথাও বুকের ভাঁজে রেখে দিতে হয়। এমন কী
ছেলেবেলায় যে শাড়িটা পড়ে ক্লাস ওয়ানে লালপরী সেজেছিল, সেটাও আছে রাখা, ভাঁজে
ন্যাপথলিনে। বাবা যেটা ছোটবেলায় কিনে দিয়েছিল, ওইটা তো মায়ের শাড়ি, ও কি আর দেওয়া
যায়? দুজনে মিলে কেনা বিয়ের সময়ের তিন-চারটে শাড়ি। তখন আর কতই মাইনে পেত আলোক।
তাঁতের সাধারণ শাড়ি। তা হোক, শাড়িগুলো থাক। বিয়ের বালুচরী শাড়িটা, চাদর। এইসবেই তো
ওর আলমারী ভরে থাকে। তাছাড়া শাড়ি ও খুব একটা নিজে কেনেও না, ফলে প্রায় সব শাড়িতেই
আলোকের পছন্দ লেগে থাকে। আত্রেয়ী বলে, ওর আলমারীর নাম ‘কিছু
ফেলতে পারি না’।
শেষপর্যন্ত দু-একটা ধুত্তোর বলে
বার করে দিতেই হয়। এই তো দুদিন আগে ও বেশ অবাক হয়েই পুরোনো জামাকাপড় হাঁকা লোকটাকে
জিজ্ঞাসাই করে ফেলল, আচ্ছা, আজকের দিনে ধুতি কে পড়ে বলতো? আমরাও কি আর শাড়ি পরি,
সে ওই অবরেসবরে। আর শাড়ি থাকলে আগে তো মাসিকেই দেব, বলে পুরোনো জামাকাপড়ের
কুরুক্ষেত্রের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ওর সারাক্ষণের সঙ্গী যে মহিলা কাজ করতে এসে
বহুকাল প্রায় বাড়ির একজন হয়ে উঠেছে সেই লক্ষ্মীদিকে দেখায়। অতসত বোঝে না কাপড়ওলা।
সে একবার আত্রেয়ীর গেঞ্জি-প্যান্ট পরা চেহারার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে ‘ঠিক, ঠিক’ বলে, তারপর সেই মাসির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘মায়ের শাড়ি নেই’? আত্রেয়ী ভাবে, এতো আচ্ছা জ্বালা, ফের প্রশ্ন করে,
প্যান্টগুলো নেবে না কেন? কাপড়ওলার অম্লানবদনে উত্তর, ‘ও তো
ছেঁড়া’। আত্রেয়ী এবার বিরক্ত হয়, নতুন জামাকাপড় তোমায় দেব নাকি?
তবে পুরোনো জামাকাপড় বল কেন? কাপড়ওলা এবার কিঞ্চিৎ বিব্রত স্বরে বলে, ‘আমি কি নতুন জামাকাপড় চাচ্ছি? ছেঁড়া-ফাটা হলে মালিক নেবে না। শাড়ি কাপড় না হলে
মালিক নেবে না, আমি কী করব?’ অতএব আত্রেয়ীকে সেই
নিজের শাড়ি, মৃত শাশুড়ির শাড়ি বের করে দিতে হয়, এবং কাপড়ওলা খুশি মনে চলে গেলে
বারান্দায় গিয়ে দেখে বাতিল জামাকাপড়ের অর্ধেকেরও বেশি এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। বেচারা
আত্রেয়ী তখন বিপন্ন গলায় হাঁক পারে, ও লক্ষ্মীদি, আমার যে কিছুই হল না।
ছেলেবেলায় মায়ের মুখে শোনা টলস্টয়ের
একটা গল্প খুব প্রিয় আত্রেয়ীর। গল্পের প্রথম বাক্য, মার্টিন নামে এক মুচি ছিল। গল্পটা
হল, মার্টিন ঈশ্বরে বিশ্বাস করত আর ঈশ্বর কেন দেখা দেয়না তাকে, এই নিয়ে ভারী মনখারাপ
করে থাকত। শেষে একদিন সে শুনতে পেল, ঈশ্বর তাকে বলছে, আমি আগামীকাল তোমার কাছে
আসব। পরেরদিন প্রবল বরফবৃষ্টির মধ্যে ঝাড়ুদার স্তেপানিচ, বাচ্চা কোলে একটি বউকে আর
এক বৃদ্ধাকে আশ্রয়, খাবার আর নিজের গরম চাদর দিয়েছিল মার্টিন। তবু ঈশ্বর আসেনি।
সেদিন রাতে যিশুর কাছে আবার কাঁদলে, বাইবেলের একটা পাতা খুলে যায়, তাতে লেখা, আমি
ক্ষুধার্ত ছিলাম, তুমি আমাকে অন্ন দিয়েছিলে, আমি শীতার্ত ছিলাম, তুমি আমাকে বস্ত্র
দিয়েছিলে, আমি তোমার আশ্রয়প্রার্থী ছিলাম, তুমি আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলে। আমি তো
তোমার ঘরে গিয়েছিলাম, তুমিই আমায় চিনতে পারনি। এই গল্পটা মাঝেমাঝেই ছেলেবেলায় সে বায়না
করে শুনতো। ছোট থেকেই ভারী অসুস্থ সে। অসুখের দিনগুলোতে এই গল্পটা ওর মনে শক্তি
জোগাতো। গল্পটা শুনলেই অপূর্ব একটা অনুভূতিতে মন ভরে উঠত ওর। এখনও গল্পের শেষের সেই
অনুভূতি ফিরে ফিরে আসে ওর মনে। এখনও অসুখ করলে মায়ের গলা ভেসে আসে কানে – ‘মার্টিন নামে এক মুচি ছিল’।
আত্রেয়ী ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না।
মানুষে ওর অগাধ বিশ্বাস। এই বিশ্বাসটা খানিক উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া, ঈশ্বরে না-বিশ্বাসটা
একান্তই নিজের। আত্রেয়ীর মাও খুব মানুষকে বিশ্বাস করেন। আলোক ওকে একবার বলেছিল,
আমি বোকার মতো মানুষকে বিশ্বাস করি না, সে আমাকে ঠকাবে জেনেই বিশ্বাস করি।
বিশ্বাসের এই গাছটা তাই সারাজীবন ডালপালা মেলেছে আত্রেয়ীর ভেতরে। বিশ্বাস নিজেকে ভাঙতে
ভাঙতে আর গড়তে গড়তে তার গভীরে বিছিয়ে দিয়েছে শিকড়বাকড়। মানুষকে তাই বিশ্বাস করে ও।
আর সেই বিশ্বাস সত্যি করতে খুব প্রয়োজনের সময় ওকে নিখরচায় গাড়িতে লিফট দেয় কোনও
অপরিচিত। ট্যাক্সির আকালের কলকাতাতেও ফাঁকা পথে রাত গভীরে হাঁটতে হাঁটতে পেয়ে যায়
ট্যাক্সিসমেত কোনও সহৃদয় চালকের দেখা। জীবনের খুব কঠিন দিনে কোথা দিয়ে না কোথা
দিয়ে এসে বন্ধুরা বলে, আছি তো, লড়ে যা তুই। এদেরকেই আত্রেয়ী বলে, মানুষ অথবা ওর
ঈশ্বরই। আত্রেয়ীর বাইপোলার সিনড্রোম যখন খুব বেড়ে যায়, লক্ষ্মীদি এসে হাতের কাজ
কেড়ে নিয়ে বলে, কাজ করতে পারছ না তো একা একা দাঁড়িয়ে কাঁদছ কেন বৌদি? কাঁদলে না
তোমার শরীর খারাপ বেড়ে যায়, একদম কাঁদবে না। আর বাবুইকে একদম বকবে না। অত
চেঁচামেচি করলে তোমারই শরীর খারাপ হয়। ঘুমের মধ্যে টের পায় বাবুই এসে ওর মাথায় হাত
বুলিয়ে দিচ্ছে। তখন আর ভয় করে না ওর।
ল্যাপটপটা নিয়ে লিখতে বসেছিল
আত্রেয়ী। এটাই ওর নেশা, এটাই ওর আশ্রয়। হঠাৎ একটা চিৎকার, একটা ডাক কানে এল ওর।
মাত্র কয়েকবছর হল উত্তর কলকাতার পুরোনো বাড়ি ছেড়ে এই ফ্ল্যাটে এসেছে ওরা। তখন
পাড়াটা চেহারা আর স্বভাবে একেবারে অন্যরকম ছিল। কয়েকটা পাকাবাড়ি আর খানকতক টালির
চালের বাড়ির মাঝে ওদেরটাই এক চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি। যার দোতলাটা কিনে নিয়ে এসেছিল
ওরা। তখন আলোকের বন্ধুবান্ধব কেউ কেউ বলেছিল, ‘একদম
টালির চালের বাড়ির গায়ে ফ্ল্যাট কিনলি!’ আলোক বলেছিল, ‘কী আর করা যাবে, কমদামে বড় ফ্ল্যাট হল’। তাছাড়া এপাড়ায়
থাকাটার মধ্যে কেমন একটা মধ্যবিত্ততার গন্ধ মাখা, সেটাও আসলে ছাপোষা আলোক-আত্রেয়ীর
ভালোলেগেছিল। অথচ এই ক’বছরেই একের পর এক টালির চালের বাড়ি ভেঙে পাকা বাড়ি
উঠেছে, পাকা বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাটবাড়ি। আর পাড়া পাড়া ভাবটা কমে গিয়ে বেড়েছে
খিস্তি-খেউড় প্রকাশ্য পথে। প্রথমে তাই মন দেয়নি আত্রেয়ী। তারপরে লেখা থামিয়ে
বারান্দার দরজা খুলে উঁকি মারে। মাঝবয়সী দুটো বউ, হাতে অল্প কয়েকটা জামাকাপড়, ‘আমাদের কিছু জামাকাপড় দাও গো..., ও মা, বৌদিরা, আমাদের ঘর ভেসে গেছে...’ - দু’হাত
মাথার ওপরে তুলে অনেকটা গৌরাঙ্গ ভঙ্গীতে চাইছে। এর আগে কখনও এমন অভিজ্ঞতা হয়নি
আত্রেয়ীর। সুন্দরবনের আয়লা-র সময় ওর পরিচিত-অপরিচিত অনেকে এসে গাঁঠরি বেঁধে পুরোনো
কাপড়জামা নিয়ে গেছে বন্যাবিধ্বস্তদের জন্য। কিন্তু ঘর-গেরস্থালী ভেসে যাওয়া কাউকে
কখনও বিলাপ করে জামা ভিক্ষা করতে দেখেনি ও। সাধারণতঃ বাবা-মায়ের ক্যান্সার, কারখানা
বন্ধ - এমন একাধিক লোক বা একা কেউ কেউ আসে বটে। এছাড়া, বাবা লোকনাথ ধরণের কেউ
কেউও। কিন্তু জামাকাপড় তো কেউ ভিক্ষা করে না!
লক্ষ্মীদি বাড়ি নেই, একা
দুপুরবেলায়, একটু দোনামোনা করে আত্রেয়ী। ওর একটু ভয় করে। ওরা দু’জন আর ও একা। যেমন, ভয় লেগেছিল পার্কসার্কাস মোড়ে এক অচেনা ভদ্রলোক হাত
দেখাতেই ওকে একা লিফট দিয়েছিলেন, সেইসময়। খানিকটা সেই ভয় নিয়েই ও একজনকে ডাক দেয়।
পুরোনো জামাকাপড়ের পোঁটলাগুলো বারান্দা থেকে দরজার কাছে এনে সেই ভয়ে ভয়েই দরজাটা
সামান্য ফাঁক করে। বউটি ওকে দেখে হাঁউমাউ করে ওঠে, ‘ওমা,
কিছু কাপড়জামা দাও মা, বাচ্চার কাপড়, শাড়ি’। একজন দেখে সাহস
বাড়ে আত্রেয়ীর, গায়ের জোর না থাক, মনে তার ঢের জোর। শাড়ি শুনে আবার আতঙ্কিতও হয়,
তবে এ অন্য আতঙ্ক। জিজ্ঞাসা করে, তোমার বাড়ি কোথায়? বউটি বলে, ‘সুন্দরবন, ঘর ভেসে গেছে মা’। জামাকাপড়ের পোঁটলা
খুলে আত্রেয়ী বলে, নিয়ে যাও। নিজের পরার শাড়িই এনে দেয়, পুরোনো সোয়েটার, গরম শাল।
বৌটি সব গুছিয়ে নিতে নিতে সেই দু’হাত তুলেই আশীর্বাদ
করে তাকে – ‘ছেলেমেয়ে ক’টা মা? একটা? ভালো
থেকো মা, ভালো থেকো, স্বামী-সন্তান নিয়ে’। এই বউটি নামে সিঁড়ি
বেয়ে, একই সিঁড়ি বেয়ে অন্য বউটি ওঠে, ‘ওমা আমায় কিছু দিলে
না মা’। মায়ের তখন আবার সেই বিপন্ন অবস্থা। আত্রেয়ী মনখারাপের
গলায় বলে, এক্ষুনি তো কিছু নেই গো, ওটাই ভাগ করে নাও না দুজনে। প্রথম বউটি চোখের
ইশারায় আর জোরে মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘না, না’। আত্রেয়ী বিপন্ন গলায় বলে, আর কিছু এক্ষুনি নেই তো, তুমি কয়েকমাস পরে এসো।
দ্বিতীয় বউটি বলে, ‘তুমি ওকে দিলে মা, আমাকে কিছু দিলে না, আমাকে কিছু
দাও’। আত্রেয়ী হাহাকারের সুরে না, না করে দরজা বন্ধ করে দেয়
ওদের মুখে।
আত্রেয়ী নিজের টেবিলে ফিরে আসে।
আত্রেয়ী একা বসে থাকে ল্যাপটপ কোলে করে। ফেসবুকে স্ট্যাটাস লেখে, আসলে আমরা কেউ
কারোর জন্য কোনদিন কিচ্ছু করতে পারি না। আয়নায় মুখ দেখলে দেখি, হয় এক স্বার্থপর,
নাহয় এক ভিখারি।
মোবাইলের নোটে নিজের কাছেই ডায়েরি,
কবিতা লেখে আত্রেয়ী রোজ। টুকরো টুকরো ভাবনা, টুকরো টুকরো লেখা। মোবাইলে নোট লিখতে
থাকে আত্রেয়ী, সত্যি, আমার কি দেওয়ার মতো কিছুই ছিল না? আমার কি কোনও জামাকাপড়ই
ছিল না? তাহলে দিতে পারলাম না কেন? কেন?
পরেরদিন ঠিক দুপুরে আবার সেই ডাক
কানে আসে ওর। ‘ও মা, ও বৌদি, কিছু জামাকাপড় দাও না, ঘর ভেসে গেছে’। আত্রেয়ী উঠে আর দেখতে যায় না, প্রথম, দ্বিতীয় নাকি তৃতীয় অন্য কেউ।
আত্রেয়ীর ভয় করে।
- কান্তরেণু, ২০১৭
ফাঁসি
শনিবার দুপুরটা তিন্নি আর তাতাইয়ের একা একাই কাটে। ওদের স্কুল ছুটি থাকলেও বাবা-মায়ের অফিস ছুটি থাকে না। ওরা দুজন আর পলিমাসি। পলিমাসি ওদের বাড়িতে কাজ করে। দিনরাত থাকে। দুপুরের সব টিভি সিরিয়াল পলিমাসির মুখস্থ। অন্যদিন বাড়ির চারজনই স্কুল আর অফিসে বেরিয়ে গেলে হাতের কাজ সেরে সে টিভির সামনে বসে পড়ে। শনিবারদিনটায় ওদের দুজনকে নিয়েই হিমসিম খেয়ে যায় সে। এগারোটা থেকেই স্নানের তাড়া দিতে শুরু করলে হয়তো দেড়টায় গিয়ে শেষ হয়। তিন্নিকে কোনওমতে হাতের কাছে পাওয়া গেলেও তাতাই তিনটে সিঁড়ি লাফিয়ে উঠে বাউন্ডারির বাইরে চলে যায়। অনেক দৌড়াদৌড়ি করে দুটো-আড়াইটে নাগাদ ভাই-বোনের খাওয়ার পাট চুকলে পলিমাসি তার কানাউঁচু থালায় ভাত-তরকারি নিয়ে টিভির সামনে বসে পড়ে। চেনা সিরিয়াল অথবা কোন কোনও শনিবারে বাংলা বা হিন্দি সিনেমাও। দেখতে দেখতে হাতের এঁটো শুকিয়ে খড়খড়ে হয়ে আসে। দোতলায় তিন্নি-তাতাইয়ের হট্টগোলও আর কানে আসে না। মাঝে মাঝেই শনিবার দুপুরে পাশের বাড়ির ছ’বছরের শুভও জুটে যায় ওদের সঙ্গে। যেদিন যেদিন তার ছুটি থাকে। সেদিন বাড়িতে কাক-চিল বসতেও ভয় পায়।
তিন্নির পৃথিবী
তিন্নির আজ খুব মন খারাপ, অপর্ণা মাসি আর আসবে না তাদের বাড়িতে। তিন্নির
বাবা-মা দু’জনেই রোজ অফিস চলে যান। তিন্নি সকালে স্কুল করে এসে সারাদিন
অপর্ণা মাসির কাছেই থাকে, স্নান করে, খায়, ঘুমায়, খেলে। মা-বাবা ছাড়া এক অপর্ণা মাসিকেই
তার খুব আপনজন বলে মনে হয়। অপর্ণা মাসি তাকে কত গল্প বলে, রাক্ষস-খোক্কস আর
রাজপুত্র-রাজকন্যার গল্প, বাঘের গল্প, শেয়ালের গল্প, এমনকী সত্যিকারের কুমীরের
গল্পও। তিন্নি মাঝে মাঝে মাসির কথা বুঝতে পারে না, কেমন জানি অন্যরকম টানে কথা
বলে। বাবা বলে ওর দেশ নাকি উড়িষ্যায়, তাই ওড়িয়া ভাষা চলে আসে ওর কথায়।
বাবাকে জিজ্ঞেস করে তিন্নি ম্যাপে উড়িষ্যা রাজ্য খুঁজে বার করেছে। অবশ্য ও
একবার গেছে উড়িষ্যায়, আরও ছোটবেলায়, পুরীতে। বেশ মনে আছে, কত বড় বড় সমুদ্রের ঢেউ,
উপস্... একটুও ভয় পায়নি ও। বাবার হাত ধরে জলে ভিজেছে আর সমুদ্রকে বালির নাড়ু
বানিয়ে দিয়েছে। সমুদ্র ওর ভারী ভালোলাগে, জল থেকে উঠতেই ইচ্ছা করে না। আর ভালোলাগে
রঙীন রঙীন ম্যাপে পৃথিবীর সব দেশগুলো চিনে নিতে।
স্কুলের বাংলা বইতে ও পড়েছে প-এ ঋকার থ-এ হ্রস্বই ব-এ দীর্ঘ-ঈ। এই পৃথিবীর
মধ্যেই নাকি আমরা সবাই থাকি। আরেকটু বড় হলে বাবা ওকে গ্লোব কিনে দেবে। পৃথিবীটাও
নাকি ওই গ্লোবের মতই দেখতে। তিন্নি সব জানে – পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে,
আরও আরও অন্য গ্রহরাও সূর্যের চারদিকে ঘোরে। মোট ন’টা গ্রহ, সব্বার নাম জানে ও।
আমাদের চাঁদের মতো অন্য অনেক গ্রহেরই চাঁদ আছে, তারাও চাঁদের মতো সেই গ্রহগুলোর
চারদিকে ঘোরে। বাবা ওকে রাতের আকাশে মঙ্গল আর শুক্রগ্রহ চিনিয়ে দিয়েছে। কেমন
সুন্দর লাগে রাতের আকাশের গায়ে ওইসব ঝকঝকে গ্রহ-তারাদের দেখতে। খুশিতে ও হাততালি
দিয়ে বলে ওঠে, ‘ঝিকিমিকি ঝিকিমিকি ছোট্ট তারা, আমি শুধু ভেবে যাই তোমরা
কারা!’
অপর্ণা মাসি তিন্নিকে তার দেশের গল্প বলে, সে দেশ বাংলাদেশ নয়। ছোটবেলায়
বাবা-মার হাত ধরে সে চলে এসেছিল উড়িষ্যায়। তার বাবা কাজের খোঁজে এসে সেখানেই রয়ে
যায়। আর তাই সমুদ্রের জল-হাওয়ায় বড় হওয়া অপর্ণা মাসির স্মৃতি মন্থনে যেন সাগরের
লোনা জলের গন্ধ ভেসে আসে, লোনাজল চিকচিক করে মাসির চোখের কোনায়।
তিন্নি মাসির সব গল্পের সবটুকু বুঝতে পারে না, ও শুধু বোঝে মাসিরা খুব গরীব। ‘পৃথিবী’-র মতোই ‘গরীব’ শব্দটাও ওর পড়ার বইতে আছে।
তাই তার মানে ও জানে। মাঝে মাঝে স্কুলের আন্টি বললে বাবার কাছ থেকে দু’ টাকা কী পাঁচ টাকা পকেটে
করে নিয়ে যায় গরীবদের জন্য। পাঁচশ টাকা মানে কত টাকা ও বোঝে না, মাসিকে তার বাবা
নাকি পাঁচশ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছিল একজন অসুস্থ, পঙ্গু লোকের কাছ, সেই নাকি
অপর্ণামাসির বর। মাসি সেই বরকে, মেয়ে-জামাইকে টাকা দেওয়ার জন্য চাকরি করে তাদের
কাছে। অনেকদিন শুনতে শুনতে এই সবকিছুই ও বুঝতে পারে। কিন্তু এই সব উপলব্ধি করার
বয়সে সে এখনো পৌঁছায়নি, আর তাই মাসির গলা জড়িয়ে ও শুধু বলে, একটা গ... ল্প বল’না মাসি। অপর্ণা ফিরে যায়
তার ছেলেবেলায়।
তিন্নির কল্পনায় ভেসে ওঠে গল্পের বইতে আঁকা গ্রামের বাড়ি, পাশে চওড়া খাল যেটা
নাকি সমুদ্রে গিয়ে পড়েছে। অপর্ণামাসি চোখ ঘুরিয়ে, হাত নেড়ে গল্প বলে চলে, ওঃ, কত
বড় বড় সব কুমীর, সমুদ্রের ধারে বালিতে শুয়ে থাকে। তাদের এই এত বড় বড় দাঁত। তিন্নি
চিড়িয়াখানায় কুমীর দেখেছে, তাই তার মিলিয়ে নিতে কোন অসুবিধাই হয় না। সেই সব
কুমীরেরা নাকি ছাগল, বাছুর টেনে নিয়ে যায় পাড় থেকে, এমনকী অসতর্ক মানুষজনও। খালের
একটা পাশে জলের মধ্যে বেড়া দিয়ে খানিকটা অংশ আলাদা করা আছে, নিরাপদে স্নান করার
জন্য। তবে কখনো কখনো কুমির সেই বেড়া ভেঙ্গেও মানুষ টেনে নিয়ে যায়। অপর্ণা মাসি
এমনই সব গল্প বলে আর তিন্নি হাঁ করে শোনে। এমনকী ছুটির দিনে কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাও
কান পাতে সেই গল্পে। মাসি বলে, জানো বৌদি, একবার একটা নতুন বৌকে কুমীরে ধরেছিল। বৌটার
কী বুদ্ধি, হাতে কাজললতা ছিল, দিয়েছে বসিয়ে কুমিরের চোখে। কুমীরতো ব্যথার চোটে জলে
ঝাপটাচ্ছে আর ঝাপটাচ্ছে। যেই না একটু আলগা লেগেছে বৌটা সাঁতরে ডাঙায় পালিয়ে আসে।
তিন্নির অবশ্য সবচেয়ে ভালোলেগেছে অন্য একটা গল্প। একবার নাকি একটা কম বয়সী
মেয়েকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল কুমীরে, কিন্তু খায়নি তাকে, কে জানে বোধ হয় পেট ভরা ছিল।
জ্ঞান হতে মেয়েটা দেখে জলের তলায় একটা গুহার মধ্যে সে রয়েছে। আশপাশে খালি হাড়গোড়
আর দামী গয়নাগাটি, টাকাকড়ি পরে আছে, কুমিরটা কোথাও নেই। মেয়েটা চট্ করে আঁচলের
মধ্যে যতটা যা পারে টাকাপয়সা, গয়নাগাটি বেঁধে সাঁতরে উঠে আসে। আর তারপরে ঠিক
রূপকথার গল্পের মত মস্ত বড়লোক হয়ে যায়। মা বলে, কীসব আবোল-তাবোল গল্প কর অপর্ণা,
অন্যকিছু বলতে পার না? অপর্ণা মাসির তখনো গল্পের ঘোর কাটে না, সে জোর দিয়ে বলে
ওঠে, না বৌদি, বিশ্বাস করো, সব সত্যি, আমি নিজের চোখে মেয়েটাকে দেখেছি, উঃ বাবা,
কত বড় দোতলা বাড়ি...। তিন্নিও বারবার শুনতে চায় এই গল্পটা, অপর্ণা মাসিও বলে
যায়... আর সেই গল্পের ঘরে অপর্ণা মাসিই কখন যেন সেই মেয়ে হয়ে ওঠে। তিন্নিকে
ফিসফিস্ করে বলে, আমিও একবার ডুব দেবরে মানু, যদি সেই কুমীরের গুহায় পৌঁছাতে পারি।
তাহলে আমাকে আর লোকের বাড়িতে কাজ করে খেতে হবে না। নাতি-নাতনিগুলো রোজ দু’বেলা ভাত খাবে, নতুন
জামা-জুতো পরবে, শীতে গরম জামা, লেপ-কম্বল গায়ে দেবে...।
তিন্নি ভারতবর্ষের ম্যাপে সমুদ্রের ওপর হাত বোলায়, খুঁজতে চায় অপর্ণা মাসির
গল্পের সেই গ্রাম... তার বড় বড় চোখ জলে টলটল করে। অপর্ণা মাসি নিশ্চয় ডুব দেবে
সমুদ্রে। তিন্নি কল্পনায় দেখতে পায়, মাসি সমুদ্র থেকে উঠে আসছে সারা গায়ে গয়না,
সুন্দর শাড়ি – ঠিক যেন রানীর মতো। তারপর সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে দু’হাত দিয়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে কত
টাকাপয়সা, গয়নাগাটি, আর দলে দলে গরীব লোক এসে কুড়িয়ে নিচ্ছে সেসব, তাও ফুরাচ্ছে না
সেই অনন্ত ভাণ্ডার। তিন্নি চোখ মুছে মাকে বলে, কেন তুমি মাসিকে টাকা দিলে না মা?
তাহলে তো বাবার পকেট থেকে টাকা নিত না। আমিওতো একদিন খেলব বলে টাকা নিয়েছিলাম
বাবার পকেট থেকে, কই তখনতো কিছু বলনি আমায়। তিন্নির মা বকে ওঠেন, সবকিছুতেই তোমার
এত পাকা পাকা কথা কেন বাবু, যাও খেলগে যাও। ঘরবাড়ি সব ফেলে রেখে যাই যার হাতে, সে
যদি চুরি করতে শুরু করে তাহলে তাকে আর রাখা যায় না, গজগজ করেন তিন্নির মা। তিন্নির
ভালোলাগে না মার কথা, ও মনখারাপ করে অন্য ঘরে চলে যায়। ওর চোখের জল আর মনখারাপে
মিশে থাকে সমুদ্রের গন্ধ।
কলিংবেলটা বেজে ওঠে। বোধহয় নতুন মাসি এল। মা দরজা খুলতে এগিয়ে যান। তিন্নিও
অন্য কোন অপর্ণামাসিকে দেখতে দরজার দিকে দৌড় দেয়।
ছোটদের গল্প
১
চওড়া ট্রামরাস্তাটা যেখানে হেদুয়ার পাশ দিয়ে গেছে সেখানেই
আমরা থাকি। আমরা মানে আমি, মা আর আমার ছোট দুটো ভাই-বোন। আমার নাম বিশু। আমার বয়স
কত তা জানিনা, তবে আমি ইস্কুলে পড়িনা। ‘যারা
রাস্তায় থাকে তাদের জন্য ইস্কুল নয়’ – মা বলেছে। হ্যাঁ, আমরা রাস্তাতেই
থাকি, ফুটপাতে, আকাশের নীচে। আমার মতো বয়সের অন্য ছেলেমেয়েরা যারা ওই উঁচু উঁচু বাড়িগুলোয়
থাকে তারা কেমন বাবা-মার সঙ্গে, নয়তো গাড়িতে চড়ে ইস্কুলে যায়। আমার মন কেমন করে।
আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই আর বলি, ‘বাবু
একটা টাকা দেবে, ও দিদি দাওনাগো’, কেউ কেউ
দশ, বিশ পয়সা দেয়। অনেকেই চলে যায় পাশ কাটিয়ে, কেউবা কুকুর তাড়ানোর মতো যা যা করে।
তাও আমি চেয়ে যাই, আমার যে খিদে পায় খুউব, তাই। রাস্তার দুধারে কী সুন্দর সুন্দর
দোকান, আলো ঝলমল করে। কত সুন্দর সাজগোজ করে সবাই ঘুরে বেড়ায়। রাস্তার ধারে গরম
চাউমিন, রোলের বাস ছড়ায়। আমার খিদে পায়, খুব খিদে পায়। আমি এক টাকার মুড়ি কিনি।
মুখে দিতে না দিতেই শেষ হয়ে যায়। পেট চোঁ চোঁ করে। রাস্তার কল থেকে জল খাই অনেকটা।
তারপর আবার হাঁটি, ‘একটা টাকা দেবে
গো’...
আমি রাস্তার পাশে দোকানের টিভিতে সিনেমা দেখি। খুব ভালোলাগে
তখন, খিদের কথা আর মনে থাকেনা। আমার শাহরুখ আর আমির খানের মতো জামা-প্যান্ট পরতে
ইচ্ছা করে। উঃ, কেমন সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়ি, লোকজন, জামাকাপড় – মনে হয় যেন স্বপ্ন দেখছি। আমারও ওরকম ভালো
ভালো জামাকাপড় পরে স্বপ্নের বাড়িতে থাকতে ইচ্ছা করে। সিনেমার ভিখিরিদের জামাকাপড়ও
আমার থেকে ঢের ভালো। আমার রাস্তায় থাকতে ভালোলাগেনা, ছেঁড়া জামা পরতেও না, না, না।
দোকানেতো কত সুন্দর সুন্দর জামা-প্যান্ট ঝোলে। আমার দুটো মোটে জামা, তাও একদম
ছিঁড়ে গেছে, প্যান্টেরও সেই অবস্থা। দোকান থেকে আমার জামা পেড়ে নিতে ইচ্ছা করে।
দোকানেতো কত আছে, কী হবে আমি একটা নিলে? কিন্তু ভয় করে, খুব ভয় করে, সবাই যদি মারে
আমায়, যদি চোর বলে? আমার জামা ঝোলে, ভাইয়ের জামা ঝোলে, বোনের জামা ঝোলে, মায়ের
কাপড় ঝোলে, কিন্তু কেউ দেয়না। রাঙা শাড়িতে আমার মাকে কী ভালোলাগে। মা যখন পরে,
ছেঁড়া কাপড়েও একেবারে দুগগা ঠাকুরের মতো লাগে। আমার যদি কোনদিন যদি অনেক টাকা হয়
তাহলে মাকে ওরকম একটা রাঙা শাড়ি আর দুগগা ঠাকুরের গায়ে যেমন থাকে অমনি চকচকে গয়না
কিনে দেব। আমার মার একটাও গয়না নেই। দোকানের কাচের আলমারিতে কেমন চকচকে সব গয়না
সাজানো থাকে, আমি দেখেছি, কেউ পরেনা। কিন্তু আমার যদি অত টাকা থাকত তাহলেতো আগে
পেট ভরে খেতাম, আমি, মা, ভাই। বোনের জন্য দুধের প্যাকেট আর নতুন বোতল কিনে দিতাম।
আমার যে সারাদিন শুধু খিদে পায়, রাতে একেকদিন খিদেতে ঘুমই আসেনা, মাথা ঝিমঝিম করে
ওঠে।
রাস্তার ওপারে একটু দূরে একটা বড় রোল-চাউমিনের দোকান আছে।
ভাইটা সারাদিন সেখানেই পড়ে থাকে। কেউ খেয়ে তার এঁটো প্লেট নামালে ভাই আর আরেকটা
ছেলে কাড়াকাড়ি করে খায়, কয়েকটা নেড়ী কুকুরও জুটে যায় ওদের সঙ্গে। বোনটা মায়ের দুধ
খায় তাই ওর বেশ সুবিধা। তবে মা বলে মায়ের নাকি দুধ হয়না। বোনটাও সারাদিন কেবল
ঘ্যানঘ্যান করে কাঁদে। দিনেরবেলায় মাও ভিক্ষা করে, তবে আমার মত ঘুরে ঘুরে নয়।
ফুটপাতের ওপর বোনকে কোলে নিয়ে বসে একঘেঁয়ে সুরে বলে যায়, ‘কিছু দাওনাগো, সারাদিন বাচ্চাটা কিছু খায়নি,
একটু দুধ কিনবো’। কেউ কেউ খুচরো
পয়সা দেয় অবশ্য তবে তা দিয়ে ওর দুধ কেনা হয়না। মা ডাস্টবিন থেকে ওর জন্য একটা
দুধের বোতল কুড়িয়ে এনেছে। বোতলটার ঢাকাটা ফাটা। মা ওর জন্য চায়ের দোকান থেকে একটু
দুধ, চিনি চেয়ে নিয়ে আসে। মার দুধে ওর পেট না ভরলে খুব চ্যাঁচায় খিদেতে। মা ওই
ফাটা বোতলটায় চায়ের দোকানের গুঁড়ো দুধ গুলে ওর মুখে দেয়। দুধ না থাকলে চিনিটাই জলে
গুলে বোতলে ভরে দেয়। ও কেমন সেটাই চুষতে চুষতে ঘুমিয়ে পরে। সন্ধ্যেবেলায় থান ইঁটে
ঘেরা ছোট উনুনে মা আমাদের জন্য ভাত রান্না করে। কাঠকুটো দিয়ে আগুন জ্বালায়। গরম
ভাতের গন্ধে পেটে খিদে চনচন করে ওঠে। সারাদিনে এই একবারই ভালোমতো খাওয়া। আমাদের
খাওয়া হলে ভাতের ফ্যানটা ঠাণ্ডা করে বোতলে ভরে মা বোনকে খাওয়ায়। বোনও চকচক করে
সবটা খেয়ে নিয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠে। ছোট কালো হাঁড়িটার তলায় হাত ঢুকিয়ে খেতে খেতে
মা প্রায়দিনই দুঃখ করে যে একটা বাড়িতে যদি কাজে নিত। ‘বাবুরা বিশ্বাস করেনা, ভাবে আমরা চোর। একটা
বাড়িতে যদি কাজ পাই তোদের দুবেলা ভাত দিতে পারি’...
২
মা তাও একটা কাজ করে, বিশু এখন বোঝে। প্রথম প্রথম ওর খুব ভয়
করত। তখন আরেকটু ছোটও ছিল অবশ্য। একদিন অনেক রাত্রে কীরকম সব আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে
যেতে ওর মনে হল কে যেন মাকে মারছে। ও চিৎকার করে উঠতেই মা হাত দিয়ে ওর মুখ চেপে
ধরে বলল, ‘ চুপ, চোখ বুজে ঘুমা’। ওকেও তাই ঘুম ভেঙ্গে গেলে বা
ঘুম না এলেও প্রায় দিনই চোখ বুজে ঘুমিয়ে থাকতে হয়। একটু বড় হওয়ার পর থেকে ও আবছা
আবছা বুঝতে পারে যে ঘটনাটা মারামারি নয়, অন্যকিছু, খানিক ওর নিজস্ব ধারণায় আর
খানিক ওর মতো অন্য অন্য বিশুদের কাছ থেকে। ...মা কি টাকা পায়? সেই টাকায় কি ভাত
খাই? কে জানে! ফুটপাতের ছেলেদের ওসব ভাবতে নেই, এই সত্য ও বুঝে গেছে।
বিশুর ভিক্ষা করতে ভালোলাগেনা। ও কাজ করতে চায়। কাজ করলে
টাকা পাবে। সেই টাকায় ও খাবার কিনবে, কাপড় কিনবে সবার জন্য। ফুটপাতে আর থাকবেনা।
মাথার ওপর আকাশ নয়, ছাদের স্বপ্ন দেখে ও। শীতে বড্ড কষ্ট হয় ওর। ছেঁড়া-পাতলা দুটো
চাদর আর একটা দুর্গন্ধ কম্বলে কারোরই শীত মানেনা। দুই ভাই জড়াজড়ি করে শোয় যদি
শরীরের ওমে গরম হওয়া যায়। বর্ষায় আরও কষ্ট হয়। তেরপলে, চটে, প্লাস্টিকে বৃষ্টির
ছাঁট আটকাতে চায়না। ঝমঝমিয়ে পড়লেতো কথাই নেই। গায়ের জামা ভিজে সপ্ সপ্ করে। পোঁটলা
করে রাখা দু’চারটে শুকনো
জামা তাও ভিজে যায়। বিশুর খুব শীত লাগে, বোনটা কাঁদে, মা আঁচল ঢাকা দেয় ওকে, তাও
ভেজে, সবাই ভিজে যায়।
বিশুদের আশেপাশে, রাস্তার ওপারের ফুটপাতেও এমন অনেক
ঘরসংসার। যাদের সংসারে জোয়ান পুরুষ মানুষ আছে তাদের অবস্থা খানিক ভালো। লোকগুলো এদিক-ওদিক
নানান ধান্দা করে রোজগার করে। চারপাশে পুরোনো বাড়ি ভেঙ্গে অনেক নতুন নতুন ফ্ল্যাট
উঠছে। সেখানে জন খাটে। বিশুদের মতো ছেলেমেয়েদের একটা ছোট দল আছে। তারা ভিক্ষা করে,
কখনো খেলে বেড়ায় রাস্তায় বা হেদুয়ার পার্কের ভেতরে, শুকনো পাতা-কাঠের টুকরো কুড়িয়ে
আনে আগুন জ্বালানোর জন্য। একটু বড় দু’একজনকে ও
হাতসাফাই করতেও দেখেছে। ওরা বিড়ি খায়, মাঝে মাঝে বেশি পয়সা পেলে সিগ্রেট। মেয়েগুলো
মাঝে মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে সস্তা দামের টকটকে লাল লিপস্টিক লাগায়, তখন বিশুর কেমন
অন্যরকম লাগে ওদের, বিশেষ করে রেখাকে। রেখাকে ও ছোট থেকে বড় হতে দেখেছে এই
ফুটপাতেই। রেখার মা নেই, বাবা মদ খায় আর ওদের দুই ভাই-বোনকে খুব পেটায়। মাঝে মাঝে
রাত্তিরে ওদের চিৎকার শুনলে ফুটপাতের অন্য বাসিন্দারা গিয়ে ওদের বাবাকে টেনে সরিয়ে
আনে, গালাগাল দেয়। আবার পরের দিনই হয়তো শুরু হয় সেই একই কাণ্ড। মাথার ওপর কোনদিন
একটা ছাদ হলে সেখানে রেখা আর রেখার ভাইকেও থাকতে দেবে ও। কালু বলেছে, ও নাকি
পকেটমার। সেদিন একটা পার্স ওকে দেখিয়েছিল। তাতে অনেক টাকা ছিল। কালু বলেছে ওর
এলাকা নাকি অন্য, নিজের জায়গায় এসব করতে নেই, এটা অন্যদের এলাকা। কালু ওর থেকে বেশ
কয়েকবছরের বড় বলে ওর মনে হয়। কালুর অল্প অল্প গোঁফ-দাড়ি গজিয়ে গেছে, ওর এখনো হয়নি।
কালু ওকে সেদিন একটা টাকাও দেয়নি। ওই টাকা নাকি ওর একার নয়, ভাগ হবে। বিড়ি দিয়েছিল
একটা আর মেয়েদের ছবিওলা ম্যাগাজিন দেখিয়েছিল। ওর শরীরে কেমন একটা উত্তেজনা হচ্ছিল।
বিড়িটায় খুব জোরে একটা টান দিতেই বিষম-টিষম খেয়ে একদম একাকার কাণ্ড হয়েছিল। কালু
খুব হাসছিল। ও বিড়িটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে চলে গিয়েছিল সেখান থেকে, ওর রাগ হচ্ছিল
খুউব।
ওদের থেকে একটু দূরে ফুটপাতের ওপর জুতোচাচা বসে। জুতোচাচার
সত্যিকারের নাম কী কে জানে! ছোট থেকেই ও জুতোচাচাকে দেখছে সেই একইরকম চেহারা। ওর
মাও তাকে জুতোচাচা বলে, ফুটপাতের সবাইই, তাই ওঔ বলে। জুতোচাচার কাছে যেতে বিশুর
খুব ভালোলাগে। জুতোচাচার আর কেউ নেই। জুতোচাচা বিশুকে বলেছে জুতো সেলাই করা শিখিয়ে
দেবে। কালু ওকে বলেছে যে পকেটমারিটা শিখে গেলে নাকি কিচ্ছু কঠিন নয়, তবে ধরা পড়লে
বেধরক পিটুনি খেতে হয়। ওর যদি ইচ্ছে থাকে তাহলে ওদের লিডারের কাছে নিয়ে যাবে।
পকেটমার হওয়ার ইচ্ছা ওর নেই। তার থেকে অনেক ভালো জুতোচাচার কাজ। বিশুও ওরকম
রাস্তার ধারে বসে পালিশের ব্রাস দিয়ে পালিশের বাক্সে ঠকঠক করে শব্দ করবে। আর
বাবুদের জুতোগুলো পালিশ করে একেবারে আয়নার মতো চকচকে করে ফেলবে। ওর অবশ্য কানুর
মতো খাবারের দোকানে কাজ করতেও ইচ্ছে করে। লোকে নাকি খুশি হলে বকশিশ দেয়, কানু
বলেছে। তাছাড়া রেস্টুরেন্টের বাসি টুকরো-টাকরা খাবারও এমনিই পাওয়া যায়। এগুলো সবই
আর যাইহোক মার খাওয়ার থেকেতো অনেক ভালো বলেই বিশুর মনে হয়। কিন্তু কানু বলে বাবুরা
ওকে দোকানে রাখবেনা। বাবুরা নাকি বিশ্বাসী লোক চায়। রেস্টুরেন্টের রান্নার লোক
কানুর কাকার সুবাদে দেশ থেকে কানু এখানে এসেছে কাজ করতে। এসব শুনলে বিশুর খারাপ
লাগে, কেন ওকে, ওদেরকে কেউ বিশ্বাস করেনা? জুতোচাচাওতো অনেকসময় ওর দিকে সন্দেহের
দৃষ্টিতে দেখে। বলে, ‘দেখিস, আবার দু’চারটাকা সরাসনা যেন’। কথাগুলো খিদের পেটে বিশুর খুব
গায়ে লাগে, ও উত্তর দেয়না, চুপচাপ উঠে চলে আসে। জু্তোচাচাই আবার ডাক দেয়, ‘ও বিশু, রাগ করলি নাকি?...’
বিশুরতো বাবা-কাকা কেউ নেই, আছে শুধু ছেঁড়া শাড়ি পরা মা।
তাই বিশু শুধু স্বপ্নই দেখে জু্তো সারানো কিম্বা রেস্টুরেন্টে কাজ করার। বিশুর
অনেক স্বপ্ন – টাকা রোজগারের
স্বপ্ন, পেট ভরা খাবারের স্বপ্ন, মাথার ওপর ছাদের স্বপ্ন, নিজের জন্য, ভাইয়ের জন্য
নতুন জামা-প্যান্ট আর বোনের জন্য নতুন ফ্রকের স্বপ্ন, মায়ের জন্য রাঙা শাড়ি আর
চকচকে গয়নার স্বপ্ন, ভাই-বোনের ইস্কুলে যাবার স্বপ্ন, রেখাকে ভালো রাখার স্বপ্ন।
ইঁট-কাঠের উনুনের আলোয়, ফুটন্ত ভাতের ম’ ম’ গন্ধে, ভাই-বোনের ক্ষুধার্ত
চাহনিতে, মায়ের বিষণ্ণ মুখের আঁকিবুকি রেখায় বিশু রোজ এইসব স্বপ্ন দেখে আর হাঁটে, ‘একটা টাকা দাওনা, ও বাবু, কিছু
খাইনিগো সারাদিন’...
No comments:
Post a Comment