Monday, August 17, 2015

শাঁখা-সিঁদুর




ফেসবুকের একটি গ্রুপে সদ্য নিহত ব্লগার নীল-এর একটি পোস্টের বিরুদ্ধে লেখা একটি পোস্ট পড়ছিলাম। বিষয় ছিল শাঁখা-সিঁদুর। মেনে নিলাম, নীল কিছুটা তীব্র ভাষায় বলেছিলেন, ব্যবহার করেছিলেন স্ল্যাং শব্দ। কিন্তু বলেছিলেন খাঁটি সত্য কথা।


কিছুদিন আগে নূপুর পড়বার সখ হল। আমার কিশোরী মেয়ে আপত্তি জানিয়ে বলল, জানোনা মা এসব কিসের চিহ্ন? জিজ্ঞাসা করলাম, কে বলেছে তোকে এসব, আমাদের সঙ্গে তো এ বিষয়ে কথা হয়নি তোর? বলল, কোনো এক শিক্ষিকা পড়ানোর সময় বলেছেন। খুশি হলাম। শিক্ষিকা কিছু সত্য শেখালে তা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হয় জীবনে। আমাকে কে এসব শিখিয়েছিল মনে পড়ে না। ছোটবেলায় শাঁখা-সিঁদুর পড়া নিয়ে কোনোদিনই মায়ের মধ্যে কোনো তাপ উত্তাপ দেখিনি। কখনো পড়েছে, কখনো পড়েনি। আমার ধারণা বিশেষ মাথা ঘামাতে চায়নি। আমি বরং শখ করে অনেকসময় সিঁদুরের টিপ পড়তাম কপালে। বেশ লাগতো। মাঝে মাঝে শুধু বিরক্ত হত মনে আছে বাবা এ বিষয়টা বললে। মানে যখনই ওই চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা আসত। পরবর্তীকালে যখন জেনেছি বাবা-মা বিবাহিত ছিলনা তখন এই ব্যাপারটা আরোই আশ্চর্য লেগেছে। আর না করার কারণ যেখানে স্রেফ বাবার আলসেমী। হ্যাঁ, আলসেমী করেই ব্যাপারটা হয়ে ওঠেনি, শেষপর্যন্ত আমার বিয়ের মাস তিনেক আগে মায়ের বিস্তর চাপাচাপিতে উদ্যোগ করে মাকে অফিসিয়ালি বিয়ে করে বাবা। তাও কতবার চেয়েছিলাম সাক্ষী হই, কিছুতেই রাজি হলনা। বাবা-মায়ের বিয়ের সাক্ষী হওয়ার এমন সুযোগটা স্রেফ বাবার আপত্তিতে হলনা, মায়ের কোনো আপত্তিই ছিল না।


কলেজে পড়াকালীন হস্টেলে মাঝেমধ্যেই এই বিষয়টা নিয়ে তর্ক চলত বন্ধুদের সঙ্গে। বলেছিলাম, দেখিস বিয়ের সময় কেউ আমাকে শাঁখা-সিঁদুর পড়াতে পারবেনা। না, তর্কের খাতিরে বলিনি, গভীর বিশ্বাস থেকেই বলেছিলাম। কিন্তু ব্যাপারটা আমার কাছে যে এতটাই সিরিয়াস ছিল তা বিয়ের সময় অন্যজন ঠিক বুঝতে পারেনি। তাহলে অবশ্যই ঘটনাগুলো ঘটতো না। ফলে কেন শাঁখা-সিঁদুর পড়তে হবে বলে বিয়ের দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি ভয়ানক কেঁদেছিলাম বিয়ে আমি করবনা বলে। এখানে বলে রাখি বিয়ে করছিলাম একেবারেই স্বেচ্ছায়। যাইহোক সকলে অনেক বুঝিয়ে কোনোমতে বন্ধুরা সাজিয়েগুজিয়ে অসম্ভব রাগত আমাকে বিয়ের আসরে তুলল। রেজিস্ট্রি হয়ে যাওয়ার পর সিঁদুর দানের সময় প্রচণ্ড বেগে হাত ছুঁড়লাম। ছবিটা দেখলে এখন অসম্ভব হাসি পায়। বিশেষ করে ঝুমলাদিদি আর সারুর আতঙ্কিত মুখ দেখে যে এবারে ও কী করবে কে জানে! রাগের চোটে রাতে নার্ভাস ব্রেক ডাউন। বৌভাতের দিন আরেক কাণ্ড। বেঁকে বসলাম কেন সিঁদুর পড়ে সাজতে হবে? কেন কেউ আমাকে শাড়ি পরিয়ে দেবে? আমি সাজব না। অনেক কষ্টে সাইডে সিঁথি করে সামান্য ছোঁয়া থাকবে এই কড়ারে রাজি হলাম। বিয়ে আর বৌভাত দুদিনই ভয়ানক কাঁদো কাঁদো মুখ আমার। আসলে কিন্তু বিষয়টা অন্য ছিল।


বিয়ের কয়েকদিনের মধ্যেই ঠকাঠক মেরে দুটো শাঁখাই ভেঙে ফেললাম। আর লোহা বাঁধানো হাতের মুঠোয় চেপে দুটুকরো।

শুনেছি আমার ননদেরা বলেছিল, তাদের ভাইয়েরা আসলে ভীষণ ভালো, তাই তাদের বৌয়েরা যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। হতো তাদের বর আর শ্বশুরবাড়ি তাহলে বুঝতো। গল্পের এই অংশটা সবথেকে বোরিং লেগেছে আমার। মেয়েরা যাই করুক ক্রেডিটটা শেষপর্যন্ত ছেলেদের হবে, এবং দেবে যারা তারাও আদপে মহিলাই। যেমন, দীর্ঘদিন ধরে অনেকেই আমার মায়ের লেখাকে ভাবত বাবা লিখে দিয়েছে। এবং যখন তারা ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে শুরু করল যে নাহ্‌, লেখাগুলি মায়েরই, তখন কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার বাবার প্রশংসা করে বলত, অমন স্বামী থাকলে হতেই পারে, নেহাত আমাদের নেই তাই আর হলনা। মুশকিলের বিষয় এই যে মাকে মাছের ঝোল উনুনে চাপিয়ে উপন্যাস লিখতে কিম্বা উনুনে নিজের লেখা কাগজ দিস্তা ধরে গুঁজে দিতে এক হয়তো আমিই দেখেছি।

এখন চিন্তাভাবনায় কিছু পরিবর্তন এসেছে আমার। লাল-সাদা ঢাকাই কী তেমন তেমন শাড়ির সঙ্গে লাল লিপস্টিকের মতোই শাঁখা-সিঁদুরটা জমে ভালো। আর সেদিনের কান্ডগুলোর জন্য বেশ হাসিও পায় এখন। আরেকটু স্পোর্টিভলি বিয়েটা করা উচিত ছিল আমার মনে হয়। এত রেগে কেউ নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করে?
সবচেয়ে বিরক্তিকর পোশাক প্যান্ট-শার্ট কী টি-শার্টের সঙ্গে সিঁদুর-শাখা। এই আধুনিকারা আবার সিঁদুরও নয়, অন্য কিছু রঙ মাখেন। এদের দেখলেই আমার কেমন গা গুলিয়ে ওঠে। এর থেকে শাড়ি আর শাঁখা-সিদুরে অনেক বেশি সুন্দর মা-মাসিমারা। এঁরা পোশাকে যত আধুনিকা হন মনের দিক থেকে ততোটাই মান্ধাতার আমলের। এঁদের দেখলে আমার মনে হয় ঊনবিংশ বাঙালি মেয়ে ঠিক বুঝেছিল, কর্ম আর শিক্ষার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা। আর আজকের বাঙালি মেয়ে আধুনিকতা বোঝে পোশাকে। মনেও নয়, মননেও নয়। এটা বোধহয় ভয়াবহ বাংলা সিরিয়ালের শিক্ষা।কে জানে বাবা!
নীল বিন্দুমাত্র ভুল বলেনি। তবে ও চিরাচরিত কথা বলেছিল। অর্থাৎ, শাঁখা-সিঁদুর একটি মেয়েকে একটি পুরুষের ‘মাল’ অর্থাৎ ভালো ভাষায় বললে সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত করে। এটাতো পুরুষশাসিত সমাজের প্রতি একটা বক্তব্য। ঠিক কথা। সেটা তো অনেক পুরুষই মনে করেন। তবে অবশ্যই সকলে নন। বরং কমবেশি সব মেয়েরাই মনে করে। এই সংস্কার থেকে তারা যতদিন না বেরিয়ে আসছেন ততদিন কিছুতেই বলে বোঝানো যাবেনা যে সংস্কারটা টিঁকিয়ে রেখেছে মেয়েরাই।ছেলেদেরকে দোষ দেওয়াটা নিতান্ত অজুহাত মাত্র নিজের সংস্কার আঁকড়ে থাকার জন্য। সে আমাকে নিত্য সিঁদুরও পরাবেনা ধৈর্য ধরে আর নিত্য শাঁখা কী লোহা বাঁধানো নিয়ে গজর গজরও করবে না। বিরক্ত হবে কখনো, তারপর ধুত্তোর বলে নিজের কাজে মন দেবে। গজগজ করবে বাড়ির বয়স্ক মহিলারা আর নিজের মন। সেইটা কিন্তু মেয়েদেরই পেরোতে হবে। নাহলে ফল ওই কিম্ভুত সাজ – জিনসের সঙ্গে সিঁদুরের আধিখ্যেতায়। আসলে ওইখানেই আটকে রয়েছে অধিকাংশ বাঙালি মেয়ের আধুনিকতা - ক্রমশঃ ছোট হয়ে আসা পোশাকে আর আধখানা শিক্ষায়।
লেখাটা পড়ে একটি অল্পবয়সী ছেলে আমায় ফেসবুকে ইনবক্স করল, কেন আমি মেয়েদের দোষ দেখেছি। বললাম, কী করব বলো, আজ পর্যন্ত আমি কেন শাঁখা, সিঁদুর পড়িনা তাই নিয়ে কোনো ছেলে আমায় জিজ্ঞাসা করেছে বলে মনে পড়েনা। এমনকী বাসে কন্ডাক্টররাও দিদি, বৌদি, মাসীমা যা পারে ডাকে। কিন্তু অনেকবার প্রশ্ন শুনেছি মেয়েদের মুখ থেকে, আমি বিধবা না ডিভোর্সি। কোনোটাই নই শুনে দীর্ঘশ্বাস পড়েছে আমার স্বামীভাগ্য ভেবে। যেন শুধু ওইটুকুর জন্য সে কিছুই করে উঠতে পারল না। আর সবাই তো জিজ্ঞাসা করেনা, কিন্তু অনেকের চোখে প্রশ্ন ঝুলে থাকে মেয়ে সহ আমাকে দেখলে পথেঘাটে, বাসেট্রেনে। তাই মেয়েদের কথাই আগে মনে আসে আমার।
 

5 comments:

  1. পড়লাম, লেখাটা বেশ ভালো। তবে কীরকম গোলমেলে ঠেকলো। ব্লগার নীল-এর লেখাটা পড়া হয় নি, বা পড়ার সুযোগ হয় নি, তাই এ বিষয়ে কিছু না বলাই ভালো।

    ReplyDelete
  2. সুবীরদা, সেই শেষপর্যন্ত আপনিই আমার একমাত্র সরব পাঠক। সকাল থেকে প্রায় দুশো জন ব্লগ দেখেছে। যার বড় একটা কারণ বোধহয় ওই গ্রুপটিতেও পোস্ট করেছিলাম। ওই গ্রুপে যেকোনো বিষয়েই সপক্ষে বিপক্ষে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক হয়। সেখানেও কোনো মতামত পেলাম না। আপনার প্রশ্নের উত্তর তো আমি দিয়েছি। কিন্তু এই নীরবতা বড় গোলমেলে ঠেকছে আমার নিজেরই।

    ReplyDelete
  3. সঠিক কথা, বড় সুন্দর করে বলা (শুধু নিরিবতা নিয়ে আক্ষেপ করেছেন তাই এটুকু লিখলাম, নইলে এলেখার সামনে মারনাস্ত্রও চুপ করবে)

    ReplyDelete