Wednesday, January 11, 2017

লেডি অবলা বসু – নারী শিক্ষায় প্রাসঙ্গিকতা


লেডি অবলা বসুর সঙ্গে আমার কাজের যোগাযোগের শুরুটা একটু অদ্ভুতই। ঠিক এইভাবে যে ওনার কাছে পৌঁছাব তা ভাবিনি। বাংলায় ভ্রমণকাহিনি লিখছি দীর্ঘদিন। আর তা লিখতে লিখতেই পূর্বসূরীদের লেখা অর্থাৎ বাঙালি মেয়েদের লেখা ভ্রমণকাহিনি খোঁজার ইচ্ছা জাগে মনে। কাজটা করতে গিয়ে স্বর্ণকুমারী দেবীর মতো পরিচিত নামের পাশাপাশি অনামী অনেকের নাম যে পাব তা আশাই করেছিলাম। বরং ছোটদের মুকুল পত্রিকায় লেডি অবলা বসুর লেখা ভ্রমণকাহিনিগুলি আমাকে প্রাথমিকভাবে আশ্চর্যই করেছিল। তবে পরে বিষয়টির গভীরে যখন ঢুকেছি মনে হয়েছে তাঁর পক্ষে এটাই খুব স্বাভাবিক ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালি মহিলাদের মধ্যে অবলা বসুই হয়তো সবথেকে বেশি দেশ-বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছিলেন। আবার শিক্ষা বিষয়ে আগ্রহী অবলা বসু ছেলেমেয়েদের শিক্ষার প্রসারের জন্য ভ্রমণকাহিনি লেখার জন্য ছোটদের পত্রিকাই বেছে নেবেন সেটাই স্বাভাবিক। কাশ্মীর নিয়ে লেখা তাঁর প্রথম ভ্রমণকাহিনিটি শুরুতেই এই কথা বলেওছেন। সত্যি বলতে কী সেই সময়ের প্রেক্ষিতে দেখতে গেলে অবরোধবাসিনী বাঙালি মেয়ের কাছে বেড়াতে যাওয়া এবং ফিরে এসে সেই কাহিনি লেখার মধ্যেই নারী শিক্ষা ও নারী স্বাধীনতার বীজটি লুকিয়ে ছিল। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই অবলা বসুর জাপান ভ্রমণ হয়ে উঠেছিল তাঁর নারী শিক্ষা সমিতির প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা।

সত্যি বলতে কী অবলা বসুর বিস্তৃত কর্মকাণ্ডের যেটুকু জানতে পেরেছি তাতে ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে শিক্ষিত বাঙালি মেয়েদের বিদ্যাসাগরের পরেই অবলা বসুর কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। মেয়েদের জন্য সারা বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে পাঁচশো বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা সেই সময়ের নিরিখে বেশ কঠিন কাজ ছিল। তবে ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে যুক্ত থাকায় এবং হয়তো স্বনামধন্য বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র বসুর স্ত্রী হওয়ায় এই কাজে তিনি যে বাধা পেয়েছিলেন বলে তেমন কিছু জানা যায় না। অথচ মৃত্যুর সত্তর বছরেরও কম সময়ে এই মহিয়সী মহিলার অবদান প্রায় বিস্মৃতিতে চলে যাওয়ার ঘটনা আমার খুবই আশ্চর্য লেগেছে। স্বাধীনোত্তর দ্বিখণ্ডিত বাংলায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত অধিকাংশ স্কুলের যে অস্তিত্ব আর নেই তা যদিও খুব আশ্চর্যের কিছু নয়, কিন্তু যেগুলি এখনও বেঁচে আছে তাদের প্রতিষ্ঠাত্রীকে না জানাটা বেদনাদায়ক। আর সবচাইতে বেদনাদায়ক বোধহয় ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয় যার সঙ্গে তিনি কর্মজীবনের শেষপর্যন্ত যুক্ত ছিলেন তাদের স্পষ্টতঃই সে ঋণ অস্বীকার করা। অবলা বসুর ওপর কাজটি করতে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতা বেশ তিক্তই। এই বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষিকা তাঁরই অর্থে নির্মিত ভবনের ছাদের নীচে দাঁড়িয়ে বেশ ন্যক্করজনক ভাষাতেই বলেছিলেন যে সেখানে অবলার কিছু নেই। সত্যিই কিছুই নেই অবলা ও জগদীশচন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত বসু বিজ্ঞান মন্দির লাগোয়া তাঁদের বাসভবনে। বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠাতেও অবলা বসুর ভূমিকার কথা প্রায় ধরাই হয় না। ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয় থেকে তাঁর নামাঙ্কিত প্লেকটিও নাকি উধাও হয়েছে সার্ধ শতবর্ষে! কেন এই বিস্মৃতি? কোনও উত্তর খুঁজে পাইনি!

একমাত্র নারী শিক্ষা সমিতি অবলা বসুকে স্মরণে ও বরণে রেখেছে তাদের কাজের মধ্যে দিয়ে। সংস্থাটি যত ছোটই হয়ে আসুক কলকাতা ও ঝাড়গ্রামের দুটি ঠিকানাতেই সক্রিয় রয়েছে। এই প্রসঙ্গে আমার স্বল্প পরিচিতির বৃত্তে বারবারই মনে হয়েছে রীতাদি মানে রীতা ব্যানার্জির কথা। তাঁর একটি কথা বড় ভালো লেগেছে আমার অবলা বসু প্রচার চাইতেন না, আমরাও তাঁর কথা মনে রেখে নীরবে কাজ করে যাই। এটা হয়তো রীতাদির নিজের পরিচয়ও।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে সত্যিকারের শিক্ষিত আলোকময়ী বাঙালি নারীদের পেয়েছি, আজকের শিক্ষিত মহিলাদের ভিড়ে সেই সত্যিকারের মন ও মেধা দুর্লভ। আর মেয়েদের প্রকৃত শিক্ষিত করে তোলার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে একটা জাতির ভবিষ্যত। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষার প্রকৃত চিত্রটি অনুধাবণ করলে অবলা বসুর অসমাপ্ত এই বিরাট কর্মকাণ্ডের প্রয়োজনীয়তা খুব স্পষ্টই লক্ষ্য করা যায়। আধুনিকতা পোশাকে বা আচারে নয় প্রতিফলিত হওয়ার প্রয়োজন শিক্ষায় ও ব্যক্তিত্বে তথা মানসিকতায়। সাধারণ ঘরের মেয়েরা প্রকৃত শিক্ষিত হয়ে উঠলে সমাজ থেকে পণ প্রথা, বধূ হত্যার মতো নিয়ত বেড়ে ওঠা সমস্যাগুলি কমতে পারে। অবলা বসুকে আমরা যতই বিস্মৃতির অন্তরালে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করিনা কেন তাঁর প্রয়োজন আজও সমধিক।

No comments:

Post a Comment