আজ সকাল
থেকেই ‘ইচ্ছে’ নিয়ে দু’চার কথা লিখতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু ঠিক যা ইচ্ছে জমছে না
কলমে থুড়ি কী বোর্ডে। ‘ইচ্ছে’ ব্যাপারটা বেশ চমৎকার যতক্ষণ তা একলার থাকে। যখনই
তার ইচ্ছে হয় আরও আরও মানুষেরাও সেই ইচ্ছেতে চলে আসুক তখন অন্যপক্ষের ইচ্ছে না
হলেই ভারী মুশকিল।
এই যে
আমায় ছোটবেলায় যারা ভীষণ কাছের থেকে দেখেছে তারা বলে, তোকে আর মনে নেই? ‘আমার এখন
কান্না পাচ্ছে, আমি কাঁদবই’ - ওইটাই তো তুই। একদম ঠিক। কারণ ওই কান্নায় অন্যদের
বিশেষ অসুবিধা ঘটত না বলে বা ছোটরা অমন কেঁদেই থাকে।
কিন্তু
বড় হয়েও আমার ইচ্ছেগুলো ওইরকমই রয়ে গেল। ক্লাস টেনে যখন স্কুলের মধ্যে বন্ধুদের
টেনে নিয়ে হেডমিস্ট্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলাম, মা ভারী বিরক্ত হয়ে বলেছিল,
তোমায় তো বলে লাভ নেই, করছ কর এরপর নিজে উল্টাবে আর তখন পাশে কেউ থাকবে না।
একেবারে অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল সেই ভবিষ্যতবাণী।
ক্লাস
নাইন-টেনে পড়তে একা একা ধানক্ষেতে বিকেল-সন্ধ্যেয় ঘুরে বেড়ানোর অভ্যেস ছিল। তখন
ওইসব জায়গা একদম ফাঁকা। একদিন সূর্য অস্ত গেছে, ফিরে আসছি, একজন গ্রাম্য ধরণের
দেখতে লোক আমায় বললেন, এভাবে একা একা ঘুরে বেড়িও না, বিপদ হতে পারে। বললাম, বিপদ
তো আমার হবে, আপনার তাতে কি? আমার ইচ্ছে আমি ঘুরে বেড়াব। বেচারা লোকটা নিতান্ত
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চলে গেল। আমার অবশ্য অত বড় বয়সেও বিপদের কোনো ধারণা ছিল না, এটা
ঠিক।
একবছর
বিষ্ণুপুরে থাকতে হস্টেলের খাবার আমার ভালোলাগত না। অধিকাংশ দিনই রাতে খেতাম না।
এক বন্ধু অনেক সাধাসাধি করে একেকদিন খাওয়াতো। অধিকাংশ দিন তাকে বলতাম আমি খাব না,
থালাটা ছুঁড়ে ফেলে দে, আমার ইচ্ছে। হস্টেলের পিছনের দিকে মাঠ, ঝোপঝাড় আর অনেক
ভাঙ্গা ভাঙ্গা মন্দির ছিল। ওখানে যাওয়া বিশেষ করে বিকেলের দিকে হস্টেলের নিয়ম ছিল
না। অতএব অধিকাংশ দিন ওইখানেই যেতাম আমরা দুই বন্ধুতে। একেকদিন ধরা পড়লে বলতাম,
ইচ্ছে হয়েছিল।
নাহ্,
কোনোদিন ইচ্ছের জন্য মিথ্যে কথা বলিনি কাউকেই। মিথ্যে বলতে আমার খুব বিরক্ত লাগে,
একটুও ইচ্ছে করে না।
কলকাতায়
হস্টেলে অসম্ভব কড়া নিয়ম ছিল। হস্টেল থেকে বেরোতে হলে হাজার রকমের সই-সাবুদ,
পাস...। যারা বেচারা প্রেম করত বড্ড ঝঞ্ঝাটে পড়ত। হস্টেল থেকে পাঁচজন ছাড়া বেরোনো
যেত না। এইসব প্রেমিকাদের আমি বিভিন্ন সময়ে সাহায্য করেছি, কখনো দারোয়ানকে রোল
আনতে দিয়ে সরিয়ে দিয়ে, কখনোবা পঞ্চম ব্যক্তি হিসেবে সঙ্গ দিয়ে। আসলে ওই চাপিয়ে
দেওয়া নিয়ম আমার অসহ্য লাগত। হস্টেলের ভিতরেও নিয়ম ভেঙ্গেছি কখনও। আমার ওপর কিছু
চাপিয়ে দিলেই আমি সেটা ঠিক কোথাও না কোথাও নামিয়ে রেখে আসি। নিজেও একই কাজ না করতে
চেষ্টা করি তবে মাঝেমধ্যে ইচ্ছে বেগড়বাই করে। যাইহোক একবার ব্রাহ্মসমাজের এক
অনুষ্ঠানে হস্টেল থেকে সব্বাইকে যেতে হল। ওখানে পৌঁছনোর পর চারজন প্রেমিকা এসে
আমায় বলল তারা পালাতে চায়, দলে একজন কম পড়েছে। আমি বললাম চল, আমারও বোর লাগছে।
কিছুটা দূরে তাদের প্রেমিকেরা অপেক্ষা করছিল। সবাই মিলে সল্টলেকের একটা পার্কে
গিয়েছিলাম মনে আছে। ওরা প্রেম করছিল আর আমি দুপুরবেলায় রোদের মধ্যে দোলনায় দুলে
দুলে একা একাই বকবক করছিলাম আর গান করছিলাম। ভাগ্যিস আর কেউ ছিল না। কিন্তু বেলা
যত বাড়তে লাগল ওদের এই ঘোর প্রেমের ইচ্ছেতে আমার মাথা গরম হতে লাগল। না ওদের কাছে
যাওয়া যায়, না দূর থেকে ডাকলে সাড়া দেয় – সে এক কেলেঙ্কারী কাণ্ড। শেষে অনেক কষ্টে
সব কটাকে গুছিয়ে যখন আনতে পারলাম তখন অনুষ্ঠান শেষ, টিফিন দেওয়ার লাইন পড়েছে।
সুড়ুৎ করে লাইনে ঢুকে গেলাম। তারপরে অন্যদের সঙ্গে দিব্য তাল মিলিয়ে আলোচনা অমুকের
গান কিম্বা বক্তৃতা...। না দেখলে-শুনলে কী হবে সে ম্যানেজ করা যায় একটু ইচ্ছে
থাকলেই। তবে ওদেরকে শাসিয়ে ছিলাম বাব্বা তোদের সঙ্গে আর নয়, হয়েছিল আর কী!
এরপরে ওই
হস্টেল ছেড়ে দিই। সেই ইচ্ছে। প্রাইভেট হস্টেলে থাকার সময় টিফিন খাওয়ার পয়সা থাকত
না অধিকাংশ দিনই, ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কেন জানি টিউশনি জোগাড় করতে পারিনি। আসলে
ভীষণ ইন্ট্রোভার্ট আর আনস্মার্ট ছিলাম। কিন্তু ওইসময় কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় একা
হেঁটেছি অনেক সময়, বেশ লাগত।
এই
হস্টেলে থাকার সময়েই একদিন মৌসুমীদির বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেও আর এক অদ্ভুত মেয়ে
ছিল। ওর ওপর আমার একটাই রাগ ছিল, তখন আমার গোটা দুয়েক সালোয়ার কামিজ আর দুটো-তিনটে
শাড়ি ছিল। ওই সালোয়ার কামিজ দুটোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কলেজে পড়ে যেতাম। আর মাঝে মাঝেই
তার একটা পড়ে ও অদৃশ্য হত এবং কয়েকদিন বাদে না কেচে ফেরত দিয়ে যেত। খুব রাগ হলেও
বুঝেছিলাম এই রকমই। মানে এটা ওর ইচ্ছের মধ্যে পড়ে। আমার রুমের আরেকটি মেয়ে
রবীন্দ্রভারতীতে পড়ত। তার ইমিটেশন দুল পড়লেই কানে ইনফেকশন হয়ে ফুলে যা তা কাণ্ড
হত। প্রতিবার কাঁদতে শুরু করত আর আমাকে গরম জল তুলো দিয়ে পরিস্কার করে ওষুধ লাগিয়ে
সেটা ম্যানেজ করতে হত। সেটাও ওর ইচ্ছে বুঝে পরের দিকে বকুনি দেওয়া বন্ধ করে
দিয়েছিলাম।
একদিন
সন্ধ্যেবেলায় মৌসুমীদি এসে বলল, চল আমাদের বাড়ি যাবি। মনটা নেচে উঠল ইচ্ছেয়। বললাম
চলো। এর আগে বিষ্ণুপুরে থাকতে একবার এক রুমমেটের বাড়ি গিয়েছিলাম রুমের সবাই মিলে।
তার নাম ছিল মল্লিকা। বাড়ি ছিল মেদিনীপুরের কোথাও একটা। পিঠের সময় নিয়ে গিয়েছিল।
নানা রকম পিঠে খেয়েছিলাম ওদের বাড়িতে আর খিচুড়ি-ইলিশ মাছ। তখন তো বাড়িতে ফোনও নেই।
একটা পোস্টকার্ড ছেড়ে দিয়ে রওনা। এবারে সে সময়ও নেই, কারণ ইচ্ছে জেগেছে। মৌসুমীদি
বলল, চল, এইসময় আমাদের ওখানে বড় মেলা বসে। তা চেপে বসলাম ট্রেনে, ভাবলাম ফিরে এসে
বাড়িতে বলা যাবেখন। মুড়াগাছা লোকালের নাম শুনেছি ঢের, এবারে গন্তব্য সেই
মুড়াগাছাই। রাতের ট্রেন কেমন হু হু হাওয়া, বাইরে ভরা জ্যোৎস্না। স্টেশনে নেমে দেখি
জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। রাস্তার পাশে বড় বড় গাছ, ছায়া এসে পড়ছে পথে। ওরই মাঝে
নির্জন রাত্তিরে রিক্সায়। সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত ওদের বাড়ির ছাতে পরিপূর্ণ
জ্যোৎস্নায় বসেছিলাম। কে জানে কোথায় আজ মৌসুমীদি, মাঝে মাঝেই ওকে মনে পড়ে আমার, আর
সেই জ্যোৎস্না রাত।
এই
হস্টেলেই আরেকটা মেয়ে ছিল, মেমসাহেবের মত দেখতে, ওকে আমরা ডাকতাম নেড়ু বলে। নাম
ছিল শর্মিষ্ঠা, চুলগুলো পিক্সিকাট করা সেইসময়ে। ওর সঙ্গেও কলকাতায় ঘুরে বেরিয়েছি
আমি অনেকদিন। সবচেয়ে মনে পড়ে বেশ গভীর রাতে একদিন সল্টলেক থেকে ফিরছিলাম। চারদিক
নিঃশব্দ, অন্ধকার।
মাঝে মাঝে
ভাবি কোথায় গেল মল্লিকা, নিবেদিতা, ফুলকি, মৌসুমীদি, শর্মিষ্ঠার মতো কেউ কেউ। কোথায়
গেল বাংলাদেশের মেয়ে শম্পা? সাধারণ মেয়েটা একটা বড়লোকের ছেলেকে ভালোবেসেছিল।
কিন্তু কাহিনির শেষটা আর জানতে পারিনি। কোথায় গেল তারা যারা কখনো না কখনো আমার
ইচ্ছের সঙ্গী হয়েছিল? আর ইচ্ছেগুলো, তারাও কি একইরকম আছে?
আমি জানি
ইচ্ছে মানে অনেকসময়েই কিছুটা দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, ইচ্ছে মানে অনেকসময়
আত্মকেন্দ্রিকতাও।
ইচ্ছে
মতো ইচ্ছে করা যায় না অনেকসময়, ইচ্ছেমতোই করা যায় না অনেকসময়।
তবু
ইচ্ছেরা থাকে। থেকেই যায়। আমার মতো কেউ কেউ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইচ্ছে পূরণ করে কখনও।
আর অনেক
মানুষ যখন একসঙ্গে বৃহত্তর ইচ্ছেপূরণ করে তখন তার নাম হয় বিপ্লব বা দিনবদল।
কিন্তু
সেই ইচ্ছেগুলোও অধিকাংশ সময়ে ইচ্ছে হয়েই রয়ে যায়।