Sunday, April 23, 2017

প্রার্থনা


কালো পর্দার ওপারে আর আমি বলে কেউ নেই কিছু নেই। অথচ দেখ এ পারে তার কত আয়োজন। কত কোলাহল।

সাদা দেওয়াল সাদা চাদর ওষুধের গন্ধ চাপা স্বরে কথা যন্ত্রণার গোঙানি অথবা নি:শব্দতা সেও এপারেরই।

গেরুয়া সবুজ লাল ঝাণ্ডারা কোনদিন ওই কালো পর্দার ওপারে উড়বে না। ওপারে যাবে না তরোয়াল বন্দুক বোমা অথবা ধর্মের চিৎকার। ওরা শুধু প্রশস্ত করবে ওপারে যাওয়ার পথ।

এপারেই তবুও বৃক্ষ আছে, পাখিদের গান। নীল আকাশ আর সাদা পাহাড়। হলুদ ধানের শীষ, সন্ধ্যার মায়াময় আলো। নদীর আলিঙ্গন মেশে সাগরবেলাতে। এই সব এই পারে আছে। ভালোবাসা, কবিতা এবং তুমি।

সব আছে তবু হেঁটে যাই অন্ধের মতো বোধশূন্যতায়। যেন এক রক্তকণা ভুল করে ছুটে গেছে চেতনার কোষের গভীরে। তারপরে সব অন্ধকার।

কালো পর্দার এপার আর ওপারের দূরত্ব প্রতিদিন কমে আসছে একটু একটু করে।

তবু প্রার্থনা করি, তোমারই প্রিয়তম ভূমিতে জেগে ওঠো নিষ্পাপ মানুষ। আর একবার।

Tuesday, April 18, 2017

রিপ্রিন্টে পুরোনো বাংলা বই, বাঙালির গবেষণা এবং কয়েকটি দীর্ঘশ্বাস


সাহিত্য পরিষদ লাইব্রেরীতে গেলেই যে ছবিটা চট করে চোখে পড়ে তা হল, অনেক মহিলা ও পুরুষ তাঁদের পেশা হিসেবে অন্যের গবেষণার জন্য পাতার পর পাতা বই ও পুরোনো পত্র-পত্রিকা থেকে টুকছেন, তা বাংলা হোক বা ইংরেজি। এনারা সকলে পাতা পিছু টাকা পান। আর গবেষকেরা ঘরে বসে নিশ্চিন্তে যা টুকে আনে ঠিক বা ভুল তাই দিয়ে গবেষণা করে যান, বই প্রকাশ করেন। তাঁদের নামের জোরে সে সব উতরেও যায় পাঠকের কাছে। এই বই যায় পরবর্তী গবেষকদের হাতে। অতএব বাঙালির গবেষণার হাল কোথায় পৌঁছাচ্ছে তা বেশ বোঝাই যায় (দীর্ঘশ্বাস ১)। গবেষকদের প্রশ্ন করলে জবাব মেলে, অত সময় কোথায়? সত্যিই তো, চাকরি, গ্রান্ট, ডিগ্রী, খ্যাতি, গবেষণার সূত্রে বিদেশ ভ্রমণ - সব দিক সামলে চললে গরু খোঁজার সময় কোথায় তাঁদের? কিন্তু যেনতেন প্রকারেণ গবেষণা করে যাওয়াটা জরুরি। নাহলে আবার অন্যদিকে টান পড়ে যে

আর এইভাবেই গত বেশ কয়েক বছর ধরে হিড়িক পড়েছে বাংলা পুরোনো বইয়ের রিপ্রিন্টের। ভুলভাল টোকায় ভুলে ভরা রিপ্রিন্ট তো চলছিলই (দীর্ঘশ্বাস২)। কিন্তু তারও সুবিধা হয়ে গেল। আন্তর্জালের নানা সাইটে আর ফেসবুকের বিভিন্ন বইয়ের গ্রুপে এখন অনেকেই আন্তরিকভাবে ভালোবেসে বা পুরোনো বইগুলির অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার এবং নিয়মিত চর্চায় রাখার জন্য নিজেদের সংগ্রহ থেকেই হোক বা অন্যের এবং সরকারিভাবেও বিভিন্ন বইয়ের পিডিএফ, ই-পাব আপলোড করছেন। কিছু প্রকাশক, কিছু গবেষক এই সুযোগে হাতে গরম বই পেয়ে ডাউনলোড করে কোনমতে একটা ভূমিকা লাগিয়ে বিক্রি করছেন (দীর্ঘশ্বাস ৩)

বাংলা ভ্রমণ কাহিনির রিপ্রিন্ট নিয়ে আমি কাজ করছি দীর্ঘদিন। তাতে যা বুঝেছি অধিকাংশ গবেষকই যাঁরা ভ্রমণকাহিনি নিয়ে গবেষণা করছেন বা বই রিপ্রিন্ট করছেন, প্রায় সবাই বললেও বিশেষ অত্যুক্তি হবে না হয়তো, নিজে জীবনে ভ্রমণকাহিনি লেখেননি। পড়েছেন নিতান্ত যেটুকু দরকার তার বাইরে একটিও না। অথচ মনে করেন যে সব জানেন (দীর্ঘশ্বাস ৪)!

এই লেখায় আমার দুটি অনুরোধ ১) জাতীয় গ্রন্থাগার এবং সাহিত্য পরিষদের মতো লাইব্রেরীগুলি থেকে টাকা দিয়ে বই টোকানো অবিলম্বে বন্ধ করা হোক।

২) পাঠককে বলি, পুরোনো বইয়ের রিপ্রিন্ট কেনার আগে ভেবে দেখেছেন কি বইটা কেন পড়বেন? কী তার ঐতিহাসিক পটভূমিকা? বই কেনার আগে ভূমিকায় যদি এর উত্তর পান তবেই কিনবেন এটাই আমার পরামর্শ। নাহলে ইন্টারনেটে খুঁজলে মূল বই বিনা পয়সাতেই পাবেন।

তবে কিনা এ দুটোর কোনটাই হবে না আমি জানি। অতএব...(দীর্ঘশ্বাস ৫)।

নবজাতক


তবু এই পৃথিবীতে জন্ম নেয় আর এক নবজাতক।

আমাদেরই পাপে বিষাক্ত মাটি ও আকাশ।

গাছেদের লাশ জমে ওঠে মৃত মানুষের পাশাপাশি।

তবু এই পৃথিবীতে এখনও জন্ম নেয়

আর এক নবজাতক।

মানুষ যখন ধর্ম, ত্রিশূল অথবা চাপাতি বিদ্ধ

করছে অপর এক মানুষের বুকে অথবা

গাছের শিকড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিষ,

কাণ্ডে কুঠারের কোপ - ঠিক তখনি

এই পৃথিবীর কোনওখানে জন্ম নিচ্ছে

জাতহীন ধর্মহীন মানুষেরা - আমাদেরই সন্তান - নবজাতক।

ফিরে এসো

বরং ফিরে এসো।

ঘাস হয়ে

মাটি হয়ে

গাছ হয়ে...।

বরং ফিরেই এসো।

বৃষ্টি হয়ে বা

আকাশ হয়ে।

যেতে তো সকলেই পারে।

Saturday, April 1, 2017

আমার মা সব পারে


জীবনে আমার দুটি দুর্বলতা। এক লেখা আর দুই হিজিবিজি টিফিন বানানো। আমার মেয়েরও রকমারি খাওয়ার ঝোঁক। বাড়িতে নানারকম টিফিন হয়, শঙ্করীদিও বানায়, আমিও। বাকি দুজনের কেউ যদি অন্য কোথাও কিছু খেয়ে এসে বলে বেশ চমৎকার খেলাম। ব্যস, হয়ে গেল।

বীরেনদের বাড়িতে চমৎকার চিলি বেবীকর্ন খেয়ে এসেছিল কদিন আগে। জিজ্ঞাসা করেছিলাম কী করে বানায়? বলল, আমি কী জানি, নেটে পেয়ে যাবে বলে ল্যাপটপে খুঁজে বের করে দেখাল।

সেই থেকে তাল করছি। বিকেলে বেলের সরবত শেষ করার পর হাঁক পারলাম বেবীকর্নের রেসিপিটা বলতো, ফ্রিজ থেকে বের করে রেখেছি।

মেয়ে বলল, 'তুমি নিজেই তো দেখে নিতে পার।'

বললাম, আমিই যদি সব করব...

রেসিপি বেরোলো। একবার চোখ বুলিয়েই বুঝেছি, বুঝেছি বলে রান্নাঘরে হাওয়া।

আসলে রেসিপি ধরে রান্না করা আমার স্বভাব নয়, বেসিকটুকু পড়ে নিয়ে নিজের কল্পনা না মাখালে আর লেখক থুড়ি টিফিনকার কিসের? মানে ওই গল্পকারের কাছাকাছি আর কী।

কী আশ্চর্য সেলারি নেই বলে সবুজ সবুজ বিনস দিতে যাইনি, পুড়িয়ে ফেলে ম্যানেজও করিনি...

একবারেই পুরোপুরি সফল!

অন্তত পাঠকেরা থুড়ি বাবা-মেয়ে-শঙ্করীদি তাই বলল। নিজের কথা নাহয় বাদই দিলাম।

আরে দূর রেসিপি দিয়ে কী হবে? ও হয় সবাই জানে নয় নেটে পাওয়া যাবে। বাকিটা মাথা ঘেঁটে।

মেয়েকে বললাম, এই রান্নার নাম কী বলতো?

- কী?

- 'আমার মা সব পারে।'

পুঃ যাঁরা হাতে গরম রেসিপি চাইছেন -

আপনি তো জানেন যে মেয়েকে পরীক্ষায় দিতে-নিতে আসার সময় টালিগঞ্জ মেট্রোর সামনে থেকে বেবীকর্ন কিনেই ছিলেন। নাহয় কিছুটা খরচই হয়ে গেছে। আপনি তো আর এটা করবেন ভেবে কেনেননি। আর আজকে বাজার আসামাত্র আপনার চোখে পড়েছে একটা বড়সড় ক্যাপসিকাম রয়েছে। বেবীকর্ন তিন কী চার টুকরো করুন আর সেইমাপের আন্দাজে ক্যাপসিকাম সরু বা মোটা করে কাটুন।

এরপর আর কী আদা,রসুন, লঙ্কা, পেঁয়াজ কেটে নিয়ে লেগে পড়ুন। ওহো পেঁয়াজ কিন্তু রিঙপিস হবে, ওই আদা-রসুনের মতো কুচিয়ে ফেলবেন না। এইসব রেসিপিতে থাকবে না। আরে না থাকলেই বা কী, আপনার মাথা বলে তো কিছু থাকবেই।

এরপর একটা পাত্রে জল ফুটে উঠলে গ্যাসটা অফ করে আধ মিনিট বেবীকর্নগুলো ভিজিয়ে তুলে ঠান্ডা করে নিন।

তারপর যেমন ধরুন এক জায়গায় লিখেছে ময়দা আর কর্নফ্লাওয়ারে শুকনো শুকনো মাখিয়ে তেলে ফেলুন আর আরেক জায়গায় কিছুটা গোলা বানিয়ে। দেখুন জীবনে মঝ্যিম পন্থা হচ্ছে আদর্শ, সেই কবেই বুদ্ধদেব বলে গেছেন। অতএব বেবীকর্নটা শুকনো মেখে জল ছিটিয়ে খানিক আঠা আঠা মতো করে নিন। আপনার শ্যাম ও কূল দুই-ই রইল। আর নিজের কায়দার জন্য না বলা সত্ত্বেও ফ্রিজে যখন চালের গুঁড়ো আছে, দিয়ে দিন, আটকাচ্ছে কে? আরে আমি প্রথমে নুন দিতে ভুলেছিলাম বলে আপনিও যেন ভুলে যাবেন না।

এবারে একটু ডুবো তেলে বেবীকর্নগুলো বাদামী করে ভেজে তুলে রাখুন। কড়াই থেকে অতিরিক্ত তেল বাটিতে ঢেলে রেখে অল্প তেলে আদা-রসুন কুচি, লঙ্কা, পেঁয়াজ, ক্যাপসিকাম ভেজে নিয়ে টম্যাটো সস, সয়া সস, গোলমরিচ গুঁড়ো, নুন, মিস্টি দিন। ওর মধ্যে বেবীকর্নের বড়াগুলো দিয়ে নাড়িয়েচাড়িয়ে ক্যাপসিকাম সেদ্ধ হয়ে গেলে নামিয়ে ফেলুন।

হয়ে গেল আপনার চিলি বেবীকর্ন। হল তো?

ব্যক্তিগত অক্ষরমালা


সবাই বিপ্লবের কথা বলবে এমনটা নয়;

কেউ কেউ নিভৃতে ভালোবাসার গানও গাইবে।

জেনে রাখো, সকলেই মিছিলে হাঁটবে না।

হয়তো ভাতের থালা নি:শব্দে তুলে দেবে

অন্য কারোর মুখে।

প্রতিবাদী লিফলেটের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি না তুলে

উঠোন জুড়ে একান্তে বুনে যাবে গাছ -

তোমারই শ্বাস নেওয়ার জন্য।

ঋণ


কারো কারো কাছে

কিছু ঋণ থাকে -

জল, মাটি, গাছের মতন

যারা বাঁচিয়ে রাখে।

শরীরের ঋণ কিছু

কিছু অশরীর -

শব্দ-অক্ষর-বাক্য

প্রিয় নদীটির তীর।

চেনা পথ,

বাগানের রোদ্দুর;

বাড়ানো হাত ছিল

যে বন্ধুর।

আর যে পাখিটা

শুনেছিল মনখারাপের কথা -

কিছু ঋণ তারও কাছে

এ জীবনে রাখা আছে।

কিছু কিছু ঋণ

আজীবন থাকা ভালো -

অন্ধকারে যে তোমাকেই

একান্তে দিয়েছিল আলো।

ঋণ


বন্ধুর বাড়ানো হাতে কি ঋণ থাকে?


তাহলে তো কতকিছুর কাছেই এ জীবনের ঋণ। ওই যে মাটির ওপর পা রেখে হেঁটে গেছি ছেলেবেলা থেকে। মন আলো করে দেওয়া রঙ্গন গাছটা। বাগানের রোদ্দুর। স্টেশনের সিটগুলো। ওভারব্রিজটা - যার তলা দিয়ে ঝমঝম করে রেলগাড়িগুলো যায়। ওই যে অজয়ের তীর। যে সব গাছের কাছে, পাখির কাছে মনের কথা বলেছিলাম, তার ঋণ?

শব্দের ঋণ, অক্ষরের ঋণ, বাক্যের ঋণ, সুখের ঋণ, অসুখের ঋণ!

আর কিছু না থাক। কিছু ঋণ থাকা ভালো কারো কারো কাছে। এ জীবনে যারা জল, মাটি, গাছের মতো বাঁচিয়ে রাখে।