Monday, October 31, 2016

ল র ব য হ - জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ - সুকুমার রায়

"মনে কর, অনেকদিন ধরে চুপ করে থাকতে থাকতে ফেসবুকে হঠাৎ যদি সব আওয়াজ শোনা যেত, কম্পিউটারগুলো সেই প্রবল হাসি, কান্না, গান, চিৎকারে বিষম খেত, আর মানুষগুলো সেই দেখেশুনে একেবারে বোবা হয়ে যেত..."
- এই বলে সে আবার ভীষণ কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল।
আমি বললাম, "কী আশ্চর্য! এরজন্য তুমি এত ভয়ানক মনখারাপ করছ?"
সে এবার হাসিমুখে বলল, " না, না, শুধু এরজন্য নয়। মনে কর একজনের প্রোফাইলের একদিকে ছিল পিকচার আর একদিকে ভিডিও। দুটোই জ্যান্ত হয়ে ভিডিওগুলো পিকচার হয়ে গেল আর পিকগুলো ভিডিও - ভ্যাঁ ভ্যাঁ, ভ্যাঁ, ভ্যাঁ, আ: আ: আ: আ: -" আবার কাঁদার পালা।
আমি বললাম, " কেন তুমি এই-সব অসম্ভব কথা ভেবে খামোকা কেঁদে-কেঁদে কষ্ট পাচ্ছ?"
সে বলল, "না, না, সব কি আর অসম্ভব? মনে কর, একজন নিয়মিত লেখে, রোজ তারপরে লাইক, কমেন্ট দিতে দেয়, একদিন দেখল কতগুলো ইমোজি এসে সব লেখা মুছে ফেলেছে - ভ্যাঁ ভ্যাঁ ভ্যাঁ ভ্যাঁ - "
জন্তুটার রকম-সকম দেখে আমার ভারি অদ্ভুত লাগল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "তুমি কে? তোমার নাম কি?"
সে না ভেবে বলল, " আমার নাম গুগল। আমার নাম গুগল, আমার ভায়ের নাম গুগল, আমার বাবার নাম গুগল, আমার পিসের নাম গুগল -"
আমি বললাম, তার চেয়ে সোজা বললেই হয় তোমার গুষ্টিসুদ্ধ সবাই গুগল।"
সে আরোই না ভেবে বলল, " তা তো নয়, আমার নাম ক্রোম। আমার মামার নাম ক্রোম, আমার খুড়োর নাম ক্রোম, আমার মেসোর নাম ক্রোম, আমার শ্বশুরের নাম ক্রোম -"
আমি হেসে বললাম, "সত্যি বলছ? না বানিয়ে?"
জন্তুটা একটুও থতমত না খেয়েই বলল, " না, না আমার শ্বশুরের নাম জুকেরবার্গ।"

আমার ভয়ানক হাসি পেল, তেড়ে বললাম, "একটা কথাও অবিশ্বাস করিনা।"

Thursday, October 27, 2016

পুড়ছে

কোথাও কিছু পুড়ছে।
ছাইয়ের গন্ধ বাতাসে
কাগজের মতো উড়ছে।
পুড়ছে, কেবল পুড়ছে।
ছাইয়ের গন্ধ শূন্য হৃদয়ে
বেদনার মতো উড়ছে।
পুড়ছে, তোমার-আমার জীবনে
চিরকালই কিছু পুড়ছে।
ছাইয়ের গন্ধ বাতাসে
উড়ছে, কেবল উড়ছে।

সেইসব শব্দ অক্ষর বর্ণমালারা...

শব্দের কি অশ্রু থাকে? বর্ণমালার চোখে কাজলের দাগ? কবিতার ঠোঁটে অভিমানের কুঞ্চন? বেদনার আভাসে তারা ভাসে কি মেঘমালায়? অথচ এইসব প্রশ্নের উত্তর তার সেই লন্ঠনের আলোর রেখায় এঁকে কবেই হারিয়ে গিয়েছিল পাগলের প্রলাপ আঁকা বনে। যার মুঠোয় ছিল বৃষ্টির হীরে-মানিক কুচি।

বাজে বাজে রম্যবীণা

মা সুর বাঁধছে তানপুরায়। হারমোনিয়ামটা আগে বাজিয়ে নিচ্ছে। তানপুরার একেকটা কান ধরে আলতো মোচড়। একটা শব্দ তারপর তারের আওয়াজ। না, ঠিক লাগছে না, মাথা নাড়ছে না বাচকে, তারপর তানপুরার লাউয়ের খোলার ওপরে আটকানো কড়িগুলো আলতো করে এগোচ্ছে, পেছোচ্ছে। চুপ করে বসে দেখছি। মাথায় আঁকছি হয়ত ছবিটা। অথবা দুষ্টুমি করে আঙুল ঢুকিয়ে দিচ্ছি হারমোনিয়ামের পেছনের কাপড় লাগানো গোল গোল ফুটোগুলোয়। উলটোদিকের বেলোটা খুলে দিচ্ছি কখনও। মা বারণ করছে সুর বাঁধতে বাঁধতে। আর আমি ভাবছি কখন ওই হলুদ তারটা বাঁধা হবে আর টঙ করে আওয়াজটা কানে আসবে। ওটা আমার খুব প্রিয়। তারপরে মা হয়ত আমাকে বাজাতে দেবে তানপুরাটা। নিজে হারমোনিয়ামটা নেবে। অথবা শুধু তানপুরা বাজিয়েই গান হবে, মা-ই বাজাবে হয়ত। আমি তো সুর শুনে খালি গলায় তুলে নিতে পারি যখন তখন, কিন্তু বাজনায় রপ্ত করতে কঠিন লাগে। সেপটিক টনসিল বারবার। পরীক্ষক বলেছিলেন, গাইলে একমাত্র এই মেয়েটারই হবে।
'বাজে বাজে রম্যবীণা বাজে...'

মা দোতলায় গান শেখাচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের। ওরা কেউ তুলতে পারছে না। কতবার ভেঙে ভেঙে শেখাচ্ছে মা - 'তোদের রথের চাকার সুরে আমার সাড়া পাইনি গো পাইনি...।' সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে গাইছি মায়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে, 'তরীতে পা দিইনি, আমি পাড়ের পানে যাইনি গো যাইনি...।'
বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। 'আমার নিশীথ রাতের বাদলধারা...' আর অন্ধকারের অন্তরধন আমার প্রাণমন ঢেকে দিচ্ছে। আমার চোখে জল - 'আমি চাইনে তপন, চাইনে তারা...।'

মীরার ভজন গাইছে মা, ' চাকর রহসু বাগ লাগাসু, নিশদিন দরশন পাসু, বৃন্দাবন কী কুঞ্জবনমে তেরে লীলা গাসু' - আর আমি দেখতে পাচ্ছি অবন ঠাকুরের রাজকাহিনির মতো মীরা চাবির গোছাটা সেই রাজপুত প্রেমিকের হাতে তুলে দিচ্ছে - প্রেম না করলরে, বিনা প্রেমসে, প্রেম না মিলল রে। ওই তো পথে নেমে গেল মীরা। মায়ের গলায় ভেসে আসছে - 'তাত মাত বন্ধু ভ্রাত আপনান কোঈ...'। ওদিকে কবীরের সুর শুনছি - 'মন মোহি গঙ্গা মন মোহি যমুনা, মন মোহি ধ্যান করে...।' ঈশ্বর মিলেমিশে যাচ্ছেন না ঈশ্বরের সঙ্গে, ভালোবাসার সঙ্গে। জন হেনরির সুরেও তখন তাঁকেই শোনা যায়।

খুব মনখারাপ মনখারাপ। স্কুলে বড্ড কষ্ট। শরীরও খুব খারাপ। আর লড়তে পারছি না। মা গান শেখাচ্ছে, 'জানে গুণি গুণকো নিরগুণ কেয়া জানে, জানে বলি বল কো, নিরবল কেয়া জানে?' সত্যিই তো ওরা কী জানে কেমন করে ভারতবর্ষের ''-এর থেকে বেরোনো যায় না। আমার হাত গোল্লাটায় ঘুরতে থাকে, ঘুরতেই থাকে, এবারে ঠিক তুলে পরের অক্ষরটা লিখতে পারব, ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যাচ্ছে...'জানে হরি বল গজ মুশক কেয়া জানে...'

বহু বছর পর কানের কাছে বাজতে থাকে - হাউ মেনি রোডস মাস্ট এ ম্যান ওয়াকড ডাউন...

Wednesday, October 19, 2016

ভাবছিলাম

একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। একটি মেয়ে দৌড়তে চেষ্টা করছে অথচ কিছুতেই এগোতে পারছে না। অথচ তার পিছনে কেউ তাড়া করে আসছে।

চোখ খুলেও চারপাশে তাই দেখতে পাচ্ছি।

কেন এগোতে পারছে না, প্রশ্নটা এখানেই।

শুধু পুরুষের দিকে আঙুল তুললেই হবে না। ধর্ষণ না হোক, অধিকাংশ বধূহত্যার সঙ্গে জড়িত থাকে মেয়েরাও।

আসলে তারাও ওই এগোতে না পারা...।

অক্ষর অথবা ডিগ্রি কোনও শিক্ষা দেয়না, হয়ত লাঠিখেলা জানত যেসব মেয়েরা এককালে তাদের মানসিক অবস্থান এর চেয়ে ভালো ছিল।

চিরকালই মরে এসেছে। অথচ এখন তো অনেক সহজে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছনো যায়। বেরিয়েও আসা যায় সহজে সামাজিক বন্ধন থেকে।
তাহলে মুখ বুজে মরে কেন?

কেন এগোতে পারছে না, আসলে প্রশ্নটা সেইখানেই।

নিজেদেরও প্রশ্ন করা উচিত বইকি। অন্য কারোর দিকে আঙুল তোলাটা ক্রমশ দায় ঝেড়ে ফেলা হয়ে আসছে যে।

মানুষ খারাপ হয়, ভালো হয়। যে কোনও মানুষ।

কিন্তু আমরা এগোতে পারছি না কেন?


আর একটা চিরন্তন প্রশ্ন তো রয়েই যায় মানুষ খুন করে কেন? ধর্ষণও।

শৈশব

দুপুরের জটিলতা আঁকতে পারিনা। শব্দেরা জন্ম নেয় শেষ রাত্তিরের নির্জনে অথবা ভোরের আলোয়। শিউলি ফুলের মতো লাল বোঁটার লাজুক অক্ষর কুড়োতে কুড়োতে পৌঁছাই রেলব্রিজের নীচের সেই কাশবনে। ছবিতে দেখেছিলাম। চলে যাওয়া যে রেললাইনের গায়ে লেখা আছে ছেলেবেলা।

তোমাকে দেখছিলাম

মেঘ ছিল না। অথচ লাল-নীল অভিমানী বেলুনগুলো উড়ছিল আকাশে। মুঠো খুলে ভাসিয়ে দিতে দিতে হাঁটছিল একা। সমুদ্রের ঢেউ পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিয়ে আপনমনে হেসে উঠছিল বারবার। এলোমেলো হাওয়া চুল সরিয়ে চিবুকের ঘাম মুছে ক্লান্ত চোখের পাতা বেয়ে নামছিল সাদা জামায়। বৃষ্টির হীরে-মানিক কুচিরা রোদ্দুরের প্রিজম আঁকছিল তার মুখের পরে, বুকের পরে।

খুব কাছেই কবিতারা কাটাকুটি খেলছিল দিগন্তে  - ছুঁতে পারা আর না ছোঁয়ার ব্যবধানে।

বিসর্জন

না, আমি রিজওনুরের জন্য পথে হাঁটিনি। কারণ হাঁটতে গেলে পথেই থাকতে হয়, ঘরে ফেরা যায় না। ভারতবর্ষের নানা রাজ্যে কত রিজওনুর মরছে প্রতিদিন, কে তার খবর রাখে?

মিতার জন্যও কোনও পিটিশনে সই করিনি। তাহলে এই কদিনে কাগজে এক কলাম, দেড় কলাম ভরালো যে ধর্ষিত, খুন হওয়া, অ্যাসিডে পুড়ে যাওয়া মেয়েগুলো তাদের জন্যও কোনও পিটিশন পেলাম না কেন? আর ওই যে আপনার পাশের গলির মেয়েটি, কাগজে যার নাম আসেনি, যার মৃত্যু দু-চারজন কাছের মানুষ ছাড়া কাউকে নাড়া পর্যন্ত দিল না, তারজন্য?


পিটিশন, মোমবাতি, হাঁটাহাঁটি সব মৃত্যুর পরে হয়। বেঁচে থাকতে থাকতেই কিছু করুক মেয়েগুলো অথবা তার পরিচিত, অপরিচিত জনেরা। এখনও তো অনেকেই বিসর্জনের অপেক্ষায় রয়েছেন।

পূজা করি মোরে রাখিবে উর্ধ্বে সে নহি নহি...

দিনচারেক পুজো করে মাথায় তুলে রেখে তারপর দুম করে আক্ষরিক অর্থেই এই 'জলে ফেলে দেওয়া'র কোনও মানে হয় যুগ যুগ ধরে?


কবে যে দুর্গা কোমরে আঁচল থুড়ি স্টোল গুঁজে আমাকে আমার মতো থাকতে দাও বলে ছেলেমেয়ের হাত ধরে মন্ডপ থেকে গটগট করে নিজেই নেমে আসবেন বোধন কী ফিতে কেটে মন্ত্রীর উদ্বোধনের আগে তার প্রতীক্ষায় আছি।

চিড়িয়াখানা!

খোলা জঙ্গলে প্রথম জীব-জন্তু দেখি গরুমারায়, ডুয়ার্সে। মনে পড়ে ওয়াচটাওয়ার থেকে মানুষের সম্মিলিত চিৎকার - 'গণ্ডার গণ্ডার'। শুনতে শুনতে ভাবছিলাম ওই জন্তু-জানোয়ারেরা যদি কখনও মানুষ দেখতে আসে তবে কেমন হয়? কলকাতার কোনও ওয়াচটাওয়ার থেকে চিৎকার করবে তাদের নিজস্ব ভাষায় - 'মানুষ, মানুষ'!

বেঙ্গালুরুর বানারঘাট্টা ন্যাশনাল পার্ক এক অর্থে অনেকটাই চিড়িয়াখানা। নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে জীবজন্তুদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত। তবে জু বলতে যা বুঝি, সেই অংশটা আবার আলাদা। এইদিকটায় খোলা জঙ্গলে সাফারি হয়। ভাল্লুক, হরিণরা মানুষের পক্ষে তুলনায় নিরাপদ বলে তাদের সামনে খাঁচার আড়াল নেই। রাস্তার ধারেই তাদের খেতে দেওয়া হয়েছে যাতে দর্শকেরা দেখতে পায় সহজেই। এ যেন রঙিন পোশাক আর সাজে খদ্দের ধরানোর চেষ্টা। আর অন্যদিকে বাঘ-সিংহেরা আমাদের মতোই জালের আড়ালে। দর্শকদের আমোদের জন্য একেকটা বাঘকে একেকসময় খাঁচার বাইরে খোলা জায়গায় খানিকক্ষণ ছেড়ে দেওয়া হয়।

সাফারিতে নিয়ে যাওয়া হয় জাল দেওয়া বাস বা জিপে। ভেতরে বসে থাকলে মনে হয় যেন আমরাই খাঁচার ভেতরে, আর ওরা বাইরে। মেয়েকে বলছিলাম, নিশ্চয় ওরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে, সেই দু'পেয়ে জন্তুগুলো আবার এসেছে রে। কী অসভ্যের মতো চিৎকার করে আর কী সব আমাদের দিকে তাক করে! কই আমরা তো ওদের বিরক্ত করিনা? ছেড়ে রাখা বাঘটা আগেপিছে থাকা দুটো বাসের মাঝখানে পায়চারি করে দেখছিল আমাদের বেশ কিছুক্ষণ। শেষে খানিক ধুত্তোর ভঙ্গীতে নেমে গেল পাশের রাস্তায়।

একবার কাজিরাঙ্গা থেকে বেরিয়ে আসার সময় এক হরিণের চাহনি দেখে আমাদের মনে হয়েছিল, যেন এটাই ভাবছে যে কতক্ষণে এরা বেরিয়ে যাবে আর আমরা একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচব।

খাঁচার ভেতর থেকে ওদের দেখছিলাম। অথবা খাঁচার বাইরে থেকে ওরা আমাদের। ভাবছিলাম, ন্যাশনাল পার্ক বা অভয়ারণ্য এইসবও তো সেই নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যেই থাকা। আসলে সবই তো সেই মানুষের সৃষ্ট লক্ষণের গন্ডি - যাকে আমরা ওদের স্বাধীনতা বলি।

আসলে আমরা তো নিজেদেরও বেঁধেছি 'দেশ' নামক লক্ষণের গন্ডিতে। 'ধর্ম' নামক অভয়ারণ্যে বাস করি আমরা। 'সমাজ' নামক ন্যাশনাল পার্কে।


যেদিন কারোরই কোনও ক্ষমতার সীমায়ণ ছিল না, আমরা স্বাধীন ছিলাম অন্যান্য জন্তুজানোয়ারদের মতোই। এখন আমরা দেশ ধর্ম সমাজের জাল দেওয়া যে যার 'চিড়িয়াখানা'য় থাকি। সেখানে কে যে কাকে দেখে সেটাই ভাববার।

জটায়ু উবাচ

'ঘেন্না ধরে গেল মশাই, দেশের যেখানেই যাই, কোথাও আমাদের মতন এমন শহরজুড়ে মুখ্যমন্ত্রীর বিজ্ঞাপন চোখে পড়েনা।' - এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে বাসে করে বেঙ্গালুরু শহরের দিকে আসতে আসতে মন্তব্যটা করলেন লালমোহনবাবু। 'এই তো গত পুজোর সময় লাদাখ গেসলাম, আর এই পুজোয় বেঙ্গালুরু - দেখুন তো কেমন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শহর, গাড়ি, বাস, অটো দিব্য চলছে সাঁ সাঁ করে।'

'কেন ওড়িশা তো একদম ঘরের পাশেই। কদিন আগেই তো পুরী ঘুরে এলেন' - চারমিনার থুড়ি গোল্ডফ্লেক-এ একটা টান দিয়ে ধোঁয়ার রিঙটা ছেড়ে মন্তব্য করল ফেলুদা। গোল্ড ফ্লেকে ঠিক চারমিনারের মতো আমেজ নেই, ফেলুদা বলে। তবে পরিবর্তন তো মেনে নিতেই হয়। এটাও অবশ্য ওরই মন্তব্য।

মোবাইলে টেম্পল রান টু খেলার ফাঁকে ফেলুদার সিগারেটের মিলিয়ে যাওয়া রিঙগুলো দেখতে দেখতে ফুট কাটলাম, আর গ্যাংটকের কথা ভুলে গেলে ফেলুদা?

গড়পাড় থেকে রজনীসেন রোড আসতে গিয়ে ষষ্ঠীর দিন বিকেলেই জ্যামে ঝাড়া আড়াই ঘন্টা আটকে ভয়ানক চটেছেন লালমোহনবাবু। তারপর গড়িয়াহাট থেকে নাকি গাড়ি আবার ঘুরিয়ে দিয়েছিল পুজোর উদ্বোধনের জন্য। অমন ঠান্ডা মেজাজের হরিপদবাবু শুদ্ধু দেখি আপনমনে গজগজ করছেন।
'ধুর মশাই 'কলকাতায় কুরুক্ষেত্র' ছাড়া আর কোনও লেখাই মাথায় আসছে না। নার্ভগুলো সব গেছে।' অনেকদিনধরেই অবশ্য ডাক্তার দেখাতে বেঙ্গালুরু যাওয়ার কথা বলছিলেন। পরামর্শটা ফেলুদারই। ইদানীং যেরকম ব্যথা-বেদনা হয়ে মেজাজ খারাপ করছেন, তাতে একবার নিমহানস-এ না দেখিয়ে এলে সত্যিই কী কুরুক্ষেত্র করবেন কে জানে! কলকাতার কোনও ডাক্তারেই নাকি কিছু করতে পারছেনা।

তবে আমাদের কোনও মন্তব্যই অবশ্য গায়ে মাখেননা তিনি - 'আরে মশাই, দু-দুবার স্বয়ং মগনলাল পর্যন্ত কিস্যু করতে পারলনা আর রোগ-বালাই!' বেশ জোর গলাতেই বললেন।

পুজোর কদিন আমারও ছুটি। অতএব ষষ্ঠীর দিন যখন জেট এয়ারের তিনটে টিকিট পকেট থেকে বার করে সোফায় ধপ করে বসে পড়লেন বুঝলাম, একেবারে বেঙ্গল থেকে বেঙ্গালুরু যাত্রাটা পাকা করেই বেরিয়েছেন।


অতএব...।

Thursday, October 6, 2016

আমাদিগের ভ্রমণবৃত্তান্ত

ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি ভারতবর্ষে রেল চালু হল। তার আগে বাঙালি মেয়ে তীর্থে বেরোলেও তার কোনও লিখিত দলিল চোখে পড়ে না। এই শতকের সত্তরের দশকে এক বাঙালি মেয়ে বম্বাই' বেড়াতে গিয়ে লিখল তার ভ্রমণকাহিনি আমাদিগের ভ্রমণ বৃত্তান্ত'। লেখিকার নামের উল্লেখ ছিল না। তার আগেই অবশ্য ষাটের দশকে বামাবোধিনী'পত্রিকা প্রকাশের তিনমাসের মধ্যেই কবিতায় ভ্রমণকথা লিখেছিল বাঙালি মেয়ে রমাসুন্দরী।

একবিংশ শতকের শুরুতে মফঃস্বলের এক বাঙালি মেয়ে লিখতে শুরু করেছিল ভ্রমণকাহিনি। নিজের ভ্রমণকথা লিখতে লিখতে আর ভ্রমণ পত্রিকার সম্পাদনা করতে করতে তার মনে প্রশ্ন জাগে আমার আগে কারা লিখেছিল,কোথায় গেল সেইসব লেখা?

এর উত্তর খুঁজতে বিভিন্ন লাইব্রেরিতে,বইমেলায় এবং আরও নানা সম্ভাব্য, অসম্ভাব্য জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে গড়ে ওঠে আর এক ভ্রমণকাহিনি আমাদিগের ভ্রমণবৃত্তান্ত'

উনিশ শতকের বাঙালি নারীর বাড়ির বাইরে এবং বহির্বিশ্বে পা রাখার কাহিনি উঠে আসে একুশ শতকের বাঙালি মেয়ের কথায় ও তাদের নিজের লেখা কাহিনি'তে।


এরই প্রথম পর্ব প্রকাশিত হ গাঙচিল' প্রকাশনা থেকে। অসংখ্য ধন্যবাদ অধীরদাকে।

কাহিনির নির্মাণ অথবা কিছুই না

তাকে সকলেই একসঙ্গে দেখতে পেয়েছিল অথবা কেউই পায়নি। সকলেই শুনতে পেয়েছিল অথবা ভেবেছিল পেয়েছে।

সে নারী অথবা পুরুষ অথবা যে কোনও কিছুই। তার কোনও অবয়ব ছিল অথবা ছিল না।

কথাটা শুনেছিল সকলেই অথবা ভেবেছিল।

কেউ কেউ প্রশ্ন করেছিল, কেন? অথবা তুমি কে?

কেউ বলেছিল, যদি না বলি?

সবাইকে একটা করে ধারণা ভাবতে হবে অথবা গল্প। তাও না পারলে কোনও সূত্র।

তোমরা সবাই আমার চরিত্র। উত্তর না দিলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সবচেয়ে ভালো উত্তরটা নিয়ে একটা কাহিনি লেখা হবে। কাহিনির চরিত্রেরা কখনও মারা যায় না।

কী করে বুঝব সত্যি না মিথ্যে? আবারও প্রশ্ন করেছিল কেউ কেউ। অথবা এইসবই ছিল তাদের ভাবনার মধ্যে প্রশ্ন এবং উত্তরগুলো।

নতুন কিছু বলতে হবে যা কখনও লেখা হয়নি।

আমি গল্প ভাবতে পারি না একজন চিৎকার করে উঠল।

জীবনকে ভাব। কে যেন উত্তর দিল কানে কানে।

জীবন খুব সাধারণ। আমরা ব্যতিক্রমী নই। বলে উঠল অনেকগুলো কন্ঠস্বর।

ব্যতিক্রমী হলেই কি অন্যরকম হয়? খোঁজো।

যদি চেনা গল্প অন্যভাবে বলি। যদি মিশিয়ে দিই সাদা-কালো, ধর্ম-অধর্ম।

সেটা তোমার পছন্দ।

এক মুহূর্তের নিরবতা। তারপর কেউ প্রশ্ন করল কিন্তু বলব কাকে? কে তুমি?

নিজেকে বল। নিজের কাছে বল। আমি সব শুনতে পাই। সব দেখতে পারি।

শালা, নিজেকে ঈশ্বর ঠাওড়াচ্ছে - কে যেন বিরক্ত গলায় হিসহিস করে উঠল।

ঈশ্বর তো যে কোনও কেউ হতে পারে যদি চেষ্টা কর।

ধপ করে বসে পড়ে লোকটি।

সে একজন সাধারণ মানুষ। বলে চলেছিল তার আপন কাহিনি, রাগে, ক্ষোভে, চোখের জলে, আনন্দে।

এ তো রোজকার গল্প। এ আবার নতুন কি? যে এগিয়ে এসেছিল সে ছিল একজন সৈনিক। সীমান্তের পাহারাদার। তার ঝুলিতে সব রোমাঞ্চকর ঘটনা।

কথা বলতে বলতে বদলে যাচ্ছিল ঘর বাড়ি, দৃশ্যপট। এমন কী চরিত্রেরাও।

এরপর কে এগিয়ে আসবে অথবা মুখ বুজে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এমনটা ভাবছিল অনেকেই। অথচ তারা যে কোনও কেউই সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে খাদের ধারে বা পাহাড়ের মাথায়, বুঝছিল না। অথবা বুঝতে পারছিল কিন্তু ভাবতে চাইছিল না।


আমি এদের সকলকেই দেখছিলাম অথবা দেখছিলাম না, নির্মাণ করছিলাম। অথবা এর কোনটাই আসলে সত্যি ছিল না।

ভাবছিলাম...

রাষ্ট্র, সাম্প্রদায়িকতা, যুদ্ধ এসব যেমন সমাজে শ্রেণী ব্যবস্থাকে ইন্ধন দেয় তেমনই দেয় বিপ্লব। কোনও সফল বিপ্লবের পর যখন রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতবদল হয় তখন যা হতে থাকে তা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। অতএব আবারও হাত বদল। আসলে ক্লাসলেস সোসাইটি হলে এর কোনটাই বাঁচে না, এমন কী বিপ্লবও।


একমাত্র এর বিকল্প মানুষে মানুষে ভালোবাসা এবং সকলের জন্য শিক্ষা। এই বিষয়গুলিই এড়িয়ে যায় যে কোনও রাষ্ট্রযন্ত্র। তারা ইন্ধন দেয় সাম্প্রদায়িকতা, যুদ্ধ অথবা বিপ্লবে।

তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল?

আমার কোনও দেশ নেই অথবা ধর্ম। অতএব দেশভক্তির প্রশ্নই ওঠেনা। তার থেকে মানুষের মৃত্যুর দু:খ আমার কাছে বড়, সে যে দেশ, যে ধর্মেরই মানুষ হোক, যে সীমান্তেরই। তাকে যে আপেক্ষিকে জঙ্গি বা দেশপ্রেমী আখ্যা দেওয়া হোক না কেন।

ইদানীং কাগজ পড়তেও আর ইচ্ছে করেনা। টিভি দেখা তো কবেই ছেড়েছি।

না, আমি যুদ্ধ চাইনা। কারণ আমি উলুখাগড়াদের একজন। আমার বা আমার নিকটজনদের মাথার ওপরে বোমা এসে পড়লে বা আমরা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেলে রাষ্ট্রযন্ত্রের কিচ্ছু যায় আসেনা।


না, আমি যুদ্ধ চাইনা। কারণ চিরকালের মতোই মানুষের মধ্যে এই বিভেদ কিছু স্বার্থ্যান্বেষী মানুষের বানিয়ে তোলা। বানিয়ে তোলা অভাবের মতোই। সাধারণ মানুষ পেটের ভাত চায়, মাথার ওপর ছাদ চায়, গায়ে কাপড় চায়; বিলাসীতা বা অর্থনৈতিক রাজনৈতিক আধিপত্যের আগে। তাদের কাছে ওই মন্ডা-মিঠাইয়ের হাঁড়িটাই জরুরি।