Friday, December 29, 2017

বছরশেষে


কিছুতেই পৌঁছেতে পারি না আকাঙ্ক্ষিত শব্দের কাছে। শুধু পুড়ে যাই

শব্দের ঘরবাড়ি বানাই, সিঁড়ি আঁকি মুঠো ভরি শব্দের বৃষ্টিফোঁটায়।

তবু পারি না

দিনশেষে, বছরশেষে দেখি শূন্য খাতা, অর্থহীন আঁকিবুকি কাটা।

পৌঁছতে পারি না আকাঙ্ক্ষিত শব্দের কাছে

তবু লিখি, লিখে যাই পুড়িপুড়ে যাইএবং রক্তপাতে।

Friday, December 1, 2017

চিত্রকর


কত যে ছবি আঁকে চেনা মানুষ

কাগজে কলমে আর ক্যানভাসে;

আমিও চিত্রকর অচেনা এক

কী যেন খুঁজে ফিরি কোন আশে!

তুলির টানে সাজে শব্দেরা

বর্ণমালারা আঁকে ছেঁড়া চাদর,

রঙের ঝাপটা কালো আঁকিবুকি

গদ্য-কবিতায় ভরা আদর।

কত যে ছবি আঁকে চেনা মানুষ

শব্দ আলো জ্বালে সাদা খাতায়;

আমি যে চিত্রকর অচেনা এক

সামিল হয়েছি আজ সেই হাঁটায়।


বিষণ্ণতার তুলির রেখা


শীতের বেলার হাতে একটা বিষণ্ণতার তুলি আছে। রোজ সে দুপুরের ঝলমলে রোদ্দুরের ক্যানভাসে এক একটা তুলির টান দেয় আর একটু একটু করে রোদ্দুর মুছে সন্ধ্যা নেমে আসে। একেবারে শেষে বেশ কিছুটা অন্ধকার নিয়ে ঝুপ করে বুলিয়ে দেয় যেন। আর অমনি একটা ঠান্ডা মনখারাপ চেপে বসে বুকের ঠিক মধ্যিখানে। কখন অন্ধকার হয়ে যায়।

পতাকাহীন


লেকটাউনের মুখে এসে দেখি একদল মানুষ চলেছে মিছিল করে। অনেক মানুষ। অথচ তাদের হাতে কোনও পতাকাও নেই, মুখে কোনও স্লোগানও নেই! নিজেরা হাসতে হাসতে গল্প করতে করতে চলেছে। কেউ বা চুপচাপ। অথচ মিছিল করেই যাচ্ছে।

ভারী আশ্চর্য লাগল। ঠাওর হল না কিচ্ছু। নাহ, বিয়েবাড়ির দল, পুজো কিছুই না। স্রেফ পতাকাহীন একটা মিছিল কেমন আমাকে পেরিয়ে চলে গেল। একটুু এগোতে আবার একটা দল। এটা একটু ছোট অবশ্য।

ভাবি, অনেকদিন পর মানুষের মিছিল দেখলাম! এমন কেন হয় না লাল নীল গেরুয়া সবুজ সব পতাকা ফেলে মানুষ শুধু মানুষ হয়ে পথে নামবে ওই পতাকাধারী ক্ষমতালোভীদের বিরুদ্ধে।

পতাকাও তো মানুষকে আলাদা করে ধর্মের মতোই।

Tuesday, October 17, 2017

রূপকথার শেষে


আজকের রূপকথা শেষ হয় এভাবে - তারপর তো রাজপুত্রের সঙ্গে মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেল। আর রাজপুত্রও রাজা হয়ে গেল। তারা সুখে-শান্তিতে সংসার করতে লাগল। রোজ রাজা সকালে উঠে খেয়ে দেয়ে রাজকার্য দেখতে বেরোনোর সময় রুমালটা এগিয়ে দিয়ে রানি বলে, শুনছ, আজ দুধ, ডিম আর আটা এনো। কোনওদিন ফেলে যাওয়া রাজমুকুটটা হাতে তুলে দিয়ে বলে, আলু কিন্তু এক্কেবারে নেই। ওবেলা রান্না হবে না। রাজামশাই ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, দাও দেখি বাজারের ছোট ব্যাগটা সাইড ব্যাগে ঢুকিয়ে নিই। তারপর বিড়বিড় করে, এই জানলে কেউ বিয়ে করত? একে আস্ত একখানা রাজ্য দেখো, তার ওপর...।

আর এভাবেই অনন্তকালের রূপকথা চলতেই থাকে...

Thursday, August 31, 2017

কবিতার জন্ম


যখন কলম তুলে নিই হাতে

শিউলি ফুলের মতো শব্দ কুড়াতে কুড়াতে আসিস।

জানিস তো, বড্ড ভুলো মন,

কখন যে হারিয়ে যায় দুটো-একটা অক্ষর

আর হাতড়াতে থাকি মাথার ভেতরে।

আর তখনি হাত বাড়িয়ে দিস তুই।

আর সেই হাত থেকে অক্ষরেরা

ফিরে আসে আমার গর্ভে।

- বারবার কিন্তু কুড়িয়ে দিতে পারব না।

তাহলে তোর কবিতা থেকে ধার দিস বরং,

ঠোঁট উলটে জবাব দিই আমিও।

- সে তো কবেই দিয়েছি! বিস্ময় দেখে,

আচ্ছা রাগ ধরে আমারও। হেঁকে বলি, তবে যে

ফিরিয়ে নিলি চেয়ে? এমন কথোপকথন চলতেই থাকে অনন্তকাল

আর এইসব শব্দ অক্ষর বর্ণমালারা ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হয়ে

আমার মাথার মধ্যে জন্ম দেয় আর একটা কবিতার।

ভুল ভাঙাতে


গত কয়েকদিন ধরে আমার পোস্ট কবিতা ইত্যাদি পড়ে যাঁরা ধরেই নিয়েছেন আমি বড্ড খারাপ আছি, তাঁদের ভুল ভাঙাতেই এই পোস্টাচ্ছি। কিছু অসুস্থতা বাদ দিলে হয়তো জীবনের সেরা প্রোডাক্টিভ সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। খুব খুশী আছি। আর সেই জায়গায় পৌঁছেচি বলেই নিজের জন্য মুখ খোলার উপযুক্ত সময় বলে মনে হয়েছে।

আগেও বলেছি, এখনো বলছি, কারোর সহানুভূতি, ইস টিস পাবার জন্য কোনোদিন লিখি না। ওমা, সহানুভূতি, ভালোবাসা পাবার সত্যিকারের যখন দরকার ছিল, সুদূর দিগন্তেও কাউকে দেখতে পাইনি। এখন বাপু বিস্তর লোকজন আমাকে ভালোবাসে। আর যারা ভালোবাসে তারা তো আর সহানুভূতি দেখায়না, ভালোইবাসে, অনুভব করে সমস্যাগুলো।

আমার কিছু শারীরিক সমস্যা আছে, সেই রিলেটেড মানসিক সমস্যা। তাতে নিজের কাজ সময়ে করতে না পারলে বেশ চাপ পড়ে। সত্যি বলতে কী গতকাল প্রুফের লাইব্রেরী ওয়ার্কটা শেষ করতে পেরে কী যে ফূর্তি হয়েছে কী আর বলব। সেই আনন্দে আজ বারটা অবধি মানে দুপুর আর কী টেনে ঘুমালাম। সকালে ডেকে তুলে পাঁউরুটি পোচ আর চা খাইয়ে গিয়েছিল অবশ্য কর্তামশাই।

তিরিশ বছর পরে শুনে যাঁরা বুঝতে পারছেন। সামনাসামনি কমেন্ট করছেন, উৎসাহ দিচ্ছেন বা অসুবিধা থাকলে মেসেজ করছেন তাঁদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আর যাঁরা এত কিছুর পরেও আমার ভুল খুঁজতে বসছেন তাঁদেরকে বলি, নমস্কার ভালো থাকুন। আমাকে বিরক্ত করবেন না।

তিরিশ বছর আগে গৌরী আচার্য, উত্তরা বসু, অমিতা কী যেন টাইটেল এরা মিলে যে অবোধ বালিকাকে খুন করেছিল, সে আজকের আমি নই। কোনো কোনো মানুষ নিজের চিতার আগুন থেকে নিজেকে গড়ে নেয় ফিনিক্স পাখির মতো। সেটাই এই আমি।

আর নামগুলো লিখতেই কিছু কিছু মানুষের বড্ড গায়ে লাগল। কী মুশকিল আপনার সন্তানের সঙ্গে আজ এই ঘটনা ঘটলে তো এই নামগুলো দিয়েই থানায় এফ আই আর করতেন। কোর্টে তুলতেন ডেকে ডেকে। আমি মাত্তর ফেসবুকে বলেছি বলেই এত্ত গায়ে লাগছে!

আর কেবলস মরে গেছে এই সত্যিটা বলায় যারা বড় বড় মহৎ কথাটথা বলছেন, তাদের বলি, মশাই কেবলস কেন মরল? আপনি তো ওখানেই ছিলেন, তা বাঁচাতে পারলেন না? হঠাৎ আমার কথায় খামোখা ফোঁস ফোঁস করছেন কেন? আমি কি সেই আগেকার দিনের মুনি-ঋষি নাকি? শাপ-টাপ দিয়ে দিলাম আর ফলে গেল? পারেন বাপু আপনারা।

আর সত্যিই, সিলভিয়া প্ল্যাথ যদি 'ড্যাডি' কবিতাটা ওদেশে না লিখে এখানে লিখতেন, আর দেখতে হতো না। বিখ্যাত এই কবিতাটা আমায় এমন নাড়া দিয়েছিল যে আমি তাঁর লেখার ভক্ত হয়ে গেছি।

এই জন্য বলে, সত্যি কথা বললে বন্ধু ব্যাজার।

সেদিন মরে গেলে কিচ্ছু বলতে আসতাম না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ বেঁচে তো আছিই আরো বহুকাল বাঁচব, উঁহু ব্যথা আর মাঝে মাঝে উলটে পড়লেও। এমনিতেই এসব বলেটলে বেশ আরামই হয়েছে মনে। এদ্দিন অপেক্ষা করেছি তো। তিরিশ বছর কী আর মুখের কথা মশাই?

আজকে বিকেলে চিংড়ি মাছের মালাইকারী আর পেন্ডিং মুড়িঘন্ট সঙ্গে প্রুফটার ফাইনাল চেক আপ। আপাতত এই।

পাপ


তিরিশ বছর ধরে পাপ জমেছিল ওই মাটিতে

ফসল শুকিয়ে গেছে, নদী সেও, ফিরিয়েছে মুখ।

ঘরবাড়ি ঢেকেছে জঙ্গলে, মানুষের চোখের কোটরে শুধু ভুখ।

মাটি খোঁড়ো যদি কোনোদিন। অনেক গভীরে

খুঁজে পাবে অস্থি অবশেষ।

নিষ্পাপ বালিকা ছিল এই অপরাধে

বিশ্বাস করে ছিল যাদের, তারাই হত্যাকারী -

শ্বাসরুদ্ধ। শেষ।

বিচার পায়নি সে, মাটি শুধু দিয়েছিল ঠাঁই।

মাটির গভীরে পাপ, আজ শুধু জন্ম নেয় ছাই।

দেখতে পেলে আছে, না দেখতে পেলেই নেই


শব্দেরা ভাষা খুঁজে পায় সেই তীব্র বোবা যন্ত্রণায়। ফুটে ওঠে বেদনার অবয়ব। অবোধ বালকের দৃষ্টিতে জেগে ওঠে অক্ষর, বর্ণমালারা। ওরা কেড়ে নিচ্ছিল। শব্দের রিনিঠিনি, কালির আঁকিবুঁকি। কেড়ে নিচ্ছিল আলো আর বাতাস। শব্দেরা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল। যন্ত্রণার ভেতর থেকে জন্ম নিচ্ছিল সশস্ত্র অক্ষরেরা। জন্ম নিচ্ছিল আলো তার গভীরে। বার বার ফিরে ফিরে আঘাত করে ঘাতকেরা। আর শব্দেরা গড়ে তোলে প্রতিরোধ। আলো দেখায় পথ।

উত্তরণ হয়। যে উত্তরণের তাপ ওরা সহ্য করতে পারে না। ভয় পায়। ঈর্ষা করে আলো আর অক্ষরকে। তারারা নেমে আসে তখন। এক একটি তারা এক একটি আলো এক একটি শব্দ হয়ে তাকে ঘিরে রাখে অনন্তকাল। তা দেখতে পায় কেবল রূপকথারা। শব্দ আলো আর বেদনায় জন্ম হয় জীবনের।

ম্যাজিক দিদির গল্প


- বলবে না ম্যাজিকদিদি? প্রশ্ন করে, এলোমেলো রোদ্দুর।

ভুলে গেছিলাম, হঠাৎ করে মনে পড়ল, তাই তো, কে যেন আমায় ডেকেছিল, ম্যাজিক দিদি!

জীবনের কোন যাদুর সন্ধান সে পেয়েছিল আমার কাছে কে জানে! কতজনেই তো বলে, বেঁচে থাকার, লড়াই করার মধ্যে একটা যাদু আছে, আর সেই যাদু লুকিয়ে আছে আমার অক্ষরের ছবিতে।

ঘুম পেলে অক্ষরেরা কেমন রিমঝিম শব্দ করে মাথার ভেতর। সেও কি কথার মায়া?

ম্যাজিক দিদি খুব এক কৌটো বেদনার পলাশ নিয়ে ছড়িয়ে দিতে পারে। বৃষ্টির হীরে মানিক কুচি? সে তো হারিয়েছে কবেই।

- গল্পটা কিন্তু বলছ না ম্যাজিক দিদি।

বলছি, বলছি, দাঁড়া। সে অনেকদিন আগের কথা। তখন ম্যাজিক দিদি মফ:স্বলের এক শহরের রূপকথায় বাস করত। সেইখানে বড় বড় গাছ ছিল, মাঠ ছিল, ধানক্ষেত ছিল, আর ছিল আস্ত একটা টিলা। ছোট্ট চোখের অবোধ দেখায় সেটাই হত মস্ত পাহাড়।

আর সেই রূপকথায় মানুষের বেশে ছিল রাক্ষসী সব রানিরা। কোথায় থাকত জানো? একটা ইস্কুলে। সেই ইস্কুলে যেখানে ম্যাজিক দিদিকে ইচ্ছে না হলেও যেতে হত।

আর তখন তো আর সে ম্যাজিক জানত না, ছোট্ট মেয়েটা জানত কেবল কান্না। তার কলম বেঁচে থাকলে রাক্ষসীদের ভারী সর্বনাশ। তাই তারা চেষ্টা করল কেড়ে নিতে শব্দ অক্ষরদের। কেড়ে নিতে আলো আর বাতাস।

মিস্টি মিস্টি হেসে বিষ ছড়াতো সবার মধ্যে। যাতে কেউ না ম্যাজিক দিদির বন্ধু হয়ে ওঠে। ওমা, কেন তাও জানো না বুঝি? বন্ধু শব্দের ম্যাজিক যে সবচেয়ে বেশি। কেউ তাকে হারাতে পারে না।

আর ম্যাজিক দিদি কি করেছিল জানো? চুপিচুপি বন্ধু বানিয়েছিল। শব্দ অক্ষর আর বর্ণমালাদের সঙ্গে। সেইসব জুড়ে জুড়ে ওই যে কাহিনির চরিত্ররা, তারা এসে হাত রেখেছিল তার হাতের ওপর। রাক্ষসীরা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে নি যে আস্তে আস্তে ম্যাজিকের জন্ম নিচ্ছে সেই বালিকার ভেতরে। যে ম্যাজিক একবার শিখে গেলে আর কেউ তাকে মারতে পারে না।

- তারপর?

তারপর একদিন রাক্ষসীরা তাকে মেরে ফেলল।

- এই তো তুমি বললে যে তোমায় কেউ মারতে পারে না। তুমি তো রয়েছ ম্যাজিক দিদি। আমি তো চাইলেই তোমার কথার ছবি দেখতে পাই, শুনতে পাই শব্দের কন্ঠস্বর।

দূর বোকা, পারে নাই তো। ওরা কি আর তোর ম্যাজিক দিদির কথা জানতো? মেরেছিল একটা অবোধ বালিকাকে। আর অমনি...

- অমনি কী হল ম্যাজিক দিদি?

অমনি ম্যাজিক দিদি বেঁচে উঠল। তার শব্দ আর আলোর অস্ত্র নিয়ে। চিরকাল ওই রাক্ষুসীরা, ছোট ছেলেমেয়েদের মারতে চায়, চেহারাগুলো কেবল বদলে বদলে যায়। তাদের হাতে আলো শব্দ আর বন্ধুত্বের অস্ত্র তুলে দেবে বলে সে তারপর থেকে কেবল ম্যাজিক শিখতে লাগল।

- কী ম্যাজিক দিদি?

ভালোবাসা।

Wednesday, August 30, 2017

মানুষ এখনো যা পারে


কারও কারও মুখোশ খুলে দেওয়াটা দরকার।

আমরা সকলেই তো কোনো না কোনো সময় মুখোশ পরে থাকি

ভালোমানুষের মুখোশ।

সততার মুখোশ।

মহত্ত্বের মুখোশ।

আর তাই মাঝে মাঝে সেইসব মুখোশ

টেনে খুলে দেওয়াটাই উচিত।

কারণ, এখনো কেউ কেউ পারে;

এই পৃথিবীতেই, কেউ কেউ পারে

সাহস করে মুখোশ খুলে চলতে।

অনায়াসে দেখাতে পারে

ঘৃণা, রাগ, এমন কী ভালোবাসাও।

আর তখনই সেই সব মুখোশ পরা মানুষেরা

আয়নায় নিজেদের বীভৎস মুখ দেখে শিউরে ওঠে।

তাড়াতাড়ি ভদ্র-সভ্য মুখোশটা টেনে দেয় মুখে।

তারপর খেপে ওঠে মুখোশহীন মানুষগুলোর ওপর।

চিৎকার করে বলে ছি, ছি তোমাদের বুকের ভাঁজ, উরু

সব দেখা যাচ্ছে বোরখা পর, বোরখা পর।

মুখোশ না পরলে তুমি আবার মানুষ নাকি?

আর তাই মুখোশহীন মানুষগুলো

তাদের রাগ কিম্বা ঘৃণার মুহূর্তে

টেনে ছিঁড়ে দেয় অন্যের মুখোশ।

আর মুখোশহীন সেইসব প্রেতাত্মারা

দুহাতে মুখ ঢাকতে ঢাকতে ওরই ফাঁকে

ছুরি বসিয়ে দেয় মুখোশহীন মানুষটির বুকে।



তবু, কিছু মানুষ আজো মুখোশহীন থাকতে ভয় পায় না।

তবু, কিছু মানুষ আজো টান দিয়ে ছিঁড়ে দিতে দ্বিধা করে না

অন্য কারো কারো রঙিন ভদ্র ঝলমলে মুখোশ।

কবিতার গল্প


আজ পথে যেতে যেতে কবিতাটা লিখলাম। অনেকদিনই এমন লিখি। কিন্তু আজকেরটা আলাদা দুটো কারণে। প্রথমত, মোবাইল না থাকায় বহুকাল পর কাগজ-পেন এ লিখলাম। আর দ্বিতীয়ত নারীশিক্ষার মিটিং-এ গিয়ে নিজেই ব্যাগ থেকে খাতা বের করে পড়ে শোনালাম। কোত্থাও এমন করি না। কিন্তু এখানে এলেই আমি আপনজনেদের মুখ দেখতে পাই যে।

একটি প্রতিবাদের জন্ম


প্রতিবাদ করার স্বভাবটা আমার খুব ছোটবেলাতেই তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শুরুতেই একটা ঘটনায় এমন ধাক্কা খেয়েছিলাম যে যার জের আমাকে অনেকদিন বয়ে যেতে হচ্ছে।

তার আগে একটা কথা বলি। ছোটবেলায় চিত্তরঞ্জনে প্রাইমারী স্কুলে পড়তাম। কিন্তু আমার ইচ্ছের না থাকলেও হিন্দুস্থান কেবলস হাই স্কুলে ভর্তি হতে হয়েছিল। আর সেখানে শিকার হয়েছিলাম স্কুল পলিটিক্সের। বাবা সেখানকার একজন ছাত্রদের প্রিয় শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু সহকর্মীদের কদ্দূর ঠিক জানি না। তার জের এসে পড়ত আমার ওপর। লেখাপড়ায় ভালো হওয়া সত্ত্বেও নম্বরে পিছিয়ে দেওয়া, শারীরিক অসুস্থতা জানা সত্ত্বেও নিয়মিত মানসিক অত্যাচার করা এই চলতে লাগল বছরের পর বছর। ইতিমধ্যে এপিলেপ্সি, থাইরয়েডের সমস্যা, ব্রেস্ট টিউমার অপারেশন একের পর এক লেগেই আছে। স্কুলে অসুবিধা হচ্ছিল রোদে দাঁড় করিয়ে রাখত, তাই বাবা ডাক্তারবাবুকে (ডঃ কল্যাণ চ্যাটার্জি, নিউরোলজিস্ট) দিয়ে সার্টিফিকেত লিখিয়ে জমা দিয়েছিল। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। ফলে ক্রমশঃ মানসিক অসুস্থতার শিকার হতে লাগলাম। টেবিলে ঘুঁষি না মারলে কথা বলতে পারতাম না। আর তার পরেও আমাকে পড়া জানা সত্ত্বেও সহপাঠীদের সামনে অপমান করার জন্য শিক্ষিকারা পড়া জিজ্ঞাসা করে আমার বলতে পারার আগেই বসিয়ে দিতেন। এদের সত্যি আপনি বলতেও এখন ঘৃণা করে। এছাড়া লেখাতেও তোতলামি শুরু হল। হাত আটকে যেত লিখতে লিখতে। তবু চলতে লাগল ক্লাসে, করিডরে, প্রেয়ারে সর্বত্র কোনো না কোনোভাবে হ্যারাস করা। আর এর মধ্যে প্রধান ছিল হেডমিস্ট্রেস উত্তরা বসু আর তার দক্ষিণ হস্ত গৌরী আচার্য এবং ভূগোলের শিক্ষিকা অমিতাদি। আশ্চর্য এই যে কোনো সহপাঠীই পাশে দাঁড়ায়নি সেদিন। আজ যখন ফেসবুকে বন্ধু বলে তখন বড্ড হাসি পায় আমার। রোজ বাড়ি এসে কাঁদতাম আর কী আশ্চর্য তা সত্ত্বেও বাবা স্কুল বদলানোর কথা একবারও ভাবেনি। কেন? মেয়ে সন্তান বলে?

যে প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করেছিলাম এবার তা বলি। তখন ক্লাস টেনে পড়তাম। আমাদের স্কুলে একজন খুব ভালো শিক্ষিকা ছিলেন অশোকাদি, অশোকা বিশ্বাস, জীবন বিজ্ঞান পড়াতেন। খুব অসুস্থও ছিলেন। নিয়মিত ডায়ালিসিস করাতে কলকাতায় যেতেন, নেফ্রাইটিস ছিল। আমার ওপর এই সৎ, প্রতিবাদী, আদর্শবান মানুষটির একটা গভীর প্রভাব আছে। দেখতে তথাকথিত কিছুই ভালো ছিলেন না। কালো, সামনের দাঁতও একটু উঁচু। অথচ যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকতাম ওনার হাঁটাচলায়, কথা বলায়। সেইসময় আমাদের নতুন প্রধান শিক্ষিকা এসেছেন উত্তরাদি। তিনি নিজে বেশ ফাঁকিবাজ ছিলেন। ফলে ফাঁকিবাজ শিক্ষিকারা তাঁর দলে ভিড়লেন। দুঃখের কথা আমাদের স্কুলে এঁরাই দলে ভারী ছিলেন।

আমাদের ক্লাস টিচার শোভনাদি ছিলেন একটু পাগল মতো কষ্ট করে যেদিন ক্লাসে এসে পৌঁছতেন সেদিন সকালে কী রান্না করলেন, কী দিয়ে ভাত খেলেন, ম্যয় মাঝেমধ্যে বরের সঙ্গে টুকরোটাকরা প্রেমালাপ পর্যন্ত আমাদের রসিয়ে রসিয়ে গল্প করতেন। ভূগোল শিক্ষিকা অমিতাদিকে টিচারস রুম থেকে টেনে টেনে এনে ক্লাস করানোয় তিনি আমার ওপর বিস্তর চটা ছিলেন, শোধ তুলতেন খাতায়। আর যেসব শিক্ষিকারা উল-কাঁটা নিয়ে বসতেন তাঁদের ক্লাসে আনে কার সাধ্যি। আরেকজন শিক্ষিকাও সকলেরই খুব প্রিয় ছিলেন চন্দনাদি। আমি মাঝে মাঝে পৃথিবীর সবার ওপর অভিমান করে যখন লাস্ট বেঞ্চিতে বসে থাকতাম তখন চন্দনাদিই কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে কিম্বা আদর করে ডেকে সেই মান ভাঙাতেন। অশোকাদি আবার এসব লক্ষ্যই করতেন না। পড়ানোতেই মসগুল হয়ে থাকতেন। করিডরে যেই ওনার জুতোর চেনা খটখট আওয়াজ উঠত তখনই পিন ড্রপ সাইলেন্স ক্লাসে।

ঘটনার শুরুটা এতদিন পরে আর ঠিক মনে নেই। যতদূর মনে পড়ে হেডমিস্ট্রেস উত্তরা বসু আর তার সহযোগী গৌরী আচার্য অশোকাদির সঙ্গে এমন কিছু ব্যবহার করেছিলেন বা সকলের সামনে এমন কোন অপমান করেছিলেন যে উনি বলেছিলেন ক্ষমা না চাইলে আর ক্লাস নেবেন না। আমি তখন আমাদের সেকশনের ক্লাস টেন -র সকলকে ডেকে বোঝালাম যে চল, আমরাও ক্লাস বয়কট করি অশোকাদি যতদিন পর্যন্ত না আমাদের ক্লাস নেবেন আমরাও ক্লাস করবনা। সত্যি বলতে কী আপত্তি উঠল ভালো মেয়েদের মধ্যে থেকেই বেশি। তবু শেষপর্যন্ত সকলকে একরকম বোঝাতে পেরেছিলাম। শুধু তাই নয় ক্লাসের দরজা বন্ধ করে চেয়ার-টেবিল ভেঙ্গেছিলাম সঙ্গীসাথী জুটিয়ে। যেকটা ভাঙ্গতে পারিনি সেগুলো টানতে টানতে পেছনে নিয়ে গিয়ে জড়ো করেছিলাম। তারপর দরজা টেনে দিয়ে সবাই মিলে বাইরে। এই ঘটনা কতদিন চলেছিল আজ আর মনে নেই। তবে এটা ছিল টেস্ট পরীক্ষার ঠিক আগে আগেই। মা বহুবার সাবধান করেছিল আমার এপিলেপ্সি থাকার জন্য। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল যে এটা আমায় করতেই হবে।

যেদিন জানলাম আমাদেরই জয় হয়েছে, ক্লাসে ফিরলেন অশোকাদি, আর সেই ক্লাসেই অ্যাটাক হল। জ্ঞানেই কনভালশন। স্কুল চেয়েছিল সরাসরি বাড়ি পাঠিয়ে বিষয়টার সেইখানেই ইতি টানতে। কিন্তু অশোকাদির হস্তক্ষেপে তা হয়নি। কনভালশন থামাতে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হল। সেখান থেকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হল। বাড়িতে আবার শুরু হল। একশো পর্যন্ত গুনেছিলাম ঘাড়ের ওপর মাথার কেঁপে ওঠাটা। তারপরে দম আটকে ঠাওর হল আমি মারা যাচ্ছি। তাতে একটা অভিজ্ঞতা হল বৈকী দম আটকানোর শুরুতে যতটা কষ্ট হয়, পরের দিকে কিন্তু কষ্টটা কমে আসে, বোধহয় সেন্সটা ভোঁতা হয়ে যায় বলে। যাইহোক মায়ের উপস্থিত বুদ্ধিতে কাম্পোজ কোনোমতে গিলিয়ে দেওয়ায় সেযাত্রা বেঁচে গেলাম। তারপরে আবার হাসপাতাল। টেস্ট পরীক্ষা দিতে পারলাম না। আমার সব সহপাঠীরাই দিল, যাদের একজনও আমাকে দেখতে আসেনি অসুস্থ হবার পর।

শুনলাম আমাকে নাকী থার্ড লিস্টে অ্যালাও করা হয়েছে। বাবাকে বললাম, আমি এবছর মাধ্যমিক দেবনা, আর এই স্কুল থেকেতো দেবইনা, আমাকে অন্য স্কুলে ভর্তি করে দাও। ক্লাস টেনে নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়া খুব মুখের কথা নয়। যাইহোক মধ্যশিক্ষা পর্ষদ পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি করে বাবা সেই কাজ করেছিল। তবে সেইসময়ে চিত্তরঞ্জনের দেশবন্ধু বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মৈত্রেয়ী মজুমদার পাশে না দাঁড়ালে কিছুতেই হত না। মৈত্রেয়ীদি আমাকে দ্বিতীয় জন্ম দিয়েছেন। যে আমি আজ লড়ে যাচ্ছি। ইনিও আরেকজন অসাধারণ মানুষ। স্বল্প পরিচয়ে যেটুকু অনুভব করেছি। একবছরের মধ্যেই ওই স্কুলের শিক্ষিকারা এবং ক্লাসের সহপাঠীরা আমাকে আপন করে নিয়েছিল, যা আগের স্কুলে পাঁচ বছরেও হয়নি। যদিও তখন আর মেশার মতো কোন মনের অবস্থাই আমার ছিল না।

অসুস্থ অবস্থায় খোঁজ না নিলেও মাধ্যমিকের ফল বেরোলে পুরোনো স্কুল থেকে নতুন স্কুলে ফোন গেল আমার রেজাল্ট জানতে। যাক তাদের মুখ রক্ষা করেছিলাম প্রথম বিভাগের তালিকায় আরেকজন বাড়িয়ে। কিন্তু এই একবছর এভাবে নষ্ট হওয়ায় এবং বাকী সবার সরে দাঁড়ানোয় আমার কিশোর মনে যে গভীর ছাপ ফেলেছিল তার থেকে আজো বেরোতে পারিনি।

এই ঘটনাটা আমি গল্পের আকারে সেইসময় আনন্দমেলায় পাঠিয়েছিলাম। বাবার এক বন্ধুই তখন আনন্দমেলার দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু স্কুলের শিক্ষিকাদের বিরুদ্ধে এমন কাহিনি সত্যি হলেও তিনি নীতিগত (?) দিক থেকেই প্রকাশ করতে রাজী হননি।

অথচ আমার পরবর্তী জীবনে যখনই কোনো খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে, আমার মাথায় কাজ করেছে যে, কেউ আমাকে মেরে ফেলতে চাইছে। আর তার থেকেই দীর্ঘ মানসিক অসুস্থতার সূত্রপাত।

আর আজ যখন সেই সত্য মানুষের সামনে তুলে ধরছি তখন আমার এই লড়াইয়ে যেমন অজস্র মানুষ পাশে দাঁড়াচ্ছেন, কাছে টেনে নিচ্ছেন। তেমনি কেউ কেউ বিদ্রূপ করে সেই অপরাধীদের মহান বোঝাতে চাইছেন।

তাদের নাম কেন দেওয়া হয়েছে এই নিয়েও উঠছে কথা। আসলে মৃত মানুষ কথা বলে না। আর জীবিত মানুষের কেউ কেউ সত্যি বলতে ঘাবড়ায় না। আমার কী যায় আসে তাদের নাম জানানোয়? বরং মানুষ জানুক, চিনুক মুখোশের আড়ালে তাদের প্রকৃত মুখ।
আরো আশ্চর্য লাগে যখন নিকটজনেরাও আমার ওপরেই দোষারোপ করে!

আমি বলব। কলম নামক অস্ত্র আছে আমার হাতে। তা ওরা কেড়ে নিতে পারে নি।

Tuesday, August 29, 2017

ধর্মাবতার, বিচার চাইছি ৩০ বছর পর


আমার হাতে এফ আই আর এর কোনও নথি নেই। নেই হাসপাতালের রিপোর্ট।

যদিও সাক্ষীরা বেঁচে আছে। সাক্ষ দিক অথবা না। সকলেই তো সত্যি বলতে পারে না। তাহলে পৃথিবীটা অন্যরকম হতো।

আছে স্কুলে দেওয়া ডাক্তারের সার্টিফিকেট-এর একটা কপি। সেইসময়ের যাবতীয় ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন, ই ই জি রিপোর্ট, স্কুলের রেজাল্ট,আমার ডায়েরি।

সর্বোপরি বেঁচে আছে আমার কলম।

তিরিশ বছর আগে স্কুলের কিছু শিক্ষিকার চক্রান্তে এবং এক অন্যায় ঘটনায় আমি মারা যেতে পারতাম। কিন্তু মরিনি। মারা গেছে সেই সংস্থা, যার হাতে ছিল সেই স্কুল। এটাই বাস্তব। মূলে ছিল উত্তরা বসু ও গৌরী আচার্য।

সেই ঘটনা আমার মনে এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে যার জন্য আমার জীবনের নানা ক্ষেত্রে বারবারই মনে হয়েছে আমাকে কেউ মেরে ফেলতে চাইছে। এবং বিনা কারণে আমাকে যে মারতে চাইছে তাকে আমি ছেড়ে দেব না।

এত বছর পরে আমার এই মনোভাবের শিকড় খুঁজে পেয়ে যখন সেই জায়গার লোকজনকে জানালাম, তখন আমাকে সেই গ্রুপ থেকে সরিয়ে দিল।

যেন এভাবেই মেরে ফেলতে পারবে আবারও।

ওরা ভুলে গেল আমার হাতে কলম আছে।

আর সিলভিয়া প্ল্যাথ বলেছেন, যে কোনও কিছুই লিখে ফেলা যায়।

তিরিশ বছর আগে বছর ১১-১৫ বছরের একটি মেয়ের ওপর যে ধারাবাহিক মানসিক অত্যাচার হয়েছিল হিন্দুস্থান কেবলস স্কুলে তা আমি লিখব। সর্বত্র লিখব।

এইটাই আমার প্রতিবাদ। প্রতিশোধও। যদি আইনি লড়াই করা যেত, তাহলে বলতাম, ধর্মাবতার, আমার হারিয়ে যাওয়া সময়, আমার যন্ত্রণার দিনগুলির বদলে আনন্দ, আমার সুস্থতা ফিরিয়ে দেওয়া হোক। আমি এই বিচারই চাই।

Saturday, August 19, 2017

দ্য মার্ভেলস


হুগো-র ছবি এঁকেছিলাম। কিন্তু হুগো-কে নিয়ে লিখিনি। কী আশ্চর্য! অথচ কী বই, কী সিনেমা দুটোই অদ্ভুত ভালো লেগেছিল। তেমনই ভালো লাগল ব্রায়ান সেলজনিক-এর নতুন বই দ্য মার্ভেলস।
একটা বিষয়ে নিশ্চিন্ত হলাম যে যাক, সারাক্ষণ কল্পনার জগতে আমি একাই থাকিনা এই বুড়োবয়সে। আরো আরো লোকজনও থাকে। আর তেমনই এক মানুষ ডেভিস সারভার। আপন মনের কল্পনাকে রূপ দিতে লন্ডনের বুকে এক পুরোনো বাড়ি কিনে তাকে এমন অ্যান্টিকভাবে সাজিয়ে ফেললেন যেন সময় পিছিয়ে গেল একশো বছর। আর সেই বাড়িতে থাকা এক কাল্পনিক পরিবারকে নিয়ে তৈরি করলেন যেন এক রূপকথার গল্প। হ্যাঁ, বইয়ের দু পাতার মধ্যে নয়, সত্যি ত্রিমাত্রিক কী চতুর্মাত্রিক এক গল্প তৈরি করেছিলেন ডেভিস। তাঁর একটাই দুশ্চিন্তা ছিল যে, তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ফুরিয়ে যাবে, স্তব্ধ হয়ে যাবে সেই কাহিনির গতি। কিন্তু কী আশ্চর্য জুটে গেল অমনি খেপা আর এক বন্ধু ডেভিড মিলনে। ডেভিস এর মৃত্যুর পর এক ট্রাস্টের মাথা এই ডেভিড পরম যত্নে বাঁচিয়ে রেখেছে প্রিয় বন্ধুর স্মৃতি সেই গল্পবাড়িটি। আর এই গল্প বাড়িটি নিয়ে লেখায় আঁকায় দুই মলাটের ভেতর চমৎকার আর এক গল্প বানিয়ে ফেললেন ব্রায়ান। যে গল্পে ডেভিসের কাল্পনিক চরিত্র জার্ভিস হয়ে গেল সত্যিকারের আর সৃষ্টি করলেন নতুন এক কাল্পনিক পরিবারের মার্ভেলস।
পুরো গল্পেরই মূল কথা তুমি যদি দেখতে পাও তাহলে সবই আছে, আর না পেলে কিছুই নেই। সত্যিই গল্পের দুনিয়া আমার মতো মানুষের কাছে তো তাই?


মনে হচ্ছে, মনে পড়ছে


গত কদিন ধরে কয়েকটা দৃশ্য বড্ড মনে পড়ছে। ছোটবেলার কয়েকটা দৃশ্য। কিন্তু আমার কাছে যার গুরুত্ব আছে, অন্যের কাছে আছে কি? তবু লিখতে ইচ্ছে করছে।

কেন মনে পড়ছে সেটাই আগে বলি। তারপরে দৃশ্যগুলো।

১) গতকাল নারী শিক্ষা সমিতিতে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। দিতে দিতে ক্রমশ: খানিক কথা বলতেই শুরু করলাম। মাথায় ঘুরছে রীতাদির দেওয়া বক্তৃতার বিষয় - নিবেদিতা আর অবলা বসুর সম্পর্ক। একবছর ধরে পড়ছি তো পড়ছি। নিবেদিতাকে অনেক জানা যায়। যদিও মানুষ নিজের স্বার্থে কাউকে কাউকে মহামানব বানিয়ে তোলে। আবার অন্যদিকে অবলার প্রায় কিছুই জানা যায় না। একে তো এই দুই ভয়ানক মুশকিল। তার ওপর জগদীশচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ এত সব বড় বড় মানুষদের ভিড়। একটু এদিক ওদিক হয়েছে কী..! কিন্তু সত্যি খোঁজার মধ্যে ভারী একটা আনন্দ আছে। অনেকটা রহস্য উন্মোচনের আনন্দ। আর আরো ভালো লাগে যখন দেখি বলার পরে এক দিদি বলে ওঠেন, দময়ন্তী এত ভালো বলে, ও বললে ওঠা যায় না। রীতাদিও খুশী হয়ে ওঠেন।

আর আমার মনে পড়ে একটা বারো-তেরো-চোদ্দো বছরের মেয়েকে। যে পড়া করে এসেছে। প্রতিদিনই আসে যতই শরীর খারাপ থাকুক না কেন। তাকে দাঁড় করিয়ে পড়া জিজ্ঞাসা করা হল। তার মুখ দিয়ে কিছুতেই কথা বেরোচ্ছে না, বেরোচ্ছে না। এমন কী সে যে জানে এটাও না। হাই বেঞ্চে ঘুঁষি মারছে একটা একটা, একটা একটা শব্দ বেরিয়ে আসছে। শিক্ষিকাদের ধৈর্য কোথায় শোনার? বসে পড় ঠিক আছে। পরের জন উত্তরটা বল। রাগে অপমানে মেয়েটার মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। নাহ, কোনো বন্ধুও নেই সাহস যোগানোর...

২) আমি যে কাজেরই ভাবনার কথা বলি, অধীরদা বলেন, আছি। আমি না বললে তবেই তুমি অন্য কোথাও যাবে। অন্য একটি বিশেষ সম্মানজনক প্রতিষ্ঠান থেকেও ফোন আসে, আমার কাজের বাছাই ইংরেজি অনুবাদ হবে।

ভারী আনন্দ হয়, কিন্তু ওই আবার মনে পড়ে।

মনে পড়ে যায় সেই বারো-তেরো- চোদ্দো-পনেরো বছরের মেয়েটার কথা। ভারতবর্ষের ভ এর গোল্লা থেকে যে কিছুতেই বেরোতে পারছে না, হাতটা কেবল ঘুরে যাচ্ছে, ঘুরেই যাচ্ছে। তারপর মাধ্যমিক এসে গেছে। একটানা দশ মিনিটের বেশি পড়তে পারে না। দশ মিনিট পড়লে, দশ মিনিট বিশ্রাম। খাতার পেছনে রোজ গোটা গোটা করে লেখে, আমাকে পারতেই হবে। ইতিহাস পরীক্ষার দিন। লিখতে লিখতে যন্ত্রণায় হাত জড়িয়ে আসছে। পাশে রাখা মলম মেখে আবার লেখা। নাহ, তাও একটা প্রশ্ন ছেড়ে দিতেই হল।

কয়েক বছর পরের কথা। পার্ট ওয়ান চলছে। পরীক্ষার আগেই তেড়ে জ্বর, ম্যালেরিয়া। অলরেডি দু বছর নষ্ট হয়ে গেছে, ড্রপ দেওয়া যাবে না। ওদিকে হাত অবশ হয়ে যাচ্ছে, দুটো হাতই। ওষুধ, গরম জলের সেঁক। বটানি পাস পরীক্ষা, শেষ করা যাবে না, আর হাত-মাথা চলছে না। বেরিয়ে বাস স্ট্যান্ডে এসেই অজ্ঞান। অপরিচিত একজন জল ভেবে ও আর এস নিয়েই চোখে-মুখে ছিটান। ফিজিওলজি পাসের আগের দিন তিনবার ১০৫ জ্বর। তৃতীয়বারে জ্বর নামছে না। ইঞ্জেকশন দিতে গিয়ে স্থানীয় ডাক্তারেরও হাত কেঁপে যাচ্ছে। জ্বর নামতেই মেয়েটার মনে হল ফেল করে যাব? পাঁচটা প্রশ্ন লিখতে হবে। ছটা পড়ে যাই। কী ভাগ্যিস ঠিক ওই ছটাই এসেছিল।

৩) এর চেয়েও আশ্চর্য প্রস্তাব নিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন দুই অধ্যাপক। তাঁদের কথায় তুমি এমন একটা কাজ একা একা করেছ মা। কী অসম্ভব একটা কাজ করেছ। তোমার জন্য কিছু করতে পারলে ভীষণ ভালো লাগবে।

মনে পড়ছিল সেই ছোট মেয়েটাকে আবারো। যত ভালোই পরীক্ষা দিক ভুগোলের দিদিমণি কান ঘেঁষে পাস করাবে। বাংলা ইংরেজিতে শেষপর্যন্ত অন্য স্কুলে গিয়ে স্কুল টপার হলেও এই ইস্কুলে কম নম্বর সে পাবেই। কিছুতেই তাকে নম্বর দেওয়া হবে না।

মনে পড়ে কলেজ শেষের দিকে সে টিউশনি খুঁজছে অথবা চাকরি...। কিচ্ছু পাচ্ছে না। কাউকে চেনেই না সে। মুখ ফুটে বলা তো দূর। ওদিকে বাবা বলেছে আর পড়াতে পারবে না...

সাংবাদিকতা করতে এসেও তাই।

মনে পড়ে যায় একা গবেষণার তিক্ত ঘটনাগুলো।

৪) বছর দুয়েক আগে হাসপাতালে ভর্তি। হস্টেলের পুরোনো বন্ধুরা খোঁজ নিচ্ছে। ফিরে এলে কুড়ি বছর পর প্রথম গেট টু গেদারটা বাড়িতেই হল। খোঁজ নিচ্ছে আমাদের ছুটির বন্ধুরা। আবার এই কয়েকদিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হলাম। অভিষেক হাজির হল। হাসপাতালেই আলাপ হল আমাদের ছুটির এই তরুণ লেখক ভ্রাতৃপ্রতিম অভিষেকের সঙ্গে। ফোন করে খোঁজ নিচ্ছে নিয়মিতই নতুন পুরোনো বন্ধুরা।

সাদা দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে একটা তেরো বছরের মেয়ের কথা মনে পড়ছিল। ব্রেস্ট টিউমার অপারেশন হয়ে বাড়িতে দেড়মাস। নাহ, দেখতে আসা তো দূরের কথা কেউ খোঁজ পর্যন্ত নেয় না। সারাদিনে সব মিলিয়ে ২১টা ওষুধ। দেওয়ালে নিজে চার্ট বানিয়ে রেখেছে। দেখে দেখে খায় আর জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। যে জানলায় কোনদিনও কোনো দইওলা আসবে না।

আরো দু বছর পর স্কুলেরই গন্ডগোলে আবার হাসপাতালে। মাধ্যমিকের ঠিক আগে। নাহ, এবারেও খোঁজ নিল না কেউ। খোঁজ নিল যখন এক বছর পর অন্য স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করল, তার রেজাল্ট জানতে চেয়ে সেখানে ফোন গেল পুরোনো স্কুল থেকে।

আজকাল মনে পড়ে, বড্ড মনে পড়ে। যখন বিছানা থেকে উঠতে পারি না, ক্লান্ত লাগে, ব্যথা করে সেইসব দিনগুলো মনে পড়ে যখন অনেককিছু সত্ত্বেও হেঁটে চলে বেড়াতাম।

কিন্তু কাজ তো সবে শুরু করেছি। এখনও অনেকটা পথ বাকি।

Monday, August 14, 2017

মনখারাপের জানলার পাশে


মনখারাপের জানলায় দাঁড়িয়ে দেখি

বর্ষা পেরোয়, রোদ্দুর ওঠে, জমাট বাধে শীত;

তারপর আবার গ্রীষ্ম আসে প্রখর দাবদাহে।

আমার গরাদের ছায়াগুলো শুধু বদলে বদলে যায়।

বদলে যায় বৃষ্টি ভেজা পর্দা আর সোয়েটারের হাতার রঙ।

জানলার বাইরে ব্যস্ত মানুষজন, ফেরিওয়ালার ডাক

এইসবই কেমন বদলে বদলে যায়।

কোনো গাছ কাটা পড়ে বেমালুম, রাস্তা চওড়া হয়,

ওরই ফাঁকে দু-একটা সবুজ কচি পাতা বাতাসে মাথা দোলায়।

গলির মোড়ের দোকানটা উঠে যায়,

ডানদিকের টালির চালের ঘর ভেঙে চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি গজিয়ে ওঠে কবেই যেন।

এইসব দেখতে দেখতে মনখারাপের জানলার পাশে অনন্তকাল কেটে যায় আমার।

তারপর একদিন নিজেকেও আর চিনতে পারি না।

Tuesday, July 25, 2017

যারা আর একটি মৃত্যুর জন্য কাঁদছে তাদের প্রতি


বিশ্বাস কর, আমরা কিন্তু ঠিক ভুলে যাব।

কিছু মানুষ প্রথমটায় শিউরে উঠবে,

আর ছি ছি করবে নিজেকে মানুষ ভেবে।

কেউ বা চটজলদি লিখে ফেলবে আর একটি সময়োপযোগী কবিতা।

অথবা প্রতিবেদন, ভীষণ দুঃখ আর রাগের একটা কাহিনি।

অধিকাংশই অবশ্য এসব কিছুই করবে না,

নির্বিকারে খবরের কাগজের পরের পাতার আরেকটা খবরে চোখ রাখবে

অথবা, টিভি সিরিয়ালে।

আর আমরা সকলেই, যে যাই করি না কেন, দেখো,

কয়েকদিন, নাহয় কয়েকটা মাস, খুব বেশি হলে,

আচ্ছা বছরখানেকই ধরে নিলাম নাহয় -

ঠিক ভুলে যাব।

ভুলে যাব যে, এখনও এ পৃথিবীতে রাক্ষসেরা বেঁচে আছে

এবং তারা কচি মাংস খায়,

আর তাদের দেখতে অবিকল মানুষের মতোই।

এইসবই ভুলে যাব দেখো, ভালোভাবে বেঁচে থাকার মতো

অনেক জরুরি কাজে ব্যস্ত হতে হতে

একেবারেই ভুলে যাব।

শুধু কিছুটা সময় অপেক্ষা কর।

আর দেখে নিও তারপর।