ভাবনা

সার্ধশতবর্ষে অবলা বসু – একটি পুনরুদ্ধারের প্রয়াস



বাংলাদেশে নারী শিক্ষার প্রসারে যে নামটি বিদ্যাসাগরের পরেই উচ্চারিত হওয়া উচিত ছিল, তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষ কেটে গেল প্রায় নীরবে। বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক স্বামী জগদীশ চন্দ্র বসুর স্ত্রী-এর পরিচিতি নিয়েই যিনি অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারতেন একটা সুখ এবং স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন। অথচ দেড়শো বছর আগে জন্মগ্রহণ করা নিতান্ত আধুনিক এই নারীটি তা পারেননি। কর্মের ভেতর দিয়ে, কলমের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন তাঁর স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়। এবং সেখানে তিনিই সম্পূর্ণা অবলা বসু।
সমাজ সংস্কারক দুর্গামোহন দাসের এই কন্যাটি যদি কলকাতায় ডাক্তারি পড়তে পারতেন তাহলে হয়তো প্রথম বাঙালি মহিলা ডাক্তার হিসেবে তাঁর নামটিই ইতিহাসে লেখা থাকত। কিন্তু ভর্তি হওয়ার সুযোগ না পেয়ে চলে যান সুদূর মাদ্রাজ। তাঁর মাদ্রাজ ভ্রমণ লেখাটি আসলে এইসময়ের কিনা জানা যায় না। আসলে অযত্নে-অবহেলায় অবলা-জগদীশচন্দ্র দুজনেরই ব্যক্তিগত ডায়েরি হারিয়ে যাওয়ায়, তাঁদের বয়ানে প্রায় জানা যায় না কিছুই। আশ্চর্য লাগে এত এত গবেষণা হয় বাংলায় নানা ব্যক্তিত্ত্বকে নিয়ে অথচ এমন দুটি উজ্জ্বল নক্ষত্র কেন আড়ালেই থেকে যান?
খুব হাস্যকর একটি কথা শুনলাম সম্প্রতি অবলা নাকি জগদীশচন্দ্রকে বিয়ে করার জন্য ডাক্তারি পড়া ছেড়ে চলে আসেন। এবং বাঙালি নারীর চিরন্তনী রূপটিতে তিনি নাকি আদর্শ! বাঙালি মহিলাদের ওপরে অকারণে এই সতী-সাধ্বীর তকমা কেন লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় বুঝিনা। এমনিতেই তাঁদের অনেককিছু নিত্য প্রমাণ করতেই হয়, যথেষ্টই চাপে থাকেন। তাই বোধহয় হাতে কলম পেলে অন্যরকম ভাবতে শুরু করেন। যেমন, সময়ের তথ্য বলছে অবলা অধিকাংশই বেড়িয়েছেন জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে। অথচ একমাত্র আগ্নেয়গিরি দর্শন লেখায় এক-দুবার সাথী শব্দটি উচ্চারণ করা ছাড়া জগদীশচন্দ্রের উল্লেখ কোথাও নেই। প্রবাসীর লেখাটি অবশ্য জগদীশচন্দ্রকে নিয়েই, তাই তাঁর কথা এবং গবেষণার উল্লেখ থাকবে এতো খুব স্বাভাবিক। আসলে সেইসময়ে ভ্রমণে পুরুষসঙ্গী ছাড়া যাওয়া যেতনা বলেই হয়তো লেখায় শুধু অবলা কেন প্রায় সকলেই সঙ্গীর উল্লেখ করেননি বিন্দুমাত্র। বরং ঊনবিংশ শতকে তাঁরা ঘর থেকে বাইরে পা দিতে পারতেননা সমাজের শাসনের জন্য, সেই ক্রোধ, মেয়েদের অবস্থা এবং অবস্থানের কথা বারবার ফিরে এসেছে তাঁদের কলমে, ভ্রমণে, দেখায়।
অবলা সেখানেও ব্যতিক্রম। ভ্রমণকে তিনি জীবনদর্শন করেছেন, কর্মে তাকে কাজে লাগিয়েছেন। তাঁর স্বাধীনতার মাপকাঠিটি সেইসময়েও অন্য অনেক নারীর থেকে ভিন্ন ছিল। খুব আধুনিক একটি সম্পর্কও ছিল অবলা এবং জগদীশচন্দ্রের মধ্যে। বিয়ের পর প্রথম প্রথম আলাদা থাকাকালীন গঙ্গায় নৌকা বেয়ে জগদীশচন্দ্রকে কর্মক্ষেত্র থেকে আনতে যেতেন অবলা। জীবনের সব কাজে জগদীশচন্দ্র তাঁকে পাশে পেয়েছেন এবং পাশে রেখেছেন। সব ভ্রমণেই সঙ্গী ছিলেন অবলা। আবার অবলা সব কাজেই পাশে পেয়েছেন জগদীশচন্দ্রকে। কয়েকটি জায়গায় এমন উল্লেখও পেয়েছি যে অবলার লেখা জগদীশচন্দ্র দেখে দিতেন। তা যদি সত্যিও হয়, সেক্ষেত্রেও কখনো কলম চালাননি জগদীশচন্দ্র। কারণ বাংলা গদ্য লেখার হাত জগদীশচন্দ্রের অনেক ভালো তা অব্যক্ত-র লেখা পড়েই বোঝা যায়। এবং সেই লেখার সঙ্গে অবলার লেখার কোনো মিলই নেই। আসলে দুজনে খুব ভালো সহযোদ্ধা ছিলেন জীবনে এবং যাপনে।
বিশিষ্ট সমাজসেবী ও শিক্ষাব্রতী লেডি অবলা বসুর জন্ম ১৮৬ সালের (মতান্তরে ১৮৬৪) ৮ আগস্ট (বাংলা ১২৭১ সাল)  - বাংলাদেশের বরিশালে। পিতা স্বনামধন্য সমাজ সংস্কারক দুর্গামোহন দাস, মা ব্রহ্মময়ী দেবী। তাঁদের আদিনিবাস ছিল ঢাকার তেলির বাগে। ভাই বাংলার অ্যাডভোকেট জেনারেল সতীশ রঞ্জন দাস এবং গোখেল মেমোরিয়াল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা বোন সরলা রায় দুজনেই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে খ্যাত ছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এবং ভারতের পঞ্চম মুখ্য বিচারপতি সুধী রঞ্জন দাস ছিলেন তাঁদের নিকটাত্মীয়।
অবলা বসুর শিক্ষা জীবন শুরু হয় কলকাতার বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ে ও পরবর্তীতে বেথুন স্কুলে। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে ২০ টাকা বৃত্তি পেয়ে এন্ট্রান্স পাস করেন। বাংলাদেশে তখনও মেয়েদের ডাক্তারি শিক্ষার সুযোগ না থাকায় মাদ্রাজে যান ডাক্তারি পড়তে। অসুস্থতার জন্য পাঠ অসমাপ্ত রেখে ফিরে আসতে হয়। তবে সেখানে তিনি দুবছরের একটি নির্দিষ্ট পাঠক্রম সমাপ্ত করেছিলেন। মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজের তরফে তাঁকে একটি সার্টিফিকেট অফ অনার দেওয়া হয়েছিল।
১৮৮৭ সালে তাঁর বিবাহ হয়। স্বামী প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে বহুবার দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করেন।
১৯১০ সালে অবলা ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়ের সম্পাদিকা হন। ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত তিনি অসামান্য যোগ্যতার সঙ্গে স্কুলটি পরিচালনা করেন। পুরো স্কুলটিকেই নতুন করে গড়ে তোলেন অবলা। দিদি সরলা রায়ের সঙ্গে গোখেল মেমোরিয়াল মেমোরিয়াল স্কুলটিও প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার মেয়েদের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে ১৯১৯ সালে ‘নারী শিক্ষা সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অবলাএই সংস্থা গ্রাম-বাংলায় বালিকাদের জন্য অনেকগুলি বিদ্যালয় স্থাপন করে। বিধবাদের স্বনির্ভর করে তোলার লক্ষ্যে বিদ্যাসাগর বাণীভবন, মহিলা শিল্প ভবন বাণীভবন ট্রেনিং স্কুল নামক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। বসু বিজ্ঞান মন্দির-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকও ছিলেন অবলা। স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর সঞ্চিত এক লক্ষ টাকা দিয়ে অ্যাডাল্টস প্রাইমারি এডুকেশন নামক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। ১৯৫১ সালের ২৫ এপ্রিল অবলা বসু কলকাতায় মারা যান।
বাংলাদেশের প্রথমদিককার নারীবাদী হিসেবে অবলা বসু একটি পরিচিত নাম। তৎকালীন নামী ইংরেজি পত্রিকা মর্ডান রিভিউ-এ নারীশিক্ষা-নারীস্বাধীনতা বিষয়ক তাঁর একাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। পাশাপাশি বিভিন্ন বাংলা সাময়িক পত্রিকায় বেরিয়েছিল তাঁর বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং ভ্রমণ কাহিনি। অবলা বসুর ছড়ানো ছিটানো গদ্য রচনাগুলির কিছু নিদর্শন একটিমাত্র সংকলনেই পাওয়া যায় - শকুন্তলা শাস্ত্রী প্রকাশিত বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ও লেডি বসুর প্রবন্ধাবলী নামে
১৩০২ থেকে ১৩৩২ এই তিন দশকের বিভিন্ন সময়ে মুকুল এবং প্রবাসী পত্রিকায় ভ্রমণ কাহিনি লিখেছেন অবলা। পরশপাথর প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত অবলা বসুর ভ্রমণকথা তাঁর একমাত্র ভ্রমণ কাহিনি সংকলন এবং একমাত্র একক সংকলিত বইও। তাই তাঁর কথা লিখতে বসলে তাঁর প্রায় হারিয়ে যাওয়া ভ্রমণকাহিনিগুলি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।
ঊনবিংশ শতকের খ্যাতনাম্নী লেখিকাদের মধ্যে স্বর্ণকুমারী দেবী, প্রসন্নময়ী দেবী এবং অবলা বসু - তিনজনই ধারাবাহিকভাবে সাময়িক পত্রিকায় ভ্রমণ কাহিনি লিখতেন। প্রসন্নময়ী বাদে বাকি দুজনের কোন ভ্রমণ কাহিনি সংকলন সেইসময় পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়নি। তাই ঊনবিংশ শতকের ভ্রমণ কাহিনি লেখিকা হিসেবে আমরা ইংলণ্ডে বঙ্গমহিলা গ্রন্থ রচয়িত্রী কৃষ্ণভাবিনী দাস অথবা আর্য্যাবর্ত্ত রচয়িত্রী প্রসন্নময়ীর নাম যেভাবে জানি, সেভাবে জানতে পারি না স্বর্ণকুমারী বা অবলা বসুর কথা। পরবর্তীকালে স্বর্ণকুমারীর লেখা ভ্রমণ কাহিনির অনেকগুলিই পৃথক পৃথকভাবে তাঁর বিভিন্ন রচনাসংকলনে সংযোজিত হয়। কিন্তু অবলা বসুর লেখাগুলি প্রায় দুষ্প্রাপ্য। প্রবন্ধাবলী নামক সেই সংকলনটিতেও কোন লেখাটি কার বা কোথায় কবে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল এইসব জরুরি তথ্যগুলি অনুপস্থিত।
অথচ বাঙালি নারীর লেখা ভ্রমণ সাহিত্যের ধারায় একটি বড় অবদান আছে অবলার।  প্রথম বিদেশ ভ্রমণ কাহিনি রচয়িত্রী কৃষ্ণভাবিনীর ইংলণ্ডে বঙ্গমহিলা-র পরে ঊনবিংশ শতকে বাঙালি মেয়ের বিদেশ ঘোরার কথা একমাত্র অবলার কলমেই পাই। ১৮৯৭-৯৮ সালে মুকুল পত্রিকায় তিনটি কিস্তিতে বেরোয় তাঁর ইংল্যান্ড ভ্রমণ কাহিনি। কৃষ্ণভাবিনীর বইটিতে লন্ডন যাওয়ার পথে ইতালির ভেনিস ছুঁয়ে যাওয়া বা সুইজারল্যান্ড ও ফ্রান্সের ওপর দিয়ে যাত্রাপথের বর্ণনা পাওয়া যায়। কিন্তু আলাদা করে বিলেত ছাড়াও অন্য দেশ ভ্রমণের কাহিনি মেয়েদের কলমে অবলাই প্রথম লেখেন। ঊনবিংশ শতকেই তাঁর ইতালি ভ্রমণ নিয়েআগ্নেয়গিরি দর্শন, লুপ্তনগরী এবং ভেনিস এই লেখা তিনটি পাই। বিংশ শতাব্দীতে তাঁর আমেরিকা নিয়ে লেখাটি সম্ভবত বাঙালি মেয়ের লেখা প্রথম আমেরিকা ভ্রমণ কাহিনি। প্রথম জাপান ভ্রমণকারী বাঙালি মহিলা হরিপ্রভা তাকেদার বঙ্গমহিলার জাপানযাত্রা বইটি প্রকাশিত হয় ১৯১৫ সালে। এর ঠিক পরে পরেই ১৯১৬ সালের প্রথমদিকে মুকুল পত্রিকায় অবলার লেখা জাপান ভ্রমণ কাহিনিটি প্রকাশিত হয়েছিল। তাকেদা জাপান গিয়েছিলেন ১৯১২ সালে। অবলা বসু ১৯১৫ সালের এপ্রিল মাসে জাপান যান। দুষ্প্রাপ্য এই লেখাটির সন্ধান পেয়ে আমি ‘আমাদের ছুটি’(www.amaderchhuti.com) আন্তর্জাল ভ্রমণ পত্রিকায় এটি প্রথম পুনঃপ্রকাশ করি। 
শুধু বাঙালি মেয়েদের ক্ষেত্রেই নয়, সারা বিশ্বেই নারীদের লেখা ভ্রমণ কাহিনিকে দীর্ঘকাল যাবৎ নিম্নমানের লেখা বলে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। যদিও ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান চর্চায় সাহিত্যের এই ধারাটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মহিলালিখিত ভ্রমণ কাহিনির ইতিহাসও খুব কম দিনের নয় -  যতদূর জানা যায় এর সূচনা হয়েছিল ১৪৩৬ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ মহিলা মার্জারি কেম্পের তীর্থভ্রমণ কাহিনির মাধ্যমে (অবশ্য মার্জারি ছিলেন নিরক্ষর, গ্রন্থ রচনার জন্য তাঁকে অনুলেখকের সাহায্য নিতে হয়েছিল)। পরবর্তীতে ইংলণ্ডের সীমানা ছাড়িয়ে এর প্রসার ঘটেছে বিশ্বের সব আনাচে-কানাচেই। লিখেছেনও সমাজের সব স্তরের মহিলাই। অভিজাত বংশের লেডি মেরি ওয়ার্টলি মন্টেগুর পাশাপাশি কলম ধরেছেন ঘরপালানো মেয়ে আলেক্সান্ডার ডেভিড-নীল। গৃহবধূ, ধর্মপ্রচারক, অভিনেত্রী, চাকুরিজীবী, অভিযাত্রী, ভবঘুরে - কে নেই এই লেখক তালিকায়? শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ভ্রমণকারী মহিলার সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে শুরু করেছিল। একদিকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ইউরোপীয় কলোনি গড়ে ওঠা, রেলপথের প্রসার আর অন্যদিকে নারীশিক্ষার প্রচলন মেয়েদের আপাত নিরাপত্তাবোধ বাড়িয়ে দিয়েছিল। ভ্রমণ কাহিনি লেখার চলও বেড়েছিল এর সাথেই। ঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে বাইরে বেরোনোর পাশাপাশি সেই বেড়ানোর কথা, অন্য কিছু দেখার কথা কাগজে-কলমে লিখে প্রকাশ করতে পিছিয়ে রইল না ঊনবিংশ শতকের বাঙালি মেয়েও। ভ্রমণ কাহিনিতে আমরা মূলতঃ এক সংস্কৃতির চোখ দিয়ে অন্য সংস্কৃতিকে দেখি। নারীর লেখা ভ্রমণ কাহিনিতে এই দেখার ভঙ্গি পুরুষদের থেকে ভিন্নতর - অনেক বেশি অন্তরঙ্গ।
আধুনিককালে নানা দেশেই মেয়েদের লেখা ভ্রমণ কাহিনি নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে, হচ্ছে। সাংবাদিক নেলি ব্লাই-এর মত পৃথিবী ভ্রমণকারী কোন মহিলা বা কিম্বা ইসাবেলা এবেরহার্ডট-এর মত ভবঘুরে মেয়েকে না পেলেও ঊনিশ শতকের বাঙালি মেয়ে ভ্রমণে এবং মুক্ত চিন্তার ভুবনে কিন্তু অনেককিছুই দেখেছে। তখনকার বাংলা ভ্রমণ কাহিনির লেখিকারা সবাই-ই ছিলেন ব্যতিক্রমী। এঁরা কেউ দুর্গম দেশে পাড়ি দেননি কিংবা কোন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার শরিক হননি। কিন্তু সেদিন মেয়েদের বাড়ির বাইরে পা রাখা মানেই ছিল তাঁদের ঘোমটা খুলে বেরোনো - সমাজ-সংসারের প্রচলিত অবস্থানের বিপরীতে পা ফেলা। ঊনবিংশ শতকে বাঙালি মহিলারা যখন গল্প-কবিতা-উপন্যাস লিখতে শুরু করেছেন তখন জেন অস্টেন-এর মতোই তাঁদেরও লেখার মূল বিষয়বস্তু ঘর এবং চারপাশের সমাজ। এই পটভূমিকায় কৃষ্ণভাবিনী-প্রসন্নময়ী-স্বর্ণকুমারী-অবলারা যখন অন্যান্য লেখালেখির পাশাপাশি ভ্রমণকাহিনি লেখার জন্য কলম ধরলেন অর্থাৎ মেয়েদের ঘরের বাইরে পা রাখার কথা বলা শুরু হল সেটাতে নিঃশব্দে নারীর সামাজিক অবস্থান বদলেরও একটা সূচনা ঘটলএঁরা তাই সেই সময়ের শুধুমাত্র কবি-গল্পকার-ঔপন্যাসিক লেখিকাদের থেকে কিছু বিশিষ্টতার সাক্ষর রেখেছেন। পাশাপাশি অপরিচিত যেসব ভ্রমণলেখিকারা সেদিন কলম ধরেছিলেন তাঁদের রচনাও সামগ্রিকভাবে সমাজে নারীর অবস্থান বদলের সূচনারই সাক্ষ্য দেয়। অথচ বাংলায় নারীদের লেখা সাহিত্য নিয়ে যা কিছু আলোচনা হয়েছে, বই প্রকাশিত হয়েছে সেখানে কিন্তু মেয়েদের লেখা ভ্রমণকাহিনির উল্লেখ প্রায় নেই। সেদিনও যেমন জ্ঞানদাসুন্দরী দেবী নিজের দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে অভিভাবক ছাড়াই জাহাজে সাগরপাড়ি দিয়েছিলেন, আজকের বাঙালি মেয়েও ঠিক তেমনি একা একাও দেশ-বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে নিশাত মজুমদার, ওয়াসফিয়া নাজরিন, ছন্দা গায়েন, টুসি দাসের মত নিতান্ত মধ্যবিত্ত এমনকী নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরাও উঠছেন এভারেস্টের মাথায় কিম্বা সুপরিচিত সাহিত্যিক-অধ্যাপিকা নবনীতা দেবসেন তো বটেই, মঞ্জুশ্রী সিকদারের মত সাধারণ চাকুরিজীবি মহিলাও ঘরের লোকের সঙ্গ ছাড়াই ঘুরে বেড়াচ্ছেন সাত মহাদেশের নানান প্রান্তেবাঙালি মেয়ের ভ্রমণ এবং ভুবনের এই পরিবর্তনের বীজ কিন্তু লুকিয়ে ছিল একশো-দেড়শো বছর আগের লেখা সেই ভ্রমণ কাহিনিগুলিতেই।
আবার ঊনবিংশ শতকের বাঙালি ভ্রমণ লেখিকাদের মধ্যেও স্বর্ণকুমারী দেবী এবং অবলা বসু ছিলেন আরও আলাদা। এঁদের ভ্রমণ সেই সময়ের অন্যান্য মহিলা ভ্রমণ লেখিকার মত ঘোমটা খুলে বেরোনো নয়। ঠাকুর বাড়ির খোলা হাওয়ায় বেড়ে ওঠা স্বর্ণকুমারী দেবীর ভ্রমণ কাহিনিগুলির প্রকাশের সময়কাল লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বেশিরভাগই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর দুই পর্বে ভারতী পত্রিকা সম্পাদনার সময়ে। অর্থাৎ সম্পাদকের নিজস্ব তাগিদও এর পেছনে হয়তো-বা কাজ করেছে। আবার এই দুই মহিলাই সেই সময়ে পরিবারের সঙ্গে শুধুমাত্র বেড়ানোর জন্যও বেড়াতে গেছেন - সেই সময়ের মেয়েদের ঘরের বাইরে পা রাখার অন্যতম উপায় তীর্থদর্শন বা শরীর সারানোর উদ্দেশ্যে নয়। আবার কৃষ্ণভাবিনীর মত স্বামীর সঙ্গে বাইরে যাওয়ার বা বাইরে থাকার কাজটিও করেছেন, যদিও কৃষ্ণভাবিনীর মত কোন বিরুদ্ধ পরিস্থিতি এঁদের ছিল না।
অবলা সমাজসংস্কারক দুর্গামোহন দাসের কন্যা এবং বিজ্ঞানসাধক জগদীশচন্দ্র বসুর পত্নী হওয়ায় সেই সময়ের তুলনায় অনেকটাই আধুনিক পরিমণ্ডল পেয়েছিলেন। ভ্রমণ লেখার ক্ষেত্র হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন ছোটদের পত্রিকা মুকুলকে। কেন তিনি ছোটদের পত্রিকায় লিখলেন তার কারণ খুঁজে পাই প্রথম লেখাতেই - বাংলা ১৩০২ সালের অগ্রহায়ণ ও পৌষ সংখ্যার মুকুল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর কাশ্মীর ভ্রমণ কাহিনি। লেখার শুরুতেই অবলা বলছেন ইংলণ্ড প্রভৃতি সুসভ্য দেশের বালক বালিকাগণ বাল্যকাল হইতেই ভ্রমণ বৃত্তান্ত পড়িতে ভাল বাসে, তাহার সুফল এই হয় যে, বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া তাহারা নূতন দেশ আবিষ্কারের জন্য প্রাণ পর্য্যন্ত ত্যাগ করিতে প্রস্তুত হয়। ... আমাদের এই ভ্রমণ বৃত্তান্ত পাঠ করিয়া এতটা না হইলেও আশা করি তোমাদের মধ্যে অনেকের মনে নানাস্থান ভ্রমণ করিয়া প্রকৃতির শোভা দেখিবার আগ্রহ জন্মিবে। এই যে অন্যরকমভাবে দেখা এবং ভ্রমণকে জীবনের বৃহত্তর অর্থে খুঁজে পাওয়া এটাই বোধহয় অবলার লেখার সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য। ভ্রমণের এই অভিজ্ঞতাই হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবনের সব কর্মসাধনার উৎসও।
অবলা বসুর লেখা ভ্রমণ কাহিনি পড়ার সময় একটা কথা খেয়াল রাখতে হবে যে তিনি ছোটদের পত্রিকায় ছোটদের কথা ভেবেই লিখেছিলেন। তাই তাঁর লেখার ধরণ অনেক সহজ-সরল। নারীশিক্ষা-নারীস্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর জোরালো মতামত থাকলেও ভ্রমণ কাহিনিতে তার ছাপ পড়েনি। এমনকী বাঙালি মেয়ের সঙ্গে অন্য প্রদেশের কী বিদেশের মেয়েদের তুলনামূলক বিচার নিয়েও তিনি বিশেষ মাথা ঘামাননি। যদিও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় সব ভ্রমণ লেখিকার রচনাতেই সমাজে নারীর অবস্থানের বিষয়টি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উঠে এসেছে। হয়তো লেখার মাধ্যম হিসেবে ছোটদের পত্রিকা বেছে নিয়েছিলেন বলেই অবলার ভ্রমণকাহিনিগুলি সমসাময়িক ভ্রমণ লেখিকাদের থেকে অন্যরকমের  ছিল। এইরকম সহজ ভাব একমাত্র স্বর্ণকুমারীর লেখায় অনেকটা পেয়েছি, তবে সেখানেও ব্যক্তিগত দুঃখভাবনার কথা এসেছে, যা অবলার লেখায় নেই। সার্থক ভ্রমণ কাহিনির মত তাঁর রচনায় প্রাধান্য পেয়েছে প্রকৃতি বা জায়গাটির কথাই। কাহিনিগুলির আরেক আকর্ষণ সঙ্গের উডকাট ও হাফটোন ছবিগুলি, যেটা ঊনবিংশ শতকে অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত ভ্রমণ লেখাগুলিতে পাওয়া যায়না। ছবিগুলির শিল্পী কে তা নিশ্চিতভাবে জানতে পারিনি। খুব সম্ভবতঃ এই ছবিগুলি মুকুলে প্রকাশিত হত উপেন্দ্রকিশোরের ইউ.রয় এন্ড সন্স-এর সূত্রে। চিত্র সংযোজনের সুবাদে লেখাগুলি অন্য মাত্রা পেয়েছে, হয়তোবা এতে আধুনিক ভ্রমণ কাহিনির কিছুটা রসাস্বাদনও করা যায়
কাশ্মীর অবলার প্রথম ভ্রমণ লেখা হলেও কিন্তু এটাই তাঁর প্রথম ভ্রমণ নয়। শুরুতে প্রসঙ্গক্রমে কুমায়ুনের তুষার নদীর বর্ণনা পড়লেই একথা বোঝা যায়। কখনওবা একটি লেখায় উল্লেখ রয়েছে অন্য বেড়ানোর। একমাত্র স্বর্ণকুমারী ছাড়া অন্য কারোর লেখায় এই বৈশিষ্ট্যটি পাই নি। হয়তো এঁদের দুজনের মত এতটা ভ্রমণের সুযোগও অন্যরা পাননি সেটাও একটা কারণ। জগদীশচন্দ্র বসুকে নিয়ে ভাগিনেয় খ্যাতনামা পদার্থবিদ ডি.এম. বোসের প্রবন্ধেও জগদীশচন্দ্র এবং অবলার বেড়ানোর উল্লেখ পাওয়া যায় - "The couple used to go out on travels twice every year during the vacations. Their objectives were to visit famous places of pilgrimages, caves and rock-cut temples, scenes of natural beauty, of cultural importance, sites of ancient universities. Armed with a full plate camera the couple explored and photographed; ...Amongst the places they visited may be mentioned Ajanta, Ellora, Sarnath, Budh Gaya, Pataliputra, Nalanda, Taxilla, Badrinath, Kedarnath, the temple at Puri, Bhubaneswar, Konark, and many temples of South India, glaciers etc....In later life in connection with his scientific deputations Jagadish Chandra accompanied by his wife travelled extensively in Europe (barring Russia), America, Japan and Egypt."
এছাড়াও বিভিন্ন সূত্রে অবলা ও জগদীশচন্দ্র বসুর ভ্রমণ সম্পর্কে পাওয়া তথ্য থেকেও জানতে পারি তাঁরা ভারতবর্ষে বুদ্ধগয়া, রাজগীর, সাঁচি, রাজস্থানের চিতোর, আজমীর, অম্বর, জয়পুর, কাশ্মীর, বাঁকিপুর, অমৃতসর, মুম্বাই, অজন্তা-ইলোরা, ওড়িশার পুরী, ভূবনেশ্বর, কোনার্ক, উদয়গিরি, খণ্ডগিরি, দক্ষিণ ভারতের মন্দির নগরীগুলি, লখনৌ, নৈনিতাল, পাঞ্জাব, কেদার-বদরী প্রভৃতি স্থান ভ্রমণ করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে দুটি তথ্য বিশেষ উল্লেখ্য - ১৯০০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তারিখে রবীন্দ্রনাথ বন্ধুবর জগদীশচন্দ্রকে চিঠিতে [বিশ্বভারতী প্রকাশিত ‘চিঠিপত্র’]  লিখেছিলেন, “বোধ করি, মনে আছে, আপনি আমাকে একটি ভ্রমণ সঙ্গ-দানে প্রতিশ্রুত আছেন, কাশ্মীরে হোক্, উড়িষ্যায় হোক্, ত্রিবাঙ্কুরে হোক্, আপনার সঙ্গে ভ্রমণ করে আপনার জীবনচরিতের একটা অধ্যায়ের মধ্যে ফাঁকি দিয়ে স্থান পেতে ইচ্ছে করি। আশা করি বঞ্চিত করবেন না - সেই ভবিষ্যত কোন একটা ছুটির জন্যে পাথেয় সঞ্চয় করে রাখচি। রবীন্দ্রনাথের এই ইচ্ছাপূরণ হয় ১৯০৪ সালের অক্টোবর মাসে। রাজগীর-বুদ্ধগয়া প্রভৃতি জায়গায় বেড়াতে যান তাঁরা  - জগদীশচন্দ্র ও অবলা ছাড়াও এই সফরে কবির সঙ্গী ছিলেন ভগিনী নিবেদিতা, আচার্য যদুনাথ সরকার, স্বামী সদানন্দ প্রমুখ। আবার শ্রীঅসিত কুমার হালদারের অজন্তা ভ্রমণ কাহিনির ভূমিকায় পড়ি, বিজ্ঞানাচার্য্য শ্রীযুক্ত জগদীশচন্দ্র বসু, তাঁর পত্নী, Sister NiveditaSister Christianaর  সঙ্গে Mrs. Herringhamএর পূর্ব্বে পরিচয় থাকায় সেই সময় বড়দিনের অবকাশে নিমন্ত্রিত হয়ে তাঁরা সেখানে কয়েক দিনের জন্য বেড়াতে যান এটা ১৯০৯ সালের ঘটনা। অসিত কুমার হালদার ও নন্দলাল বসু সেইসময় ইণ্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্টের পক্ষ থেকে বিলেতের খ্যাতনাম্নী চিত্রশিল্পী মিসেস সি.জে. হ্যারিংহ্যামের সঙ্গী হিসেবে গুহার চিত্রগুলির প্রতিলিপি আঁকার উদ্দেশ্যে অজন্তায় ছিলেন। অসিত কুমারের লেখাটি থেকে আরও জানতে পারি, বসুদম্পতি ও সিস্টার নিবেদিতার পরামর্শেই মিসেস হ্যারিংহ্যাম তাঁদের আরও দুই সতীর্থ শিল্পীকে কলকাতা থেকে আনিয়ে নেন কাজের সুবিধার্থে।
 বিদেশ ভ্রমণেও জগদীশচন্দ্রের নিয়মিত সঙ্গী ছিলেন অবলা। ১৮৯৬ সালের ২৪ জুলাই মুম্বাই থেকে এস. এস. ক্যালেডোনিয়া জাহাজে তাঁরা ইংল্যান্ড যাত্রা করেন। এটাই তাঁদের প্রথমবার ইউরোপ যাত্রা। ২১ সেপ্টেম্বর লিভারপুলে ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত বিজ্ঞানী-সম্মেলনে জগদীশচন্দ্র বিদ্যুৎ-তরঙ্গ সম্বন্ধে বক্তৃতা দেন। এরপর ১৮৯৭ সালের ২৯ জানুয়ারি রয়্যাল ইনস্টিটিউটের শুক্রবাসরীয় সান্ধ্য বক্তৃতায় ওই বিষয়ে তিনি আবার নিজস্ব মতামত পেশ করেন। এই দুই বক্তৃতার সাফল্যের কথা পাই অবলারপ্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাটিতে। এই যাত্রার লণ্ডন এবং ইতালি ভ্রমণকথা উঠে এসেছে অবলার লেখায়। এরপরে ১৯০০ সালের জুলাই মাসে দ্বিতীয়বার ইউরোপ যান বসু দম্পতি। যাত্রার উদ্যোগপর্বে আর্থিক বাধার সম্মুখীন হওয়ায় রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে জগদীশচন্দ্রের সাফল্য কামনা করে পনেরো হাজার টাকার চেক পাঠান ত্রিপুরার রাজা রাধাকিশোর দেবমাণিক্য। প্যারিস পৌঁছে ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেসের সভাতে ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের কাছে জড় পদার্থের সাড়া বিষয়ক উপলব্ধির কথা তুলে ধরেন জগদীশচন্দ্র। সভায় উপস্থিত স্বামী বিবেকানন্দ বাঙালির এই গৌরবের কথা লিখে গেছেন তাঁর পরিব্রাজক গ্রন্থে সে বহু গৌরবর্ণ প্রতিভামন্ডলীর মধ্য হতে এক যুবা যশস্বী বীর বঙ্গভূমির - আমার মাতৃভূমির নাম ঘোষণা করলেন, সে বীর জগৎপ্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক ডাক্তার জে. সি. বোস। একা যুবা বাঙালী বৈদ্যুতিক আজ বিদ্যুদ্ বেগে পাশ্চাত্যমন্ডলীকে নিজের প্রতিভায় মুগ্ধ করলেন - সে বিদ্যুৎসঞ্চার, মাতৃভূমির মৃতপ্রায় শরীরে নবজীবন তরঙ্গ সঞ্চার করলে। সমগ্র বৈদ্যুতিক মন্ডলীর শীর্ষস্থানীয় আজ জগদীশচন্দ্র বসু - ভারতবাসী, বঙ্গবাসী, ধন্য বীর! বসুজ ও তাঁর সতীসাধ্বী সর্বগুণসম্পন্না গেহিনী যে দেশে যান, সেথায়ই ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেন - বাঙ্গালীর গৌরব বর্ধন করেন। ধন্য দম্পতি। ১৯০১ সালের ১০ মে লণ্ডনের রয়্যাল ইনস্টিটিউটের সান্ধ্য সম্মিলনে জগদীশচন্দ্র প্রাণী ও জড়ের সাড়ালিপি একই ভঙ্গীতে লেখা তাঁর এই মতবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। জগদীশচন্দ্রের এই সাফল্যের কাহিনি ভগিনী নিবেদিতা এবং অবলা দুজনেই রবীন্দ্রনাথকে জানিয়েছিলেন। অবলা তাঁর চিঠিতে লিখছেন আপনিও যদি সেই বৈজ্ঞানিকমন্ডলীর মধ্যে এই ক্ষুদ্র ভারতবর্ষীয়ের নির্ভীক সত্যপ্রচার দেখিতেন তাহা হইলে স্তম্ভিত হইতেন। সেদিন আর লোকে কি বলিবে সে ভয় ছিল না, আমি সত্য লইয়া আসিয়াছি তোমরা শ্রবণ কর এই ভাবই প্রকাশ হইতেছিল। নিবেদিতার পাঠানো বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে জগদীশচন্দ্রের জয়বার্তা (বঙ্গদর্শন, আষাঢ়, ১৩০৮) শীর্ষক প্রবন্ধে এক অসাধারণ চিত্রকল্প আঁকলেন রবীন্দ্রনাথ সন্ধ্যা নয়টা বাজিলে দ্বার উন্মুক্ত হইল এবং বসু-জায়াকে লইয়া সভায় সভাপতি প্রবেশ করিলেন। সমস্ত শ্রোতৃমণ্ডলী অধ্যাপকপত্নীকে সাদরে অভ্যর্থনা করিল। তিনি অবগুন্ঠনাবৃতা এবং শাড়ী ও ভারতবর্ষীয় অলঙ্কারে সুশোভিতা। তাঁহাদের পশ্চাতে যশস্বী লোকের দল এবং সর্বপশ্চাতে আচার্য বসু নিজে। ১৯০৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তৃতীয়বার ইউরোপ যাত্রা করেন বসু দম্পতি - জার্মানি হয়ে পৌঁছান ইংলন্ডে। পরের বছর সেপ্টেম্বর মাসে ইংল্যান্ড থেকে তাঁরা আমেরিকা পৌঁছান। জগদীশচন্দ্র -অবলার এই প্রথম আমেরিকা যাত্রা। আমেরিকায় সপ্তাহকাল আরবানা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ব্রুকস-এর পরিবারে আতিথেয়তা লাভ করেন তাঁরা। এই পরিবার সম্পর্কে কিছু কথা অবলার আমেরিকা নিয়ে লেখাটিতে পাওয়া যায়। আবার নদীর পাড়ে মিসেস বুল-এর পরিবারেও তাঁরা একমাস ছিলেন। সেখান থেকে রবীন্দ্রনাথকে লেখা অবলার চিঠিতে সেই নদীর কথা আর শরতের প্রকৃতির খানিক বর্ণনা পাওয়া যায়। ১৯১৪ সালের প্রথমদিকে চতুর্থবার ইউরোপ যাত্রা করেন সস্ত্রীক জগদীশচন্দ্র। ইংল্যান্ডে পুনরায় সফল মিশনের পর ২২ নভেম্বর তাঁরা আমেরিকা পৌঁছান। আমেরিকা থেকে ফিরে আসার ঠিক আগে বসুদম্পতি নিমন্ত্রিত হয়ে টেলিফোনের উদ্ভাবক গ্রাহাম বেলের বাড়িতে গিয়েছিলেন। অবলা বসুর দিনলিপিতে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ৬ জানুয়ারি ১৯১৫ তারিখে তিনি লিখছেন, "...We went to dine with Graham Bell. The inventor of Telephone.  Mr. Graham Bell is over 80 now, still he is as strong and vigorous as ever. He has a beautiful house and he keeps beautiful medium sized fern plants in his room which showed how rich he must be. He had travelled in India a few years ago with his wife. He is still experimenting and is as keen as ever about new inventions. He has a gathering of Scientific men in his house every Wednesday and every one comes with some new thoughts or new inventions or...Something new that they have been doing..." । এই যাত্রায় জাপানের পথে ভারতে ফেরেন অবলারা। ১৯১৫ সালের ২০ মার্চ সানফ্রান্সিস্কো থেকে জাহাজে যাত্রা করে ৭ এপ্রিল তাঁরা জাপানের ইয়াকোহামা বন্দরে পৌঁছান। জগদীশচন্দ্র ১ মে ওয়াসেদি (Wasede) বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেন। টোকিয়ো এবং জাপানের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলি পরিভ্রমণ করে জাহাজে ভারতে ফেরার পথে সিংহলে নেমে সেখানকার প্রাচীন বৌদ্ধমন্দিরগুলি ঘুরে দেখেন। কলকাতায় ফেরার আগে দক্ষিণ ভারতের রামেশ্বর, মাদুরা, তাঞ্জোর, ত্রিচিনাপল্লী, শ্রীরঙ্গম প্রভৃতি মন্দিরনগরীগুলিও তাঁরা পরিভ্রমণ করেন। এরপর ১৯১৯, ১৯২৩, ১৯২৬, ১৯২৭, ১৯২৮ এবং ১৯২৯ সালে বসুদম্পতি ইউরোপে বিজ্ঞান মিশনে যান। লণ্ডন ছাড়াও প্যারিস, জেনেভা, ব্রাসেলস, ভিয়েনা, মিউনিখ, আলেকজান্দ্রিয়া প্রভৃতি স্থানে এক বা একাধিকবার তাঁরা গিয়েছিলেন। বেড়ানোর পাশাপাশি ছবি তোলারও সখ ছিল জগদীশচন্দ্র ও অবলার। আচার্যের ভাগিনেয় শ্রী ডি.এম. বোসের লেখাটিতে তো বটেই বিশিষ্ট গবেষক দিবাকর সেনের লেখাতেও উল্লেখ পাই, বেড়ানোর সময় জগদীশচন্দ্র ১০ X ১২ প্লেটের ক্যামেরা নিয়ে যেতেন আর ফটো ডেভেলাপ করা, এনলার্জ করা, প্রিন্ট করা সবই জগদীশচন্দ্র ও অবলাদেবী একসঙ্গে করতেন। জগদীশচন্দ্রের ক্যামেরায় তোলা তাঁদের বেড়ানোর ছবিগুলি খুঁজে পাওয়ার আশায় আচার্য ভবন, বসু বিজ্ঞান মন্দির, নারী শিক্ষা সমিতি সর্বত্র ঘুরে বেরিয়ে বেশ দুঃখজনক তথ্যই পেলাম - ক্যামেরাটি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই আর আলোকচিত্রগুলি পরবর্তীকালে নাকি নিশ্চিহ্ন হয়েছে উইয়ের আক্রমণে!
বসু দম্পতির বিস্তৃত ভ্রমণ অভিজ্ঞতার খুব সামান্য বিবরণই আমরা পাই অবলার লেখালেখিতে। অবলার লেখায় একটি আধুনিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় – বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জায়গাটির ভৌগোলিক অবস্থান এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন, কোথাও কোথাও দিয়েছেন যাওয়ার পথের হদিশও। অবস্থান এবং যাওয়ার পথনির্দেশ দিয়েই তাঁর নিজের মাদ্রাজ ভ্রমণের কথা শুরু করছেন লেখিকা। তখন ট্রেনে বা জাহাজে মাদ্রাজ যাওয়া যেত। কলকাতা থেকে মাদ্রাজের সরাসরি কোন ট্রেন ছিল না, পুণেতে বদল করতে হত। যাত্রাপথেই ছ’দিন লেগে যেত। তাই পাঠকদের উদ্দেশে লেখিকার পরামর্শ জলপথে যাওয়াই ভালো। তাতে চারদিনে সরাসরিই মাদ্রাজ পৌঁছানো যাবে আর উপরি লাভ হবে সমুদ্র দেখা আর জাহাজে চড়াটা। লেখিকা নিজেও জলপথেই গিয়েছিলেন। সেই সময়ে বিদেশ যাওয়ার এত নিয়মিত সুযোগ অন্য কোন ভ্রমণ লেখিকাই পাননি। ইউরোপগামী জাহাজে চড়ে বিলাত যাওয়ার সাধ জেগেছিল স্বর্ণকুমারীর। সে সাধ পূর্ণ হলে হয়তো বিলেত নিয়ে অসাধারণ কিছু ভ্রমণ কাহিনিতে সমৃদ্ধ হত বাংলা সাহিত্য। কৃষ্ণভাবিনীও তাঁর বিলাত যাত্রার প্রথম কয়েকবছরের ছবিই বারবার এঁকেছেন। সেই দিক থেকে অবলা বসুর বিদেশের নানান জায়গা নিয়ে ছোট ছোট লেখার ধরণটি বেশ অন্যরকম। নিয়মিত যাওয়ার সুযোগ ছিল বলেই হয়তো কৃষ্ণভাবিনীর মত বড় লেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি অবলা।
পুরোনো পত্রিকাগুলি বিশেষতঃ ‘মুকুল’ দুষ্প্রাপ্য হওয়ার জন্য অবলা বসুর লেখাগুলি খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিনই ছিল। বিভিন্ন সূত্রে যে কয়টি লেখার প্রসঙ্গ পেয়েছি তার সবকটাই খুঁজেপেতে উদ্ধার করেছি। কাশ্মীর, লখনৌ, চিতোর, মাদ্রাজ – ভারতের এই চার জায়গার ভ্রমণ কাহিনি এবং ইংলণ্ড, ইতালি, আমেরিকা ও জাপান এই চার বিদেশ ভ্রমণকথা অবলার কলমে পাই।
১৩৩২ সালের প্রবাসীতে তাঁর এই প্রথম ইউরোপ ভ্রমণের কথা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল বাঙ্গালী মহিলার পৃথিবী ভ্রমণ লেখাটি। এই লেখাতে তাঁদের ইউরোপ যাত্রার কারণ এবং বিজ্ঞানী মহলে সমাদরের উল্লেখ পাওয়া যায় –‘বহুদেশ ভ্রমণ করিয়া দেশসেবার নানা উপাদান সংগ্রহ করিতে পারিয়াছি। সেকথা বলিতে গেলে ১৮৯৬ খৃষ্টাব্দ হইতে আরম্ভ করিতে হয়। সেই বৎসরে আচার্য্য বসু মহাশয় অদৃশ্য-আলোক সম্বন্ধে তাঁহার নূতন আবিষ্ক্রিয়া বৈজ্ঞানিক সমাজে প্রদর্শন করিবার জন্য ব্রিটিশ এসোসিয়েশনে আহুত হন। তাঁহার সহিত আমিও যাই; এই আমার প্রথম ইয়োরোপ যাত্রা। ইহার পর ৫।৬ বার তাঁহার সহিত পৃথিবীব্যাপী ভ্রমণে বাহির হইয়াছি। আমার ভ্রমণকালের মধ্যে পৃথিবীর ইতিহাস নানা ভাবে ভাঙ্গিয়াছে ও গড়িয়াছে, এক আমার বয়সেই ইয়োরোপে কত পরিবর্ত্তন দেখিলাম।
ভারতীয় বৈদিক ধর্ম এবং দর্শনকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। একইভাবে ভারতীয় বিজ্ঞানের আধুনিক ধারাকে পশ্চিমি দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। তাঁদের এই ইউরোপ ভ্রমণ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা - যা আজও সেই আঙ্গিকে দেখা হয়নি। অবলার লেখাতে সে কথাই আমরা অনুভব করতে পারি এতকাল তো ভারতবাসী বিজ্ঞানে অক্ষম এই অপবাদ বহুকন্ঠে বিঘোষিত হইয়াছে, আজ বাঙ্গালী এই প্রথম বিজ্ঞান-সমরে বিশ্বের সম্মুখে যুঝিতে দণ্ডায়মান। ফল কি হইবে ভাবিয়া আশঙ্কায় আমার হৃদয় কাঁপিতেছিল, হাত পা ঠাণ্ডা হইয়া আসিতেছিল। তার পর যে কি হইল সে-সম্বন্ধে আমার মনে স্পষ্ট কোনো ছবি আজ আর নাই। তবে ঘন-ঘন করতালি শুনিয়া বুঝিতে পারিলাম যে পরাভব স্বীকার করিতে হয় নাই বরং জয়ই হইয়াছে। এই ভ্রমণেই কলকাতায় বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাটি তাঁদের মনে তৈরি হয়েছিল।
১৩০৫ সালের আষাঢ় ও শ্রাবণ সংখ্যার মুকুল পত্রিকায় অবলার ইতালি ভ্রমণ নিয়ে দুটি লেখা প্রকাশিত হয়। কৃষ্ণভাবিনীর লেখায় ইতালির ভেনিস নগরীর বর্ণনা পেলেও অবলার এই ভ্রমণ কাহিনির বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন, এমনকী ঊনবিংশ শতকে মহিলালিখিত সমস্ত ভ্রমণ কাহিনির থেকেই এই দুটি লেখা কিছুটা স্বাতন্ত্র্য বা বিশিষ্টতা দাবি করেএই লেখাদুটির বিষয়বস্তু ইতালির বিখ্যাত আগ্নেয়গিরি ভিসুভিয়াস এবং মৃত নগরী পম্পেয়াই। অবলার ইতালি ভ্রমণ শেষ হয়েছিল ভেনিস দিয়ে। ১৩০৬ সালের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যার মুকুলে এই লেখাটি প্রকাশিত হয়।
এডওয়ার্ড বুলেয়র লিটন লিখিত দ্য লাস্ট দেজ অফ পম্পেয়াই-এর একটি সংক্ষিপ্ত বাংলা অনুবাদ ছেলেবেলায় পড়ে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। অবলা বসুর লুপ্তনগরী লেখাটি পড়তে পড়তে বারবার সেই কাহিনি মনে পড়ছিল। সাবলীল কথনে দুহাজার বছর আগের প্রাচীন নগরী আমাদের চোখের সামনে যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। অতীতকথা শুনতে শুনতে আমরাও তাঁর সঙ্গে প্রত্যক্ষ করি সেই ঘুমন্তপুরীকে। কোথাও ভষ্মের আবরণে কারও যন্ত্রণাকাতর দেহ আজও একইরকম রয়ে গেছে, কোথাওবা বন্দির কঙ্কাল বাঁধা রয়েছে অনন্ত শৃঙ্খলে। থিয়েটার, স্নানাগার, বাজার সর্বত্রই সেই একই চিত্র। সারাদিন ঘোরার পর দিনের শেষে একটা উঁচু জায়গায় বসে শহরটিকে শেষবারের মত দেখতে দেখতে নানান ভাবনা ভিড় করে আসছিল লেখিকার মনে। মনে হচ্ছিল এই অভিজ্ঞতা বুঝি বা বাস্তব নয় সবটাই কল্পনা, মনে পড়ছিল ছেলেবেলায় পড়া কোন এক রূপকথার গল্প - যেখানে সাজানোগোছানো রাজ্যে সবই আছে, শুধু হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, রাজপুত্র-রাজকন্যা সবাই মৃত। কিন্তু পরমুহূর্তেই মৃত পম্পেয়াই নগরীর এক দৃশ্যের কথা মনে পড়ল তাঁর - আর বড় বেশি জীবন্ত সেই দৃশ্য দিয়েই সহস্র বৎসরের দূরত্ব যেন তাঁর চোখে মুহূর্তে মিলিয়ে গেল, মুছে গেল দেশকালের ব্যবধান। এই অনুভূতিতে এসেই লেখাটি একটি বৃহত্তর মাত্রা পেল একটি গৃহ ক্রমে ক্রমে ভষ্মে ঢাকিয়া যাইতেছিল। সেই গৃহে একটী নারী দুহাতে তার শিশুটিকে উচ্চে ধরিয়া রহিয়াছিল। ভগ্নস্তূপ ক্রমে ক্রমে উন্নত হইয়া দুঃখিনী মাতাকে নিমজ্জিত করিতেছিল। কিন্তু সেই অগ্নির প্রসার হইতে শিশুকে রক্ষা করিতে হইবে। জ্বলন্ত ভষ্মস্তূপ তিল তিল করিয়া দগ্ধ করিয়াও জননীকে একেবারে অবসন্ন করিতে পারে নাই; কি যেন এক মহাশক্তি, দুঃসহ যন্ত্রণা দমন করিয়া রাখিয়াছিল! মাতার হস্ত দুইটি মৃত্যু যন্ত্রণাতেও অবশ হইয়া পড়ে নাই। দুই সহস্র বৎসর পরে সেই উর্দ্ধোথ্থিত করপুটে সন্তানটি পাওয়া গিয়াছে। সেই মাতার স্নেহস্পর্শে যেন অতীত বর্ত্তমানের সহিত মিলিয়া গেল। একই দুঃখে, একই স্নেহে, একই মমতায় সেকাল ও একাল, পূর্ব্ব ও পশ্চিম যেন বান্ধা পড়িল! তখন পম্পেইর মৃত রাজ্য সঞ্জীবিত হইয়া উঠিল, এবং রাজপথ আমার চক্ষে অকস্মাৎ লোকজন পূর্ণ হইল! - এই রচনাটি নিঃসন্দেহে অবলা বসুর ভ্রমণ কাহিনিগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
আমেরিকা হয়ে ১৯১৫ সালের এপ্রিল মাসে জাপানে পৌঁছান অবলা। জাপান দেশটি দেখার এবং জানার জন্য খুবই আগ্রহী ছিলেন অবলা। জাপান ভ্রমণ লেখাটিতে অল্প কথায় সেইসময়ের জাপানের প্রাকৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সামগ্রিক চিত্রটি খুব সুন্দর তুলে ধরেছেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই আমেরিকার পরপরই জাপানে যাওয়াতে দুই দেশের মধ্যে তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গীর অবতারণাও হয়েছে তাঁর ভাবনায়। একমাত্র জাপানের ক্ষেত্রেই  তিনি নারী স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি নিয়ে আলোচনা করেছেন - যদিও বাঙালি মেয়ের সঙ্গে কোন তুলনা না করেই। জাপানি মহিলাদের দেখে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হন অবলা। তাঁর মনে বাংলার মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের ভাবনাটি সেখানেই শুরু হয়েছিল যার উল্লেখ পাই নারী শিক্ষা সমিতি নামে একটি প্রবন্ধে আমি যখন ১৯১৪ খৃষ্টাব্দে জাপান ভ্রমণ করিতে যাই তখন সেখানে শিক্ষার বিস্তার দেখিয়া নিজের দেশের অজ্ঞতা স্মরণ করিয়া অত্যন্ত দুঃখ হয়। তখনই আমার মনে নারী শিক্ষা সমিতি স্থাপন করিবার কল্পনা উদয় হয়।

অবলা বসুর মতো দেশ-বিদেশ ভ্রমণের এত সুযোগ সেইসময়ে আর কোনও বাঙালি মহিলা পেয়েছিলেন বলে আমার জানা নেই। তাই ভ্রমণ কাহিনিগুলির শেষে পৌঁছে স্বাভাবিকভাবেই মনে হয় আরও লিখলেন না কেন অবলা? লেখাগুলি পড়তে পড়তে শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে হয় সেই মানুষটিকে যিনি একশো বছর আগেও মহিলা হয়ে নিজের জীবন এবং যাপনকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন বৃহত্তর কোনো উদ্দেশ্যে। সেই মানুষটিকে স্মরণ করতে ইচ্ছে করে যাঁকে আমরা বাঙালি মেয়েরা আজ প্রায় কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুলে গেছি, ভুলে গেছি তাঁর আদর্শ মাথা পেতে নিতে। একমাত্র ব্যতিক্রম তাঁর আদর্শে গড়ে ওঠা নারী শিক্ষা সমিতি

No comments:

Post a Comment