Thursday, June 30, 2016

স্টেশনের কাকিমা

স্টেশনের কাকিমা মারা গেছেন, এইমাত্র খবর পেলাম। স্টেশনের কাকিমা আমার আত্মীয় সম্পর্কে কাকিমা নন। কিন্তু কাকিমা বলতে চিরকাল ওই একটি মুখই মনে ভেসে ওঠে।

রূপনারায়ণপুরের ছোট্ট নির্জন স্টেশনটার থেকে সিঁড়ি বেয়ে উঠে সামনেই সবুজ চওড়া চত্বর পেরিয়ে সার দিয়ে স্টেশনের ছোট্ট ছোট্ট কোয়ার্টারগুলো। হয়ত এটা ৩৫ বছর আগের স্মৃতি আমার কিম্বা আরও বেশি। একেবারে স্মৃতি নেই থেকেই শুরু করা ভালো বোধহয়।

মা আর দাদার চিকেন পক্স হয়েছিল পরপর। সেইসময়ে একমাস ওদের বাড়িতেই থাকতাম। তখন আমি কত ছোট তা মা বলতে পারবে। দু-তিন বছর হবে হয়ত।

কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে একটু ডানহাতে একটা কাঠচাঁপা ফুলের গাছ ছিল। গাছের তলা থেকে ফুল কুড়াতে খুব ভালোলাগত। সকালবেলায় উঠে গোবর কুড়িয়ে আনত কাকিমা। সেই দৃশ্য আবছা আবছা মনে আছে আমার। আমিও ঘুরতাম সঙ্গে সঙ্গে। আমি নাকি উঁ, উঁ করে গোবরের তাল দেখাতাম।
আমি চাটনি খেতে খুব ভালোবাসতাম। ব্রাহ্মণ বাড়ি, ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপার ছিল। আমি নাকি একদিন চাটনির বাটিতে হাত ডুবিয়ে খাচ্ছিলাম। মা বকতেই, কাকিমার প্রবল আপত্তি, ও যা করছে করুক, ওতে কিছু হবে না। ওই বাড়িতে সর্বত্র আমার অগাধ গতি আর দোর্দণ্ড প্রতাপ। ওখান থেকেই সকড়ি কথাটা শিখে বাড়িতে খুব বলতাম।

বাবার প্রথমবার হার্ট অ্যাটাক হল, আমি ক্লাস টুতে পড়ি, দাদা থ্রি। মা তো বাবার খাবার নিয়ে চিত্তরঞ্জন হসপিটালে চলে যেত। আমরা দুই ভাই-বোনে গুটি গুটি পায়ে স্টেশনের কাকার বাড়ি। তখনও কাকিমার পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াতাম।

মৌদিদির পাত্র দেখতে আসার কথা মনে পড়ে। মৌদিদির গান প্র্যাকটিশ হারমোনিয়ামের রিড টিপে। গানগুলোও মুখস্ত ছিল অনেকদিন। যে ঘরে মৌদিদি প্র্যাকটিশ করত, সেই ঘরের দেওয়ালে বেশ কয়েকজনের ছবি বড় ফ্রেমে ঝোলানো ছিল। একজোড়া আলতা মাখা পায়ের ছবিও। সেটা দেখে আমার ভয় করত খুব। ভয় করত ওই কাঠচাঁপা গাছটার থেকে একটু এগিয়ে একটা ছোট শিবমন্দির ছিল ঝোপঝাড়ের মধ্যে সেই জায়গাটাকে। কেমন একটা অদ্ভুত লাগত ওখানে, ভয় আর কৌতূহল মেশানো অনুভূতি। তাও মাঝে মাঝেই ওখানে যেতাম। একেকদিন সন্ধেবেলায় কাকিমার কাছে বকুনিও খেয়েছি। কে একবার ওখান থেকে টেনে নিয়ে এসেছিল।

মৌদিদির বিয়ের কথা মনে আছে। পেটুক আমির খাওয়ার কথাই মনে পড়ে যায়। লাল রঙের দই খুব খেয়েছিলাম, মানে অল্পবয়সে যেমন খাওয়া যায়। সেই মৌদিদির স্বামীও আর নেই, সেও গতবছর রূপনারায়ণপুরে গিয়ে জানতে পারলাম।

উত্তম দাদা স্নেহ করত খুব। আর গৌতম দাদা অত বড় নয় বলেই বোধহয় আমার বেশি প্রিয় ছিল।
বাবা আর স্টেশনের কাকা রূপনগরে একসঙ্গে জমি কিনেছিল, পাশাপাশি বাড়ি করবে বলে। শেষপর্যন্ত বাড়ি করাটা আর হয়নি আমাদের ভাই-বোন দুজনের আপত্তিতে। কেবল বাবার পাঁচিল ধরে ধরে আমি অনেক বড় বয়সে মায়ের সাহায্যে সাইকেল শিখেছিলাম। কাকার রিটায়ারমেন্টের পর ওনারা রূপনগরের বাড়িতে চলে যান। ওই বাড়িতে বরং আমি কম গেছি। ততোদিনে বড় হয়ে গেছি অনেকটাই।

গতবছর ওই যে হঠাৎ করে গেলাম, আজ মনে হল ভাগ্যিস গিয়েছিলাম। কাকিমার কাছে শেষবার আদরটুকু খেয়ে এলাম। এত বড় আমাকে সেই ছোটবেলার মতোই জড়িয়ে ধরে আদর করল। একা একা গিয়েছি বলে কাকা রাগ করছিল। কাকিমা আড়াল করল। নিজেই গিয়ে দোকান থেকে খাবার কিনে আনল।


কাকিমা চলে গেল। আমার একটুকরো অবোধ ছেলেবেলা চলে গেল ওই সঙ্গে।

ভালোকথা-মন্দকথা

নিজের চারপাশে ভালোকথার প্রাকার খাড়া করে তুলেছিলাম এত বছর একটু একটু করে। পাছে একটুও মন্দকথা ঢুকে পরে তাই সব ফাঁকফোকর বুজে একলা একলা শক্ত হয়ে ছিলাম। হঠাৎ বিষম একটা ঝড়ের মতো মন্দকথা প্রাকারটাকার ভেঙে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে এল। এদিক সামলাই তো ওদিক ভাঙে। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি এতদিনের জমে ওঠা ভালোকথার ধুলো আর শেওলা কী ভয়ানকই না দেখাচ্ছে মন্দ কথার রোদ্দুর আর বাতাসে। সে রোদ্দুর আর বাতাস যতই বইতে থাকে,ঝরে পড়ে ভালোকথার টুকরোগুলো। লাগে,খুব লাগে। প্রবল বেদনায় ভেঙে পড়ি। শেষে,আর কিচ্ছু বাকি রইল না,ভালো আর মন্দে একেবারে মিলেমিশে গেল,তখন খেয়াল করে দেখলাম প্রাণের গভীরে যেটা পড়ে আছে,তারই নাম মুক্তি অথবা আনন্দ।

Wednesday, June 29, 2016

না

স্মৃতির ভেতরে তোমাকে রাখিনা কখনও।
এই সময়ের মতো মরে যাওয়া স্মৃতির হাঁ করা গহ্বরে।
স্মৃতি তো পুরোনো কাগজফেলে দিলেই মুক্তি।
এতটা জীবন্ত একটা মানুষকে 
কেবল লিখে রাখা যায়। কলমে অথবা বিষন্নতায়।
স্মৃতির ভেতর তোমাকে রাখিনি কখনওসময়ের ভাঁজে।
জলকণায় রাখিঅথবা দুই চোখে।

তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা

কতগুলো শব্দ-অক্ষর-বর্ণমালার প্রেমে পড়ে গেলাম। যে সবকিছু আমাকে মনে করে উচ্চারিত হয়নি কখনও অথচ আমাকেই লিখে গেছে চিরকাল। যে সব শব্দের ভাঁজে অনুচ্চারিত জুঁইয়ের সুবাস ঝরে ঝরে পড়ে বৃষ্টিকণার মতো। যেসব শব্দ কবিতার মতো নেশা ধরায় অথবা নিবিড় শান্তি বহন করে আনে। নিজেকে খুঁড়তে খুঁড়তে বিষ উঠে এলে অমৃতর আস্বাদ এনে দেয়। পরিপূর্ণ সঙ্গম শেষের ধূপধুনো সেইসব শব্দ-অক্ষর-বর্ণমালা।

এই গুমোট মনখারাপ

অর্থহীন মনখারাপের ভেলায় ভেসে আসা কথোপকথন স্মৃতির মধ্যে জলতরঙ্গের মতো বাজতে থাকে। অথচ গুমোট গরমে পাখার একঘেঁয়ে শব্দতোলা বাতাসে চুলগুলোও এলোমেলো হয়না। আজও মেঘ করেছে। দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি নিভে গেছে মাটির কোলের কাছে এসে। খুব একপশলা বৃষ্টির সোঁদা বাতাস মনকেমন ভাসিয়ে নিয়ে যায় দূর দেশে। যেখানে রূপকথারা কেবল বৃষ্টি হয়ে ঝরতে থাকে।

ভারতবর্ষ?

উন্নয়ণের একেবারে নীচের তলায় প্রতিটা আন্ডারপাস এখন কলকাতার বেশ কিছু ভিখারির ঠিকানা - পায়ের তলায় শক্ত জমি এবং মাথার ওপর ছাদ। স্বাধীনতার এত বছরে রঙ আর দল বদলাতে বদলাতে এদের বেঁচে থাকার চিত্রটা এটাই।


ওরই পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে হঠাৎ করে ভারতবর্ষের মতো লাগছিল। এই যে না সারা এত অসুখ, এত বেদনা ভেতরে ভেতরে, অথচ ওপরে দিব্বি একটি হাসিমুখ কাঠামো।

Sunday, June 26, 2016

একটি সত্যিকারের মানুষের ইতিকথা অথবা কয়েক ঘন্টার কাহিনি -১

কাহিনির শুরুটা হয়েছিল একতলায়। পুরোনো বাড়ির একটা ঘরে মানানসই পুরোনো বড় হাতলওলা চেয়ারে বসে। অনেকেই ওনার ইন্টারভিউ নিয়েছেন শুনলাম। এটা নিতান্তই সাধারণ কথোপকথন। নাহ্‌, কাজের ঠেলায় সব কথায় কান দিয়েছি, বা কান দিলেও মন দিয়েছি এমন বলব না, তবে কিছু কিছু শব্দ-অক্ষর-বর্ণমালা তো গেঁথে যায় মনে ও মগজে।

কলিংবেলে দরজা খুলে দিয়েছিলেন লম্বা সুদর্শন পিতৃতুল্য ব্যক্তিটিই সাতাত্তর বছরের তরুণ অশোক কুমার রায়।

বললেন, ওই যে চেয়ারটায় বসে আছেন, ওইটাও আমার করা। এই বাড়ি, আর যা কিছু দেখছেন সবই। ওই যে কারো কাছ থেকে পাওয়া, আমি কিছুই পাইনি।

জানলেন আমার গবেষণার বিষয়। বেশ মন দিয়েই শুনলেন। ওরই ফাঁকে পাশে ফাঁকা খাট দেখালেন, বললেন, এখানে কারা থাকে জানেন? প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা ছাত্রছাত্রীরা। এখানেই থাকে, খায়। ওরাই যখন যা পারে ফুটিয়ে দেয় দুটো ডাল-ভাত, আলুসেদ্ধ, ওরাও খায়, আমিও তাই খাই। অনেকসময় পড়ার খরচও দিই। এখনি আসবে দেখুন, মুসলিম মেয়েটি, এই প্রথম জেনারেশন পড়াশোনা করছে, বাঁশি বাজায় খুব ভাল। রবীন্দ্রভারতীতে বি মিউজ করছে, আমিই ভর্তি করিয়ে দিয়েছি। তবে বেশ চালাক-চতুর, এরমধ্যেই সংখ্যালঘু স্কলারশিপ এসব অ্যাপ্লাই করে ফেলেছে (এখানে মনে হয় একটু অন্যমনস্ক ছিলাম, ডিটেলস ভুলে গেছি)। ওরই আমাকে দেখার কথা, আর আমিই ওকে দেখছি। এই তো কাল সকালে আমাকে টিফিন দিয়ে যাবে কামালগাজি, কোন এক গুরুর কাছে, আমার খাওয়া-দাওয়া, কে জানে! তবে দেখুন, ও যদি এমন কিছু করত যে আমার মনে হত সময় নষ্ট করছে, আমি নিশ্চয় বলতাম। ও তো নিজের কেরিয়ার বিল্ড করছে। একদিন অনেক ওপরে উঠবে, নাম হবে ওর।

প্রশ্ন করি, আপনার খবর পায় কী করে?

বললেন, পায়। হয়ত একজন গিয়ে তার গ্রামের অন্যদের বলে। তাছাড়া একেবারেই আলাদা জায়গা থেকেও আসে। সবাই বেশ দুঃস্থ। কারো বাবা চাষা, কেউ ছুতোর মিস্ত্রীর ছেলে-মেয়ে। অধিকাংশই ফার্স্ট জেনারেশন লেখাপড়া করছে। কিন্তু করছে তো আগ্রহ নিয়ে।

তারপর আবার নিজের কথায় ফিরে আসেন।

খুব ছোটবেলায় মা মারা গিয়েছিল। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা সেই যে সরে দাঁড়ান আর কখনওই ছেলে-পুলের কোন দায়িত্ব সেভাবে নেননি। অথচ বাবা যথেষ্ট সম্ভ্রান্ত, সচ্ছ্বল ব্যক্তি ছিলেন। জীবনের একটা বড় সময়ই বেশ স্যুটেড-বুটেড অবস্থায় কাটিয়েছেন সুলেখক, সম্পাদক, গবেষক, নৃতত্ত্ববিদ, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রট এমন নানান পেশা ও নেশায় সেইসময়ের পরিচিত মানুষ নৃপেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী। কাকা স্বনামধন্য শিবনারায়ণ রায়। দাদু ছিলেন ঊনবিংশ শতকের নামী প্রবন্ধকার ও জীবনীকার মন্মথনাথ ঘোষ। বড় হয়েছেন মামাবাড়িতে। তারপর দেওঘর রামকৃষ্ণ মিশনে পড়েছেন। পরে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। আর্থ কোয়েক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে বিদেশে পড়াশোনা করেছেন। চাকরি শুরু করেছিলেন লারসন অ্যান্ড টুবরোয়। ওনার একটি নতুন ভাবনা সম্বলিত পেপার ভারতে স্বীকৃতি না পাওয়ায় বাবার পরামর্শে ইউনাইটেড নেশনস-এ পাঠান। তাঁরা সাগ্রহে সেটি গ্রহণ করে এবং ওনাকে চলে আসতে বলে। উচ্চপদে চাকরি সূত্রে ঘুরেছেন বহু দেশ-বিদেশ।

মামারবাড়ির খাটে শুয়েছি, তাদের বালিশ মাথায় দিয়েছি, তাদের থালায় খেয়েছি। স্বচ্ছল পরিবারে যত্নে-আদরে বড় হয়েছি। মা-কে সেভাবে না পেলেও মামীমা সেই অভাব বুঝতে দেননি। দাদু ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে বলেছিলেন। আমাদের বাড়ির সবাই আর্টসের ছাত্র। আমাকে বললেন, করে খেতে হবে তো। লেখালেখি করবি, ওটা সবসময় থাকবে, আগে পেটের ব্যবস্থা কর। লেখালেখিটা কখনও ছাড়িনি বুঝলেন। দাদু উইলে লিখে গিয়েছিলেন, আমাদের যতদিন ইচ্ছে আমরা ও বাড়িতে থাকব, খাব। দাদা তো ষাট বছর বয়সে সল্টলেকে ফ্ল্যাট কিনে বিয়ে করে ওবাড়ি ছাড়ল। আমি তো সেই কুড়ি বছর থেকেই বাইরে বাইরে কাটিয়েছি। একটা কিছুও নিয়ে আসিনি ওখান থেকে।

তো সেই দাদার বিয়ের গল্পও শোনালেন।

স্ত্রী মারা গেছেন এগার বছর হল। নিজের বিয়ের সূত্রেও দু-একটা মজার কথা বলেছিলেন পরে। ছেলে সরকারি চাকরি করেন। কলকাতায় আলাদা ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছেন। চাকরি সূত্রে ছেলে আর তার বউ দুজনেই আলাদা থাকে্ন, নাতি মানুষ হচ্ছে তার দিদিমার কাছে। উইকেন্ডে কলকাতার ফ্ল্যাটে থাকেন তাঁরা। বছরে বিশেষ কয়েকটা দিন এখানে আসেন।

এই সূত্রেই জেনে যাই ওনার ছেলে আর আমি প্রায় এক বয়সী। অনেকক্ষণ থেকেই সুযোগটা খুঁজছিলাম। এবার বলেই ফেলি, আমাকে আর আপনি করে বলবেন না।

অজস্র ছেলেমেয়ে প্রতি বছর তাঁর পরামর্শে, সাহায্যে নানা ডিগ্রীধারী হয়ে চলে যাচ্ছে, ভুলে যাচ্ছে তাঁকে। আবার আসছে নতুন দল। একটাই কথা, কারোর থেকে অর্থ সাহায্য নয়। একটি দুটি গল্প বললেন। একবার কোথায় এক সভায় গেছেন। সেখানে হঠাৎ করে তাঁর এক পুরোনো পি এইচ ডি কারিনীর সঙ্গে দেখা। সে বলল, স্যার আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখিনি, এ আমার অপরাধ। রবিবার আপনি থাকবেন? আমি যাব। আপনার সব দায়িত্ব আমার। তারপর ম্লান হেসে যোগ করলেন সে আর আসেনি কোনদিনই। আরেকজন, বেশ পরিচিত নাম। তাঁর সহায়তায় পি এইচ ডি এবং অন্যান্য কাজ করেছেন। কিন্তু কোনও বই-ই দেননি। অবশ্য এটা অধিকাংশের ক্ষেত্রেই হয়। ভদ্রমহিলার মৃত্যুর পর তাঁরই স্মৃতিতে আয়োজিত একটি বক্তৃতা সভায় প্রথমে আপত্তি করেও তারপর বক্তব্য রাখেন। বিষয় অন্যকিছু ছিল। সভাশেষে ভদ্রমহিলার প্রসঙ্গে জানান, ওঁর কথা আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। তারপর আমার দিকে ফিরে ছেলেমানুষের মতো বললেন, বলুন থাকবে না? সব কটা বই কিনে নিতে হয়েছিল। তবে ওরা সেদিন হাজার টাকা সাম্মানিক দিয়েছিল। নিলাম। ভাবলাম বই কটার দাম হয়ে গেল।

এইসব বলতে বলতেই বাস্তবে ফিরলেন আবার। বিদেশের চাকরি ছেড়েছুড়ে চলে এলাম। ভাবলাম যা টাকাপয়সা আছে বইপত্তর পড়ে আর ডাল-ভাত আলুসেদ্ধ খেয়ে দিব্যি চলে যাবে। তখন পোস্টাফিসে সুদের হার ছিল চোদ্দ পার্সেন্ট আর এখন আট পার্সেন্ট। কেমন করে চলবে বলুন তো? যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে রোজ। আমি একা। কিন্তু একা তো নই।


সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠি আমরা। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে তখন।

Saturday, June 25, 2016

একটি ‘ভারতী’র জন্য

১৩০৬-এর ভারতী পত্রিকা কোথাও পাচ্ছিলাম না। যাকেই জিজ্ঞাসা করি সেই ন্যাশনাল লাইব্রেরী আর সাহিত্য পরিষদ দেখায়। আরে বাবা ওসব কবেই চষে ফেলেছি। জাতীয় গ্রন্থাগারে নেই আর সাহিত্য পরিষদের কপিটা ড্যামেজড। যারা উত্তরপাড়া ইত্যাদি বলছিল, তাদেরকেও বলেছি বাপু অমন চেনাশোনা সব জায়গা সে কি আর না দেখেছি? চন্দননগর যাব বলে সবে প্ল্যান করছিলাম। শুনেই সোমনাথ (বাংলা রাশিয়ান বই-এর ব্লগের সূত্রে বন্ধুত্ব) হাঁ হাঁ উঠল, এই শরীরে...আমি দেখছি...

একটাই বেশ ভালো কন্ডিশনে কপি ছিল চৈতন্য লাইব্রেরীতে। সেটা প্রায় একবছর ধরে শুনছি মিসপ্লেসড। মাঝে মাঝেই চৈতন্য লাইব্রেরীর অল্পবয়সী যে ছেলেটির হাতে বইটা প্রথমবার দেখে তুলে দিয়েছিলাম, তাকে তুলে আছাড় মারতে ইচ্ছে হয়নি, এমন কথা অস্বীকার করব না। সত্যি বলতে কী মনে মনে ডাকাতির প্ল্যানও করেছি মাঝে মাঝে যে, কী ভাবে ওই লাইব্রেরীতে ঢুকে আগাপাশতলা ঘেঁটে বইটা উদ্ধার করা যায়। মানে ওদেরই দিয়ে আসতাম। আসলে মিনিট পাঁচ-সাত খুঁজে এসে ওই বয়স্ক নির্বিকার মুখ -নাহ্‌, পেলাম না...,  মাথার ভেতরটা কেমন রী রী করে উঠতে থাকে।

বুঝলাম, অতঃপর ফের ছোট শান্তিনিকেতন। ফের অনিচ্ছুক লোকজনকে ধর। যাওয়া-আসা, অন্তত একদিন থাকা...। সেই অবলা বসুর পুনরাবৃত্তি...।

সোমনাথ অনেকদিন আগে অশোক রায়ের নম্বরটা দিয়েছিল। সিঁথিতে ভদ্রলোকের ব্যক্তিগত লাইব্রেরী আছে। ফোনে কথা হয়েছে আগে কিন্তু মোবাইল ঘেঁটে নম্বর পেলাম না। আবার সোমনাথকে মেসেজ, নম্বরটা দাও। উনি বলেছিলেন, ঊনিশ শতকের তেমন কিছু বই-পত্রিকা নেই, অধিকাংশই বিশ শতকের। আর আমি জানি, যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখিও তায়, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন ইত্যাদি।

অতএব ছাই উড়াইতে চলিলাম।

১৩০৬-এর ভারতী বলতেই নির্দিষ্ট তাক থেকে বার করে দিলেন। বললাম, আমার উচিত আপনাকে একটা প্রণাম ঠোকা। যাওয়া-আসা, একদিন অন্ততঃ থাকা এই যে এতটা খরচ বেঁচে গেল মোষ তাড়ানোর সে কি কম? তবে উনিও প্রণাম নিলেন না, আর আমিও ওনার গল্পের ফাঁকে ফাঁকে কাজ করতে লাগলাম।


Thursday, June 23, 2016

অলীক

সব মুছে দিতে পারি
সমস্ত স্মৃতি ও যন্ত্রণা।
পারি বলেই সঙ্গোপনে থাকো।
পারি বলেই নিভৃত বেদনা।

কবিতা

শব্দ ও অক্ষর মুঠোভরে রাখি
তোমাকে হারাই পাছে।
অথচ মুঠো খুলে দেখেছি কখনও
জলকণা, বাষ্প লেগে আছে।

বন্ধু

স্মৃতির ভেতর তোকে রাখিনা কখনও -
এই সময়ের মতো মরে যাওয়া স্মৃতির হাঁ-করা গহ্বরে।
স্মৃতি তো পুরোনো কাগজ, ফেলে দিলেই মুক্তি।
এতটা জীবন্ত একটা মানুষকে কেবল লিখে রাখা যায় কলমে অথবা বিষণ্ণতায়।
স্মৃতির ভেতর তোকে রাখিনা কখনও সময়ের ভাঁজে।
জলকণায় রাখি, অথবা দুই চোখে।

Monday, June 20, 2016

ভাবছিলাম

এভাবে কিছু হওয়ার নয়। হবেও না। আমি তোকে বলেছিলাম। বামপন্থী বলতে যে সৎ সাধারণ আদর্শবাদী মানুষের ছবি চোখে ভেসে ওঠে, তেমন মানুষেরা আজও আছে। শুধু বামপন্থী বলতে আর তাদের কথা মনে হয়না মানুষের। বামপন্থী বলতে ভেসে ওঠে তাদেরই মুখ, ক্ষমতায় টিঁকে থাকার জন্য যাদের আশ্রয় দিয়েছিল, পুষ্ট করেছিল দল। নাহলে অনেক আগেই ক্ষমতাচ্যূত হত। অথচ সেই ক্ষমতাচ্যূত হলোই, তারসঙ্গে মানুষের মনের শ্রদ্ধাটুকুও হারাল। অনেক আগে ক্ষমতাচ্যূত হলে অন্তত বিরোধী রাজনীতি বলে কিছু থাকত। এত বছরে কী হয়েছে বল? একেবারে শুরুতে যেসব কৃষকেরা চাষের জমি নিজেদের বলে পেয়েছিল তা ছাড়া? সেই জমিও আজ তাদের প্রয়োজনের তুলনায় কম। আর যাদের কাছ থেকে জমি কাড়া হয়েছিল তারা কখনওই বামপন্থীদের সমর্থন করবে না। শিল্পের ভরসা দিয়েও আর ফেরানো যাবেনা মানুষকে। তারা হাতে গরম জিনিস পাচ্ছে। সেই সাইকেল, স্কুল ব্যাগ হোক কী চাল। তারা কিছু তো পাচ্ছে, কিছু না পাওয়ার থেকে। রাস্তাঘাট আপাত উন্নত হয়েছে, বিদ্যুৎ এসেছে। দু-একটা উড়ালপুল অমন ভেঙে পড়তেই পারে। মানুষকে সব কিছুই ভুলিয়ে দেওয়া যায় এমন কী মৃত্যুও। কারণ নিজের বেঁচে থাকাটা, আরেকটু ভালো থাকাটা তার কাছে বেশি জরুরি। এই প্রক্রিয়ায় কে কত ঘুষের টাকায় পকেট ভরালো কার তাতে কী?

কংগ্রেস এবং সিপিএম এদের মুশকিল হল, কিছু না কিছু আদর্শ তাদের গায়ে লেগে আছে। ফলে কিছু করলে তার থেকেও বেশি ছি ছি জোটে। আর বাকি দলগুলো যতই নীচে নামুক, মানুষ ভাববে আরে এরা তো এরকমই, বলে পাশ ফিরে শোবে।

মানুষ বুঝে গেছে কেউ তাদের ভালো করবে না। অতএব যা পাওয়া যায় এই বাজারে।

এই সব কিছুর ভবিষ্যত কী, অথবা আদৌ ভবিষ্যত বলে কিছু আছে কিনা ভাবছিলাম। মানে শেষপর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে, কতটা পাঁকে?

ছোটবেলায় সত্তরের সেইসব দিনের কাহিনি শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ক্যালকাটা ইউথ কয়ারের গান। আমাদের আগের মানুষদের সামনে স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শ তখনও খুব স্পষ্ট।

আমাদের সময়টায় খুব বড় কোনও আন্দোলন বা তেমন কিছু হয়নি এইখানে। শুধু আদর্শগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেছে।

কিছুই শেখাইনা আগামী প্রজন্মকে, বেঁচে থাকার লড়াই-এর কঠিন বাস্তবটুকু ছাড়া। তবু কোথাও যেন আশা করি ওরাও স্বপ্ন দেখতে শিখবে।


এই আশাটুকুই যা আছে।

অচেনা

আমি তো তোমায় চিনিনা একটুও।
তবু দাঁড়িয়ে থাকি -
যেমন করে ভোর দাঁড়িয়ে থাকে

অচেনা রাতের মোহনায়।

জাদু

এই জীবনের মধ্যেই অন্য এক জীবন চেয়েছিলাম। অন্য এক রূপকথা জীবন। অন্য এক আগুন জীবন। অথচ চাইলেই পাওয়া যায়না সবকিছু এটা ধ্রুবসত্য। অথবা অধিকাংশই খুব কম চাইলেও। জলরঙের ক্যানভাসে শুধু পড়ে থাকে ওষুধের শেষ হয়ে যাওয়া সার সার ফয়েল, ডাক্তারের বিল আর জমে ওঠা ব্যথা ও ক্লান্তি পিঠোপিঠি হয়ে। সেরে ওঠা নেই, মরে যাওয়াও নেই, কেবল টেনে নিয়ে যাওয়া। এই জীবন পেরোতে চেয়েছিলাম পাহাড় সমুদ্রের মতো। ভেবেছিলাম বন্ধ দরজার ওপারে আসলে সবুজ একটা মাঠ আছে, যার নাম কবিতা।

একটা জাদু খুঁজে যাচ্ছি শেষপর্যন্ত।

বুরুন, তুমি অঙ্কে তের

একটা স্বপ্নের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অন্য স্বপ্নে প্রবেশ করছিলাম। যেসব স্বপ্নের দরজা-জানলা অথবা পথ আমার এখন আর মনে পড়ছে না। এমন নয় যে বহুদিন আগে দেখা। স্বপ্নের মধ্যে শুনতে পাচ্ছিলাম কে যেন বলছিল, এভাবে জুড়ে দেওয়া যাচ্ছেনা খুলে যাওয়াগুলো। হাঁটতে হাঁটতে অন্য স্বপ্নে ঢুকতে গিয়ে ফেলে আসছিলাম পুরোনো পোশাকের মত আমাকে। একটা আমি থেকে অন্য আমিতে বদলাতে বদলাতে শুনতে পাচ্ছিলাম আবার কে যেন বলছে, বেঁচে থাকার কথা অথবা মৃত্যুর। কোনকথাই স্পষ্ট নয়। শব্দগুলো যেন আলতোভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে স্বপ্নের আনাচে-কানাচে।

এইসব ধ্বনিতে আমার শব্দের দরজা-জানলা পথ ভেঙে ভেঙে পড়ছিল। আমি নিজের ভেতরে ফিরতে গিয়ে কাঁপছিলাম। কাঁপতে কাঁপতে জেগে উঠছিলাম চেনা আলোয়, চেনা অন্ধকারে।

আমাকে ডাকছিল।


চোখ মেলে সেই আলো এবং ধ্বনির সঙ্গে সহাবস্থানে আসতে আসতে মনে পড়ল, 'বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো'। আর অমনি সব কেমন পরিষ্কার হয়ে স্বপ্নগুলো মুছে গেল।

Friday, June 17, 2016

তোমাকে

যদিও বেদনার টান রক্তের আরও নি:সীম গভীরে;
হাসির প্রলাপে ঢাকা তীব্র ক্ষতের দাগ। তবু

রাত্রির আয়ু মেখে এ আমি দীর্ঘজীবি হলাম।

মায়ের হাতের জাদু

সংসারে সবথেকে দরকারি মায়ের হাতের জাদু। যেটা ছোটবেলায় দেখে এসেছি। গল্পের বইটইতে থাকে যে মায়েদের গয়না দিয়ে দিল আর তা বন্ধক দিয়ে সংসার চলছে এইসব। আমার মায়ের কোনও গয়না ছিলনা, সত্যিই। ঠাকুমা যে বালাজোড়াটা দিয়েছিল তা ছোটপিসির বিয়ের সময়ে দিয়ে দেয়। আমার বিয়ের আগে বাবা কোনওদিন মাকে গয়না গড়িয়ে দেয়নি। বিয়ের সময়ে কেনা হারটাও আমাকে দিয়ে দিয়েছিল। সংসারের সব টাকাই চিরকাল বাবার কাছেই থাকত। আমাদের জন্য একটা পেন্সিল কিনতে হলেও মাকে তার দাম চাইতে হত। অথচ এই মা-ই দিনরাত্তির একা হাতে ঘরের সব কাজ, দুটো বাচ্চা সামলিয়ে, বাজার-হাট করে কেমন গড়িয়ে নিয়ে যেত সংসারটাকে। সারাবছরে মায়ের হয়ত একটাই শাড়ি কেনা হত। হয়ত বলছি, কারণ স্মৃতিতে প্রায় নেই যে মায়ের শাড়ি কেনা হচ্ছে। আমাদের বরাদ্দ ছিল বছরে দুটো জামা আর একটা জুতো। আমাকে বাবা আংটি কিনে দিয়েছিল। সেই আংটিই আমি পড়তাম না বলে মা পড়ত। এই শাড়ি-গয়না না থাকার জন্য পিসীরা উলটে মাকেই কত বাঁকা কথা শুনিয়েছে। এরপরেও ছোটবেলায় খাওয়াপরা নিয়ে কষ্ট হয়েছে কখনও মনে হয়নি। মায়ের হাতে কাচা ফর্সা কাপড় আর যাই থাকুক তাই দিয়েই মায়ের হাতের চমৎকার সব রান্না। ওরই মধ্যে নাড়ু-নিমকি, তালের বড়া, ক্ষিরের সিঙারা, মালপোয়া, আচার, জেলি বানাচ্ছে। আসলে ওই যে মায়ের হাতের জাদুতেই সংসার চলে।


দিনদিন জিনিসের যা দাম বাড়ছে, এতদিন সংসার করেও আমি তাল পাইনা। নিজে যখন হিমসিম খাই এখনও ফোন করে মাকে বলি, তুমি কিকরে চালাও বলতো? মায়ের এই জাদুটা যদি জানতে পারতাম তো বড় ভালো হত।

Wednesday, June 15, 2016

কবিতা

আমি তো পথে যেতে যেতে বেঁধেছিলাম একটা ভোর দুই ডানার মাঝখানটিতে।

আর তাই পরের শব্দ অক্ষরগুলো মিশে গিয়েছিল গত রাতের অন্ধকারে।

Sunday, June 12, 2016

একদিন একসঙ্গে

দূরে কোথায় দূরে দূরে...

কোথায় যেন বৃষ্টি পড়ছে কোথায়... কার জানলায়, কোন আলপথে বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে...। ঠাণ্ডা হাওয়া এসে লন্ঠনের শিখাটাকে নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে বারে বারে...। অন্যমনস্ক না ভাবনায় মাটির গন্ধ মিশে যাচ্ছে। ওই জল বাড়ছে জল বাড়ছে জানলায় শিকে মুখ লাগিয়ে কেমন মুখ চোখ চুল ভিজছে, কপাল বেয়ে জল গড়িয়ে এল। ঠাণ্ডা লেগে যাবে - সেই এক বকুনি। জানি সর্দি কাশি তারপর জ্বর। তাহোক ও লেগে থাকবেই। বৃষ্টি তো ওই আলপথ বেয়ে মেঘের ডানায় মাথা রেখে কোথায় চলে যাবে, সেই তেপান্তরের দেশে। ততোক্ষণ একটু ভিজে নিই আলগোছে। কাল স্নানের আগে বৃষ্টি এলে কিন্তু পুরো চুপ্পুস। আজ শুধু একটু হাতটা বাড়াই। যাবার আগের শেষ ছোঁয়াটুকু। দেখে নিও আমার জ্বর আসবে না, আসবে না, আসবে না। সত্যি।

তারপর

যে আমাকে বৃষ্টি দিয়েছিল, তার হাতে ছিল রঙিন লন্ঠন। সেইটা দোলাতে দোলাতে যাচ্ছিল জঙ্গলের পথে। বৃষ্টির ভেতর দিয়ে লাল নীল আলো কেমন হীরের কুচির মতো ঝরে ঝরে পড়ছিল।

তারপর চুপ কথারা।

হয়তো

ট্রেনের জানলায় মুখোমুখি বসে থাকে অনিশ্চিতেরা, নিশ্চিত গন্তব্যের দিকে যেতে যেতে।
মাঝখানে খোলা জানলা মেঘ রোদ্দুর, রাত দিন পেরিয়ে যায় একলা একলা।

কে জানে হয়তো বৃষ্টি পড়েছিল!

কবিতার বৃষ্টিপত্র

সেইথেকে বৃষ্টিরা আমার কবিতার ডায়েরিতে থাকে। যে ডায়েরির অনেক পাতা খালি। আর বাকিটা বৃষ্টি দিয়ে ভরা।
আমি শব্দ অক্ষর আর বর্ণমালা দিয়ে বৃষ্টির আঁকিবুকি কাটি। আর অমনি মেঘ জমে। জমতে জমতে অন্ধকার।
অন্ধকারের কথারা ঝরে ঝরে আমার পাতাগুলো টলমল করে।

ভালোবাসা

কবিতার নাম কবিতা কেন ওকে প্রশ্ন করেছিলাম।

ওর নাম হতেই পারত মনখারাপ কিম্বা এক পশলা বৃষ্টি। হতেই পারত ওর নাম শবনম কিম্বা মেঘপাহাড়ি। ওর সব ভালো। কেবল ওই কবিতা নামটা একেবারে মানায় না। ওই আটপৌরে হলুদ মাখা আঁচলের নামটা ওর জন্য নয়। ওর নাম হতেই পারত রূপকথা কিম্বা অন্য পৃথিবী। ভোরবেলা, আঁধার রাত যা কিছুই মানিয়ে যেত ওকেই।

তবু সোজা টানটান বিশ্রীরকমের কবিতা হয়েই তাকিয়ে রইল আমার মুখের দিকে। আর তারপরেও ওকে ঠিক আগের মতোই ভালোবাসতে ইচ্ছে করল।

আশ্চর্য!

ফিরে ফিরে আসা স্বপ্ন

কোনও কোনও দরজার ওপারে থাকে সবুজ মাঠ, কাঁচা মাটির রাস্তা আর দূরে নদী, নদীর ওপারে গাছের সারি। এমন অনেককিছুই যা তুমি যেতে যেতে বুনে নিতে পার।

কোনও দরজার ওপারে আছে কংক্রিটের পথ, ধুলো, জমে থাকা উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর বিরক্তি। এও বুনে নেওয়া সন্তর্পণে।

আর কোনও কোনও দরজার ওপারে এর কোনটাই নেই। কেবল জমাট বাঁধা অন্ধকার।
এর কোনওটা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার নাম এক জীবন।

আমি তো দেখছি অনেক মানুষ ওই তৃতীয় দরজার দিকে পা বাড়াচ্ছে। প্রতিদিন একটু একটু করে মরে যাচ্ছে মানুষ। বুলেটে নয়, ছুরিতে নয়, খিদেয় নয়। অন্যকে হত্যা করতে করতে নিজেকে মেরে ফেলছে।

আমি দেখছি দরজার ওপারে অন্ধকার সেই স্বপ্নটা বার বার।

প্রিয় কবি সিলভিয়া প্ল্যাথের অনুভূতিতে

যে কোনও কিছুই লিখে ফেলা যায়, যে কোনও কিছুই। যতক্ষণ শ্বাস নিতে পারছ, যতক্ষণ অনুভব করতে পারছ তুচ্ছকে, যতক্ষণ বিস্মিত হতে পারছ। একটা নিটোল বিস্ময় প্রথম দেখার মতো। সাদা ক্যানভাসে তুলির টান যে কোনও কিছুই।


যতক্ষণ ভালোবাসতে পারছ।

Saturday, June 11, 2016

উপন্যাসের চরিত্রেরা

কেউ কেউ উপন্যাসের চরিত্রের মতো হয়।
সেইসব কাহিনির যা বারবার পড়লেও আবারও পড়তে ইচ্ছে করে। এবং তারপরেও
পুরোনো হয়না। আবার কেউবা প্রায় অপঠিত বইয়ের পাতা থেকে নেমে আসে।

কিন্তু এমন সব জটিল চরিত্ররা যখন বাস্তবে হাজির হয় সত্যি সত্যি তাকে মেনে নিতে পারাটা শক্ত হয়ে যায়। গতানুগতিকতায় অভ্যস্ত মানুষ। সাধারণকে নিয়েই তার ঘর-সংসার। চেনা কাঠামো ভেঙে গেলে তাকে মানতে পারেনা মন থেকে।


তবু উপন্যাসের চরিত্রেরা জন্ম নেয় রোজকার জীবন থেকেই। চিরকাল।

গল্প দেখা, গল্প শোনা

সবার একটা করে গল্প থাকে, সব্বার। ওই যে বুড়ো ট্রাম ড্রাইভারটা ক্রসিংয়ে ট্রামটা দাঁড়ালেই মাঝের দরজা দিয়ে এসে সামনের সিটটায় বসে পড়ছে, ওর ক্লান্ত মুখের ভাঁজে ভাঁজে কোথাও একটা আলগা সুখ-দু:খের কাহিনি লেগে রয়েছে যেন। ভাগ্যিস সামনের সিটটায় বসিনি। ইস, রোজ সারারাস্তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ট্রাম চালাতে হয়। মোটাসোটা কনডাক্টরটারও বয়স হয়েছে। শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ের ক্রসিংয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কী কথা বলে যায় ড্রাইভারের সঙ্গে। ওর কথা বলার ধরণটার মধ্যেও যেন একটা গল্প আড়মোড়া ভাঙে।

ট্রাম চলে টুং টাং সুর তুলে। জানলার ধারে বসে দেখতে দেখতে যাই। পুরোনো ইমারতের ইট-কাঠে, বড় বড় গাছেদের পাতায় পাতায় কত না গল্প লেগে আছে। রাস্তায়, বাসের চাকার দাগে বয়ে চলে কাহিনিরা।

ওই যে লোকটা ছাতা মাথায় দিয়ে আপনমনে হাসতে হাসতে আসছে গল্পটা ওর হাসিতে আছে না পুরোনো ছাতার গায়ে তা আমার জানা হবেনা কোনোদিনও। পথের ধারের দোকান থেকে খাবার খেয়ে আলগোছে জল খায় বউটি, চেহারা-পোশাক দেখে খুব সাধারণ ঘরেরই মনে হয়। ওই তো আরেকজন হাঁটতে হাঁটতে হসপিটালের গেট দিয়ে বেরিয়ে আসছে, সুখ-দু:খ কিছুরই আভাস নেই মুখে। অথচ এদেরও আঁচলের খুঁট খুললে ঠিক কিছু না কিছু গল্প মিলবে, মিলবেই। আর ওই যে ঠেলাওলা তার বোঝাখানি ঠেলার ওপর চড়িয়ে আস্তে আস্তে ব্রিজ পেরোচ্ছে, ঘাম গড়িয়ে নামছে কপাল বেয়ে, ওর ওই ঠেলায় শুধুই কি আর দরকারি জিনিস আছে, একটা নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় গল্পও কি লুকিয়ে নেই কোথাও?


শেষ স্টপেজ এসে গেছে প্রায়। জানলা দিয়ে ফিরে দেখি, রাস্তার ধারে পিছনে পড়ে রইল ফলওলারা, তাদের ঝুড়ি বোঝাই টক-মিষ্টি গল্প নিয়ে। কনডাক্টর তাড়া দেয়। আমি কাঁধে ব্যাগ, হাতে মেয়ের বইয়ের প্যাকেট আর মাথায় একরাশ গল্প নিয়ে আবার পথে নেমে পড়ি।

Saturday, June 4, 2016

দিগন্তরেখায়

কাজ শেষ হল?
জানলা দিয়ে মাথা গলিয়ে জানতে চায় বৃষ্টি।
বলি, না গো, অনেক বাকি।
চিঠি পাঠিয়েছে দিগন্ত,
সব কাজ শেষ হলে উত্তর দিও -
মাটির গন্ধ ভেসে আসে নিঃশ্বাসে।
ঘর গোছানো থামিয়ে ফিরে তাকালাম,
কয়েক ফোঁটা জল টেবিলে টলমল।

ছুটি হল তোমার?
ঠাণ্ডা হাওয়া আলগোছে কপালের চুল সরিয়ে বলে।
কলম থামিয়ে উত্তর দিই, নাহ্‌, কিছুই লেখা হয়নি,
মিল খুঁজে পাচ্ছিনা একটা ছন্দেরও।
দিগন্ত বলে পাঠাল, ছুটি হলেই চলে এসো কিন্তু –’
চেয়ে দেখি খাতা উলটে পড়ে আছে একটা শূন্য!

অসুখ সারল?
ফুলের ডালিটা নামিয়ে রেখে জিজ্ঞাসা করে সুধা।
মাথা নাড়ি বিষাদে, দেখছ না, ওষুধের পাহাড় জমেছে।
দক্ষিণের জানলাটা আজও কেউ খোলেনি।
রাজার চিঠির অপেক্ষায় বসে আছি সেই কবে থেকে।
চিঠি পেলেই ডাক দিও তাহলে, 
দিগন্তরেখায় মালা গেঁথে অপেক্ষা করে থাকব।
হাত ধরতে যেতেই ছেলেবেলার জানলা থেকে হারিয়ে গেল সে।

হাতের সব কাজ থামিয়ে, কলম নামিয়ে রেখে ভাবি,
ঠিক সেরে উঠব এবার, আর তারপর
ছুটি হলেই রাজার চিঠি সঙ্গে নিয়ে
ওইদিকে যাব ওইদিকে।
যেখানে আকাশ এসে মাটিতে মেলে -
দিগন্তরেখায়।

ভ্রমণ

গতবছর বৃষ্টি ছিল না।
ভীষণ রোদ্দুরেই খুঁজেছিলাম সুখ।
আজ মেঘ জমেছে বাইরে।

ঘরে আমার ঘোরতর অসুখ।

ভ্রমণে

বৃষ্টি ডাক দিলে -
চৌকাঠ ডিঙিয়ে বারান্দা,
বারান্দা থেকে নেমে বাগান,
বাগানের শেষে মাঠ,
মাঠ পেরিয়ে দিগন্তরেখার দিকে
এভাবেই বেরিয়ে পড়ি একা।

ভ্রমণে।

Friday, June 3, 2016

বাঁচা

এইসব গতকালের লেখা।
ছেঁড়া ছেঁড়া শব্দ, পুরোনো মনখারাপের টুকরো...
গতকালের ইতিবৃত্ত সবই।
এরা তোমার কাছে পৌঁছবে না পথেই হারিয়ে যাবে,
সে তো আগামীকালই জানে।
আজকের দিনটায় অন্ততঃ ভেবে নিই সব ঠিকঠাক আছে।

আজকের দিনটা বেঁচে নিই নিরুদবিগ্নভাবে।

অমল

বড় হয়ে রোজ রোজ অসুখ করলে কিছুতেই আর ছোটবেলার মতো অমল হওয়া যায় না। কিছুতেই ভাবা যায় না দইওলার মতো কেউ কী নিদেনপক্ষে ঠাকুরদাদা এসে গল্প শোনাবে। রাজার কাছে চিঠি লিখলে যে উত্তর মিলবে না কেমন তা স্পষ্ট জানা থাকে। ছোটবেলায় এই সব না ঘটাগুলো ভুলিয়ে দেয় মা,গল্পে,গানে। আর ঠিক এই জন্যই,এই জন্যেই অসুখ করলে আর যাইহোক বড় হতে নেই। কিম্বা বড় হয়ে অসুখ করতে। মায়েদেরও তাতে বয়স বেড়ে যায় যে। কিছুতেই আর ছোটবেলার মা মেলে না।

তবু কারোর কারোর রোজ অসুখ করে। এমন কী না চাইলেও বড় হয়ে গেলেও।

ভারী যত্ন পেলেও কারোর কারোর তাও তখনও দইওলা,ঠাকুরদাদা,সুধা,রাজার চিঠি কিম্বা ছোটবেলার মায়ের জন্য মনকেমন করে। বড় হয়ে গেলেও।

বিষাদ

স্মৃতির ভেতর থেকে তুলে আনি
জলকণাগুলি।
দুচোখে তারা আজও
টলমল করে।
স্মৃতির গভীর থেকে টেনে নিই
সেইসব বন্য সুবাস।
সমস্ত শরীর জুড়ে বেদনারা
সারারাত ঝরে।

তবু মনে রেখো

সমস্ত ক্লান্তিগুলো একদিন জড়ো করে রেখে আসব তোমার উঠোনের একপাশে। সমস্ত বেদনাগুলো তোমার আলনায় এলোমেলো হয়ে থাকবে। সব বিষাদ উপুড় হয়ে পড়ে থাকবে ওই বিছানায়। আর তোমার জানলার নীচে যেখানে রঙ্গন গাছটিতে লাল ফুল ফুটেছে, ওইখানে, ঠিক ওইখানটিতে রেখে আসব আদর।


রোজকার মতো বাড়ি ফিরে এঘর-ওঘর খুঁজতে খুঁজতে কোথাও না পেয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালে দেখবে দিগন্তরেখায় নীল-রাঙা মেঘে আঁচলের প্রান্তখানি আঁকা হয়ে আছে।

Wednesday, June 1, 2016

অফার

মেঘলা দিনে ঘরের মধ্যে রজনীগন্ধার হালকা সুবাস ভাসছে বাতাসে।


দিন তিনেক আগে, বেশ রাত্তির হয়ে গিয়েছিল। ২০ টাকায় তিন বাণ্ডিল করে রজনীগন্ধা বেচছিল লোকটা কেষ্টপুর আন্ডারপাসটার মুখে। জোরে জোরে হাঁক পাড়ছিল অফার অফার। আমরাও কিনে ফেললাম। 

তোমাকে দেখছিলাম

অথচ সে আছে। আর তাই হৃদয়টা পরিপূর্ণ হয়ে কেমন টলমল করে ওঠে। দুহাত বাড়িয়ে চাইলেই তাকে ছুঁয়ে দিতে পারি আর যেই ছুঁতে যাই অমনি সে সমস্ত আকাশ বাতাস জুড়ে এমনি ছড়িয়ে যায় যে আপনি আমি মিলিয়ে যাই সেই অসীমতায়। আর তখন আমার একলাপনাটা হারিয়ে গিয়ে কেমন পূর্ণ হয়ে উঠি। কোথাও আর একটুও ফাঁক থাকেনা। আনন্দ ভরে ওঠে মনে। ধূ ধূ রোদ্দুরে অথবা শীতের সন্ধের দুঃখের গায়ে সেই আনন্দের রেশ এসে যখন পড়ে তখন বেশ লাগে। খুব একপশলা বৃষ্টির পর সমস্ত সবুজের গায়ে ঝলমল করতে করতে যখন সে বলে ওঠে, এই আমি এই আমি, তখন মনটা আপনি বালিকা খুশিতে নেচে ওঠে। পাহাড়ি রাস্তা ধরে একা একা হাঁটলে আনমনে ফুটে থাকা ফুলে সেই হাসিটুকু হঠাৎ যেন ঝিকমিকিয়ে ওঠে। রাত গভীর হলে একলা চাঁদ যখন এক পাহাড়ের গায়ে আলো ছড়ায় আর অন্য পাহাড়টা অভিমানে আঁধার হয়ে থাকে তখন মনে হয় ওই আলো-আঁধারির ঠিক মাঝখানটিতে আপনমনে স্বপ্নের জালখানি বিছিয়ে রেখেছে সে। সেকথা ভাবতে ভাবতেই বুনোফুলের গন্ধ এসে মাথার ভেতরটায় কেমন ঝিমঝিম করতে থাকে। আবার খুব ভোরবেলার আলো যখন সমুদ্রের দিগন্ত ছোঁয়, অমনি একটা আশা জাগে মনে - এইবার, ঠিক এইবার তাকে দেখতে পাব। আর তাই ভিড়ে ঠাসা কলকাতায় ট্রামের জানলা দিয়ে তাকে দেখতে দেখতে যাই।

যখন এসেছিলে

কাল সারা সন্ধে মাথার মধ্যে রবি ঠাকুরের গানের শব্দ-অক্ষরগুলো বেজে যাচ্ছিল, দেবব্রত? না, না, সুচিত্রা মিত্রের গলায় –‘আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে...। মেঘ জমেনি তখনও। অথচ আমি তার জন্যই বসেছিলাম। অথবা ভাবছিলাম, জানতে চাইছিলাম, আমায় কেন বসিয়ে রাখ, কেন বসিয়ে রাখ...? 

ভোরের দিকে ঝড়ের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল, তুমি এসেছিলে, আমি ঘুমিয়েছিলাম। যাবার বেলায় ডাক দিয়ে গেলে অমনি অমনিই।

আমি তখন ছিলেম গহন মগন ঘুমেরই ঘোরে যখন বৃষ্টি নামল...


তারপর থেকে সারাটাদিন মেঘলা হয়ে আছে।

নেমতন্ন!

সেদিন সহ সম্পাদক মেল খুলে কাজের তাড়নায় ফোন করেছেন, তো সম্পাদক চিঁ চিঁ করে জানালেন, আমি বিছানায়, তুমি ওদিকে যা পার কর। সহ সম্পাদক উদবিগ্ন গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, আবার কি হল? উত্তরে সম্পাদক রীতিমতো হাহাকার করে উঠলেন,কী আর হবে, নেমতন্ন, বুঝেছ, আমি আর নেমতন্নে যাচ্ছিনা

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সহ সম্পাদক জানতে চান, মানে? আর বোলো না, সম্পাদক বলতে থাকেন, গতকাল রাতে একটা বিয়েবাড়ির নেমতন্ন ছিল। একে তো জামাকাপড় পরাটাই ইদানীং প্রায় যুদ্ধ করার মতো লাগে। যাইহোক সেজেগুজে হাঁপাতে হাঁপাতে তো গিয়ে পৌঁছালাম। খুব কাছেই ছিল বিয়েবাড়ি, বাসে এই গোটা দু-তিন স্টপেজ। বিশেষ চেনা-পরিচিত কেউ তেমন ছিলনা, গিফট দিয়ে খেতে গেছি। প্লেট নিয়ে সামান্য দু-এক পদ নিয়ে কিছুটা খেতেই বুঝতে পারলাম প্লেট ধরায় হাতের পাতায় খুব ব্যথা করছে, মানে একেবারে ভেঙে আসছে আর কী। আচ্ছা, তুমিই বলো, একজন মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা সেজেগুজে নেমতন্ন খেতে গিয়ে যদি অন্যের হাতে ধরা প্লেট থেকে খান, কেমন বিশ্রী লাগে! তাই তাতে রাজি না হয়ে কোনওমতে নম নম করে খাওয়াটা শেষ করে ফেললাম। ফের হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি ফিরে একেবারে শয্যাশায়ী। আর বোলো না, তখন তো বুঝিনি, বাড়ি ফিরে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম, হ্যাঁ, একেবারে হাড়ে হাড়েই, যে বাঁ কাঁধটায় অসহ্য যন্ত্রণা করছে। ওই যে প্লেটটা ধরেছিলাম বাঁ হাতে। সারারাত ধরে বুঝলে, টের পেলাম নেমতন্ন কারে কয়! পেনকিলারেও কিচ্ছু হলনা, ঘুমোতেই পারলামনা। যে পাশই ফিরি ব্যথা ডিফারেন্ট অ্যাঙ্গেলে জেগে ওঠে, মানে জেগেই থাকে আর আমাকেও জাগিয়ে রাখে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খুব সিরিয়াস গলায় সহ সম্পাদক পরামর্শ দেন, সব গেছে, খুলে অয়েল করতে হবে। ...


বেশিক্ষণ কথা বললেও হাত-কাঁধ আবার নতুন করে ব্যথা বাড়তে পারে। ফোন নামিয়ে রেখে সম্পাদক ভাবেন, কত ডাক্তার দেখালাম, এ চিকিচ্ছে কী আর সহজ কথা, ওমন তেল-মোবিলের কম্ম নয়, চামড়াটা কেটে ভেতরের খোলনলচে শুদ্ধু বদলিয়ে যদি আবার নতুন করে হাড়-মাংস পোরা যেত, তাহলে হলেও হতে পারত। সেতো আর হওয়ার নয়, এই বলে ফের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঁধে সেঁকটা লাগিয়ে অন্য পাশ ফিরে শুলেন।