Monday, November 30, 2015

মানুষ বন্ধু (২)

‘মানুষ বন্ধু’ লেখার পর আমার সেই বন্ধুকে জানাই – “বুঝলি তোর কথা লিখে ফেলেছি”। (কেমন দিলাম গোছের হাসি)

মানুষ – ভয়ঙ্কর।

আমি – “তাও  গামছা পড়ে বাথরুমে যাওয়ার প্রথম অভিজ্ঞতা লিখিনি, বাড়াবাড়ি হয়ে যেত বলে”। ( এটা নিরীহ মুখে)

মানুষ – “বাঁচিয়েছিস”।

পড়ার পর, মানুষ উবাচ – “তুই আমার বিয়েতে এসেছিলি তো, ভুলে গেছিস?
আর আমি এখন রানিগঞ্জে, দুর্গাপুর হয়ে গেল কেন?
তোর বাড়ি গিয়ে রাত হওয়ায় রানিগঞ্জ থেকে কানেকটিং বাস পাইনি, সারা রাত স্টেশন ওয়েটিং রুম-এ ছিলাম।
আমার বিয়েতে তুই একা নয় তোর মেয়ে আর বরও এসেছিল, উখরা-তে, রাত্তিরে ছিলিস।
কারেক্শন কর”।

আমি – “একদম স্মৃতি গেছে রে, এ হে হে হে...( মাথা চুলকে), তা তুই যে সারারাত স্টেশনের ওয়েটিং রুমে ছিলিস তা তো বলিস নি (খেয়েছে, কী হাল আমার পাল্লায় পড়লে!)!”

মানুষ – “সব ভুলে মেরেছিস!”


আমি – “(ভয়ানক লজ্জিত, ইয়ে ইয়ে টাইপের মুখ করে) এক্ষুনি কারেকশন করে দিচ্ছি”।

Sunday, November 29, 2015

পিছুডাক

কাউকেই আর কিচ্ছু বলার নেই।
কবিতা, তোমার সঙ্গেও এখন আড়ির বেলা।
কথা বন্ধ বৃষ্টি আর রোদ্দুরের সাথে।
ভোরের আকাশ এসে আজ বলে গেছে,
সেও আর আসবে না আমার উঠোনে।
যদি বেরিয়েই পড়ি তবে পৃথিবীর পথে

কেউ আর পিছু ডাকবে না?

ঋণ

কিছুটা ঋণ থাক
তোমার কাছে।
এই ধূসর পৃথিবীতে
যদি কিছু নাও থাকে
আমাদের মাঝে
একমুঠো ঋণ থাক।
আর সব হারালেও
ঋণ তবু সুদে বাড়ে -

আজীবন ঋণী থাকতে চাই।

পরিণত!

স্মৃতি মুছে মুছে বড় হতে থাকি -
ভাঙতে ভাঙতে দেখে নিই
ঝিনুকে মুক্তো ছিল কতখানি,
কতখানি শাঁস আছে বাকি।

অপেক্ষা

কবিতারা বসে আছে উঠোনের ঘাসে।
কবিতারা একাকী উপবাসে আছে।
কবিতারা কথা বলে না জানালার কাছে,
হাত আর বাড়ায় না আকাশে।
কবিতারা বসে আছে, 
বসে আছে একা -
উঠোনের ঘাসে।

Saturday, November 28, 2015

মানুষ বন্ধু

আমার একটা সত্যিকারের মানুষ বন্ধু আছে। ওই যাহ্‌, তুই বারণ করেছিলি, তাও তোর কথা লিখতে বসেছি। কবে থেকেই লিখব ভাবি আর হচ্ছিল না, মানে তুই বেঁচে যাচ্ছিলি আর কী। আচ্ছা, নাহয় তোর নামটা বাদ দিয়েই লিখছি, তাতে আপত্তি নেই তো? আর থাকলেই বা শুনছে কে?

বিষ্ণুপুরের রামানন্দ কলেজের জুওলজির ল্যাবে ওর সঙ্গে আমার আলাপ। জানতে চাই তোর নাম কি? এক গাল হেসে বলে, মানুষ মনে রাখিস, তাহলেই মনে থাকবে। মানুষের কাছাকাছিই ওর নামের উচ্চারণ, তাই কক্ষনো ভুলিনি নামটা। ছেলেবেলায় পোলিও হয়ে একটা পায়ে জোর কম, ক্রাচ নিয়ে অবশ্য আমাদের চেয়ে জোরে হাঁটত, বলা যায় দৌড়তই। আর আমাদের মেয়েদের পুরো দলটাতেই অসম্ভব জনপ্রিয় ছিল। অবশ্য তার জন্য কম পরিশ্রম করতে হয়নি ওকে। পড়া বুঝতে অসুবিধা হলে, প্র্যাকটিকাল করতে গিয়ে আরশোলার নার্ভ ছিঁড়ে ফেললে কী চারতলা থেকে একতলায় নেমে স্যারকে ডাকতে সবেতেই আমাদের এই সর্বদা হাসিমুখ মানুষ বন্ধুই ভরসা।

কয়েক মাস পরে দুজনেই ওই কলেজ ছেড়ে দিই। ও রাণিগঞ্জে ভর্তি হল, আমি কলকাতায়। কিন্তু চিঠিতে বন্ধুত্ব রয়ে গেল অবিচ্ছিন্ন। একেবারেই চিঠিলেখা টাইপ নয়, আমার পাল্লায় পড়ে বোধহয় হাসিমুখেই দাঁত কিড়মিড় করে লিখত। তখন ও থাকত উখড়ায়, আমি রূপনারায়ণপুরে। একদিন ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, সেও না জানিয়ে হঠাৎ করেই। তখন মোবাইল, ফেসবুক তো দূরের কথা, ল্যান্ডলাইনেরও তেমন চল নেই। তবে যেটা ছিল, তা হল অমলিন বন্ধুত্ব। যতদূর মনে পড়ে সেদিন ওর বাড়িতে কেউ ছিল না। দুজনে এন্তার আড্ডা মেরে তারপর আমার মাথায় ঢুকল ওকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসতে হবে। কতবার বোঝাল, বাড়িতে ফিরতে হবে, কেউ নেই, আমারও এক কথা, তুই গিয়েই চলে আসবি। অগত্যা কী আর করে।

তারপর চিঠিতেই যোগাযোগ অব্যাহত। আমার বিয়ের সময় আসতে পারেনি। সম্ভবতঃ আমিও ওর বিয়েতে কোনো কারণে যেতে পারিনি। তবে তার আগেই একবার গিয়েছিলাম, সেও না জানিয়ে অবশ্যই। আসানসোলের কাছে আমার এক বন্ধুর বিয়েতে সপরিবারে নেমতন্ন ছিল। আমি মেয়ে আর তার বাবাকে বিয়েবাড়ির ঠিকানায় পাঠিয়ে নিজে মাঝপথে নেমে পড়লাম। এদ্দূর আসছি আর বন্ধুর সঙ্গে দেখা হবে না, তাও কি হয়? আমাকে দেখে তো ভারি খুশি। নিজের ঘরটাই ছেড়ে দিল, আমি অধিষ্ঠান করলাম। সেবারে ভীষণ ভালো এবং মাটির মানুষ কাকু-কাকিমার সঙ্গেও আলাপ হল। তারাও দিব্যি আমার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন। পরেরদিন ওখান থেকেই বিয়েবাড়ি পৌঁছলাম।

এরপরে কলকাতাতেও কাজের সূত্রে এলে দেখা হয়েছে। এবার তো অনেকদিন পর রূপনারায়ণপুর যাওয়ায় দেখা হল। খুব চিন্তা করছিল যে, একা যাচ্ছি, রাত্তিরে যদি কোনো বিপদ হয় তাহলে দুর্গাপুর থেকে দৌড়ে আসতে পারবে না। দৌড়ে নাহোক বাস বদলে এল অবশ্য। দুজনে মিলে কল্যাণেশ্বরী আর মাইথন ঘুরে বিস্তর আড্ডা হল। সে গল্প তো আমাদের ছুটি-তে করেইছি। তাতে অবশ্য নামসহই।


ওই যাহ্‌, নামটা জেনে গেল তো সবাই। তা জানুক না, ক’জন এমন মানুষ বন্ধু পায় বলতো? অথবা কেই বা বন্ধুর এত পাগলামী তেইশ বছর ধরে হাসিমুখে সহ্য করে?

সিরিয়াল কিলার

শঙ্করীদি টিভিতে বাংলা সিরিয়াল দেখে। কানে আসে। মাঝে মাঝে চোখও চলে যায়। সেইসব টুকরোটাকরা দেখে মনে হয় সিরিয়ালের পরিচালকরা ঠিক কী ভাবে? আর দর্শকরাও। 

সিরিয়াল মূলতঃ হয় পরিবারকেন্দ্রিক। তাও আবার অধিকাংশই যৌথ পরিবার গোছের! আবার তার মধ্যে প্রায় প্রত্যেকের হয় গোটা দুয়েক বিয়ে নয় অন্ততঃ একটা পরকীয়া থাকতেই হবে এবং অবশ্যই রিভেঞ্জ (প্রতিশোধ শব্দটা জমবে না)। এতকিছুর পরেও মহিলাদের হয় সতীসাধ্বী নয় ভয়ানক কুচক্রী টাইপের হতে হবে। সত্যি যাঁরা অভিনয় করে তাঁদের এলেম আছে বলতে হবে, বাস্তবে তো এতকিছু একটা মেয়ের পক্ষে সম্ভবই নয়। 

কোন একটা সিরিয়ালের এক খামচা দেখে যা বুঝলাম, স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ হয়েছে, উভয়েই আবার বিয়েও করে ফেলেছে। তারপর উভয়ের পুরোনো প্রেম উথলে উঠেছে এবং শেষ পর্যন্ত আবারো মিলন হল। এই কাজের সুবিধার জন্যে ডিভোর্সটা পরিচালক করেননি। মানে যা দাঁড়ালো, তিন জোড়া বিয়ে ভেঙে একজোড়ায় দাঁড়িয়ে মেয়েটির প্রেম এবং সতীত্বের পরীক্ষা হল। কী ভাগ্যিস সীতা এ যুগে জন্মাননি, আধুনিক সতীত্বের পরীক্ষায় ডাঁহা ফেল করতেন। আর আমি ভাবছিলাম, পরের যে স্বামী হয়েছিল অথবা স্ত্রী, কার সঙ্গে পরিচালকের কনট্রাক্ট ফুরিয়ে ছিল? এই যেমন, উত্তমকুমারের বেশ দেখতে নাতিটাকে ব্লাস্ট করে উড়িয়ে দিল দেখলাম। আহা বেচারা, ওর সঙ্গে নিশ্চয় কনট্রাক্ট ফুরায়নি। বেচারা বউটা সতীত্বের পরীক্ষা থুড়ি অভিনয় করতে করতেই গেল। 

এরপরে আবার গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে শঙ্করীদি বলে, এরকম হয় জানো বৌদি? শঙ্করীদির নাহয় ক্লাস ফোর পর্যন্ত বিদ্যা। শিক্ষিত গৃহবধূদের কথাও ছেড়েই দিলাম, যেসমস্ত চাকুরীরতারা বাড়ি ফিরে জিনস-টপ ছেড়ে বাংলা সিরিয়ালে মগ্ন হয় তাদের কথা ভাবছিলাম...


ওই রে শঙ্করীদি এসেছে!!

মরিয়া প্রমাণ করিল

আজকের দিনে কোন সাধারণ মেয়ে অথবা নিরুপমাদের কী কাহিনি লিখতেন রবি ঠাকুর জানিনা। একশো-দেড়শো বছরে আমরা যতই বলিনা কেন সমাজে মেয়েদের অবস্থা এবং অবস্থান বদলেছে, সত্যিটা কিন্তু ভিন্ন। মুষ্টিমেয় তথাকথিত শিক্ষিত কিছু মহিলা খানিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও সামগ্রিক চিত্রে এবং সর্বোপরি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গীতে কিছুই বদলায়নি। কন্যা ভ্রূণ হত্যা থেকে ধর্ষণের ক্রমবর্ধমান হার তার সুস্পষ্ট প্রমাণ।

এখন মরিয়া অথবা ধর্ষিতা হইয়াও তা প্রমাণ করা বড় সহজ নয়। লোকলজ্জা, সমাজের অনুশাসন তো রয়েইছে, এসব থেকে বেরিয়ে এসে কোনো মেয়ে যদি সাহস করে লড়াই করে তাহলে আইন আর রাজনীতি তাকে বাঁচতে দেবে না। প্রমাণ করা বা শাস্তি তো অনেক দূরের কথা। আগেকারদিনে জমিদাররা ধর্ষণ ও খুন করে হয় লাস জলে ভাসিয়ে দিত নাহলে বিষ দিয়ে আত্মহত্যার নাটক সাজাত। সেখানে তাও সমাজের ভয়ে কিছুটা গোপনীয়তা থাকত। এখন এই মানসিকতা রয়েই গেছে, বরং ছড়িয়ে গেছে সমাজের তৃণমূল স্তর পর্যন্ত এবং সবই ঘটছে সর্বসমক্ষে। যার সঙ্গেই রাজনৈতিক ক্ষমতার আঁতাত সেই নির্ভয়। অতএব আইন তার হাতে। রবি ঠাকুরের সাধারণ মেয়েরা এখন প্রতিনিয়ত আতঙ্কে ভোগে হত্যা এবং ধর্ষণের, নিজের এবং কন্যা সন্তানদের, কারণ সে বলিয়াছিল, মরি নাই, ধর্ষিত হইয়াছি। তার কন্যা সনাক্ত করেছিল ধর্ষণকারীদের - ন্যায়বিচারে যারা মুক্ত!

সমাজের বিচারে আজও সেই দোষী – কেন সে ধর্ষিত হয়েছে? নিশ্চয় পুরুষটিকে লোভ দেখিয়েছিল। নাহলে তার কি খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে এমন কাজ করবে? আর যদি ভুল করে করেই থাকে, তাহলেই বা এত বলার কী আছে? তুমি মেয়েমানু্‌ষ, এ তোমার লজ্জার বিষয়, কোথায় গোপন করবে, তা নয়, আবার নালিশ জানাচ্ছ? আস্পর্ধা তো কম নয়!! এবার বোঝ ঠেলা। তখন বাপু আমাদের দোষ দিতে এসো না।

এরপরে তো আরও অনেক ব্যাপার আছে, একে তো মেয়েমানুষ, তারপরে তুমি কোন দলে? তুমি যদি কোনো দলে না হও তাহলে বহু বছর আগে মরে যাওয়া তোমার স্বামী নিশ্চয় বর্তমান শাসক বিরোধী দলে ছিল, মানে ছিলই। নাহলে খামোখা তুমি ধর্ষিত হবে কেন? তুমি যদি জল না খেয়েও থাক, তোমার ঠাকুরদাদা তো এই ঘাটে জল খেয়েছিল। তাও তো ভাগ্যিস হিন্দু পাড়ায় তুমি মুসলমানের ঘরের বউ হয়ে হিন্দুর বিরুদ্ধে নালিশ করনি, কিম্বা উল্টোটা।


মোদ্দা কথা, তুমি মেয়েমানুষ, চুপচাপ থাকবে। তোমার কিছু প্রমাণ করার নেই।

বিশ্বাস

আমাদের বাড়িতে বার দুয়েক বড় রকমের চুরি হয়েছে। মানে সেটাকে ডাকাতি বললে ডাকাতদের অপমান করা হয় আর কী। প্রথমবারেরটা মায়ের মুখে শোনা। সেটা দাদার অন্নপ্রাশনের ঠিক পরপর। ফলে অন্নপ্রাশনে যা সামান্যকিছু দাদা পেয়েছিল সেসবই গিয়েছিল। খালি গায়ে ভীষণ তেল মাখা চোরটা যখন হাতের বালা খোলার চেষ্টা করছিল, তখন মায়ের ঘুম ভেঙে যায়।

এই চোরকে মা চিনতে পেরেছিল। যদিও চুরির কোনো কিনারা বা চোরাই মাল পাওয়া যায় নি। আমাদের বাড়িতে তখন এক মাঝবয়সী মহিলা কাজ করত। তার নাম ছিল নেহারির মা। এই নেহারির মা দীর্ঘসময় কাজ করেছিল, আমার ছোটবেলাতেও বেশ কিছুদিন দেখেছি বলে আবছা একটা স্মৃতি আছে। সেদিনের চোরের দলে নেহারি না তার বাপ ছিল তা আমার মনে নেই, মা হয়ত এখনও বলতে পারবে। কিন্তু তারপরেও মা সেই নেহারির মাকে কাজ থেকে ছাড়ায়নি, এমন কী তার হাত টান আছে জেনেও। মা বলত অজানা চোরের চেয়ে জানা চোর ঢের ভালো।

মানুষকে প্রায় অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে আমি ছোট থেকে দেখেছি বাবাকে। মা কিন্তু ভীষণ বিশ্বাস করলেও ভালোমন্দ বুঝেই বিশ্বাস করত। আমি নিজেও দেখেছি বিশ্বাস করে জেনেবুঝে ঠকা ভালো, মানুষকে অবিশ্বাস করার থেকে। আসলে মানুষকে অবিশ্বাস করতেই শিখিনি বা পারি না। আর বিশ্বাস করতে খুব ভালোও লাগে। মাঝে মধ্যে দুঃখ পাই ঠিকই, কিন্তু নিজের মনে আনন্দ পাই অনেক বেশি। তাই সহজেই বিশ্বাস করি, কিন্তু পারলে কিছুতেই তা ভাঙি না। নাহয় ঠকালোই বা কেউ, কী বা যায় আসে তাতে।


ওই যে, অজানা চোরের চেয়ে জানা চোর ঢের ভালো।

Friday, November 27, 2015

কিছু ফেলতে পারি না

কলেজ জীবনে হস্টেলে থাকার সময় আমার একটা কালো রঙের ছোট ট্রাঙ্ক ছিল। ছিল বলা অবশ্য উচিত নয়, কারণ ট্রাঙ্কটা এখনও আছে। তখন হয়ত ট্রাঙ্কটার নাম ছিল – সব পেয়েছির দেশ। গোটাকতক জামাকাপড়, বইখাতা, মায়ের দেওয়া চিঁড়েমুড়ি মোয়ানাড়ু সবেরই কলকাতায় আসার ঠিকানা ছিল ওটাই। ট্রাঙ্কটা আমার খুব প্রিয়। তাই পরবর্তীকালে আমার যাবতীয় চিঠিপত্র-ডায়েরি, কার্ড মানে যা যা খুব নিজের বলে মনে হত তাই রাখতাম, এখনও রাখি। অপুর মতো পাখির বাসা না থাকলেও আমার অনেক স্মৃতি, ভালোলাগা-মন্দলাগা, হাসি- কান্না রয়েছে ওই ট্রাঙ্কের অন্দরে। আমার অল্পবয়সের গন্ধ কিম্বা অভিমান, অথবা বেশি বয়সের রাগ তাও থাকতে পারে। তাই তো ওর আজকাল নাম রেখেছি – কিছু ফেলতে পারি না।


ছেলেবেলায় মা যখন ট্রাঙ্ক গোছাতে বসত, তখন সেই পুরোনো জামাকাপড় কিম্বা মায়ের ডায়েরি, চিঠির সেই পুরোনো গন্ধ ভারী রহস্যময় লাগত। কৌতূহলী হয়ে বসে থাকতাম কখনো যদি সাত রাজার ধন এক মানিক বেরোয়। একটু বড় হলে মাঝে মধ্যে মা এটা ওটা পড়তেও দিত। এখন আমার ট্রাঙ্কের ওপর মেয়ের ততোটা কৌতূহল নেই, যদিও আমার ছোটবেলায় খাতায় লেখা সব গল্প আর হাতে লেখা পত্রিকা সবই ওর পড়া হয়ে গেছে কখনো ট্রাঙ্ক খোলায়। আমার নিজের কিন্তু ট্রাঙ্কটা খুলে অল্পবয়সটা উলটে দেখতে বেশ লাগে, যদিও এখন অনেকদিনই আর সময় পাই না। তবু ট্রাঙ্কটা খুললে এখনো যেন ছোটবেলার মতো রহস্যময়ই লাগে, হোক না নিজেরই ট্রাঙ্ক, পুরোনো ট্রাঙ্ক তো বটেই।

Sunday, November 22, 2015

ওয়েবসাইট, ব্লগ এবং প্রিন্ট - লেখা নিয়ে তঞ্চকতা অথবা কতটা পৌঁছালাম পাঠকের কাছে?

কোন মাধ্যমে লিখি, তার আগে যে প্রশ্নটা মাথায় আসে, তা হল, কেন লিখি? প্রথমতঃ লেখক তাঁর নিজের অনুভূতিকে নিজের মধ্যে না রেখে প্রকাশ করতে চান। আমি যখনই কোনো কথা বলছি বা লিখছি তার প্রথম কারণ অন্য মানুষের সঙ্গে একটা যোগসূত্র তৈরি করতে চাইছি। যেমন, আদিম মানুষ কথা বলার আগে নিজেকে বোঝাতে ছবি এঁকেছিল গুহার গায়ে, তার জীবনযাপন আর ভাবনার কথা অন্যদের কাছে পৌঁছে দিতে। লেখক প্রকৃতপক্ষে সেই কাজই করেন। 

ওয়েবসাইট এবং ব্লগে লেখালেখির ধারণা অনেক আধুনিক। বাংলাভাষার ক্ষেত্রে আরো-ই। আধুনিক এই মাধ্যমে বাংলাকে নিয়ে আসা এবং ক্রমশঃ জনপ্রিয় করার সূচনা এবং প্রসারের কৃতিত্ব বাংলাদেশের। বিভিন্ন বাংলা সফটওয়ার তৈরি থেকে বাংলা ওয়েবপত্রিকা এবং ব্লগের জন্মদাতা বাংলাদেশ। বাংলাদেশে একজন লেখক বই লেখার থেকেও ব্লগ লিখে এখন অধিক পরিচিত বা জনপ্রিয়। প্রিন্ট পুরোনো মাধ্যম। বইপড়ার চল কমলেও প্রিন্ট মাধ্যম থাকবে, কিন্তু আগামীদিনে আরও প্রসারিত হবে ওয়েব দুনিয়া। এটা 'আমাদের ছুটি' করতে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতা। 'আমাদের ছুটি' দেশ-বিদেশের এমন অনেক বাঙালির কাছে পৌঁছে গেছে, যেখানে প্রিন্ট মাধ্যমের কোনো জনপ্রিয় ভ্রমণ পত্রিকাও পৌঁছায়নি। 

অল্পবয়সে কবিতা লিখেই পন্টিয়াক কেনার সখ ছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের, এবং লেখার তুমুল জনপ্রিয়তায় সেই জায়গায় পৌঁছেছেনও তিনি। কিন্তু শুধুমাত্র লিখে সেই পরিমাণ রোজগারের জায়গায় পৌঁছানোটা বাঙালি লেখকের কাছে খুব সহজ নয়। বিদেশি সাহিত্য বা ইন্ডিয়ান ইংলিশ রাইটারদের মতো বেস্ট সেলার বাংলা সাহিত্যে কিছুটা এক সুনীলই লিখতে পেরেছেন। অথচ প্রিন্ট মিডিয়ায় খুব জনপ্রিয় অথবা বিশিষ্ট লেখক ছাড়া অধিকাংশ বাংলা লেখককেই পুরো বা আংশিক খরচ দিয়ে নিজের বই প্রকাশ করতে হয়। অথচ মাসিক ইন্টারনেটের খরচ চালাতে পারলে অনায়াসেই ব্লগার হওয়া যায়। কিম্বা আরেকটু বেশি খরচ করতে পারলে নিজস্ব ওয়েবসাইট। একটি ক্লিকেই পৌঁছে যাওয়া অজস্র মানুষের কাছে। সোসাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার এবং লেখক-পাঠক সংযোগ এখন খুব সহজ। খুব সহজেই জানা যায় পাঠকের প্রক্রিয়া বা কতটা মন ছুঁতে পারা গেল। এটা কিন্তু লেখককে উৎসাহী করে তোলে। তবে মুশকিল যেটা, মোবাইল ক্যামেরায় ফোন থাকার পর থেকে যেমন সকলেই ফটোগ্রাফার, ঠিক তেমনি ওয়েব দুনিয়ায় সকলেই লেখক। তাই ভালো লেখা পড়া মাঝে মাঝে দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে অনেকের না হয়ে ওঠা লেখার মাঝে। তবে তেমন যে প্রিন্টেও থাকে না, তা নয়। একজনের লেখা আরেকজন নিজের নামের দেওয়ার অভ্যসটা প্রিন্ট মিডিয়ায় পুরোনো অভ্যেস, ওয়েব মিডিয়ায় নতুন।

ব্যক্তিগতভাবে আমার যেমন ছাপার অক্ষরের বই থেকে শুরু করে পিডিএফ-এ বই সবই ভালোলাগে, লেখার ক্ষেত্রেও নিজের ছাপার বইয়ের মতোই খুশি হই ‘আমাদের ছুটি’-র নতুন সংখ্যা বেরোলে কী নিজের ব্লগে নতুন কিছু লিখলে। আসলে লেখা মানে লেখক-পাঠক যোগাযোগ মাধ্যম যাই হোক না কেন। অনেকদিন আগে ধনঞ্জয়ের ফাঁসির আগে আমার একটি মৃত্যুদণ্ডবিরোধী চিঠি ‘প্রতিদিন’ কাগজে প্রকাশিত হওয়ার পর ওই কাগজে বেশ বাদানুবাদ হয়, এবং আমার বাড়ির ঠিকানাতেও অনেক চিঠি আসে স্বপক্ষে, বিপক্ষে। আমার লেখা পড়ে মানুষ ভেবেছেন এটা আমাকে নাড়া দিয়েছিল খুব। কারণ ধনঞ্জয়কে কেন্দ্র করেই সেইসময় আমার মিডিয়ায় লেখালেখি শুরু হয়। তখন আমি মূলতঃ গল্প-কবিতা লিখি ছোট পত্রিকায়। এখন এই পাঠক প্রতিক্রিয়া পাওয়া অনেক সহজ হয়েছে। এটা অবশ্যই একটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ভালোলাগার জায়গা। কারণ দিন বদলের স্বপ্ন অনেক লেখক দেখলেও সুমনের কথা আমার বড় সত্যি লাগে – আমি গান গাইলেম, কিছুই হল না, যা ছিল আগের মতো রয়ে গেল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি গান লিখলেন এবং গাইলেন। চুপ করে থাকলেন না।

আমার মনে হয়, লেখকের লেখার যদি সত্যিই কোনো উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে তা এই চুপ করে না থাকা। কোনো কোনো লেখক নিজের লেখা প্রকাশ করেন না। যেমন জীবনানন্দকে আমরা চিনি তাঁর অখণ্ড কবিতাসমগ্রে, অথচ বহু খণ্ডে তাঁর গদ্য এখন উদ্ধার হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। কেন তা জানা নেই।  এখন লেখক-পাঠক দূরত্ব কমেছে তাই আমার মনে হয় এমন ব্যতিক্রমের ঘটনাও কমবে, বরং অনেক আগে যিনি নিজের লেখা প্রকাশের কথা ভাবতেই পারেননি, তেমন মানুষও স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠছেন ব্লগে, ওয়েবসাইটে। এর খুব ভালো উদাহরণ, ‘আমাদের ছুটি’-তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত সুবীর কুমার রায়ের ভ্রমণ কাহিনি। প্রিন্ট মিডিয়ায় একেবারে অপরিচিত এই সুবীরদার গল্প লেখার হাতও ভীষণ ভালো। কিন্তু সবই ছিল তাঁর ডায়েরি বা খাতার পাতায় এতদিন। লেখক হতে পারেন, এই ভাবনাই মাথায় আসেনি। আমি তো বারবার করে বলি ওয়েবের পাশাপাশি প্রিন্ট মিডিয়াতেও লেখা দিতে। ষাটোর্ধ্ব এই যুবক এখনও তা উদ্যোগ করে করেননি, নাহ্‌, আমিও হাল ছাড়িনি।

আসলে, চুপ না করাটাই যে কাজ। তা কলমে-কাগজেই হোক বা আন্তর্জালে।

‘দ্য শো মাস্ট গো অন’...

প্রস্থান

প্রতিদিন মানুষের লোভ বিবর্ণ করে আমায়।
হিংস্র কামনা নিঃশব্দে ক্ষয় করে শরীর।
যেন ভুল করে এ পৃথিবীতে আসা,
যেন ভুল করে অমল বিশ্বাসে
মানুষের হাতে হাত রাখা।

সব ভুল? এইসব, সমস্ত বিশ্বাস?
যেন সত্য, আলো, ভালোবাসা, পবিত্রতা
বলে কোনো শব্দের জন্ম হয়নি কোথাও।
আমাদের অজাত সন্তান অথবা হত শিশুদের মতো?

সময়ের সাথে ক্রমশঃ মুছে যাচ্ছি পৃথিবীর থেকে।
যেন এ ভূবন আমার ছিল না কখনও।


Friday, November 20, 2015

কথোপকথন


-         আজ সারাদিন কথা বলোনি যে?

-         জানো না, সব কথা ফুরিয়ে যায় একদিন,
     অথবা, থেমে যায় অকস্মাৎ মৃত্যুর মতো?

-         তাই নাকি? সব কথা! তারপর?

-         না কথারা ভিড় করে মনে ও মগজে।
     মিলেমিশে কবিতার আর্ত কন্ঠস্বর।

-         এই শেষ? আর কিছু বাকি? আমাদের মাঝে?

-         ভেবে নাও তবে, অনন্ত কথোপকথনে   
     বয়ে যাবে নৈঃশব্দের নদী।

ক্রুশবিদ্ধ

প্রতিদিন মানুষের মৃত্যু বড় পীড়া দেয়,
বুকে বাজে না ভালোবাসা।
ক্ষমাহীন পাপ জমে শরীরের ভাঁজে।
তুমি আমি সকলেই দায়ী, অথচ
ক্রুশবিদ্ধ হয় অন্য কারা।

টুকরো ভাবনা

১) ক্ষমতা এবং অর্থের লোভে মানুষ মানুষকে হত্যা করে, এই মোদ্দা কথাটা নিজের কাছেই আমরা স্বীকার করতে চাইনা বলে, হিন্দু-মুসলমান, সাদা-কালো, খ্রিস্টান-জিউস, দলিত-ব্রাহ্মণ নানারকম মুখোশের আড়ালে নিজেদের এবং অন্যদের মুখ ঢাকতে চাই। মানুষ হিসেবে নিজেকে টের পেলে পাছে মানবিকতা নামক পচা দূর্বলতা জেগে ওঠে।

২) জীবনের কিছু কিছু ছোট ছোট সুখ থাকে, যেটার জন্য বাঁচতে ইচ্ছে করে অথবা ছেলেবেলা মনে পড়ে। যেমন, শীতের দুপুরে রোদে পিঠ দিয়ে কমলালেবু খাওয়া। আহা, এখনও শীত পড়েনি, তাতেই বা কী? মিঠে রোদ্দুরও আছে, কমলালেবুও। অতএব সুখটুকুও থাকুক স্বাদে-সুঘ্রাণে।

৩) দুপুরের রোদ ক্রমশঃ মরে আসছে। দূরে কোথাও যেন হেমন্তর সুরেলা কন্ঠের ডাক ভেসে আসছে, ঘরেও নাহি পারেও নাহি যেজন আছে মাঝখানে সেই বসেছে ঘাটের কিনারায়...আমায় নিয়ে যাবি কে রে দিনশেষের শেষ খেয়ায়, ওরে আয়...।
দিনের শেষে...
আপন মনেই মনে হয়
দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না - সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি/ কান্নাহাসির বাঁধন তারা সইল না...

৪) অনুভূতিরা যখন বাস্তব হয়, তার একটা আনন্দ আছে। আর অবাস্তব কিছু অনুভূতিতে টুপ করে ডুবে গেলেই পাওয়া যায় অপার্থিবকে। অধিকাংশ রবীন্দ্রসঙ্গীতই ঠিক অনুভবে গাওয়া হলে তেমনই মনে হয়।।
যদি প্রেম দিলে না প্রাণে কেন আকাশ এমন চাওয়া চায় এ মুখের প্রাণে...' - সুচিত্রা গেয়ে যাচ্ছেন...তরী সেই সাগরে ভাসাও যাহার কূল সে নাহি জানে...




Wednesday, November 18, 2015

ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা

ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানো এবং পৌঁছে দেওয়ার জন্য চিরকালই অনেক মাধ্যম, অনেক রক্তপাত। মন্দির, মসজিদ, চার্চ, মনাস্ট্রি। তাদের মধ্যে আরও আরও ভাগ। এতেও হয় না, একে ভাঙছে ও, ওকে ভাঙছে এ। আমার ঈশ্বর, তোমার আল্লা, অথবা আমার গড তোমার ভগবান। আমার ঈশ্বরই শ্রেষ্ঠ, তোমাকে শুদ্ধু আমার ঈশ্বরই মানতে হবে, নাহলে তোমার ঘাড় মানবে মানে ঘাড় আর মাথায় থাকবে না আর কী। কুপিয়ে হত্যা, গুলি, বোমা – ঈশ্বরের কাছে সোজা পৌঁছানোর এবং পৌঁছে দেওয়ার কত সহজ উপায়!

মোবাইল ফোন, হোয়াটস অ্যাপ, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের যুগে ভালোবাসারও অনেক মাধ্যম। চিঠির অনন্ত প্রতীক্ষা অথবা না পাওয়া আর হারিয়ে যাওয়ার হাহাকার নেই।

ওদিকে রেকর্ড তো অনেক অতীত, ক্যাসেটও বদলে গেল সিডি-ডিভিডিতে, তাও বদলে ইউটিউব আর নানা ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করা গান বাজছে মোবাইলে, ল্যাপটপ, ট্যাবলেটে।

অথচ আজও গীতবিতানের গান বাজে সুচিত্রা মিত্রের কন্ঠে – ‘আরো আরো প্রভু, আরো আরো, এমনি করে, এমনি করে আমায় মারো...’। একলা ঘরে গলা মেলাই যখন এই পৃথিবীতেই ঈশ্বর আর ভালোবাসার গভীর শান্ত পরশ পাই। শৈশবে মায়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাইতে গাইতে আর বড় হতে হতে জীবনের সব দুঃখ-কষ্ট ব্যথা বেদনায় দেখেছি এই আমার ভালোবাসা পৃথিবী ঈশ্বর।

আর ঠিক কোথায় যেন তখনই সুচিত্রা গেয়ে ওঠেন – ‘কোথায় ফিরিস পরম শেষের অন্বেষণে/ অশেষ হয়ে সেই তো আছে এই ভূবনে/... কোথায় ফিরিস ঘরের লোকের অন্বেষণে/পর হয়ে সে যে দেয় যে দেখা ক্ষণে ক্ষণে...'।

Tuesday, November 17, 2015

মানুষ হয়ে ওঠা

আমি বারবার পরিচয়হীন মানুষ হব।

বারবার মানুষের দিকে
মানুষেরই হাত বাড়াব।

ঈশ্বর, আল্লা বা গড নামধারী
যদি আদৌ কেউ থাকে -
মানুষের মধ্যেই আছে,
অথবা কোথাও নেই।

লোভ, ঘৃণা, ক্ষমতার নীল মায়া
অথবা সাম্রাজ্যবাদের রক্তচক্ষু,
সেও রয়েছে মানুষেরই মাঝে।

মানুষ এবং প্রকৃতি ছাড়া
আর কিছু নেই এ পৃথিবীতে।

প্রকৃতি এবং প্রকৃতিজাত জীবনে
এসব কিছুই নেই, বাস্তুতন্ত্রের
নিরপেক্ষ ভারসাম্য ছাড়া।

ভারসাম্যহীন মানুষ শুধু
কুঠার হানে পরস্পরের প্রতি
আর নির্মাণ করে অশরীরী
অলীক হৃদয়হীন দেবতা।
যে বদলে দেয় মানুষের
নাম এবং পরিচয় -
লোভ এবং ঘৃণার শিরোনামে।

আমি মানুষ হব,
প্রকৃতির অন্য কোনো জীবন নয়।
বারবার মানুষই হব -
যে মানুষ এখনও
ভালোবাসতে ভুলে যায়নি,
ভুলে যায়নি অশ্রু ফেলতে
অথবা গর্জে উঠতে প্রতিবাদে।

আমি সেই পরিচয়হীন মানুষ হব।

আমি বারবার মানুষ হব এই পৃথিবীতে।

তোমার ছেলের হাতে বিষের নাড়ুর মতো বোমা

আমি তো দেখতে পাচ্ছি পৃথিবী জুড়ে শুধু মানুষের লাস জমছে। কিছুদিন পরে আর হাঁটা যাবে না। হয় লাস হতে হবে, নাহয় বন্দুক। আর তা নাহলে প্রতিমুহূর্তে হোঁচট খেতে হবে মৃতদেহের ভিড়ে।

ফ্রান্স-আমেরিকার মত দেশগুলির গায়ে একটা ঢিল লাগলেও বিশ্বজুড়ে চিৎকার শোনা যাবে। আর আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশের মানুষগুলো মানুষ নয়, তাই আমাদের মৃত্যুতে বদলায় না কোথাও রঙ।

জঙ্গীদমনের নামে মুড়ির মোয়ার মতো বোমা পড়তেই পারে আমাদের মাথায়। ক'টা মানুষ মরল গুণতে আসবে না কেউ।

সন্ত্রাসকে সন্ত্রাস বলব আর বিপরীত সন্ত্রাসকে ন্যায়। এভাবেই চিরকাল ইতিহাসে অন্যায় আর ন্যায় তথা সন্ত্রাস আর বিপরীত সন্ত্রাস ঘটে এসেছে। আগামী দিনেও তাইই ঘটবে। কুরুক্ষেত্রে পাঁচ পান্ডবেরা চিরকাল ন্যায়ের জন্য একশ কৌরবকে ধ্বংস করবে। আর শ্রী কৃষ্ণ তথা সাম্রাজ্যবাদ একেই ধর্মযুদ্ধ আখ্যা দেবেন। এভাবেই ধর্ম এবং ন্যায় বেঁচে থাকবে এই পৃথিবীতে!


অন্তিমে সেই দিন আসছে যেদিন আমরা নিজেরাই পরস্পর মুষলযুদ্ধ করে যদুবংশ ধ্বংশ করব আর শ্রীকৃষ্ণ ইহাই আমাদের ভবিতব্য বলে দেহত্যাগ থুড়ি পলায়ন করবেন।

Monday, November 16, 2015

ফিরে আসা

একদিন সে আমার কাছে ফিরে আসবে,
ফিরে আসবে ঠিক বন্ধু হয়েই।
তেমন করেই হাত ধরবে,
যেমন করে হাত ধরা যেত ছেলেবেলার নিশ্চিন্তে।
চিঠির ভাঁজে বলে ফেলা যেত
ভীষণ অপ্রয়োজনীয় গোপন কথাগুলো।
চোখের তারায় ফুটে উঠত ভালোবাসা আর বিশ্বাস।
ঠিক তেমনি ভাবেই একদিন ফিরে আসবে সে,
যেমন ভাবে চলে যায়নি আজও।

তুলনা

কথা বলা আর না বলার মধ্যে কতটা ফাঁক আর কতটা শূন্যতা থাকে?

পাহাড় আর সমুদ্রের মতন
?
অথচ সমুদ্রের গা বেয়ে তো অনেক পাহাড় জেগে ওঠে,
পাহাড় থেকে নদী হাসতে হাসতে নাচতে নাচতে
পৌঁছে যায় ঠিক একদিন সমুদ্রের বুকে।

মাটি আর আকাশের মতো?
সেখানেও তো দিগন্তে লিখে রেখে আসে গোপন কথা তাদের।

পাতা আর শেকড়ের মতন কি?
কোনোদিন দেখা হয়না যদিও,
গভীরে বেঁচে থাকে একে অপরের বাতাস আর রসে।

তাহলে, প্রকৃতি আর মানুষের মতো -
প্রকৃতি বিমূখ হলে অস্তিত্ব সংকট জেনেও
মানুষ শুধুই তাকে ধ্বংস করে।
নির্বাক প্রকৃতি নীরবে মরতে মরতে
ভাবে, এ যে নিজের মরণ ডাকে, তাও বোঝে না...!

কেবল নৈশব্দঃ আর শূন্যতা মানুষের মাঝখানে হাহাকার করে।

একটুকরো ছেলেবেলা

ধর্ম, রাজনীতি এসব প্রসঙ্গ এলেই খুব ছোটবেলার কথা মনে পড়ে আমার, নানান টুকরো ঘটনা। ছোটবেলায় প্রতি বৃহস্পতিবার আমি লক্ষ্মীপুজো করতাম। আমার শিশুমনের আকর্ষণ ছিল পাঁচালীর গল্প আর প্রসাদ। আসলে ছোট থেকেই হাতের কাছে যে বই পাই বুভুক্ষুর মতো পড়ি। তাই পাঁচালিই সই। সব গল্পই পড়া, কয়েকটা আবার বেশি পছন্দ। মাস, তারিখ মিলুক ছাই না মিলুক সেগুলোই বার বার পড়া চাই। কিছুদিন পরে অবশ্য এই হুজুগ কেটে গেল। ক্লাস ফাইভ সিক্সে পড়তে দাদা বলল, ভগবান নেই। ব্যস, আমার ভগবানের সেখানেই ইতি হয়ে গেল, দাদা সব জানে। দাদা স্কুল বা বাইরে থেকে তখন যা শেখে সেই জ্ঞান বোনের ওপর প্রয়োগ করে। মাঝে একবার বাবার মাথায় ঢুকল শিব প্রতিষ্ঠা করবে, সে কী হইহই কাণ্ড বাড়িতে! আমরাও পরম উত্তেজিত এবং মা পরম বিরক্ত। কারণ বাবার যাবতীয় হুজুগের ঝামেলা মাকেই পোহাতে হত। তা দিনকয়েক দুধে-বেলপাতায় শ্বাসরূদ্ধ হওয়ার পর বাবার উৎসাহ শেষ হয়ে গেল, শিব পড়ল মায়ের ঘাড়ে। তখন ফেলতেও পারি না, গিলতেও পারি না গোছের দশা। কিছুদিন মায়ের হাতের জল পেয়ে শেষে তাকের ওপরে উঠে গেলেন শুকনো শিব। ইতিমধ্যে বাবার সখে ব্ল্যাকি নামক কুকুরের আগমন এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে মায়ের দায়িত্বে আসা। আমাদের ছোটবেলায় মায়ের একটা পেটেন্ট বকুনি ছিল, ‘সেই কুকুর থেকে ঠাকুর সবই তো আমার ঘাড়ে পড়বে, তাহলে এসব আনা কেন বাপু? আমি আর পারি না’। তারপর অনেকদিন বেশ শান্তিতেই ছিল বাবা মাছধরা আর বাগান করায় যতটা মাকে জ্বালানো যায় আর কী। যেমন নেই ফ্রিজের যুগে রাত ন’টার সময় ধপাস করে কতগুলো ধরে আনা মাছ নামিয়ে রাখা। তখন কারেন্টও নেই, লন্ঠনের আলোয় সেই মাছ ঘচাঘচ কাটা হচ্ছে আর কাটতে কাটতে মা রাগে গরগর করছে। আমি তখন বোধহয় ইলেভেন কী টুয়েলভে পড়ি, বাবার মাথায় ঢুকল সরস্বতী পুজো করবে। ব্যস, আবার হইহই কাণ্ড পুরুত-টুরুত ডেকে। তখন মা গান শেখাতো তাই ছাত্রছাত্রীরাও হাজির। পরের বছরই বাবার উৎসাহ নিভে গেছে। সেবারে আমি না দাদা কে যেন পুরুতের কাজ করেছিলাম। সরস্বতীর সঙ্গেই আমাদের পুজো ঠাকুর  ইতি ঘটে।

বাবা আর মায়ের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে নিত্য তর্কাতর্কি হামেশাই শুনতে পেতাম। মায়ের কাছে তখন মায়ের দামাল ছেলেবেলা থেকে সত্তরের দশকে পার্টি করার নানান গল্প শুনে বেশ উদ্বুদ্ধ আমি। মায়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাশাপাশি ‘হেই সামালো ধান হো’, ‘জন হেনরী’, ‘উই শ্যাল ওভারকাম’, ‘ক্যালকাটা ইউথ কয়ার’-এর গান গাইতে রোমাঞ্চ হত। ঠিক যেমন রোমাঞ্চ হত পনেরোই আগস্টে স্কুলে পতাকা উঠলে বা ‘ভারত আমার ভারতবর্ষ’ গানে গলা মেলালে। সত্তরের নানা গল্পে অনায়াসেই মিশে যেত মায়ের প্রথম শ্বশুরবাড়ির যৌথ পরিবারের কাহিনিও। গল্পের টানেই আমরা বিভোর। আনন্দদাদা মায়ের বন্ধুর ছেলে থেকে ক্রমে আমাদের দাদা হয়ে ওঠে সেভাবেই। সেইসময় অনেক কংগ্রেসীরা বাবার সঙ্গে আড্ডা দিতে আসত। তারা কংগ্রেসী বোঝার মত বড় হইনি, মায়ের গজগজ মনে আছে – আমি ‘কংগ্রেসী চা’ করতে পারব না। যেমন আগের শ্বশুরবাড়িতে অনেক নানাবয়সী ছেলেমেয়েরা আসত, আর মাকে প্রায়ই তাদের জন্য ‘বিপ্লবী রুটি’ বানাতে হত। সুনীল, শক্তিদের কথা, মানে তখনও খ্যাত নয় কেউই, কাকা বা সন্তোষ রানা, জয়শ্রী রানা এদের সকলের কথা মায়ের মুখেই শুনেছি। বাবা এসব গল্প একদম করত না। এক জ্যোতি বসুর কিছু কথা বাবার কাছে কখনও শুনেছি। তবে মায়ের কলেজ লাইফে দেবেশ মামা বা অমিতাভ কাকা এদের সঙ্গে আড্ডা মারা, পার্টির গল্প এগুলো মায়ের বেশি প্রিয় এখনও।

এর পাশাপাশি ছিল মায়ের গান সাধনা। সংসারের সব কাজ একা হাতে সেরে একটু বেলায় বসত, একেকদিন বিকেল চারটে-পাঁচটা পর্যন্ত চলত। খাওয়া তারও পরে। মা অল্প যেকদিন চাকরি করতে পেরেছিল, তখন আমার ছিল পোয়া বারো। চেয়ার কিম্বা মোড়ায় উঠে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ‘দেশ’ পড়া। তখন সমরেশ বসুর ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’ একে একে বেরোচ্ছে। আর বাবা মায়ের ঝগড়া হলেই ছাদে পালিয়ে যাওয়া। আর গাছেদের সঙ্গে বকবক কিম্বা রাতে আকাশের তারা দেখা। ইতিমধ্যে বিভূতি, বঙ্কিম, রবি ঠাকুর থেকে চেকভ, দস্তাভয়স্কি, মোঁপাসা থেকে কাগজের ঠোঙা যা পাওয়া যায়। ওদিকে দেশ পড়া বারন, এদিকে ‘ন হন্যতে’ পড়তে পেলাম ক্লাস সেভেনেই। মায়ের লেখালেখিও শুরু হয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই উনুনের মধ্যে পুড়ছে উপন্যাস আবার মাছের ঝোল চাপিয়ে চলছে লেখাও। ‘আমাকে কেউ ইঁট চাপা দিলে আমি ইঁট ফুঁড়ে বেরোব’ – এটাও মায়ের পেটেন্ট ডায়লগ। মায়ের যেটা সবচেয়ে ভালো ছিল, একা কাউকে বকত না, আমাদের তিনজনকে একসঙ্গে বকত, একেকসময় এটা চলত প্রায় মাঝ রাত্তির অবধি। সবার আগে ঘুমাত বাবা, মানে বিছানায় পড়া মাত্র। দাদাও খানিকটা সিনসিয়ারলি শুনে ঘুমিয়ে পড়ত, আর আমি এক্কেবারে শেষ পর্যন্ত। অনেকবার পরেরদিন সকালে কাল রাতে পুরো বকুনি একা শোনার জন্য আমাকে কিছু দিতে হবে এই দাবী জানাতাম। কম পাজি তো ছিলাম না। মায়ের আরেকটা ব্যাপার ছিল, কক্ষনো মিথ্যা বলত না, আর কেউ যদি ভুল করেও মা কে মিথ্যাবাদী বলেছে, তাও হয়তো সরাসরি নয়, অসম্ভব ক্ষেপে যেত।

ছ’-সাত বছর বয়স থেকে অনেক বড় পর্যন্ত আমার প্রিয় বই ছিল কাশীদাসী মহাভারত। পরে এই জায়গাটা দখল করে বিভূতিভূষণ আর গীতবিতান এবং আরও পরে রাণী চন্দের ভ্রমণ কাহিনি। আমি তখন একা একা ধানক্ষেতে ঘুরে বেড়াই। সাত-আট বছর বয়সেই মা হাতে ধরে দিয়েছিল ডায়েরি আর কলম, সেই লেখালেখির প্রতি ভালোবাসার শুরু। এখনও মায়ের পরে এটাই আমার সবথেকে বড় ভালোবাসা আর আশ্রয়ের জায়গা। অবশ্যই গীতবিতানও আছে। আসলে বই বা কলম এমন বন্ধু, অনেকটা মায়ের মত, তুমি যাই কর, তোমায় প্রশ্রয় দেবে, আড়াল করবে, ভালোবাসবে।

আমার মা এখন সাদা চুলে সামান্য ভারী চেহারায় দুই নাতনীর প্রিয় দিদিমা, ঠাকুমা, যে কীনা ওয়ান ডি-র গান থেকে ফ্রেঞ্চ শেখা সবেতেই সতেরো বছরের বড় নাতনীর সঙ্গে তাল মেলায় আর ডিভাইন কমেডি-র বাংলা অনুবাদ আর উপন্যাস লেখার ফাঁকে ছ’ বছরের ছোট নাতনীকে তাল দেয়। এই তো কয়েকদিন আগে, আর ঘুড়ি ওড়াতে পারি না, তাও চেষ্টা করলে এখনও পারতে পারি, তোদের কারোর উৎসাহ নেই, এই বলে দুঃখ করছিল। ওরে বাবা মায়ের ঘুড়ি ওড়ানো – সে আরেক গপ্প!


আমার কেবল মাঝে মাঝে আমার ভীষণ রোগা, ঊড়ণচণ্ডি, গাছে চড়া, বৃষ্টিতে ভেজা, হলুদ আঁচলের ছেলেমানুষ মা টার জন্য খুব মনকেমন করে।

ভারতবর্ষ কোনো ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ নয়

যতদিন সরকারি বিভিন্ন জায়গায় বা ফর্মে ধর্ম লিখতে হবে, ততদিন পর্যন্ত ভারত কিছুতেই ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ নয়। ব্যক্তিগতভাবে যে কেউ যে কোনো ধর্মাচরণ করতেই পারেন কিন্তু ধর্ম নিরপেক্ষ কোনো দেশে সরকারিভাবে কোনো ধর্ম কারোর থাকতে পারে না।

আমি এখনোপর্যন্ত কখনও কোথাও বাধ্যতামূলকভাবে ধর্ম লিখতে হলে ‘হিউম্যানিটি’ বা ‘মানবতা’ লিখি। ভাবছি এরপর ‘ভালোবাসা’ বা ‘love  লিখলে কেমন হয়?

সত্যিই কি আমাদের প্রকৃত কোনো ধর্ম আছে? আমার অন্ততঃ অফিসিয়ালিই নেই। বাবার দিক থেকে পরিবারগতভাবে এক সময়ে হিন্দু হলেও বাবার ঠাকুরদা এক ব্রাহ্ম মেয়েকে বিয়ে করায় সেইসময় ত্যাজ্যপুত্র হয়েছিলেন। আমার মায়েরা পরিবারগতভাবে বৌদ্ধ, কিন্তু মায়ের ঠাকুরদাদা আবার খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন এবং তিনি এক বার্মিজ মেয়েকেও বিয়ে করেছিলেন, আমার মায়ের দিদিমাকে ছাড়াও। ফলে আমার মধ্যে এক মুসলিম ছাড়া পরিচিত বেশ কয়েকটি ধর্মের উত্তরাধিকার রয়েছে। আমার জন্মের সময় এবং তারপরেও দীর্ঘদিন মানে আমার বিয়ের ঠিক আগে অবধি বাবা-মা লিভ ইন রিলেশনশিপে ছিলেন। আমার হিন্দু পরিবারে বিয়ে হলেও হিন্দুমতে হয়নি। এবং শাঁখা-সিঁদুর জাতীয় সংস্কার আমি মানি না। আমার বাড়িতে ঠাকুর বা কোনোরকম কোনো পুজো-আচ্চারও বালাই নেই, যদিও সমস্ত ধর্মের প্রসাদ খেতে আমার দারুণ লাগে। ফলে, ধর্মের কলামে প্রচলিত কোনোটা কেন লিখব সেটাই আমার মাথায় ঢোকে না।

আমার পাসপোর্ট নেই। বাংলাদেশ যাওয়ার খুব ইচ্ছে, তার জন্য পাসপোর্ট করালে ধর্ম আমার যা মনে হবে লিখব। দেখি ধর্মনিরপেক্ষ ভারত সরকার কী বলেন?


বন্ধু

অনেকদিন পর পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়ায় একধরণের নস্টালজিয়া বা ভালোলাগা থাকে। কিন্তু যদি পঁয়ত্রিশ বছর ধরে সামনে বা আড়ালে, যোগাযোগে বা না যোগাযোগে কাউকে শেষপর্যন্ত বোঝানো যায় যে সত্যিই তোর পাশে আছি, সেটা খুব বিরল একটা ভালোলাগা। তেমনই এক ঘটনা ঘটল এইমাত্র। আমার আট বছর বয়স থেকে ক্লাসের একটি মেয়েকে খুব বন্ধু বলে ভাবতাম। চিরকালই ওর আচরণ খুব অদ্ভুত ছিল আমার সঙ্গে। আমাকে আঘাত করেই যেন খুশি হত। বড় হওয়ার পর ও যোগাযোগ না রাখলেও ওর খোঁজ রাখতাম দীর্ঘদিন ওর দিদির বাড়িতে ফোন করে। অনেক পরে যখন দেখা হল তখনও কিছুদিন মিশেই আবার আগের মতোই ব্যবহার করতে শুরু করল। এত যে রাগী, বদমেজাজি আমি, কোনোদিন ওর প্রতি মেজাজ হারিয়ে ফেলিনি, বরং মায়া হয়েছে ওর ছন্নছাড়া জীবন দেখে। আরোই ভালোবেসেছি। অনেকসময় ফোন করলেও ধরেনি। তাও ফোন করেছি। হঠাৎ করেই দু'দিন আগে ফোন করে যোগাযোগ করে দেখা। লেকটাউন মেলার মাঠে বসে টুকিটাকি কথা হল। এমনিতেই কারোর ব্যক্তিজীবন নিয়ে আমার কোনো কৌতূহল নেই। নিজের ক্ষেত্রেই দেখেছি ব্যক্তিজীবন নিয়ে কৌতূহল মানুষকে কতটা ভেঙে দেয়। ফিরে গিয়ে মেসেজ করেছিল, বুঝলাম একা ফিল করছে। বললাম, আমি আছি, তোর জন্য আমার সবসময় সময় আছে। আজ মেসেজ করে আমার ঠিকানা চেয়েছে, চিঠি লিখবে সেটাই তার কাছে মনে হয়েছে নস্টালজিক আর হিলিং। ঠিকানা দিয়ে বললাম, তোর যা ইচ্ছে লেখ, ভুলে যা উল্টোদিকে আমি আছি, জানিস তো আমার কোনো ব্যক্তিগত কৌতূহল নেই, বড়জোর উপন্যাসের রসদ খুঁজতে পারি।

মনে হল এতদিনে হয়ত ওর
'বন্ধু' হয়ে উঠতে পারছি। পঁয়ত্রিশ বছর, এমন কী আর বেশি সময়, বন্ধুসাধনার জন্য?
আরেকজনের এখনও পারলাম না, সেই সম্পর্ক সাঁইত্রিশ বছরের। জানিনা সে কখনও বন্ধু হবে কী না...

"এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর সাথে..." - এই গানটা মাঝে মাঝেই বেজে ওঠে মনে।


আমার মনে হয়, যে কঠিন সময়ে আমরা আজ দাঁড়িয়ে আছি তার সঙ্গে লড়াই করবার সবচেয়ে ভালো অস্ত্র মানুষে মানুষে বিশ্বাস, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব।

সন্ত্রাস, সাম্রাজ্যবাদ এবং ধর্ম

প্রথমেই বলে রাখি রাজনীতি বিষয়ে এবং বিশ্ব রাজনীতির ব্যাপারে আমি খুব কম জানি। আমি অনেকটাই লিখি যা অনুভব দিয়ে বুঝি। গতকাল আমার এক বন্ধুর ফেসবুক প্রোফাইলে তার একটি পোস্টের বিরুদ্ধে একজন ‘মুসলমানের দালাল’ বলে কটূক্তি করেছে। আমার মনে হয় সোশাল মিডিয়ার মত জায়গায় এই ধরণের কথাবার্তা খুবই অশালীন মানসিকতার পরিচয়। এতেই বোঝা যায় যে সাম্রাজ্যবাদ কতটা মগজ ধোলাই করতে পারে মানুষের। সন্ত্রাসের সঙ্গে ধর্মের সে অর্থে কোনো যোগাযোগই নেই। ধর্ম বা জাত, রঙ-এর বিভেদ একেক জায়গায় সন্ত্রাস প্রকাশের মাধ্যম মাত্র। মূলতঃ সন্ত্রাস জড়িয়ে আছে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে। সাম্রাজ্যবাদেরই আরেক মুখ হল সন্ত্রাস। মূলতঃ যে দেশগুলির মানুষের মধ্যে সন্ত্রাস জিইয়ে রাখলে বাজার দখল করা যাবে সেখানেই ধর্ম, জাত এসবের বিচার উঠে আসে। মুসলিম দেশ বলে নয় ইরাক এবং ইরান তেলের বাজার দখলের জন্য সন্ত্রাসের শিকার। ভারতবর্ষের মতো দেশেও যে টাকা সেনাবাহিনীকে পুষতে, সন্ত্রাস দমন করতে খরচ হয়, সেই টাকা দেশের উন্নয়নে খরচ হলে দেশের চেহারাই পালটে যেত। কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের মত দেশগুলি যদি নিজেদের উন্নয়নে মন দেয় তাহলে তাদের বাজার দখল হবে কী করে? কী করে বিক্রি বাড়বে পশ্চিমী দেশগুলি, মূলতঃ আমেরিকার অস্ত্র শিল্পে?

এশিয়া, আফ্রিকার বিভিন্ন অংশে প্রতিদিন শ’য়ে শ’য়ে মানুষ এই সাম্রাজ্যবাদ তথা সন্ত্রাসের শিকার হয়। কিন্তু সেসব নিত্য ঘটনা শিরোনামে আসে কচিৎ কদাচিৎ। আর তাই যখন বুমেরাং হয়ে পশ্চিমী কোনো উন্নত দেশের গায়ে লাগে তখন তা হইচইয়ে পরিণত হয়। আমরা ভুলে যাই, সব জায়গাতেই মারা যায় রক্ত মাংসের মানুষ, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষ, তার বাইরের পরিচয় যাই হোক না কেন। এই হিন্দু-মুসলিম, ইহুদী-খ্রিস্টান, সাদা-কালো বিভেদ তৈরি করে ও জিইয়ে রাখে সাম্রাজ্যবাদ তার নিজের বাজার দখলের স্বার্থেই। আর বোকা মানুষের মগজ ধোলাই করে। আর আমরা তাই নিজেদের মধ্যে অকারণে মারামারি করে মরি। ওরা উপভোগ করে আর মাঝে মাঝে শান্তির বুলি আওড়ায়।

তাই সন্ত্রাসের কোনো ধর্ম নেই একথা একেবারেই সত্যি। সন্ত্রাস বেঁচে থাকে সাম্রাজ্যবাদের হাত ধরেই।


Sunday, November 15, 2015

তুমি সুন্দর তাই...

চোখ-নাক-মুখের সৌন্দর্য সবার থাকে না, ওতে মানুষের কোনো হাত নেই। চেষ্টা করলেও বদলানো যায় না গায়ের রঙ, মাথার চুল। কিন্তু মনকে সুন্দর রাখলে তার একটা প্রতিফলন ঘটে মুখে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে অশোকাদিকে। কালো রঙ, দাঁত উঁচু, মাঝারি উচ্চতার এই মহিলা আমাদের কিশোরী মনে দারুণ শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার জায়গা করে নিয়েছিলেন। রঙিন শাড়ি, হিলতোলা জুতো আর ডানহাতে ঘড়ি, বাঁহাতে একটাই চুড়ি – বছর পঁচিশ আগে সেইসময়ে মফঃস্বল শহরে সহজেই আমাদের আইডিয়াল হয়ে উঠেছিলেন। নিজেকে ঠিকঠাকভাবে প্রেজেন্টেশন শুধু নয়, কাজের প্রতি অসম্ভব আন্তরিকতা এবং সহজ সরল মন ছিল তাঁর জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ।

এবং শেষোক্ত এই ব্যাপারটিই সৌন্দর্যের আসল চাবিকাঠি বলে আমার মনে হয়েছে। ত্বক পরিচর্যা অথবা অজস্র রূপটানেও মানুষ সুন্দর হতে পারে না, যদি না মন সুন্দর হয়। আবার মন সুন্দর হলে অনেক সাধারণ চেহারাও অসাধারণ হয়ে ওঠে। ওই যে কথা আছে না, মুখই মনের প্রতিবিম্ব, সত্যিই তাই।


যদি সত্যি মানুষের মন সুন্দর হত তাহলে ধর্মের নামে এই হানাহানি, সন্ত্রাস কিছুই থাকত না। মানুষকে শুধু মানুষ বলেই ভাবতে পারত মানুষ। আর তা নেই বলেই প্রসাধনের মুখোশে মুখ ঢাকতে হয়।

Thursday, November 12, 2015

আমি খুঁজছি তোমার ঠিকানা

লেকটাউন জয়া সিনেমার ঠিক পাশের গলিতে ঢুকেই ডানহাতে একটা ঝুপড়ি দোকান আছে চায়ের। খিদে পেয়েছিল, ডিম-পাঁউরুটি বলে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। দেখছি দোকানদারের ধীরেসুস্থে বানিয়ে তোলার ভঙ্গী। আমার পাশে শ্যামলা রঙের রোগা পাতলা একটা লোক দাঁড়িয়ে দোকানদারের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল। হঠাৎ আরেকজন এসে কিছুটা চিন্তিত মুখে জিজ্ঞাসা করল, এখানে প্রিয়া বিস্কুটের দোকান কোথায় আছে জানেন? দোকানদার ধীরেসুস্থে ঠিকানা জানতে চায়। কিন্তু জয়ার কাছে ছাড়া কোনো ঠিকানা সে জানে না। দোকানদার বলে, কোন রাস্তা তাও জানো না? জয়ার পাশে তো কতকিছুই আছে। একদম সত্যি কথা। বিভ্রান্ত দেখায় লোকটিকে। পাশের থেকে শ্যামলা ভদ্রলোক মন্তব্য করেন, এখন তো সবারই সিঁড়ির নীচে বিড়ির দোকান – সব বাড়িতেই একটা-দুটো অফিস রয়েছে, ঠিকানা না জানলে হয়?  সবে পাঁউরুটি কাটা হয়ে ডিম গোলা হচ্ছে। আমি বলি, ফোন নম্বর তো আপনার কাছে নিশ্চয় আছে, ফোন করে ঠিকানাটা জেনে নিন। লোকটি কিঞ্চিৎ স্বস্তির মুখ করে বলে, আছে, আছে। দোকানদার বলে, ঠিকানাটা জেনে নিয়ে বলুন আমি সব চিনি, বলে দেব। লোকটি বোধহয় ফোন করতে সরে যায় এবং আর ফিরে আসে না। পাশের শ্যামলা লোকটির কথা কানে আসছে। ইতিমধ্যেই বুঝলাম লোকটি ফ্রিজ সারায়, পাকা চাকরি কিছু নেই, সামনে ছোট মেয়ের বিয়ে। সবই একই রকম হাসিমুখে বলে যাচ্ছে, দোকানদার এবং অপরিচিত আমাকে ভারী চেনা মুখ করে। ওরই মাঝে ডিম-পাঁউরুটির ঠোঙা বার করে দোকানদারের নির্দেশে। ঠোঙা হাতে নিয়ে দাম মিটিয়ে পাঁউরুটি চিবোতে চিবোতে হাঁটা দিই। ভাবতে ভাবতে যাচ্ছিলাম যে, লোকটা খুঁজে পেল কীনা দোকানটা আদৌ।


‘সারি সারি সব বাড়ি, যেন সার বাঁধা সৈন্য, সব একধাঁচ সব এক রঙ তুমি কোথায় থাক অনন্য’ ... ওই যাহ্‌ প্রিয়া বিস্কুট...!

স্পর্শ

তোর ঠোঁটের ওপর একটা আঙুল রাখতে দিবি?
তোর টেবিলের শূন্য খাতায় একটা আঁচড় কাটতে দিবি?
একটা আঙুল ছুঁয়ে দিয়েই, দু’একটা দাগ রেখে
চলে যাব, ঠিক দেখে নিস, চলেই যাব দেখে।

ভ্রমণ কাহিনি (২)

'আমাদের ছুটি'-র ফেসবুক গ্রুপে আমার ‘ভ্রমণ কাহিনি’ লেখাটির কমেন্টে বাপ্পাদার একটি খুব সুন্দর আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এই লেখা -

বাংলা এবং পশ্চিমী ভ্রমণ কাহিনির ইতিহাস পড়তে পড়তে একটা বিষয় মনে হয়েছে, তা হল ভ্রমণ কাহিনি লেখার ধরণ এবং পাঠকের আগ্রহ এবং চাহিদা নির্ভর করে সমকালীন পরিস্থিতির ওপর। ঊনবিংশ শতকে যখন বাংলা ভ্রমণ কাহিনি লেখার চল শুরু হল তা মূলতঃ সাহিত্য নির্ভর ছিল। বাংলা সাহিত্যেরই একটা শাখা হিসেবে এর জন্ম। রবীন্দ্রনাথ, স্বর্ণকুমারীরা যখন লিখছেন তখন তা পড়ে কেউ সেই জায়গায় বেড়াতে যাবেন সেটা ভাবছেন না, কারণ তখনও বাঙালির বেড়াতে যাওয়ার চল তেমন নেই, যতটা পড়ার আনন্দ আছে। বাঙালির পায়ের তলায় সর্ষে খুব আধুনিক ধারণা। ব্যতিক্রম কৃষভাবিনী দাস এবং গিরিশচন্দ্র বসু। এঁরা কিন্তু তাঁদের ধারণায় কাজে লাগবে এমন তথ্যের ওপর জোর দিয়েছেন। কারণ সেইসময় বাঙালির মধ্যে বিলেত যাওয়ার একটা হিড়িক উঠেছিল। এইসময়ে ভারত ভ্রমণ মূলক তীর্থকেন্দ্রিক লেখাগুলোও কিন্তু তুলনায় তথ্যবহুল, কারণ বাঙালির দেশের মধ্যে বেড়ানো মূলতঃ তীর্থভ্রমণ ছিল। ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে প্রথম ঠিকঠাক তথ্যমূলক ভ্রমণ কাহিনি, তাও খানিক কাহিনির আঙ্গিকে লিখলেন পদ্মনাভ ঘোষাল – রেলপথে ভারত ভ্রমণ। গল্পের আঙ্গিকে লেখা দুর্গাচরণ রায়ের – দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন একটি অসাধারণ তথ্যমূলক লেখা। বাঙালি যত বেরোতে থুড়ি বেড়াতে শুরু করল তথ্যমূলক লেখার চাহিদা তত বাড়তে থাকলেও তখনও পড়ার অভ্যেস কমেনি, ভ্রমণ সাহিত্যই মূলতঃ খবর দিত নতুন জায়গার। প্রায় একশ বছর পরে বিংশ শতকের শেষের দিকে ভ্রমণ যখন ক্রমশঃ সাধারণের সহজলভ্য হয়ে উঠছে এবং পড়ার অভ্যেস কমছে, চটজলদি তথ্যের প্রয়োজন বাড়ছে, তখন বাংলা ভ্রমণ পত্রিকাগুলির ধারণা এবং জন্ম হল। এটা মোটামুটি সত্তর-আশির দশকে। কিন্তু গত দশবছরে আন্তর্জালের কল্যাণে তথ্য এখন হাতের মুঠোয়। তাহলে ভ্রমণ কাহিনি পড়ে খেটেখুটে তথ্য জানতে যাব কেন? অথচ ভ্রমণ কাহিনি পড়ার একটা চল ছিল, থাকবেও চিরকাল মানস ভ্রমণের। ফলে খুব সম্ভাবনা রয়েছে ভ্রমণ সাহিত্য মূলক লেখার আবার ফিরে আসার। অন্ততঃ ইতিহাসের নিয়ম আমার মতে তাই তো বলে। ভালো লেখা পড়ার একটা চাহিদা বাড়ছে সেটা 'আমাদের ছুটি' করতে গিয়েই লক্ষ্য করেছি। শুধু উমাপ্রসাদ বা পুরোনো সাহিত্যমূলক লেখাই নয়, নতুনদেরও এরকম লেখা লিখতে হবে। কারণ চাহিদা তারই বেশি। তথ্য থাকবে সে লেখায়, কিন্তু তা কখনও সাহিত্যকে বিঘ্নিত করবে না। আমার এটাই মনে হয়েছে।


ইউরোপীয় ভ্রমণ কাহিনির পুরোনো ইতিহাসটাও একই। প্রথমে সাহিত্যমূলক এবং অনেক পরে তথ্যের আগমন।