কোন
মাধ্যমে লিখি, তার আগে যে প্রশ্নটা মাথায় আসে, তা হল, কেন লিখি? প্রথমতঃ লেখক তাঁর নিজের অনুভূতিকে নিজের মধ্যে না রেখে
প্রকাশ করতে চান। আমি যখনই কোনো কথা বলছি বা লিখছি তার প্রথম কারণ অন্য মানুষের
সঙ্গে একটা যোগসূত্র তৈরি করতে চাইছি। যেমন, আদিম মানুষ কথা বলার আগে নিজেকে বোঝাতে ছবি এঁকেছিল গুহার গায়ে, তার জীবনযাপন আর ভাবনার কথা অন্যদের কাছে পৌঁছে দিতে। লেখক
প্রকৃতপক্ষে সেই কাজই করেন।
ওয়েবসাইট এবং ব্লগে লেখালেখির ধারণা অনেক আধুনিক।
বাংলাভাষার ক্ষেত্রে আরো-ই। আধুনিক এই মাধ্যমে বাংলাকে নিয়ে আসা এবং ক্রমশঃ
জনপ্রিয় করার সূচনা এবং প্রসারের কৃতিত্ব বাংলাদেশের। বিভিন্ন বাংলা সফটওয়ার তৈরি
থেকে বাংলা ওয়েবপত্রিকা এবং ব্লগের জন্মদাতা বাংলাদেশ। বাংলাদেশে একজন লেখক বই
লেখার থেকেও ব্লগ লিখে এখন অধিক পরিচিত বা জনপ্রিয়। প্রিন্ট পুরোনো মাধ্যম। বইপড়ার
চল কমলেও প্রিন্ট মাধ্যম থাকবে, কিন্তু আগামীদিনে আরও প্রসারিত হবে ওয়েব দুনিয়া।
এটা 'আমাদের ছুটি' করতে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতা। 'আমাদের ছুটি' দেশ-বিদেশের এমন অনেক
বাঙালির কাছে পৌঁছে গেছে, যেখানে প্রিন্ট মাধ্যমের কোনো জনপ্রিয় ভ্রমণ পত্রিকাও
পৌঁছায়নি।
অল্পবয়সে কবিতা লিখেই পন্টিয়াক কেনার সখ ছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের, এবং
লেখার তুমুল জনপ্রিয়তায় সেই জায়গায় পৌঁছেছেনও তিনি। কিন্তু শুধুমাত্র লিখে সেই
পরিমাণ রোজগারের জায়গায় পৌঁছানোটা বাঙালি লেখকের কাছে খুব সহজ নয়। বিদেশি সাহিত্য
বা ইন্ডিয়ান ইংলিশ রাইটারদের মতো বেস্ট সেলার বাংলা সাহিত্যে কিছুটা এক সুনীলই
লিখতে পেরেছেন। অথচ প্রিন্ট মিডিয়ায় খুব জনপ্রিয় অথবা বিশিষ্ট লেখক ছাড়া অধিকাংশ
বাংলা লেখককেই পুরো বা আংশিক খরচ দিয়ে নিজের বই প্রকাশ করতে হয়। অথচ মাসিক
ইন্টারনেটের খরচ চালাতে পারলে অনায়াসেই ব্লগার হওয়া যায়। কিম্বা আরেকটু বেশি খরচ
করতে পারলে নিজস্ব ওয়েবসাইট। একটি ক্লিকেই পৌঁছে যাওয়া অজস্র মানুষের কাছে। সোসাল
মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার এবং লেখক-পাঠক সংযোগ এখন খুব সহজ। খুব সহজেই জানা যায়
পাঠকের প্রক্রিয়া বা কতটা মন ছুঁতে পারা গেল। এটা কিন্তু লেখককে উৎসাহী করে তোলে।
তবে মুশকিল যেটা, মোবাইল ক্যামেরায় ফোন থাকার পর থেকে যেমন সকলেই ফটোগ্রাফার, ঠিক
তেমনি ওয়েব দুনিয়ায় সকলেই লেখক। তাই ভালো লেখা পড়া মাঝে মাঝে দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে
অনেকের না হয়ে ওঠা লেখার মাঝে। তবে তেমন যে প্রিন্টেও থাকে না, তা নয়। একজনের লেখা
আরেকজন নিজের নামের দেওয়ার অভ্যসটা প্রিন্ট মিডিয়ায় পুরোনো অভ্যেস, ওয়েব মিডিয়ায়
নতুন।
ব্যক্তিগতভাবে
আমার যেমন ছাপার অক্ষরের বই থেকে শুরু করে পিডিএফ-এ বই সবই ভালোলাগে, লেখার
ক্ষেত্রেও নিজের ছাপার বইয়ের মতোই খুশি হই ‘আমাদের ছুটি’-র নতুন সংখ্যা বেরোলে কী
নিজের ব্লগে নতুন কিছু লিখলে। আসলে লেখা মানে লেখক-পাঠক যোগাযোগ মাধ্যম যাই হোক না
কেন। অনেকদিন আগে ধনঞ্জয়ের ফাঁসির আগে আমার একটি মৃত্যুদণ্ডবিরোধী চিঠি ‘প্রতিদিন’
কাগজে প্রকাশিত হওয়ার পর ওই কাগজে বেশ বাদানুবাদ হয়, এবং আমার বাড়ির ঠিকানাতেও
অনেক চিঠি আসে স্বপক্ষে, বিপক্ষে। আমার লেখা পড়ে মানুষ ভেবেছেন এটা আমাকে নাড়া
দিয়েছিল খুব। কারণ ধনঞ্জয়কে কেন্দ্র করেই সেইসময় আমার মিডিয়ায় লেখালেখি শুরু হয়।
তখন আমি মূলতঃ গল্প-কবিতা লিখি ছোট পত্রিকায়। এখন এই পাঠক প্রতিক্রিয়া পাওয়া অনেক
সহজ হয়েছে। এটা অবশ্যই একটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ভালোলাগার জায়গা। কারণ দিন বদলের
স্বপ্ন অনেক লেখক দেখলেও সুমনের কথা আমার বড় সত্যি লাগে – আমি গান গাইলেম, কিছুই
হল না, যা ছিল আগের মতো রয়ে গেল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি গান লিখলেন এবং গাইলেন।
চুপ করে থাকলেন না।
আমার মনে
হয়, লেখকের লেখার যদি সত্যিই কোনো উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে তা এই চুপ করে না থাকা।
কোনো কোনো লেখক নিজের লেখা প্রকাশ করেন না। যেমন জীবনানন্দকে আমরা চিনি তাঁর অখণ্ড
কবিতাসমগ্রে, অথচ বহু খণ্ডে তাঁর গদ্য এখন উদ্ধার হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। কেন তা জানা
নেই। এখন লেখক-পাঠক দূরত্ব কমেছে তাই আমার
মনে হয় এমন ব্যতিক্রমের ঘটনাও কমবে, বরং অনেক আগে যিনি নিজের লেখা প্রকাশের কথা
ভাবতেই পারেননি, তেমন মানুষও স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠছেন ব্লগে, ওয়েবসাইটে। এর খুব ভালো
উদাহরণ, ‘আমাদের ছুটি’-তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত সুবীর কুমার রায়ের ভ্রমণ কাহিনি।
প্রিন্ট মিডিয়ায় একেবারে অপরিচিত এই সুবীরদার গল্প লেখার হাতও ভীষণ ভালো। কিন্তু
সবই ছিল তাঁর ডায়েরি বা খাতার পাতায় এতদিন। লেখক হতে পারেন, এই ভাবনাই মাথায়
আসেনি। আমি তো বারবার করে বলি ওয়েবের পাশাপাশি প্রিন্ট মিডিয়াতেও লেখা দিতে।
ষাটোর্ধ্ব এই যুবক এখনও তা উদ্যোগ করে করেননি, নাহ্, আমিও হাল ছাড়িনি।
আসলে,
চুপ না করাটাই যে কাজ। তা কলমে-কাগজেই হোক বা আন্তর্জালে।
‘দ্য শো
মাস্ট গো অন’...
No comments:
Post a Comment