যে বয়সে সুনীল বা বুদ্ধদেব গুহর রোমান্টিক লেখা পড়ে অল্পবয়সী
মেয়েরা মুগ্ধ হয়, আমি সেসব হাতের কাছে পাইনি। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র,
বিভূতিভূষণের পরেই হাতের কাছে পেয়েছি ইংরেজি সাহিত্য, এবং রুশ এবং অন্যান্য ভাষার
অনেক বই অনুবাদে। হাতের কাছে বই না পেলে ঠোঙাই পড়ি তখন – মায়ের ভাষায় ঠোঙা
সাহিত্য। মনে আছে, ছোটবেলায় মা আমাদের মজা দেওয়ার জন্য বাজার কী দোকান থেকে আসা
কাগজের ঠোঙা ফুলিয়ে দুম করে ফাটাত, আর তারপরে ছেঁড়া ঠোঙাটার এপিঠ-ওপিঠ পড়ত।
তাই বিভূতিভূষণের অপু বা শঙ্করের মতো বিদেশি গল্পের নানা
চরিত্র আমার প্রিয় হয়ে উঠতে লাগল। তারমধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছিল ‘ওয়াদারিং হাইটস’-এর
হিটক্লিফ। হিটক্লিফকে নিয়ে আমি আগেও একবার লিখেছিলাম। হিটক্লিফের ওই প্যাশনেট
চরিত্র এবং হিস্টিরিক ভালোবাসা আমার কমবয়সী মনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। বহুবার
পড়েছি বইটা সেইসময়েই।
গতকাল ‘দ্য গ্রেট গ্যাটস বি’ দেখছিলাম। ইংরেজি এম এ তে
পাঠ্যে ছিল। তখন পুরোনো সিনেমাটা দেখেছিলাম। কাল দেখলাম নতুনটা। শেষে যথারীতি
আগেরবারের মতোই মনখারাপ হয়ে গেল। ‘গ্যাটস বি’-র চরিত্রটার সঙ্গে কোথাও হিটক্লিফের
চরিত্রের একটা মিল আছে। গল্পটা যদিও পুরোই আলাদা। গ্যাটস বি-র গল্পের মূল থিম একজন
নিজে একেবারেই পছন্দ করে না অথচ নিয়মিতই পার্টি দেয় শুধুমাত্র যে মেয়েটাকে
ভালোবাসে সে যদি কোনোদিন সেই পার্টিতে আসে তারজন্য। গ্যাটস বি-র চরিত্রটাও ভীষণ
প্যাশনেট। ভালোবাসা হিস্টিরিক ধরণের। দুটো উপন্যাসেই আরেকটা মিল আছে – প্যাশনেট চরিত্রটি
কষ্ট পাচ্ছে। ওয়াদারিং হাইটস-এ ক্যাথরিন মারা যায় অসুখে, কিন্তু হিটক্লিফ
ক্যাথরিনের মৃত্যুর জন্য অথবা তার দুর্ভাগ্যের জন্য কিছু মানুষের ওপর প্রতিশোধ নেয়
যা প্রায় পাগলামী তুল্য। অন্যদিকে গ্যাটস বি-কে বিপদে ফেলে চলে যায় ডেইজি। খুন হয়
গ্যাটসবি।
পাঠ্য হিসেবে দুটো উপন্যাসেই সমকালীন পরিস্থিতি, চরিত্র চিত্রণ ইত্যাদি করতে হয়েছে। কিন্তু স্রেফ পাঠক হিসেবে এই দুই চরিত্র আমাকে ভীষণ নাড়া দেয়। সমাজের চোখে কালো চামড়ার অশিক্ষিত রাগী ক্ষমাহীন প্রতিশোধস্পৃহ হিটক্লিফ এবং উচ্চাকাঙ্খি ঠগ গ্যাটস বি উভয়েই কিন্তু মানুষ হিসেবে অসম্ভব ভালো। অথচ সেই ভালো মানুষটাকে সমাজ কোনো সুযোগ বা স্বীকৃতি দেয়নি, শুধু ঘৃণা করেছে, সমালোচনা করেছে।
আমার খুব প্রিয় দুই চরিত্র, হয়ত বা প্রিয় দুই মানুষ।
No comments:
Post a Comment