Monday, November 16, 2015

একটুকরো ছেলেবেলা

ধর্ম, রাজনীতি এসব প্রসঙ্গ এলেই খুব ছোটবেলার কথা মনে পড়ে আমার, নানান টুকরো ঘটনা। ছোটবেলায় প্রতি বৃহস্পতিবার আমি লক্ষ্মীপুজো করতাম। আমার শিশুমনের আকর্ষণ ছিল পাঁচালীর গল্প আর প্রসাদ। আসলে ছোট থেকেই হাতের কাছে যে বই পাই বুভুক্ষুর মতো পড়ি। তাই পাঁচালিই সই। সব গল্পই পড়া, কয়েকটা আবার বেশি পছন্দ। মাস, তারিখ মিলুক ছাই না মিলুক সেগুলোই বার বার পড়া চাই। কিছুদিন পরে অবশ্য এই হুজুগ কেটে গেল। ক্লাস ফাইভ সিক্সে পড়তে দাদা বলল, ভগবান নেই। ব্যস, আমার ভগবানের সেখানেই ইতি হয়ে গেল, দাদা সব জানে। দাদা স্কুল বা বাইরে থেকে তখন যা শেখে সেই জ্ঞান বোনের ওপর প্রয়োগ করে। মাঝে একবার বাবার মাথায় ঢুকল শিব প্রতিষ্ঠা করবে, সে কী হইহই কাণ্ড বাড়িতে! আমরাও পরম উত্তেজিত এবং মা পরম বিরক্ত। কারণ বাবার যাবতীয় হুজুগের ঝামেলা মাকেই পোহাতে হত। তা দিনকয়েক দুধে-বেলপাতায় শ্বাসরূদ্ধ হওয়ার পর বাবার উৎসাহ শেষ হয়ে গেল, শিব পড়ল মায়ের ঘাড়ে। তখন ফেলতেও পারি না, গিলতেও পারি না গোছের দশা। কিছুদিন মায়ের হাতের জল পেয়ে শেষে তাকের ওপরে উঠে গেলেন শুকনো শিব। ইতিমধ্যে বাবার সখে ব্ল্যাকি নামক কুকুরের আগমন এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে মায়ের দায়িত্বে আসা। আমাদের ছোটবেলায় মায়ের একটা পেটেন্ট বকুনি ছিল, ‘সেই কুকুর থেকে ঠাকুর সবই তো আমার ঘাড়ে পড়বে, তাহলে এসব আনা কেন বাপু? আমি আর পারি না’। তারপর অনেকদিন বেশ শান্তিতেই ছিল বাবা মাছধরা আর বাগান করায় যতটা মাকে জ্বালানো যায় আর কী। যেমন নেই ফ্রিজের যুগে রাত ন’টার সময় ধপাস করে কতগুলো ধরে আনা মাছ নামিয়ে রাখা। তখন কারেন্টও নেই, লন্ঠনের আলোয় সেই মাছ ঘচাঘচ কাটা হচ্ছে আর কাটতে কাটতে মা রাগে গরগর করছে। আমি তখন বোধহয় ইলেভেন কী টুয়েলভে পড়ি, বাবার মাথায় ঢুকল সরস্বতী পুজো করবে। ব্যস, আবার হইহই কাণ্ড পুরুত-টুরুত ডেকে। তখন মা গান শেখাতো তাই ছাত্রছাত্রীরাও হাজির। পরের বছরই বাবার উৎসাহ নিভে গেছে। সেবারে আমি না দাদা কে যেন পুরুতের কাজ করেছিলাম। সরস্বতীর সঙ্গেই আমাদের পুজো ঠাকুর  ইতি ঘটে।

বাবা আর মায়ের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে নিত্য তর্কাতর্কি হামেশাই শুনতে পেতাম। মায়ের কাছে তখন মায়ের দামাল ছেলেবেলা থেকে সত্তরের দশকে পার্টি করার নানান গল্প শুনে বেশ উদ্বুদ্ধ আমি। মায়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাশাপাশি ‘হেই সামালো ধান হো’, ‘জন হেনরী’, ‘উই শ্যাল ওভারকাম’, ‘ক্যালকাটা ইউথ কয়ার’-এর গান গাইতে রোমাঞ্চ হত। ঠিক যেমন রোমাঞ্চ হত পনেরোই আগস্টে স্কুলে পতাকা উঠলে বা ‘ভারত আমার ভারতবর্ষ’ গানে গলা মেলালে। সত্তরের নানা গল্পে অনায়াসেই মিশে যেত মায়ের প্রথম শ্বশুরবাড়ির যৌথ পরিবারের কাহিনিও। গল্পের টানেই আমরা বিভোর। আনন্দদাদা মায়ের বন্ধুর ছেলে থেকে ক্রমে আমাদের দাদা হয়ে ওঠে সেভাবেই। সেইসময় অনেক কংগ্রেসীরা বাবার সঙ্গে আড্ডা দিতে আসত। তারা কংগ্রেসী বোঝার মত বড় হইনি, মায়ের গজগজ মনে আছে – আমি ‘কংগ্রেসী চা’ করতে পারব না। যেমন আগের শ্বশুরবাড়িতে অনেক নানাবয়সী ছেলেমেয়েরা আসত, আর মাকে প্রায়ই তাদের জন্য ‘বিপ্লবী রুটি’ বানাতে হত। সুনীল, শক্তিদের কথা, মানে তখনও খ্যাত নয় কেউই, কাকা বা সন্তোষ রানা, জয়শ্রী রানা এদের সকলের কথা মায়ের মুখেই শুনেছি। বাবা এসব গল্প একদম করত না। এক জ্যোতি বসুর কিছু কথা বাবার কাছে কখনও শুনেছি। তবে মায়ের কলেজ লাইফে দেবেশ মামা বা অমিতাভ কাকা এদের সঙ্গে আড্ডা মারা, পার্টির গল্প এগুলো মায়ের বেশি প্রিয় এখনও।

এর পাশাপাশি ছিল মায়ের গান সাধনা। সংসারের সব কাজ একা হাতে সেরে একটু বেলায় বসত, একেকদিন বিকেল চারটে-পাঁচটা পর্যন্ত চলত। খাওয়া তারও পরে। মা অল্প যেকদিন চাকরি করতে পেরেছিল, তখন আমার ছিল পোয়া বারো। চেয়ার কিম্বা মোড়ায় উঠে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ‘দেশ’ পড়া। তখন সমরেশ বসুর ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’ একে একে বেরোচ্ছে। আর বাবা মায়ের ঝগড়া হলেই ছাদে পালিয়ে যাওয়া। আর গাছেদের সঙ্গে বকবক কিম্বা রাতে আকাশের তারা দেখা। ইতিমধ্যে বিভূতি, বঙ্কিম, রবি ঠাকুর থেকে চেকভ, দস্তাভয়স্কি, মোঁপাসা থেকে কাগজের ঠোঙা যা পাওয়া যায়। ওদিকে দেশ পড়া বারন, এদিকে ‘ন হন্যতে’ পড়তে পেলাম ক্লাস সেভেনেই। মায়ের লেখালেখিও শুরু হয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই উনুনের মধ্যে পুড়ছে উপন্যাস আবার মাছের ঝোল চাপিয়ে চলছে লেখাও। ‘আমাকে কেউ ইঁট চাপা দিলে আমি ইঁট ফুঁড়ে বেরোব’ – এটাও মায়ের পেটেন্ট ডায়লগ। মায়ের যেটা সবচেয়ে ভালো ছিল, একা কাউকে বকত না, আমাদের তিনজনকে একসঙ্গে বকত, একেকসময় এটা চলত প্রায় মাঝ রাত্তির অবধি। সবার আগে ঘুমাত বাবা, মানে বিছানায় পড়া মাত্র। দাদাও খানিকটা সিনসিয়ারলি শুনে ঘুমিয়ে পড়ত, আর আমি এক্কেবারে শেষ পর্যন্ত। অনেকবার পরেরদিন সকালে কাল রাতে পুরো বকুনি একা শোনার জন্য আমাকে কিছু দিতে হবে এই দাবী জানাতাম। কম পাজি তো ছিলাম না। মায়ের আরেকটা ব্যাপার ছিল, কক্ষনো মিথ্যা বলত না, আর কেউ যদি ভুল করেও মা কে মিথ্যাবাদী বলেছে, তাও হয়তো সরাসরি নয়, অসম্ভব ক্ষেপে যেত।

ছ’-সাত বছর বয়স থেকে অনেক বড় পর্যন্ত আমার প্রিয় বই ছিল কাশীদাসী মহাভারত। পরে এই জায়গাটা দখল করে বিভূতিভূষণ আর গীতবিতান এবং আরও পরে রাণী চন্দের ভ্রমণ কাহিনি। আমি তখন একা একা ধানক্ষেতে ঘুরে বেড়াই। সাত-আট বছর বয়সেই মা হাতে ধরে দিয়েছিল ডায়েরি আর কলম, সেই লেখালেখির প্রতি ভালোবাসার শুরু। এখনও মায়ের পরে এটাই আমার সবথেকে বড় ভালোবাসা আর আশ্রয়ের জায়গা। অবশ্যই গীতবিতানও আছে। আসলে বই বা কলম এমন বন্ধু, অনেকটা মায়ের মত, তুমি যাই কর, তোমায় প্রশ্রয় দেবে, আড়াল করবে, ভালোবাসবে।

আমার মা এখন সাদা চুলে সামান্য ভারী চেহারায় দুই নাতনীর প্রিয় দিদিমা, ঠাকুমা, যে কীনা ওয়ান ডি-র গান থেকে ফ্রেঞ্চ শেখা সবেতেই সতেরো বছরের বড় নাতনীর সঙ্গে তাল মেলায় আর ডিভাইন কমেডি-র বাংলা অনুবাদ আর উপন্যাস লেখার ফাঁকে ছ’ বছরের ছোট নাতনীকে তাল দেয়। এই তো কয়েকদিন আগে, আর ঘুড়ি ওড়াতে পারি না, তাও চেষ্টা করলে এখনও পারতে পারি, তোদের কারোর উৎসাহ নেই, এই বলে দুঃখ করছিল। ওরে বাবা মায়ের ঘুড়ি ওড়ানো – সে আরেক গপ্প!


আমার কেবল মাঝে মাঝে আমার ভীষণ রোগা, ঊড়ণচণ্ডি, গাছে চড়া, বৃষ্টিতে ভেজা, হলুদ আঁচলের ছেলেমানুষ মা টার জন্য খুব মনকেমন করে।

No comments:

Post a Comment