Thursday, December 31, 2015

ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা

আগেও লিখেছি, পথেঘাটে মাঝে মধ্যেই ঈশ্বরের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়ে থাকে। গতকালও হয়েছিল - কলকাতা শহরে যে বেশে তাকে পাওয়া সবচেয়ে দূর্লভ, অর্থাৎ কিনা ট্যাক্সিচালক। অশোক সেন-এর স্মরণসভা থেকে ফিরে মা-কে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ফিরছিলাম। রাত দশটা বেজে গেছে। ওই রাস্তায় অত রাতে বাস বন্ধ হয়ে যায়। অন্য কেউ হলে থেকেই যেত হয়ত। কিন্তু যতক্ষণ আমার পদযূগল আছে ততক্ষণ আমি ও নিয়ে বিশেষ চিন্তা করি না। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে অটো বা রিক্সা কিচ্ছু না পেয়ে হাঁটা দিলাম। একটা স্টপেজ মতো হেঁটেও ফেললাম। এর আগে আমাকে স্টপেজে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক স্কুটারচালক হাসি হাসি মুখে এগিয়ে এসে বলেছিলেন, 'এখন তো বাস পাবেন না'। মনে হল ভদ্রলোকের হয়তো মনে হয়েছিল আমাকে কিছুটা এগিয়ে দেওয়ার কথা, কিন্তু মুখ ফুটে ঠিক বলতে পারলেন না। যাইহোক, হঠাৎ একটা হলুদ ট্যাক্সি থামল ঘ্যাঁচ করে - 'যাবেন নাকি?' দেড়শো টাকা চাইল। আমার মনঃপুত হল না। আরে বাবা, ভি আই পি কী নিদেন পক্ষে চিনার পার্ক পৌঁছাতে পারলেও কিছু না কিছু পেয়েই যাব। বলি, নাহ্‌, যাব না। আবার হাঁটা দিই। এবারে একটা সাদা গাড়ি এসে দাঁড়াল, সেটা ট্যাক্সি বা এমনি গাড়ি ঠিক বলতে পারব না। একশ টাকা চাইতে উঠে বসলাম। জয়া সিনেমার-র কাছে নামিয়ে দিয়ে গেল। বাড়ি ফিরে বললাম, দেখলে তো কেমন চলে এলাম, মিছিমিছিই চিন্তা করছিলে। মনে মনে ভাবি, রাখে কেষ্ট, হাঁটে কে?

অনেকদিন আগে, কালান্তরে চাকরি করার সময় একদিন পার্কসার্কাস থেকে এক ভদ্রলোক আমাকে অমনিই পৌঁছে দিয়েছিলেন। আমি অন্যান্য রানিং গাড়ি যেগুলো যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়, তেমন ভেবে হাত দেখিয়েছিলাম। সেই ভদ্রলোকও গাড়ি থামিয়ে কেবলমাত্র আমাকে তুলে নিয়েই আবার রওনা দিলেন। অর্ধেক রাস্তা উনি গাড়ি চালাতে চালাতে মোবাইলে কথা বলে গেলেন আর আমি পিছনে বসে আক্রমণ করলে জলের বোতল না ছাতা কোনটা আত্মরক্ষার জন্য বেটার হবে ভেবে গেলাম। আর বাকি অর্ধেক রাস্তা আমার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন দূরবস্থা নিয়ে গম্ভীর আলোচনা করে গেলেন। ভদ্রলোক প্রবাসী বাঙালি, কয়েকদিনের জন্য এসেছেন। নামার সময় ভাড়া দিতে গেলে বললেন, কী মুশকিল, আমি তো এপথেই যাচ্ছিলাম, আপনার জন্য আমার তো বাড়তি কোনো তেল পোড়েনি। অকাট্য যুক্তি। আমিও আর কথা বাড়াই নি।

এই গল্পটা হয়ত আগেও করেছি। আসলে কিছু কিছু অভিজ্ঞতা, কিছু কিছু মানুষের কথা ফিরে ফিরে আসে মনে। ঈশ্বরের দেখা পাওয়া, তাও গাড়ি সমেত, কলকাতা শহরে, সে কি সোজা কথা?


‘তাই হেরি তায় যেথায় সেথায় তাকাই আমি...’।

Wednesday, December 30, 2015

আমার পাড়া

বামফ্রন্ট ভালো হোক বা মন্দ, অন্ততঃ বামফ্রন্টের একটা আদর্শের মোড়ক আছে। যার জন্য খুব নীচু তলা ছাড়া সাধারণতঃ খারাপ হওয়াটা দেখাতে পারে না। মানে তথাকথিত খারাপের সঙ্গে একটা আদর্শগত বিরোধ আছে তাদের। যেমন, আমাদের এই পাড়ার লোকজন যতদিন বামফ্রন্ট ক্ষমতায় ছিল ততোদিন বামপন্থী ছিল, এখন তৃণমূলপন্থী। এটা তাদের আচার-ব্যবহারের পরিবর্তনের মধ্যেই বেশ বোঝা যায়।

যখন ২০০৭ সালে এখানে আসি তখন জায়গাটার কলোনী রূপ বা পাড়া পাড়া ভাবটা বেশ লাগত। একটু আপন আপন ভাব। যেন ঠিক কলকাতা নয়। বরং পরিচিতরা কেউ কেউ বলেছিল, যে এমন একটা জায়গায় কিনলে কেন, ফ্ল্যাটের গায়েই টালির চালের বাড়ি? আমরা বলেছিলাম, একটু কমেও পাওয়া গেছে, আর তাতে ক্ষতিই বা কী? আর এখন ২০১৫-১৬ তে মনে হয় যেন বস্তিতে বাস করছি। ইতিমধ্যে পাড়ার চেকনাই বেড়েছে - টালির চালের বাড়ি ভেঙে পাকাবাড়ি উঠেছে, আর পাকাবাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাটবাড়ি। এই তো রাস্তা পাকা হচ্ছে। কিন্তু কলতলার আড্ডা বাড়ছে দিন দিন।রাত-বিরেতে কুকুরের অবিশ্রান্ত ডাকের মতোই বাড়ছে রাস্তায় খিস্তি-খেউড় আর চেঁচামেচি।

আসলে এতবছরে শিক্ষিত মানুষের হার বাড়েনি পশ্চিমবঙ্গে। এইটাই সবচেয়ে খারাপ দিক বলে আমার মনে হয়েছে। তার ফলই এই সম্পূর্ণ অশিক্ষিতে পরিবর্তন।


রাস্তার মোড়ে মস্ত ঘড়ি থুড়ি বিগ বেন, এসি বাসস্ট্যান্ড - লেকটাউনের লন্ডন হতে আর খুব বেশি বাকি নেই। আঁচ তো পড়বেই প্রতিবেশি পাতিপুকুরের গলিতে। লন্ডনের বস্তিতেও শুনেছি ইংরেজিতে খিস্তি শোনা যায়। এপাড়া সবচেয়ে আগে সেইটুকু শিখে নেবে ঠিক।

তবে কেন পায় না বিচার নিহত গোলাপ?

জানিস, আমাদের ফ্ল্যাটের সামনের রাস্তা পাকা হচ্ছে। রাস্তার ওপারে যে পেয়ারা গাছটায় একদিন একটা ছেঁড়া ঘুড়ি লটকে ছিল, আর বারান্দা থেকে দেখে আমি দু-লাইন লিখেছিলাম, সেই গাছটা কাটার আওয়াজ পাচ্ছি। মনে হচ্ছে আমার বুকের মধ্যেই ঠক ঠক করে আঘাতগুলো লাগছে। এই মুহূর্তে একটি বৃক্ষের হত্যাকাণ্ড ঘটছে, অথচ আমরা কেউ কিচ্ছু বলছি না। অসহায় গাছটা মরমর শব্দে নুয়ে পড়ছে ক্রমশঃ। পাড়ার লোকে পেয়ারার আফশোস করছে, ওদিকে গাছটা ভেঙে পড়ছে টুকরো টুকরো হয়ে।

রাস্তা সারাই হচ্ছে, ভালোই তো। উন্নয়ণ হচ্ছে বুঝলি, সব আমাদের জন্য। এমন উন্নয়ণে ক'টা পাঁঠা থুড়ি গাছ বলি হবে এ আর নতুন কথা কি?

ভি আই পি-র ফ্লাই ওভার হওয়ার সময় কত গাছকে বিষ দিয়ে মেরেছিল। এ তো একটিমাত্র বৃক্ষ!

মনটা খারাপ হয়ে গেল।

Tuesday, December 29, 2015

এত সুর আর এত গান

আমাদের ছোটবেলায় রবিবার সকালে পুরোনো হিন্দি সিনেমার গানের একটা চমৎকার অনুষ্ঠান হত, আর রেডিওতে পুরোনো বাংলা গান শোনার জন্য ছিল ‘অনুরোধের আসর’। নাহ্‌, এই দুটোর কোনোটাই আমার দেখার বা শোনার অনুমতি ছিল না। বাড়িতে প্রচুর ক্যাসেট ছিল, যার অধিকাংশ রবীন্দ্রসঙ্গীত, এছাড়া ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ভূপেন হাজারিকা, বেগম আখতার, ভীমসেন যোশী, বিঠোফেন এইরকম নানা জাতের সঙ্গীত। কিন্তু আধুনিক হিন্দি এবং বাংলা গানের অনুপ্রবেশ ছিল একান্ত নিষিদ্ধ। কী করে একটু বড় হওয়ার পর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সেখানে স্থান পেয়েছিলেন সে রহস্য আমার আজও জানা নেই। একবার হিন্দি সিনেমা ‘মধুমতী’-র ক্যাসেট এনেছিল খোদ বাবা-ই। কিন্তু শুনতে দেবে না। এই নিয়ে রাগারাগিতে বেচারা ক্যাসেটটাই গেল ভেঙে। হিন্দি সিনেমা এবং হিন্দি গান তো একেবারে কানে ঢোকানোই বারন। ওদিকে বাবা না থাকলেই চলে মায়ের গানের সাধনা। ক্ল্যাসিকাল, রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাশাপাশি হিন্দি ও বাংলা আধুনিক গান। অতএব বাবার চোখ রাঙানো নিষেধ সত্ত্বেও তালাত মামুদ, লতা, আশা, গীতা দত্ত, হেমন্ত, কিশোর, রফি সবার গান আমার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। অসুখ তো লেগেই থাকত। আর অসুখ করলে মা-ই আমার সেই ঠাকুরদাদা। ক্রৌঞ্চ দ্বীপের গল্প বলা থেকে গান শোনানো সব। জ্বর হলে আমার খুব প্রিয় ছিল তালাত মামুদের গান শুনতে শুনতে ঘুমোনো। এই ঘুম পাড়ানোর তালিকায় সুবীর সেনের বেশ কিছু গানও ছিল। তবে সুবীর সেনের গানের মধ্যে মা সবচেয়ে বেশি গাইত, ‘ওই উজ্জ্বল দিন ডাকে স্বপ্ন রঙিন’ – আর অমনি আমার মনমরা দিনটা কেমন ঝলমলে হয়ে উঠত। এদের নিজেদের গলায় সব গানই আমি শুনেছি, তবে বহু পরে। এমন অসাধারণ সব গান কেন যে বাবার ভালোলাগত না কে জানে! এখন যে গানই শুনি, মনে মনে শুনতে পাই আমার তরুণী মায়ের কন্ঠস্বর। ছেলেবেলা ফিরে আসে তখনি। এখনও অসুখ করলে মনে মনে বলি, মা ওই গানটা গাও না, ওই যে, ‘রাত হল নিঝুম, ফুলের দুচোখে ঘুম, চাঁদ ওই জেগে রয়, হাওয়া শুধু কথা কয়’। মাথার বালিশের পাশে মোবাইলে সুবীর সেন বাজে। আসলে তো মা গান গায়, রাতের পর রাত জেগে।

গ্যাস দেবেন ঘনাদা?

ভাবছিলাম, প্রেমেন মিত্তিরের ঘনাদা কই গেলেন? আগে তেল দিতেন, এবার সত্যি সত্যি গ্যাস দিতে তাঁকে ডাকা ছাড়া উপায় নেই। কী ভাগ্যিস কেরানীর সংসার, তাই এখনও ভর্তুকি মিলবে। ওই যে সরকারের মন্ত্রী-আমলারা যাঁদের হিসেবের রোজগার অনেক, বেহিসেবের কথা নাহয় বাদই দিলাম, তাদের যে বাড়ি ফ্রি, গাড়ি ফ্রি, টেলিফোন ফ্রি, ইন্টারনেট পরিষেবা ফ্রি, দেশ-বিদেশ ভ্রমণ থুড়ি কূটনৈতিক যাত্রা ফ্রি...তারা নাহয় ভর্তুকি ফ্রি হলেন। কিন্তু আমরা যারা সারাজীবনে দু-একটা প্লাস্টিকের থালা-বাটি ছাড়া কিচ্ছু ফ্রি পাইনা এবং ওটাও আসলে ফ্রি নয়, মূল জিনিসটার দাম বাড়িয়ে ধরা, তাদের কাছে রান্নার গ্যাস অধরা হলে ভারী মুশকিল। আমাদের তো গ্যাস ব্যবহার কমালে ইলেকট্রিকের বিল বেড়ে যায়। সেই যে ছোটবেলায় বাড়িতে কিছু না থাকলে মা খুব রেগে গেলে বলত, আমি কি হাত-পা পুড়িয়ে রান্না করব? সেই ‘অচ্ছে দিন’ এবার সত্যি সত্যি আসছে।

Sunday, December 27, 2015

টুকরো ভাবনা

তেরো পার্বণ

দর্শনার্থীদের বলছি, আপনারা রাস্তার মাঝখানে ভিড় করবেন না, একে একে দেখুন, সকলকে দেখার সুযোগ দিন। বাচ্চাদের হাত ছাড়বেন না, ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারে।
নাহ্‌, কলকাতার কোনো নামী দুর্গাপুজোর মণ্ডপ নয়, যিশুর জন্মদিনে পার্কস্ট্রিটের রাস্তায় ঘোষণা।

কতরকম ফ্রি আছে

আসলের থেকে ‘ফ্রি’-এর কদর চিরকাল বেশি। সে একটা কাচের বাটি হোক কী প্লাস্টিকের প্লেট। রাস্তায় হঠাৎ চোখ পড়ল একটা মেগা ক্যাবের দিকে – লেখা রয়েছে, প্রত্যেক রাইডের সঙ্গে ৫ কিমি ফ্রি।
এটা বোধহয় চলতে চলতে পাওয়া...।


ব্রিগেডে মিটিং হবে!

বাইরে এখন হাজার হাজার লাল পতাকা – বাড়ি থেকে বেরিয়ে লেকটাউনের মোড় পর্যন্ত পৌঁছাতেই অনেকদিন পর এটা চোখে পড়ল। কয়েকদিন ধরে সুমনের গানের কয়েকটা লাইন খালি মাথায় ঘুরছে – ব্রিগেডে মিটিং শেষ ফুরোয় না সংকট...কী করে বাঁচবে লোকে কেউ যদি বলে দিত...

কেউ যদি বলে দিত...

কেউ যদি বলে দিত...

পতাকার রঙ শুধু বদলে যায়। বদলায় না মানুষের সংকট।

ওদিকে সুমন গেয়ে যান – তুমি গান গাইলে, কিছুই হলনা, যা ছিল আগের মতো রয়ে গেল...


তবু গাইলেন, থেমে গেলেন না, গান তো গাইতেই হয়, গেয়ে যেতে হয় কাউকে না কাউকে চিরকাল...।

Tuesday, December 22, 2015

এমন কেন সত্যি হল না আহা!

গতকাল বাড়িতে তিনজনে মিলে কী যেন সব আলোচনা করছিলাম, তারমধ্যে ভারতভাগও একটা বিষয় ছিল। তার থেকে একটা কথা মাথায় ঘুরছে, যেটা মেয়েকে বলছিল তার বাবা – ভারত যদি ভাগ না হত তাহলে পৃথিবীর মধ্যে একটা অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র হত। প্রতিবেশীদের মধ্যে বড় শক্তি বলতে এক চিনের সঙ্গে সদ্‌ভাব রাখলেই চলত। ভারত এবং পাকিস্তানের একটা বিরাট অর্থ অপচয় হয় পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষায়। সেই টাকায় দেশের অনেক উন্নতি হতে পারত। তারপর থেকে কেবলই ভেবে যাচ্ছি, এমন কেন সত্যি হল না আহা!

তাহলে এই যে হিন্দু মৌলবাদীরা মুসলিম বিরোধী এবং মুসলিম মৌলবাদীরা হিন্দু বিরোধী সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে তার বদলে কেমন শান্তিতে থাকা যেত। মানুষকে মানুষ বলে, ভাইকে ভাই বলেই মনে করতে পারত।

অথচ, এমনটা কখনই হতে দিত না পশ্চিমী সভ্যতা। এত বড় একটা শক্তিকে কিছুতেই বিভেদ শূন্যভাবে বাঁচতে দিত না। এত বড় একটা বাজার কিছুতেই হাতছাড়া করত না।

আর আমরা তো অন্ধ হয়ে থাকতেই ভালোবাসি আর নিজেদের দোষ ধরে মারামারি করতে। ভাবি কবে মূষলপর্ব শুরু হবে?


অথচ এখনও আমরা পারি কিন্তু, আমরাই পারি, নিজেদের শুধু মানুষ ভাবতে।

লালন বলে জেতের কী রূপ দেখলেম না এই নজরে...

মায়ের কাছে আমন্ত্রণ এসেছিল বাংলায় বর্তমান বাউল-ফকির গোষ্ঠীকে সসম্মানে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যিনি প্রায় নিঃশব্দে লড়ে যাচ্ছেন, সেই শক্তিনাথ ঝা-এর কাছ থেকে, বাউল-ফকির সম্মেলনে যাওয়ার জন্য। এদের নিয়ে আমার পড়াশোনা একেবারে শূন্য, মানে সব দাদা জানে আর কী। দুই ভাই-বোনে মা-কে নিয়ে যাব ওইটেই তো মজা। আর বাকি সব উপরি পাওনা।

শক্তিবাবুর এবং অন্য কয়েকজন বক্তার কিছু কথা বেশ লাগল। মনে যে ছায়া রয়ে গেল তার থেকেই লিখছি। বাউল এবং ফকির এই দুই গোষ্ঠীকে আমরা সাধারণত আলাদা বলেই ধরে নিই। অর্থাৎ কী না বাউল হল হিন্দু এবং ফকির মানে মুসলমান। অথচ বাউল-ফকিরদের জীবন এবং যাপনের মূল কথা কিন্তু মানুষ এবং ভালোবাসা। যে সব কিছু ত্যাগ করেছে, সেই হল ফকির। লালন যেমন নিজেকে বিভিন্ন জায়গায় ফকির বলে উল্লেখ করেছেন। ফলে যারা কার্যক্ষেত্রে নিজেকে বাউল বা ফকির যে কোনো একটা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে কিছু সুবিধা পেতে চান, তারা আসলে কোনোটাই নন। জাতিভেদ, ধর্মভেদ এই সবের বিরুদ্ধেই এই বাউল-ফকির আন্দোলন। যা আজকের পরিপ্রেক্ষিতে আরও-ই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

শক্তিবাবু বললেন, তাঁদের সামর্থ্য কম, রান্নার আয়োজন সামান্য। রান্না করেছেন ওখানকারই এক গ্রামের মানুষজন। মুসলিম এই গ্রামের মানুষেরা বংশানুক্রমে নিরামিষ খান। মাছ, মাংস, ডিমের গন্ধ সহ্য করতে পারেন না। অথচ অনেক বৈষ্ণব আছেন যাঁরা গান শুনতে এসে এঁদের হাতে রান্না বলে খান না।

আরেক জনের একটা কথাও বেশ লাগল। তিনি বললেন, বাউল বা ফকির আসলে একটা জীবন-যাপন।

গান তো কত জনেই গাইল। যে গানটা সবচেয়ে প্রাণে গেল সেটা যিনি গাইলেন তিনি আপাত বাউল-ফকির নন, কলকাতা থেকে গিয়েছিলেন ভদ্রমহিলা, লেখালেখি করেন, গানটা তাঁর নিজেরই লেখা। নিজেকে খোঁজার কথা বললেন তাঁর গানে।


যাঁরা এই বাউল-ফকির গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছেন তাঁরা কতটা সেইভাবে আত্মস্থ করেছেন বা ভাবেন তাতে সন্দেহ আছে। তবু তাঁদের হাত ধরেই বয়ে চলুক মানুষ হয়ে ওঠার চেষ্টার এই গানের এবং প্রাণের পরম্পরা। ধর্ম এবং সন্ত্রাসের দিনে কিছু মানুষ তবু ভালোবাসার কথা শোনাক।

সংশোধনাগার

আমি সততই মৃত্যুদণ্ড বিরোধী। কারণ যে কেউ এমন কী রাষ্ট্রও কাউকে হত্যা করতে পারে এমনটা আমি মনে করি না। মৃত্যুদণ্ড একটি দোষী অথবা নির্দোষ মানুষের প্রাণ নিলেও মূল সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারে না। এমন কী সমস্যাটাকে কমাতেও পারে না। খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি যে সমস্ত অপরাধের বিচারে অনেকসময় মৃত্যুদণ্ড হয়ে থাকে সেই সমস্যাগুলো মোটামুটি রক্তবীজের ঝাড়ের মতন। কোনো দৃষ্টান্তেই তা পালটে যাওয়ার নয়। আসলে পালটাতে হবে মানসিকতা। মানুষের মধ্যে অন্যের প্রতি অত্যাচারের যে মানসিকতা তা আসে আর্থ-সামাজিক এবং নৈতিক অবদমনের থেকে। এর শিকার হয় তুলনায় যে কম শক্তিশালী – সাধারণত নারী এবং শিশু। যে অত্যাচার মিডিয়ায় আসে তা চর্চিত হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে শাস্তি হয় বা হয় না। কিন্তু এর চেয়ে অনেক বৃহত্তররূপে অত্যাচারের ধারাবাহিক ইতিহাস মানব সমাজে রয়েছে, যা আলোচিত নয় অথবা আড়াল করে রাখা হয়। দু’এক জনকে মেরে ফেলাটা এই সমস্যার কোনো সমাধান নয়। এমন কী ওই মেরে ফেলার ভেতর দিয়ে আমরা যারা কোনভাবেই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নই, যে তৃপ্তি পাচ্ছি, তাও ওই অবদমনের বহিঃপ্রকাশ কিনা তা ভাবার আছে। আসলে আমরা যতটা সরল অঙ্ক কষে কোনো ব্যাপার আপাত মিটিয়ে ফেলতে চাই, বিষয়টা ততটা সরলও নয়, আর মিটিয়ে ফেলারও নয়। সমস্যার মূল নিয়ে না ভাবলে বা সমাধানের চেষ্টা না করলে চিরকাল কোনো কোনো ধনঞ্জয় সত্যি সত্যি খুন এবং ধর্ষণ করে ফাঁসি যাবে, কোনো কোনো ধনঞ্জয় এর কোনোটাই না করেও ফাঁসি যাবে, আবার কোনো কোনো ধনঞ্জয় দুটো করেই ফাঁসি যাবে না। এর যেকোনোটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঘটতে থাকবে। অর্থাৎ ধর্ষণ, খুন এবং রাষ্ট্র কর্তৃক বিপরীত খুন এই প্রথা চলতে থাকবে। কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে না কোথাও। আমার মনে হয় এই কোনোমতে সমাধান না করে বিষয়টা নিয়ে সোসিও-সাইকোলজিকাল আসপেক্টে ভাবা এবং তা নিয়ে বড় আকারে কাজ করাটা ক্রমশঃ ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছে। সবার জন্যই সংশোধনাগার দরকার। এমন কী আমাদের জন্যও।

শান্তিতে খাওয়া

নাহ্‌, শান্তিতে খাওয়া আমার কপালে লেখা নেই। আগে যে ঘরটায় ডাইনিং টেবিল ছিল, তার জানলার ঠিক ধারেই পাশের বাড়ির টিনের চাল। খেতে বসলেই ওখানে একটা কাক পায়চারি করত আর তাগাদা দিত নিত্যই। টিনের চালে ওর পদধ্বনির আওয়াজে মাঝে মাঝেই মাথার মধ্যে রি রি করত। যেমন – ঠক্ ঠক্‌ ঠক্‌ ঠক্‌ কা কা, ঠক্‌ ঠক্‌ ঠক্‌ ঠক্‌ ঠক্‌ কা কা কা... ইত্যাদি। অসম্ভব রেগে চিৎকার করে না উঠলে এটা খাওয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চলতেই থাকত। চিৎকার করলেও কিছুক্ষণ বাদে আবার আক্ষরিক অর্থেই উড়ে এসে জুড়ে বসত। খাওয়ার সময় কেউ যদি রোজ ক্রমাগত খা খা বলে তাগাদা মারে তাহলে মোটেও শান্তিতে খাওয়া যায় না।

আজ দুপুরে খেতে বসতে না বসতেই সেই অদৃশ্য বেড়ালের ম্যাও আর্তনাদ শুরু হল। সঙ্গে শঙ্করীদির কথোপকথন – তোর কি অফিসের তাড়া আছে নাকি? থাম থাম। কিন্তু ভবি থুড়ি বেড়াল ভুলবার নয়, তার স্বর ক্রমশঃ উচ্চ থেকে উচ্চে উঠতে থাকে – আমি কোনোমতে গবগবিয়ে খাই। তারপর ভাত মাখা চলে কাঁটাকুটি দিয়ে, দাঁড়া, দাঁড়া, উফফ্‌... বাচ্চারও অধম...। ওপর থেকে ভাতের দলা পড়ে, আওয়াজ থেমে যায়। কেউ একজন শান্তিতে খায় আর কী।


আমরাও শান্তি পাই।

Monday, December 21, 2015

ইয়ে তেরা ঘর ইয়ে মেরা ঘর, ইয়ে ঘর বহত হাসিন হ্যায়

গতকাল সকাল অবধি একটা ঘরে ছিলাম। আজ সকালে আরেকটা ঘরে ফিরলাম। ইংরেজিতে হোম শব্দটা যে নৈকট্যভাব বহন করে বাংলা ‘ঘর’ শব্দটা দিয়ে কি সেটা বোঝানো যায়? ভাবছিলাম। বাসা-র সঙ্গে আসলে ভালোবাসার একটা খাসা সম্বন্ধ আছে। গতকাল সকাল পর্যন্ত যে ঘরে অথবা বাসায় অথবা বাড়িতে ছিলাম সেখানে আজান, সুজান, ইন্দ্রনীল, এবং আরও আরও সকলের সঙ্গে একরাত্তির-সকাল গল্প-আড্ডা-ঘুমে কেটে গেল। রাতে আমাদের সকলের জন্য বারবার করে উঠে দরজা খোলা-বন্ধ করছিলেন নুরুল হুদা, বাড়িটি যাঁর। সকালবেলায় থালায় থালায় মুড়ি এল, গরম চা আর বিস্কুট। ভিড় সরতে মায়ের সঙ্গে ভাব জমাতে বাড়ির বউটি হাজির হল। মাকে তার বোনের বাড়ি বেড়াতে নিয়ে যাবে, এই ইচ্ছে। গাড়ি এসে গিয়েছিল, তাই রীতিমতো খিদে আর খাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও মাছের ঝোলভাতটা খাওয়া হলনা অনেক অনুরোধেও। ভাবছিলাম, ইস্‌, ঘন্টাখানেক আগে বলত যদি...। আগের রাত্তিরে মাঠে পাতা পেড়ে গরম ভাত-ডাল আর ঘ্যাঁট তরকারি দিব্য লাগল। গান কতটা প্রাণে গেল জানিনা, তবে মানুষ দেখলাম। ওইজন্যই তো ভ্রমণ – নিজেকে জানা আর অন্যকে দেখা। “আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না, এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা...”।

বাড়ি ফিরতেই শঙ্করীদির হাতের গরম পরটা আর গরমাগরম চা মিলল আর সেধে খাওয়ালো মিস্টি। ভারী খুশি মনে জানালো, ‘টিফিনের জন্য কালকে ভাইকে ফোন করে বললাম মিস্টি আনতে’। বাড়িতে না থাকলে আমি সাধারণত কী রান্না হবে, কী টিফিন হবে সব আগাম না-থাকার দিনগুলোর জন্য বলে রাখি। এবারে শঙ্করীদি বলল, তোমায় কিচ্ছু চিন্তা করতে হবে না। আর আমিও দিব্যি নিশ্চিন্তে চলে গেলাম। মাঝে একদিন কী কাজে নিজের ভাড়া বাড়ি যাওয়ার ছিল, তাও ভাই আর বুইয়ের অসুবিধা হবে বলে গেল না। আসলে মেয়েদের মধ্যে সংসার করার বা বাসা বাঁধার একটা সাধ বোধহয় রয়েই যায়। অল্পবয়সে স্বামী ছেড়ে চলে গেছে আর এখন ছেলে-মেয়েরা যোগাযোগ রাখে, আপদে-বিপদে আসে, ওই পর্যন্তই। তাতে আর যাই হোক সংসার করার সুখটা জমে না। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে সেই বাসা বাঁধার আনন্দ পেয়েছে হয়ত এখানেই। এইতো এক্ষুনি আমায় বলে গেল, দুধ এনেছে, পাটালি এনেছে, চাল এনেছে, পঁচিশে ডিসেম্বর পায়েস খাওয়াবে বলে, আমি যেন রাগ না করি। বললাম, কী মুশকিল, বিনা পরিশ্রমে গুড়ের পায়েস খেতে পাব, রাগ করব কোন দুঃখে!

ভালোই হয়েছে আমারও, স্বভাবতঃ ঊড়নচণ্ডী।

ওই রে, শঙ্করীদি বকুনি দিচ্ছে, খেয়ে আসি।


ইয়ে তেরা ঘর, ইয়ে মেরা ঘর, ইয়ে ঘর বহত হাসিন হ্যায়...

টুকরো লেখা

১) আগে প্যাসেঞ্জারদের গাড়ি থেকে নামতে দিন, তারপরে উঠবেন - নাহ্‌, এটা বাসের কন্ডাক্টরের উক্তি নয়, বহরমপুর কোর্ট স্টেশনের অ্যানাউন্সমেন্ট।

২) গান এবং ভালোবাসা দুটোর মধ্যে একটা মিল আছে, হৃদয় না ছুঁলে কোনোটাতেই পৌঁছানো যায় না। আসলে দুটোই তো যাত্রা। বাউল গানের মূলে আছে ভালোবাসা। অথচ গানে ক’জন তা ছুঁতে পারে? বাউল-ফকির উৎসবে গান শুনতে শুনতে দেখতে দেখতে ভাবছিলাম।
প্রাণের মানুষ প্রাণে না থাকলে তাকে কোথাও যে পাওয়া যায় না। আত্মার মধ্যে তাকে খুঁজতে ফিরতে হয় নিজের কাছেই।
গান আমাদের সেখানে পৌঁছে দিতে পারে। কিন্তু তেমন গান গাইতে পারে ক’জন? ক’জন পারে নিজের মধ্যে ফিরতে?

৩) চারদিকে নানা মানুষের নানা গবেষণার টুকরো কথা – কতটা কানে গেল আর কতটা প্রাণে সেইটা হল ভাববার।

৪) জলঙ্গীর এই জায়গাটার নাম মনসাতলা। চার কিলোমিটার মতো মাঠ আর ক্ষেত পেরোলেই পদ্মা। ওপারে বাংলাদেশ। সেই ওপারে আমার দেশের বাড়ি ছিল – মাঝে মাঝেই ‘কোমলগান্ধার’ মনে পড়ে আজকাল।


৫) চারদিকে সর্ষে ক্ষেত – দিকদিগন্ত আলো করে আছে। আজান-এর সঙ্গে গল্প করছিলাম ছাদে। হঠাৎ দেখি ওর সঙ্গিনী সুজান ন্যাড়া ছাদের পাড় থেকে উঠে আসছে। হাতে এক গুচ্ছ সর্ষেফুল। বিলিয়ে দিল আমাদের একটু একটু করে। কিন্তু কেমন করে ছাদ থেকে মাঠে গেল এবং ফিরে এল বুঝলাম না – পাইপ বেয়ে না গাছ! জিজ্ঞাসা করিনি। নেমে এসে ফুলটা  মাথায় গুঁজে নিলাম।

৬) খুব সাধারণ মানুষের মধ্যে গেলে বোঝা যায়, মানুষ মানুষকে স্বভাবগতভাবে ভালোবাসে। না-ভালোবাসা অথবা বিভেদ সমাজের দ্বারা আরোপিত। মূলতঃ এই বিভেদ সৃষ্টিই সাম্রাজ্যবাদের বেঁচে থাকার শক্তির উৎস। সে বিভেদ ধর্মীয় হোক অথবা জেন্ডার বিভাজন।
ওই রে আবার সাম্রাজ্যবাদ! পালাই বাবা।

Monday, December 14, 2015

দেড়শো বছর আগের শিক্ষিত নারীর বয়ানে ধর্ম – পুরুষতন্ত্র বাঙালি মেয়েকে ধর্ম মানতে বাধ্য করেছে তা ঐতিহাসিক সত্য

প্রথম পর্ব কবিতায় -

“দেখিনু পরেতে ওহে, সেই বিশ্বেশ্বর।
মন্দিরের মধ্যে আছে, কেবল প্রস্তর।।
দেখিতে না হয় ভাই, কিছু চমৎকার।
কেবল তাহাতে আছে, কাপট্য আচার।।
পুষ্পদন্ত কেদারেশ, আদি দেবগণ।
নাহি হয় তারা কেহ, নয়ন রঞ্জন।।
কেবল মুর্খেতে ওহে, ভক্তির কারণ।
সাক্ষাৎ ঈশ্বর যেন, করে দরশন।।”
-          
রমাসুন্দরী

আমার সঙ্গিনীগণ বেণীঘাটে যায়।
একে একে সকলেতে মস্তক মুড়ায়।।
নাপিতে ধরিয়ে কেশ মাথে দেয় ক্ষুর।
পৈরাগী দাড়ান কাছে সাক্ষাৎ অসুর।।
দেখিয়া ঘৃণিত কাজ অঙ্গ গেল জ্বলে।
আমাকে সকলে মাথা মুড়াইতে বলে।।
অনুরোধ নাহি রাখি না কহি বচন।
-          
লক্ষ্মীমণি দেবী

ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি এইসময়ের পুরুষ লেখকেরা তীর্থভ্রমণ লিখছেন। এবং এর আগে এবং পরেও। ঊনবিংশ শতকের পুরুষ ভ্রমণ লেখকদের একটা বড় অংশই লিখেছেন তীর্থ কাহিনি। তাতে ভ্রমণ কাহিনির রসেরও নিতান্তই অভাব।

ঈশ্বর বিশ্বাসের ধারণাটা বাঙালি মেয়েদের ওপর চাপিয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। এটা ঐতিহাসিক সত্য। প্রথম পঞ্চাশ বছরে একেবারে শেষ বছরে অর্থাৎ ১৮৯৯ সালে প্রথম মেয়েদের লেখা তীর্থ ভ্রমণ কাহিনি পাওয়া যায়। তার আগে তীর্থস্থানে গেছেন তাঁরা, ভ্রমণ কাহিনিও লিখেছেন। নাহ্‌, তীর্থভ্রমণ নয়।

একশো বছর আগের সংস্কারমুক্ত নারীর গদ্য -

স্বর্ণকুমারী দেবী তাঁর ‘প্রয়াগ যাত্রা’-য় লিখছেন, “মুসলমানদের এলাহাবাদ অর্থাৎ আল্লার স্থান আর আমাদের পুণ্যতীর্থ প্রয়াগ,- এখানে আসিয়া পবিত্র গঙ্গা যমুনার সঙ্গমে স্নান করিয়া কত পাপী তাপী তরিয়া গেল, অধম আমার কিছু হইল না, আমি যে পাপের বোঝা সঙ্গে লইয়া আসিয়াছিলাম – তাহা যেমন তেমনি রহিয়া গেল, এখানে আসিয়া অবধি আমার একদিন গঙ্গাস্নান হয় নাই। এই শীতের দেশ, ভোরে উঠিয়া গঙ্গাস্নানের কথা মনে করিতে গেলেও গায়ে কাঁটা দিয়া উঠে, - তবু না হয় এক দিন কষ্টে শ্রষ্ঠে তাহাও করিব ভাবিয়াছিলাম, কিন্তু শুনিলাম পাণ্ডাদের কিছু কিছু দিয়া মাথা না মুড়াইতে পারিলে শুধু গঙ্গাস্নানের ফল হয় না। তা প্রথমটিতে আমার আপত্তি ছিল না, দ্বিতীয় কথাটি শুনিয়া অবধি এমনি আতঙ্ক উপস্থিত হইয়াছে যে সেই দিন হইতে এই সহজ পুণ্য লাভের আশাটা একেবারে ছাড়িয়া বিজ্ঞ দার্শনিক হইয়া মনে মনে সিদ্ধান্ত করিয়া রাখিয়াছি – এত সহজে পাপমুক্ত হইয়া তৃপ্তি নাই”

স্বর্ণকুমারীর বড়মেয়ে হিরন্ময়ীর ভাবনাও তদ্রূপ - লেখিকা যেদিন ব্যান্ডেল চার্চে গিয়েছিলেন সেদিন ছিল কনফেশন ডে। একটি মহিলার কনফেশন পর্ব দেখে লেখিকার মনে বিচিত্র ভাবের উদয় হয়। স্বর্ণকুমারীর সংস্কারমুক্ত মনের উত্তরাধিকারে তিনি লিখছেন – “মনে হইতে লাগিল, না জানি কোন রমণী কি শোক কি পাপ তাপে ব্যথিত হইয়া গুরুর আশ্বাস বাণীতে শান্তি লাভ করিতে এখানে আসিয়াছে? আর তুমি পুরোহিত কে? তুমি কি এই হৃদয়গুলি লইয়া ছেলেখেলা করিতেছ, তোমার আশ্বাসে মুগ্ধ হইতেছে বলিয়া নির্ব্বোধ ভাবিতেছ, বা ব্যথিতের সঙ্গে অদৃশ্যে তুমিও অশ্রুজল মিশাইতেছ? হৃদয়ের সহিত তাহাদের শুভ কামনায় আশীর্ব্বাদ করিতেছ? ব্যথিত হৃদয় গুলিতে সান্ত্বনা বারি সেচন করিয়া তাহাদের নবজীবন দিয়া সংসারে ফিরাইতেছ? কে তুমি পুণ্যবান, তোমার কি সত্যই এত ধর্ম্ম বল আছে, তুমি যে পাপীদিগকে পাপ হইতে নিষ্কৃতি দিতে পার?”

প্রথিতযশা সাহিত্যিক গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী দেওঘর বেড়াতে গিয়ে বৈদ্যনাথের মন্দিরের বর্ণনায় লিখলেন, বৈদ্যনাথের মন্দির অনেকটা কালিঘাটের কালীর মন্দিরের মত। মাঝখানে বৈদ্যনাথের মন্দির, চারদিকে আর চার পাঁচটী দেবালয় আছে, মন্দিরের দালানে একখণ্ড প্রস্তর বসাইয়া তাহার কষ্টহরণ নাম দিয়া পাণ্ডারা বিলক্ষণ পয়সা রোজগার করিতেছেপার্ব্বতীর মন্দিরের সহিত শিবের মন্দিরের চূড়ার সঙ্গে একটী লম্বা সুতা বাঁধা দেখিলাম। জিজ্ঞাসায় জানা গেল, সেটী গাঁটছড়া। নব-দম্পতীর মধ্যে গাঁটছড়ার নিয়ম আট দিন মাত্র, কিন্তু দেব-দম্পতীর চিরদিন। তীর্থস্থানমাত্রেই পাণ্ডার উপদ্রব যথেষ্ট থাকিলেও পাণ্ডাদের আচার ব্যবহার মোটের উপর আমার ভালই লাগে, ইহারা যাত্রীদের আত্মীয়ের মত যথেষ্ট যত্ন আতিথ্য করে, বাস্তবিক নবাগত দেশে ইহারা বিশ্বস্ত অনুচরের মত, সামান্য অর্থ দিয়া অনেকটা সুবিধা পাওয়া যায়।”

এরপর জনৈকা গিরিবালা দেবী যিনি ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে লিখতেন, ওড়িশার পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে এক ভাঙা মন্দিরে পৌঁছে অন্যান্য বর্ণনার সঙ্গে তার নিজের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও তুলে ধরেছেন - শুনা যায়, এই মহাদেব তিনবর্ণে পরিবর্ত্তিত হন। প্রাতঃকালে কৃষ্ণবর্ণ, দ্বিপ্রহরে ধূসর বর্ণ এবং সন্ধ্যায় রক্তবর্ণ ধারণ করেন। আমরা মধ্যাহ্নে মহাদেব দর্শন করিয়াছিলাম তৎকালে ধূসরবর্ণ দেখা গেল। অজ্ঞ লোকের বিশ্বাস যে ইহাতেই মহাদেবের মাহাত্ম্য অতি প্রত্যক্ষ। কিন্তু একটু অনুধাবন করিয়া দেখিলে ইহার কারণ স্পষ্টই অনুভূত হয়। মন্দিরের দ্বার পশ্চিমাভিমুখে, সেই জন্যই বোধ হয় মহাদেবের নাম পশ্চিমেশ্বর। দ্বার হইতে মহাদেবের যে পার্শ্ব দৃষ্ট হয়, তাহা অতি মসৃণ। সেই মসৃণ পার্শ্বেই সূর্য্যের আভা প্রতিফলিত হওয়ার জন্য ভিন্ন ভিন্ন সময়ে উক্তরূপ বিভিন্নবর্ণ দৃষ্ট হয়।

এইসময়ের মেয়েদের লেখায় ধর্ম, ঈশ্বর, সমাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী অনেক সত্যিকারের আধুনিক এবং বিজ্ঞানমনস্ক। ঈশ্বর নিয়ে সমালোচনা আছে, এমন কী ব্যঙ্গও। বিশ্বাস, সেতো অনেক পরে তার ওপরে চাপিয়ে দেওয়া। এগুলো পড়লে মনে হয় একশ বছরে বাঙালি নারী নিজস্বতা পুরোপুরি হারিয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রভাবে।

এদেরই উত্তরাধিকার বহন করতে চাই আমি।




Inferno



What aches inside me
I do not know.
What is it inside me
that burns, I still
Do not know.

But it aches, it burns
Right through my brain.
It hurts it pains -
In a most impossible way.

Nothing can heal me now.
I am just evaporating
Like smokes from a terrible fire.

কৃষ্ণকলির কথা

শ্যামলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
এমনটাই হওয়ার ছিল যদিও,
নাহলে তাকে নিয়ে আর কবিতা হত না।
শ্যামলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি,
যেমনটা আলো বা মেঘ হতে পারেনি
সেই শ্যামলী মেয়েটি।
এমনটা হওয়াও খুব স্বাভাবিকই ছিল।
কারণ তাকে নিয়ে কোনো কবিতা লেখা হবে না।

তাকে নিয়ে কেউ কখনো কোনো কবিতা লেখেনি,
কিন্তু অ্যাসিড ছুঁড়েছিল মুখে তার প্রেমিক!
গায়ে আগুন, স্বামী নিজের হাতেই দিয়েছিল।
নাহ্‌, তাকে কোনো কবিই শব্দের আখরে আঁকেনি –
যাকে ধর্ষণ করেছিল সাতটি পুরুষ, একে একে;
তারপরে পেট কেটে নাড়ি টেনে বার করে উল্লাস করেছিল –
যে নাড়ির বন্ধনে একদিন তারা সকলেই বাঁধা ছিল মায়ের সঙ্গে।
নাহ্‌, এদের কারোর হরিণ চোখ দেখে গান বাঁধেনি কেউ –
যে মেয়েটা কাল বিক্রি হয়ে গেল দালালের হাতে,
বেচেছিল তার নিজের বাপই খিদে বা নেশার টাকার বিনিময়ে।

যখন আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত -
প্রেম অথবা যৌনতা নিয়ে কবিতা লিখেছ ঢের।
আর যখন নিস্প্রয়োজন -
অনায়াসে ঠেলে দিয়েছ যাহান্নামে।
আসলে কবিতার কাল্পনিক নায়িকা হওয়ার চেয়ে
বাস্তবে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকাটাই
বিষম জরুরি আমাদের কাছে। আমরা
রোদ্দুর, মেঘ বা আলো কোনোকিছুই হতে চাইনি,
হতে চাইনি কৃষ্ণকলিও। চিরকাল মানুষ হতে চেয়েছি –

ভালোয়মন্দয় সুখে-দুঃখে রক্তমাংসের আস্ত একটা মানুষ।

চাঁদা

গতকাল শনিপুজোর চাঁদা চাইতে এসেছিল, আর ঠিক ওইসময়ে আমার অসহ্য দাঁত ব্যথা করছিল। অতএব ...।

সে যাইহোক পরে ভাবছিলাম, চাঁদা কয়প্রকার ও কি কি, এবং চাঁদা কেন দেব?

ভেবে দেখলাম চাঁদা মূলতঃ দুই প্রকার – মানবস্বার্থে চাঁদা এবং ঈশ্বরস্বার্থে চাঁদা। মানবস্বার্থে চাঁদা আবার দুই প্রকার – জনস্বার্থে এবং ব্যক্তিগতস্বার্থে।

ব্যক্তিগতস্বার্থে মানে, কারখানা বন্ধ, বাবার ক্যানসার ইত্যাদি। জনস্বার্থে মানে মূলতঃ বন্যা এবং কখনও কখনও ভূমিকম্প।

ব্যক্তিস্বার্থে আরও একরকম অলিখিত চাঁদা হয়, তা হল, দরকার না থাকলেও নিয়মিত কোনো সেলসম্যানের কাছ থেকে জিনিসপত্র কেনা।

ঈশ্বরস্বার্থে মানে প্রধানতঃ বার্ষিক দুর্গাপুজো, কালীপুজো, লক্ষ্মীপুজো, সরস্বতী পুজো ইত্যাদি। এই ইত্যাদির মধ্যে উল্লেখযোগ্য শনি এবং লোকনাথ। তারমধ্যে লোকনাথ আবার মানব ভেকধারী দেবতা। তবে তেত্রিশ কোটির তুলনায় যৎসামান্য তা স্বীকার করতেই হয়।

এবার প্রশ্ন আসে চাঁদা কেন দেব, এবং দিলেও কাকে দেব?

ব্যক্তিস্বার্থে আমার মতে তুলনায় সেলসম্যান ভালো, যদি সে চুরি বা ডাকাতির উদ্দেশ্যে না আসে। কারণ এরা সরাসরি ভিক্ষা চায় না। কারখানা বন্ধ বা বাবার ক্যানসার গোছের একটা বড় অংশ সত্যি হয় না, বানানো হয়। তবু সিমপ্যাথেটিক গ্রাউন্ডে কখনো দেওয়া চলে। বন্যা বা ভূমিকম্প ত্রাণ আমার মতে পরিচিত কোনো সংস্থার মাধ্যমে দেওয়া ভালো। সেক্ষেত্রে টাকাটা যথাস্থানে পৌঁছনোর সম্ভাবনা তুলনায় বেশি থাকে।

এইসব চাঁদা তাও মধ্যবিত্তের পক্ষে দেওয়া সম্ভব, সামর্থ্য অনুযায়ী। কিন্তু ঈশ্বরস্বার্থে যে টাকা চাঁদা হিসেবে দাবী করা হয়, তা যারা চাঁদা চায় তারাই ঠিক করে অঙ্কটা ঠিক কত হবে। আমি কী দিতে পারব তা বিবেচ্য নয়। অনেকক্ষেত্রেই মদ বা ফূর্তিতেও এই টাকার অধিকাংশটা ব্যয় হয়, বেচারা ঈশ্বরকে সামনে রেখে। অনেক জায়গায় এটা জুলুমের আকার নেয়। এখন প্রশ্ন যাঁরা ঈশ্বর মানেন, তাঁরা নাহয় ভক্তির থেকে চাঁদা দিলেন। আমার মতো কাঠ নাস্তিকেরা কেন চাঁদা দেব? সবচেয়ে বড় কথা ধরে নিলাম কিছু মানুষ বিশ্বাস থেকেই হোক আর ফূর্তি করার জন্যই হোক জনৈক ঈশ্বরকে খাড়া করেন। তা করুন। আমি বিন্দুমাত্র মাথা ঘামাতে যাচ্ছি না। কিন্তু তাঁদের বিশ্বাসের জন্যই হোক অথবা ফূর্তির জন্য, খামোখা আমাকে কেন টাকা দিতে হবে?

সাধারণতঃ অপরিচিত হলে চাঁদার লোককে আমি দূর দূর করে তাড়িয়ে দিই। বিশেষ করে দাঁতে যন্ত্রণা থাকলে আরোই। মুশকিল পাড়ার লোকজনকে নিয়ে। খুব বিরক্ত লাগলেও মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখতে হয়।

এতো ভিক্ষা চাওয়ারই রকমফের, লোকে বোঝে না কেন, বিশেষ করে যাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে, তারাও যখন বেচারা ভগবানের নাম করে চাঁদা চায় তখন মানুষ হিসেবে নিজেরই কেমন লজ্জা লাগে। ওই যে লোকগুলো চা বাগানেই হোক কী আলূর ক্ষেতে মরে যাচ্ছে, ওদের জন্যও তো চাইতে পারত। পারত তো নিজে দিয়ে সেই কাজটা শুরু করতে?


আমি বাপু বেকার মানুষ, চাঁদা কিম্বা দাঁতের ডাক্তারের ভিজিট সবেতেই পরস্মৈপদী। তাই ফ্ল্যাটের সামনে “পথের কুকুর মারিবেন না”, পোস্টারটা তুলে “চাঁদা চাহিয়া লজ্জা দিবেন না, অবশ্য এখানে দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী, শনি, ইতু, ঘেঁটু ইত্যাদি যাবতীয় দেবতা এবং অপদেবতা, অধিদেবতার প্রসাদ হাসিমুখে গ্রহণ করা হইয়া থাকে” – এমন পোস্টার একখানা মারব ঠিক করেছি। 

Thursday, December 10, 2015

ভালোবাসা

গতকাল অশোকাদির কাছে গিয়েছিলাম। সেই ছোটবেলার প্রিয় শিক্ষিকা, আদর্শও। সম্পর্কটা যদিও অনেক কাছেরই ছিল। ভীষণ খুশি হলেন। আনন্দে খাওয়ার সময় একদলা ভাতও খাইয়ে দিলেন। দুপুরবেলায় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, জানিস কিছুদিন ধরেই খুব মনখারাপ লাগছিল, তুই ফোন করলি সেদিন, খুব আনন্দ হয়েছিল। ওনাকে নিয়ে লেখা কবিতাটা কাগজে লিখে দিতে বলেছিলেন, সেটাও পড়তে হল। খানিক আবেগ, খানিক ভালোলাগা সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছিল কিছু মুহূর্ত। হ্যান্ডিক্যাপড দিদিকে নিয়ে খুব সমস্যাতেই আছেন, বিশেষত তাঁর নানারকম বাতিক হওয়ায় আর বড় রকমের নিউওমোনিয়া পর্ব থেকে সদ্য উঠে আসার জেরে। নিজেরও অস্টিওপোরেসিস নিয়ে মাঝে কিছুদিন হাঁটাচলাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ চিকিৎসা আর হরমোন ইঞ্জেকশন নিয়ে এখন কিছুটা ভালো।

বিকেল-সন্ধ্যে নাগাদ ছাদে বসে গল্প করছিলাম। ফুলবাগান করেছেন মালীর সহায়তায়। রূপনারায়ণপুরের কাঠচাঁপাও রয়েছে সেখানে। বললেন ছোটবেলায় একবার স্কুল থেকে চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্কসের কারখানা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। সেবারে পাঁচটা টাকা, তখনকার দিনে অনেকই, হারিয়ে ফেলেছিলেন। তারপর একটু নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কে জানত আমার অন্ন ওখানেই বাঁধা আছে। পাশের বাড়িটা দেখিয়ে বললেন, ওই যে ছাদের চিলেকোঠার ঘর বি এড পড়ার সময় ওখানেই দিনরাত কাটত। বাবা লিখে দিয়ে গেলেন সৎ দাদাকে। ভাগ্যিস মায়ের এই জমিটা আমাদের দুই বোনের নামে দানপত্র করেছিলেন। তারপরেও তো এই ফ্ল্যাট করার জন্য কত লড়াই, মামলা করতে হয়েছে...। এইসব সিরিয়াস কথার মাঝেই নানান মজার কথা বলছিলাম আমি। মাঝে মাঝেই হো হো করে হেসে উঠে বলছিলেন, কতদিন পরে যে হাসলাম দময়ন্তী কে জানে!

অশোকাদি খুব ঈশ্বরে বিশ্বাসী। বললেন, মন দিয়ে ডাকলে সত্যি কিছু হয় রে। আমার খুব একা লাগছিল, খুব মনখারাপ লাগছিল আর ঈশ্বর তোকে পাঠিয়ে দিলেন। বললাম, তোমার ঈশ্বরের আক্কেলটা কী বল তো, বেছে বেছে আমার মতো নাস্তিককেই পাঠালেন? লোকটা কিন্তু ভারী গন্ডগোলের।

আমাকে খালি আদর করেন, আর বলেন, তুই সেই একই রয়ে গেছিস। আমি মাথা চুলকে ভাবি পনেরো-ষোলর পর সেই পঁচিশ আর সাতাশে দেখা, তারপরে আবার পনেরো বছর পর। বলি এক থাকি কী করে?


অবশ্য বয়স যতই বাড়ুক। প্রায় না থাকা পেনসনে জমা টাকা ভেঙে যাওয়ার নিয়ত দুশ্চিন্তায়, এখনও চলতে থাকা মামলার ভারে, নিজের এবং দিদির অসুস্থতায়, অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের আশঙ্কায় চিন্তার যতই ভাঁজ পড়ুক চোখেমুখে, আমার কাছে তিনি তো সেই সাতাশের হার্টথ্রব। বিকেল বেলায় আমাকে বাসে তুলে দেওয়ার আগে চট করে পড়ে নিলেন তাঁর সেই সিল্কের শাড়ি। ছাত্রী যে ঢুকেই বলেছিল, ওমা তুমি সাজোনি কেন, বোধহয় তাই।


ওই যে একদিন লিখেছিলাম না ভালোবাসার হাজার রঙ হয়, অথবা রকমের, হয়তো। বিশ্বাস করলেই হয়।