Saturday, December 5, 2015

অবশেষে অবলা

মনে হয় কাজটুকুই হোক আমার পরিচয়।
ব্যাপ্তিতে ব্যতিক্রমী ভ্রমণ-রচনা
সীমন্তী সেন
৫ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০০:০১:০০
অবলা বসু
সাহেবি শাসকদের সংস্পর্শে বাঙালির আধুনিকহয়ে ওঠার অন্যতম সূচক ছিল ভ্রমণকারী এবং ভ্রমণবৃত্তান্ত রচয়িতা হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে পশ্চিমি শিক্ষা এবং জাতি-চেতনার উন্মেষএই দ্বিবিধ যুগ-অভিজ্ঞতার ফলে ভারতীয় তথা বাঙালি নব্য শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মনে ভ্রমণ শুধু বিলাসই নয়, প্রায় এক অবশ্যপালনীয় কর্তব্য ধার্য হয়। স্বাভাবিক কারণেই, এই নবলব্ধ ভ্রমণের সংস্কৃতি ছিল মূলত পুরুষকেন্দ্রিক। সে কালে খুব বেশি মহিলা ভ্রমণের সুযোগ পাননি, আর পেলেও নিজেদের দৃষ্টি এবং স্বরকে পাঠককুলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রত্যয় বা প্রেরণা, কোনওটাই তেমন ছিল না। এ দিক থেকে অবলা বসুর ভ্রমণ-সংক্রান্ত রচনা বিশেষ উল্লেখের দাবিদার।
১৩০২-১৩৩২ কালপর্বে অবলা বসুর ভ্রমণের বিবিধ রচনা প্রকাশিত হয় মূলত ছোটদের পত্রিকা মুকুল-এ এবং দু-একটা প্রবাসী-তে। অবলা বসুর জন্মের সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে দময়ন্তী দাশগুপ্ত তাঁর এই রচনাগুলি সংকলিত করে তৎকালীন বাঙালি মহিলার ভ্রমণ রচনার খুব সীমিত তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন করলেন। সমসাময়িক কালে স্বদেশ ভ্রমণ বিষয়ে স্বর্ণকুমারী দেবী, প্রসন্নময়ী দেবী বা প্রিয়ম্বদা দেবীর বেশ কিছু রচনা পাওয়া গেলেও, ইউরোপ ভ্রমণের বৃত্তান্ত কৃষ্ণভাবিনী বা জগৎমোহিনী চৌধুরীর বাইরে বিশেষ একটা চোখে পড়েনি। অবশ্য কাছাকাছি সময়ে, হরিপ্রভা তাকেদা বা সরোজনলিনীর রচনায় জাপান ধরা পড়েছে। তবে এঁরা কেউ-ই জীবনে অবলার মতো এত বিস্তৃত ভ্রমণের সুযোগ পাননি। জগদীশচন্দ্র বসু বিদেশ থেকে বার বার ডাক পেয়েছেন এবং এ রকম বহু জায়গায় স্বামীর সহযাত্রী হয়েছেন অবলা। জাতীয়তাবাদের স্বপরিচিতি নির্মাণের কালে অবলা-ই বাঙালি মহিলাদের মধ্যে প্রথম, যিনি পুব এবং পশ্চিমদুই পৃথিবী সম্পর্কেই তাঁর দেখাপাঠকের দরবারে হাজির করতে পেরেছেন।
অবলা বসুর ভ্রমণকথা, সংকলন ও সম্পা: দময়ন্তী দাশগুপ্ত। পরশপাথর, ১৭৫.০০
জলপথে মুর্শিদাবাদ, মনোমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, সম্পা: গৌতমকুমার দে। পরশপাথর, ১৭৫.০০
ভ্রমণকারীর ভ্রমণ বৃত্তান্ত, রসিককৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সম্পা: সমীর পাত্র ও শেখর ভৌমিক। মহিষাদল রাজ কলেজ, পরি: আশাদীপ, ১৫০.০০
অবলার কাশ্মীর, লখনউ, মাদ্রাজ কিংবা চিতোরের বিবরণ একই ধাঁচেরযাত্রাপথ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, স্থাপত্য, লোককথা, লোক-বিশ্বাস, অঞ্চলের ইতিহাস। লেখার ধরনে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, উদ্দিষ্ট পাঠক হল কিশোর-কিশোরী। তবু এরই মধ্যে টুকরো মন্তব্য ধরা পড়ে সমসাময়িক বাঙালি বুদ্ধিজীবী শ্রেণির রাজনৈতিক বোধ বিশ্বাসে লেখিকার অংশীদারিত্ব। যেমন, লখনউতে পুরনো রেসিডেন্সি অঞ্চলে সিপাহি বিদ্রোহে নিহত ইংরেজ সেনানায়কদের স্মৃতিসৌধ দেখে তাঁদের বীরত্ব সম্পর্কে তাঁর মন শুধু শ্রদ্ধায় ভরে আসে না, ‘মনে গভীর বিষাদের(ও) আবির্ভাবহয়। আবার চিতোর কিংবা কাশীতে হিন্দু স্থাপত্য, মন্দিরের ভগ্নদশা দেখে লেখেন ‘...সর্ব্বত্রই হিন্দু কীর্ত্তির ভগ্নাবশেষ দেখিয়া প্রাণে এক প্রকার ক্লেশ হয়। বর্ত্তমান রাজারা যে কত ভাল তাহা বারবার মনে হয়। তাঁহারা কেমন যত্ন করিয়া হিন্দু ও মুসলমানদিগের প্রাচীন কীর্ত্তি সকল রক্ষা করিতেছেন।
অবলার বিলেতের বিবরণ তৎকালীন অন্যান্য বিলেতের বিবরণের সঙ্গে প্রায় মিলে যায়। বিলিতি জাহাজেই প্রথম ইংরেজদের নিয়মানুবর্তিতাএবং শৃঙ্খলাবোধ’-এর সঙ্গে পরিচয়, এরপর এর দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে রাস্তাঘাটে, পার্ক, মিউজিয়মেপ্রায় সমস্ত প্রতিষ্ঠানে বা লোক সমাগমে। ছোটদের জন্য লন্ডনের গল্প লিখতে বসেও কিন্তু অবলা পার্লামেন্টের দীর্ঘ বিবরণ দেন, জানান ফ্যাক্টরি বিল নিয়ে আলোচনা, ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা বা লর্ড এবং কমন’-দের বসার আলাদা বন্দোবস্তের কথা। উপনিবেশাশ্রিত শিক্ষিত বাঙালির শাসকের সংস্কৃতির সঙ্গে নৈকট্যবোধের পরিচয় মেলে  যখন ওয়েস্টমিন্‌স্টার অ্যাবিতে কবিদের সমাধি দেখে মনে হয় যে...অনেক দিনের পরিচিত বন্ধুদিগের সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছে। রোম বা ভেনিসের বিবৃতিতেও বাজে এ রকমই পূর্ব-পরিচিতির সুর।
উন্নতি, সমাজ সংগঠনে আমেরিকা যেন ইউরোপীয় সংস্কৃতিরই বিস্তৃত রূপ। তৎকালীন অন্যান্য ভ্রমণকারীর মতোই অবলা পশ্চিমি সমাজ সভ্যতার অনেক কিছু দেখেই মুগ্ধ হন। তবে মুগ্ধতায় জাতীয়তাবোধকে হারাতে দেওয়া যায় না, তাই তিনি কিশোরদেরও বলতে ভোলেন না যে আমাদের জাতীয় চরিত্রে ভাব ও আকাঙ্খার এমন সরল ও উচ্চমান বিদ্যমান, যাহার পরিবর্ত্তে বিদেশের সভ্যতা সম্পূর্ণ গ্রহণ করিবার ইচ্ছা আমার মনে কখনই উদয় হয় নাই

লেখিকা যখন জাপানে যাচ্ছেন ১৯১৫ নাগাদ, তখন জাপানকে ঘিরেই গড়ে উঠতে শুরু করেছে পুবের আত্মবিশ্বাস, আত্মাভিমান। তার উন্নত সভ্যতা, আধুনিকতার পরিচয় লেখিকা পেতে শুরু করেন জাপানি জাহাজ থেকেই। এর পর বাড়িঘর, যানবাহন, শিশু প্রতিপালন, উৎসব, অনুষ্ঠান, গৃহসজ্জাপ্রায় সব কিছুই যেন এরই অভিজ্ঞান। তবে এই রকম আধুনিকতাএবং উন্নতিসত্ত্বেও জাপান কিন্তু স্বাতন্ত্র্য হারায়নি। নারী স্বাধীনতা থেকে চা-পান অনুষ্ঠান পর্যন্ত জাপান নিজস্বতায় সমুজ্জ্বল। তবে ভুললে চলে না যে, এই উন্নতির পাশাপাশি প্রকটিত হচ্ছে জাপানের আগ্রাসী রূপ। অতএব, আমরা এরকম মন্তব্য পাই যে অত্যন্ত কম সময়ে এই অত্যাশ্চর্য উন্নতি জাপানিদের আত্মম্ভরী করে তুলেছে। সে কালে কোনও মহিলার তো নয়ই, সচরাচর কোনও পুরুষের রচনাতেও এত দেশ, সংস্কৃতির বয়ান মেলে না। অতএব, বক্তব্যে না হলেও ব্যাপ্তিতে অবলার ভ্রমণরচনা ব্যতিক্রমী।

2 comments: