আমাদের ছোটবেলায় রবিবার সকালে পুরোনো হিন্দি সিনেমার গানের
একটা চমৎকার অনুষ্ঠান হত, আর রেডিওতে পুরোনো বাংলা গান শোনার জন্য ছিল ‘অনুরোধের
আসর’। নাহ্, এই দুটোর কোনোটাই আমার দেখার বা শোনার অনুমতি ছিল না। বাড়িতে প্রচুর
ক্যাসেট ছিল, যার অধিকাংশ রবীন্দ্রসঙ্গীত, এছাড়া ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার, হেমাঙ্গ
বিশ্বাস, ভূপেন হাজারিকা, বেগম আখতার, ভীমসেন যোশী, বিঠোফেন এইরকম নানা জাতের
সঙ্গীত। কিন্তু আধুনিক হিন্দি এবং বাংলা গানের অনুপ্রবেশ ছিল একান্ত নিষিদ্ধ। কী
করে একটু বড় হওয়ার পর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সেখানে স্থান
পেয়েছিলেন সে রহস্য আমার আজও জানা নেই। একবার হিন্দি সিনেমা ‘মধুমতী’-র ক্যাসেট
এনেছিল খোদ বাবা-ই। কিন্তু শুনতে দেবে না। এই নিয়ে রাগারাগিতে বেচারা ক্যাসেটটাই
গেল ভেঙে। হিন্দি সিনেমা এবং হিন্দি গান তো একেবারে কানে ঢোকানোই বারন। ওদিকে বাবা
না থাকলেই চলে মায়ের গানের সাধনা। ক্ল্যাসিকাল, রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাশাপাশি হিন্দি
ও বাংলা আধুনিক গান। অতএব বাবার চোখ রাঙানো নিষেধ সত্ত্বেও তালাত মামুদ, লতা, আশা,
গীতা দত্ত, হেমন্ত, কিশোর, রফি সবার গান আমার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। অসুখ তো লেগেই
থাকত। আর অসুখ করলে মা-ই আমার সেই ঠাকুরদাদা। ক্রৌঞ্চ দ্বীপের গল্প বলা থেকে গান
শোনানো সব। জ্বর হলে আমার খুব প্রিয় ছিল তালাত মামুদের গান শুনতে শুনতে ঘুমোনো। এই
ঘুম পাড়ানোর তালিকায় সুবীর সেনের বেশ কিছু গানও ছিল। তবে সুবীর সেনের গানের মধ্যে মা
সবচেয়ে বেশি গাইত, ‘ওই উজ্জ্বল দিন ডাকে স্বপ্ন রঙিন’ – আর অমনি আমার মনমরা দিনটা
কেমন ঝলমলে হয়ে উঠত। এদের নিজেদের গলায় সব গানই আমি শুনেছি, তবে বহু পরে। এমন
অসাধারণ সব গান কেন যে বাবার ভালোলাগত না কে জানে! এখন যে গানই শুনি, মনে মনে
শুনতে পাই আমার তরুণী মায়ের কন্ঠস্বর। ছেলেবেলা ফিরে আসে তখনি। এখনও অসুখ করলে মনে
মনে বলি, মা ওই গানটা গাও না, ওই যে, ‘রাত হল নিঝুম, ফুলের দুচোখে ঘুম, চাঁদ ওই
জেগে রয়, হাওয়া শুধু কথা কয়’। মাথার বালিশের পাশে মোবাইলে সুবীর সেন বাজে। আসলে তো
মা গান গায়, রাতের পর রাত জেগে।
No comments:
Post a Comment