অন্য লেখকের চরিত্রেরা

গোলাপসুন্দরী


তাহার কক্ষে গোলাপসুন্দরীর প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। অথচ গোলাপ জানিত কক্ষখানি একান্ত তাহারি। গোলাপকে দেখিলেই সে মুখখানি ফিরাইয়া লয়, দ্বার বন্ধ করিয়া দেয়। গোলাপসুন্দরী দ্বারে করাঘাত করিয়া প্রতিদিন বলিয়া যায়, ‘তুই মর’। দ্বার খুলে না। কেবলমাত্র অন্যপার্শ্বে সে ডাকিতে থাকে, ‘গোলাপ গোলাপ’। গোলাপ শুনিতে পায়, গোলাপ সাড়া দিয়া বলিয়া উঠে, ‘যাইই...।’ দ্বার খুলে না। দ্বার শুধু ডাকিতে থাকে, ‘গোলাপ, গোলাপ’।
মধ্যে মধ্যে তাহার বড় শ্রান্ত লাগিতে থাকে। এই জীবন, এই বাঁচিয়া থাকা – আপনার মনে অস্ফুটে ডাকিতে থাকে সে – ‘গোলাপ, গোলাপ’। চক্ষে জল আসিয়া পড়ে। গোলাপ কি নিদ্রা যাইতেছে? সাড়া দেয় নাই কেন? – ‘গোলাপ, গোলাপ...’।
কলম দিয়া কি চক্ষের জল পড়ে? তাহা না হইলে অক্ষরময় পৃষ্ঠাগুলি আবছায়া হইয়া যাহে কেন? নিদ্রা আসিতেছে, ‘ও গোলাপ, মস্তকে হস্ত বুলাইয়া দিবি না? ওষ্ঠে অঙ্গুলি বু্লাইবিনা তোর? ও গোলাপ, স্বপনে আসিবি তো ঠিক?’
গোলাপ প্রাতঃকালে স্নান করিয়া পাটভাঙা শাড়িখানি পরিয়া আসিয়া দ্বারে করাঘাত করিতে থাকে, ডাকিয়া কহে, ‘ওঠ মরণ, উঠিয়া পড়, প্রাতঃকাল যে কখন হইল’। দ্বার কেহ খুলিয়া দেয় না। স্বপনের ঘোরে শুনিতে পাওয়া যায় অস্পষ্ট কন্ঠস্বর, ‘গোলাপ, গোলাপ’।
দিন কাটিয়া যায়, নিঃশব্দতায়। কেবলমাত্র গোলাপের কঙ্কনগুলি রিনিঠিনি বাজিয়া কহে, ‘মরণ,মরণ’। সূর্য উঠিবার সময় ডাক দিয়া যায়, ‘ও গোলাপ, গোলাপ’। নামিবার সময় ফিসফিস করিয়া বলিতে থাকে, ‘গোলাপ, গোলাপ’। গোলাপ খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠে, ঠোঁট চাপিয়া ভ্রুভঙ্গী করিয়া কহে, ‘মরণ’। নিদ্রা যাইবার পূর্বে স্নান সারিয়া আসিয়া পুনরায় দ্বারে করাঘাত করিয়া যায়, হাসিতে হাসিতে বলিয়া উঠে, ‘খুলিয়া দে, একমুষ্টি হলাহল দিয়া যাই, মক্ষিকাসুধা তো মুখে রুচিবে না’। দীর্ঘশ্বাস শুনিতে পাওয়া যায় দ্বারের অন্যপার্শ্ব হইতে।
একেকটিদিন বড় বেদনা হইতে থাকে তাহার। স্থির থাকিতে পারেনা। পালঙ্কে এপাশ-ওপাশ করিতে থাকে সে। সেইসব রাত্রে গোলাপসুন্দরী বৃক্ষ হইয়া যায়। বৃক্ষ হইয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরে, ডালপালায়, শিকড়ে। তাহার শ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসে। গোলাপকে সে দুই হস্তে ঠেলিয়া দেয়। গোলাপ তাহাকে পুনরায় জড়াইয়া ধরিয়া কহে, ‘মরিতে চাহিয়াছিলিস অদ্যপি ভীত হইলে চলিবে কেন?’ সে মরিতে থাকে অতঃপর। কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ করিয়া বৃক্ষদেহে মিশিয়া যাইতে যাইতে মরিতে থাকে। তাহার ইহকাল পরকাল, অতীত বর্তমান সব হারাইয়া যায়। একটি ক্রমশঃ গভীর মরণে সে শ্বাস বন্ধ করিয়া ডুবিয়া যায়। গোলাপ তো ঠিকই কহিয়াছে, সেতো মরিতেই চাহিয়াছে আজীবন।
পরদিন প্রাতঃকালে পালঙ্কে  শুষ্কপত্র পড়িয়া থাকে।
কোনো কোনোদিন গোলাপসুন্দরীর দেহে নদী বহে। নদী হইতে লবণাক্ত সমুদ্রের লাবণ্যে ঢেউ উঠিতে থাকে। লবণাক্ত বাতাসের স্পর্শে ঘুম ভাঙিয়া যায় তাহার। ডুবিতে ডুবিতে তৃণখণ্ড আঁকড়াইয়া ধরিতে চাহে – অথচ সর্বত্র ঢেউ বহে - ওষ্ঠে, স্তনে, নাভিতে, জঙ্ঘায়। গোলাপ দন্ত দিয়া ওষ্ঠ চাপিয়া ফিসফিস করিয়া বলিয়া ওঠে, ‘আ, মরণ, কেবলমাত্র দুষ্টামি’।
প্রাতঃকালে সিক্ত শয্যাবস্ত্রটি পড়িয়া থাকে পালঙ্কে।
একেকটিদিন গভীর রাত্রিতে তৃষ্ণায় তাহার ছাতি ফাটিয়া যায়। অন্ধকারে হাতরাইয়া হাতরাইয়া ডাকে, ‘গোলাপ, গোলাপ’। গোলাপ জল রাখিয়া যায় নাই কেন? গোলাপ জল হইয়া আসে নাই কেন? ‘গোলাপ, খানিক বৃষ্টি দিয়া যা গোলাপ’। গোলাপসুন্দরী তাহার কক্ষে নিদ্রা যাইতে যাইতে মৃদুস্বরে বলিয়া উঠে, ‘মরণ’।
প্রাতঃকালে শয্যায় লাগিয়া থাকে অশ্রু এবং স্বেদ।
কোনো রাত্রিতে গোলাপ আসিয়া তাহার দ্বারে আছড়াইয়া পড়িয়া বলিয়া উঠে, ‘উঠ, উঠ, অগ্নি লাগিয়াছে’। সে আসিয়া গোলাপকে তুলিয়া কহে, ‘কোথা?’ গোলাপ বলিয়া উঠে, ‘চক্ষুর মাথা খাইয়াছিস নাকি, দেখিতে পাইতেছিস না?’ অতঃপর অগ্নি জ্বলিতে থাকে। তাহার শ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিতে চাহে - উত্তাপে, ধুম্রে। সে পুড়িতে থাকে। সে মরিতে থাকে।
প্রাতঃকালে শয্যায় কিয়ৎখানিক ভস্ম পড়িয়া থাকে।

এই কাহিনিটি আমি শুনিয়াছি তাহার কাছেই। চিত্র অঙ্কন করিত সে। গোলাপসুন্দরীর চিত্র দেখাইয়াছিল আমায়। গোলাপ - নদী, বৃক্ষ, আগুন। প্রাতের আলোক আর সন্ধ্যাকালের স্নিগ্ধতা। বলিয়াছিল, হয়তো গোলাপসুন্দরী বলিয়া কেহ ছিল না। অথবা গোলাপসুন্দরীরা হয়তো হারাইয়াই যায় চিরকাল। বলিয়াছিল, হয়তো সকল পুরুষের কল্পনাতেই গোলাপসুন্দরীরা বাঁচিয়া থাকে, বাঁচিয়া থাকিতে চাহে।

শুনিতে শুনিতে অকস্মাৎ মনে হইল, নূপুর নিক্কনশব্দে হাসিয়া কে যেন কহিয়া উঠিল, ‘মরণ’।


'ঋতবাক' ব্লগজিন, ২০১৫







কথোপকথন



একদা কলকাতা নামের এই শহরে শুভঙ্কর নামে ৪৫ বছর বয়সী এক সদ্যজাত যুবক ভালোবেসে ফেলেছিলো নন্দিনী নামের এক বিদ্যুৎ-শিখাকে। গেরিলা-যুদ্ধের মতন তাদের গোপন ভালোবাসাবাসির নিত্য সঙ্গী ছিলাম আমি। আর নিজের খাতায় রোজ টুকে রাখতুম তাদের আবীর-মাখানো কথোপকথনগুলো।

ওপরের অংশটা একদা পড়েছিলাম পূর্ণেন্দু পত্রীর কথোপকথন’-এর ভূমিকায়। সেই আমার নন্দিনী আর শুভঙ্করের সঙ্গে আলাপ। ইদানীং আবার কলকাতার পথেঘাটে মাঝে মধ্যেই নীরার মতো নন্দিনীর সঙ্গেও দেখা হয়। কখনও সে রক্তকরবীর পাতা থেকে নেমে আসে, কখনও বা কথোপকথনের স্কেচ সত্যি করে জেগে ওঠে পথে এলোচুলে। কথায় কথায় একদিন বলল, শুভঙ্করের সঙ্গে আবার দেখা হয়েছে। হঠাৎ করেই কিছুদিন আগে যোগাযোগ হয়েছে ওদের। শুভঙ্করের বয়স এখন সাতাত্তর। নন্দিনীর বয়স? জানিনা। কেউ তো কোথাও লেখেনি যে দুইয়ে দুইয়ে চার করে তার বয়স বুঝব, আর বিদ্যুৎ-শিখার আবার বয়স হয় নাকি?
নন্দিনী বলল, শুভঙ্কর লেখালেখি করে, ছবিও আঁকে। তবে ইদানীং কানে একটু কম শোনে, তাই মেসেজেই যোগাযোগ করতে হয়। জীবনের নানা ঝড়ঝাপটায় যেন অনেকটাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। নাতি-নাতনী নিয়ে নন্দিনীর ভরভরন্ত সংসারের ওপর ভারী রাগ একা শুভঙ্করের। জিজ্ঞাসা করলাম, আর তোমার? হেসে, ওর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে হাত-পা নেড়ে বলল, ভারী মায়া হয় জানো? এখনও ও ওই সদ্যজাতই রয়ে গেছে। তেমনই ভালোবাসতে ভালোলাগে ওকে আজও।
শেষ যেদিন দেখা হল, আমার হাতে একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে নন্দিনী বিষণ্ণ মুখে বলল, শুভঙ্করের যে কী হয়েছে কে জানে, আমার কোনো মেসেজের উত্তর দেয় না, ফোন করলেও ফোন ধরে না। এটা একটু পৌঁছে দেবে শুভঙ্করের কাছে? আজই? ওকে বোলো, আমি অপেক্ষা করে থাকব। ভালো করে কিছু বোঝার আগেই দেখি আর নেই।
কাগজটা উল্টেপাল্টে কোথাও শুভঙ্করের ঠিকানা খুঁজে পেলাম না। রক্তকরবীর একটা পাঁপড়ি খসে পড়ল শুধু। পড়ন্ত বিকেলের শেষ মনখারাপের আলো এসে পড়ল নন্দিনীর হাতের অক্ষরে -
শুভঙ্কর... শুভঙ্কর,
আজ একবার দেখা করবি আমার সঙ্গে?
উত্তর দিবি না তো?
কফি হাউসে আসবি?
তোকে একটা কবিতার বই দিতাম।
আজকের দিনটা মনে আছে তোর?
চৌঠা জুন।
কেন মনে রাখবি?
তা নিজেই ভেবে দেখ,
আদৌ মনে রাখবি কিনা?
সে তো গেল অন্য কথা।
আজ একবার আসবি কফি হাউসে?
বইয়ের নাম?
কথোপকথন’ – পূর্ণেন্দু পত্রীর।
জানি তোর পড়া।
কী আশ্চর্য, পড়া বই কি
আবার করে পড়া যায় না!
না, দেওয়া যায়না?
কবিতা তো বারবারই পড়া যায়।
তুই পড়বি না, সে আলাদা কথা।
আসলে তুই আসবি না,
ওইটেই সত্যি।
তা বেশ, তা বলে আমি কি যাব না?
আমি তো কবিতার বই হাতে নিয়ে
দাঁড়িয়ে থাকতেই পারি
কফি হাউসের দোরগোড়ায়,
অথবা, কফির কাপ হাতে
বসে থাকতে পারি দোতলা বা তিনতলায়।
যেমন, একদিন একা হেঁটেছিলাম পথে পথে,
তোর জন্মদিনেও তুই আসিসনি,
অনন্ত অপেক্ষায় বসেছিলাম আমি।
সেইরকম অনন্ত কোনও কিছু তো
থাকতেই পারে আমাদের মধ্যে।
যেমন ধর, অনন্ত না পাওয়া।
আবার বাজে বকছি? ওইটাই তো
আমার স্বভাব, তুই জানিস।
তোর সঙ্গে বাজে কথা
বলেই সময় কাটাই আমি।
অথবা, সময় নষ্ট করি।
নষ্ট কি হয় আদৌ,কিছুই
কি লাগে না কাজে?
কে জানে!
তুই তো কথাই বলিস না আজকাল
আমারএকাএকাই কথোপকথন।
তোর সঙ্গে?
হয়ত বা নিজের সঙ্গেই।
যাক্‌গে, আসল কথাটাই তো বললি না,
আসবি আজকে, মনে আছে তোর,
চৌঠা জুন?
আমি কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকব।
অথবা যাওয়ার সময় কবিতার বই
ভুল করে ফেলে রেখে যাব।
ওয়েটারটা হাতে তুলে নিয়ে
পাতা ওলটালে দেখতে পাবে,
লেখা রয়েছে - শুভঙ্করকে নন্দিনী।
নীচেই রয়েছে তারিখ লেখা
চৌঠা জুন।
জমা দেবে সেটা মালিকের কাছে?
হয়তবা রাখবে তুলেই
কোনোদিন যদি কোনো শুভঙ্কর

চেয়ে নিয়ে যায় পথ ভুলে।

'এবং একুশ' ব্লগজিন, ২০১৫





কথোপকথন (২)



“একদা কলকাতা নামের এই শহরে শুভঙ্কর নামে ৪৫ বছর বয়সী এক সদ্যজাত যুবক ভালোবেসে ফেলেছিল নন্দিনী নামের এক বিদ্যুৎ-শিখাকে। গেরিলা-যুদ্ধের মতন তাদের গোপন ভালোবাসাবাসির নিত্য সঙ্গী ছিলাম আমি। আর নিজের খাতায় রোজ টুকে রাখতুম তাদের আবীর-মাখানো কথোপকথনগুলো।”
ওপরের অংশটা একদা পড়েছিলাম পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘কথোপকথন’-এর ভূমিকায়। সেই প্রথম নন্দিনী আর শুভঙ্করের সঙ্গে আলাপ। ইদানীং আবার কলকাতার পথেঘাটে মাঝে মধ্যেই নীরার মতো নন্দিনীর সঙ্গেও দেখা হয় আমার। কখনও সে রক্তকরবীর পাতা থেকে নেমে আসে, কখনও বা কথোপকথনের স্কেচ সত্যি করে জেগে ওঠে পথে এলোচুলেকথায় কথায় বলল, শুভঙ্করের সঙ্গে আবার দেখা হয়েছেহঠাৎ করেই কিছুদিন আগে যোগাযোগ হয়েছে ওদের। শুভঙ্করের বয়স এখন সাতাত্তর। নন্দিনীর বয়স? জানিনা। কেউ তো কোথাও লেখেনি যে দুইয়ে দুইয়ে চার করে তার বয়স বুঝব, আর বিদ্যুৎ-শিখার আবার বয়স হয় নাকি?
নন্দিনী বলল, শুভঙ্কর লেখালেখি করে, ছবিও আঁকে। তবে ইদানীং কানে একটু কম শোনে, তাই মেসেজেই যোগাযোগ করতে হয়। জীবনের নানা ঝড়ঝাপটায় যেন অনেকটাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। নাতি-নাতনী নিয়ে নন্দিনীর ভরভরন্ত সংসারের ওপর ভারী রাগ একা শুভঙ্করের। জিজ্ঞাসা করলাম, আর তোমার? হেসে, ওর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে হাত-পা নেড়ে বলল, ভারী মায়া হয় জানো? এখনও ওই সদ্যজাতই রয়ে গেছে। তেমনই ভালোবাসতে ভালোলাগে ওকে আজও।
কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম, কেমন করে আবার দেখা হল তোমাদের? হেসে উঠে বলল, কেন, যেমন করে বিদ্যুৎ-শিখার সঙ্গে আকাশের দেখা হয়, হঠাৎ করে চমকে যাওয়ার মতো। কলকাতার পথে ওকে তো আমি মাঝেমধ্যেই দেখতে পাই। যেমন করে ছায়া দেখে তার অবয়বকে। বললাম, সে আবার কী, ছায়া দেখতে পায় নাকি, মানুষই তো তার ছায়াকে দেখে! মাথা দুলিয়ে খিলখিল করে হেসে বলল, আর যে মানুষ তার ছায়াকে দেখতে পায় না, তার ছায়াকেই দেখতে হয় মানু্ষটাকে। তখনও ভালো করে সকাল হয়নি। বললাম, এই শেষরাত্তিরে চললে কোথায়? বলল, শুভঙ্করকে খুঁজতে। এই বলে আমার হাতে একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে টুক করে কোথায় হারিয়ে গেল। কাগজটা খুলতেই বৃষ্টিভেজা জুঁইফুলের গন্ধ পেলাম। ভোরের অমল আলো এসে পড়ল নন্দিনীর কলমের রেখায় -



শুভঙ্কর, কলকাতার রাস্তায় আজকাল
মাঝে মাঝেই তোকে দেখতে পাই -
মেট্রোয় হয়তো ব্যস্ত কথোপকথনে;
কখনোবা ট্যাক্সির পিছনের সিটে
খেয়াল করতে না করতেই ক্রসিং পেরিয়ে গেছিস।
কখনো দেখেছি পাশের বাসের জানলাটা
আমার জানলার পাশ দিয়ে ডানা মেলে চলে গেছে যখন -
হাতে বই, অথচ চোখে অন্যমনস্ক দৃষ্টি।
মনে মনে ভেবেছি, ঠিক স্টপেজে নামলে হয়!

ইদানীং কলকাতার রাস্তায় প্রায়ই দেখি তোকে -
চৈত্রের বিকেলে যখন লাল পলাশ বা কৃষ্ণচূড়ার আগুন
চোখে পড়ে যায় কংক্রিটের এই শহরের পথে।
বৃষ্টিতে দেখেছি লাল-নীল ছাতাদের ভীড়ে,
অথবা মনকেমন করা জুঁইয়ের সুবাসে।
শরতে-হেমন্তে-শীতে-বসন্তে ঋতুর মতোই
বদলাতে থাকিস তুই কলকাতার পথে পথে।
আর আমি তোকে দেখতে দেখতে
কেমন একলাই পেরিয়ে যাই ক্রসিংগুলো।

শেষ যেদিন চোখে পড়ল, ঠিক
আমার আগে আগেই হাঁটছিলি তুই -
একা, মাথাটা ঝুঁকিয়ে, পাটা যেন টেনে টেনে -
যেন কী একটা অসহনীয় ভার চেপে বসেছে শরীরে,
যেন গভীর এক বেদনা গলা টিপে ধরেছে তোর;
শেষ বিকেলের রাঙা আলো পড়ছিল
ক্লান্ত কপালে, চোখের পাতায়, চিবুকে।
কোনোদিনই পিছু ডাকিনি তোকে,
সেদিনও ডাকলাম না।
সব মানুষকেই নিজের ক্রুশ তো
নিজেকেই বয়ে নিয়ে যেতে হয়।
সকলেরই কষ্ট হয়। তবু যে সামনে থাকে
তার ব্যথা বুঝতে পারে অন্যে।

আসলে পিছন ফিরে তো কেউ তাকায় না।

তবু ছায়া তার অবয়বের ঠিক পিছনেই থাকে।

'অন্যনিষাদ' ব্লগজিন, ২০১৫


কথোপকথন (৩)


“একদা কলকাতা নামের এই শহরে শুভঙ্কর নামে ৪৫ বছর বয়সী এক সদ্যজাত যুবক ভালোবেসে ফেলেছিল নন্দিনী নামের এক বিদ্যুৎ-শিখাকে। গেরিলা-যুদ্ধের মতন তাদের গোপন ভালোবাসাবাসির নিত্য সঙ্গী ছিলাম আমি। আর নিজের খাতায় রোজ টুকে রাখতুম তাদের আবীর-মাখানো কথোপকথনগুলো।”
ওপরের অংশটা একদা পড়েছিলাম পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘কথোপকথন’-এর ভূমিকায়। সেই প্রথম নন্দিনী আর শুভঙ্করের সঙ্গে আলাপ। ইদানীং আবার কলকাতার পথেঘাটে মাঝে মধ্যেই নীরার মতো নন্দিনীর সঙ্গেও দেখা হয় আমার। কখনও সে রক্তকরবীর পাতা থেকে নেমে আসে, কখনও বা কথোপকথনের স্কেচ সত্যি করে জেগে ওঠে পথে এলোচুলেএমন কী ফেসবুকেও মাঝে মাঝে লেখে আজকাল। যে নন্দিনীর ঘরবসত অন্য কোনো দেশে। ওর ফ্রেন্ডলিস্টে শুভঙ্করকেও পেয়ে গেলাম সেদিন। আর শুভঙ্করের প্রোফাইল দেখতে গিয়ে চোখে পড়ল এই কথোপকথন। নন্দিনীর বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র আমার জন্যই ওরা খুলে রেখেছে এটা।


নন্দিনী - শুভঙ্কর, তুমি ফেসবুকে!
          অনেক খুঁজে পেয়েছি তোমাকে। (ফিলিং হ্যাপি)
          চিনতে পারছ?  নন্দিনীকে?
          খোঁজনি নিশ্চয় কখনও আমাকে? (ফিলিং মনখারাপ)
         
          কতদিন পরে মনে পড়ে আজও?
          সেইসব কথা?... কেমন আছ?  (ফিলিং নস্টালজিক)

শুভঙ্কর – আরে নন্দিনী? তোমাকে ভুলব?
          আমি ভালো আছি, তুমি কি করছ?
          ওদেশে এখনও? চাকরি না গৃহ?
          ছেলেমেয়ে আছে? কোন ক্লাস হল?


নন্দিনী – অ্যাই শুভঙ্কর, মনে আছে তোর?
          রামধনু রাঙা সেইসব ভোর? (ফিলিং এক্সাইটেড)
          অথবা, বিকেল বিষণ্ণমাখা?
          কী হবে জেনে আমাদের কথা? (ফিলিং লস্ট)

          বিয়ে করেছিস? প্রেম করে? বোঝো!
          আমার থেকেও বেশি কাউকে
          বেসেছিস ভালো? এ জনমে আজো?
          স্ট্যাটাস দেখেছি। সুন্দরী বুঝি? ছবি নেই কেন? (ফিলিং কৌতূহলী)

শুভঙ্কর – ওসব কথা বাদ দে দেখি।
          এখনও তো তুই তেমনই পোড়ামুখী!
          বইটই পড়িস, আজকাল আর?
          নাকি এখন শুধুই সংসার?
          লেখালেখি, গান – ছেড়েছিস আবার?

নন্দিনী – যা ইচ্ছে পড়ি, যা ইচ্ছে করি।
          কার তাতে কি? বাঁচি না মরি?
          এখনও দেখছি কবিতা লিখিস -
          কাকে নিয়ে সব বউ না প্রেমিকা? ছবিও আঁকিস? (ফিলিং হিংসুটে)

তোর বইগুলো সঙ্গেই রাখি,
          শেষ হয়ে গেলে ফুরায় যদি –
          ব্যাগে রেখে দিই, রোজ, নিরবধি।
          পাতা ওলটাই, পড়িনা কখনও।
          মনে আছে সব, ভুলিনি তো কোনো।
          ফেরত দেবনা, ধরে নে এখনও। (ফিলিং দুঃখী)

অ্যাই শুভঙ্কর, কথা বল, কি রে?
চিরকাল আমি মরি গলা চিরে! (ফিলিং হরিবল্‌)
কলকাতা এলে, একদিন আয়, কফিহাউসে একা -
বহুকাল পরে সেই টেবিলেই, করবি তো দেখা? (ফিলিং লোনলি)

শুভঙ্কর – তুই কথা আর আমি নীরবতা
এমনিই তো ছিল চুক্তিপত্র।
তোতে আমাতে দেখা হবে ঠিক,
এক সমুদ্র দূরত্ব মাত্র।

নন্দিনী – কোনোদিন হবে? বল ঠিক করে... (ফিলিং পা ঠোকা)
শুভঙ্কর – ঠিক হবে দেখ, হয় ধাপার মাঠে নাহয় ওপারে।
নন্দিনী – আবার ঠাট্টা, এই জন্যেই দুচোখের বিষ। (ফিলিং দাঁত কিড়মিড়)
শুভঙ্কর – ক্ষেপী তুই থাম, তোদের ওখানে রাত হল ঢের, শুয়ে পড়িস।
নন্দিনী – মাথায় একটু হাত বোলাবি? মনে মনে তবু?
পোর্তোপ্লাতার সমুদ্রতীরে নিয়ে যাবি অপু,
আমাকেই শুধু? (ফিলিং ফোঁপানি)

শুভঙ্কর – হুঁ...চুপ কর দেখি, চুলগুলো ঘাঁটি।
চিঠি লিখবি? কোথায় থাকি?
ঠিকানা তো তোর মনে শুধু –
এ ভূবনে আর কোথাও না বাকি।

ঠিকানাপত্র? ডিজিটাল বা পোস্ট অফিসের?
খুঁজিস না কভু, সেথা আমি নেই, শেষে বলে রাখি।



'অন্যনিষাদ' ব্লগজিন, ২০১৬



কথোপকথন -৮

- তুই গাছ হবি নন্দিনী?

- নাহ্‌, এই বেশ ভালো আছি রে শুভঙ্কর। যেখানে ইচ্ছাই চলে যেতে পারি।

- তুই গাছ হলে, একটা পাখি হতাম আমি, বাসা বাঁধতাম তোর ডালে। রোজ খড়কুটো মুখে              করে নিয়ে এসে জড়ো করতাম একটু একটু করে। ভুরু কুঁচকাচ্ছিস কেন? অন্য কারোর সঙ্গে             নয়, ধরে নে, একাই থাকতাম সেই বাসায়।

- আর যেদিন সেই গাছের গুঁড়ির গায়ে মানুষের কুঠার এসে পড়তো? টুকরো টুকরো করে                কাটত আমায়, তোরই চোখের সামনে? তোর বাসা যেত ভেঙে? সেদিন? সেদিন কি করতিস?          দেখছিস না চারদিকে তাকিয়ে কংক্রিটের মহীরূহ গড়তে গাছেরা পড়ছে কাটা? দেখছিস না               আমাদের ছায়ার কোনও দরকার নেই! দরকার নেই আশ্রয়ের!

- মানছি। তবু ভাবতে ইচ্ছে করছে তোর ওই সবুজ শাড়িটা দেখে, তোকে একটা মস্ত বড় গাছ             আর তার বুকের আশ্রয়ে আমি একটা ছোট্ট পাখি। ধর, যদি বনের গাছ হতিস?

- অনেক গাছের মধ্যে চিনতে পারতিস আমায়? অন্য কারো ডালে বাসা বাঁধতিস না তো?

- ঠিক পারতাম। তোর গায়ের গন্ধ, তোর আঁচলের খসখসানি ওই সব আমার চেনা।

- আর যদি বন কাটতেও হাজির হত মানুষ? অথবা জমি দখল করতে আগুন লাগিয়ে দিত               বনে? ধূ ধূ রাঙা আগুনে পুড়তে থাকতাম আমি সঙ্গীসাথীদের নিয়ে নিঃশব্দে। তুই কি ডানা মুড়ে         বসে থাকতিস শেষপর্যন্ত? একসঙ্গে ছাই হওয়ার জন্য? কেমন জানি বিশ্বাস হয় না।

- থাকতাম।

- তারপর মানুষের খবরে কি বলত জানিস?

- কী?

- দাবানলে মৃতের সংখ্যা শূন্য।



'অন্যনিষাদ' -জুন ২০১৬



কথোপকথন

-      এত সকাল সকাল যে নন্দিনী?

-      জানো শুভঙ্কর, কাল রাত্তিরে মনে মনে একটা ছবি আঁকলাম।

-      বেশ তো। কী আঁকলে শুনি?

-      অন্ধকার ঘর। ঘরের মাঝখানে চেয়ারে আধশোয়া একটা মানুষ। আর তার সামনে খোলা দরজার ওপারে রোদ্দুর।

-      রোদ্দুরই আঁকলে যদি, তবে অন্ধকার আর রইল কোথায়? একটু হলেও কি আলো ঢুকছিল না সেই ঘরে?

-      ঢুকছিলই তো। আর অমনি মানুষটা উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে আবার অন্ধকারে এসে বসল। দরজা দিয়ে নাকি ঠান্ডা হাওয়া আসছিল!

-      ছবিটার নাম কী রাখলে তারপর?

-      ঘরটার নাম রাখলাম, সমাজ। আর ওই দরজাটার নাম, সংস্কার। বাইরের রোদ্দুরের নাম, মুক্তি। কিন্তু ছবিটার নাম রাখতে পারলাম না।

-      নন্দিনী, তাহলে নাম দাও আশা

-      ওই অন্ধকার ঘরে আশা কোথায় দেখলে শুভঙ্কর? ঠান্ডার ভয়ে যে আলোকেও ঘরে ঢুকতে দেয় না, তার জীবনে আশা কোথায়?

-      কেন! দরজার বাইরে যতক্ষণ আলো রয়েছে। ঠান্ডা কমে আসবে একদিন। রোদ্দুর তো  থাকবে, তাই না?

অন্যনিষাদ, মে ২০১৭

No comments:

Post a Comment