Wednesday, September 30, 2015

জীবন-মরণের সীমানা ছাড়ায়ে

ছোট থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীত আমার পরম বন্ধু। কবে থেকে যে গল্পের বইয়ের মতো গীতবিতান পড়তাম মনেও পড়ে না। উচ্চারণ স্পষ্ট হওয়ার আগেই 'দেবতোতো' বিশ্বাসের গান শুনি। আমার চিরকালীন প্রিয় দেবব্রত, সুচিত্রা মিত্র এবং অবশ্যই আমার মায়ের গান। মা নিজেও একসময় সুচিত্রা মিত্রের ছাত্রী ছিলেন। আমার যেটুকু যা গান শেখা সবটাই মায়ের কাছে। ছেলেবেলা থেকেই দুঃখে-সুখে আমার আশ্রয় রবীন্দ্রসঙ্গীত। একেবারেই যাকে বলে রাজদ্বারে-শ্মশানে চ...। মায়ের গানের কথা লিখতে গেলে তো মহাভারত হয়ে যাবে। একবার মনে আছে, মা দোতলায় গান শেখাচ্ছে, আমি সিঁড়ির একদম নীচে দাঁড়িয়ে আছি। শুনে শুনে তখনই তুলে ফেললাম, আমার বড় প্রিয় গান - 'নিবিড় ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রুবতারা, মন রে মোর পাথারে হোস নে দিশেহারা'। আহা শেষের লাইনগুলো কী অপূর্ব - 'রাখিও বল জীবনে রাখিও চির আশা, শোভন এই ভূবনে রাখিও ভালোবাসা।' ভাগ্যিস আমার এমন একটা মা যে আমাকে রবীন্দ্রনাথকে উপলব্ধি করতেও শিখিয়েছে। নাহলে বাঁচতাম কী করে?

আমাদের বিয়েতে কোনো অনুষ্ঠান হয়নি। কেবল আশীষদা আর আমি গান গেয়েছিলাম আর ঝুমলাদিদি আর আমার এক বন্ধু সারু নেচেছিল। আমার খুব ভালো লেগেছিল এই অংশটা। আশীষদার গলা ভারী চমৎকার।

কালান্তরে থাকতে সি পি আই-এর নেতৃস্থানীয় কারোর এক স্মরণসভায় গান গাইতে হবে। অফিসে কল্যাণদা যথারীতি চেঁচিয়ে যাচ্ছেন কে গান করবে? কেউ একটা গান জানে না কী আশ্চর্য! আমি অনেকক্ষণ চুপ। ভাবছিলাম কেউ যদি হাত তোলে। কিন্তু কেউ আর হ্যাঁ বলে না। অগত্যা বললাম, আর কেউ না গাইলে এ অভাগা আছে। 'আছে দুঃখ আছে মৃত্যু' গেয়েছিলাম। প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে মনে আছে। আমার আবার অমাইক গলা কী না। উতরে গেছিল আর কী। শুধু মায়ের কাছে ছাড়া কারোর কাছে শিখিনি এতে লোকজন একটু আশ্চর্যই হয়েছিল। এইজন্য আমি চিরকাল বাথরুমে গাই। যদিও বাথরুমে গাওয়ারও রিস্ক আছে। বিষ্ণুপুরে হস্টেলে থাকতে একতলার সব ঘর, রান্নাঘর পেরিয়ে বাথরুমে বসে রাত্তিরে যদি একটু শান্তিতে গলা ছেড়েছি কী ব্যস, থামা থামা। একমাত্র শ্বশুরবাড়িতে তিনতলার ছাদে গান করলে একতলায় নামলে টুনুমা বলত, বেশ গাইছিলি।

তবে যে গানের কথা মাঝে মাঝেই মনে পড়ে তা হল বাবার স্মরণসভায় ইরাবতীর গাওয়া গান। ইরাবতীর গলা ভারী মিস্টি। তার ওপর গানদুটোও খুব অদ্ভুত বেছেছিল। প্রথম গানটা গেয়েছিল, 'ছিন্ন শিকল পায়ে দিয়ে', আর তারপরে 'যারে নিজে তুমি ভাসিয়েছিলে'। বাবার মৃত্যুর পর সেই প্রথম চোখ দিয়ে জল পড়েছিল আমার। পরে আবারও ওদের বাড়িতে গিয়ে গানদুটো শুনেছি, অন্য গান ছাড়াও। যতবারই শুনি ওর মুখে, ততোবারই চোখে জল আসে আমার।

ইরাবতী আশীষদা আর ঝুমলাদিদির মেয়ে, অমিতাভ কাকা মানে কবি অমিতাভ দাশগুপ্তের নাতনী।

রবিবাবুর গান

আজ সকালে রবিবাবুর গান শুনলাম বিচিত্র গলায়, বিচিত্র সুরে কিম্বা অসুরেও বলা যায়। তাই তাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত বলা যাবে না অন্ততঃ আমার বিচারে। অনেককাল আগে রবিবাবু যখন ঠিক রবি ঠাকুর হয়ে ওঠেননি, তাঁর গান নানারকমভাবে গাওয়া হত। কিন্তু সেসব সামান্য যা শুনেছি তা গান বলেই বিবেচ্য। আর এখন তাঁর গান নিয়ে যা হচ্ছে তা বাংলা গানের ব্যর্থতার আরেকটা দিগন্ত বলা যায়। রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে বহু আগেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জাত গিয়েছিল দেবব্রত বিশ্বাসের। অথচ সেই কাজ একমাত্র তাঁরই সাজে। এবং তার সবকটিই সার্থক রবীন্দ্রসঙ্গীত। দেবব্রত যখন বলেন, ভেঙ্গেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময় - তখন দিব্য সেই জ্যোতির্ময়কে দেখা যায়, অনুভব তো করাই যায়। দেবব্রত যখন গেয়ে ওঠেন, আকাশ ভরা সূর্য তারা তখন মনের আকাশে সূর্য-তারা সব টপাটপ জ্বলে ওঠে। দেবব্রত যখন ডাক দেন, শুধু তোমার বাণী নয় গো হে বন্ধু হে প্রিয়, মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিও, তখন সে বন্ধুর সাধ্য কী, সব বক্তৃতা ফেলে তাড়াতাড়ি হাজির হয় প্রাণের মাঝে। অথচ এমন দেবব্রতকে 'ব্রাত্য' করা হয়েছিল রবীন্দ্রসঙ্গীতের দুনিয়ায়। আর আজ যারা রবিবাবুর গান নিয়ে ইয়ার্কি মারছে, নিজেদের লেখবার মত কলমের জোর নেই, গাইবার মত গলায় সুর নেই আর রবীন্দ্রসঙ্গীত বোঝার অনুভব শক্তি নেই তাদেরকে কী বলা যায় ভেবে পাই না, অথচ সর্বত্র তারা বেজেই যাচ্ছে, বেজেই যাচ্ছে। বাঙালির তালবোধ কোনোকালেই নেই, সুরটাও যাচ্ছে এবারে।

ছোটবেলায় প্রতিদিন আমরা গল্পের বই পড়ার মত গীতবিতান পড়েছি। অধিকাংশ গানই মুখস্থ ছিল, অনেকগুলো কন্ঠস্থও। আমি তো বাথরুম সিঙ্গার। কিন্তু যারা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে চায় তাদের উচিত আগে কথাগুলো হৃদয়ে উপলব্ধি করা, সুরকে মরমে পৌঁছানো। আগে তো দেবব্রতর পায়ের নখের যুগ্যি হতে হবে, তারপরে এক্সপেরিমেন্ট। ভীষ্মলোচন শর্ম্মাদের জ্বালায় বেচারা রবি শর্ম্মার অবস্থা একেবারে যাচ্ছেতাই।


সত্য সেলুকাস...

Tuesday, September 29, 2015

দায়িত্ব অথবা থ্রিলারও বলা যেতে পারে/ হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল পার কর আমারে

যেচে পরের মানে অপরের দায়িত্ব নেওয়া এবং যেচে গালে চড় খাওয়া অনেকটা সমার্থক। অনেকসময় চড়টা নিলেও খেতে হয় আবার না নিলেও। অন্ততঃ আমার নিজের অভিজ্ঞতাটা একেবারেই তাই।

বর্তমান -

আমার ঠিক পরপরই শঙ্করীদির ভাইরাল জ্বর ইত্যাদি হয়েছিল। আমি বারবার ডাক্তার দেখাতে বলেছিলাম তিনি দেখাবেন না। প্রথম কদিন কিনে খেয়েই চলল। আমার নিজের প্রায় বছরখানেক ধরে টানা একের পর এক এবং গত কয়েকমাস ধরে প্রায় প্রতিদিন ভুগে যে অবস্থা তাতে খুব বাধ্য না হলে রান্না করার মতো অবস্থায় নেই। এর আগে হয়েছে, যখন উনি আমাদের বাড়িতে থাকতেন না, আমার অসুখ করলে মেয়ে আর মেয়ের বাবা মিলে সামলে নিত। এখন উনি কাউকে কাজ করতেও দেবেন না, আবার সামান্য কিছু করতে বললেই উদয়াস্ত আমাকে মুখ করে যাচ্ছেন। একবারও মনে পড়ছে না যে উনি মাত্র কয়েকদিন অসুস্থ আর আমার টানা চলছেই। কারণ আমি মুখে কষ্ট হচ্ছে বলতে পারছি না, তাই ওনার ধারণা আমি দিব্য সুস্থ। উনি সারাদিন এই করে যাচ্ছেন আর আমি নিজেরই বাড়িতে চোরের মতো দিন কাটাচ্ছি। একবার রান্নার কথা বলেছিলাম, তো বললেন আমি নাকী অনেক বাসন করি, যেন আমি বাসন মাজতে পারব না। কী যে জ্বালা, পাছে ম্যালেরিয়া,ডেঙ্গু হয় তাই মায়ের জন্য রাখা বিছানা-মশারিও ছেড়ে দিয়েছি। তারপরেও গাল খেয়ে বেঁচে আছি।
এখন প্রায় বাড়ি থেকে পালাতে পারলে বাঁচি গোছের অবস্থা আমার।

অতীত -

এতো তাও অল্পের ওপর দিয়ে যাচ্ছে, এর আগে তো দায়িত্ব না নেওয়ার জন্য প্রায় এক ভদ্রমহিলার আত্মহত্যার চার্জ ঘাড়ে পড়েছিল বা এখনো পড়ে আছে। আমার এক অতি বড়লোক ননদ ছিলেন যিনি সামনে লক্ষ টাকার হীরের হার দেখাতেন তাঁর মধ্যবিত্ত আত্মীয়স্বজনকে। শুনেছি ভাইয়ের বউ খুব খারাপ হওয়ায় ভাইয়ের কপালের কথা ভেবে অনেক চোখের জলও নাকী ফেলেছেন। বাড়িতে আমার থেকেও বেশি দায়িত্ব নিতে হয় অবশ্য আমার এক জা-কে। সম্প্রতি দায়িত্ব নেওয়ার ক্রমাগত চাপে বেচারি কিছুদিন হল মানসিক অসুস্থই হয়ে পড়েছে। যাইহোক আমার অনেক সৌভাগ্য যে এই ননদ কখনো আমার বাড়িতে থাকেনি। কারণ ওই জায়ের কাছেই শুনেছি তাদের বাড়িতে কী কী কান্ড করেছে। সে বছর আমার জায়ের ছেলের মাধ্যমিক ছিল। তারমধ্যে শ্বশুরবাড়ির সবচেয়ে বড় জেঠিশ্বাশুড়ির এখন-তখন অবস্থা। এই ভদ্রমহিলা অল্পবয়সে যৌথ সংসারে এসে চিরকাল লাঠি ঘুরিয়ে গেছেন। এমনকী আমার ওই জায়ের ওপর চিরকাল অকথ্য অত্যাচার করে গেছেন। নিজের সন্তান ছিল না বলে অন্যদের সন্তান সহ্য করতে পারতেন না। অথচ বাড়ির সকলেই দেখেছি বিস্তর ভক্তিশ্রদ্ধা করত। কারণ এই পরিবারটা যখন বাংলাদেশ থেকে চলে আসে তখন নাকী তাঁরা স্বামী-স্ত্রীই সব করেছিলেন। কিন্তু এরজন্য  তৃতীয় পুরুষ পর্যন্ত সবাই কেন হাতজোড় করে থাকবে তা আমার মোটা মাথায় ঢোকেনি। আমি ছোট থেকেই মায়ের কাছে শুনেছি মায়ের দাদু ডঃ বেণীমাধব বড়ুয়ার বাড়িতে পার্টিশনের আগে পরে প্রচুর আশ্রিত ছিল। কিন্তু সেটা খুব স্বাভাবিক হিসেবেই তখনকার দিনে মনে করা হতো। দৈবক্রমে এদের বড়জেঠুও ছিলেন বেণীমাধব বড়ুয়ার তেমনই একজন আশ্রিত। এবং তাঁর চাকরিবাকরি করে কলকাতায় থাকা সবই হয়েছিল আমার মায়ের দাদুর কল্যাণে। একথা তিনি আমাকে নিজের মুখেই বলেছিলেন। তাই ভাবলুম এদের বরং আমার মায়ের দাদুর প্রতিনিধি হিসেবে আমার ওপরে কিঞ্চিৎ কৃতজ্ঞতা থাকা উচিত। কিন্তু দেখলাম না কোনদিনই। তবে আমার ওই জা-টা বড্ড বোকা, তাই চিরকাল পড়ে পড়ে মার খেল। আমাকেও কোনদিন বলেনি, তাহলে আজ ওর এই অবস্থা হতো না। যাইহোক, সেই জেঠিশ্বাশুড়ি তো এসে পড়লেন শেষ অবস্থায় আমাদের কাছে। মরণাপন্ন রোগী বাড়িতে ওদিকে আমার মেয়ের অ্যানুয়াল পরীক্ষা চলছে।

এদিকে তার কয়েকমাস আগে থেকে আমার সেই ননদ প্রতিদিন ফোন করছেন তাঁর দাবী যে স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলে তাঁর ওপর অত্যাচার করছে তাই ভাই তাকে উদ্ধার করুক। প্রায় মাস তিন-চার ধরে দিনে চার-পাঁচবার কয়েক ঘন্টা করে ফোন চলছে। সে একেবারে থ্রিলার গল্পের মত। ছেলে সম্পত্তি কেড়ে নিয়েছে, এখন মেরে ফেলতে চায় ইত্যাদি। যতদিন অর্থ ছিল ততদিন অবশ্য আমাদের বিশেষ খোঁজটোঁজ করতেন না। কলকাতার দুটো ফ্ল্যাট বেচে তার তিনগুণ সাইজের দুটো ফ্ল্যাট কিনেছিলেন বাঙ্গালোরে, আর বেনারসে নিজেদের বাড়ি। যত দায়িত্ব যথারীতি আমাদের দুই পরিবারের। তবে এতদিনে আমার ওই জায়ের মাথায় বিন্দুমাত্র বুদ্ধি খুলেছিল, আমায় বলল, এনে বৃদ্ধাশ্রমে রাখুক, খরচা দিক সে যাইহোক, বাড়িতে রেখো না। তুমি যেরকম, কিছুদিন পরে তোমাকেই বাড়ি থেকে বার করে দেবে। তাই ছেলেমেয়ের পরীক্ষার ইত্যাদি বলে আমরা দুজনেই একটা বিষয়ে চুক্তি করলাম যে কিছুতেই বাড়িতে রাখব না, একদিনের জন্যও না। বাড়ির অন্যদের চোখে দায়িত্ব নিতে না চাওয়ায় খারাপ তখন আমরা হয়েই গেছি, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ তো মরিয়া হয়েই যায়। তারমধ্যে বাড়িতে একজন মারা যাচ্ছে, কী ভয়ানক অবস্থা।
বড় জেঠিমা মারা গেলেন। সেই খবর পেয়ে ওই ননদ নাকী খুব কান্নাকাটি করেছিল, স্বাভাবিক মায়ের মতো তো। যাইহোক তাঁকে জানানো হোলো যে আমরা কেউ তাঁকে এক দিনের জন্যও বাড়িতে থাকতে দিতে রাজি নই। পরেরদিন তাঁর বন্ধ ঘর থেকে সিরিয়াস অবস্থায় উদ্ধার করা হয়, হাসপাতালে মারা যান। এটা তাঁর ছেলের বয়ান। আমরা রাজি হলে হয়তো বেঁচে যেতেন তাই বুঝলাম আমরা দুজনে। এটা হত্যা না আত্মহত্যা জানিনা, দায়ী কে তাও না? তবে তালিকায় আমাদের দুই জায়ের নাম আছে তা বুঝেছি।

আর ওই বড় জেঠিমা তাঁর সম্পত্তির কানাকড়িও শ্বশুরবাড়ির কাউকে দিয়ে যাননি। আমি অবশ্য চিরকাল শুনে এসেছি আমার মেয়ের বাবা নাকী তাঁর নিজের ছেলের মতো! তা শেষসময়ে সেটা নিজের চোখেও দেখলাম। আর যে মেয়েটা সারাজীবন মার খেল তার ভাগ্যেও কিছু জুটবে না সেটা বেচারী সহ্য করতে না পেরে অসুস্থই হয়ে পড়ল এই অসম্মানে। তাঁর পরেও সেই জেঠিমা নিত্য পুজিত।

বাব্বা যৌথ পরিবারের খুড়ে খুড়ে নমস্কার।

ভবিষ্যত -

এখনও আছেন এক মাসি। তিনি বিয়ে করেননি। নিজের টাকা প্রচুর এবং যথেচ্ছ নয়ছয় করেন। আমার অসুখের সময় এসে ফোঁস ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে গেলেন আমি তো একাই থাকি, আমাকে কে দেখে। অথচ যখনি দরকার-অদরকার হয় বউমা আজ থাকব। কী মুশকিল, আমি কি ওনাকে বিয়ে করে ছেলেপুলে হতে বারণ করেছিলাম? আমাকে লোকে যদি একটু যত্ন-আত্তি করে তারজন্য কম পরিশ্রম তো করিনি, বিয়ে করেছি খেটেখুটে, মেয়ে হয়েছে। কষ্ট না করলে কেষ্ট পাওয়া সোজা নাকী?

এনার শেষসময়ে আমার হাল কী দাঁড়ায়, কতটা দাগী আসামী তাই ভাবি মাঝে মাঝে!


হরি দিন তো গেল, সন্ধ্যা হল, পার করো আমারে...

লেগে যা লেগে যা

ইদানীং প্রায়ই দেখি নিজেদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা মরছে। এভাবে কিছুটা ময়লা সাফ হলে মন্দ না। তবে মরে অবশ্য সবসময়েই উলুখাগড়ার দল। নেতারা এ সি ঘরে বসে রাজ্য চালান। আহা, তাঁদের নিজেদের মধ্যে একটু ভালোরকম লেগে যাক, বেশ ধপাধপ ধপাধপ মরতে থাকুক। লোকসংখ্যা যত্ত কমে তত্ত ভালো।


লেগে যা লেগে যা, নারদ নারদ...

বাজারি লেখা

আজকাল লেখালেখি করে সম্মান অথবা অর্থ পেতে গেলে দু'তিন রকমের নিয়ম নিষ্ঠাভরে মেনে চলতে হয়। হয় বাজারি হতে হবে, নয় বুদ্ধিজীবী হতে হবে, নাহলে অন্ততঃ বুদ্ধিজীবী বা রাজনৈতিক ধামাধরা হতে হবে। নাহলে ভালো লিখলেও প্রকাশকেরা পুছবে না। তাঁরা দৌড়াবেন তুলনায় নিম্নমানের বাজারি লেখার দিকে অথবা প্রচারের আলোকে থাকা বুদ্ধিজীবীদের দিকে। আমার সুচিত্রা ভট্টাচার্য কী তিলোত্তমা মজুমদারের অধিকাংশ লেখাই খুব নিম্নমানের লাগে। কিন্তু এঁরাই জনপ্রিয়, যাকে বলে হটকেক। আমার মায়ের নাম পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষই জানেন না। অথচ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখিকা এই তকমা পাওয়ার যোগ্যতা তাঁর কলমে আছে। কিন্তু তিনি বাজারি লেখা লেখেন না। এ সি ঘরে বসে সাধারণ মানুষের জন্যে চোখের জল দেখিয়ে লেখেননি, বরং যাঁদের কথা লিখেছেন তাঁদের সঙ্গে সত্যিকারের মিশেছেন তাঁদের মুখে নিজের ভাগের ভাত তুলে দিয়েছেন। দেশ-বিদেশ ঘোরার মত অর্থ তাঁর কোনোদিনই ছিল না। কোনোদিন কারোর ধামা ধরেননি। অতএব তিনি মারা গেলে কোথাও এক কলমও লেখা হবে না, বাংলা সাহিত্যে গেল গেল রব উঠবে না। তাই যখন কোনো প্রকাশক অথবা লেখক আমার মায়ের নাম আলপনা ঘোষ বলিনি কেন জিজ্ঞাসা করেন, আমিই আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করি আপনি চেনেন নাকি তাকে? মানে তাঁর প্রকাশিত বইয়ের তালিকায় কিন্তু মায়ের বই থাকে না।


আমার মাকে নিয়ে আমি অন্ততঃ খুবই গর্বিত। কারোর কাছেই কলম বেচেনি বলে। আর বাংলা সাহিত্যে বেঁচে থাকতে সত্যিকারের সম্মান খুব কমই পেয়েছেন গুণীজনেরা। এ আর নতুন কথা কী। একমাত্র দেবেশ মামা আর রুশতীদিকে দেখেছি মায়ের লেখার সত্যিকারের কদর করতে, আর কাউকে নাহ্‌।

Monday, September 28, 2015

স্বপ্নের ফেরিওলা

এদিকে তো রাজকন্যা গুলিসুতো খেয়ে ফেললো থুড়ি ডিজিটাল ইন্ডিয়া হয়ে গেলো। ভাত-ডাল, নিদেনপক্ষে জলও জুটবে না, ওদিকে আন্তর্জালে দেশ ছাইল। মন্ত্রীমশাই বিদেশে গিয়ে এমন ভেল্কী দেখাচ্ছেন, সত্যি এযাবত কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। ওই যাহ্‌, স্বপ্নের কথা বলতেই মনে পড়ে গেল, কেষ্টপুরে মেয়েকে নিয়ে বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে আছি আর মাইকে দিদির স্বপ্ন বাজছে। দিদি স্বপ্ন দেখছেন আর দেখাচ্ছেন - আগামী বর্ষায় আর ভেনিস নয়, কলকাতা লন্ডন হচ্ছেই হচ্ছে। শুধুই স্বপ্ন দেখে যেতে হবে্‌...। যেত্তেই হবে...। ধুত্তোর মাথার মধ্যে কেমন ক্রমশঃ চিড়বিড় করাটা বাড়ছিল, এমনিতেই শরীরটা জুতে না থাকলে মাথা একটুতেই গরম হয়, তারমধ্যে একদিনে এত ওভারডোজ!

ভাগ্যিস বাসটা এসে গেল। বক্তার গলা টিপে দিতে ইচ্ছে করছে সেই মুহূর্তে চেঁচিয়ে মেয়েকে বলছিলাম।


যাকগে, এ যাত্রা বেঁচে গেল। ফের যদি স্বপ্ন স্বপ্ন বলবি তো তোর একদিন কী আমার একদিন এই না বলে...

বিচার

মানুষকে ভালোবাসা যেতে পারে, মন্দবাসাও। কিন্তু কাউকে বিচার না করাই ভালো। জীবনে একজনকে আমি কোনোদিন ভালোবাসতে পারিনি, এমন কী ক্ষমা করতেও পারিনি। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে সে আমার যা ক্ষতি করেছে আজ পর্যন্ত আর কেউ তা করেনি। তিনি আমার মাতৃস্থানীয়া একজন এইটুকুই শুধু বলতে পারি। সেইসময়ে আমার মানসিক স্থিতি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, এবং যে আমি কোনোদিন বড়দের মুখের ওপর কোনো কথাই প্রায় বলিনা, সেই আমিও খুব মন্দ কথা বলেছি এবং খারাপ ব্যবহার করেছি নিয়মিত। তারপর দীর্ঘ চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠলেও সেই ঘটনার রেশ আজও আমার মনে আছে। আমার মানসিক স্থিতি নষ্ট হওয়ার জন্য একমাত্র উনিই দায়ী ছিলেন বলিনা, কারণ আমার এপিলেপ্সি এবং হিস্টিরিয়ার দীর্ঘ ইতিহাস ছিল। কিন্তু তাঁর শারীরিক-মানসিক অসুস্থতার কোন দায় বহন করার দায় আমার ছিল না, যা আমাকে বাধ্য হয়ে করতে হয়েছিল। তাঁর শারীরিক অসুস্থতার সময়ে আমার পক্ষে যখন যেটুকু করা যায়, সুস্থ থাকলে করেছি। আমার মৃতদেহ ছুঁতে একটাসময় পর্যন্ত আতঙ্ক হত এমন কী দেখতেও, তাও কাটাতে হয়েছে তার ক্ষেত্রেই। মারা যাবার পর একেবারে মনখারাপ লাগেনি  তা বলব না, যেটুকু লেগেছিল সেটুকু সত্যি ছিল, তা হয়ত একসঙ্গে দীর্ঘদিন বসবাসের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে। কারণ মৃত্যুর কিছুদিন আগেও যখন আমার হাত ধরে জিজ্ঞাসা করেছেন, তুমি আমায় ভালোবাস তো? আমি চুপ করে থেকেছি, মিথ্যা কথা বলতে পারি না তাই। করুণা হয়েছিল সেদিন এইটুকুই। সেই অর্থে আমি ভীষণ নিষ্ঠুর তো বটেই।

আমি তাঁর জায়গায় দাঁড়িয়ে পরে ভেবে দেখেছি হয়তো ওই আচরণ অস্বাভাবিক ছিল না। যদি অস্বাভাবিককে স্বাভাবিক বলে ভেবে নেওয়া যায়। নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে মনে হয়েছে, এখন হলে ইগনোর করতাম, তখন ফালতুই অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে নিজের অসম্ভব ক্ষতি করেছি।

সবচাইতে ক্ষতি হয়েছিল আমার লেখালেখির। যেকোনকারণেই হোক সেইসময় থেকে আমার কবিতা লেখা একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গদ্য লেখাতে ফিরতেও সময় লেগেছিল।

এতবছর পর যে মানুষটা আমার কবিতা ফিরিয়ে দিয়েছে তার কাছে আমি অসীম কৃতজ্ঞ। কে জানে একটু একটু করে পুরোনো বাধাগুলো পেরিয়ে আসছি যখন, অল্পবয়সের সেই অস্বাভাবিক দিনগুলোর স্মৃতিও কাটিয়ে উঠব নিশ্চয়।

আমি নিজে ভালো বা সবাইকে ভালোবাসতে পারি এমনটা মনে করিনা কখনোই। ভালোমন্দে মিশিয়েই মানুষ হয়। আমিও মানুষ মাত্র। একেবারেই ছাপোষা।


শুধু বুঝেছি কাউকে বিচার করতে নেই। বিচার করবার কোনো অধিকারই নেই। 

Sunday, September 27, 2015

ভালোবাসা

যারা বলে সারাজীবনে কেবলমাত্র একজনকেই ভালোবাসা যায়, তারা ভয়ানক অভাগা। জীবনে তিনশ তেত্রিশ জনকে তিনশ তেত্রিশ রকমের ভালোবাসা যায়। দিব্যি যায়। নাহলে জীবনের অর্ধেক আনন্দই মাটি। ভালোবাসা শীতকালের রোদ্দুরের মতো পিঠ দিয়ে বসে কমলালেবু কিম্বা মায়ের রোদ্দুরে শুকোতে দেওয়া আচারের কুল খাওয়ার মতো, রোদ্দুরে দেওয়া জলে চান করার মতো, মায়ের আঁচল কিম্বা হাতে তৈরি কাঁথার মতন। ভালোবাসা ভাইয়ের সঙ্গে খুরপী হাতে বাগানে ঘুরে বেড়ানোর মতো, টেবিলের তলায় ঢুকে জীবনের একমাত্র গল্পটা সাড়ে ছেষট্টিবার বলার মতো, দাদাকে কেউ মারলে তাকে তিনটে ঘুঁষি মেরে আসার মতো, বন্ধুর সঙ্গে পথ হাঁটা আর আবোল-তাবোল গল্প করার মতো। ছোটবেলার বন্ধুর হাত ধরে টেনে নিয়ে আচার খাওয়ানোর মতন।

ভালোবাসা ডায়েরি অথবা কবিতা লেখার মতো। পুরোনো চিঠি খুলে পড়া অথবা পুরোনো ডায়েরির পাতায় রাখা শুকনো হলুদ গোলাপের মতো, রাস্তায় একা একা কাঁদতে কাঁদতে যাওয়ার মতো, আবার কখনো কখনো পেছনে পেছনে কেউ মানাতে মানাতে আসার মতো। ভালোবাসা একা একা মনখারাপের বৃষ্টিতে ভেজার মতো। ভালোবাসা কারোর সঙ্গে এক ছাতায় অর্ধেক ভেজা কিম্বা ছাতা ছাড়া আপাদমস্তক ভেজার মতন। যার সঙ্গে চারবেলা দেখা হয় তার সঙ্গে রাস্তায় দেখা করে বেঞ্চিতে পাশাপাশি বসে খাবার খাওয়ার মতন কিম্বা হাত ধরে হাঁটার মতন। ভালোবাসা বেচারা মাকে জানলার ধার ছেড়ে দিয়ে নিজে ভেতরের দিকে বসার মতন। ভালোবাসা মাঝ রাত্তিরে গা থেকে সরে যাওয়া চাদর টেনে দেওয়ার মতো।

ভালোবাসা অন্যের প্রেমিকা পাছে রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে থাকে, তার জন্য সময় নষ্ট করে প্রক্সি দেওয়ার মতো, কিম্বা অন্যের প্রেমিকা ক্লান্ত হয়ে এলে এক গ্লাস লেবুর সরবত বানিয়ে দেওয়া এবং মেয়েটির সেই সরবতের তলার চিনি আঙুল ঢুকিয়ে চেটে চেটে খাওয়ার মতো। ভালোবাসা অনেকদিন পর পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার মতো। অনেকদিন পর দেখা হয়ে বলা, তোকে একদম ভুলিনির মতো। ভালোবাসা গুড ফর নাথিং অথবা হোপলেস বন্ধুর সঙ্গে কুড়ি বছর ধরে টানা বন্ধুত্ব রেখে যাওয়ার মতন, এমনকী যেকোনো সময় হাঁক পাড়লে হাজির হওয়ার মতন অথবা যেকোনো সময় সে বিনা নোটিশেও হাজির হলে আশ্চর্য না হয়ে নিজের ঘর ছেড়ে দেওয়ার মতন। ভালোবাসা একটুও না চেনা কারোর জন্য ভীষণ দুশ্চিন্তায় থাকার মতন। ভালোবাসা উত্তর না দিলেও পুরোনো বন্ধুকে ফোন, মেসেজ করেই যাওয়ার মতন। প্রিয়বন্ধু গাল দিলেও শুনতে পাচ্ছিনা, আমার তো কোন কষ্টই হচ্ছেনা গোছের হাসিমুখের মতন। ভালোবাসা আপন ভেবে অন্য কারোর সন্তানকে কোলে নেওয়ার মতন।

ভালোবাসা আমার মত কারোর সঙ্গে সতের-আঠেরো বছর স্রেফ ধৈর্য ধরে কাটিয়ে দেওয়ার মতন।

ভালোবাসা সে কী আর চাট্টিখানি কথা! সে হাড়ে হাড়ে জানে আমার আশেপাশের মানুষজন।
আর কে যেন বলল, ভালোবাসা বারবার ধাক্কা খেয়েও আবার বেসে যাওয়ার মতন। অথবা আমি বলি কী চমৎকার একটা বই পড়তে পড়তে সারারাত কাটিয়ে দেওয়ার মতন। হঠাৎ একটা ভোরবেলার মতনও।


ভালোবাসা মাঝে মাঝে কারোর জন্যে হারা উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ার মতন। তার সঙ্গে কোথাও না কোথাও ঠিক একদিন দেখা হয়ে যাবে এই আশাটুকুর মতনও।

বেঁচে থাকার রকমফের

কালকে কলামন্দিরের সামনেটায় অনেকক্ষণ বসেছিলাম, বসে বসে দেখছিলাম। মানুষ দেখতে বড় ভালোে লাগে আমার। বড় বিচিত্র জীব কী না। একটা বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির পত্রিকার তরফে অনুষ্ঠান ছিল। তাই এথনিক শাড়ি-পাঞ্জাবীতে মাপমত সজ্জিত মানুষজন জমছিল একটু একটু করে। ওরই মাঝে বেমানান আমি চান করিনি, চুল আঁচড়াইনি গোছের (আক্ষরিক অর্থে, মানে সকালে বেরিয়েছিলাম, আবার জামা ছাড়তে হবে সেই আলসেমীতে সত্যিই স্নান করিনি। তারপর সেই জামা পরেই এক ঘুম দিয়ে উঠে কোনোমতে চুলে একটা গার্ডার আটকে), কোঁচকানো জামা আর ঢলঢলে পালাজো পরে। আসলে এটাতে আমার সবচেয়ে আরাম লাগে।

চোখে পড়ল চেনা-অচেনা বুদ্ধিজীবীদেরও। মায়ের সুবাদে এদের অনেকেই আমার আপাত পরিচিত। যদিও আমি দূরত্ব বজায় রাখতে মানে দূর থেকে বন্ধ টিভির মতোই দেখতে পছন্দ করি। কাছে গেলে সবই তো সেই বাংলা সিরিয়াল। আমার আজকাল এই বুদ্ধিজীবী ক্লাসটাকে ভীষণ ঘৃণাও লাগে আবার করুণাও। মাঝে মাঝে মনে হয় সারাক্ষণ মেপে মেপে চলতে চলতে কখনো ওদের হাঁপ ধরেনা? কখনো ভীষণ ওই সাজানো মুখোশটা খুলে ফেলে স্বাভাবিকভাবে বেঁচে উঠতে ইচ্ছে করে না? কী করে মানুষ সারাক্ষণ মাপমতো হাসে, কথা বলে, গোঁফ-দাড়ি কাটে অথবা রাখে, হাঁটে, ওঠে-বসে? কী করে কখনো তরাজু কাঁপে না ওদের? কী ভয়ানক জীবন! নিশ্চয় ভালোবাসে অথবা রাগও করে মেপে মেপে। মেপে ঘুমায়, মেপে জাগে। উফফ...ভাবতেই কী ভীষণ খারাপ লাগে আমার। এরা কক্ষণো সক্কাল বেলা আমার আজ কাউকে ভালোলাগছে না, কিচ্ছু ভালোলাগছে না বলে বেরিয়ে পড়তে পারবে না। এরা জীবনে কোনোদিন হারা উদ্দেশ্যে হাঁটতে পারবে না কারোর জন্যই। সারাক্ষণ ঈশ্বরের মতো সর্বশক্তিমানের অভিনয় করে যেতে হবে। একটাই জীবনে এভাবে বেঁচে থাকা...!!

আজকের সবথেকে সন্দেহজনক, সবথেকে সুবিধাবাদী ক্লাস কিন্তু এরাই। ঈশ্বরের বরপুত্রের মতো ভক্তেরা ঘিরে থাকে এদের। কথা অমৃতসমান। দেখলেই কেবল বিরিঞ্চিবাবার কথা মনে পড়ে যায় আমার। সূর্য-চন্দ্রেরা আজকাল এদের আদেশেই চলছে কী না। যত ভালো লেখাই লিখুন, ভালোলাগে না পড়তে, মনে হয় সেসবও নিজের একটা বিজ্ঞাপনী প্রচার মাত্র।


নাহ্‌, মা ঠিকই বলেছে, বুদ্ধিজীবীরাই আমাকে সুপারি দেবে।

লাবণ্যর জন্যে

ঢাকা থেকে লাবণ্য এসেছে কলকাতায়। ফেসবুকে আমার সঙ্গে সামান্য পরিচয়। আমাকে ও ভালোবাসে। কেন যে ভালোবাসে তা ওই জানে। ওর ভারী মিস্টি একটা ছেলে আছে - শঙ্খনীল। ফেসবুকে নীলের ছবি দেখে আমার ছোট্টবেলার একটা বন্ধুর কথা মনে পড়ত। অমনিই মিস্টি আর শান্ত ছেলে ছিল।

লাবণ্য বলেছিল, গতকাল কলামন্দিরে আসবে একটা অনুষ্ঠান দেখতে কারো সঙ্গে। কলকাতা ও একেবারেই চেনে না। আমি যদি যাই দেখা হবে। শরীর এখনও খুব দূর্বল। যেতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু শরীরে দেবে কী না বুঝতে পারছিলাম না। তাই যাবই এমন কথাও দিইনি। ওর স্থানীয় কোনো ফোন নম্বরও ছিল না। আমার নম্বর দিয়েছিলাম ওকে। লিখেছিল শরীরটা ভালো নেই, ডাক্তার দেখাতে এসেছে। তাই চিন্তাও ছিল। বিকেলে হারা উদ্দেশ্যেই বেরিয়ে পড়লাম। যদিও বাবা আর মেয়ে মিলে পৌঁছে দিল, ফেরার সময় নিয়েও এল।

প্রায় ঘন্টাখানেক বসে থাকার পর এল। কথা হল খানিকক্ষণ। কথায় কথায় ছেলের কথা বলছিল। ওর মনে হয় নিজের জন্যে নয়, ছেলের জন্যেই ওকে বাঁচতে হবে, ওর তো কেউ নেই। রিপোর্ট সব ভালো আসায় খুশি আছে। আমাকে বলল, তোমায় ভারী মিস্টি দেখতে, আমায় একটুও মিস্টি দেখতে নয় বলো? আমি আসলে মুখে খুব গুছিয়ে বলতে পারিনা। এমনিই খুব ক্লান্ত লাগছিল, কথাই বলতে পারছিলাম না। আসলে চোখ-নাক-মুখের সৌন্দর্যে মানুষের সৌন্দর্য হয় না, সৌন্দর্য থাকে মনে আর ব্যবহারে আর যে দেখে তার অনুভূতিতে। আমার লাবণ্যকে বেশ ভালোলাগে, সেটা মিস্টি না তেঁতো কখনো ভেবে দেখিনি। এই তো সবে আলাপ হল। আর মানুষের আপনজন যে কোথায় থাকে তা কেউ জানে না। হয়তো তুমি নিজেকে ভাবছ একা, অথচ অনেক দূরে কেউ তোমারই জন্য ভেবে যাচ্ছে, হয়তো সারাজীবনেও তুমি তাকে চিনলে না।

মানুষ বড় আশ্চর্য। যেমন সে অকারণে ঘৃণাও করতে পারে তেমনি ভালো এক সেই বাসতে পারে।


মাঝে মাঝে কারোর জন্য এই হারা উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তে বেশ ভালোলাগে আমার।

পুজো আসছে

এই সময়টায় আকাশ বাতাস কেমন একটা পুজো আসছে, মনখারাপ-মনভালো গোছের হয়ে থাকে। ঠাকুর দেখতে ছোট থেকেই খুব একটা আগ্রহী ছিলাম না। এখন কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় থিমের পুজোর বিজ্ঞাপন দেখতে দেখতে শুধু মনে হয় কত টাকা নষ্ট হচ্ছে। অলিতে-গলিতে পুজো। বড় পুজো, মেজ পুজো, সেজ পুজো, ছোট পুজো। চারদিকে যত সন্ত্রাশ বাড়ছে, যত অন্যায়-অত্যাচার বাড়ছে, ভক্তিও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়।

পুজো এলে কিছু মানুষের রোজগার হয় মূর্তি গড়ে, ঢাক বাজিয়ে...কিন্তু সে আর কতটুকু, অধিকাংশ টাকাটাই যায় কিছু মানুষের ফূর্তিতে। এই টাকার সামান্য একটা অংশ পেলেও হয়তো কত মানুষের ক'দিন খাওয়া জুটতো, কারোর পরীক্ষার ফি। কে জানে কতগুলো আত্মহত্যাও ঠেকানো যেতো হয়ত এই ফূর্তির টাকায়। কে জানে...। কারণ পুজো হবে, হতেই থাকবে, মচ্ছব...প্রতিবছর আরও আরও বাড়বে।

Tuesday, September 22, 2015

যা কিছু আজীবন রয়ে যায়

কিছু কিছু হারায় না এ জীবনে -
যেমন আকাশ অথবা মাটি,
পাহাড় অথবা সমুদ্র,
বৃষ্টি অথবা চোখের জল,
আর
কবিতা।

কিছু কিছু হারায় না এ জীবনে -
যেমন প্রতিবাদ এবং স্বপ্ন,
বিশ্বাস এবং ভালোবাসা,
সত্য এবং অভিমান,
এবং
তুমি।


এইসব কিছু আজীবন রয়ে যায়।

Monday, September 21, 2015

লীলা – পথের পাঁচালী থেকে অপরাজিত

পর্ব – ১ পথের পাঁচালী

কোথায় যেন পড়েছিলাম, উপযুক্ত অভিনেত্রীর অভাবে ‘লীলা’র চরিত্রটা সত্যজিত তাঁর চলচ্চিত্রে বাদ দিয়েছেন। কেন জানি বিশ্বাস হয় না আমার। কারণ সুপ্রিয়ার মতো শক্তিশালী অভিনেত্রীকে কাজে লাগাননি অথচ বিভূতিভূষণের অপুর সঙ্গে বর্ণনায় না মেলা সত্ত্বেও সৌমিত্র অপু হয়ে ওঠে। আমার মনে হয়, সিনেমার স্বল্প পরিসরে লীলার মত বহুমাত্রিক চরিত্রটি আদৌ দাঁড়াবে কী না সে নিয়েও হয়তো সংশয় ছিল মনে।

পথের পাঁচালী বা অপরাজিত সত্যজিতের নয়, প্রথমতঃ এবং শেষপর্যন্ত বিভূতিভূষনেরই। সেখানেও লীলার আত্মহত্যা যেন কিছুটা আরোপিত লাগে আমার। যেন লীলাকে নিয়ে শেষপর্যন্ত কী করা যায় তা ভেবে না পেয়ে আত্মহত্যাই বেছে নিলেন, অথচ লীলার যে চরিত্র এঁকেছিলেন, সেই চরিত্র আত্মহত্যা করতে পারে না, বরং অপুর সঙ্গে পোর্তোপ্লাতার সমুদ্রতীর দেখতে বেরিয়ে পড়তেই পারে। অথচ লীলা আত্মহত্যা করে কেন? কেন সে বিষ খায়?

অপুকে বারবার বন্ধনহীন করার জন্যই কি তার প্রিয় নারী চরিত্রেরা মারা যায়? না কী দুর্গার মৃত্যুর রেশ বারবার ফিরে আসে লেখকের অবচেতনে? দুর্গার অসুখে মৃত্যু, অপর্ণার প্রসবের কারণে মৃত্যু অথবা সর্বজয়ার বয়স জনিত মৃত্যুগুলি কিন্তু আরোপিত নয়। কিন্তু লীলার মৃত্যু না হলে অপু যেন বেরিয়ে পড়তে পারছিল না। তাই কি লীলা অপুকে মুক্তি দিয়ে গেল?

লীলাকে আমরা দুটো পর্বে দেখি। কিশোরী লীলা এবং যুবতী লীলা।

পথের পাঁচালীর চতুস্ত্রিংশ পরিচ্ছেদে বড়লোকের মেয়ে লীলা আলাপ করে তাদের বাড়ির রাঁধুনীর ছেলে অপুর সঙ্গে। আসলে আলাপ হয় প্রায় সমবয়সী দুই বালক-বালিকার। বালিকাটির বয়স এগার এবং বালকটির তেরো। অপুর লীলাকে ভালোলেগেছিল, লীলার অপুকে। প্রথমদিনের বর্ণনাতেই লেখক তা স্পষ্ট করেছেন। দুজনেই সুন্দর, দুজনেরই নির্মল মন। দুজনের মনেই কোনো ঈর্ষা নেই, অপুর কিছুটা অপ্রতিভতা আছে সামাজিক বৈষম্যের কারণে। লীলা তা বোঝার বয়সে পৌঁছায়নি তাই সহজেই সে খুশি হয়ে নিজের ফাউন্টেন পেন অপুকে দিয়ে দেয়, অপুর সঙ্গে তার এঁদো ঘরে আসে। অপুর সুকুমার ঠোঁটের নীচে তিলে হাত রেখে বলে তোমাকে বেশ দেখায়, বেশ মানায়।

পরেরদিন লীলা নিজের থেকেই অপুর ঘরে আসে। এমনকী অপুকে নিজের দুধের গেলাস থেকে জোর করে দুধ খেতে দিয়ে নিজে এঁটোটা খায়। এই শেষ অংশে সে অবচেতনে অপুকে গ্রহণ করে। কেন তার এঁটো খেলো লীলা এর উত্তরে লীলা বলে – ‘আমার ইচ্ছে’। লীলার চরিত্রের স্বাধীন দিকটাও এই শব্দ ব্যবহারে প্রথম পরিস্কার হয়।

এই ঘটনাটার উল্লেখ দুজনের মনেই পরবর্তীতে বারবার ফিরে আসে।

এর পরের পরিচ্ছেদে অপুর উপনয়নের পর আবার লীলা আসে। মেজ বৌরাণীর দেওয়া উপহার দেয় অপুকে। এই অংশেই অপু ‘মুকুল’ থেকে পড়ে শোনায় লীলাকে – ‘সমুদ্রের তলায় কোন্‌ স্থানে স্পেনদেশের এক ধনরত্ন-পূর্ণ জাহাজ দুই-তিনশত বৎসর পূর্বে ডুবিয়া যায় – আজ পর্যন্ত অনেক খোঁজ করিয়াছে, কেহ স্থানটা নির্ণয় করিতে পারে নাই।’ এই সেই ‘পোর্তো প্লাতার সন্নিহিত সমুদ্রগর্ভ’ – যার স্বপ্ন অপু দেখে যায়, যে স্বপ্নে বোহেমিয়ান অপুর মন আর মনন মিলে যায় নিতান্ত উড়নচন্ডী লীলার সঙ্গে। লীলা অপুর কপাল টিপে দেয় মজা করে। ছোট ছোট এই মুহূর্তগুলোকে লেখক শুধু যেন এঁকে দেন যে ছবি আসলে ছিলই।


পথের পাঁচালীতে অপু-লীলা পর্ব এখানেই শেষ।

জলপ্রপাত

অসুখ করলে সবচেয়ে কষ্ট লিখতে না পারাটা। কারণ বিছানার থেকে মাথা তোলা যায় না, কেবল ঘুম পায়। অসুখ করলে ভাবনাগুলো কেমন অগোছালো হয়ে যায়। আগে খাতা বা ডায়েরিতে শুয়ে শুয়েও লিখতাম। তারপর যখন ল্যাপটপ এল প্রথম প্রথম কী বোর্ডে লিখলে শব্দগুলো আপন লাগত না। এখন সেটাই অভ্যেস হয়ে গেছে। জ্বরের মধ্যেও তাই মোবাইলে লিখি, লিখে যাই, অর্থহীন কবিতা আর নিরর্থক চিঠি।

তবু লিখতে হয়, লিখে যেতেই হয়, নাহলে ভারী কষ্ট হয়। সন্ধ্যাবেলায় পিঠে বালিশ নিয়ে উঠে বসি। মাথাটা মাঝে মাঝে ঢুলে পড়ে, ভীষণ কাশি ওঠে...। কার জন্য লিখি, কেন লিখি কিছুই আর মাথায় ঢোকে না তখন।

কবিতা লেখাটা ভীষণ ব্যক্তিগত। গদ্য দূর থেকেও লেখা যায়। গদ্যে যখন কবিতা উঠে আসে তাতে ঘামের গন্ধ লেগে যায় আবার, মনখারাপেরও। মানুষের প্রতি মানুষের অনুভূতি লেখার জন্ম দেয়, লেখার মৃত্যু ঘটায়। কোথাও কেউ থেকে যায় যে সব পাঠ পড়ে। তার জন্যই কি লিখতে হয়? লিখলেই কি সব শব্দের মানে বোঝা যায়? সব শব্দ কি আদৌ আভিধানিক অর্থ বহন করে? শব্দ কি আদৌ কোথাও পৌঁছায়?

এই লেখাটা আসলে কোনো লেখা নয়, আসলে এর কোনো শুরু বা শেষ নেই। যে নদী হঠাৎ করে জলপ্রপাতে বদলে আবার আছড়ে পড়ে নদী হয়ে যায় তার কোনো শুরু বা শেষ থাকে না। অনেক সম্পর্কেরও থাকে না। দিগন্তহীনতা খুঁজে যাচ্ছি। আবার দিগন্ত না থাকলে কি রামধনু ওঠে?

সুমনের গান মানুষকে পথে নামাল না কেন? তুমি গান গাইলে, যা ছিল আগের মতো রয়ে গেল কেন?

এখনো বিভূতিভূষণ কেন এত মনকেমন করায়? লীলাকে নিয়ে কোনো লেখা পড়িনি। লীলাকে সবাই ভুলে গেল কী করে? সত্যজিত রাখেনি বলে?

আমাদের জীবনে ইছামতীর বহমানতা নেই, গঙ্গার পাঁকে আটকে আছি।

অপু, আমার চিঠি না পেলেও তুই চলে যাস না, তোর সঙ্গে পোর্তোপ্লাতার সমুদ্রতীরে যাওয়ার কথা ছিল আমার। ভুলে যাস না যেন। ওদিকে ভৃগু বলছে,  পদ্মার ওই পাড়ে আমার বাড়ি,  ওই পাড়ে যেখানে ধর্মের নামে আজ মানুষ মানুষকে খুন করছে। আর কে যেন চিৎকার করছে, আমরা কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম, এ রাজ্যে, ও রাজ্যে, এ দেশে, ও দেশে।
আসলে আমার মাথার মধ্যে বোধহয় ট্রেন যাচ্ছিল। মুখটা বিস্বাদ হয়ে আছে। আর মাথার মধ্যে ঝমঝম করে ট্রেন যাচ্ছে।

পৃথিবীটাই কেমন বিষাক্ত লাগে মাঝে মাঝে, দমবন্ধ হয়ে আসে। পিঁপড়ের মত মানুষ মরছে আবার চারদিকে বিজ্ঞাপনের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। বিভূতিভূষণের দেখার মৃত্যু হয়েছে, শুধু এন্টারটেনমেন্ট। আমরা সবাই অন্ধ হয়ে যাচ্ছি।


অপু, আমায় একবার পোর্তোপ্লাতার সমুদ্রতীরে নিয়ে যাবি?

বৃক্ষ হয়ে ওঠো

নিজেকে প্রতিদিন বলি,
বৃক্ষ হও, বৃক্ষ হয়ে ওঠো
জীবনের সমস্ত ঝড়ঝাপটা সামলে।
আশ্রয় দাও, ছায়া, নীড়, পুষ্পপত্রে
ভরিয়ে তোলো পৃথিবী, দাও নির্মলতা।

শুধু দাও, কারো কাছে চেয়ো না কিছুই।

মাটির গভীরে শিকড় ছড়িয়ে দিও
নিবিড় আলিঙ্গনের, পান কোরো স্নেহরস –
যতটুকুতে শুধুমাত্র বেঁচে থাকা চলে।

তারপরে প্রস্তুত থেকো,
যাদের ছায়া দিয়েছিলে বিশ্বাসের,
আশ্রয়, নীড়, নির্মলতা; দেখো,
তারাই একদিন তোমার বুকে
কুঠার হানবে। অথবা,
শিকড়ে ঢালবে গরল।

সেদিনও পারলে ক্ষমা করে দিও।
তবু বৃক্ষ হয়ে ওঠার চেষ্টা করো,
বৃক্ষ হয়ে ওঠো –

নিজেকে বলে যাই প্রতিদিন।

সময়ের দাম

ফাল্গুনীদা মেসেজে লিখেছেন, দময়ন্তী কত কাজ আছে তোমার, তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো। অসুখ করলেই ইদানীং এই কথাটা বড্ড মনে হয়, গত বেশ কয়েকমাস ধরে টানা এবং নানা অসুখে ভুগতে ভুগতে আরও বেশি করে মনে হচ্ছে যে সময় চলে যাচ্ছে, সময় চলে যাচ্ছে, কত কাজ, কত ভাবনা, কত লেখা মাথায় ঘুরছে, কিচ্ছু হচ্ছে না।

ছোটবেলায় মা বলতো আমি নাকি সময়ের পিছনে দৌড়াই না, সময়ই আমার পেছনে দৌড়ায়। রিক্সা এসে প্যাঁক প্যাঁক করত আমার মোজা কিছুতেই আর ঠিক করে পড়ে ওঠা হতো না, কেবল খুলছি আর পড়ছি, আবার অসুবিধা হচ্ছে, আবার খুলছি আর পড়ছি। আর একটু বড় হয়ে কতদিন স্ট্যান্ডে পৌঁছে স্কুলবাসকে দিগন্তে মিলিয়ে যেতে দেখেছি অথবা আমাকে দেখতে পেয়ে বাকিদের চিৎকারে খানিক এগিয়ে যাওয়া বাস থেমেছে।

আসলে অল্পবয়সে সামনেটা অফুরন্ত হয়।

এখন কাক্কেশ্বর কুচকুচের কথা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এই যে তিনটে দিন গেল তার মানে তিন সাত্তে একুশ লক্ষ টাকা চোদ্দ হাজার আনা নশো পাই গেলো তো খরচ হয়ে? ওমা পেঁয়াজের দাম পর্যন্ত বেড়েছে আর সময়ের দাম বাড়বে না?
এখন কোনোমতে জামাটামা গলিয়ে চুলের গার্ডারটা হাতে নিয়ে দৌড়াই - রাস্তায় পড়ে নেব।

সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়...

আসলে মাঝবয়সে পৌঁছে গেলে আর নিজের ওপর বিস্তর অকাজ চাপালে আর তার একটাও না করতে পারলে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে কেবল মনে হয় -


জীবন এত ছোট ক্যানে?

জ্বোরো কথা


লেখাগুলো ক'দিন আগের। জ্বরের তাড়নায় ব্লগে রাখা হয়নি।
(১)
জ্বরের ঘোরে তরাজু কেঁপে যায়
এই লাইনটার মানে এদ্দিনে বুঝলাম। তাই একদিন বিস্তর আবোলতাবোল বকেছি আর লিখেছি।
জ্বরের ঘোরে আরও একটা হয়, ঘুম ভাঙলে সকাল, বিকেল, রাত কিচ্ছু বোঝা যায় না। সময় অনন্ত হয়ে গেছে ভেবে আবার ঘুমিয়ে পড়া যায়।
জীবনে অন্ততঃ কখনও তো সময় অনন্ত হয়, সেও বা কম কী!

(২)
আমার মাগো
অসুখ করলেই তোমাকে সেই ছেলেবেলার মায়ের মত লাগে আমার। মায়ের গা থাকত ঠাণ্ডা, আর আমি ছ্যাঁকা দিতাম গরম হাত-পা দিয়ে। তারপরে ঠিকঠাক ওষুধ খাওয়ানো। রাত জেগে গা হাত পা টিপে দেওয়া। এই তো সেরে উঠবি বলে আশ্বাস দেওয়া। কত রাত্তির যে জেগেছে আমার জন্য মা তার কোনো হিসেবই নেই, এখন তো তাও সেই তুলনায় অনেক সুস্থ আমি। তখন তো বচ্ছরভর অসুখ লেগেই থাকত। ছোটবেলায় অসুখ করলেই তালাত মামুদের গান শুনিয়ে ঘুম পাড়াত আমায়। দুদিন আগে মোবাইলে তালাতের গান শুনতে শুনতে মন্তব্য করলাম, মা এর থেকেও ভালো গাইত।

আজ সারাদিন তেমন জ্বর আসেনি, তরাজু ক্রমশঃ স্থির হচ্ছে।

Wednesday, September 16, 2015

জ্বরের ঘোরে

কোনো না কোনোদিন সবাই আগুনে পোড়ে
অথবা মাটিকে ছোঁয় ঘুমের গভীরে।

আমিও আগুনে পুড়ি, মাটিকে ছুঁই
জ্বরের ঘোরে।

তারপর চোখ মেলে বেঁচে উঠি ফের।

আত্মহননের একটি সম্ভাব্য প্রাককথন

সময় - মধ্যরাত
(মশারি তোলা এবং খচমচ আওয়াজ)

স্বামী - কী হল? (ঘুম ভেঙে গিয়ে)
স্ত্রী - কোমরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা করছে, কোনো পাশ ফিরেই শুতে পারছি না। তাই প্যারাসিটামল খাচ্ছিলাম।
স্বামী - আচ্ছা হাত বুলিয়ে দিচ্ছি (ঘুম ঘুম গলায়, এবং ঘুম)।
স্ত্রী - শুনছ?
স্বামী - বল (ঘুমজড়িত কন্ঠে)
স্ত্রী - ধরো, আমি যদি কোনোদিন আত্মহত্যা করি, তাহলে কিন্তু একেবারেই ভাববে না যে আমি জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ। ভীষণ পজিটিভ আমি। কারোর ওপর রাগ-অভিমান তাও নয়, ওসবের কোনো মানেই নেই মারা যাওয়ার জন্য। কিন্তু সারা গায়ে এই প্রবল ব্যথা মাঝে মাঝে আর সহ্য হচ্ছে না।
স্বামী - না কোরো না। (ঘুম ঘুম ব্যথিত গলায়)
স্ত্রী - চিন্তা কোরো না, এক্ষুণি করছি না, আপাতত ঘুমের চেষ্টাই করছি। (গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে)
স্বামী - আচ্ছা। (ঘুম)

আবার দু'একদিনের মধ্যেই এই প্রসঙ্গ অথবা শেষবয়সে দরকার হলে ইউথ্যানাসিয়া কোরো এই বিকল্প বকবক সে আবারও করে যাবে ব্যথা বাড়লেই এই ভাবতে ভাবতে স্ত্রী-র ঘুমের চেষ্টা...।


এটা একটা শুরু বা শেষ না হওয়া কাহিনি।

Tuesday, September 15, 2015

মানুষ কেন যে বড় হলে এমন 'হোৎকা' হয়ে যায়!

ঈশ্বর, আল্লা, গড এবং সর্বোপরি ধর্ম বলে কিছু নেই। সবটাই মানুষের বানানো। আছে কিছু স্বার্থপর চতুর ক্ষমতালোভী মানুষ, কিছু বুদ্ধিজীবী (এরাও ওই একই গোত্রেই পড়ে শুধু মুখোশটা আলাদা), আর অজস্র অশিক্ষিত এবং অর্ধ শিক্ষিত নারী-পুরুষ। আর তাই পৃথিবী, দেশ, রাজ্য, সমা্‌জ সর্বত্র এই হাল। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়।


সব্বাই আসলে বড় 'হোৎকা' হয়ে গেছে।