Wednesday, September 2, 2015

বিরিঞ্চিবাবা

১)
স্বর্ণাক্ষরে চাকরি করতে পুজোসংখ্যার লেখার জন্য চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্নের বাড়ি গিয়েছিলাম। উনি লিখতে পারবেন না, অনুলিখন করতে হবে। বেশ বড় সাজানো বাড়ি। ঢোকার মুখে জলে ফুলটুল কীসব ভাসছে। ঘরে অজস্র আর্টের জিনিস। প্রত্যেকটা ঝকঝক করছে। বসার ঘর দেখলেই তাঁর আর্থিক সাচ্ছল্যের একটা সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়। সময়টা ছিল নন্দীগ্রাম ঘটনার ঠিক পরেই পরেই। প্রসঙ্গটা উনিই তুললেন। আমি শুনলাম, শুনেই গেলাম। মনে হল, ফাঁকা কথাগুলো যেন এই সাজানো সচ্ছ্বল ঘরে হাস্যকরভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। উনি বিদেশ ভ্রমণের গল্প বলছিলেন একটু আগে, সেটাই বেশ মানাচ্ছিল। এটা শুনতে শুনতে আমার খুব হাসি পাচ্ছিল, ভীষণ হাসি...। সেই থেকে লোকটাকে বড় ঘেন্না লাগে আমার।

২)
‘আমাদের ছুটি-র হয়ে শঙ্খ ঘোষের সাক্ষাতকার নিতে গেছি। তার আগে মায়ের সুবাদে একদিন গিয়েছিলাম ওনার বাড়িতে। ছাদ পর্যন্ত বই, দারুণ লেগেছিল। ভদ্র ব্যবহার, ভালো। শঙ্খ ঘোষের গদ্য এবং কবিতা আমার সবসময়ই খুব ভালোলাগে। সাক্ষাতকার মুখে দেবেন না। প্রশ্ন লিখে দিয়ে যেতে বললেন, লিখে উত্তর দেবেন। তাই সই। আমার সাক্ষাতকার নেওয়ার অভিজ্ঞ মন বলল, মুখে বললে আলগা শব্দ দু’একটা বেরিয়েই আসতে পারে, খুব সতর্ক হলেও। লিখে দিলে সে সুযোগ নেই। আর শঙ্খ ঘোষ এখন বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে অন্যতম। কাজেই ‘আমাদের ছুটি’-র মত অতি ক্ষুদ্র, তুচ্ছ একটা পত্রিকাতেও তিনি কী বলছেন সেটা খুব বুঝেশুনেই বলতে হবে। লিখিত সাক্ষাতকার আনতে গিয়ে ছবির কথা বললাম। কিছুতেই রাজি হলেন না। ওনার বক্তব্য ওনার অনেক ছবি পাওয়া যায়, যেকোনো জায়গা থেকে নিয়ে নিতে। আমাদের ছবি তুলতে দেওয়ার মতো সময় ওনার নেই।
কিন্তু ‘আমাদের ছুটি’-তে কোথাও থেকে নিয়ে ছবি প্রকাশিত হয়না। হতে পারি আমরা খুব ক্ষুদ্র, খুব তুচ্ছ, কিন্তু আমাদের নিজস্ব কিছু এথিকস রয়েছে। ছবি ছাড়াই সাক্ষাতকার প্রকাশিত হল। সেটা দেখার কোনো আগ্রহও দেখালেন না শঙ্খ ঘোষ। সত্যিই তো ওনার মতো মানুষের সাক্ষাতকার কত নামীদামী পত্রিকায় বেরোচ্ছে, আমরা তো চুনোপুঁটি। কিন্তু কেন ওই সাক্ষাতকারের সঙ্গে ছবি নেই তা নিয়ে আমাদের অনেকবার পাঠকদের জিজ্ঞাসার মুখে পড়তে হয়েছে। বলেছি, প্রথম সংখ্যা তো তাই কিছু ত্রুটি রয়ে গেছে আমাদেরই।

৩)
বর্তমানে বাংলা ভ্রমণলেখিকাদের মধ্যে মূলতঃ পরিচিত মুখ নবনীতা দেবসেন। তাঁর লেখার সরসতা আমার খুব ভালোলাগে। কিন্তু যখন লেখার প্রতি ছত্রে ছত্রে ‘আমি’ এবং আবার ‘আমি’ থাকে তখন ক্লান্ত লাগতে শুরু করে ভীষণ। অমর্ত্য সেনের কোনো লেখায় নবনীতার উল্লেখ থাকে কিনা জানিনা, কিন্তু নোবেল পাওয়ার পর থেকে নবনীতার লেখার পাতায় পাতায় অমর্ত্যের কথা পড়তে পড়তে আমার আরও ক্লান্ত লাগে। তা হোক তবু সাক্ষাতকার একটা নেওয়া যেতেই পারে বলে যোগাযোগ করলাম। প্রথমে সময় হবে না ইত্যাদি। আসলে এই তুচ্ছ পত্রিকা, কে পড়বে, কে জানবে আর কী...। কারণ তারমধ্যেই তিনি বহু কিছু করছেন কাগজে দেখি মাঝেমধ্যে। যাইহোক বিনীতভাবে জানাই ই-মেল-এ প্রশ্ন পাঠাতে পারি সময় করে উত্তর দিলেই হবে। যাহোক প্রশ্ন পাঠাই। বেশ কয়েকবার তাগাদা দেওয়ার পর উত্তর আসে দায়সারা, দু’তিনটে প্রশ্নের দু’এক কথায় সংক্ষিপ্ত জবাবের পর লেখা - তোমার প্রশ্নগুলো বেশ ভালো, আমার বইগুলো দেখ, উত্তর পেয়ে যাবে। দাঁতে দাঁত চেপে বলি, আপনার ছবি লাগবে, আপনি যদি পাঠিয়ে দেন বা আমরা গিয়ে তুলে আনতে পারি। উত্তর এল, ওসব ছবি-ফবি দিতে পারব না। ও যোগাড় করে নাও। নাহ্‌, সাক্ষাতকার প্রকাশ করিনি আমরা। ওই যে আমাদেরও একটা এথিকস আছে, যত তুচ্ছই হই না কেন।

৪)
এদিক থেকে দেবেশ মামা তুলনায় অনেক ভালো। অন্ততঃ এই ধরণের কোনো মানসিকতা আমি দেখতে পাইনি। শুধু ছোট থেকেই দেখেছি একদম খাওয়ায় না। মনে হয় এইজন্য ওনার পপুলারিটি এত কম। শঙ্খ ঘোষের বাড়িতে গেলে প্রচুর খাওয়ান। অনেক মানুষের আড্ডাও জমে ওখানে। সেই ছোটবেলায় দেখেছি আমরা কলকাতায় এলে দেবেশমামা যখন কখনো সখনো গেস্টহাউসে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসতো কোনোদিন হাতে করে আমাদের জন্যে কিচ্ছু আনেনি। তাই আমি নাম দিয়েছিলাম শুকনো মামা। কিছুদিন আগে আমার বইটা আর মায়ের একটা বই দিতে গিয়েছিলাম বাড়িতে। আমার ধারণা আমি প্রথমবার গেলাম। মা যদিও বলল, নাকি আগে গেছি, কে জানে বাবা, এরকম না খাইয়ে রাখলে ঠিক মনে থাকত আমার। একে তো কানে শুনতে পায়না এখন, সে এক বিড়ম্বনা, তার উপর আমার ভয়ানক খিদে পেয়ে গিয়েছিল। লোকে তো বাড়িতে কেউ এলে চা-বিস্কুট দেয়, ওমা কতক্ষণ ভাবলাম বুঝি এই দেবে এই দেবে, আর দেয়ই না। অনেকক্ষণ বাদে প্রায় ওঠার সময় জিজ্ঞাসা করল, কিছু খাবি? তোর মিস্টি খাওয়ার বারণ নেই তো? বোঝো ঠ্যালা! ওদিকে পেটেয় ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে...। লোকে তো অন্ততঃ এক প্লেট মিস্টি এনে খাও খাও করে তবে একথা বলে। আমার আবার মুখ দিয়ে মিথ্যে বেরোতে চায় না। দাঁত-মুখ চিপে বলি, না খাব না, সুগার আছে। আমার এদিকে খিদে পেলে কেমন পাগল পাগল লাগে। তারপরে জিজ্ঞাসা, ডিমটিম খাসতো, ওমলেট খাবি, না বারণ আছে? নিতান্ত নিরুপায় আমি বলি, বারণ আমার বিস্তর কিছুতে আছে, সে প্রায় না খেয়ে থাকলেই হয়, ও বাদ দাও অত আমি মানিনা, দাও কী দেবে। যাইহোক অমলেট আর জল খেয়ে ধড়ে প্রাণ এল। বাইরে বেরিয়েই একটা দোকানে ঢুকে তাড়াতাড়ি কিছু খেয়ে নিলাম। বাড়ি ফিরে মাকে হুমকি দিই, আর আমি যাচ্ছিনা দেবেশ মামার বাড়ি। এরপর কখনো যদি যাইও তাহলে এক পেট খেয়ে তবে যাব। মা বলল, এরকম তো ছিল না দেবেশদা, আমাদের নাটকের রিহার্সালের সময় কত খাওয়াতো। আই বলি, রেখে দাও তোমার খাওয়াতো, আমি তো জম্মে দেখলাম না, সাধে কী আর বলি শুকনো মামা। তবে খেতে না দিক দেবেশমামার শেষ প্রকাশিত বইটা দিয়েছে। তাতেই আমি খুশি – যা পাওয়া যায় আর কী।

৫)
আসলে ছোটবেলায় যখন মায়ের কাছে শুনেছি যে শারদীয় আনন্দমেলাগুলো পড়তে নিয়ে আর একটাও জয়া কাকিমা ফেরত দেয়নি, তখন থেকেই আমি বুদ্ধিজীবিদের ওপর রীতিমতো চটা।

৬)
এখনো পর্যন্ত একমাত্র ব্যতিক্রম মনে হয়েছে অমিতাভকাকাকে। ছোটবেলায় বা বড় হয়েও কলকাতায় অমিতাভকাকা-রত্না কাকিমাদের বাড়িতে অনেকবার থেকেছি। সেই স্মৃতিগুলো কিন্তু বেশ মজার। রাত বারোটার সময়, তাড়াতাড়ি ছোটদের খেতে দিয়ে দাও, কী উদাত্ত কন্ঠে ‘সায়নারা সায়মন’। ‘নিজ হাতে নিজস্ব ভাষায়’ আমাকে দিয়েছিল অমিতাভকাকা, আর একটা রাশিয়ান গল্পের বইয়ের বাংলা অনুবাদ আমাদের দুজনকে। পৃথ্বীশকাকাকে অমিতাভকাকার বাড়িতেই দেখেছি আমি। আবছা মনে আছে। আমাদের বিয়ের কার্ডও পৃথ্বীশকাকার আঁকা। আমাকে স্নেহ করতেন। একেবারে মনে নেই শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে। অথচ ওনার তুমুল ডাক, ‘রত্না রত্না’ স্মৃতিতে রয়ে গেছে। কিছুদিন আগে জানতে পারলাম রত্না কাকিমা অবলা বসুর ভাইয়ের নাতনী।

৭)
ভালোলাগে আড্ডাবাজ মানবকাকুকেও। সেই ছোট থেকেই দেখছি যেন একইরকম রয়ে গেছে। অরুণকাকা লোকটা ভালোই ছিল, ছোটবেলায় আমার কবিতা পড়াতাম। আমাকে একটা বই উৎসর্গও করেছিল। কিন্তু একটু ইয়ের দোষ ছিল আর কী।

অতএব,

বুদ্ধিজীবিদের মিছিলে আমি কখনো যাবনা। আসলে আমার মনে হয় কবিতা, গদ্য বইয়ের পাতায় অথবা শিল্পের ভেতর দিয়ে যাঁকে পাওয়া যায় সেটাই ভালো। কারণ সেখানে তাঁরা আমাদের কাছে এত বড় হয়ে ওঠেন যে বাস্তব মানুষটা সেই জায়গায় পৌঁছতে পারেন না। সেখানে খারাপ লাগাটা আরো বেশি হয়ে ওঠে।

আসলে বুদ্ধিজীবিদের মিছিলেরও রঙ থাকে যা আপাতভাবে বোঝা যায় না। সরাসরি রঙ তাও একরকম। এ আরও ভয়ঙ্কর।


আসলে সমাজের উঁচুতলার মানুষদের দূর থেকে দেখাই ভালো। শুধু তাঁরা যখন সাধারণ মানুষের কথা বলেন, তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা আমার কেমন বিশ্রী একটা হাসি পেয়ে যায়...। অনেকটা বিরিঞ্চিবাবা গল্পের ওই ছেলেটার মতো।

No comments:

Post a Comment