Monday, September 21, 2015

লীলা – পথের পাঁচালী থেকে অপরাজিত

পর্ব – ১ পথের পাঁচালী

কোথায় যেন পড়েছিলাম, উপযুক্ত অভিনেত্রীর অভাবে ‘লীলা’র চরিত্রটা সত্যজিত তাঁর চলচ্চিত্রে বাদ দিয়েছেন। কেন জানি বিশ্বাস হয় না আমার। কারণ সুপ্রিয়ার মতো শক্তিশালী অভিনেত্রীকে কাজে লাগাননি অথচ বিভূতিভূষণের অপুর সঙ্গে বর্ণনায় না মেলা সত্ত্বেও সৌমিত্র অপু হয়ে ওঠে। আমার মনে হয়, সিনেমার স্বল্প পরিসরে লীলার মত বহুমাত্রিক চরিত্রটি আদৌ দাঁড়াবে কী না সে নিয়েও হয়তো সংশয় ছিল মনে।

পথের পাঁচালী বা অপরাজিত সত্যজিতের নয়, প্রথমতঃ এবং শেষপর্যন্ত বিভূতিভূষনেরই। সেখানেও লীলার আত্মহত্যা যেন কিছুটা আরোপিত লাগে আমার। যেন লীলাকে নিয়ে শেষপর্যন্ত কী করা যায় তা ভেবে না পেয়ে আত্মহত্যাই বেছে নিলেন, অথচ লীলার যে চরিত্র এঁকেছিলেন, সেই চরিত্র আত্মহত্যা করতে পারে না, বরং অপুর সঙ্গে পোর্তোপ্লাতার সমুদ্রতীর দেখতে বেরিয়ে পড়তেই পারে। অথচ লীলা আত্মহত্যা করে কেন? কেন সে বিষ খায়?

অপুকে বারবার বন্ধনহীন করার জন্যই কি তার প্রিয় নারী চরিত্রেরা মারা যায়? না কী দুর্গার মৃত্যুর রেশ বারবার ফিরে আসে লেখকের অবচেতনে? দুর্গার অসুখে মৃত্যু, অপর্ণার প্রসবের কারণে মৃত্যু অথবা সর্বজয়ার বয়স জনিত মৃত্যুগুলি কিন্তু আরোপিত নয়। কিন্তু লীলার মৃত্যু না হলে অপু যেন বেরিয়ে পড়তে পারছিল না। তাই কি লীলা অপুকে মুক্তি দিয়ে গেল?

লীলাকে আমরা দুটো পর্বে দেখি। কিশোরী লীলা এবং যুবতী লীলা।

পথের পাঁচালীর চতুস্ত্রিংশ পরিচ্ছেদে বড়লোকের মেয়ে লীলা আলাপ করে তাদের বাড়ির রাঁধুনীর ছেলে অপুর সঙ্গে। আসলে আলাপ হয় প্রায় সমবয়সী দুই বালক-বালিকার। বালিকাটির বয়স এগার এবং বালকটির তেরো। অপুর লীলাকে ভালোলেগেছিল, লীলার অপুকে। প্রথমদিনের বর্ণনাতেই লেখক তা স্পষ্ট করেছেন। দুজনেই সুন্দর, দুজনেরই নির্মল মন। দুজনের মনেই কোনো ঈর্ষা নেই, অপুর কিছুটা অপ্রতিভতা আছে সামাজিক বৈষম্যের কারণে। লীলা তা বোঝার বয়সে পৌঁছায়নি তাই সহজেই সে খুশি হয়ে নিজের ফাউন্টেন পেন অপুকে দিয়ে দেয়, অপুর সঙ্গে তার এঁদো ঘরে আসে। অপুর সুকুমার ঠোঁটের নীচে তিলে হাত রেখে বলে তোমাকে বেশ দেখায়, বেশ মানায়।

পরেরদিন লীলা নিজের থেকেই অপুর ঘরে আসে। এমনকী অপুকে নিজের দুধের গেলাস থেকে জোর করে দুধ খেতে দিয়ে নিজে এঁটোটা খায়। এই শেষ অংশে সে অবচেতনে অপুকে গ্রহণ করে। কেন তার এঁটো খেলো লীলা এর উত্তরে লীলা বলে – ‘আমার ইচ্ছে’। লীলার চরিত্রের স্বাধীন দিকটাও এই শব্দ ব্যবহারে প্রথম পরিস্কার হয়।

এই ঘটনাটার উল্লেখ দুজনের মনেই পরবর্তীতে বারবার ফিরে আসে।

এর পরের পরিচ্ছেদে অপুর উপনয়নের পর আবার লীলা আসে। মেজ বৌরাণীর দেওয়া উপহার দেয় অপুকে। এই অংশেই অপু ‘মুকুল’ থেকে পড়ে শোনায় লীলাকে – ‘সমুদ্রের তলায় কোন্‌ স্থানে স্পেনদেশের এক ধনরত্ন-পূর্ণ জাহাজ দুই-তিনশত বৎসর পূর্বে ডুবিয়া যায় – আজ পর্যন্ত অনেক খোঁজ করিয়াছে, কেহ স্থানটা নির্ণয় করিতে পারে নাই।’ এই সেই ‘পোর্তো প্লাতার সন্নিহিত সমুদ্রগর্ভ’ – যার স্বপ্ন অপু দেখে যায়, যে স্বপ্নে বোহেমিয়ান অপুর মন আর মনন মিলে যায় নিতান্ত উড়নচন্ডী লীলার সঙ্গে। লীলা অপুর কপাল টিপে দেয় মজা করে। ছোট ছোট এই মুহূর্তগুলোকে লেখক শুধু যেন এঁকে দেন যে ছবি আসলে ছিলই।


পথের পাঁচালীতে অপু-লীলা পর্ব এখানেই শেষ।

No comments:

Post a Comment