Saturday, September 12, 2015

কোমলগান্ধার

অনেক অনেকদিন পর কোমলগান্ধার দেখছিলাম। তিনটে প্যারাসিটামল, কোমলগান্ধার, এবং রাত জেগে লেখা।

আসলে অনেকদিন ধরেই কিচ্ছু ভালোলাগছেনা। এই দেশ, ওই দেশ, এই রাজ্য, এই রাজনীতি, এই ক্রিপলড বেঁচে থাকা।

সাতচল্লিশের দেশভাগে আমরা ফেলে এসেছিলাম সেই 'নিশ্চিন্দি'। দেশভাগের ফসল আমরা নই, আমাদের আগের প্রজন্ম।

অথচ ছোটবেলা থেকেই যতবার কোমলগান্ধার দেখেছি, ভৃগুর কন্ঠস্বরে শুনেছি, পদ্মার ওই পাড়ে আমার দেশ।

আমার জন্ম এখানেই, এদেশেই, পশ্চিমবঙ্গে।

আমি দারিদ্র্য দেখেছি, কষ্ট দেখেছি, যদিও তার আঁচ তেমনভাবে লাগেনি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমি বেশ ছোট।

গত কয়েক দশকে হুড়মুড়িয়ে বদলে গেল সবকিছু। আমাদের দেখা, অনুভব, চাওয়া।

ক্লাসলেস সোসাইটির যে লড়াইয়ের কথা আর গান শুনে বড় হলাম, দেখলাম তা প্রতিদিন আরো বাড়ছে।

সাহিত্য-সংস্কৃতি, সঙ্গীত-নাটক যা কিছু ছিল লড়াইয়ের হাতিয়ার সবই আজ বাজারে বিকোয়।

আসলে এখন সবকিছুই বাজার সর্বস্ব।

রাজনৈতিক দলগুলোও বাজার দখলের লড়াইয়ে নেমেছে কাদার তাল হাতে নিয়ে।

এখনো ভাগ্যিস এরপরেও কেউ কেউ ভৃগুদের মতো লড়াই করে, কেউ কেউ নিঃস্বার্থে মরে।

একটিমাত্র মানুষ আমাদের পথ দেখাতে পারত, একটি মাত্র মানুষ, যাঁর গান অল্পবয়সে আমাদের পথ দেখিয়েছিল। সেই মানুষটি নিজেও বড় কনফিউসড। অথচ সেই মানুষটি যদি তাঁর গিটার হাতে গান গেয়ে ডাক দিতেন, হতেই পারতেন হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা। তিনিও সস্তা গিমিকে ভুললেন।

বাকি সবাই নিজেদের ইমেজ নিয়ে ব্যস্ত - লেখায়, কথায়। সাধারণ মানুষের কথা ভাবতে তাঁদের বয়েই গেছে। যেটুকু নিজেদের ইমেজের জন্য প্রয়োজন তা বাদে। তাঁরা যতই ভালো কথা বলুন, লিখুন, ব্যক্তি হিসেবে ঘৃণ্য।

আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের এখনো ভাত জোটেনা, অধিকাংশ মানুষের মাথায় ছাত নেই। অধিকাংশ মানুষ ইন্টারনেট বা কমপিউটারের ব্যবহার জানেন না। এটাই আমাদের দেশ।

এই দেশ, এই বাংলা এত বছরে না শিক্ষায়, না স্বাস্থ্যে না খেতে পাওয়ায় কোথাও এগোয়নি। এখনো অল্পবয়সে বিয়ে হয়, পণ নেওয়া হয়, নারী শিক্ষার হার খুব খারাপ, এই তালিকার কোথাও শেষ নেই।

রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতির মেলবন্ধনে একটা সমাজ এগোতে পারে। তাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারে মিডিয়া।

অথচ সব উলটো হচ্ছে। আমরা ক্রমশঃ পিছন দিকে যাচ্ছি, অবক্ষয়ের দিকে।

ঊনবিংশ শতকে, বিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সমাজ বদলের লড়াইয়ের মধ্যে একটা হারমনি ছিল। নির্দিষ্ট শত্রু  ছিল। এখন আমরা নিজেরাই নিজেদের সবচেয়ে বড় শত্রু। আমরাই শোষণকারী, আমরাই শোষিত, ক্লাস কনসেপ্টটাই আগাপাশতলা গেছে গুলিয়ে এই খোলা বাজার অর্থনীতিতে।

আগে তাই নিজেদের ভেঙে ফেলতে হবে। নাহলে ক্ষমতায় যেই আসুক ঘটনাক্রম একই থাকবে।

রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি মিডিয়া প্রাণপণে আমাদের চোখে ঠুলি এঁটে সমস্যার থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে আমাদের, প্রাণপণে মদত দিচ্ছে এই ক্লাস ডিফারেন্সকে।

আগে নিজের আয়নাটাকে ভাঙতে হবে। এটা কিন্তু শেষপর্যন্ত পারে কবিতা, গান, নাটক, ভালোবাসা।

অনেকদিনপর কোমলগান্ধার দেখতে দেখতে সেই সুমনের গানই কানে ভাসে - 'এক ধরণের বিদ্রোহ হল কবিতা, একধরণের বিদ্রোহ হল গান, একধরণের বিদ্রোহ ভালোবাসা, ভেঙেচুরে সব খানখান'

অনসূয়ার মনের মতোই বিভক্ত বাংলার নাম আর কোনোদিনও 'কোমলগান্ধার' হবে না জানি।

2 comments:

  1. এখানে আমার দীর্ঘশ্বাস রাখলাম

    ReplyDelete
  2. আমিও তো তাই-ই রেখেছি।

    ReplyDelete