Sunday, May 29, 2016

ঈশ্বর

কেউ আমার কথা শুনছে। নিঃশব্দে শুনেই যাচ্ছে। কোনও মন্তব্য করছে না, কোনও প্রতিবাদ তো দূরের কথা। আমাকে সংশোধন করার চেষ্টাও করছে না। অথচ একবারও মেনে নিচ্ছে না যে আমার সবটাই ঠিক। শুধু শুনেই যাচ্ছে আমার শব্দের নিঃশব্দ উত্থানপতন।

এই গভীর নিঃশব্দ শ্রোতারই নাম ঈশ্বর।

Thursday, May 26, 2016

আনফিনিসড পোট্রেট

ছোটবেলা থেকে সবসময় এই স্বপ্নটা পেরোতে চেয়েছি। অন্ধকারের মধ্যে শুধু পাল্লাহীন একটা দরজার ফ্রেম যার অন্যপাশটা অন্ধকার। প্রতিবারই ওপাশটায় পা দিয়ে ক্রমশ অতল অন্ধকারে নেমে গেছি। এইসময়েই ঘুমটা ভেঙে যেত আর বুঝতাম ওটা নিছক স্বপ্ন। অথচ কোথাও একটা হয়ত আশা থাকত কোনদিন ওপাশটায় আলো থাকবে। ছোটবেলায় বোধহয় এভাবে কখনও ভাবিনি। ছোটবেলায় স্বপ্নটা দেখতেই চাইতাম না। অথচ একেকসময়ে প্রতি রাতেই দেখতাম বা ঘুমিয়ে পড়লেই। স্বপ্নটাকে বেশ ভয়ই পেতাম একটা সময়। অথচ আমাকে দেখতেই হত। বেশ বড় বয়স পর্যন্তই দেখেছি, হয়ত কলেজ জীবনেও। তারপর অনেকদিন আর দেখিনা।

সেদিন আগাথা ক্রিস্টির একটা উপন্যাস পড়ছিলাম। গোয়েন্দা কাহিনি নয়। মেরি ওয়েস্টম্যাকট ছদ্মনামে যে ছটি উপন্যাস লিখেছিলেন তারই একটি আনফিনিসড পোট্রেট। মূল মহিলা চরিত্রটি ছোটবেলায় একটি ভয়ের স্বপ্ন ক্রমাগত দেখার প্রসঙ্গে আবার মনে পড়ল নিজের স্বপ্নটা। মহিলাটিকে কেন্দ্র করে ঘটনা আবর্তিত হলেও হয়ত মূল চরিত্র ওই স্বপ্নটাই। ছোটবেলায় নিয়মিতই স্বপ্নে একটি গানম্যানকে তিনি দেখতে পেতেন যার একটি হাত নেই, যে রূঢ়ভাবে তার দিকে চেয়ে থাকত। একটু বড় হলে নিজের চেনা চরিত্রগুলোই অন্য স্বপ্নের মধ্যে বদলে গিয়ে কোনও একজন এক একবার গানম্যান হয়ে যেত। বড় হওয়ার পর মহিলাটি আর সেই স্বপ্নটা দেখতেন না। কিন্তু নিজের জীবনে বদলে যাওয়া মানব চরিত্রের মধ্যে স্বপ্নের সেই গানম্যানকে দেখে ভয় পেতেন। কাহিনির একেবারে শেষে যখন মহিলাটি স্বপ্নের সেই গানম্যানকে বাস্তবে সত্যি সত্যিই দেখতে পাবেন তখন প্রাথমিকভাবে আতঙ্কিত হলেও সে যে আসলে একেবারেই সাধারণ একটা মানুষ, ভয় পাওয়ার কিছুই নয়, সেইটা অনুভব করে নিজের ভয়টা কাটিয়ে উঠবেন। ঊনচল্লিশ বছর বয়সে আবার নতুন করে জীবন শুরু করবেন, যে জীবনে তাঁর ছোটবেলার সেই ভয় তাঁকে আর তাড়া করে বেড়াবে না। 

ছোট থেকেই তিনি খুবই কল্পনাপ্রবণ ছিলেন, নিজের কল্পনার সেই জগতেই থাকতে ভালোবাসতেন। কথা খুব কম বলতেন, মিশতে পারতেন না সহজে, বই পড়তে ভালোবাসতেন। একটা সময় তা কাটিয়ে উঠতে গিয়ে বাধা পান। তারপর লিখতে শুরু করেন। প্রথম লেখা প্রকাশকের কাছ থেকে ফেরত এলেও পরে আরেক প্রকাশকই ওঁকে আবিষ্কার করেন। লেখক হিসেবে কিছুটা পরিচিতিও হয়। একবার আত্মহত্যা করতে গিয়ে বেঁচে যান। হয়ত দ্বিতীয়বার করতেন, কারণ তাঁর মনে হয়েছিল সেই গানম্যান-এর হাত থেকে সারাজীবনেও তাঁর আর নিস্তার নেই এবং এই ভয় তাড়িত জীবন তিনি আর বইতে পারছেন না। কিন্তু বাস্তবে শেষপর্যন্ত যাকে তিনি অবচেতনে ভয় পেতেন, চেতনে তাঁর কাছেই না জেনে নিজের জীবনের কথা খুলে বলেন। যে মুখ ফুটে কথাই বলত না, এক রাতেই বলে ফেলে সারা জীবনের অজস্র ঘটনা। আর তাকেই ঠিকমতো সাজিয়ে নামটাম দিয়ে লিখে ফেলেন সেই পুরুষটি যিনি শুনেছিলেন নিঃশব্দে। আসলে কখনওই মহিলাটির কথা কেউ এত মন দিয়ে এবং বাধা না দিয়ে শোনেনি। কাহিনির কথক একসময় ছবি আঁকিয়ে ছিলেন, প্রথম জীবনে যুদ্ধে তাঁর সেই হাতটি বাদ যায়, যা দিয়ে তিনি আঁকতেন। তাঁর জীবনের এটাই প্রথম লেখা বা ভিন্ন মাধ্যমে ছবি আঁকা। লেখাটি তিনি পাঠাচ্ছেন তাঁর এক বন্ধুর কাছে যিনি একজন লেখিকা।

উপন্যাসটা পড়ে মনে হল, আমিও সেই স্বপ্নটাকে পেরোতে পেরেছি কি? বোধহয়, একটু একটু করে। আসলে অবচেতনে যা মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে চেতনে হয়ত তা আদপে ভয়েরই নয়। হয়ত সেই ফ্রেমহীন দরজার ওপারে অনেকটা আলোই থাকে যাকে শেষপর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়।


স্বপ্নের গানম্যান আসলে আতঙ্কের কেউ না। বাস্তবে সেই বন্ধু হয়ে ওঠে। অথচ বাস্তবের অনেক চরিত্রই যাকে বিশ্বাস করা যায়, শেষপর্যন্ত বদলে যায় গানম্যান-এ।

Tuesday, May 24, 2016

ঠিকানা

আমার একটা ঠিকানা থাক
যেখানে আমি যেকোনদিন চলে যেতে পারি।
আত্মীয়বাড়ি, অথবা বন্ধুর এমন কী নিজেরও হতে পারে।
যেখানে কড়া নাড়লে কেউ একজন দরজা খুলে খুশি হয়ে উঠবে, আমি এসেছি বলেই।
বন্ধু অথবা আপনজন বা প্রিয় মানুষ।

আমার একটা ঠিকানা থাক
যেখানে আমি যেকোনদিনই চলে যেতে পারি।
যেখানে নক্সা পাড়ের আসনে বসিয়ে, সে গরম ভাতের থালা এনে দেবে।
তারপর নিজের বিছানাটা ছেড়ে দিয়ে ঝেড়েঝুড়ে বালিস পেতে বলবে,
ঘুমোও, আমি জেগে রইলাম মাথার কাছে।

আমার একটা ঠিকানা থাক
যেখানে আমি ইচ্ছে করলে চলে যেতে পারি।
যেখানে ঘুমিয়ে পড়লেই রূপকথা বা জাদুর দেশে চলে যাব, যে গল্পের শেষটা খুব সুন্দর 
আর তাই আমার ঘুমন্ত ঠোঁটের কোণে লেগে থাকবে এক টুকরো হাসি।

আমার একটা ঠিকানা থাক
যেখানে আমি ইচ্ছে করলেই নিরুদ্দেশে যেতে পারি।
আর তাই কখনও যাব না।

Monday, May 23, 2016

বেদনার তৃতীয় দিনে

ব্যথার মহিমাময় দিক এটাই যে সে তোমাকে উঠে দাঁড়াতে শেখায়।
যেকোনওভাবেই উঠে দাঁড়াতে। ভর দিয়ে অথবা একা একাই।
প্রথমে একটু ভেবে নিতে হবে ঠিক কী ভাবে উঠে দাঁড়ালে সহনীয় হবে।
কারণ যেভাবেই হোক উঠে দাঁড়াতে হবে। ওটাই প্রাথমিক লক্ষ্য।
আর এই সহনীয় শব্দটা তখন একটু একটু করে বদলে যেতে থাকবে। অনেকটা সিঁড়ির ধাপে ধাপে ওঠার মতো। ওঠার জন্য শুধু ওপরের আর সামনের দিকের সিঁড়িই থাকে।
দাঁড়িয়ে থাকলেই তো চলে না, হেঁটে যেতেও হয় এক পা দুপা করে।
কারণ দাঁড়িয়ে থাকলে চলেনা।
হাঁটার সময় প্রথমে একটু ঝুঁকে, তারপরে ক্রমশ মাথা তুলে সোজা।
কারণ মাথা তোমাকে তুলতেই হবে। আর ঠিক তখনি ব্যথাগুলো ক্রমশ নুয়ে আসতে থাকবে বহুদিনের অভ্যেসের মতো।
যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা আবার তোমাকে নুইয়ে দিচ্ছে।
হতাশার কিছু নেই। ব্যথার মহিমাময় দিক এটাই যে সে তোমাকে আবারও উঠে দাঁড়াতে শেখাবে।

Saturday, May 21, 2016

টুকরো ভাবনা

রাজনীতি কিছু বুঝিনা। যা মনে হয় তা লিখি। তাই সব কথা সর্বজনের ভালোলাগবেনা বা পলিটিকালি কারেক্ট হবেনা সেটাই স্বাভাবিক। ইন্টেলেকচুয়াল নই। একেবারেই সাধারণ মানুষ। যা কিছু লিখি, অভিজ্ঞতা থেকে যা আহরণ করেছি তার থেকে লিখি। যা কিছু লিখি, যা শিক্ষা পেয়ে বড় হয়েছি তার থেকেই লিখি।

চিরকাল দেখে এসেছি মিথ্যাকে মা খুব ঘৃণা করত। আমিও করি। আরও যখন দেখি মিথ্যার ওপর ভিত্তি করেই যাবতীয় কিছু চলছে তখন যারপরনাই বিরক্ত এবং অসহায় লাগে। আমাদের একমাত্র সন্তান সেও একটি ডাঁহা সত্যবাদী। আর সেইজন্যই বন্ধুদের কাছে অনেকসময় মিথ্যেবাদী আখ্যা পায় আর বাড়ি এসে কান্নাকাটি করে। ওকে বলি, এখন মিথ্যে ব্যাপারটাই এত সহজ আর স্বাভাবিক যে তুই যখন সত্যি বলছিস কেউ সেটা বিশ্বাস করতে পারেনা। তারা ওভাবেই বড় হয়েছে, ওদের দোষ নেই। তুই যদি সত্যবাদী থাকতে চাস জীবনে অনেক ঘা খেতে হবে, সেভাবেই মনটাকে তৈরি কর এখন থেকে। একদিন আমাদের দুজনের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল যে, অপ্রিয় সত্য বলা উচিত না মিথ্যে। এবিষয়ে ও দেখলাম আমার সঙ্গে একমত। অপ্রিয় হলেও সত্য বলব, মিথ্যে বলব না। আমার মনে হয়, অপ্রিয় বলে আমি যদি কারোর কাছে সত্য গোপন করি আর সে যদি অন্য কারোর কাছ থেকে সেটা শোনে তাহলে সেটা তার কাছে আরও বেশিই আঘাতের হবে। তাই অপ্রিয় হলেও সত্য বলা উচিত।

তবে যেমন আদর্শ নিয়ে বাবা-মা বড় করেছিলেন, তেমন আদর্শ কিছু আর আজ খুঁজে পাইনা, তাই সে শিক্ষা দিতেও যাইনা। যুগটা স্বার্থপরের, যুগটা আত্মকেন্দ্রিকতার। যদি অন্য কিছু হও তবে পদে পদে আঘাত খাবে। এইটুকু সাবধান শুধু বারবার করি। এছাড়া আর কী বা করার আছে? ভালো হতে না বলতে পারি, খারাপ হতেও তো বলতে পারিনা একটা আপাদমস্তক ভালোমানুষকে। কেবল সাবধানটুকুই করতে পারি যে, অনেক আঘাত খাবি সেইমতো মনকে প্রস্তুত করে রাখ। কিন্তু তারপরেও সবটুকু পারে না। সেটাই তো স্বাভাবিক। সতেরো বছরে আর কতটুকু বড় হয় মানুষ? কিন্তু পরিস্থিতি এমনই যে হয়ে যেতে হয়।

নিজের জীবনে একটা জিনিস বুঝেছি, শিক্ষাটা যেদিন ভাত ডাল খাওয়ার মতো জরুরি করা যাবে, একমাত্র সেদিন কোনও পরিবর্তন সম্ভব। যারা পরিবর্তন বলতে অন্য কিছু বোঝেন এবং শিক্ষিতদের গাল দেন, আমার তাঁদের কিছু বলার নেই। তাঁরা নিজেরাই শিক্ষিত নন, এবং সেইজন্য নিজেদের আমজনতার সঙ্গে একাসনে বসিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। আমজনতার সঙ্গে একাসনে বসা তো খুব ভালো কথা। তবে তাঁদের শিক্ষিত করে একাসনে বসাই ভালো নয় কি? নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি। বাবা বলতেন, তোদের আর কিছুই দিয়ে যেতে পারলাম না শিক্ষা ছাড়া। কথাটা একেবারে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। পড়াশোনাটা ইচ্ছেমতো করতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু ভাগ্যিস,  শিক্ষাটা পেয়েছিলাম। এই শিক্ষাটা জরুরি। একটা সময় বাঙালির মধ্যে এই শিক্ষাটাই মূলধন ছিল। গ্রামের সাধারণ মানুষের ভেতর থেকেই উঠে আসতেন ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ত্বেরা। ঊনবিংশ শতক নিয়ে পড়াশোনা করতে করতে আমার এ কথাই মনে হয়েছে। প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে নম্র করে, ভদ্র করে।

নিজে সরকারি শিক্ষায় বড় হয়ে বুঝেছি সে শিক্ষা অন্তঃসারশূন্য। তাই মেয়ের ক্ষেত্রে বেসরকারি শিক্ষা মাধ্যমের কাছ থেকে শিক্ষা কেনা ছাড়া অন্য উপায় দেখিনি। আর্থিক কারণে খুব ছোটবেলায় ওকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে দিতে পারিনি। একটু বড় হওয়ার পর থেকে খুব সাধারণ মানের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলেই পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গে যে তিনটি বোর্ডের মাধ্যমে স্কুলশিক্ষা হয় তারমধ্যে সবথেকে কঠিন মনে হয়েছে আই সি এস সি-কে। তুলনায় সি বি এস সি এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ডের সিলেবাস অনেক কম এবং সহজ। তবে আই সি এস সি বোর্ডে তুমুল ফাঁকিবাজ ছেলেটিও বাধ্য হয়ে যেটুকু জানে, তা অন্য বোর্ডের খুব মনযোগী ছাত্রটিও হয়ত জানেনা। হয়ত বলার অর্থ অনেকেই সিলেবাসের বাইরেও প্রচুর পড়াশোনা করে। সে তো জানবেই। আমার মেয়ের যেমন পড়াশোনা একেবারেই ভালোলাগে না। কিন্তু অধিকতর সহজ সি বি এস সি বোর্ডে যেতে সে কিছুতেই রাজি হয়নি ইলেভেনে ওদের নাকি সেক্সপিয়ার নেই। সেক্সপিয়ার না থাকলে আর ইংরেজি পড়ে লাভ কি? আমাদের সময় ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ডে নম্বরই উঠত না। সেইসময়ে কলকাতার স্কুলগুলিই মূলতঃ প্রথম দিককার স্থানগুলো দখল করত। হঠাৎ রাতারাতি যেন চিত্রটা বদলে গেল। মফঃস্বল থেকেই অধিকাংশ ভালো রেজাল্ট এবং ঝুড়ি ঝুড়ি নম্বর! কিন্তু তারপরে তাদের আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না। আসলে শিক্ষা সবসময়েই রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সেটা আমাদের কেরালা রাজ্য বা প্রতিবেশি ছোট্ট দেশ ভুটানকে দেখলে বোঝা যায়। 

কিন্তু শিক্ষায় যখন রাজনীতির রঙ লাগে তখন তার চেয়ে খারাপ আর কিছু হয় না। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গ। আগামী দিনে একথা আরওই বোঝা যাবে। আর এর শিকার হয় জেনারেশনের পর জেনারেশন সাধারণ মানুষ। তৈরি হয় একটি সম্পূর্ণ অশিক্ষিত জাতি। এতটাই অশিক্ষিত যে শিক্ষার অভাব তার মনে লজ্জা নয়, গর্ব তৈরি করে। শিক্ষার অভাব তাকে ঈর্ষায় নীল করে দেয় শিক্ষিতদের প্রতি। এই অশিক্ষাই জন্ম দেয় মিথ্যা, স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, ধর্মান্ধতার মতো বৈশিষ্ট্যগুলির। আর একবার অশিক্ষা মজ্জায় ঢুকে গেলে তাকে শিক্ষিত করা খুব কঠিন। শিক্ষাকে গ্রহণ করার মতো মানসিকতা আর থাকে না। শিক্ষা তখন তার কাছে একটি বর্জনীয় পদার্থ। আর এরই সুযোগ নেয় আবার রাজনীতি। এরা যত বেশি জানে, ততো কম মানে। এটা বড় সত্যি কথা। অশিক্ষিতকে সহজে বোঝানো যায়, সহজে ভোলানো যায়, সহজে অধীনত করা যায়। শিক্ষা বড় শক্ত জিনিস। হজম না করতে পারলেই বদহজম হয়ে যায়। নিজেকে শিক্ষিত বলে দাবী করে যেসব লেখাপড়া জানা অশিক্ষিতেরা তারা আরও ভয়ঙ্কর সমাজের পক্ষে।


ভেবে দেখেছি রাজনীতি বড় বিশ্রী ব্যাপার। ওর ধারেকাছে আমার না ঘেঁষাই ভালো। বুঝিও না ঠিক ওটা খায় না মাথায় দেয়। আমি বরং ঊনবিংশ শতকেই ফিরি। সেই সময়েও সমাজে নানা কিছু নেতিবাচক দিক ছিল। তবু বাঙলা এবং বাঙালির স্বর্ণযুগ সেটা শিক্ষা এবং আদর্শে। আমার ওখানে নিজেকে অন্তত ইনসিকিওরড লাগেনা।

Friday, May 20, 2016

এই লেখার নাম মেরুদণ্ড ছাড়া যে কোনও কিছুই

আমি মেরুদণ্ড নিয়ে লিখিনা।

জীববিজ্ঞানে একসময়ে পড়েছিলাম মেরুদণ্ড মানুষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তখন লিখতেই হত।

ইদানীং মেরুদণ্ড নিয়ে অনেক কিছু পড়ি। বায়োলজিতে নয়, কাব্যে। কবিরা লেখেন আর তাঁদের স্তাবকেরা নিজেদের মেরুদণ্ডহীন পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বাহবা দেন। কবিদের মেরুদণ্ড থাকে কিনা বা থাকলেও তা কেমন আমার জানা নেই। 

আমার নিজের মেরুদণ্ডের অসুখ দীর্ঘদিনের। আর তাও বারান্দায় সোজা হয়ে দাঁড়ালে আমি কোনও মেরুদণ্ডওলা জীব দেখতে পাইনা। 

আমি আর যাইহোক মেরুদণ্ড নিয়ে লিখিনা।

কেন ভোট দেব?

এইসবই আমার শোনা কথা, তবু মনে প্রশ্ন জাগে। শুনেছি বাম আমলে পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষের বিঘে বিঘে জমি সিপিএম দখল করেছিল। তাই তারা বা তাদের উত্তর পুরুষেরা কখনওই আর সিপিএম-কে ভোট দেন না। মানে দেবেনই বা কেন? তাঁদের রাগের তো সঙ্গত কারণ আছে। কখনও যদি সিপিএম-কে ভোট দিলে তা পশ্চিমবঙ্গের ভালো হয় তাও দেবেন না। অবশ্যই ব্যক্তিস্বার্থ আগে। সেটাই তো পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির মূল সূত্র।

আর আমরা যাদের পূর্বপুরুষেরা ভিটে-মাটি উচ্ছেদ হয়ে এক বাংলা থেকে অপর বাংলায় এসেছি, আমাদের অনেকেরই ওরকম বিঘে বিঘে জমি ছিল ও বাংলায়। শুনেছি আমার দিদা ডঃ বেণীমাধব বড়ুয়ার মেয়ে, তাঁকেও বোরখা পরে বাংলাদেশ ছাড়তে হয়েছিল। অথচ এখনও বোধহয় আমার দাদুদের সেই মুৎসুদ্দি পাড়া রয়েছে ওখানে। আমার ঠাকুরদাদাদের জমিদারী ছিল সে কথা না বলাই ভালো, কারণ পশ্চিমবঙ্গে একটা বিশ্রী ব্যঙ্গ আছে এই বাঙালদের নিয়ে যে তারা সকলেই নাকি দাবি করে যে তাদের পূর্বপুরুষ ওপার বাঙলায় জমিদার ছিল।

আমরা এখনও অধিকাংশই ভিটে-মাটির মালিক হয়ে উঠতে পারিনি বাম-ডান কোনও আমলেই। এখনও আমরা এই বাঙলায় চিহ্নিত এবং কিছুটা ব্রাত্য 'বাঙাল' বলে। হয়ত আমাদের মধ্যে সেটা কিছুটা গর্বও কাজ করে কারোর কারোর। কিন্তু আমি ভাবি, আমরা কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করব? আমাদের তো শুধু ভিটে-মাটিই যায়নি, আমাদের শিকড় চলে গেছে। আমরা ওই বাংলায় 'পশ্চিমবঙ্গের লোক' আর এই বাংলায় 'বাঙাল'

আমি কেন ভোট দেব কাউকে?

Thursday, May 19, 2016

আত্মরক্ষা

আমি তো তোমাকে বলেইছিলাম, এমনটাই হবে।
এছাড়া অন্য কোনও বিকল্প ছিল না তাই। এমনটাই হবে।
চিরকাল নিজের কবর মানুষ নিজেরাই খুঁড়েছে। আর খুঁড়েছে
ঠিক তখনই, যখন তার পিঠ পুরোপুরি দেওয়ালে ঠেকে গেছে।
দেওয়ালে ঠেকে যেতেই সে কুঁকড়ে কেবল নীচু হতে হতে
একসময় পুরোপুরি বেরিয়ে এসেছে মানুষ নামক খোলস থেকে।


অনুগত হও

অনুগত হও।
কেন বার বার প্রশ্ন কর?
বলেছি না, অনুগত হও।
নাহলে ওই উদ্ধত মাথা
কী করে নত করতে হয়
সে মন্ত্র আমার জানা আছে।

অনুগত হও।
নাহলে তুমি এবং তোমার প্রিয়জনদের
বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই।

অনুগত হও, পা চাটো।
তোমাকেও মুষ্টিভিক্ষা দিতে পারি
মানুষের রক্তে-ঘামে ভেজা লুটের ভাগের।

অনুগত হও, পা চাট।
কে বলতে পারে তোমাকেও
দিয়ে যেতে পারি ক্ষমতার উত্তরাধিকার।

Thursday, May 12, 2016

সম্পাদকীয় - ষষ্ঠ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা 'আমাদের ছুটি'-র জন্মদিনে


কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে পাঁচটা বছর কেটে গেল! ২০১১ সালের ১২ মে 'আমাদের ছুটি'-র পথচলা শুরু হয়েছিল। তার নির্মাণ পর্ব চলেছিল আরও দুবছর আগে থেকেই, সেই ২০০৯ সাল থেকে ছবি, তথ্য, লেখা সব জড়ো করার পালা। গত কয়েক বছরে বদলে বদলে গেছে সহযোগিতার হাত। এই মুহূর্তে 'আমাদের ছুটি'-র সঙ্গে খুব সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে রয়েছেন সহ সম্পাদক সুদীপ্ত দত্ত আর আমাদের সকলের প্রিয় সুবীরদা ও বাপ্পাদা - অর্থাৎ সুবীর কুমার রায় এবং তপন পাল।

প্রায় কোনও প্রচার না থাকলেও 'আমাদের ছুটি' যে বেশ কিছু পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে তা শুধু গুগল অ্যানালিটিকসের তথ্য থেকে নয়, নানা টুকরো টুকরো প্রতিক্রিয়াতেও বুঝতে পারি। ওয়েবসাইটে মতামতের পাতায়, ফেসবুকে, ই-মেলে পত্রিকাটিকে ভালোলাগার অনুভূতির কথা নিয়মিতই কেউ না কেউ জানান। একাধিক পাঠক এমনও জানিয়েছেন যে, বিনামূল্যেই এত ভালো সব লেখা পাচ্ছেন যে প্রিন্টেড ভ্রমণ পত্রিকা না কিনলেও চলে! 'আমাদের ছুটি'-র পাতাতেই লেখালেখি শুরু করে এখন নিয়মিত লেখক হয়ে ওঠার জন্য ধন্যবাদও জানিয়েছেন কেউকেউ। আবার কোনও পাঠক পত্রিকা প্রকাশ কেন এত দেরি করে হয় তাই নিয়ে ক্ষোভও জানিয়েছেন।

পাঠকদের কাছে আবারও আমরা ক্ষমাপ্রার্থী, বছরে চারটের বেশি সংখ্যা প্রকাশের আয়োজন কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। তবে লেখার ধরণে নানা বৈচিত্র্য এনে গতানুগতিক ভ্রমণ কাহিনির বাইরে অন্যস্বাদ পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি আমরা। এই সংখ্যায় স্মৃতির ভ্রমণের পাতায় স্বনামধন্য লেখিকা মেরি ওলস্টোনক্রফটের দীর্ঘ ভ্রমণকাহিনির একটি টুকরো অনুবাদে দেওয়া হল। আগামীদিনে এমন আরও বিদেশি পুরোনো ভ্রমণকাহিনির অনুবাদ পাঠকের দরবারে হাজির করবার ইচ্ছে রইল।

জনপ্রিয়তার স্বাভাবিকভাবেই কিছু মন্দ দিকও থাকে। তার ভুক্তভোগী আমরাও। 'উত্তরের সারাদিন' নামে উত্তরবঙ্গকেন্দ্রিক একটি সংবাদপত্র গত বেশ কয়েকমাস ধরে নিয়মিতভাবেই কোনও অনুমতি বা স্বীকৃতি ব্যতিরেকেই 'আমাদের ছুটি' থেকে লেখা ও তথ্য তাঁদের কাগজে পুনঃপ্রকাশ করছিলেন। একই কাজ করছিল বাংলাদেশের একটি নিউজ পোর্টাল বিসিসি টোয়েন্টি ফোর নিউজ ডট কম যারা কিনা নিজেদের 'সততার প্রতীক' ঘোষণা করে! এছাড়াও দুটো-একটা লেখা বিচ্ছিন্নভাবে অন্য দু-একটা ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়েছে তা নজরে এসেছে আমাদের। যথাবিধি চিঠি পাঠানোর পর চৌর্য্যবৃত্তি বন্ধ হয়েছে, কিন্তু খোলাখুলি স্বীকার করতে হয়ত তাঁদের সকলেরই 'সততায়' বেঁধেছে।

'আমাদের ছুটি' তার নিজের যোগ্যতায় আর আপনাদের আগ্রহে আজ এই জায়গায় পৌঁছেছে। ভ্রমণ ও তার কাহিনি লেখার মারফত সারা পৃথিবীর বাঙালির মধ্যে যে একটা বন্ধুত্ব গড়ে তোলা যায়, পাঁচ বছর আগে দেখা এই স্বপ্ন আজ সত্যি হয়েছে। যে যত্নে প্রতিটি সংখ্যার নির্মাণ হয় তা কি কয়েকটা লেখা আর ছবি টুকে প্রকাশ করে দিয়ে নিজেদের সততার প্রতীক বলে জারি করলেই হয়ে যায়? তার গায়ে যে ভালোবাসা আর মায়া মাখানো থাকে তা তো চুরি করা যায় না। অনেক কিছুই হয়না, হওয়া যায় না, অর্জন করতে হয়। অনেক কিছুই হয়না, নির্মাণ করতে হয়।


এই পাঁচ বছরে 'আমাদের ছুটি' আমার নিজের কাছে তেমনই এক অর্জন, এক নির্মাণ। পাঠকের কাছে তা কী সেটা তাঁরাই জানাবেন।
www.amaderchhuti.com

Tuesday, May 10, 2016

ওয়েটিং ফর গোডো

অল্পবয়সে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলাম বন্ধু চাই।
ঈশ্বর দিলেন।

তরুণ বয়সে বললাম, এবারে প্রেমিক দাও।
ঈশ্বর তাও দিলেন।

মাঝ বয়সে এসে একেবারে চেপেই ধরলাম তোমাকে চাই।
কোনও সাড়াশব্দ নেই।
বললাম, তুমি রবি ঠাকুরের লেখা পড়নি? ওই যে বলে গেছেন, এতো যদি দিলে সখা, আরও দিতে হবে হে, তোমারে না পেলে আমি ফিরিব না, ফিরিব না।
ঈশ্বর ধাঁ করে দর্শন দিয়ে বললেন, শালা, তোর গালে যে দুটো থাপ্পড় মারিনি এই ঢের। পরমুহূর্তেই অন্তর্ধান করলেন।

জীবনের শেষে এসে তাই অপেক্ষায় আছি, কবে তিনি আমাকে চাইবেন...


Ø  লেখাটির নাম Samuel Beckett -এর বিখ্যাত নাটক Waiting for Godot -এর নাম থেকে নেওয়া।


লাল গানে নীল সুর

আগে দেহের প্রাচীর ভাঙো, দেখবে গো সাঁই, মনের সেতু আপনি জোড়া লাগবে।/ কামনার ইটের পরে ইট সাজিয়ে গড়া দেহ, ইট খসালেই তুমি-আমি নাহি কেহ।/ থাকে কেবল সেই জনা।

তারে কেউবা ভজো আল্লা নামে, কেউবা মজো কৃষ্ণ ভাবে; / খেপী কয়, নামে কী আসে যায়,
তার প্রেমে ডুব দেয় সবজনা।/ তুমি-আমি সবজনা।

ডুব দিলে সাঁই একেবারে, আল্লা হরি মিলতে পারে।/ না ডুবিলে কেবল দেহ পড়ে রয়, মন তো মেলে না।

একবার ডুব দিয়ে দেখ গো সাঁই, নাহলে মন তো মেলে না।


Monday, May 9, 2016

মনের মানুষ

মেয়ে বায়না ধরেছে মনের মানুষ চাই তার। মাটি ছেনে ছেনে শিল্পী তাকে গড়তে বসল। হাত-পা-মাথা-শরীর কেমন দিব্যি সুন্দর হয়। কেবল বাকি থাকে চক্ষুদুটি। চোখেই তো মূর্তির প্রাণ প্রতিষ্ঠা। চক্ষুদুটি বাঙময় হলে ফুটে ওঠে মূর্তির ভাব, তার মনের ভাষা। মূর্তির শরীরে রঙের পোঁচ পড়ে, রঙ শুকিয়ে গেলে মেয়ের পছন্দের রঙিন কাপড় যত্ন করে পরিয়ে দেয় শিল্পী।

সব শেষ হলে মেয়ে জিজ্ঞাসা করে, আর চোখ দুটি? তা করবে না? শিল্পী বলে, তোমার মনের মানুষের চোখ আমি কী করে আঁকি বলতো? সে তো তাহলে আমার মনের মতন হবে। তোমার মনের মতন তো আমি বানাতে পারব না। মেয়ে অবাক হয়ে বলে, বা রে, তা কী হয়, আমি তো তোমার মতো আঁকতে পারব না, ট্যাঁরা হবে না ব্যাঁকা হবে, কে জানে! শিল্পী বলে, তা যাই হোক, তাতেই সে তোমার মনের মানুষ তো হবে। মেয়ে রাগ করে বলে, বিচ্ছিরি হলে আমি কিছুতেই সইতে পারব না। শিল্পী শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, বেশ, আমার মনের মতন করে এঁকে দিচ্ছি, তখন যেন বোলো না যে সুন্দর হয়নি।

শিল্পী তো তার সব মনপ্রাণ দিয়ে মূর্তির চোখ আঁকল খুব ধৈর্য ধরে, যত্ন করে। শেষ হলে মেয়ে বহুক্ষণ দেখলে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, এপাশ থেকে, ওপাশ থেকে। শিল্পী জানতে চাইল, কোনোখানটা হয়নি বল, মুছে ঠিক করে দিই। মেয়ে বলল, হয়েছে, সবটুকুই হয়েছে, এর চাইতে ভালো আর কিছুতেই হতো না। বলে চুপ করে রইল। শিল্পী বলল, তবে, পছন্দ হয়নি? মেয়ে মাথা নেড়ে বলল, খুব পছন্দ হয়েছে, কেবল...। শিল্পী বলল, কেবল কী? মেয়ে বলল, কেবল আমার মনের মানুষটি হয়নি।


Sunday, May 8, 2016

তুমি হে

তোমায় ভুলতে দিতে নাইকো আমার ভয়... গান-কবিতার ঘোরে শব্দটা মাথার মধ্যে ফিরে ফিরে আসে বৃষ্টিপাতের মতো, রবি ঠাকুরের গানের মতো, তোমার মতোই ফিরে ফিরে আসে। বহুকাল আগে বিদ্যাপতি গান বেঁধেছিলেন, মাধব বহুত মিনতি করি তোয়..., রবি ঠাকুর সেই সুর মাথায় রেখে ভানুসিংহের পদাবলীতে গাইলেন, তুঁহু নহি বিসরবি, তুঁহু নহি ছোড়বি...। ঈশ্বর আর প্রেমিক মিলে গেলেন হৃদয়ে।

অথচ তুমি চিরকাল দাঁড়িয়ে থাকলে আমার গানের ওপারে। আর আমি ইহজীবনে শুধু ডাক দিয়েই গেলাম, বাহির হয়ে এস তুমি যে আছ অন্তরে...

কোনও কোনও পাঠক বা শ্রোতা প্রশ্ন করেন, জানতে চান, কে তুমি? নিজের গভীরে ডুবে উত্তর খুঁজে পাই না। কলম হাতে লিখতে বসে হয়ত এমন প্রশ্নের সম্মুখীন সকলেই হয়েছেন। অন্যের কাছে অথবা নিজের কাছেই কে তুমি আমারে ডাক, অলখে লুকায়ে থাক, ফিরে ফিরে চাই, দেখিতে না পাই...।

শহীদ কাদরির কবিতায় সুর বসিয়ে সুমন একদিন গেয়ে উঠেছিলেন, তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা...সেই সুর মাথার মধ্যে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হতে হতে আমরাও যেন মাথা নত করেছি সেই প্রিয়তমার সম্মুখে, বলতে চেয়েছি, ভয় নেই, এমন দিন এনে দেব, বোমারু জঙ্গি যত বিমানের ঝাঁক থেকে বোমা নয় গুলি নয়...নাহ্‌, মুখ ফুটে বলতে পারিনি কোনদিনও।

রবি ঠাকুর একবার বলছেন, চিরবন্ধু, চিরনির্ভর, চিরশান্তি তুমি হে প্রভু..., আবার পর মুহূর্তেই দাবি করে বসছেন, তাই তোমার আনন্দ আমার পর তুমি তাই এসেছ নীচে, আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে...।

আর তাই সারাজীবন সেই তোমাকেই খুঁজে ফিরেছি তোমায় আমায় মিলন হবে বলে আলোয় আকাশ ভরা, তোমায় আমায় মিলন হবে বলে ফুল্ল শ্যামল ধরা...। এই ফুল্ল শ্যামল ধরাতেই তোমাকে খুঁজে ফিরেছি আলোয় ভরা আকাশের নীচে, পার্থিবে অপার্থিব তোমায়। আমি খুঁজতেই থাকি আমার কলমে, বইয়ের পাতায়, চেনা অচেনা মানুষের মাঝে, সেই তোমায়।

যে তুমি আমার বন্ধু হে...।

রবীন্দ্রজয়ন্তী!

সকাল সাড়ে আটটায় সময়। সোয়া আটটা থেকে গিয়ে বসে আছি। শুরুতেই রিশেপশনে জানালো আরেকজনের চলছে একটু অপেক্ষা করুন। বলি, তাহলে ফাস্টিং-এর ব্লাডটা নিয়ে নিন, একটু চা-বিস্কুট খেয়ে নিই। ব্লাড দিয়ে সামনের দোকান থেকে চা খেয়ে ফিরে আসি। তারপরেও অপেক্ষা করতেই থাকি। অপেক্ষা করতে করতে মোবাইলের নোটে আস্ত একটা গদ্যই লেখা হয়ে যায়। এবং খিদেতে কাহিল। মানে সকাল হলেই আমার বড্ড খিদে পায় কিনা, আর তখন তো প্রায় দশটা বাজে। খিদের আর দোষ কি? উঠে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি, কত দেরি? শুনি এখনও অনেক দেরি আছে। বলি, তাহলে একটু খেয়ে আসছি। বেরিয়ে আবার চায়ের দোকানে যাই। ডিম-পাঁউরুটির অর্ডার দিই। তারপর প্লেটটা হাতে নিয়ে যেই না এক কামড় দিয়েছি, অমনি ফোন, আপনার টার্ন এসে গেছে। যাব্বাবা, আমার মুখ ভর্তি পাঁউরুটি, টার্ন এলেই হল? কোনওমতে জল দিয়ে কোঁত কোঁত করে গিলে ঘুগনীর দিকে সতৃষ্ণ নয়নে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডায়গনোস্টিক সেন্টারে ফিরে এসে শুনি আরেকজনের এম আর আই শুরু হয়েছে। আরও মাত্র পঁচিশ মিনিট বসতে হবে। তা বসি, বসেই থাকি। ছোটবেলা থেকে ডাক্তারের চেম্বার আর ডায়গনোস্টিক সেন্টারে গিয়ে গিয়ে এসব বিষয়ে আমার ধৈর্য অনন্ত। কিন্তু আধ ঘন্টা বাদে যখন আমার পরে আসা আরও একজনকে ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে দেখি, অসীম ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। রিশেপশনে গিয়ে বলি, দুঘন্টার ওপর বসে আছি, আর কতক্ষণ? আমার মেজাজ দেখে সে ভেতরে পাঠায়। ভেতরে আরেক মহিলা মধুর হেসে আমাকে ড্রেস চেঞ্জ করে দু মিনিট বসতে বলে। ইতিমধ্যে একজন বেরিয়ে এলে, আরেকজনকে ঢোকায়। আমি আপত্তি জানালে আবারও মধুর হেসে বলে, জাস্ট দুমিনিট। অপেক্ষায় থাকি, দু মিনিট কতক্ষণে শেষ হয়। জিজ্ঞাসা করি, এস আই জয়েন্ট কোথায়? বলে, কোমরে। মনে মনে ভাবি কোমরে তো গুচ্ছের জয়েন্ট আছে, সেই কবে ফিজিওলজি পড়েছিলাম, ভুলে মেরে দিয়েছি। তবে আর কথা বাড়াই না। আবারও মধুর হেসে সে বলে, আপনার ফোনটায় পছন্দের গান বেছে দিন, হেডফোনে লাগিয়ে দেব। (মনে মনে দাঁত কিড়মিড় করি, আমি কি ছেলেমানুষ যে ভোলাচ্ছ?) কানে হেডফোন দিয়ে গান শোনা আমার একেবারে পোষায় না, কিন্তু এবারেও কথা বাড়াই না।

অতঃপর সেই দু মিনিট শেষ হলে ঢুকে পড়ি। এম আর আই-এর পূর্ব অভিজ্ঞতায় জানি অত ছোট জায়গায় দম আটকানোর মতো একটা কষ্ট হয় বটে, তবে চোখ বুজে থাকলে সে ব্যাপারটা ম্যানেজ হয়ে যায়। কিন্তু ভয়ানক আওয়াজের কথাটা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। যাইহোক শুয়ে পড়ে কানে বড় একটা হেডফোন লাগালে মাথাটা কিছুতেই বেডের ঠিক জায়গায় খাপে খাপে ঢুকতে চায়না। তো সেই মধুর মেয়েটি এসে কোনওমতে ম্যানেজ করে লাগিয়ে দিয়ে মাথাটা চেপেচুপে ঢুকিয়ে দেয়। তার ওপর দিয়ে আবার একটা গোল ধরণের চাপা দিয়ে দেয় যাতে আমি আর মাথা তুলতে না পারি। হেডফোনও আমার দুকানে বেশ চেপেই বসে। এবং তা দিয়ে আবার মধুর কন্ঠস্বর ভেসে আসে, ভয় পাবেন না, আমি আপনার সঙ্গেই আছি। (মনে মনে ভাবি, আ মোলো যা, খামোখা ভয় পেতে যাব কেন!)

ওদিকে তো হেমন্ত বেজে ওঠেন, কি গাবো আমি কি শুনাব... ঘ্যাঁ ঘ্যাঁ...ঘড়ড়ড়...বুঝি আরম্ভ হয়েছে। আহা, ভেবেছিলুম রবীন্দ্রজয়ন্তী, কানে নাহয় রবীন্দ্রনাথই বাজুক। বাজছেন তিনি হয়তো অন্তরে, মরণেরও মুখে রেখে... ঘড়ড়ড়...। মনে পড়ল মেট্রোতে যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজতো তখন অনেকটা এভাবেই শুনতে হতো। যাইহোক নিজেকে আশ্বস্ত করি, রবি ঠাকুর বাজছেন তো ঠিক, সে আমি শুনতে পাই আর না পাই...। ওদিকে কানে মধ্যে ক্রমশ চেপে বসছে হেডফোন। কানের ব্যথা ঘাড়ে আর মাথায় ছড়িয়ে পড়ছে। ক্রমশ যে করেই হোক হেমন্তের হাত থেকে মুক্তি পেতে আমি বদ্ধ পরিকর হলাম। মাথা সামান্য এগোনো-পেছোনো...ঘ্যাঁগা ঘ্যাঁগা ঘ্যাঁগা...অবিকল মনে হচ্ছে মাথার মধ্যে কে বাবা, বাবা...’ বলে যাচ্ছে। যদিও আমার অবস্থা তখন বাবারে মারে ছেড়ে দে রে। এম আর আই নিয়ে আমার আর মাথা ব্যথা নেই। সমস্ত ব্যথা কেন্দ্রীভূত হয়ে দুকানের হেডফোনে। কিছুতেই ম্যানেজ করা যাচ্ছে না। ওদিকে প্রবল আওয়াজের ফাঁকেই হেমন্ত বেজে উঠছেন, অচেনাকে ভয় কি আমার ওরে...। হাত দুটোকে স্লো মোশানে ওপরে ওঠাচ্ছিলাম যাতে কেউ টের না পায়, কিন্তু ওঠাতে না ওঠাতেই দেওয়ালে গেল আটকে। হেমন্ত, ঘ্যাঁ কোঁ কো সব পেরিয়ে এবারে জোরে চেঁচাই সেই মধুর উদ্দেশ্যে হেডফোনে কানে লাগছে ভীষণ, খুব কষ্ট হচ্ছে...। হেমন্তকে পজ করে মধুর কন্ঠস্বর ভেসে আসে, আর মাত্র সাতমিনিট, একটু কষ্ট করুন। অতএব একটু কষ্ট করে সেই সাত মিনিট-এর অপেক্ষা করি। হেমন্ত একেবারে কানে কানেই জানান,হায় গো, ব্যথায় কথা যায় ডুবে যায় যায় গো... গানের বাকি অংশ আবারও ডুবে যায় আওয়াজে - ঘড়ড়ড়...। এবার মাথাটা ওপরের দিকে তোলার চেষ্টা করি, যদি দুকানের থেকে দৈবাৎ খুলে আসে হেডফোন। সামান্য তুলতে না তুলতেই আটকে যায়, মনে পড়ে ওপর দিয়ে আরও একটা তো পরানো আছে। ওভাবেই মাথাটা ঝুলিয়ে রাখি...ঘাড় দিয়ে ব্যথা উঠে মাথা যন্ত্রনায় ছিঁড়ে যাচ্ছে... সত্য মরিয়া গিয়াছে পঞ্জাব মেলের সঙ্গে দার্জিলিং মেলের কলিশন রক্তারক্তি -পিসীমা –’ খুব বিপদে পড়লে রবি ঠাকুরের পরেই হয় শিবরাম নয় পরশুরামকে মনে পড়ে আমার। ওই আর কী রাম নাম জপা। ঘড় ঘড় থেমে যায় আচমকাই আর সুযোগবুঝে হেমন্তও গেয়ে ওঠেন, এ পথে আমি যে গেছি বারবার... আমাকে টেনে বার করে আনে। আমিও আর্তনাদ করে উঠি এবার, হেডফোন, হেডফোন খুলুন, তাড়াতাড়ি...।

সব গুছিয়ে বেরোনোর আগে মোবাইল নিতে গেলে আবার মধুর হেসে জিজ্ঞাসা করে, আপনার কি দুটো পয়েন্টেই ব্যথা?' বলি, সব, সব জায়গায় ব্যথা যেখানেই চান। আমার তখনও কান-মাথা সব ঝনঝন করছে...


হেডফোন তো কখন খোলা হয়ে গেছে, তবু হেমন্ত যেন মাথার মধ্যে বেজে যান,বরষ ফুরায়ে যাবে, ভুলে যাবে, ভুলে যাবে, ভুলে যাবে জানি...। ভাবি, ভাগ্যিস!

Wednesday, May 4, 2016

পূর্বাভাস

আজ বৃষ্টি পড়বে জানতাম।

অনেক দহন শেষে এভাবেই নেমে আসে
ঘন মেঘের অভিমান কয়েক ফোঁটা অশ্রুপাতে।

পূর্বাভাস ছিল না, তবুও...

একেকদিন যেমন কান্নাভেজা ঠাণ্ডা হাওয়া
তোমার মতোই ছুঁয়ে দিয়ে যায় শুষ্ক কপাল।

ভালোবাসা

ভালোবাসা দীর্ঘ কবিতার মতো
লিখতে লিখতে নিজেকে নিংড়ে নেওয়া,
তারপর আবার কালিতে কলম ডোবানো।
ভয় করে, কখনও কলম তুলে নিলে নিলে
এ কাহিনি হয়তো অসমাপ্তই রয়ে যাবে।
খুব ক্লান্ত হয়ে গেলেও শব্দ, শব্দ
এবং আরও শব্দ জুড়তে জুড়তে

অন্তহীন লিখেই চলি...।

কবিতার জন্য

কবিতার জন্য একটা যুদ্ধ করলে কেমন হয় বলতো?

শব্দের তরবারি, হরফের তীব্র গোলাবারুদের আওয়াজ, কলমের বিষাক্ত তীর...

মানুষের লোভ, ঘৃণা আর নির্মমতার কাছে অনেকদিন ধরে হারতে হারতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে কবিতা ও প্রেমের। এবার ঘুরে দাঁড়ানো যাক, কি বলো?

চলো ওদের জন্য একবার অস্ত্র ধরি কবিতা অথবা শান্তির জন্য।
আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্যও, যাদের একটা সবুজ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম।

একদিন তো মরবই, শেষ লড়াইটা নাহয় লড়েই নিই।

জিতে গেলে আবার স্বপ্ন দেখতে বসব হয়তো...
হেরে গেলেও কোনও আর দুঃখ থাকবে না।

শেষ রক্ত, ঘাম, অশ্রুপাত শুধু কবিতার জন্য...

কবিতা অথবা তোমার জন্য নিঃশেষ হোক এ জীবন।

Monday, May 2, 2016

ঈশ্বর

যদি ঈশ্বর হও, এসো হাত ধর আমাদের এখনও অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। খুব ক্লান্ত, অবসন্ন হলেও এখনও অনেকটা পথ বাকি আছে। এসো হাত ধর  নরক না স্বর্গ কোন দিকে নিয়ে যাবে, সে একান্তই তোমারই ইচ্ছে। সে পথে শত্রুর আঘাত আমাকে খণ্ড খণ্ড করবে কিনা অথবা বন্ধুর হৃদয় জুড়ে দেবে সব ভাঙাচোরা, তা পছন্দের ভারও তোমার ওপরেই ছেড়ে দিলাম।

যদি ঈশ্বর হও, এসো, হাত ধর।