Thursday, May 26, 2016

আনফিনিসড পোট্রেট

ছোটবেলা থেকে সবসময় এই স্বপ্নটা পেরোতে চেয়েছি। অন্ধকারের মধ্যে শুধু পাল্লাহীন একটা দরজার ফ্রেম যার অন্যপাশটা অন্ধকার। প্রতিবারই ওপাশটায় পা দিয়ে ক্রমশ অতল অন্ধকারে নেমে গেছি। এইসময়েই ঘুমটা ভেঙে যেত আর বুঝতাম ওটা নিছক স্বপ্ন। অথচ কোথাও একটা হয়ত আশা থাকত কোনদিন ওপাশটায় আলো থাকবে। ছোটবেলায় বোধহয় এভাবে কখনও ভাবিনি। ছোটবেলায় স্বপ্নটা দেখতেই চাইতাম না। অথচ একেকসময়ে প্রতি রাতেই দেখতাম বা ঘুমিয়ে পড়লেই। স্বপ্নটাকে বেশ ভয়ই পেতাম একটা সময়। অথচ আমাকে দেখতেই হত। বেশ বড় বয়স পর্যন্তই দেখেছি, হয়ত কলেজ জীবনেও। তারপর অনেকদিন আর দেখিনা।

সেদিন আগাথা ক্রিস্টির একটা উপন্যাস পড়ছিলাম। গোয়েন্দা কাহিনি নয়। মেরি ওয়েস্টম্যাকট ছদ্মনামে যে ছটি উপন্যাস লিখেছিলেন তারই একটি আনফিনিসড পোট্রেট। মূল মহিলা চরিত্রটি ছোটবেলায় একটি ভয়ের স্বপ্ন ক্রমাগত দেখার প্রসঙ্গে আবার মনে পড়ল নিজের স্বপ্নটা। মহিলাটিকে কেন্দ্র করে ঘটনা আবর্তিত হলেও হয়ত মূল চরিত্র ওই স্বপ্নটাই। ছোটবেলায় নিয়মিতই স্বপ্নে একটি গানম্যানকে তিনি দেখতে পেতেন যার একটি হাত নেই, যে রূঢ়ভাবে তার দিকে চেয়ে থাকত। একটু বড় হলে নিজের চেনা চরিত্রগুলোই অন্য স্বপ্নের মধ্যে বদলে গিয়ে কোনও একজন এক একবার গানম্যান হয়ে যেত। বড় হওয়ার পর মহিলাটি আর সেই স্বপ্নটা দেখতেন না। কিন্তু নিজের জীবনে বদলে যাওয়া মানব চরিত্রের মধ্যে স্বপ্নের সেই গানম্যানকে দেখে ভয় পেতেন। কাহিনির একেবারে শেষে যখন মহিলাটি স্বপ্নের সেই গানম্যানকে বাস্তবে সত্যি সত্যিই দেখতে পাবেন তখন প্রাথমিকভাবে আতঙ্কিত হলেও সে যে আসলে একেবারেই সাধারণ একটা মানুষ, ভয় পাওয়ার কিছুই নয়, সেইটা অনুভব করে নিজের ভয়টা কাটিয়ে উঠবেন। ঊনচল্লিশ বছর বয়সে আবার নতুন করে জীবন শুরু করবেন, যে জীবনে তাঁর ছোটবেলার সেই ভয় তাঁকে আর তাড়া করে বেড়াবে না। 

ছোট থেকেই তিনি খুবই কল্পনাপ্রবণ ছিলেন, নিজের কল্পনার সেই জগতেই থাকতে ভালোবাসতেন। কথা খুব কম বলতেন, মিশতে পারতেন না সহজে, বই পড়তে ভালোবাসতেন। একটা সময় তা কাটিয়ে উঠতে গিয়ে বাধা পান। তারপর লিখতে শুরু করেন। প্রথম লেখা প্রকাশকের কাছ থেকে ফেরত এলেও পরে আরেক প্রকাশকই ওঁকে আবিষ্কার করেন। লেখক হিসেবে কিছুটা পরিচিতিও হয়। একবার আত্মহত্যা করতে গিয়ে বেঁচে যান। হয়ত দ্বিতীয়বার করতেন, কারণ তাঁর মনে হয়েছিল সেই গানম্যান-এর হাত থেকে সারাজীবনেও তাঁর আর নিস্তার নেই এবং এই ভয় তাড়িত জীবন তিনি আর বইতে পারছেন না। কিন্তু বাস্তবে শেষপর্যন্ত যাকে তিনি অবচেতনে ভয় পেতেন, চেতনে তাঁর কাছেই না জেনে নিজের জীবনের কথা খুলে বলেন। যে মুখ ফুটে কথাই বলত না, এক রাতেই বলে ফেলে সারা জীবনের অজস্র ঘটনা। আর তাকেই ঠিকমতো সাজিয়ে নামটাম দিয়ে লিখে ফেলেন সেই পুরুষটি যিনি শুনেছিলেন নিঃশব্দে। আসলে কখনওই মহিলাটির কথা কেউ এত মন দিয়ে এবং বাধা না দিয়ে শোনেনি। কাহিনির কথক একসময় ছবি আঁকিয়ে ছিলেন, প্রথম জীবনে যুদ্ধে তাঁর সেই হাতটি বাদ যায়, যা দিয়ে তিনি আঁকতেন। তাঁর জীবনের এটাই প্রথম লেখা বা ভিন্ন মাধ্যমে ছবি আঁকা। লেখাটি তিনি পাঠাচ্ছেন তাঁর এক বন্ধুর কাছে যিনি একজন লেখিকা।

উপন্যাসটা পড়ে মনে হল, আমিও সেই স্বপ্নটাকে পেরোতে পেরেছি কি? বোধহয়, একটু একটু করে। আসলে অবচেতনে যা মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে চেতনে হয়ত তা আদপে ভয়েরই নয়। হয়ত সেই ফ্রেমহীন দরজার ওপারে অনেকটা আলোই থাকে যাকে শেষপর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়।


স্বপ্নের গানম্যান আসলে আতঙ্কের কেউ না। বাস্তবে সেই বন্ধু হয়ে ওঠে। অথচ বাস্তবের অনেক চরিত্রই যাকে বিশ্বাস করা যায়, শেষপর্যন্ত বদলে যায় গানম্যান-এ।

No comments:

Post a Comment