Tuesday, March 21, 2017

রতনের গল্প পড়ার আর না হয়ে ওঠা উপন্যাসের কথা


একটু একটু করে পড়ছি, অনেকদিন ধরে - উড়োজাহাজ। সবটা মানে চারটে খণ্ড পড়া শেষও হয়নি। এ তো ঠিক পুস্তক আলোচনা নয় তাই যে কোনও জায়গায় দাঁড়িয়েই কিছু কথা লিখে ফেলা যায়। গল্প ধরে ধরে আলোচনাও নয়। এটা আমার ভালো লাগার অনুভূতির কথা।

ছোটবেলায় আনন্দমেলায় কখনও অধীরদার লেখা পড়েছি নিশ্চিত। তবে কখনওই প্রথম শ্রেণীর শিশু সাহিত্যিকের কোনও তকমা অধীর বিশ্বাসের জোটেনি। অথচ এমন অনেকেই পেয়েছেন আমার চোখে যাঁদের যোগ্যতা ততোটা নয়।

প্রথমেই বলে রাখি শিশু সাহিত্য নিয়ে গবেষণা আমি করি না। পড়তে ভালোবাসি। এবং পড়ি, ভাবি, নিজের আনন্দে আলোচনাও করি।

বাংলা সাহিত্য মহল মেনে না নিলেও এ কথা সত্যি যে ইংরেজি শিশু সাহিত্যের ধারেকাছেও কোনদিন বাংলা শিশু সাহিত্য আসেনি, আসবেও না। রাশিয়ান ছোটদের বই অনেক পড়েছি অনুবাদে। তার ধরণ আলাদা। চিনা, জাপানী, ভারতীয় অন্য ভাষার বা বিদেশি অন্য ভাষার সামান্যই পড়েছি।

আমরা যখন কোনো একটা বিশেষ বই পড়ি, তখন মাথার মধ্যে একটা ব্যাকগ্রাউন্ড ক্যানভাস থাকে। যে ক্যানভাসে আগের পড়াগুলোর ইম্প্রেশনের ছাপ পড়ে এবং নতুন পড়ার ছবি ফুটে উঠতে শুরু করে।

অধীরদার লেখা যখন পড়ছি মাথায় সেই বিদেশি, বিশেষত ইংরেজি ছোটদের বইয়ের ক্যানভাসটা কাজ করে। কারণ অধীরদার লেখায় কিছু ব্যতিক্রমী টাচ আছে।

লেখক যখন গল্প লেখেন, বিশেষত ছোটদের কথা মাথায় রেখে, একটা কাল্পনিক জগত তৈরি করেন যা বাস্তব হয়ে ওঠে পাঠকের কাছে। বা বাস্তব জগতের ভেতর একটা কাল্পনিক অনুভূতির জন্ম দেন। হ্যারি পটারের জাদু দুনিয়া, পার্সি জ্যাকসনের কাহিনিতে ডেমি গডেদের ক্যাম্প, হবিট অথবা লর্ড অফ দ্য রিঙসের দুনিয়া, ইঙ্কহার্ট এ বইয়ের চরিত্র হয়ে ওঠা - এইসবই প্রথম ধরণের উদাহরণ। সিক্যুয়েলওলা এই উপন্যাসগুলি ছাড়াও মিস পেরিগ্রীণ, মিনিস্ট্রি অফ প্যান্ডিমোনিয়ামের দুনিয়াও তাই। অ্যালিসের অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনিও এই গোত্রের।

অন্যদিকে গ্রেভ ইয়ার্ড বুক কিন্তু আলাদা। এখানে বাস্তব জগতে কল্পনা এসে ঢুকছে। কাল্পনিক কোনো জগত তৈরি হচ্ছে না। জর্জেস সিক্রেট কী টু দ্য ইউনিভার্স-এর সিরিজও তাই।

বাংলায় ছোটদের গল্প-উপন্যাস ওই দ্বিতীয় ধরণের। কিন্তু অধিকাংশই দূর্বল প্রকৃতির। ব্যতিক্রম লীলা মজুমদার, মতি নন্দী। প্রথম ধরণের মধ্যে সুকুমার রায় ও ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় পড়বেন।যদিও এর কোনটাই ইংরেজি কোনও কাহিনির ধারেকাছেই আসে না প্রায়। বিশেষত বিস্তৃতিতে। সুকুমার রায় অনবদ্য। কিন্তু বিস্তারের সময় তিনি পাননি।

এইখানেই অনেকেরই চোখ এড়িয়ে অধীরদার লেখাগুলি প্রায় অবহেলিতই রয়ে গেছে। অধীরদার লেখার ধরণও ওই দ্বিতীয় গোত্রেই পড়বে। বাস্তবের মাটিতে পা রেখেই কল্পনার জাল বুনেছেন। অথবা বোনেননি। কল্পনা তার রূঢ় বাস্তবের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে অবলীলায়। অথচ যদি একটার পর একটা গল্প পড়ে যাওয়া যায় তাহলে একটা বিস্তার মাথার মধ্যে ছড়িয়ে যায়। বিদেশি উপন্যাসের বিচিত্র পটভূমিকায় যেমন নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পও ছোটদের লেখার পটভূমিকা হতে পারে, ভালোবাসা থেকে যৌনতা সবই থাকতে পারে কাহিনির সহজ চলায়, অধীরদার লেখায় তেমন করেই এসেছে দেশভাগ, যৌন নিপীড়নের মতো অভিজ্ঞতাগুলি। হ্যাঁ, কিশোর সাহিত্যে বা শিশু সাহিত্যে এই যৌনতাবোধ বাংলা সাহিত্যে হয় অবাঞ্ছিত আর নয় আরোপিত, এমন সহজ বোধে উঠে আসেনি অন্য কারোর লেখায়।

অধীরদার গল্পগুলোয় টুকরো টুকরো স্কেচ আছে, টুকরো টুকরো চরিত্র যারা আসলে একটি না লেখা বৃহৎ উপন্যাসের অংশ। গল্পগুলো পড়তে পড়তেই উপন্যাসের একটা আবছা ছবি ভেসে ওঠে মাথায় যা হয়তো ওই প্রথম গোত্রে পড়ে। হয়ত সেই উপন্যাসের নায়ক সেই রতন নামের ছেলেটা। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যে বড় হয় অথবা বাস্তবের কোনও রূঢ়তাই তার অপার বালক মনকে নষ্ট করতে পারে না। সব লেখাতেই একটা ব্যথার সুর রয়েছে যেটা হয়তো অধীরদার লেখার বৈশিষ্ট্য অথবা তাঁর জীবনের সুরটি। তবে আনন্দের ভাগটা আরেকটু বেশি হলে ভালো হত। দু:খের ভেতরেও। বড্ড মনখারাপ লাগে, একটানা পড়া যায় না হয়তো তাই।

ছবিগুলো অধীরদার আঁকা নয়। তবু মিস পটারের পিটার র‍্যাবিটের কথা মনে পড়ায় বড্ড।

অধীরদার লেখাগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ হওয়া খুব জরুরি। আর ওই উপন্যাসটার নির্মাণও। কেন যে আগেই লেখেননি!

কবিতা দিবস!


আজ নাকি কবিতা দিবস, কী কাণ্ড! এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে হচ্ছিল। বেশ কিছুদিনই লক্ষ্য করেছি নামী কবিদের কেউ কেউ কেমন ঝপাঝপ প্রাসঙ্গিক কবিতা লিখে ফেলছেন। রাজনীতি, খুন, ধর্ষণ, মৃত্যু যখন যেটা হট আইটেম। কলম নিয়ে তৈরিই থাকেন মনে হয়। এতে যে সব পাঠক মনের কথা বোঝাতে পারছেন না, তাঁদের এক প্রকার সান্ত্বনা জোটে। আর কবি ও তাঁর কবিতার টি আর পি বাড়ে। এঁরাই বোধহয় আধুনিক কর্পোরেট কবি। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী মাল থুড়ি কবিতা সাপ্লাই দেন। না, ঠকান না। কোয়ালিটি উচ্চমানের। তবে অনেক অনামী উচ্চমানের কবিও আছেন, যাঁরা বাজারের সুনজর বঞ্চিত, নিজের মনের আনন্দে লিখে তার দ্বারা অন্যের মনের কাছে সুখে-দু:খে পৌঁছতে চান।

ভাবছি আজকের এই কবিতা দিবসটি কার?

Saturday, March 11, 2017

ভ্রমণকাহিনি - জীবিত না মৃত?


একটা দীর্ঘ সময় ধরে বাংলা সাহিত্যে উপেক্ষিত ছিল ভ্রমণকাহিনি। সুকুমার সেনের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসেও এর উল্লেখ আমি তেমন কিছু পাইনি। এর একটা বড় কারণ দেখানো হয়েছিল, ভ্রমণকাহিনি বাস্তব চিত্র, বানিয়ে তোলা গল্প-উপন্যাস নয়। এতে কল্পনার কোনও জায়গা নেই। অথচ আত্মজীবনী যা নাকি পুরোটাই সত্যি বলে ধরে নেওয়া হয়, তাও বাংলা সাহিত্যের দরবারে স্থান পেল। অথচ ভ্রমণকাহিনিতে নিজস্ব কল্পনার রঙ লাগে বলেই একই জায়গা নিয়ে লেখা একজনের কাহিনি আমাদের ভালো লাগে, আবার অন্য কারোরটা ভালো লাগে না। শুধু পুরোনো ভ্রমণকাহিনিই কেন, অপরিচিত লেখকের লেখা বেড়ানোর গল্প যখন পড়ি তখন আমাদের কাছে বাস্তব চরিত্রগুলিও আর বাস্তব থাকে না, কাহিনির অঙ্গই হয়ে পড়ে। ফলে ভ্রমণকাহিনির সাহিত্য তকমা না দেওয়ার পিছনের যুক্তিগুলো আসলে তেমন জোরালো নয়। স্রেফ জোর করেই।

অন্যদিকে ভ্রমণকাহিনির থেকে গল্প-উপন্যাসের পাঠের একটা বিভিন্নতা আছে। গল্প-উপন্যাসে লেখক কী বলছেন তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ পাঠক কী পড়ছে। ইংরেজি সাহিত্যে 'ডেথ অফ এ রাইটার' কনসেপ্টটাই খানিক তাই। গল্প-উপন্যাস আমরা হয় নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গীতে পড়ি। অথবা কোনও একটি চরিত্রের ভেতর ঢুকে গিয়ে তার দৃষ্টিতে ঘটনাগুলোর ভালো মন্দ বিশ্লেষণ করতে থাকি অবচেতনে। ভ্রমণকাহিনিতে কিন্তু লেখকের উপস্থিতি খুব পরিষ্কার। দুভাবে ভ্রমণকাহিনির সঠিক পাঠ সম্ভব। প্রথমত লেখক-পাঠক যেখানে এক হয়ে যান। যেমন বিভূতিভূষণ। আবার লেখক যেখানে পাঠকের কাঁধে হাত রেখে বন্ধুর মতো ঘুরিয়ে দেখান। যেমন - সুনীল। এর বাইরে অন্য যে কোনও ভ্রমণপাঠ সে অর্থে সার্থক ভ্রমণকাহিনি হয়ে ওঠে না। যেমন ভ্রমণকাহিনি পড়তে পড়তে পদে পদে নবনীতার 'আমি' তে হোঁচট খেতে হয়। পাঠক কিছুতেই লেখকের চোখ দিয়ে বা তার সঙ্গী হয়ে পথ পেরোতে পারেন না। আবার বিক্রম শেঠ যখন ওই একই হিচ-হাইকিং পদ্ধতিতে তিব্বত ঘুরে বেড়ান তখন পাঠকের তাঁর সঙ্গে লাফিয়ে গাড়িতে উঠতে কী পথের শোভায় মুগ্ধ হতে একটুও আটকায় না। সত্যি বলতে কী ভ্রমণকাহিনি লেখার হাত যদি সত্যজিতের এতটা ভালো না হতো, অনেক ফেলুদা কাহিনিই ওতরাতো না।

ভ্রমণকাহিনি আসলে অনুভব। এবং তারই সঙ্গে বিস্তার। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সামাজিক রাজনৈতিক ইতিহাস, ভূগোলের পাতা, দর্শন এমন অনেককিছু এবং সর্বোপরি নিখাদ ভ্রমণ।

এই তো গেল কাকে বলে ভ্রমণকাহিনি। এখন মুশকিল যেটা গত বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলা সাহিত্যের লোকজনের নজরে পড়ছে ভ্রমণকাহিনি। জানিনা, পি এইচ ডি-র বিষয় কম পড়িয়াছে কিনা। এখনও কিন্তু ভ্রমণ তার সাহিত্য মর্যাদা পেলোনা। সুকুমার সেনের মতো কেউ এর দীর্ঘ বিশ্লেষণ করতে উদ্যোগী হলেন না। সরাসরি গবেষণার বাজারে সে পণ্য হয়ে উঠল। যাঁরা নিজেরা কখনও ভ্রমণকাহিনি লেখেননি। কাকে বলে ভ্রমণকাহিনি বিন্দুমাত্র জানেন না, তাঁরা নেমে পড়লেন ময়দানে। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে গবেষকরা অধিকাংশই নিজে গল্প-উপন্যাস লেখেন না। কিন্তু বাংলা সাহিত্য নিয়ে যাঁরা পড়াশোনা করেছেন, তাঁরা বাংলা গল্প-উপন্যাস পড়েননি একথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ বাংলা সাহিত্য না পড়েও অনেক মানুষই অন্তত: হালকা গল্প-উপন্যাস পড়েন। কিন্তু ভ্রমণকাহিনি সবাই পড়েন না। পড়তে পারেন না। ওই যে 'দেখে চোখ আর মন।' যাঁরা চোখ আর মন দিয়ে ভ্রমণকাহিনি পড়েন না, ঢেঁকি গেলার মতো পড়েন তাঁদের পক্ষে ভ্রমণকাহিনির সঠিক অনুধাবন বা সঠিক বিশ্লেষণ একেবারেই অসম্ভব। বাস্তব চিত্রও তাই। অধিকাংশ পুরোনো ভ্রমণকাহিনির রিপ্রিন্টের ভূমিকা অসম্পূর্ণ। আবার ভূমিকায় জোর দিলে দেখা যায় বিশ্লেষণটি ভ্রমণকাহিনি পাঠের জন্য একেবারে ভুল। তাতে পাঠককে কেবল বিভ্রান্তই করা হয়। যেমন ইংলণ্ডে বঙ্গমহিলায় সীমন্তী সেনের ভূমিকাটি। কৃষ্ণভাবিনী দাসের এই ভ্রমণের ফল হচ্ছে তাঁর নারীবাদী ধ্যানধারণা। একই ভাবে অবলা বসুর জাপান ভ্রমণের ফল হচ্ছে নারী শিক্ষা সমিতি। এবং বিস্তৃত আলোচনায় না গিয়ে বলি, মেরী ওলস্টোনক্রাফটের ক্ষেত্রে তাঁর প্রথম স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স। এবারে জাপানের ভূমিকায় কেউ যদি নারী শিক্ষা সমিতি নিয়েই লিখে যান অথবা মেরীর লেখায় তাঁর ডিভোর্স নিয়ে সেটা যারপরনাই হাস্যকর হবে। আর তাই কৃষ্ণভাবিনী দাসের লেখারও এই ভূমিকাটি একেবারেই অর্থহীন। আর অর্থহীন বলেই লেখাটি নারীবাদী লেখা হিসেবে যেভাবে চর্চিত হয়েছে, ভ্রমণকাহিনি হিসেবে হয়নি। ভ্রমণ কাহিনির বিস্তারের তত্ত্বটি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞতাই এর কারণ। এবং অনুভবটি তো বটেই। যিনি বলতে পারেন যে, আমি ভ্রমণকাহিনি লিখব না, আমি আমার সাবজেক্ট হব না, তাঁর কাছে ভ্রমণকাহিনিও প্রাণহীন সাবজেক্টই থেকে যায়, ভ্রমণকাহিনি হয়ে ওঠে না কোনমতেই।

যতদিন বাংলা সাহিত্যের গবেষকদের হাতে পড়েনি ততোদিন তবু বেঁচে ছিল, কিন্তু এখন বেচারী ভ্রমণকাহিনির তো প্রাণ নিয়ে টানাটানি।

আমার তো নিতান্ত আতঙ্ক হচ্ছে এই ভেবে যে, পঞ্চাশ একশো বছর পর কোনও বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী বা অধ্যাপক আমার লেখায় ছুরি চালাচ্ছেন। আর আমার জীবন্ত লেখাগুলো একটু একটু করে মরে যাচ্ছে।

নলিনীবালা বসু


একদিন মা আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আমি যাইব কি না। আমি ত আহ্লাদে আট খানা হইয়া বলিলাম আমি যাইব। নলিনীর বয়স তখন মাত্র এগারো কী বারো। অসুস্থ শরীর সারাতে দার্জিলিং বেড়াতে এসেছে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে। দীর্ঘ আট মাস দার্জিলিং-এ কাটানোর পর যখন বাড়ির সবাই মিলে ফালুট-টংলু ট্রেকের পরিকল্পনা হচ্ছে, নলিনী তখনও জানে না যে তাকে নিয়ে যাওয়া হবে কিনা। কিন্তু মনে মনে আগ্রহী হয়ে আছে। ছোট্ট মেয়েটি সেই ট্রেকিং শেষে লিখে ফেলল ভ্রমণকাহিনি হিমালয় ভ্রমণ। প্রকাশিতও হল একটি ছোটদের পত্রিকায়। ভ্রমণকাহিনিটির ওপরে লেখা বালিকা লিখিত। সালটা ১৮৯২-৯৩। কিন্তু ধারাবাহিকের শেষ পর্বটি কেন বেরোয়নি কে জানে!

খুঁজতে শুরু করলাম কে এই আশ্চর্য বালিকা? এগার বছরেই যার লেখায় পরিণত হাতের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। যা জানলাম, তা মর্মান্তিক। তের বছর বয়সে বিয়ে হয় নলিনীর। অসুখে ভুগে মারা যায় মাত্র ষোলো বছর বয়সে। কে এই নলিনী? বিখ্যাত নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের পৌত্রী এবং সাহিত্যসেবী দেবেন্দ্রবিজয় বসুর কন্যা। এই পরিবারের মেয়ে হয়ে এবং দীর্ঘকালীন অসুস্থতা থাকা সত্ত্বেও তার বাল্য বিবাহ আমাকে আশ্চর্য করেছিল। আসলে বাহিরে মুক্তমনের মানুষগুলি নিজেদের অন্দরে কতটা মুক্তমনা সে প্রশ্ন রয়েই যায়।

নলিনী কবিতাই লিখত। তার আর কোনও গদ্য লেখার উল্লেখ পাইনি। মৃত্যুর পর তার অসংখ্য কবিতার থেকে মাত্র বাহাত্তরটি নিয়ে নলিনীর মামা নলিনীগাথা নামে একটি সংকলন প্রকাশ করেন। এই কটি লেখাই তার বেঁচেছে। কবিতাগুলি পড়া হয়নি আমার। তবে নলিনীর লেখা এই ভ্রমণকাহিনিটি সম্ভবতঃ সবচেয়ে কম বয়সে লেখা কোনও বাঙালির ভ্রমণকাহিনি এবং ট্রেকিংও। অন্ততঃ মেয়েদের মধ্যে তো বটেই।

নলিনীবালাকে নিয়ে লেখা শুরু করার ঠিক আগে আমার চোদ্দ বছরের মেয়ের সঙ্গে বসে আরেকবার তার ভ্রমণ কাহিনিটি পড়ে নিচ্ছিলাম। পড়তে পড়তে আমাদের নিজেদের কন্যাসহ নানান বেড়ানোর স্মৃতি বারবার মনে ফিরে আসছিল আর প্রায় একশো পঁচিশ বছর আগের এক অচেনা বালিকার কথা মনে করে মনটা মেঘলা হয়ে যাচ্ছিল। কে জানে নলিনী বেঁচে থাকলে স্বর্ণকুমারী কী অবলা বসুর মত আরেকজন ভ্রমণ লেখিকাকে আমরা পেতাম কিনা!  


Friday, March 10, 2017

লক্ষ্মীমণি দেবী


            আমাদিগের ভ্রমণ বৃত্তান্তের প্রথম পর্বে এমন কয়েকজন বাঙালি মেয়ের কথা জেনেছিলাম যাঁরা সময়ের ইতিহাসে আড়ালে চলে গেছেন। কিন্তু স্মরণযোগ্য। তেমন কয়েকজনের কথা বলতে ইচ্ছে হল।

এইসবই আমার অনুভবের কথা।

যাঁর কথা সর্বাগ্রে মনে আসে, তিনি লক্ষ্মীমণি বসু। কৈলাসবাসিনী দেবীর লেখায় যখন তাঁর উল্লেখ পাওয়া যায় তখন তিনি ব্রাহ্ম বিধবা। ছয় বছরের ছেলে নিয়ে বিধবা হন লক্ষ্মীমণি দেবী। কৈলাসবাসিনীর স্বামী ছিলেন সেকালের প্রসিদ্ধ দেশনায়ক, বাগ্মী লেখক ও সমাজ সংস্কারক কিশোরীচাঁদ মিত্র। স্বামীর কাছেই লেখাপড়া শেখেন কৈলাসবাসিনী। কৌলিন্য প্রথা, বাল্য বিবাহ এসব বিষয়ে তাঁর নানা সমালোচনা মূলক প্রবন্ধও আছে। সমাজসংস্কারক কিশোরীচাঁদ মিত্রের স্ত্রী কৈলাসবাসিনীর নাম খুব অপরিচিতও নয়। অপরিচিত লক্ষ্মীমণির নাম। যাঁকে একই সঙ্গে কৈলাসবাসিনী উল্লেখ করেছেন সভ্য অথচ বাচাল বলে। লক্ষ্মীমণির দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হয়েছে কিন্তু এই দুঃখু জে তিনি কোন সৎ বিদ্যানের হাতে পড়েন নাই। জ্যেমন এক একটা বিচি অমনি পড়ে গাচ হয় হয়ে তাহাতে অনেক ফল হয় এর তাই হইয়াছে। আমাদের জে হওয়া তাহা অনেক যত্নে মাটির পাট করে জল দে হওয়া, কিছু আশ্চর্য্য নয়। আমার মন জেমন উর্ব্বরা, তখন অমন লোকের হাতে পড়িছি, এমন করে শিক্ষা দেছেন, তন্য তন্য করে বুঝায়ে দেছেন, তাহা শুনে নিতান্ত মুখ্যুরও জ্ঞান হয়। কেন হিন্দুরা এই সব নিয়ম সৃজ্জন করেছেন তাহার মাহাত্ম্য আছে। অর্থাৎ শিক্ষিত পুরুষ মানুষের হাতে না পড়ায় লক্ষ্মীমণির শিক্ষা ঠিক হয়নি।

লক্ষ্মীমণিকে আমি চিনেছি বামাবোধিনীর পাতায়। তিনি সেইসময়ের একজন উল্লেখযোগ্য কবি ও প্রাবন্ধিক ছিলেন। থাকতেন বর্ধমানে। শুনেছি তাঁর লেখা কিছু বইও আছে, কিন্তু সেসব আমি খুঁজে পাইনি। আমার তো একলা খোঁজা। একক ভ্রমণ। এমন নয় যে কারোর বই দেখে তাকে ফোন করলাম আর লেখার ঠিকানা জেনে নিয়ে টুকে দিলাম। বামাবোধিনীর পাতাতেই খুঁজে পাই একটি সংস্কারমুক্ত আধুনিক মনের মানুষকে। যিনি কাশীর বিশ্বেশ্বর মন্দিরে গিয়ে পাথর ছাড়া কিছু দেখতে পাননা। প্রয়াগে গিয়ে মাথা নেড়া করতে অস্বীকার করেন। দেশে ফিরে এক ঘরে হন সমাজে।

আসলে কৈলাসবাসিনী শিক্ষিত ছিলেন কিন্তু লক্ষীমণি ছিলেন সংস্কারমুক্ত আধুনিক নারী, তাই লক্ষীমণির চরিত্র কৈলাসবাসিনীর মনে দাগ কাটলেও তাঁকে সম্যক বুঝে ওঠা সম্ভব হয় নি। দেখার এই তফাত প্রতিফলিত হয়েছে তাঁদের লেখাতেও। লক্ষীমণির লেখায় যে ভ্রমণ রস এবং সমাজকে দেখার নিজস্ব স্বচ্ছ দৃষ্টি দেখতে পাই কৈলাসবাসিনীর ক্ষেত্রে তা প্রায় পুরোটাই ব্যক্তিত্বময় স্বামীর আড়ালে ঢাকা। কৈলাসবাসিনীর ডায়েরি শেষ হয়েছে তাঁর বৈধব্যের পরে পরেই। কিন্তু লক্ষীমণির ক্ষেত্রে বৈধব্য, এমন কী একমাত্র পুত্রের মৃত্যুও জীবনের শেষ কথা ছিল না, তারপরেও তিনি ভ্রমণে বেরোনো, বই পড়া (এখানে বঙ্কিমচন্দ্রের মৃণালিনী উপন্যাসের উল্লেখ পাই), লেখালেখি করার মত কর্মশীলতার মধ্যে জীবন কাটানোর কথা ভাবতে পেরেছেন। কোনও শিক্ষিত পুরুষ তাঁর জীবনে আদৌ এসেছিলেন কিনা তা জানা যায় না। তবু, বিশেষ এই কবিতাটি এডিট করে কয়েক লাইন বাদ দেওয়া হলেও মনে হয় তাঁর জীবনে বামাবোধিনী-র ভূমিকা ছিল অনেকখানি।

আমরা কিন্তু লক্ষ্মীমণিকে ভুলে গিয়েছি। বাঙালি নারীর শিক্ষায়-স্বাধীনতায় তাঁর অবদানের কথা কোথাও পাইনা।

রমাসুন্দরী ঘোষ

১৮৬৪ সাল। কাশী বেড়িয়ে এসে দাদাকে চিঠি লিখেছিল ছোট বোন। কবিতায় লেখা সেই চিঠি পেয়ে মুগ্ধ দাদা হাজির সোজা বামাবোধিনী-র দপ্তরে। সম্পাদকমণ্ডলীও চমৎকৃত লেখাটি পড়ে। প্রায় অচেনা এই লেখিকার কবিতাটির মুখবন্ধ স্বরূপ সম্পাদক লিখলেন, আমাদের দেশে বিদ্যাবতী ও জ্ঞানবতী স্ত্রীলোক অতি অল্প, তথাপি তাঁহাদের হইতেই সমস্ত স্ত্রী-সমাজের অজ্ঞান-তিমির নষ্ট হইতে পারিবে। বামাবোধিনীকেও কুর্ণিশ এমন একটি কবিতা প্রকাশ করার জন্য যেখানে কবি কাশীর বিশ্বনাথ দেখে লিখছেন, কেবল মুর্খেতে ওহে ভক্তির কারণ, সাক্ষাৎ ঈশ্বর যেন করে দরশন। কবিতাতেই তাঁরা কবির পরিচয় দিলেন। কোথাও জানালেন না, যে দাদা বোনের কবিতাটি এনে তাঁদের দপ্তরে দিয়েছিলেন তিনি সত্যপ্রিয় দেব। ব্রাহ্ম সমাজের একজন অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তিত্ব শিবচন্দ্র দেবের চার কন্যার মধ্যে কনিষ্ঠ রমাসুন্দরী। শিবচন্দ্রের পুত্র সত্যপ্রিয় দেবের ব্রাহ্ম বিবাহ ঘিরে ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রায় ইতিহাস তৈরি হয়েছিল।


বাড়িতে বাবার কাছেই পড়াশোনা শেখা রমাসুন্দরীর। ছোট থেকেই লেখালেখির ঝোঁক। বিয়ে হয়েছিল সেইসময়ের নামকরা ডাক্তার ও শল্য চিকিৎসক দুকড়ি ঘোষের সঙ্গে। বামাবোধিনীতে দীর্ঘসময় ধরে নিয়মিতই কবিতা ও গদ্য লিখতেন রমাসুন্দরী। কাশী দর্শন বাঙালি মেয়ের লেখা প্রথম ভ্রমণ কাব্য। পরবর্তীকালে বামাবোধিনী থেকে তাঁর একটি বইও বেরিয়েছিল। সংসার ও লেখালেখির পাশাপাশি বঙ্গ মহিলা সমাজ, সখি সমিতি-র সক্রিয় সদস্য ছিলেন। মহিলা শিল্পমেলাতেও নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন।

এক পুত্র ও এক কন্যা রেখে স্বামীর মৃত্যুর পরেরদিনই চৌষট্টি বছর বয়সে মারা যান রমাসুন্দরী।

রমাসুন্দরীর পরিচয় জানা সত্ত্বেও এক গবেষক কিছুতেই রাজি হননি তা জানাতে। জেদ চেপে গিয়েছিল। কয়েকশো পুরোনো পত্রিকার প্রত্যেকটা পাতা খুঁটিয়ে পড়ে ফেললে জানা যেতেই পারে নিজে নিজে। যাঁরা আমার বই থেকে রমাসুন্দরীর পরিচয় টুকবেন তাঁদের একথা সবিনয়ে জানিয়ে রাখি।

জীবনে অনেক অনেক গবেষণা অন্যের আহৃত তথ্য টুকে টুকে না করে একটিও যদি সার্থক গবেষণা করা যায় তাতেই সত্যিকারের আনন্দ পাওয়া যায়। এই অনুভূতি যাঁরা নাম, খ্যাতি, অর্থের জন্য কাজ করেন তাঁরা বুঝবেন না।

Thursday, March 9, 2017

ভ্রমণকারী বন্ধুর পত্র

দীর্ঘদিন ধরে বাংলা ভ্রমণকাহিনি নিয়ে খুব নিম্নমানের গবেষণার কাজ হয়ে আসছে। এটা লক্ষ্য করার পরই একজন ভ্রমণ লেখিকা হিসেবে মহাভারতের মতো এই কাজটির পরিকল্পনা করি। আর করতে গিয়ে যেটা বুঝলাম যে তথাকথিত গবেষকরা নিজেদের নামের পেছনে ডিগ্রীর ঝুলি বা পদমর্যাদা বা পরিচিতি বাড়াতে যতটা আগ্রহী ততোটাই নন কাজটিকে ভালোবাসা বা যাঁদের নিয়ে কাজ করছেন তাঁদেরকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়ার বিষয়ে।
একজন ভ্রমণ লেখক সম্পাদক হিসেবে তাই আমাদের জন্য লড়াইয়ের অসম এই ময়দানে ঢাল তলোয়ার ছাড়াই নামতে হল। যদি পরিচিতি, ডিগ্রি এসবকে ঢাল-তলোয়ার ভাবা যায়। আমার রসদ শুধু কাজের প্রতি ভালোবাসা এবং ভ্রমণ কাহিনিকার হিসেবে আমার উত্তরাধিকার।
আমি গবেষক এবং ভ্রমণ লেখকদের মধ্যে একটা যোগসূত্র তৈরি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দেখলাম গবেষকরা এতটাই আত্মসর্বস্ব যে তাঁরা ভ্রমণ কাহিনিকারদের নিয়ে গবেষণা করবেন অথচ তাঁদেরকে সম্মানটুকু জানাবেন না।
না, আমরা তাঁদের ব্যবহারের বস্তু হব না। ভুল ইতিহাস যাত্রায় সামিল হব না।
একজন ভ্রমণ কাহিনিকার হিসেবে তাদেরকে বর্জন করব।
নিজেদের সত্যিকারের ইতিহাস আমরা নিজেরাই লিখে নিতে পারি।
এই কাজে আমার ভ্রমণকারী বন্ধুদের সবসময় পেয়েছি। এখনও আমরা পাশাপাশিই আছি। আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতা লিখি। চুরি করি না। কেউ তা করলে আমাদের মধ্য থেকে তাকে আমরাই বাদ দিই, চোরের মায়ের বড় গলা করি না।
এটা ভ্রমণ লেখকদের আন্দোলন হয়ে উঠুক।
এইসব স্বার্থপর গবেষকদের আমরা বর্জন করছি আজ এবং আগামী দিনে আমাদের ইতিহাস লেখার জন্য।

কাক্কেশ্বর উবাচ


- আমি বললাম, গবেষণা, সে আবার কী?

- কাক বলল তাও জানোনা, গরুর গ, ১৮৭০ এর ব-একার, অবলার মুর্ধন্য ষ আর চোনা-র না। হয়ে গেল গবেষণা। এ আর কঠিন কি? আর যদি বাংলায় মহিলাদের ভ্রমণ নিয়ে গবেষণা চাও তো...

- আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, থাক থাক এতেই চলবে।

অবলা বসুর ভ্রমণকথা

বেশ কিছুদিন আগে সর্বজয়া নামে একটি মেয়ে আমাকে প্রথমে ফেসবুকে ও পরে ফোনে যোগাযোগ করে। সর্বজয়া এই জয়তী গুপ্তের ছাত্রী। তার বক্তব্য ছিল অবলা বসুর বিশেষ একটি লেখা অনুবাদ করবে। মূল লেখাটি কোথা থেকে পেয়েছি যদি বলে দিই। উত্তরে জানাই অনেক কাঠ খড় পুড়িয়েছি আর ওমনি বলে দেব? এ তো বাপু আচ্ছা আবদার! পারব না। তারপরে বলে আমার বই থেকে টুকবে তার অনুমতিপত্র।

কাজটা শুনে আমার তো ঢেঁকি গেলার অবস্থা। যদি না বলি তাহলে যে পত্রিকাগুলো পাওয়া যায় তারই একটা টুকে দিয়ে আমার বইটার নামও করবে না। আর যদি দিই অনুমতি তাহলে তবু এই বইটার নাম যাবে। কিন্তু পুরো কাজটাই তো আমার করা হয়ে গেছে।

তেঁতো গলায় বললাম হুঁ। মেল এল। ওমা আমার অনুমতিপত্রে আমি কী লিখব তাও লিখে দিয়েছে! কী আস্পর্ধা! তারপরে জানিয়েছে প্রয়োজনে জয়তী গুপ্তের সঙ্গে কথা বলতে পারি। আচ্ছা আমার কী দায় কেঁদেছে? ওনার দায় কাঁদছে তো উনিই কথা বলুন। সেটাই যে ভদ্রতা ছিল সেই জ্ঞানটা পর্যন্ত নেই। সমস্ত কাজ তো ছাত্রীরা করে দেবে আর নাম কিনবেন উনি। ছি: ছি:।

আমাদিগের ভ্রমণবৃত্তান্ত - কেউ মরে বিল সেঁচে কেউ খায় কই


আমি অধ্যাপিকা নই। কোনও গ্রান্ট পাইনি এই কাজের জন্য। অথচ এই ঐতিহাসিক কাজটি আমার করা। এবং বইটি ইতিমধ্যেই গাংচিল থেকে প্রকাশিত। আমার উদ্ধারের আগে কেউ জানতই না যে অবলা বসু ভ্রমণকাহিনি লিখতেন। কেউ জানত না যে ১৮৭০ সালে আদৌ কোনও বাঙালি মেয়ে ভ্রমণকাহিনি লিখেছিলেন কিনা। এই সব তথ্যই আমার বইদুটির থেকেই নেওয়া। অথচ টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত লেখায় সব তথ্যই জনৈক জয়তী গুপ্তের নামে। ভদ্রমহিলা নাকি দীর্ঘদিন ভ্রমণ নিয়ে গবেষণা করছেন! কী জানি বাপু! যাঁর ১৮৭০-১৮৪৫ এই সময়সীমায় এখনও অপ্রকাশিত কাজটি। এর বহু আগে আমার বইটির প্রকাশিত প্রথম পর্ব আনন্দবাজার ও এই সময়ে রিভিউয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে। আমার কাজের সময় সীমা ১৮৬৩-১৯৪৭। না, আমার কোনও চেনা জানা নেই কোথাও। রিভিউ বেরোয়নি এখনও।

এরা কী জানে যে একেকজনের ইতিহাস উদ্ধার করতে কতটা জুতোর সুকতলা খইতে হয়? এরা কী জানে একেকজনের ইতিহাস উদ্ধার করতে কতটা গলাধাক্কা খেতে হয়। এরা কি জানে কত শত বই পড়তে হয় একেকজনের ইতিহাস জানতে?

টুকে টুকে কি সরস্বতীর শ্বেতপদ্ম পাওয়া যায়? জগদীশচন্দ্রের কথা মনে পড়ছে খুব।

ধিক্কার জানাই এই কাজের।

সময় তাকেই মনে রাখবে যে ঠিক কাজটি করেছে।

জীবনে অনেক বাধা পেয়েছি, পেরিয়েছি। মা বলে, কাজ করে যা। কাজটাই তোর উত্তর।

Wednesday, March 1, 2017

ডাক্তার অথবা


নাহ, কোনও ডাক্তারের হাতে আমি জন্মাইনি বটে, তবে প্রায় জন্ম ইস্তক তাঁদের আমি দেখে এবং নিজেকে দেখিয়ে আসছি। মানে তাঁরাও আমাকে দেখে আসছেন আর কী। তাঁদের হাতে হাতেই আছি আমি বা আমাকে হাতিয়েছেন তাঁরা তা কে জানে! তবে জানি শেষপর্যন্ত তাঁদের হাতেই আমি যাবও।

ডাক্তারদের কথা রুগী ছাড়া আর কেই বা ভালো জানবে এমন অচ্ছেদ্য সম্পর্ক যে; মানে রুগীকে একমাত্র চ্ছেদ করতে পারেন ডাক্তারই অথবা প্রিয়জনের মনে বিচ্ছেদ জাগাতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। আর রুগী যদি এমন হয় যে তাকে ঘড়ি ঘড়ি ডাক্তারদের কাছে দৌড়াতে থুড়ি হেঁটে, বাসে, ট্যাক্সিতে, এম্বুলেন্সে, এমন কী খোদ ডাক্তারের গাড়ি চড়েও যেতে হয় সে ছাড়া কেই বা জানবে কোনও ডাক্তার ঘড়িয়াল অথবা না।

ডাক্তার বহুপ্রকার হয়। মানে ওই বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর গোছের। প্রথমত পেশার দিক থেকে। মানে যে যে দিক থেকে রুগীকে পেশাই করা যায়। ডান হাতের ডাক্তার বাম হাত দেখেন না। অবশ্য বামপন্থী দক্ষিণপন্থী আর কবেই মিলেছে? এদিক থেকে দেখলে গুগাবাবার সেই ভুতের গান মনে পড়ে। আর দ্বিতীয়ত সততার দিক থেকে। সত্যি এক জীবনে কত যে বিচিত্র ডাক্তারকে দেখালাম এবং দেখলাম!

আমাদের ছোটবেলায় সর্ব রোগহর জেনারেল ফিজিশিয়ানের চল ছিল বেশি। তবে আমার ক্ষেত্রে তাঁরা কিছুদিন পরেই খানিক অচল হলেন। বিশেষজ্ঞদের অন্তহীন লম্বা তালিকা আর নাই বা দিলাম। জীবনের শেষপ্রান্ত অবধিই তা অনন্তই হবে জানি। কত যে নব নব রূপে তাঁকে বা তাঁদেরকে আমি দেখব, আমাকেও দেখবেন তাঁরা!

খারাপের শেষ নেই। নি:শেষে গোটা সমাজটাই অসুস্থ। সেখানে কেউ কেউ যদি শরীরের রোগটুকুও সারাতে পারেন তাও তো অনেক। একমাত্র ডাক্তাররাই পারেন তাঁদের নেকনজর থেকে আমাদের সরিয়ে অথবা সারিয়ে ফেলতে। খারাপ হয় সময়, সমাজ, সিস্টেম, খারাপ হয় এই লোভ আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিবেশ। খারাপ হয় কোনও কোনও মানুষ যারা এই অসুস্থ সময় আর সমাজের শিকার। মানে বিকারহীন আর কী। আর তারা যে কোনও পেশার মতো ডাক্তারিও বাদ দেন না। মাঝখান থেকে বরবাদ হই আমরা। তবে পেটানোর জন্য কেবল ডাক্তাররাই প্রশস্ত। কারণ আমাদের কাছে হয় তাঁরা ভগবান বা ম্যাজিশিয়ান, নাহয় শয়তান। মানুষ নন কখনওই এই ভেবে নিজেদের আস্বস্ত করে ফেলি বেমালুম।

আসলে ভালো ডাক্তারেরা শুধুই গল্প-সিনেমার চরিত্রে নয় তাঁরা চিরকালই আছেন। শুধু zআনতি পারা যায় না। তবু আছেন বলেই আমার মতো চিররুগ্ন কেউ কেউ কিছুদিন ভালো থাকার স্বপ্নও দেখতে পারে।

অথবা স্বপ্ন হলেও সত্যি।

অসুখ


১)

শব্দেরা অক্ষর হারিয়ে বেদনায় মুখ গুঁজে থাকে। / পৃথিবীর বড়ই অসুখ আজ।/ বড়ই অসুখ আজ তোমার-আমার বুকে -/ বিদ্বেষ অথবা বিষাদ।

২)

বেদনায় আকীর্ণ দিন ভুলিয়েছে বেদনার ব্যথা/ অনুভূতিশূন্য মন অক্ষর হাতড়ায় -/ শুধু জমে ওঠে খালি ফয়েলের স্তুপ।/কথারা হারিয়ে গেলে/ তোমার-আমার মাঝে/ পড়ে থাকে কেবল অসুখ।

৩)

কারোর স্পর্শ নামে

শিরার উপত্যকা বেয়ে...

আরও গভীরে কোথাও যায়।

মানুষের কঠিনতম অসুখ সারায়।