একটু
একটু করে পড়ছি, অনেকদিন ধরে - উড়োজাহাজ। সবটা
মানে চারটে খণ্ড পড়া শেষও হয়নি। এ তো ঠিক পুস্তক আলোচনা নয় তাই যে কোনও জায়গায়
দাঁড়িয়েই কিছু কথা লিখে ফেলা যায়। গল্প ধরে ধরে আলোচনাও নয়। এটা আমার ভালো লাগার
অনুভূতির কথা।
ছোটবেলায়
আনন্দমেলায় কখনও অধীরদার লেখা পড়েছি নিশ্চিত। তবে কখনওই প্রথম শ্রেণীর শিশু
সাহিত্যিকের কোনও তকমা অধীর বিশ্বাসের জোটেনি। অথচ এমন অনেকেই পেয়েছেন আমার চোখে
যাঁদের যোগ্যতা ততোটা নয়।
প্রথমেই
বলে রাখি শিশু সাহিত্য নিয়ে গবেষণা আমি করি না। পড়তে ভালোবাসি। এবং পড়ি, ভাবি, নিজের আনন্দে
আলোচনাও করি।
বাংলা
সাহিত্য মহল মেনে না নিলেও এ কথা সত্যি যে ইংরেজি শিশু সাহিত্যের ধারেকাছেও কোনদিন
বাংলা শিশু সাহিত্য আসেনি, আসবেও না।
রাশিয়ান ছোটদের বই অনেক পড়েছি অনুবাদে। তার ধরণ আলাদা। চিনা, জাপানী, ভারতীয় অন্য
ভাষার বা বিদেশি অন্য ভাষার সামান্যই পড়েছি।
আমরা যখন
কোনো একটা বিশেষ বই পড়ি, তখন মাথার মধ্যে
একটা ব্যাকগ্রাউন্ড ক্যানভাস থাকে। যে ক্যানভাসে আগের পড়াগুলোর ইম্প্রেশনের ছাপ
পড়ে এবং নতুন পড়ার ছবি ফুটে উঠতে শুরু করে।
অধীরদার
লেখা যখন পড়ছি মাথায় সেই বিদেশি, বিশেষত ইংরেজি
ছোটদের বইয়ের ক্যানভাসটা কাজ করে। কারণ অধীরদার লেখায় কিছু ব্যতিক্রমী টাচ আছে।
লেখক যখন
গল্প লেখেন, বিশেষত ছোটদের কথা মাথায় রেখে, একটা কাল্পনিক জগত তৈরি করেন যা বাস্তব হয়ে ওঠে পাঠকের
কাছে। বা বাস্তব জগতের ভেতর একটা কাল্পনিক অনুভূতির জন্ম দেন। হ্যারি পটারের জাদু
দুনিয়া,
পার্সি জ্যাকসনের কাহিনিতে ডেমি গডেদের ক্যাম্প, হবিট অথবা লর্ড অফ দ্য রিঙসের দুনিয়া, ইঙ্কহার্ট এ বইয়ের চরিত্র হয়ে ওঠা - এইসবই প্রথম ধরণের
উদাহরণ। সিক্যুয়েলওলা এই উপন্যাসগুলি ছাড়াও মিস পেরিগ্রীণ, মিনিস্ট্রি অফ প্যান্ডিমোনিয়ামের দুনিয়াও তাই। অ্যালিসের
অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনিও এই গোত্রের।
অন্যদিকে
গ্রেভ ইয়ার্ড বুক কিন্তু আলাদা। এখানে বাস্তব জগতে কল্পনা এসে ঢুকছে। কাল্পনিক
কোনো জগত তৈরি হচ্ছে না। জর্জেস সিক্রেট কী টু দ্য ইউনিভার্স-এর সিরিজও তাই।
বাংলায়
ছোটদের গল্প-উপন্যাস ওই দ্বিতীয় ধরণের। কিন্তু অধিকাংশই দূর্বল প্রকৃতির।
ব্যতিক্রম লীলা মজুমদার, মতি নন্দী।
প্রথম ধরণের মধ্যে সুকুমার রায় ও ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় পড়বেন।যদিও এর কোনটাই
ইংরেজি কোনও কাহিনির ধারেকাছেই আসে না প্রায়। বিশেষত বিস্তৃতিতে। সুকুমার রায়
অনবদ্য। কিন্তু বিস্তারের সময় তিনি পাননি।
এইখানেই
অনেকেরই চোখ এড়িয়ে অধীরদার লেখাগুলি প্রায় অবহেলিতই রয়ে গেছে। অধীরদার লেখার ধরণও
ওই দ্বিতীয় গোত্রেই পড়বে। বাস্তবের মাটিতে পা রেখেই কল্পনার জাল বুনেছেন। অথবা
বোনেননি। কল্পনা তার রূঢ় বাস্তবের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে অবলীলায়। অথচ যদি একটার পর
একটা গল্প পড়ে যাওয়া যায় তাহলে একটা বিস্তার মাথার মধ্যে ছড়িয়ে যায়। বিদেশি
উপন্যাসের বিচিত্র পটভূমিকায় যেমন নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পও ছোটদের লেখার
পটভূমিকা হতে পারে, ভালোবাসা থেকে
যৌনতা সবই থাকতে পারে কাহিনির সহজ চলায়, অধীরদার লেখায় তেমন করেই এসেছে দেশভাগ, যৌন নিপীড়নের মতো অভিজ্ঞতাগুলি। হ্যাঁ, কিশোর সাহিত্যে বা শিশু সাহিত্যে এই যৌনতাবোধ বাংলা সাহিত্যে হয় অবাঞ্ছিত আর
নয় আরোপিত, এমন সহজ বোধে উঠে আসেনি অন্য
কারোর লেখায়।
অধীরদার
গল্পগুলোয় টুকরো টুকরো স্কেচ আছে, টুকরো টুকরো
চরিত্র যারা আসলে একটি না লেখা বৃহৎ উপন্যাসের অংশ। গল্পগুলো পড়তে পড়তেই উপন্যাসের
একটা আবছা ছবি ভেসে ওঠে মাথায় যা হয়তো ওই প্রথম গোত্রে পড়ে। হয়ত সেই উপন্যাসের
নায়ক সেই রতন নামের ছেলেটা। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যে বড় হয় অথবা
বাস্তবের কোনও রূঢ়তাই তার অপার বালক মনকে নষ্ট করতে পারে না। সব লেখাতেই একটা
ব্যথার সুর রয়েছে যেটা হয়তো অধীরদার লেখার বৈশিষ্ট্য অথবা তাঁর জীবনের সুরটি। তবে
আনন্দের ভাগটা আরেকটু বেশি হলে ভালো হত। দু:খের ভেতরেও। বড্ড মনখারাপ লাগে, একটানা পড়া যায় না হয়তো তাই।
ছবিগুলো
অধীরদার আঁকা নয়। তবু মিস পটারের পিটার র্যাবিটের কথা মনে পড়ায় বড্ড।