“একদিন মা আমাকে
জিজ্ঞাসা করিলেন, আমি যাইব কি না। আমি ত আহ্লাদে আট খানা হইয়া বলিলাম “আমি যাইব।” নলিনীর বয়স তখন মাত্র এগারো কী বারো। অসুস্থ শরীর সারাতে দার্জিলিং বেড়াতে
এসেছে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে। দীর্ঘ আট মাস দার্জিলিং-এ কাটানোর পর যখন বাড়ির
সবাই মিলে ফালুট-টংলু ট্রেকের পরিকল্পনা হচ্ছে, নলিনী তখনও জানে না যে তাকে নিয়ে
যাওয়া হবে কিনা। কিন্তু মনে মনে আগ্রহী হয়ে আছে। ছোট্ট মেয়েটি সেই ট্রেকিং শেষে
লিখে ফেলল ভ্রমণকাহিনি – ‘হিমালয় ভ্রমণ’। প্রকাশিতও হল একটি ছোটদের পত্রিকায়। ভ্রমণকাহিনিটির ওপরে লেখা ‘বালিকা লিখিত’। সালটা ১৮৯২-৯৩। কিন্তু ধারাবাহিকের শেষ পর্বটি কেন
বেরোয়নি কে জানে!
খুঁজতে শুরু করলাম কে এই আশ্চর্য
বালিকা? এগার বছরেই যার লেখায় পরিণত হাতের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। যা জানলাম, তা
মর্মান্তিক। তের বছর বয়সে বিয়ে হয় নলিনীর। অসুখে ভুগে মারা যায় মাত্র ষোলো বছর
বয়সে। কে এই নলিনী? বিখ্যাত নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের পৌত্রী এবং সাহিত্যসেবী
দেবেন্দ্রবিজয় বসুর কন্যা। এই পরিবারের মেয়ে হয়ে এবং দীর্ঘকালীন অসুস্থতা থাকা
সত্ত্বেও তার বাল্য বিবাহ আমাকে আশ্চর্য করেছিল। আসলে বাহিরে মুক্তমনের মানুষগুলি
নিজেদের অন্দরে কতটা মুক্তমনা সে প্রশ্ন রয়েই যায়।
নলিনী কবিতাই লিখত। তার আর কোনও
গদ্য লেখার উল্লেখ পাইনি। মৃত্যুর পর তার অসংখ্য কবিতার থেকে মাত্র বাহাত্তরটি
নিয়ে নলিনীর মামা ‘নলিনীগাথা’ নামে একটি সংকলন
প্রকাশ করেন। এই কটি লেখাই তার বেঁচেছে। কবিতাগুলি পড়া হয়নি আমার। তবে নলিনীর লেখা
এই ভ্রমণকাহিনিটি সম্ভবতঃ সবচেয়ে কম বয়সে লেখা কোনও বাঙালির ভ্রমণকাহিনি এবং
ট্রেকিংও। অন্ততঃ মেয়েদের মধ্যে তো বটেই।
নলিনীবালাকে নিয়ে লেখা শুরু করার
ঠিক আগে আমার চোদ্দ বছরের মেয়ের সঙ্গে বসে আরেকবার তার ভ্রমণ কাহিনিটি পড়ে
নিচ্ছিলাম। পড়তে পড়তে আমাদের নিজেদের কন্যাসহ নানান বেড়ানোর স্মৃতি বারবার মনে
ফিরে আসছিল আর প্রায় একশো পঁচিশ বছর আগের এক অচেনা বালিকার কথা মনে করে মনটা মেঘলা
হয়ে যাচ্ছিল। কে জানে নলিনী বেঁচে থাকলে স্বর্ণকুমারী কী অবলা বসুর মত আরেকজন
ভ্রমণ লেখিকাকে আমরা পেতাম কিনা!
No comments:
Post a Comment