Friday, March 10, 2017

লক্ষ্মীমণি দেবী


            আমাদিগের ভ্রমণ বৃত্তান্তের প্রথম পর্বে এমন কয়েকজন বাঙালি মেয়ের কথা জেনেছিলাম যাঁরা সময়ের ইতিহাসে আড়ালে চলে গেছেন। কিন্তু স্মরণযোগ্য। তেমন কয়েকজনের কথা বলতে ইচ্ছে হল।

এইসবই আমার অনুভবের কথা।

যাঁর কথা সর্বাগ্রে মনে আসে, তিনি লক্ষ্মীমণি বসু। কৈলাসবাসিনী দেবীর লেখায় যখন তাঁর উল্লেখ পাওয়া যায় তখন তিনি ব্রাহ্ম বিধবা। ছয় বছরের ছেলে নিয়ে বিধবা হন লক্ষ্মীমণি দেবী। কৈলাসবাসিনীর স্বামী ছিলেন সেকালের প্রসিদ্ধ দেশনায়ক, বাগ্মী লেখক ও সমাজ সংস্কারক কিশোরীচাঁদ মিত্র। স্বামীর কাছেই লেখাপড়া শেখেন কৈলাসবাসিনী। কৌলিন্য প্রথা, বাল্য বিবাহ এসব বিষয়ে তাঁর নানা সমালোচনা মূলক প্রবন্ধও আছে। সমাজসংস্কারক কিশোরীচাঁদ মিত্রের স্ত্রী কৈলাসবাসিনীর নাম খুব অপরিচিতও নয়। অপরিচিত লক্ষ্মীমণির নাম। যাঁকে একই সঙ্গে কৈলাসবাসিনী উল্লেখ করেছেন সভ্য অথচ বাচাল বলে। লক্ষ্মীমণির দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হয়েছে কিন্তু এই দুঃখু জে তিনি কোন সৎ বিদ্যানের হাতে পড়েন নাই। জ্যেমন এক একটা বিচি অমনি পড়ে গাচ হয় হয়ে তাহাতে অনেক ফল হয় এর তাই হইয়াছে। আমাদের জে হওয়া তাহা অনেক যত্নে মাটির পাট করে জল দে হওয়া, কিছু আশ্চর্য্য নয়। আমার মন জেমন উর্ব্বরা, তখন অমন লোকের হাতে পড়িছি, এমন করে শিক্ষা দেছেন, তন্য তন্য করে বুঝায়ে দেছেন, তাহা শুনে নিতান্ত মুখ্যুরও জ্ঞান হয়। কেন হিন্দুরা এই সব নিয়ম সৃজ্জন করেছেন তাহার মাহাত্ম্য আছে। অর্থাৎ শিক্ষিত পুরুষ মানুষের হাতে না পড়ায় লক্ষ্মীমণির শিক্ষা ঠিক হয়নি।

লক্ষ্মীমণিকে আমি চিনেছি বামাবোধিনীর পাতায়। তিনি সেইসময়ের একজন উল্লেখযোগ্য কবি ও প্রাবন্ধিক ছিলেন। থাকতেন বর্ধমানে। শুনেছি তাঁর লেখা কিছু বইও আছে, কিন্তু সেসব আমি খুঁজে পাইনি। আমার তো একলা খোঁজা। একক ভ্রমণ। এমন নয় যে কারোর বই দেখে তাকে ফোন করলাম আর লেখার ঠিকানা জেনে নিয়ে টুকে দিলাম। বামাবোধিনীর পাতাতেই খুঁজে পাই একটি সংস্কারমুক্ত আধুনিক মনের মানুষকে। যিনি কাশীর বিশ্বেশ্বর মন্দিরে গিয়ে পাথর ছাড়া কিছু দেখতে পাননা। প্রয়াগে গিয়ে মাথা নেড়া করতে অস্বীকার করেন। দেশে ফিরে এক ঘরে হন সমাজে।

আসলে কৈলাসবাসিনী শিক্ষিত ছিলেন কিন্তু লক্ষীমণি ছিলেন সংস্কারমুক্ত আধুনিক নারী, তাই লক্ষীমণির চরিত্র কৈলাসবাসিনীর মনে দাগ কাটলেও তাঁকে সম্যক বুঝে ওঠা সম্ভব হয় নি। দেখার এই তফাত প্রতিফলিত হয়েছে তাঁদের লেখাতেও। লক্ষীমণির লেখায় যে ভ্রমণ রস এবং সমাজকে দেখার নিজস্ব স্বচ্ছ দৃষ্টি দেখতে পাই কৈলাসবাসিনীর ক্ষেত্রে তা প্রায় পুরোটাই ব্যক্তিত্বময় স্বামীর আড়ালে ঢাকা। কৈলাসবাসিনীর ডায়েরি শেষ হয়েছে তাঁর বৈধব্যের পরে পরেই। কিন্তু লক্ষীমণির ক্ষেত্রে বৈধব্য, এমন কী একমাত্র পুত্রের মৃত্যুও জীবনের শেষ কথা ছিল না, তারপরেও তিনি ভ্রমণে বেরোনো, বই পড়া (এখানে বঙ্কিমচন্দ্রের মৃণালিনী উপন্যাসের উল্লেখ পাই), লেখালেখি করার মত কর্মশীলতার মধ্যে জীবন কাটানোর কথা ভাবতে পেরেছেন। কোনও শিক্ষিত পুরুষ তাঁর জীবনে আদৌ এসেছিলেন কিনা তা জানা যায় না। তবু, বিশেষ এই কবিতাটি এডিট করে কয়েক লাইন বাদ দেওয়া হলেও মনে হয় তাঁর জীবনে বামাবোধিনী-র ভূমিকা ছিল অনেকখানি।

আমরা কিন্তু লক্ষ্মীমণিকে ভুলে গিয়েছি। বাঙালি নারীর শিক্ষায়-স্বাধীনতায় তাঁর অবদানের কথা কোথাও পাইনা।

No comments:

Post a Comment