Saturday, March 11, 2017

ভ্রমণকাহিনি - জীবিত না মৃত?


একটা দীর্ঘ সময় ধরে বাংলা সাহিত্যে উপেক্ষিত ছিল ভ্রমণকাহিনি। সুকুমার সেনের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসেও এর উল্লেখ আমি তেমন কিছু পাইনি। এর একটা বড় কারণ দেখানো হয়েছিল, ভ্রমণকাহিনি বাস্তব চিত্র, বানিয়ে তোলা গল্প-উপন্যাস নয়। এতে কল্পনার কোনও জায়গা নেই। অথচ আত্মজীবনী যা নাকি পুরোটাই সত্যি বলে ধরে নেওয়া হয়, তাও বাংলা সাহিত্যের দরবারে স্থান পেল। অথচ ভ্রমণকাহিনিতে নিজস্ব কল্পনার রঙ লাগে বলেই একই জায়গা নিয়ে লেখা একজনের কাহিনি আমাদের ভালো লাগে, আবার অন্য কারোরটা ভালো লাগে না। শুধু পুরোনো ভ্রমণকাহিনিই কেন, অপরিচিত লেখকের লেখা বেড়ানোর গল্প যখন পড়ি তখন আমাদের কাছে বাস্তব চরিত্রগুলিও আর বাস্তব থাকে না, কাহিনির অঙ্গই হয়ে পড়ে। ফলে ভ্রমণকাহিনির সাহিত্য তকমা না দেওয়ার পিছনের যুক্তিগুলো আসলে তেমন জোরালো নয়। স্রেফ জোর করেই।

অন্যদিকে ভ্রমণকাহিনির থেকে গল্প-উপন্যাসের পাঠের একটা বিভিন্নতা আছে। গল্প-উপন্যাসে লেখক কী বলছেন তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ পাঠক কী পড়ছে। ইংরেজি সাহিত্যে 'ডেথ অফ এ রাইটার' কনসেপ্টটাই খানিক তাই। গল্প-উপন্যাস আমরা হয় নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গীতে পড়ি। অথবা কোনও একটি চরিত্রের ভেতর ঢুকে গিয়ে তার দৃষ্টিতে ঘটনাগুলোর ভালো মন্দ বিশ্লেষণ করতে থাকি অবচেতনে। ভ্রমণকাহিনিতে কিন্তু লেখকের উপস্থিতি খুব পরিষ্কার। দুভাবে ভ্রমণকাহিনির সঠিক পাঠ সম্ভব। প্রথমত লেখক-পাঠক যেখানে এক হয়ে যান। যেমন বিভূতিভূষণ। আবার লেখক যেখানে পাঠকের কাঁধে হাত রেখে বন্ধুর মতো ঘুরিয়ে দেখান। যেমন - সুনীল। এর বাইরে অন্য যে কোনও ভ্রমণপাঠ সে অর্থে সার্থক ভ্রমণকাহিনি হয়ে ওঠে না। যেমন ভ্রমণকাহিনি পড়তে পড়তে পদে পদে নবনীতার 'আমি' তে হোঁচট খেতে হয়। পাঠক কিছুতেই লেখকের চোখ দিয়ে বা তার সঙ্গী হয়ে পথ পেরোতে পারেন না। আবার বিক্রম শেঠ যখন ওই একই হিচ-হাইকিং পদ্ধতিতে তিব্বত ঘুরে বেড়ান তখন পাঠকের তাঁর সঙ্গে লাফিয়ে গাড়িতে উঠতে কী পথের শোভায় মুগ্ধ হতে একটুও আটকায় না। সত্যি বলতে কী ভ্রমণকাহিনি লেখার হাত যদি সত্যজিতের এতটা ভালো না হতো, অনেক ফেলুদা কাহিনিই ওতরাতো না।

ভ্রমণকাহিনি আসলে অনুভব। এবং তারই সঙ্গে বিস্তার। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সামাজিক রাজনৈতিক ইতিহাস, ভূগোলের পাতা, দর্শন এমন অনেককিছু এবং সর্বোপরি নিখাদ ভ্রমণ।

এই তো গেল কাকে বলে ভ্রমণকাহিনি। এখন মুশকিল যেটা গত বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলা সাহিত্যের লোকজনের নজরে পড়ছে ভ্রমণকাহিনি। জানিনা, পি এইচ ডি-র বিষয় কম পড়িয়াছে কিনা। এখনও কিন্তু ভ্রমণ তার সাহিত্য মর্যাদা পেলোনা। সুকুমার সেনের মতো কেউ এর দীর্ঘ বিশ্লেষণ করতে উদ্যোগী হলেন না। সরাসরি গবেষণার বাজারে সে পণ্য হয়ে উঠল। যাঁরা নিজেরা কখনও ভ্রমণকাহিনি লেখেননি। কাকে বলে ভ্রমণকাহিনি বিন্দুমাত্র জানেন না, তাঁরা নেমে পড়লেন ময়দানে। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে গবেষকরা অধিকাংশই নিজে গল্প-উপন্যাস লেখেন না। কিন্তু বাংলা সাহিত্য নিয়ে যাঁরা পড়াশোনা করেছেন, তাঁরা বাংলা গল্প-উপন্যাস পড়েননি একথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ বাংলা সাহিত্য না পড়েও অনেক মানুষই অন্তত: হালকা গল্প-উপন্যাস পড়েন। কিন্তু ভ্রমণকাহিনি সবাই পড়েন না। পড়তে পারেন না। ওই যে 'দেখে চোখ আর মন।' যাঁরা চোখ আর মন দিয়ে ভ্রমণকাহিনি পড়েন না, ঢেঁকি গেলার মতো পড়েন তাঁদের পক্ষে ভ্রমণকাহিনির সঠিক অনুধাবন বা সঠিক বিশ্লেষণ একেবারেই অসম্ভব। বাস্তব চিত্রও তাই। অধিকাংশ পুরোনো ভ্রমণকাহিনির রিপ্রিন্টের ভূমিকা অসম্পূর্ণ। আবার ভূমিকায় জোর দিলে দেখা যায় বিশ্লেষণটি ভ্রমণকাহিনি পাঠের জন্য একেবারে ভুল। তাতে পাঠককে কেবল বিভ্রান্তই করা হয়। যেমন ইংলণ্ডে বঙ্গমহিলায় সীমন্তী সেনের ভূমিকাটি। কৃষ্ণভাবিনী দাসের এই ভ্রমণের ফল হচ্ছে তাঁর নারীবাদী ধ্যানধারণা। একই ভাবে অবলা বসুর জাপান ভ্রমণের ফল হচ্ছে নারী শিক্ষা সমিতি। এবং বিস্তৃত আলোচনায় না গিয়ে বলি, মেরী ওলস্টোনক্রাফটের ক্ষেত্রে তাঁর প্রথম স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স। এবারে জাপানের ভূমিকায় কেউ যদি নারী শিক্ষা সমিতি নিয়েই লিখে যান অথবা মেরীর লেখায় তাঁর ডিভোর্স নিয়ে সেটা যারপরনাই হাস্যকর হবে। আর তাই কৃষ্ণভাবিনী দাসের লেখারও এই ভূমিকাটি একেবারেই অর্থহীন। আর অর্থহীন বলেই লেখাটি নারীবাদী লেখা হিসেবে যেভাবে চর্চিত হয়েছে, ভ্রমণকাহিনি হিসেবে হয়নি। ভ্রমণ কাহিনির বিস্তারের তত্ত্বটি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞতাই এর কারণ। এবং অনুভবটি তো বটেই। যিনি বলতে পারেন যে, আমি ভ্রমণকাহিনি লিখব না, আমি আমার সাবজেক্ট হব না, তাঁর কাছে ভ্রমণকাহিনিও প্রাণহীন সাবজেক্টই থেকে যায়, ভ্রমণকাহিনি হয়ে ওঠে না কোনমতেই।

যতদিন বাংলা সাহিত্যের গবেষকদের হাতে পড়েনি ততোদিন তবু বেঁচে ছিল, কিন্তু এখন বেচারী ভ্রমণকাহিনির তো প্রাণ নিয়ে টানাটানি।

আমার তো নিতান্ত আতঙ্ক হচ্ছে এই ভেবে যে, পঞ্চাশ একশো বছর পর কোনও বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী বা অধ্যাপক আমার লেখায় ছুরি চালাচ্ছেন। আর আমার জীবন্ত লেখাগুলো একটু একটু করে মরে যাচ্ছে।

No comments:

Post a Comment