Wednesday, December 28, 2016

আ মরি বাংলাভাষা!

মেয়ের সামনে আই এস সি পরীক্ষা। বাংলার আগে ছুটি নেই একদিনও।

দুবছর আগে বাংলায় স্কুল টপারের নম্বরটা সে পেয়েছে না তার মা, সেই নিয়ে দুজনের মধ্যে যথেষ্ট মতদ্বৈধ আছে। মেয়ে যথারীতি সারা বছর পড়তে না এসে কেবল হুমকি দিয়েছে এবারে - নতুন সিলেবাস কিচ্ছু কমন ফেলতে পারবে না তুমি। মাও বলেছে, এবারে আর শেষে এসে দ্যাখ কোনও চেষ্টাই করব না।

এতৎ সত্ত্বেও আই সি এস সি-র মতোই শেষ মুহূর্তে মায়ের দরবারে বাংলা বইখাতা সহ হাজির সে। গত কয়েকদিন ধরেই বাংলা প্রশ্নোত্তর বই এডিট করতে করতে মায়ের মাইগ্রেন শুরু হয়ে গেছে।

তেমনই এক সকালে -

বহুবার বলার পর স্কুলে বাংলায় পাঠ্য ব্যাকরণ বই ভাষাসোপান খুলে বসেছে মেয়ে
মা, ও মা, ২১৩ নম্বর এককথায় প্রকাশটা দেখ, যারা ডাইনিকে পেটায় ডানপিটে।
কী বললি!  - হতবাক মায়ের হাঁ বন্ধ হওয়ার আগেই আবার উড়ে আসে, যার কর্ম করার শক্তি নেই তাকে কর্মক্ষম বলে? তাহলে কর্ম করতে অক্ষম লিখলেই তো পারত!
খাবি খাওয়া মা এবার হাঁ হাঁ করে ওঠে, ওরে কর্ম করতে সক্ষম মানে পারে যারা তাদের কর্মক্ষম বলে রে।
পাতা উলটে সমোচ্চারিত ভিন্নার্থক অর্থে পৌঁছেচে কন্যা। ওমা, জানো, খরা মানে প্রখর রৌদ্র (গলায় এবার ফিচেল হাসির সুর)।
মা এবার হাল ছেড়ে দিয়ে - এ যে ডোডো-তাতাই-এর চেয়েও ভয়ঙ্কর। বাবা বলেছে না, তুই বামনদেব পড় মা। ভাষাসোপান বন্ধ কর।

মেয়েকে নির্দেশ দিয়ে এবারে মা তার স্কুলের বাংলা নোটস নিয়ে বসে। পাশ থেকে মেয়ের উক্তি, ম্যাম বেশ ভালো লেখায় মা, আগে সাউথ পয়েন্টে ছিলেন, গত বছর থেকে আমাদের স্কুলে।
লাল পেন দিয়ে লাইনের পর লাইন ম্যামের নোট কাটতে কাটতে আর সংশোধন করতে করতে মায়ের উত্তর, তোর ম্যামও বোধহয় ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছে। (স্বগতোক্তি) সাধে কী আর স্কুলের বাংলা পরীক্ষায় এত নম্বর পাস!
অর্ধেক নোট কারেকশন-এর পর খাতা নামিয়ে রেখে উদাস গলায় মায়ের গান আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু...।


Saturday, December 24, 2016

বছরশেষে

মাথার মধ্যে আগে গুছিয়ে নিই আর কী কী করবার আছে?
কতখানি বেঁচে আছি আর কতটুকুই বা মৃত?
কতটা পড়ে আছে পোড়া ঘাসেউঠোনে বা বালিসের পাশে?
কভাগ মিথ্যে তার! বাকী আছে সত্য কতটুকু?

সমস্ত অগোছালো,এলোমেলো কুড়োনোর শেষে
কিছুই থাকে না আর তোমার আমার।
কিছুই থাকে না তবু কুয়াশা মাখা এক শীত সকালে
কিছুটা নরম রোদ্দুর আর কলম এখনও জীবিত।

ড্যারিয়েল ক্রেসওয়েল-এর আরও দুটি কবিতার অনুবাদ





১)

কখনও শ্বাস নেওয়াও
কঠিন হয় সে মেয়ের;
বাতাস যেন ভরে থাকে
এক তীব্র বেদনায়।
তখন নিজেই বইয়ে দেয় সে
মিঠে নরম হাওয়া
কবিতার
তুমুল বৃষ্টি ঝরিয়ে।

২)

এখন তখন দেখতে পাবে
এমন মানুষ ভিড়ের মাঝে
ভিন্ন যে।
ঝলমলেউজ্জ্বল।
অন্যকে যারা বাসতে পারে ভালো
খোলা মনে নির্ভয়ে,অবিরল।

Friday, December 16, 2016

উচ্ছেদপর্বের আগে বা পরে










উচ্ছেদ ঘটে, ঘটেই থাকে। বাস্তবে। গল্পে উপন্যাসে। মানুষের উচ্ছেদ। ভিটেমাটির উচ্ছেদপর্ব। এর পেছনে থাকে রাজনীতি, সমাজ এবং সর্বোপরি রাষ্ট্র।

এইসব কিছুই লিখছিলাম না। যদিও এরসঙ্গে এইসবও ওতপ্রোত।

আমি দেখছিলাম ঐতিহ্যের উচ্ছেদ, বইয়ের পাতার উচ্ছেদ।

একদিন আমাদের আগের বাড়ির দোতলার একটা বারান্দাকে মৃদু হাওয়ায় ভেঙে ভেঙে পড়তে দেখেছিলাম।ছবিতে দেখলাম দুশো বছরের পুরোনো গাছ কীভাবে মানুষের আঘাতে আঘাতে ভেঙে পড়ে।

এইসব এখনকার কথা, আগে একটু পুরোনো কথা বলি। কারণ 'কলেজ স্ট্রিট' বাঁচাও জমায়েতে অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি, ছবি তুলছি দেখে সঞ্চালনা করছিল যে মেয়েটি - বন্দনা আর আরও একজন আমায় কিছু বলতে বলছিল। বলিনি। কিন্তু কেন গেছি জানতে চাওয়ায় বললাম, বই, কলেজ স্ট্রিট এসবের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ বহুদিনের। সেই গল্প একটু করি।

প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার ইচ্ছে ছিল অনেকদিনের। কিন্তু জুওলজি অনার্সের পরীক্ষায় সফল হইনি। সেই প্রথম ওই কলেজে ঢোকা। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ভারী ভালো লেগেছিল। দ্বিতীয়বার গিয়েছিলাম এক প্রবল বৃষ্টির দিনে এক হাঁটুর ওপরে জল ঠেলে একটা সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিতে। নাহ, সে চাকরিও হয়নি আমার। কিন্তু প্রেসিডেন্সির প্রতি একটা সম্ভ্রম মেশানো ভালোলাগা রয়েই গেছে আমার পড়ুয়া মনে।

রামমোহনের হস্টেল 'সাধনা সরকার'-এ থাকার সময় বেরোনোর দুটো পাস ছিল - 'হাতিবাগান পাস' আর 'কলেজস্ট্রিট পাস'। পাঁচজন একসঙ্গে না হলে কলেজই যেতে দিত না তো অন্য কোথাও। হাতিবাগান পাস-এ মেয়ের অভাব হত না। যদি দৈবাৎ পড়ার বই কেনার জন্য কলেজ স্ট্রিট পাস-এ চারজনকে পাওয়া যেত তবে তো আমার পোয়া বারো। বই কেনার টাকা আমার কাছে থাকত না। মানে বাড়তি কোনও টাকাই। তাতেই বা কি? যাওয়াটাই তো আনন্দ। এই আনন্দটা যারা ভীষণ স্বাধীন একটা কলেজ জীবন কাটাচ্ছে তারা কিছুতেই বুঝবে না হেদুয়ার থেকে বাসে উঠে কলেজ স্ট্রিটে নেমে বইপত্রের মধ্যে দিয়ে হাঁটাটাই কত মজার কতটা স্বাধীনতার। আর তাই বছর কুড়ি পরে হস্টেলের কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে যখন আবার দেখা করার কথা ওঠে, আমি বলি, চল কলেজ স্ট্রিট পাস, কফি হাউসেই যাই। কে বলে কফি হাউসের আড্ডাটা আর নেই? আমরা দিয়ে এলাম তো।

এরপরও বহুবার কলেজ স্ট্রিটে এসেছি। আমার এক বন্ধু থাকত মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে, তার সঙ্গে আড্ডা দিতে। তবে বই কেনা এবং কফিহাউসে আসা সেটা সবচেয়ে বেশি যে ভদ্রলোকের সঙ্গে আমি গত আঠেরো বছর একসঙ্গে আছি এবং বছর কুড়ি ধরে চিনি। এবং মেয়ের সঙ্গেও। তার পাঠ্যের বা তার বাইরের কোনও বই কিনতে। আমার পছন্দ চিকেন স্যান্ডুইচ। মেয়ের চিকেন অমলেট আর কোল্ড কফি উইথ ক্রিম। তাঁর কালো কফির সঙ্গে যাহোক কিছু হলেই হল। প্যারামাউন্টের ডাব সরবত আমার ফেভারিট।

কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথ থেকে আমার নিজের শেষ কেনা কয়েক বছর আগে দুটো বাঁধানো ইন্দ্রজাল কমিকস। দোকান থেকে অবশ্য তার পরেও কিনেছি। পাছে ঠকে যাই তাই বই আমি কিনি কম, বায়না করি বেশি। আর তাই অবিকল ছোটবেলার মতো দেখতে বিভূতি রচনাবলী এসে যায়। পড়া হয়নি বলে মানিক গ্রন্থাবলী বা দুষ্প্রাপ্য সিরিজ। বইয়ের গল্পের তো শেষ হয় না। হয়তো ছোটবেলায় বাবাও যখন কলকাতা থেকে ফেরার সময় একেকবার বিভূতি রচনাবলীর এক একটা খণ্ড নিয়ে ফিরত আর আমরা দুজনে অপুর মতো অপেক্ষা করে থাকতাম তারও কেনার ঠিকানা হয়ত এই কলেজ স্ট্রিটই ছিল। বাবার সঙ্গে নিশ্চয় কখনও এসেছি কিন্তু সে স্মৃতি নেই আর। কিন্তু ন্যাশনাল লাইব্রেরী কী কলেজ স্ট্রিটের গল্প বাবার কাছেই শোনা।

আমার একার কলেজ স্ট্রিট ভ্রমণ খুব বেশিদিনের নয়। 'অবলা বসুর ভ্রমণকথা' প্রকাশ উপলক্ষে 'পরশপাথর' প্রকাশনার অরিন্দমদার সঙ্গে যোগাযোগ পরবর্তী সময় থেকে। অরিন্দমদার ছোট্ট অফিসটা 'সিগনেট প্রেস'-এর গা ঘেঁষে ঢুকে যাওয়া একটা অন্ধকার গলির একেবারে অন্দরে। তবে কফি হাউসের খুব কাছেই। কতদিন ওখান থেকে বেরিয়ে একা একা কফি নিয়ে বসে থেকেছি সেখানে। তারপর 'আমাদিগের ভ্রমণ বৃত্তান্ত' প্রকাশের জন্য আর্মহার্স্ট স্ট্রিট পোস্টাফিসের কাছে 'গাঙচিল'-এর পুরোনো ঠিকানায়। সেখান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কলেজ স্ট্রিট মোড়ের কাছে এসে রাস্তার ডানদিকে একটা গলিতে ঢুকে মাটির ভাঁড়ে চা খেয়ে বেরিয়ে বাস ধরা। একসময় ওই গলিতেই আরেকটু এগিয়ে একটি ক্লাস নাইন-টেনের ছাত্রীকে বায়োলজি পড়াতে আসতাম। হ্যাঁ, সেইসময়টাতেও একা এসেছি বটে কলেজ স্ট্রিটে। এটা বেশ কয়েকবছর আগের কথা। আর তারপরে এতদিনবাদে ইংরেজিতে এম এ পড়ার সময় বইয়ের সন্ধানে।

আর্মহার্স্ট স্ট্রিট থেকে কলেজ স্ট্রিট যেতে রাস্তার ধারের গন্ধগুলো কেমন বদলে বদলে যায়। কার্ডের দোকানের গন্ধ, ছাপাখানার গন্ধ, ফলের দোকানের গন্ধ শেষ হয় পুরোনো বইয়ের গন্ধে। নতুন ছাতা আর শাড়ির গন্ধ তো আছে বটেই তবে তা দোকানের বাইরে পাওয়া যায় কিনা সে খেয়াল পড়ছে না। আবার আরেকটা রাস্তা দিয়েও অনেক সময় কলেজ স্ট্রিটে ঢুকি - কলেজ স্কোয়ারে নেমে সোজা হাঁটতে হাঁটতে দিস্তে কাগজের দোকানগুলো পেরিয়ে ডানহাতে বড় দোকান আর বাঁ হাতে ছোট দোকানগুলোকে দুপাশে রেখে বাঁয়ে সংস্কৃত কলেজ আর হিন্দু স্কুল ডাইনে কফি হাউস পেরিয়ে যে রাস্তাটা সোজা ধাক্কা খায় প্রেসিডেন্সি কলেজের গায়ে। যে পথে গতকাল শেষ বিকেলে পৌঁছালাম 'কলেজ স্ট্রিট বাঁচাও' পথসভায়।

অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা জড়ো হয়েছিল প্রেসিডেন্সির ভেঙে যাওয়া গেটের বিপরীত ফুটপাথে। হাতে লেখা বেশ কিছু পোস্টারের সামনে বসে আছে কয়েকজন, দাঁড়িয়েও কেউ কেউ। পথচলতি মানুষও কিছুক্ষণ থমকে শুনে যাচ্ছেন দু-চার কথা। হাতে মাইক নিয়ে বলছে ওরাই - আমাদের ছেলেমেয়েরা। ওপাশে গেটের সামনে পুলিশের গাড়ি। গেটের এপারে-ওপারে পুলিশ। রাস্তার এই ফুটপাথেও আরেকটা পুলিশের গাড়ি। ভাবছিলাম আজও ক্ষমতাসীনেরা প্রেসিডেন্সির ছাত্রছাত্রীদের কতটা ভয় পায়! যদিও সময়টা খুব খারাপ। এই আকালে স্বপ্ন দেখার মানুষজনের সংখ্যা ক্রমশ: কমছে। তাই প্রেসি ও অন্যান্য বেশ কিছু কলেজ মিলিয়েও প্রাক্তন-বর্তমান ছাত্রছাত্রী সংখ্যা বেশ কমই। তবু কিচ্ছু না এর থেকে কিছু ভালো। প্রেসিডেন্সির ভেতরের অবস্থার কথা টুকরোটাকরা কিছু জেনেছিলাম ফেসবুকেরই বিভিন্ন জনের সৌজন্যে নানা সময়ে। চলতি মিডিয়ার ওপর ভরসা লাগেনা। আরোই লাগেনা, এই জগতটাকে খানিক ভেতর থেকে দেখেছি বলেই। প্রেসিডেন্সির এক লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে সামান্য ফোনালাপের সূত্রে লাইব্রেরীর বর্তমান হালও জেনেছি। তাই উন্নয়নের নামে প্রেসিডেন্সির অন্দরে কী চলছে সেই চিত্রগুলো আমায় আশ্চর্য করল না। অনুরাধা লোহিয়া এবং তাঁর সহচরদের ওপরে এদের ক্ষোভ খুবই সঙ্গত। কারণ উন্নয়নের নামে হাত পড়ছে ঐতিহ্যে। রাতের অন্ধকারে পাচার হয়ে যাচ্ছে দুষ্প্রাপ্য জিনিসপত্র। সস্তার রঙচঙ দিয়ে দেখানো হচ্ছে উন্নয়ন। যা এখন এই রাজ্যেরই একটি বিধি। যারাই এর বিরোধিতা করছে তাদেরই মুখ বন্ধ করা হচ্ছে যেন তেন প্রকারেণ। প্রায় চোদ্দ-পনেরোটা গাছ ইতিমধ্যে কাটা হয়ে গেছে। দুশো বছরের প্রাচীন বটগাছটির গোড়া পরিস্কার হচ্ছে দেখলাম পুলিশি পাহারায়। পুরোনো চেনা গেটের জায়গায় আপাতত বোধহয় অ্যাসবেস্টস। পাশের দোকান কিছু বোধহয় রাতারাতি উচ্ছেদ হয়েছে, কিছু বাকি। উচ্ছেদ হওয়া মানুষগুলোকে নিয়ে চিন্তার কথা তাদের রুটি-রুজি এসব নিয়ে তো ছেলেমেয়েগুলো বলল। বলল উচ্ছেদ হওয়া গাছেদের কথাও।


শরীরটা ভালো নেই। ঘুম পাচ্ছিল। আর আধ ঘুমন্ত অবস্থায় কেউ কোনদিনও বিপ্লব করেনি। অতএব চিরকালের মতোই আমি শুনি, শুনে যাই, ভাবি। ভাবছিলাম উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া বইয়েদের কথা। হাতে মোবাইল একটা থাকায় কিছু ছবিও তুলি। সেইসব ভাবনারই কিছু কথা লিখে ফেললাম আজ সকালে। দুপুরে ওদের একটা মিছিল আছে বেলা তিনটে প্রেসিডেন্সির সামনে।

অসুখ করলে অনুবাদই খেলা

কখনও সে অপরূপ জন্মে
তেমনও প্রতিকূলতায়।
নত হতে তার পানে
চোখ শুধু ভুলে যায় -
মাটির বুকের তুচ্ছতাপরে
যেখানে সে জেগে রয়।

মাথা কাজ না করলে এলোমেলো অনুবাদই সই

কখনও সেই মেয়ের
তারাগুলি আর পারেনা
আলো ছড়াতে এ ভুবনে।
অনুভবে সে একলা থাকে
আড়ালমাঝে হারিয়ে।
দুনিয়া তখন কুয়াশা
হিমমোড়া।
যদিও অদৃশ্য তবু আমি
তার আলোর দহন দেখি -
ঘ্রাণ পেতে থাকি
ধিকি ধিকি সেই
পুড়ে যেতে থাকা

আত্মার।

আনমনে অনুবাদ...

হৃদয় থেকে আপনি উৎসারিত -
আমায় দেখে তবেই হেসো স্মিত।
আত্মা থেকে ছুঁতে পারোই যদি
ছুঁয়ো আমায় স্পর্শ নিরবধি।
আমার শব্দ আখরগুলি ধরে
সততার কথা শুধুই জীবন ভরে।
বর্ণমালায় সত্য থাকে তো দিও

অথবা তোমার নি:শব্দতাই শ্রেয়।

সময়

কুয়াশার অপার্থিব ভোর কেটে গেলে
স্পষ্ট সকাল আর কবিতার নয়,
খিদের।
মরা ধান আর অসময়ের বৃষ্টির।
একা অথবা হত মানুষের মিছিলের।
শব্দেরা তবু আরেকটা সেই রাতের জন্য
অপেক্ষা করে

এখনও।

সংক্ষিপ্তসার সংকলন

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রযুক্তিগত সম্ভাবনা - সংক্ষিপ্তসার সংকলন

https://sites.google.com/site/nsbdsc/jatiya-alocanacakra-2/6-sanksiptasara-sankalana

Tuesday, December 6, 2016

শীত

মাঝে মাঝে শব্দেরা চুপ করে যায়।/ ওম চায়।/  অক্ষর খুঁজে ফেরে না-উচ্চারিত বর্ণমালার উষ্ণতা।

এখন শীতের সময়।

সকাল

স্বপ্নের ভোর থেকে প্রতিদিন দু-একটি পাতা ঝরে যায়...।

Monday, December 5, 2016

সময়ের দাম!

কাকটা ভারি অবাক হয়ে বলল,তোমাদের দেশে সময়ের দাম নেই বুঝি?
আমি বললাম,সময়ের দাম কিরকম?
কাক বলল,এখানে কদিন থাকতে,তা হলে বুঝতে। আমাদের বাজারে সময় এখন ভয়ানক মাগ্যি,এতটুকু বাজে খরচ করবার জো নেই। এই তো কদিন খেটেখুটে চুরিচামারি করে খানিকটে সময় জমিয়েছিলাম,তাও তোমার সঙ্গে তর্ক করতে অর্ধেক খরচ হয়ে গেল। বলে সে আবার হিসেব করতে লাগল।
আর আমি ব্যাঙ্ক-এর লাইনে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে ভাবতে লাগলাম, সময়ের দাম কাকে বলে? এই যে এতগুলো লোক কাজ-কম্ম, অফিস-কাছাড়ি চুলোয় তুলে সকাল থেকে রাত্তির এই এটিএম থেকে সেই এটিএম, ব্যাঙ্ক থেকে পোস্টাফিস ছুটে বেড়াচ্ছে, ঘন্টার পর ঘন্টা লাইন দিচ্ছে তাদের কারোর কি সময়ের দাম নেই? যে সাধারণ মানুষগুলোর এই টাকার চক্করে কাজ চলে গেল সেই কাজের সময়গুলোর দাম কে দেবে? ওই যে লোকগুলো লাইন দিতে গিয়ে ঝুপ ঝুপ করে মরে যাচ্ছে ওদের জীবনের দাম?
কিছুতেই আর সময়ের জমা-খরচের হিসেবটা মেলাতে পারছি না। কাক্কেশ্বরকেও আজকাল আর দেখা যাচ্ছে না বিশেষ। নিশ্চয় নতুন দুহাজার টাকার ভাঙতি না পেয়ে বাজারি কাগজে পোস্ট এডিটোরিয়াল লিখছে পেন্সিল ঠুকে।
ভাবছিলাম একবার গেছো দাদার কাছেই নাহয় যাব। ভাবতে ভাবতেই শুনি তিনি ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে গিয়েছেন জাপান। তারপর সেখান থেকে ফিরে...
নাহ্‌, কোথাও কোনও লাইনে এখনও দাদার দেখা পাইনি। দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। ওদিকে হুসহুস করে সময় চলে যাচ্ছে...

পথে চলে যেতে যেতে

এক কাঁধের ওপরে গামছার ভার। লাল, নীল, সবুজ নানা রঙ, নানান রকমের ডোরাকাটা। শান্তিপুরী, বাঁকুড়া কত জায়গার নাম তার। গামছার রঙ পেরিয়ে দৃষ্টি আটকায় মানুষটির মুখে। অন্ধ!

রাত বেড়েছে। রেলগাড়ির কামরায় যাত্রীর সংখ্যা শেষ গন্তব্য ক্রমশ এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে কমছে। বিক্রেতার ভিড়ও তেমন নেই। এক যাত্রী গামছা দেখে। নানা রঙের ছোট ছোট চৌখুপী গামছা সরিয়ে একটা নীল গামছায় নজর আটকেছে তার। রঙটি ভালো লেগেছে, নেড়েচেড়ে দেখে। বিক্রেতাও যেন আপন দৃষ্টিতে দেখতে পান বিক্রেয় পণ্যটিকে ভালোলেগে যাওয়া সেই মুখটি। তাঁর মুখেও ছড়িয়ে পড়ে পরিতৃপ্তির ঈষৎ রেশ। ওপাশ থেকে আরেকজন দাম জানতে চান। কাঁধের ওপর রাখা নির্দিষ্ট গামছায় হাত রাখলেই বিক্রেতা গামছার নাম আর দাম বলতে থাকেন। আশি টাকা, একশো টাকা, দুশো টাকা আরও দামীও রয়েছে। কোনটা মেলে দেখান। জোড়া লাগান রয়েছে লম্বা করে ছড়িয়ে ধরেন দুহাতে। আমি দেখতে থাকি চলমান জীবনের গল্পের এক চরিত্রকে।

প্রথম ও একমাত্র ক্রেতাটি ইতিমধ্যে মনস্থির করে ফেলেছেন। একশো দশ টাকার গামছা রফা হয়েছে একশো টাকায়। নিপুণ দক্ষতায় জোড়া গামছা হাতের টানে দুভাগ করে একটা গামছা ক্রেতার হাতে তুলে দেন বিক্রেতা। যাত্রীটিও দাম মিটিয়ে ভারী খুশি হয়ে ভাঁজ করতে থাকেন ব্যাগে ঢুকিয়ে নেবেন বলে। গামছাওলা এগিয়ে গেলে পিছনের যাত্রীটিকে নিজের পুরোনো আর নতুন গামছা পাশাপাশি রেখে কেমন সস্তায় ভালো গামছা পাওয়া গেছে, কেমন সুন্দর রঙ বোঝাতে উদ্যোগী হয়েও তাঁর উৎসাহের অভাবে দুটিকেই ব্যাগে ভরে প্রসন্নমুখে সিটে বসে পড়েন।


আমার সম্বিত ভাঙে। গামছাওলা এগিয়ে গিয়েছেন অনেকটা। আমার গামছার কোনও প্রয়োজন ছিলনা সত্যি। কিন্তু একটা কিনলে কি এমন ক্ষতি হত?

Tuesday, November 29, 2016

ফের কাক্কেশ্বর উবাচ

কাক জিজ্ঞাসা করল, কালোকে অর্ধেক করলে কী হয়?
আমি বললাম, কালোকে অর্ধেক করলে আর কী হবে আধখানা কালো হবে!
কাক মাথা নেড়ে বলল, হলো না, হলো না, সাদা।
আমি বললাম, ধুত, তাই আবার হয় নাকি? আমার কালো রঙ পেন্সিল ভেঙে গেলে তো সেটা কালোই থাকে, দুটো অর্ধেক কালো।
পেন্সিল নয়, পেন্সিল নয় টাকা, কালো টাকা। তোমার কালো টাকা আছে? কাক আবারও জিজ্ঞাসা করে।
আমি বললাম, না, কালো রঙের টাকা হয় নাকি? আমার কাছে তো একটাও নেই! গোলাপী রঙের দুটো দুহাজার টাকার নোট রয়েছে যেটা কোথাও ভাঙিয়ে দিচ্ছে না। খুচরো হবে নাকি?
কাক বিরক্ত হয়ে একটানা বলে গেল, কালো টাকা মানে ব্ল্যাক মানি তাও জানোনা? খুচরো? খুচরো মোটেও এখন সহজ কথা নয়। দশ টাকার কয়েন চাও তো গোটাকতক দিতে পারি কেউ নিচ্ছেনা। তোমার বয়স কত? ওজন? কালো টাকা নেই যদি তবে লাইনে দাঁড়াওনি যে বড়? তুমি দেখেছ আম্বানী, জয়ললিতা, মোদী, মমতা কাউকে লাইনে দাঁড়াতে?
মাথা নেড়ে ভয়ে ভয়ে বললাম, কই না তো, দেখিনি। কোনও মিডিয়া খবর করেনি। বয়স? আমার বয়স তো তেতাল্লিশ বছর আর ওজন সত্তর কেজি। কিন্তু আমি তো এ টি এম থেকে টাকা তুলতেই পারিনা।
কাক হেঁকে বলল, বয়স সত্তর কেজি, ওজন তেতাল্লিশ বছর, দিব্যি ফেসবুক-হোয়াটস অ্যাপ করতে পার আর টাকা তুলতে পারনা? বললেই হল? তুমি তো আর গরীব নও যে ফস করে পঞ্চাশ দিনের আগেই মরে যাবে! তাহলে হয় তুমি দেশদ্রোহী নাহলে সিপিএম।
আমি ভীষণ চটে গিয়ে বললাম, একদম বাজে কথা বলবে না। আমার বয়স মোটেও সত্তর কেজি নয়।
কাক একটুও পাত্তা না দিয়ে পেন্সিলটা দুবার ঠক ঠক করে ঠুকে ঘাড় বেঁকিয়ে একটুক্ষণ কী ভেবে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, পেটিএম জানো? ক্রেডিট কার্ড? ক্যাশলেস মানি?
আমি এবার ভারী খুশি হয়ে বললাম, পেটিএম তো? কেন জানব না? ওই যে মোদীর ছবি দিয়ে কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল।
কাক বলল, আরে বিজ্ঞাপন চাও বললেই হয়। এই নাও বলে একতাড়া কাগজ আমার হাতে ধরিয়ে দিল।
দেখি কাগজের গায়ে বড় বড় করে লেখা - শ্রী শ্রী ভুষুন্ডি কাগায় নম। সাউথ ব্লক, সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং...
এখানে হিসাবী বেহিসাবী সমস্ত কালো টাকা সাদা করিয়া থাকা হয়।
জমা টাকা কালো তাহা নিজে জানাইলে কর ৩০% জরিমানা ১০% সারচার্জ করের ৩৩% অর্থাৎ সবমিলিয়ে হল গিয়ে ৫০%। বাকি টাকা চারবছর গরিব কল্যাণ প্রকল্পে কাজে লাগবে।
জমা দেওয়া টাকা কালো বলে ধরা পড়লে...ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমার তো মাথাফাতা সব গুলিয়ে গেল।
বললাম, আর যাদের টাকা কালো নয়, যারা টাকা তুলতে পারছে না, টাকা পেয়েও ভাঙাতে পারছে না, যারা টাকা এখনও বদলাতে পারলনা...?
কাক ভারী বিরক্ত হয়ে বলল, তাও জানোনা? এরা হল হিসেবের বাইরে, খরচের খাতায়। এদের জমা টাকায় সরকারের স্বাচ্ছল্য বাড়ল, কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে ঋণ দেওয়ার মতো পুঁজি বাড়ল। সকাল থেকে বকবক করে দিলে তো আমার সময় নষ্ট করে। এখন সময়ের দাম বড্ড বেড়ে গেছে -৫০ দিন, তিন মাস, ছমাস... কতটা কালো টাকা সাদা হচ্ছে তার ওপর বদলে বদলে যাচ্ছে।
এই বলে কাক্কেশ্বর মন দিয়ে আবার কালো-সাদা হিসেব কষতে লাগল আর আমি হাতে দুটো বাতিল থুড়ি না ভাঙাতে পারা দুহাজার টাকার নোট নিয়ে আকাশপাতাল ভেবেই যেতে থাকলাম কোথায় ভাঙাব?





আন্তর্জালে বাংলা ভ্রমণপত্রিকা ও ব্লগ

২৫ ও ২৬ নভেম্বর, ২০১৬ 'বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রযুক্তিগত সম্ভাবনা' শীর্ষক দুই দিন ব্যাপি জাতীয় আলোচনাচক্রে ভাষা ও প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন এমন গুণী মানুষজনের কাছ থেকে ভাষা, ভাষাবিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি কীভাবে পাশাপাশি কাজ করতে পারে এবং করছে এ বিষয়ে নানান বিদগ্ধ আলোচনায় সমৃদ্ধ হলাম।
এই আলোচনাচক্রের প্রথম দিনের একটি অধিবেশনে আমরা যারা প্রয়োগক্ষেত্রে বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছি তাঁদের কয়েকজনের মধ্যে একেবারেই প্রযুক্তি বিষয়ে অজ্ঞ, কেবলমাত্র ভ্রমণসাহিত্যে উৎসাহী হয়েও 'আন্তর্জালে বাংলা ভ্রমণপত্রিকা ও ব্লগ' শিরোনামের একটি উপস্থাপনা রাখতে পেরে আমি আনন্দিত।

আলোচনাচক্রটি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি আয়োগের অর্থানুকূল্যে আয়োজন করেছিল সরসুনা কলেজের বাংলা বিভাগ এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ও ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ।

Monday, November 14, 2016

পর্যবেক্ষণ

বামেরা প্রতিবাদ করছেন। ওদিকে তৃণমূলও। এবারে বাম-তৃণমূল মিলল কিনা সেই নিয়েও চিন্তিত অনেকে।
বামেরা আর যাই করুক প্রতিবাদ একটা করার অভ্যেস চিরকালের। আর এটাও সত্যি যে বামেদের উপরতলার নেতারা সাধারনভাবেই থাকেন বলেই দেখেছি। আর যাঁরা ইয়ে করতে শুরু করেছিলেন তাঁরা এখন তৃণমূলে গিয়ে নিশ্চিন্তে করছেন।
খেয়াল করুন বামেরা কিন্তু কালো টাকা ধরার বিরোধীতা করছে না। করছে কাজটা যেভাবে হয়েছে তার সার শূন্যতায়।
বিরোধী থাকাকালীন করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে ধরণের মমতার প্রতিবাদী মূর্তি খুব প্রভাব ফেলেছিল জনগণের মধ্যে। না তাঁরা পেয়েছেনও। হাতে রইল সাইকেল।

আরে যে যার মতো প্রতিবাদ করুক না নিজেদের স্বার্থে, তবু করুক।
যে মানুষটার হাতে এখনও ভারতবর্ষের মানুষের রক্ত লেগে আছে, ধর্ম ব্যবসায়ী সেই মানুষটাকে কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।

ভোট দিইনা গত দশ বছরেরও বেশি। এই সবই পর্যবেক্ষণ।

গণমাধ্যম!

একজন সাংবাদিক হিসেবে যে বিষয়টা আমাকে আজ সবথেকে ভাবায় তা হল আজকে গণমাধ্যমের অবস্থান।

এ দেশে সংবাদমাধ্যম অর্থাৎ খবরের কাগজ চালু হওয়ার প্রথম দিকে তার মূল উদ্দেশ্য ছিল দুরকম। বৃটিশ কাগজগুলি ইংরেজ শাসনের পৃষ্ঠপোষকতা করত এবং ভারতীয় কাগজগুলি ইংরেজ বিরোধীতার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, আমজনতার বয়ান এবং তাদের দাবিদাওয়ার কথা তুলে ধরত। এতে যেমন বিচিত্র ভাষা-ধর্মের একটা দেশের মধ্যে প্রতিদিনের জীবনের বঞ্চনা শোষনের একটা যোগসূত্র স্থাপিত হতো ঠিক তেমনি ইংরেজ বিরোধীতার একটা সাধারণ রূপ ধরা পড়ত।

খুব স্বাভাবিকভাবেই উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণী এর যেটুকু সুফল পেয়েছিল তা সাধারণ মানুষ পায়নি। আবার এই উচ্চ ও মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশই ছিল শাসক শ্রেণীর দালাল।

এর ব্যতিক্রম বলতে যাঁর নাম বারবারই মনে পড়ে তিনি 'গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা' (১৮৬৩)-র প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক হরিনাথ মজুমদার। কাঙাল হরিনাথের কাজ ও লেখা আজও প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় আমার।

সংবাদমাধ্যমগুলির পরিবেশনা দেখলে এখন যেটা মনে হয়, খবরের স্লট বা পাতা ভরতে তারা যতটা আগ্রহী ততোটা 'খবর' নিয়ে নয়। কিছু রয়েছে পরিস্কার পৃষ্ঠপোষক গণমাধ্যম যা সরাসরি সরকারের যে কোনও নীতি সমর্থন করে। এটা সবসময় ছিল ও থাকবে। কিছু গণমাধ্যম সব দিক বজায় রেখে চলে যাতে পাশা উলটোলেও তার ক্ষতি হবে না। এরা সবচেয়ে ক্ষতিকর।

আরও ক্ষতিকর যেটা, গণমাধ্যমের শুরুর দিকে 'গণ' তে মাধ্যম চালাতো এখন ওই 'মাধ্যম' চালায় 'গণ' কে। আর তাই রিক্সাওলাও বলে, 'এবারে পাকিস্তান পুরো বুঝবে।' তা তুমি বুঝলে কী করে জানতে চাইলে বলে, 'টিভির ওমুক চ্যানেল বলছিল।'

একটা সময়ে কাগজে প্রতিবাদী চিঠি লেখার একটা বেশ চল ছিল। তখনও সোশাল মিডিয়ার যুগ নয়। অনেকটা জায়গা নিয়েই ছাপা হত কিন্তু বেশিরভাগই এডিটেড ভার্সন। অপছন্দের চিঠিপত্র ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট ভরাতো। কাগজে চিঠি লিখেই লেখক হিসেবে খানিক প্রতিষ্ঠাও পেয়ে গেলেন কেউ কেউ। এখনও বেরোয় কিন্তু সেই ব্যাপারটা আর নেই।

সোশাল মিডিয়া এক হিসেবে মানুষের মুখপাত্র হয়ে দাঁড়ালো। আর্থিকভাবে একেবারে নীচুতলার মানুষেরা অবশ্য এর আওতার বাইরেই আছেন এখনও। যদিও এখন রিক্সাওলার পকেটেও মোবাইল। ফুটপাতের মানুষও রেডিওর বদলে মোবাইলে মন দেন। ডিজিটাল ইন্ডিয়া যাকে বলে। কম টাকায় নেট কানেকশন, ফ্রি ওয়াইফাই-এর পর, বিনাপয়সার সিম অজস্র অফার।

একটা প্রশ্ন জাগে, মানুষ যখন সহজে তার ক্ষোভ বিস্তৃত মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারছে তখন তার প্রয়োগ করার ইচ্ছে বা ক্ষমতা আর কতখানি থাকবে?


তবে মিডিয়া যখন আঁটঘাট বেঁধেই নোট বাতিলের পরেরদিন পেটিএম এর বিজ্ঞাপন ছাপে, তখন মনে হয় যারা ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে কষ্ট করছেন তাঁদের আর্তনাদের অন্তত একটা উপায় বা মাধ্যম থাকুক। এখনও যাকে গণমাধ্যম বলতে পারি।

Wednesday, November 9, 2016

কাক্কেশ্বর উবাচ

কাক বলল, 'দুশো দুগুণে কত হয়?'
আমি বললাম, চারশো।
কাক মাথা নেড়ে বললো, 'হলো না, হলো না পাঁচশো।'
আমি রেগে গিয়ে বললাম, বললেই হলো, সবাই জানে দুই দুগুণে চার।
কাক বলল, 'সেটা নির্ভর করছে পাঁচশো টাকাটা নতুন না পুরোনো?'
আমি বললাম, সে আবার কি?
কাক বলল, 'ধরো কালোবাজারি আর জাল টাকার কারবার রোখার কথা বুঝিয়ে সরকার পুরোনো পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট রাতারাতি অচল করে দিলো...'
রেগে গিয়ে বললাম, দিলো তো দিলো, তাতে কি অঙ্ক বদলে যাবে?
কাক বলল, 'যেতেই পারে। ধরো তুমি একজন সাধারণ মানুষ, ধরো তোমার বাড়িতে এবার মাইনের টাকায় সব পাঁচশো আর হাজার টাকা এসেছে, ধরো তুমি রাত এগারটা থেকে এটিএম এ লাইন দিয়ে একটা-দুটোর বেশি একশো টাকা তুলতে পারলে না, ধরো তোমার পৌঁছনোর আগেই এটিএম মেশিন বসে গেল, ধরো কাল তোমার বাজারের টাকা নেই, ধরো তুমি বেড়াতে গেছো আর সঙ্গে পাঁচশো আর হাজার টাকার নোটই আছে, ধরো তোমার মেয়ের বিয়ে...' - কাক তো সমানে ধরো এই ধরো ওই বলেই যেতে লাগল।
আমি শেষে বিরক্ত হয়ে বললাম, তাতেই বা কি?
কাক বলল, 'এও বুঝলে না!'
বললাম, না।
কাক বলল, 'তোমার যখন খুব দরকার তখন দেখবে পাঁচশো টাকা নিয়ে কেউ তোমাকে দুশো, আড়াইশো, তিনশো, চারশো টাকা দিচ্ছে আর তুমিও প্রয়োজনে তাইই নিয়ে নিচ্ছ। তাহলে দুশো দুগুণে পাঁচশো হল কিনা বল? দুশো এক্কে পাঁচশো হলেই বা ঠেকাচ্ছে কে?'
এই বলে পেন্সিলটা ঠুকতে ঠুকতে বলল, 'বিরক্ত কোরো না তো, কালো টাকা আর সাদা টাকার হিসেব মেলাতে দাও। হাতে একদম সময় নেই মাত্র বাহাত্তর ঘন্টা।'
আমার তো ততক্ষণে অঙ্কটঙ্ক সব মাথার মধ্যে গুলিয়ে গেছে।
রেগে গিয়ে বললাম, ধুত, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।
কাক বলল, 'এ আবার না বোঝার কী আছে? ধরো তোমার কাছে অনেক কালো টাকা আছে। সে আর কি তুমি দেশে রাখবে? বিদেশের ব্যাঙ্কে, সোনায়, শেয়ারে খাটিয়ে রাখবে। তুমি যদি মাঝারি মানের কালো টাকা রাখো বালিশে আর কমোডে, তাহলে ওই বালিশেই মাথা দিয়ে আর ওই কমোডেই ইয়ে করে বাকি জীবনটা কাটাতে হবে। আর তুমি যদি সাধারণ মানুষ হও আর তোমার যদি কালো টাকা না থাকে তাহলে তো আরওই কেলেঙ্কারি। এমন তো নয় যে গত দু-এক দিনও এটিএম থেকে শুধু একশো টাকার নোট বেরিয়েছে তাহলে এই যে এবার দুদিন ব্যাঙ্ক বন্ধ এটিএম বন্ধ ঠেলা সামলাও।'
আমি বললাম, নাহয় পেটে পাঁচশ-হাজার টাকা বেঁধে বাহাত্তর ঘন্টা কষ্ট করা গেল, দেশ থেকে কালো টাকা আর জাল টাকা তো কমবে?
কাক বলল, 'সে বলা আরও কঠিন। সে একমাত্র বলতে পারে আমাদের মোদী দাদা।'
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কিরকম?
কাক বলল, 'প্রশ্ন হচ্ছে যাদের ভোটে জিতে সরকার ক্ষমতায় এলো, তাদের কালো টাকা গেলো কোথায়? সেটা স্কুপের আগে বদলালো না পরে? কারণ নতুন পাঁচশো-দুহাজার টাকা তো ছাপানো হয়ে গেছে ঘোষণার আগেই। তারপরেও প্রশ্ন হচ্ছে, এক হাজারের বদলে দু হাজার টাকা করা হল কেন? টাকার অঙ্কটা যত বেশি হবে ততোই যারা জাল টাকার কারবার করে তাদের পক্ষেও সুবিধা আর যারা কালো টাকার লেনদেন করে তাদের পক্ষেও।'
আমার আরওই সব গুলিয়ে গেল। কাককে আবার প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলাম তো কাকটা ভারী রেগে গিয়ে বলল, 'বড় যে বকবক করেই যাচ্ছ, আমার বুঝি সময়ের দাম নেই? সময় ভারী মাগগিগণ্ডা এখন আর সব আমি খুচরোয় নিচ্ছি আগামী বাহাত্তর ঘন্টা।'
আমি দুহাতে চাপড়ে দেখলাম জন্মদিনে পাওয়া একটা পাঁচশো আর একটা হাজার টাকা ছাড়া আর কিচ্ছু পকেটে নেই।

কী আর করি ওই দুটো হাতে নিয়ে মোবাইল তাক করে কাক্কেশ্বরের সঙ্গে সেল্ফি তুলতে গেলাম। কিন্তু ছবিটা ক্লিক করার আগেই সে 'কী সব্বোনাশ কী সব্বোনাশ সব হিসেব-বেহিসেব ফেসবুকে আপলোড করে দেবে রে, কী কেলেঙ্কারি' এই বলতে বলতে উড়ে গেল।