উচ্ছেদ ঘটে, ঘটেই থাকে। বাস্তবে। গল্পে
উপন্যাসে। মানুষের উচ্ছেদ। ভিটেমাটির উচ্ছেদপর্ব। এর পেছনে থাকে রাজনীতি, সমাজ এবং
সর্বোপরি রাষ্ট্র।
এইসব কিছুই লিখছিলাম না। যদিও এরসঙ্গে
এইসবও ওতপ্রোত।
আমি দেখছিলাম ঐতিহ্যের উচ্ছেদ, বইয়ের পাতার
উচ্ছেদ।
একদিন আমাদের আগের বাড়ির দোতলার একটা বারান্দাকে
মৃদু হাওয়ায় ভেঙে ভেঙে পড়তে দেখেছিলাম।ছবিতে দেখলাম দুশো বছরের পুরোনো গাছ কীভাবে মানুষের
আঘাতে আঘাতে ভেঙে পড়ে।
এইসব এখনকার কথা, আগে একটু পুরোনো কথা
বলি। কারণ 'কলেজ স্ট্রিট' বাঁচাও জমায়েতে অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি, ছবি তুলছি দেখে
সঞ্চালনা করছিল যে মেয়েটি - বন্দনা আর আরও একজন আমায় কিছু বলতে বলছিল। বলিনি। কিন্তু
কেন গেছি জানতে চাওয়ায় বললাম, বই, কলেজ স্ট্রিট এসবের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ বহুদিনের।
সেই গল্প একটু করি।
প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার ইচ্ছে ছিল অনেকদিনের।
কিন্তু জুওলজি অনার্সের পরীক্ষায় সফল হইনি। সেই প্রথম ওই কলেজে ঢোকা। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে
উঠতে ভারী ভালো লেগেছিল। দ্বিতীয়বার গিয়েছিলাম এক প্রবল বৃষ্টির দিনে এক হাঁটুর ওপরে
জল ঠেলে একটা সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিতে। নাহ, সে চাকরিও হয়নি আমার। কিন্তু প্রেসিডেন্সির
প্রতি একটা সম্ভ্রম মেশানো ভালোলাগা রয়েই গেছে আমার পড়ুয়া মনে।
রামমোহনের হস্টেল 'সাধনা সরকার'-এ থাকার
সময় বেরোনোর দুটো পাস ছিল - 'হাতিবাগান পাস' আর 'কলেজস্ট্রিট পাস'। পাঁচজন একসঙ্গে
না হলে কলেজই যেতে দিত না তো অন্য কোথাও। হাতিবাগান পাস-এ মেয়ের অভাব হত না। যদি দৈবাৎ
পড়ার বই কেনার জন্য কলেজ স্ট্রিট পাস-এ চারজনকে পাওয়া যেত তবে তো আমার পোয়া বারো। বই
কেনার টাকা আমার কাছে থাকত না। মানে বাড়তি কোনও টাকাই। তাতেই বা কি? যাওয়াটাই তো আনন্দ।
এই আনন্দটা যারা ভীষণ স্বাধীন একটা কলেজ জীবন কাটাচ্ছে তারা কিছুতেই বুঝবে না হেদুয়ার
থেকে বাসে উঠে কলেজ স্ট্রিটে নেমে বইপত্রের মধ্যে দিয়ে হাঁটাটাই কত মজার কতটা স্বাধীনতার।
আর তাই বছর কুড়ি পরে হস্টেলের কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে যখন আবার দেখা করার কথা ওঠে, আমি
বলি, চল কলেজ স্ট্রিট পাস, কফি হাউসেই যাই। কে বলে কফি হাউসের আড্ডাটা আর নেই? আমরা
দিয়ে এলাম তো।
এরপরও বহুবার কলেজ স্ট্রিটে এসেছি। আমার
এক বন্ধু থাকত মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে, তার সঙ্গে আড্ডা দিতে। তবে বই কেনা এবং কফিহাউসে
আসা সেটা সবচেয়ে বেশি যে ভদ্রলোকের সঙ্গে আমি গত আঠেরো বছর একসঙ্গে আছি এবং বছর কুড়ি
ধরে চিনি। এবং মেয়ের সঙ্গেও। তার পাঠ্যের বা তার বাইরের কোনও বই কিনতে। আমার পছন্দ
চিকেন স্যান্ডুইচ। মেয়ের চিকেন অমলেট আর কোল্ড কফি উইথ ক্রিম। তাঁর কালো কফির সঙ্গে
যাহোক কিছু হলেই হল। প্যারামাউন্টের ডাব সরবত আমার ফেভারিট।
কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথ থেকে আমার নিজের
শেষ কেনা কয়েক বছর আগে দুটো বাঁধানো ইন্দ্রজাল কমিকস। দোকান থেকে অবশ্য তার পরেও কিনেছি।
পাছে ঠকে যাই তাই বই আমি কিনি কম, বায়না করি বেশি। আর তাই অবিকল ছোটবেলার মতো দেখতে
বিভূতি রচনাবলী এসে যায়। পড়া হয়নি বলে মানিক গ্রন্থাবলী বা দুষ্প্রাপ্য সিরিজ। বইয়ের
গল্পের তো শেষ হয় না। হয়তো ছোটবেলায় বাবাও যখন কলকাতা থেকে ফেরার সময় একেকবার বিভূতি
রচনাবলীর এক একটা খণ্ড নিয়ে ফিরত আর আমরা দুজনে অপুর মতো অপেক্ষা করে থাকতাম তারও কেনার
ঠিকানা হয়ত এই কলেজ স্ট্রিটই ছিল। বাবার সঙ্গে নিশ্চয় কখনও এসেছি কিন্তু সে স্মৃতি
নেই আর। কিন্তু ন্যাশনাল লাইব্রেরী কী কলেজ স্ট্রিটের গল্প বাবার কাছেই শোনা।
আমার একার কলেজ স্ট্রিট ভ্রমণ খুব বেশিদিনের
নয়। 'অবলা বসুর ভ্রমণকথা' প্রকাশ উপলক্ষে 'পরশপাথর' প্রকাশনার অরিন্দমদার সঙ্গে যোগাযোগ
পরবর্তী সময় থেকে। অরিন্দমদার ছোট্ট অফিসটা 'সিগনেট প্রেস'-এর গা ঘেঁষে ঢুকে যাওয়া
একটা অন্ধকার গলির একেবারে অন্দরে। তবে কফি হাউসের খুব কাছেই। কতদিন ওখান থেকে বেরিয়ে
একা একা কফি নিয়ে বসে থেকেছি সেখানে। তারপর 'আমাদিগের ভ্রমণ বৃত্তান্ত' প্রকাশের জন্য
আর্মহার্স্ট স্ট্রিট পোস্টাফিসের কাছে 'গাঙচিল'-এর পুরোনো ঠিকানায়। সেখান থেকে বেরিয়ে
হাঁটতে হাঁটতে কলেজ স্ট্রিট মোড়ের কাছে এসে রাস্তার ডানদিকে একটা গলিতে ঢুকে মাটির
ভাঁড়ে চা খেয়ে বেরিয়ে বাস ধরা। একসময় ওই গলিতেই আরেকটু এগিয়ে একটি ক্লাস নাইন-টেনের
ছাত্রীকে বায়োলজি পড়াতে আসতাম। হ্যাঁ, সেইসময়টাতেও একা এসেছি বটে কলেজ স্ট্রিটে। এটা
বেশ কয়েকবছর আগের কথা। আর তারপরে এতদিনবাদে ইংরেজিতে এম এ পড়ার সময় বইয়ের সন্ধানে।
আর্মহার্স্ট স্ট্রিট থেকে কলেজ স্ট্রিট যেতে
রাস্তার ধারের গন্ধগুলো কেমন বদলে বদলে যায়। কার্ডের দোকানের গন্ধ, ছাপাখানার গন্ধ,
ফলের দোকানের গন্ধ শেষ হয় পুরোনো বইয়ের গন্ধে। নতুন ছাতা আর শাড়ির গন্ধ তো আছে বটেই
তবে তা দোকানের বাইরে পাওয়া যায় কিনা সে খেয়াল পড়ছে না। আবার আরেকটা রাস্তা দিয়েও অনেক
সময় কলেজ স্ট্রিটে ঢুকি - কলেজ স্কোয়ারে নেমে সোজা হাঁটতে হাঁটতে দিস্তে কাগজের দোকানগুলো
পেরিয়ে ডানহাতে বড় দোকান আর বাঁ হাতে ছোট দোকানগুলোকে দুপাশে রেখে বাঁয়ে সংস্কৃত কলেজ আর হিন্দু স্কুল ডাইনে কফি হাউস পেরিয়ে
যে রাস্তাটা সোজা ধাক্কা খায় প্রেসিডেন্সি কলেজের গায়ে। যে পথে গতকাল শেষ বিকেলে পৌঁছালাম
'কলেজ স্ট্রিট বাঁচাও' পথসভায়।
অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা জড়ো হয়েছিল প্রেসিডেন্সির
ভেঙে যাওয়া গেটের বিপরীত ফুটপাথে। হাতে লেখা বেশ কিছু পোস্টারের সামনে বসে আছে কয়েকজন, দাঁড়িয়েও কেউ কেউ। পথচলতি মানুষও কিছুক্ষণ থমকে শুনে যাচ্ছেন দু-চার কথা। হাতে মাইক নিয়ে
বলছে ওরাই - আমাদের ছেলেমেয়েরা। ওপাশে গেটের সামনে পুলিশের গাড়ি। গেটের এপারে-ওপারে
পুলিশ। রাস্তার এই ফুটপাথেও আরেকটা পুলিশের গাড়ি। ভাবছিলাম আজও ক্ষমতাসীনেরা প্রেসিডেন্সির
ছাত্রছাত্রীদের কতটা ভয় পায়! যদিও সময়টা খুব খারাপ। এই আকালে স্বপ্ন দেখার মানুষজনের
সংখ্যা ক্রমশ: কমছে। তাই প্রেসি ও অন্যান্য বেশ কিছু কলেজ মিলিয়েও প্রাক্তন-বর্তমান
ছাত্রছাত্রী সংখ্যা বেশ কমই। তবু কিচ্ছু না এর থেকে কিছু ভালো। প্রেসিডেন্সির ভেতরের
অবস্থার কথা টুকরোটাকরা কিছু জেনেছিলাম ফেসবুকেরই বিভিন্ন জনের সৌজন্যে নানা সময়ে।
চলতি মিডিয়ার ওপর ভরসা লাগেনা। আরোই লাগেনা, এই জগতটাকে খানিক ভেতর থেকে দেখেছি বলেই।
প্রেসিডেন্সির এক লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে সামান্য ফোনালাপের সূত্রে লাইব্রেরীর বর্তমান
হালও জেনেছি। তাই উন্নয়নের নামে প্রেসিডেন্সির অন্দরে কী চলছে সেই চিত্রগুলো আমায় আশ্চর্য
করল না। অনুরাধা লোহিয়া এবং তাঁর সহচরদের ওপরে এদের ক্ষোভ খুবই সঙ্গত। কারণ উন্নয়নের
নামে হাত পড়ছে ঐতিহ্যে। রাতের অন্ধকারে পাচার হয়ে যাচ্ছে দুষ্প্রাপ্য জিনিসপত্র। সস্তার
রঙচঙ দিয়ে দেখানো হচ্ছে উন্নয়ন। যা এখন এই রাজ্যেরই একটি বিধি। যারাই এর বিরোধিতা করছে
তাদেরই মুখ বন্ধ করা হচ্ছে যেন তেন প্রকারেণ। প্রায় চোদ্দ-পনেরোটা গাছ ইতিমধ্যে কাটা
হয়ে গেছে। দুশো বছরের প্রাচীন বটগাছটির গোড়া পরিস্কার হচ্ছে দেখলাম পুলিশি পাহারায়।
পুরোনো চেনা গেটের জায়গায় আপাতত বোধহয় অ্যাসবেস্টস। পাশের দোকান কিছু বোধহয় রাতারাতি উচ্ছেদ হয়েছে,
কিছু বাকি। উচ্ছেদ হওয়া মানুষগুলোকে নিয়ে চিন্তার কথা তাদের রুটি-রুজি এসব নিয়ে তো
ছেলেমেয়েগুলো বলল। বলল উচ্ছেদ হওয়া গাছেদের কথাও।
শরীরটা ভালো নেই। ঘুম পাচ্ছিল। আর আধ ঘুমন্ত
অবস্থায় কেউ কোনদিনও বিপ্লব করেনি। অতএব চিরকালের মতোই আমি শুনি, শুনে যাই, ভাবি। ভাবছিলাম
উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া বইয়েদের কথা। হাতে মোবাইল একটা থাকায় কিছু ছবিও তুলি। সেইসব ভাবনারই
কিছু কথা লিখে ফেললাম আজ সকালে। দুপুরে ওদের একটা মিছিল আছে বেলা তিনটে প্রেসিডেন্সির
সামনে।