Wednesday, September 30, 2015

জীবন-মরণের সীমানা ছাড়ায়ে

ছোট থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীত আমার পরম বন্ধু। কবে থেকে যে গল্পের বইয়ের মতো গীতবিতান পড়তাম মনেও পড়ে না। উচ্চারণ স্পষ্ট হওয়ার আগেই 'দেবতোতো' বিশ্বাসের গান শুনি। আমার চিরকালীন প্রিয় দেবব্রত, সুচিত্রা মিত্র এবং অবশ্যই আমার মায়ের গান। মা নিজেও একসময় সুচিত্রা মিত্রের ছাত্রী ছিলেন। আমার যেটুকু যা গান শেখা সবটাই মায়ের কাছে। ছেলেবেলা থেকেই দুঃখে-সুখে আমার আশ্রয় রবীন্দ্রসঙ্গীত। একেবারেই যাকে বলে রাজদ্বারে-শ্মশানে চ...। মায়ের গানের কথা লিখতে গেলে তো মহাভারত হয়ে যাবে। একবার মনে আছে, মা দোতলায় গান শেখাচ্ছে, আমি সিঁড়ির একদম নীচে দাঁড়িয়ে আছি। শুনে শুনে তখনই তুলে ফেললাম, আমার বড় প্রিয় গান - 'নিবিড় ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রুবতারা, মন রে মোর পাথারে হোস নে দিশেহারা'। আহা শেষের লাইনগুলো কী অপূর্ব - 'রাখিও বল জীবনে রাখিও চির আশা, শোভন এই ভূবনে রাখিও ভালোবাসা।' ভাগ্যিস আমার এমন একটা মা যে আমাকে রবীন্দ্রনাথকে উপলব্ধি করতেও শিখিয়েছে। নাহলে বাঁচতাম কী করে?

আমাদের বিয়েতে কোনো অনুষ্ঠান হয়নি। কেবল আশীষদা আর আমি গান গেয়েছিলাম আর ঝুমলাদিদি আর আমার এক বন্ধু সারু নেচেছিল। আমার খুব ভালো লেগেছিল এই অংশটা। আশীষদার গলা ভারী চমৎকার।

কালান্তরে থাকতে সি পি আই-এর নেতৃস্থানীয় কারোর এক স্মরণসভায় গান গাইতে হবে। অফিসে কল্যাণদা যথারীতি চেঁচিয়ে যাচ্ছেন কে গান করবে? কেউ একটা গান জানে না কী আশ্চর্য! আমি অনেকক্ষণ চুপ। ভাবছিলাম কেউ যদি হাত তোলে। কিন্তু কেউ আর হ্যাঁ বলে না। অগত্যা বললাম, আর কেউ না গাইলে এ অভাগা আছে। 'আছে দুঃখ আছে মৃত্যু' গেয়েছিলাম। প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে মনে আছে। আমার আবার অমাইক গলা কী না। উতরে গেছিল আর কী। শুধু মায়ের কাছে ছাড়া কারোর কাছে শিখিনি এতে লোকজন একটু আশ্চর্যই হয়েছিল। এইজন্য আমি চিরকাল বাথরুমে গাই। যদিও বাথরুমে গাওয়ারও রিস্ক আছে। বিষ্ণুপুরে হস্টেলে থাকতে একতলার সব ঘর, রান্নাঘর পেরিয়ে বাথরুমে বসে রাত্তিরে যদি একটু শান্তিতে গলা ছেড়েছি কী ব্যস, থামা থামা। একমাত্র শ্বশুরবাড়িতে তিনতলার ছাদে গান করলে একতলায় নামলে টুনুমা বলত, বেশ গাইছিলি।

তবে যে গানের কথা মাঝে মাঝেই মনে পড়ে তা হল বাবার স্মরণসভায় ইরাবতীর গাওয়া গান। ইরাবতীর গলা ভারী মিস্টি। তার ওপর গানদুটোও খুব অদ্ভুত বেছেছিল। প্রথম গানটা গেয়েছিল, 'ছিন্ন শিকল পায়ে দিয়ে', আর তারপরে 'যারে নিজে তুমি ভাসিয়েছিলে'। বাবার মৃত্যুর পর সেই প্রথম চোখ দিয়ে জল পড়েছিল আমার। পরে আবারও ওদের বাড়িতে গিয়ে গানদুটো শুনেছি, অন্য গান ছাড়াও। যতবারই শুনি ওর মুখে, ততোবারই চোখে জল আসে আমার।

ইরাবতী আশীষদা আর ঝুমলাদিদির মেয়ে, অমিতাভ কাকা মানে কবি অমিতাভ দাশগুপ্তের নাতনী।

No comments:

Post a Comment