Thursday, June 30, 2016

স্টেশনের কাকিমা

স্টেশনের কাকিমা মারা গেছেন, এইমাত্র খবর পেলাম। স্টেশনের কাকিমা আমার আত্মীয় সম্পর্কে কাকিমা নন। কিন্তু কাকিমা বলতে চিরকাল ওই একটি মুখই মনে ভেসে ওঠে।

রূপনারায়ণপুরের ছোট্ট নির্জন স্টেশনটার থেকে সিঁড়ি বেয়ে উঠে সামনেই সবুজ চওড়া চত্বর পেরিয়ে সার দিয়ে স্টেশনের ছোট্ট ছোট্ট কোয়ার্টারগুলো। হয়ত এটা ৩৫ বছর আগের স্মৃতি আমার কিম্বা আরও বেশি। একেবারে স্মৃতি নেই থেকেই শুরু করা ভালো বোধহয়।

মা আর দাদার চিকেন পক্স হয়েছিল পরপর। সেইসময়ে একমাস ওদের বাড়িতেই থাকতাম। তখন আমি কত ছোট তা মা বলতে পারবে। দু-তিন বছর হবে হয়ত।

কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে একটু ডানহাতে একটা কাঠচাঁপা ফুলের গাছ ছিল। গাছের তলা থেকে ফুল কুড়াতে খুব ভালোলাগত। সকালবেলায় উঠে গোবর কুড়িয়ে আনত কাকিমা। সেই দৃশ্য আবছা আবছা মনে আছে আমার। আমিও ঘুরতাম সঙ্গে সঙ্গে। আমি নাকি উঁ, উঁ করে গোবরের তাল দেখাতাম।
আমি চাটনি খেতে খুব ভালোবাসতাম। ব্রাহ্মণ বাড়ি, ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপার ছিল। আমি নাকি একদিন চাটনির বাটিতে হাত ডুবিয়ে খাচ্ছিলাম। মা বকতেই, কাকিমার প্রবল আপত্তি, ও যা করছে করুক, ওতে কিছু হবে না। ওই বাড়িতে সর্বত্র আমার অগাধ গতি আর দোর্দণ্ড প্রতাপ। ওখান থেকেই সকড়ি কথাটা শিখে বাড়িতে খুব বলতাম।

বাবার প্রথমবার হার্ট অ্যাটাক হল, আমি ক্লাস টুতে পড়ি, দাদা থ্রি। মা তো বাবার খাবার নিয়ে চিত্তরঞ্জন হসপিটালে চলে যেত। আমরা দুই ভাই-বোনে গুটি গুটি পায়ে স্টেশনের কাকার বাড়ি। তখনও কাকিমার পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াতাম।

মৌদিদির পাত্র দেখতে আসার কথা মনে পড়ে। মৌদিদির গান প্র্যাকটিশ হারমোনিয়ামের রিড টিপে। গানগুলোও মুখস্ত ছিল অনেকদিন। যে ঘরে মৌদিদি প্র্যাকটিশ করত, সেই ঘরের দেওয়ালে বেশ কয়েকজনের ছবি বড় ফ্রেমে ঝোলানো ছিল। একজোড়া আলতা মাখা পায়ের ছবিও। সেটা দেখে আমার ভয় করত খুব। ভয় করত ওই কাঠচাঁপা গাছটার থেকে একটু এগিয়ে একটা ছোট শিবমন্দির ছিল ঝোপঝাড়ের মধ্যে সেই জায়গাটাকে। কেমন একটা অদ্ভুত লাগত ওখানে, ভয় আর কৌতূহল মেশানো অনুভূতি। তাও মাঝে মাঝেই ওখানে যেতাম। একেকদিন সন্ধেবেলায় কাকিমার কাছে বকুনিও খেয়েছি। কে একবার ওখান থেকে টেনে নিয়ে এসেছিল।

মৌদিদির বিয়ের কথা মনে আছে। পেটুক আমির খাওয়ার কথাই মনে পড়ে যায়। লাল রঙের দই খুব খেয়েছিলাম, মানে অল্পবয়সে যেমন খাওয়া যায়। সেই মৌদিদির স্বামীও আর নেই, সেও গতবছর রূপনারায়ণপুরে গিয়ে জানতে পারলাম।

উত্তম দাদা স্নেহ করত খুব। আর গৌতম দাদা অত বড় নয় বলেই বোধহয় আমার বেশি প্রিয় ছিল।
বাবা আর স্টেশনের কাকা রূপনগরে একসঙ্গে জমি কিনেছিল, পাশাপাশি বাড়ি করবে বলে। শেষপর্যন্ত বাড়ি করাটা আর হয়নি আমাদের ভাই-বোন দুজনের আপত্তিতে। কেবল বাবার পাঁচিল ধরে ধরে আমি অনেক বড় বয়সে মায়ের সাহায্যে সাইকেল শিখেছিলাম। কাকার রিটায়ারমেন্টের পর ওনারা রূপনগরের বাড়িতে চলে যান। ওই বাড়িতে বরং আমি কম গেছি। ততোদিনে বড় হয়ে গেছি অনেকটাই।

গতবছর ওই যে হঠাৎ করে গেলাম, আজ মনে হল ভাগ্যিস গিয়েছিলাম। কাকিমার কাছে শেষবার আদরটুকু খেয়ে এলাম। এত বড় আমাকে সেই ছোটবেলার মতোই জড়িয়ে ধরে আদর করল। একা একা গিয়েছি বলে কাকা রাগ করছিল। কাকিমা আড়াল করল। নিজেই গিয়ে দোকান থেকে খাবার কিনে আনল।


কাকিমা চলে গেল। আমার একটুকরো অবোধ ছেলেবেলা চলে গেল ওই সঙ্গে।

No comments:

Post a Comment