Sunday, June 26, 2016

একটি সত্যিকারের মানুষের ইতিকথা অথবা কয়েক ঘন্টার কাহিনি -১

কাহিনির শুরুটা হয়েছিল একতলায়। পুরোনো বাড়ির একটা ঘরে মানানসই পুরোনো বড় হাতলওলা চেয়ারে বসে। অনেকেই ওনার ইন্টারভিউ নিয়েছেন শুনলাম। এটা নিতান্তই সাধারণ কথোপকথন। নাহ্‌, কাজের ঠেলায় সব কথায় কান দিয়েছি, বা কান দিলেও মন দিয়েছি এমন বলব না, তবে কিছু কিছু শব্দ-অক্ষর-বর্ণমালা তো গেঁথে যায় মনে ও মগজে।

কলিংবেলে দরজা খুলে দিয়েছিলেন লম্বা সুদর্শন পিতৃতুল্য ব্যক্তিটিই সাতাত্তর বছরের তরুণ অশোক কুমার রায়।

বললেন, ওই যে চেয়ারটায় বসে আছেন, ওইটাও আমার করা। এই বাড়ি, আর যা কিছু দেখছেন সবই। ওই যে কারো কাছ থেকে পাওয়া, আমি কিছুই পাইনি।

জানলেন আমার গবেষণার বিষয়। বেশ মন দিয়েই শুনলেন। ওরই ফাঁকে পাশে ফাঁকা খাট দেখালেন, বললেন, এখানে কারা থাকে জানেন? প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা ছাত্রছাত্রীরা। এখানেই থাকে, খায়। ওরাই যখন যা পারে ফুটিয়ে দেয় দুটো ডাল-ভাত, আলুসেদ্ধ, ওরাও খায়, আমিও তাই খাই। অনেকসময় পড়ার খরচও দিই। এখনি আসবে দেখুন, মুসলিম মেয়েটি, এই প্রথম জেনারেশন পড়াশোনা করছে, বাঁশি বাজায় খুব ভাল। রবীন্দ্রভারতীতে বি মিউজ করছে, আমিই ভর্তি করিয়ে দিয়েছি। তবে বেশ চালাক-চতুর, এরমধ্যেই সংখ্যালঘু স্কলারশিপ এসব অ্যাপ্লাই করে ফেলেছে (এখানে মনে হয় একটু অন্যমনস্ক ছিলাম, ডিটেলস ভুলে গেছি)। ওরই আমাকে দেখার কথা, আর আমিই ওকে দেখছি। এই তো কাল সকালে আমাকে টিফিন দিয়ে যাবে কামালগাজি, কোন এক গুরুর কাছে, আমার খাওয়া-দাওয়া, কে জানে! তবে দেখুন, ও যদি এমন কিছু করত যে আমার মনে হত সময় নষ্ট করছে, আমি নিশ্চয় বলতাম। ও তো নিজের কেরিয়ার বিল্ড করছে। একদিন অনেক ওপরে উঠবে, নাম হবে ওর।

প্রশ্ন করি, আপনার খবর পায় কী করে?

বললেন, পায়। হয়ত একজন গিয়ে তার গ্রামের অন্যদের বলে। তাছাড়া একেবারেই আলাদা জায়গা থেকেও আসে। সবাই বেশ দুঃস্থ। কারো বাবা চাষা, কেউ ছুতোর মিস্ত্রীর ছেলে-মেয়ে। অধিকাংশই ফার্স্ট জেনারেশন লেখাপড়া করছে। কিন্তু করছে তো আগ্রহ নিয়ে।

তারপর আবার নিজের কথায় ফিরে আসেন।

খুব ছোটবেলায় মা মারা গিয়েছিল। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা সেই যে সরে দাঁড়ান আর কখনওই ছেলে-পুলের কোন দায়িত্ব সেভাবে নেননি। অথচ বাবা যথেষ্ট সম্ভ্রান্ত, সচ্ছ্বল ব্যক্তি ছিলেন। জীবনের একটা বড় সময়ই বেশ স্যুটেড-বুটেড অবস্থায় কাটিয়েছেন সুলেখক, সম্পাদক, গবেষক, নৃতত্ত্ববিদ, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রট এমন নানান পেশা ও নেশায় সেইসময়ের পরিচিত মানুষ নৃপেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী। কাকা স্বনামধন্য শিবনারায়ণ রায়। দাদু ছিলেন ঊনবিংশ শতকের নামী প্রবন্ধকার ও জীবনীকার মন্মথনাথ ঘোষ। বড় হয়েছেন মামাবাড়িতে। তারপর দেওঘর রামকৃষ্ণ মিশনে পড়েছেন। পরে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। আর্থ কোয়েক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে বিদেশে পড়াশোনা করেছেন। চাকরি শুরু করেছিলেন লারসন অ্যান্ড টুবরোয়। ওনার একটি নতুন ভাবনা সম্বলিত পেপার ভারতে স্বীকৃতি না পাওয়ায় বাবার পরামর্শে ইউনাইটেড নেশনস-এ পাঠান। তাঁরা সাগ্রহে সেটি গ্রহণ করে এবং ওনাকে চলে আসতে বলে। উচ্চপদে চাকরি সূত্রে ঘুরেছেন বহু দেশ-বিদেশ।

মামারবাড়ির খাটে শুয়েছি, তাদের বালিশ মাথায় দিয়েছি, তাদের থালায় খেয়েছি। স্বচ্ছল পরিবারে যত্নে-আদরে বড় হয়েছি। মা-কে সেভাবে না পেলেও মামীমা সেই অভাব বুঝতে দেননি। দাদু ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে বলেছিলেন। আমাদের বাড়ির সবাই আর্টসের ছাত্র। আমাকে বললেন, করে খেতে হবে তো। লেখালেখি করবি, ওটা সবসময় থাকবে, আগে পেটের ব্যবস্থা কর। লেখালেখিটা কখনও ছাড়িনি বুঝলেন। দাদু উইলে লিখে গিয়েছিলেন, আমাদের যতদিন ইচ্ছে আমরা ও বাড়িতে থাকব, খাব। দাদা তো ষাট বছর বয়সে সল্টলেকে ফ্ল্যাট কিনে বিয়ে করে ওবাড়ি ছাড়ল। আমি তো সেই কুড়ি বছর থেকেই বাইরে বাইরে কাটিয়েছি। একটা কিছুও নিয়ে আসিনি ওখান থেকে।

তো সেই দাদার বিয়ের গল্পও শোনালেন।

স্ত্রী মারা গেছেন এগার বছর হল। নিজের বিয়ের সূত্রেও দু-একটা মজার কথা বলেছিলেন পরে। ছেলে সরকারি চাকরি করেন। কলকাতায় আলাদা ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছেন। চাকরি সূত্রে ছেলে আর তার বউ দুজনেই আলাদা থাকে্ন, নাতি মানুষ হচ্ছে তার দিদিমার কাছে। উইকেন্ডে কলকাতার ফ্ল্যাটে থাকেন তাঁরা। বছরে বিশেষ কয়েকটা দিন এখানে আসেন।

এই সূত্রেই জেনে যাই ওনার ছেলে আর আমি প্রায় এক বয়সী। অনেকক্ষণ থেকেই সুযোগটা খুঁজছিলাম। এবার বলেই ফেলি, আমাকে আর আপনি করে বলবেন না।

অজস্র ছেলেমেয়ে প্রতি বছর তাঁর পরামর্শে, সাহায্যে নানা ডিগ্রীধারী হয়ে চলে যাচ্ছে, ভুলে যাচ্ছে তাঁকে। আবার আসছে নতুন দল। একটাই কথা, কারোর থেকে অর্থ সাহায্য নয়। একটি দুটি গল্প বললেন। একবার কোথায় এক সভায় গেছেন। সেখানে হঠাৎ করে তাঁর এক পুরোনো পি এইচ ডি কারিনীর সঙ্গে দেখা। সে বলল, স্যার আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখিনি, এ আমার অপরাধ। রবিবার আপনি থাকবেন? আমি যাব। আপনার সব দায়িত্ব আমার। তারপর ম্লান হেসে যোগ করলেন সে আর আসেনি কোনদিনই। আরেকজন, বেশ পরিচিত নাম। তাঁর সহায়তায় পি এইচ ডি এবং অন্যান্য কাজ করেছেন। কিন্তু কোনও বই-ই দেননি। অবশ্য এটা অধিকাংশের ক্ষেত্রেই হয়। ভদ্রমহিলার মৃত্যুর পর তাঁরই স্মৃতিতে আয়োজিত একটি বক্তৃতা সভায় প্রথমে আপত্তি করেও তারপর বক্তব্য রাখেন। বিষয় অন্যকিছু ছিল। সভাশেষে ভদ্রমহিলার প্রসঙ্গে জানান, ওঁর কথা আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। তারপর আমার দিকে ফিরে ছেলেমানুষের মতো বললেন, বলুন থাকবে না? সব কটা বই কিনে নিতে হয়েছিল। তবে ওরা সেদিন হাজার টাকা সাম্মানিক দিয়েছিল। নিলাম। ভাবলাম বই কটার দাম হয়ে গেল।

এইসব বলতে বলতেই বাস্তবে ফিরলেন আবার। বিদেশের চাকরি ছেড়েছুড়ে চলে এলাম। ভাবলাম যা টাকাপয়সা আছে বইপত্তর পড়ে আর ডাল-ভাত আলুসেদ্ধ খেয়ে দিব্যি চলে যাবে। তখন পোস্টাফিসে সুদের হার ছিল চোদ্দ পার্সেন্ট আর এখন আট পার্সেন্ট। কেমন করে চলবে বলুন তো? যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে রোজ। আমি একা। কিন্তু একা তো নই।


সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠি আমরা। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে তখন।

No comments:

Post a Comment