প্রতিবাদ
করার স্বভাবটা আমার খুব ছোটবেলাতেই তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শুরুতেই একটা ঘটনায় এমন
ধাক্কা খেয়েছিলাম যে যার জের আমাকে অনেকদিন বয়ে যেতে হচ্ছে।
তার আগে
একটা কথা বলি। ছোটবেলায় চিত্তরঞ্জনে প্রাইমারী স্কুলে পড়তাম। কিন্তু আমার ইচ্ছের
না থাকলেও হিন্দুস্থান কেবলস হাই স্কুলে ভর্তি হতে হয়েছিল। আর সেখানে শিকার
হয়েছিলাম স্কুল পলিটিক্সের। বাবা সেখানকার একজন ছাত্রদের প্রিয় শিক্ষক ছিলেন।
কিন্তু সহকর্মীদের কদ্দূর ঠিক জানি না। তার জের এসে পড়ত আমার ওপর। লেখাপড়ায় ভালো
হওয়া সত্ত্বেও নম্বরে পিছিয়ে দেওয়া, শারীরিক অসুস্থতা জানা সত্ত্বেও নিয়মিত মানসিক
অত্যাচার করা এই চলতে লাগল বছরের পর বছর। ইতিমধ্যে এপিলেপ্সি, থাইরয়েডের সমস্যা, ব্রেস্ট
টিউমার অপারেশন একের পর এক লেগেই আছে। স্কুলে অসুবিধা হচ্ছিল রোদে দাঁড় করিয়ে
রাখত, তাই বাবা ডাক্তারবাবুকে (ডঃ কল্যাণ চ্যাটার্জি, নিউরোলজিস্ট) দিয়ে
সার্টিফিকেত লিখিয়ে জমা দিয়েছিল। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। ফলে ক্রমশঃ মানসিক
অসুস্থতার শিকার হতে লাগলাম। টেবিলে ঘুঁষি না মারলে কথা বলতে পারতাম না। আর তার
পরেও আমাকে পড়া জানা সত্ত্বেও সহপাঠীদের সামনে অপমান করার জন্য শিক্ষিকারা পড়া
জিজ্ঞাসা করে আমার বলতে পারার আগেই বসিয়ে দিতেন। এদের সত্যি আপনি বলতেও এখন ঘৃণা
করে। এছাড়া লেখাতেও তোতলামি শুরু হল। হাত আটকে যেত লিখতে লিখতে। তবু চলতে লাগল
ক্লাসে, করিডরে, প্রেয়ারে সর্বত্র কোনো না কোনোভাবে হ্যারাস করা। আর এর মধ্যে
প্রধান ছিল হেডমিস্ট্রেস উত্তরা বসু আর তার দক্ষিণ হস্ত গৌরী আচার্য এবং ভূগোলের
শিক্ষিকা অমিতাদি। আশ্চর্য এই যে কোনো সহপাঠীই পাশে দাঁড়ায়নি সেদিন। আজ যখন
ফেসবুকে বন্ধু বলে তখন বড্ড হাসি পায় আমার। রোজ বাড়ি এসে কাঁদতাম আর কী আশ্চর্য তা
সত্ত্বেও বাবা স্কুল বদলানোর কথা একবারও ভাবেনি। কেন? মেয়ে সন্তান বলে?
যে
প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করেছিলাম এবার তা বলি। তখন ক্লাস টেনে পড়তাম। আমাদের স্কুলে
একজন খুব ভালো শিক্ষিকা ছিলেন – অশোকাদি, অশোকা বিশ্বাস, জীবন বিজ্ঞান পড়াতেন। খুব অসুস্থও ছিলেন। নিয়মিত ডায়ালিসিস
করাতে কলকাতায় যেতেন, নেফ্রাইটিস ছিল।
আমার ওপর এই সৎ, প্রতিবাদী, আদর্শবান মানুষটির একটা গভীর প্রভাব আছে। দেখতে তথাকথিত
কিছুই ভালো ছিলেন না। কালো, সামনের দাঁতও
একটু উঁচু। অথচ যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকতাম ওনার হাঁটাচলায়, কথা বলায়। সেইসময় আমাদের নতুন প্রধান শিক্ষিকা এসেছেন
উত্তরাদি। তিনি নিজে বেশ ফাঁকিবাজ ছিলেন। ফলে ফাঁকিবাজ শিক্ষিকারা তাঁর দলে
ভিড়লেন। দুঃখের কথা আমাদের স্কুলে এঁরাই দলে ভারী ছিলেন।
আমাদের
ক্লাস টিচার শোভনাদি ছিলেন একটু পাগল মতো – কষ্ট করে যেদিন ক্লাসে এসে পৌঁছতেন
সেদিন সকালে কী রান্না করলেন, কী দিয়ে ভাত
খেলেন,
ম্যয় মাঝেমধ্যে বরের সঙ্গে টুকরোটাকরা প্রেমালাপ পর্যন্ত
আমাদের রসিয়ে রসিয়ে গল্প করতেন। ভূগোল শিক্ষিকা অমিতাদিকে টিচারস রুম থেকে টেনে
টেনে এনে ক্লাস করানোয় তিনি আমার ওপর বিস্তর চটা ছিলেন, শোধ তুলতেন খাতায়। আর যেসব শিক্ষিকারা উল-কাঁটা নিয়ে বসতেন
তাঁদের ক্লাসে আনে কার সাধ্যি। আরেকজন শিক্ষিকাও সকলেরই খুব প্রিয় ছিলেন – চন্দনাদি। আমি মাঝে মাঝে
পৃথিবীর সবার ওপর অভিমান করে যখন লাস্ট বেঞ্চিতে বসে থাকতাম তখন চন্দনাদিই কৃত্রিম
রাগ দেখিয়ে কিম্বা আদর করে ডেকে সেই মান ভাঙাতেন। অশোকাদি আবার এসব লক্ষ্যই করতেন
না। পড়ানোতেই মসগুল হয়ে থাকতেন। করিডরে যেই ওনার জুতোর চেনা খটখট আওয়াজ উঠত তখনই
পিন ড্রপ সাইলেন্স ক্লাসে।
ঘটনার
শুরুটা এতদিন পরে আর ঠিক মনে নেই। যতদূর মনে পড়ে হেডমিস্ট্রেস উত্তরা বসু আর তার সহযোগী
গৌরী আচার্য অশোকাদির সঙ্গে এমন কিছু ব্যবহার করেছিলেন বা সকলের সামনে এমন কোন
অপমান করেছিলেন যে উনি বলেছিলেন ক্ষমা না চাইলে আর ক্লাস নেবেন না। আমি তখন আমাদের
সেকশনের – ক্লাস টেন ‘এ’-র সকলকে ডেকে বোঝালাম যে চল, আমরাও ক্লাস বয়কট করি – অশোকাদি যতদিন পর্যন্ত না আমাদের ক্লাস নেবেন আমরাও ক্লাস করবনা।
সত্যি বলতে কী আপত্তি উঠল ‘ভালো’ মেয়েদের মধ্যে থেকেই বেশি। তবু শেষপর্যন্ত সকলকে একরকম বোঝাতে
পেরেছিলাম। শুধু তাই নয় ক্লাসের দরজা বন্ধ করে চেয়ার-টেবিল ভেঙ্গেছিলাম সঙ্গীসাথী জুটিয়ে।
যেকটা ভাঙ্গতে পারিনি সেগুলো টানতে টানতে পেছনে নিয়ে গিয়ে জড়ো করেছিলাম। তারপর
দরজা টেনে দিয়ে সবাই মিলে বাইরে। এই ঘটনা কতদিন চলেছিল আজ আর মনে নেই। তবে এটা ছিল
টেস্ট পরীক্ষার ঠিক আগে আগেই। মা বহুবার সাবধান করেছিল – আমার এপিলেপ্সি থাকার জন্য।
কিন্তু আমার মনে হয়েছিল যে এটা আমায় করতেই হবে।
যেদিন
জানলাম আমাদেরই জয় হয়েছে, ক্লাসে ফিরলেন অশোকাদি, আর সেই ক্লাসেই অ্যাটাক হল।
জ্ঞানেই কনভালশন। স্কুল চেয়েছিল সরাসরি বাড়ি পাঠিয়ে বিষয়টার সেইখানেই ইতি টানতে।
কিন্তু অশোকাদির হস্তক্ষেপে তা হয়নি। কনভালশন থামাতে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হল। সেখান থেকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হল।
বাড়িতে আবার শুরু হল। একশো পর্যন্ত গুনেছিলাম ঘাড়ের ওপর মাথার কেঁপে ওঠাটা। তারপরে
দম আটকে ঠাওর হল আমি মারা যাচ্ছি। তাতে একটা অভিজ্ঞতা হল বৈকী – দম আটকানোর শুরুতে যতটা কষ্ট
হয়,
পরের দিকে কিন্তু কষ্টটা কমে আসে, বোধহয় সেন্সটা ভোঁতা হয়ে যায় বলে। যাইহোক মায়ের উপস্থিত
বুদ্ধিতে কাম্পোজ কোনোমতে গিলিয়ে দেওয়ায় সেযাত্রা বেঁচে গেলাম। তারপরে আবার
হাসপাতাল। টেস্ট পরীক্ষা দিতে পারলাম না। আমার সব সহপাঠীরাই দিল, যাদের একজনও আমাকে দেখতে আসেনি অসুস্থ হবার পর।
শুনলাম
আমাকে নাকী থার্ড লিস্টে অ্যালাও করা হয়েছে। বাবাকে বললাম, আমি এবছর মাধ্যমিক দেবনা, আর এই স্কুল থেকেতো দেবইনা, আমাকে অন্য
স্কুলে ভর্তি করে দাও। ক্লাস টেনে নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়া খুব মুখের কথা নয়।
যাইহোক মধ্যশিক্ষা পর্ষদ পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি করে বাবা সেই কাজ করেছিল। তবে সেইসময়ে
চিত্তরঞ্জনের দেশবন্ধু বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মৈত্রেয়ী মজুমদার পাশে
না দাঁড়ালে কিছুতেই হত না। মৈত্রেয়ীদি আমাকে দ্বিতীয় জন্ম দিয়েছেন। যে আমি আজ লড়ে
যাচ্ছি। ইনিও আরেকজন অসাধারণ মানুষ। স্বল্প পরিচয়ে যেটুকু অনুভব করেছি। একবছরের
মধ্যেই ওই স্কুলের শিক্ষিকারা এবং ক্লাসের সহপাঠীরা আমাকে আপন করে নিয়েছিল, যা আগের স্কুলে পাঁচ বছরেও হয়নি। যদিও তখন আর মেশার মতো কোন
মনের অবস্থাই আমার ছিল না।
অসুস্থ
অবস্থায় খোঁজ না নিলেও মাধ্যমিকের ফল বেরোলে পুরোনো স্কুল থেকে নতুন স্কুলে ফোন
গেল আমার রেজাল্ট জানতে। যাক তাদের মুখ রক্ষা করেছিলাম – প্রথম বিভাগের তালিকায় আরেকজন
বাড়িয়ে। কিন্তু এই একবছর এভাবে নষ্ট হওয়ায় এবং বাকী সবার সরে দাঁড়ানোয় আমার কিশোর মনে
যে গভীর ছাপ ফেলেছিল তার থেকে আজো বেরোতে পারিনি।
এই
ঘটনাটা আমি গল্পের আকারে সেইসময় ‘আনন্দমেলা’য় পাঠিয়েছিলাম। বাবার এক বন্ধুই তখন আনন্দমেলার দায়িত্বে ছিলেন।
কিন্তু স্কুলের শিক্ষিকাদের বিরুদ্ধে এমন কাহিনি সত্যি হলেও তিনি নীতিগত (?) দিক থেকেই প্রকাশ করতে রাজী হননি।
অথচ আমার
পরবর্তী জীবনে যখনই কোনো খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে, আমার মাথায় কাজ করেছে যে, কেউ
আমাকে মেরে ফেলতে চাইছে। আর তার থেকেই দীর্ঘ মানসিক অসুস্থতার সূত্রপাত।
আর আজ
যখন সেই সত্য মানুষের সামনে তুলে ধরছি তখন আমার এই লড়াইয়ে যেমন অজস্র মানুষ পাশে
দাঁড়াচ্ছেন, কাছে টেনে নিচ্ছেন। তেমনি কেউ কেউ বিদ্রূপ করে সেই অপরাধীদের মহান
বোঝাতে চাইছেন।
তাদের
নাম কেন দেওয়া হয়েছে এই নিয়েও উঠছে কথা। আসলে মৃত মানুষ কথা বলে না। আর জীবিত
মানুষের কেউ কেউ সত্যি বলতে ঘাবড়ায় না। আমার কী যায় আসে তাদের নাম জানানোয়? বরং
মানুষ জানুক, চিনুক মুখোশের আড়ালে তাদের প্রকৃত মুখ।
আরো আশ্চর্য লাগে যখন নিকটজনেরাও আমার ওপরেই দোষারোপ করে!
আমি বলব।
কলম নামক অস্ত্র আছে আমার হাতে। তা ওরা কেড়ে নিতে পারে নি।
No comments:
Post a Comment