Monday, August 31, 2015

কেচ্ছা-কাহিনি

টাইমস অফ ইন্ডিয়া থেকে কয়েক বছর বেশ কিছু বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হত বিভিন্ন বিষয়ে। তার সব কটাতেই নিয়মিত কলাম লিখতাম আমি। একবার 'উদিতা'-র থেকে একটা ইন্টারভিউ নিতে গেছি। মেয়েটি আই এ এস পরীক্ষায় সফল হয়েছে। ইন্টারভিউয়ের উদ্দেশ্য এটাই আমার জানা ছিল। মেয়েটির মা একজন নামকরা আই এ এস অফিসার। তাঁর দ্বিতীয় স্বামীও তাই। সম্ভবতঃ বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে যতদূর মনে পড়ে। মেয়েটির বাড়িতে একটা বিরাট পিয়ানো ছিল মনে পড়ে। দাদু-দিদার কাছেই মানুষ। তাঁরাই দিয়েছেন, ও বাজাতে খুব ভালোবাসে। অনেক কথা হল। আমি দেখেছি, অন্যদের ক্ষেত্রে কী হয় জানিনা, ইন্টারভিউ নিতে আমার অসম্ভব ভালোলাগে এবং অপরপক্ষও আমার সঙ্গে খুব প্রাণ খুলে কথা বলে, সে যেই হোক না কেন। মেয়েটি আমাকে অনেক কথা বলেছিল, তার ছোটবেলার দুঃখের স্মৃতি, মায়ের কথা, নিজের বাবার প্রতি ঘৃণা, সৎ পিতাকেও অপছন্দ করা। বলতে বলতে শেষে বলেছিল, এসব কথা আপনি প্লিজ লিখবেন না। আমি বলে ফেলেছি। আমি বলেছিলাম, তুমি কিচ্ছু চিন্তা কোরো না, আমি তোমায় কথা দিচ্ছি, এসব কথা লিখব না। পরের দিন আবার ফোন, প্লিজ লিখবেন না কিন্তু। আমি বললাম, তুমি নিশ্চিন্ত থাক এমন কোনো কথা আমি লিখব না যাতে তোমার বা তোমার পরিবারের কোনো অসম্মান হয়।
আসলে আমার কেচ্ছা ব্যাপারটাই ভালোলাগেনা।
আসলে ওর মায়ের গল্পে কোথাও একটা আমার মাকেও খুঁজে পাচ্ছিলাম।
আই এ এস পরীক্ষায় সফল মেয়েটির ইন্টারভিউ জমা দিলাম। অ্যাসিস্টেন্ট এডিটর কল্যাণদা বললেন, এসব কী লিখে আনলি? অদ্ভুত একটা মুখভঙ্গী করে বললেন, ওর বাবা-মার ওইসব ব্যাপারট্যাপার লিখবি তো...। আমি নির্বিকার মুখে সংশোধন করি নিজের বাবা নয়, স্টেপ ফাদার। - কী জানতাম নাতো? তবে ওর বাবা কে? অন্য কেউ হবে - আমার নির্লিপ্ত জবাব। এটা একদম করতে পারিসনি, এতো বড় একটা সুযোগ হারালি। আমি নীরব। যদিও সাক্ষাৎকারে ও কীভাবে পরিশ্রম করে আই এ এস পেয়েছিল তার খুঁটিনাটি যত্ন করেই লেখা ছিল।
হ্যাঁ, সুযোগ হয়তো হারালাম, কারণ টাইমসে পাকা চাকরি আর হয়নি আমার কখনোই। তবে ওইখানে দাঁড়িয়েই ঠিক করলাম এমন একটা লেখা দেব যাতে একটা কথাও বলতে পারবে না।
সেই অর্থে সুযোগ এল। ভাটনগর পুরস্কার পেল আই এস আই থেকে সংঘমিত্রা। তার গবেষণার বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। অতএব আমার ডাক পড়ল 'উদিতা'-র হয়ে সাক্ষাৎকার নেওয়ার। আমি খুব মন দিয়ে ওনার গবেষণাপত্র পড়লাম ইন্টারনেটে। তারপর ঘেঁটে বার করলাম তার লিঙ্কড একটা বিষয়ের ওপর দুজন নোবেল পেয়েছে সেইটা। পড়ে ফেললাম। ইন্টারভিউটা বেশ চমৎকার হল। যখন এডিটোরিয়ালে দিলাম বুঝলাম এর বিন্দুবিসর্গ কারোর মাথায় ঢুকবে না। অতএব কেউ কোনো কথাই বলল না, হুবহু ছাপা হল। কিন্তু পত্রিকাটা হাতে নিয়ে মনে হল না অনেকটা চোনার মধ্যে একফোঁটা দুধের মতোই লেখাটা পত্রিকায় একেবারেই মানাচ্ছে না। বোর হলাম নিজেই।
তবে যে প্রশ্নটার জবাব আমাকে অনেকবার দিতে হয়েছে অর্থাৎ জুওলজির ছাত্রী হয়ে সাংবাদিকতা কেন করি তার একটা জুতসই কারণ হল।
এখন কাগজ খুলেই রোজ বন্ধ করে ফেলি। দেখি কত সাংবাদিক কেচ্ছা লিখে যাচ্ছে, কেচ্ছায় ভরে যাচ্ছে কাগজগুলো। আর রগরগে কেচ্ছা পড়তে পড়তে মানুষ ভুলে যাচ্ছে পেটে ভাত নেই। আসলে এই ভুলিয়ে রাখাটাই তো মিডিয়ার উদ্দেশ্য। বাংলাদেশের ব্লগারদের মুসলিম ধর্মান্ধরা মারে বলে তার একটা বাজার আছে, হিন্দুর হাতে হিন্দু মরলে মাঝের পাতার তলায় এক কলামের ছোট্ট খবর হয়, না দিলেই নয় গোছের। বাজারে খাবে না যে সেই খুনটা সেলিব্রিটি মা মেয়েকে মারার মতো অথবা কোন ব্যাঙ্ক ম্যানেজার যেন তার প্রেমিকা আর তার মেয়ের দেহ টুকরো টুকরো করে নদীতে ফেলছিল সেইসব মুখরোচক খুনের মতো।

বাজারে খুনও তো মুখরোচক হতে হয়।

No comments:

Post a Comment