প্রথমবার
কাশী গিয়ে বিশ্বনাথের মন্দিরে আমি ঢুকিনি। ছোটবেলার কথা মনে নেই, বড় হয়ে প্রথমবার
পুরী গিয়ে জগন্নাথের মন্দিরেও যাইনি। ঈশ্বর মানিনা এই মনোভাবটা তীব্রভাবে থাকায়। ভ্রমণকাহিনি
লেখার পাশাপাশি যখন ক্রমশ ভারতীয় স্থাপত্য, ভাস্কর্য, ঐতিহ্য, শিল্পকলা ইত্যাদি
বিষয়ে আমার মতো করে আগ্রহী হয়ে উঠলাম তখন ব্যক্তি আমি কী মানি বা মানি না সেটা
নিয়ে তেমন করে আর মাথা ঘামাইনি। তারপর যখন রমাসুন্দরী, লক্ষ্মীমণিদের লেখা পড়তে
শুরু করলাম তখন মনে হল সত্যিকারের সংস্কারবিহীন এবং ভ্রামণিক বোধহয় এমন মন না
থাকলে হওয়া যায় না। এঁরা সকলেই কম বেশি কষ্ট করে তীর্থে এসেছেন, অথচ তীর্থ শব্দটাই
কোথাও নেই। সেই সময়ে, যে সময়ে বাঙালি মেয়েরা মূলতঃ তীর্থ করতেই ঘর ছেড়ে বেরোতো। সেই
সময়ে, যে সময়ে বাংলা ভ্রমণসাহিত্যে তীর্থভ্রমণ ছিল একটি আলাদা ধারা।
বিশ্বনাথ
মন্দিরে গিয়ে কী অনায়াসে বাঙালি ঘরের বধূ রমাসুন্দরী বলতে পারেন, ‘মন্দিরের মধ্যে আছে, কেবল
প্রস্তর’। প্রয়াগে গিয়ে মাথা মুড়াতে বলায় বিধবা লক্ষ্মীমণি প্রবল
রাগ দেখিয়ে চলে আসতে পারেন অথবা স্বর্ণকুমারী তীব্র ঠাট্টা করতে পারেন। গিরিবালা
দেবী মন্দিরে শিবলিঙ্গের রঙ বদল হচ্ছে দেখে সেই সময়ে তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেন,
যেখানে এখন ফেসবুকে দেখি, এই শিবলিঙ্গ দিনের তিন সময়ে তিন রঙে বদলায়, দেখামাত্র
লাইক দিন...। পাণ্ডারা ব্যবসা করলেও ভালো গাইড হয় একথা কবেই বলে গেছেন গিরীন্দ্রমোহিনী।
পুজো না
দিয়ে মন্দিরে ঢোকা যায় কী যায় না এ বিষয়ে আমার কোন পরিস্কার ধারনা ছিল না। তাই
বিশ্বনাথ মন্দির দেখার জন্য দ্বিতীয়বারে পুজোর ফুলটুল কিনেই ঢুকেছিলাম। যেহেতু
ফেলুদা জ্ঞানবাপীতে গিয়েছিল, আমাকে লেখাটা লিখতে হলে ওখানে যেতেই হত। ফেলুদা পুজো
দিয়েছিল কিনা তা অবশ্য জানা নেই। তবে লালমোহনবাবু দিলে আশ্চর্য হব না।
প্রথমবার
জগন্নাথ মন্দিরে ঢুকে এসব নানা ভাবনা মাথায় ঘুরছিল।
কলিঙ্গ স্থাপত্যের
রীতি অনুযায়ী ওড়িশার মন্দিরগুলির চারটি অংশ - ভোগমণ্ডপ, নাটমন্দির, জগমোহন ও দেউল।
কোণার্কের মন্দিরের ক্ষেত্রে এই নিয়ম পুরোপুরি মানা হয়নি। নাটমন্দির নেই। দেউল ও জগমোহন
মিলিয়ে একটা ইউনিট হিসেবে তৈরি হয়েছিল। এখন আমরা কোণার্কে যে মন্দিরটি দেখতে পাই সেটি
মন্দিরের জগমোহন ও ভোগমণ্ডপ অংশ। মূল মন্দির বা রেখ-দেউল বহু শতাব্দী আগেই ধ্বংস হয়ে
গেছে।জগন্নাথ মন্দির কিন্তু কলিঙ্গ স্থাপত্যরীতি মেনে তৈরি।
মন্দিরের পশ্চিম থেকে পূবে যথাক্রমে দেউল, জগমোহন, নাটমন্দির ও ভোগ মণ্ডপ।
আসলে কেন জানি মন্দিরের
রেখ-দেউলের দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে কোণার্কের মন্দিরের না দেখতে পাওয়া রেখ-দেউলের
একটা আন্দাজ করতে চাইছিলাম। ১৮২৫ সালে এস্টারলিং-এর বর্ণনায় কোণার্কের রেখ-দেউলের
ভগ্নাবশেষের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৮৩৭ সালে জেমস ফার্গুসনের হাতে আঁকা ছবিতে রেখ-দেউলের
একটা অংশ দেখা যায় যার উচ্চতা ছিল আন্দাজ ১৪০-১৫০ ফুট।এটা ছবিতে দেখা অংশের উচ্চতা
না মূল উচ্চতার একটা আন্দাজ তা আমার কাছে খুব একটা পরিস্কার নয়। জগন্নাথ মন্দিরের রেখ-দেউলের
উচ্চতা প্রায় ২১৬ ফুট। ভূবনেশ্বরের অন্যান্য বেশ কয়েকটি মন্দির ঘুরলেও এত বড় দেউল চোখে
পড়েছে বলে এখন মনে পড়ছে না। আর হয়ত তাই এটা দেখে কোণার্কের কথা মনে হয়েছে আমার। জগন্নাথ
মন্দিরের দেউলে বেশ কিছু মূর্তি আছে। যার মধ্যে বড় মূর্তির চেয়ে প্যানেলের মধ্যে ছোট
মূর্তির সংখ্যা বেশি। ভিড়ভাট্টা আর চড়া রোদ থাকায় খুব খুঁটিয়ে দেখা হয়নি এবারে। কিছু
কিছু ভাস্কর্যেও কোণার্কের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। কিন্তু অনেক মোটা দাগের। সম্ভবতঃ উভয়
মন্দির সমসাময়িক অথবা কোণার্ক কিছুটা পুরোনো। ভোগ মণ্ডপের লাল রঙ খুব বিশ্রী লাগে।
তবে অবশ্যই নিত্য পূজা পান এমন ঠাকুর শুদ্ধু মন্দিরের থেকে ঠাকুর বিহীন মন্দিরের ভাস্কর্য
দেখা অনেক সুবিধাজনক। আরও সুবিধাজনক হয় যদি সেই মন্দিরও ততো প্রচারিত না হয়। মানে শেষবার
যখন শুধু কোণার্ক দেখব বলেই সেখানে গিয়েছিলাম, শীতের ছুটিতে সেখানে স্থানীয় লোকজনের
প্রায় কলকাতার চিড়িয়াখানার মতো ভিড় হয়েছিল। এটা আমাদের দেশ বলেই সম্ভব।
মূল মন্দিরে ভিড়ে
ঢোকা সম্ভব হয়নি। আমার আগ্রহ ছিল সূর্য মন্দিরটায় ঢোকা। কোণার্কের মূল সূর্যমূর্তিটি
কালাপাহাড়ের আক্রমণের ভয়ে পুরীর মন্দিরে সরিয়ে নিয়ে আসা হয় এমন গল্প কোথাও আমিও পড়েছি।
নারায়ণ সান্যালের বইতে এই তথ্য পুরাতত্ত্ব বিভাগের একটি বইতে আছে বলে জানিয়েছেন। যদিও
সেখানেও রয়েছে মন্দিরের মূর্তির পেছনে কষ্টি পাথরের একটি ভাস্কর্যের নিদর্শন আছে, কিন্তু
তা সূর্যমূর্তি বলে সনাক্ত করা যায়নি। মূর্তিটিকে খুব কাছ থেকে টর্চ দিয়ে নারায়ণবাবু
নিজেও পর্যবেক্ষণ করে সেভাবে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি। আমারও যে ভালো করে দেখার
ইচ্ছে ছিল না এমনটা নয়, কিন্তু পূজারিদের আচরণে ‘মন্দিরের মধ্যে আছে, কেবল প্রস্তর’ ভেবেই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসতে হল।
No comments:
Post a Comment