Tuesday, March 15, 2016

লিখতে লিখতে লিখতে লিখতে...

সেই কবে ছোট্টবেলায় মা হাতে ডায়েরি আর পেন দিয়ে বলেছিল, লেখো। সেই থেকে যা পাই হাতের কাছে তাতেই লিখি। যা মনে আসে তাই লিখি। ডায়েরি, খাতা, সাদা বা রুলটানা কাগজ, খবরের কাগজ বা ছেঁড়া কাগজের টুকরো, মেয়ের স্কুলের পুরোনো খাতার শেষের দিকে খালি পৃষ্ঠা, পুরোনো হলদে হয়ে যাওয়া ছোটো রাইটিং প্যাডের পাতা, দোকান থেকে কিনে আনা ঝকঝকে রাইটিং প্যাড, ডেস্কটপে ওয়ার্ড ফাইলে, ল্যাপটপে, নেটবুকে, ফোনের নোটে। নাহ্‌, কিচ্ছু বাদ দিই না। আমার সর্বগ্রাসী কলম, কলম না পাওয়া গেলে পেন্সিল আর এছাড়া কী বোর্ড কেউ রেহাই পায় না আমার হাত থেকে। লিখতে লিখতে খাতা ফুরায়, ডায়েরি ফুরায়, নেটবুক দেহ রাখে, তবু আমি থামি না। যেমন, এখন যে নেটবুকে লিখি তার বিস্তর ঝামেলা আছে। প্রথমতঃ কারসরটা যখন ইচ্ছে, যেখানে ইচ্ছে চলে যায়। মানে আমি লিখতে গিয়ে 'আ' পড়ল ঠিক জায়গায় তো একলাফে পাঁচলাইন উঠে গিয়ে কোন একটা শব্দের ফাঁকে গিয়ে 'মি' দিব্বি বসে পড়ল। এবার বোঝো ঠ্যালা। 'আমি' ভেঙে গেলে জোড়া দেওয়া কি সহজ কর্ম? এরজন্য বার তিনেক তাকে দোকানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে তার কী-বোর্ড বারদুয়েক, মাউস প্যাড আর স্ক্রিন একবার বদল করা হয়েছে। মানে অনেকটা সেই পুরোনো ছাতার গল্পের মতো। এছাড়াও কারসর যাতে সরে না যায় সেইজন্য বিশেষ সফটওয়ার ইনস্টল করা হয়েছে। এরপরেও সে লাফায় বটে, কিন্তু কম। মানে সহ্য করে নেওয়া যায়। এর পাশাপাশি আরেকটা গভীর সমস্যা হল, লেখার বেশ কিছুটা নিজেই মাঝে মাঝে সিলেক্ট করে ডিলিট করে দেয় মুহূর্তের মধ্যে, যেন ওর ইচ্ছেমতো আমায় লিখতে হবে। কী ভাগ্যিস 'আন ডু' অপশন আছে। ওর সাজেশন নিতে আমার ভারী বয়েই গেছে। ওই সমস্যা খানিক মিটে যাওয়ার পর তার নতুন বায়না হয়েছে কথায় কথায় হ্যাং করে যাওয়া। মানে গভীর ভাব নিয়ে তাকে খুলে বসলাম তো লিখল মাইক্রোসফট ওয়ার্ড নট রেসপন্ডিং। এবার লাও ঠেলা। রেসপন্ড করতে করতে গোটাকতক কাজ, বাথরুমে যাওয়া, রান্নাঘরে একবার ঘুরে আসা সব হয়ে গেল। ভাব তো ডানা মেলে উড়ে চলে গেল, এবার যাও ধরে আনো তাকে। তাই হাতের কাছে মোবাইল ভরসা। নোটে লিখেই যাই দিন-রাত যখন যা মনে আসে, আধখানা কবিতা থেকে বাসে করে যেতে যেতে পথের দেখা। এর কিন্তু কোন ব্যাকআপ নেই। আসলে আমার অধিকাংশ লেখার কোন ব্যাকআপ নেই। মাঝে মাঝেই পুরোনো লেখার খোঁজে হারিয়ে যাওয়া খাতার সন্ধান করতে করতে বাড়ি মাথায় করি। কিছু পাই, কিছু পাইনা। এরা আমার অধিকাংশ লেখার মতোই অপ্রকাশিত। একমাত্র এক খাতা কবিতা আছে, বিভিন্ন ডায়েরির পাতা থেকে টুকে রাখা। যদিও সেও আমার নিজের কাজ নয়। আমার ধৈর্যই নেই অত।

নিজের উদ্যোগে লেখা প্রকাশ করাও আমার হয়ে ওঠে না। হতে পারে স্রেফ আলসেমী। ওই একত্রিত কবিতার খাতাটা দেখার পর বাবা বেশ কিছু কবিতা বিভিন্ন ছোট পত্রিকায় পাঠিয়েছিল। সেসব প্রকাশিত হয়েছিল। আর খুব ছোটবেলায় একটা কবিতা স্থানীয় পত্রিকায় বাবা দিয়েছিল, বেরিয়েছিল। কিছু কবিতা প্রকাশের পর কিছু গল্প দিলাম। সেও বেরোলো, কিন্তু ইতিমধ্যে আমার উৎসাহ আবার ফুরালো। আসলে ছোটবেলায় যাই লিখি, বাবা-মা বলত, আরও ভালো লেখ, তারপরে ভাবা যাবে। আমার আর আমার বন্ধু সারুর দুজনেরই ছিল একই মুশকিল। ওর বাবা লেখেন আর আমার মা-বাবা উভয়েই। ফলে বাড়িতেই পরীক্ষক। দুজনের আলাপ হয়েছিল একটা গল্প-কবিতার আসরে। মানে বাবা-মায়েরা মঞ্চে আর আমরা দুজনে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। তারপরে চিঠিতে দুজনেই দুজনকে এই ব্যক্তিগত ক্ষোভ জানাতাম। ওর বাবা পাস করায় না তো আমার বাবা-মা। যাইহোক ভাবতে ভাবতে বড় হয়ে গেলাম, কিন্তু লেখা ছাড়তে পারিনি। কলেজে হস্টেলে থাকতে বালিশের তলায় টর্চ থাকত। নাহ্‌, বাথরুম যাওয়ার জন্য নয়, রাতে উঠে বই পড়া বা লেখার জন্য। কখন ঘুমের মধ্যে লেখা বিড়বিড় করবে, ঘুম ভেঙে সঙ্গে সঙ্গে না লিখলে ভাব পালিয়ে যাবে না বুঝি? বড় হওয়ার পর লেখা প্রকাশ নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাইনি। কিছুদিন কাগজে চিঠিপত্র লিখলাম। তারপর সে পর্বও চুকে গেল। তবে এই সূত্রেই হয়ত সাংবাদিকতায় চলে এলাম। সেও আরেক যুদ্ধের গল্প। কিন্তু ভ্রমণ-এ চাকরি করার সময় রোজ মনে হত, দূর কী সব রাবিশ লিখছি। শুধু সময় নষ্ট। এরকম বিশ্রী মনোভাব নিয়ে কতদিন আর কাজ করা যায়, করলাম না। কিন্তু তারপরেও লিখে যাই। লিখতে লিখতেই আমাদের ছুটি হল। তারপরে মাথায় ঢুকলো পুরোনো ভ্রমণকাহিনি। বাবার পরেই যিনি লেখা প্রকাশের জন্য ঠেলা দিলেন, তিনি অবলা বসু। ভদ্রমহিলা আমাকে এত জ্বালিয়েছেন যে বলার নয়। অতএব তাঁর এবং আমার প্রথম বই একসঙ্গে বেরোলো। এবার এনাকে দেখে বাকিরাও তাগাদা দিতে শুরু করল। এদিকে ফেসবুকের পাতায় এত বকবক করছি দেখে বন্ধুরা ব্লগ খুলতে বলল। ফলে ওদিকে আমাদের ছুটি, এদিকে যা-ইচ্ছে-তাই  আর তারসঙ্গে আমাদিগের ভ্রমণ বৃত্তান্ত আমার কোমর গেল, পিঠ গেল, ইদানীং ঘাড়ও যাচ্ছে, মাথা তো কবেই গেছে...তবু লিখে যেতেই থাকছি...।

লিখতে লিখতে লিখতে লিখতে... নাহ্‌, আমার লেখক হওয়া হল না। না কবিতা না প্রবন্ধ না গল্প  না মেয়ের স্কুলের রচনা সব মিলিয়ে একে তো ঘোর জগাখিচুড়ি হয়ে বসে আছি, তার ওপরে লেখক হওয়ার জন্য কলম ছাড়া আর যা যা গুণ থাকা দরকার তা উত্তরাধিকার সূত্রেই আমি পাইনি। নাহ্‌, বোধহয় সেই অর্থে অনেক লিখেও আমার মা-ও লেখক নন। মায়ের প্রথম গল্প সংকলনের ভূমিকায় দেবেশ মামা যাই লিখুক, মায়ের গান প্রতুল মুখোপাধ্যায় যতই সুর দিন, মায়ের প্রথম উপন্যাস অশোক জাতক বেরোনোর বহু বহু বছর পর কারো কাছে এমন বই বাংলা সাহিত্যে কমই আছে, আমি পড়ে নিজে কিনে বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে বিলিয়েছিলাম এমন পাঠক প্রশংসা শুনে যতই হতবাক হয়ে যাই, আমি কেন মায়ের পরিচয় আগে দিইনি বলে পরশপাথর-এর অরিন্দমদার কাছে যতই বকুনি খাই, আমি জানি আমার মা লেখক হতে পারেননি। কারণ লেখক হওয়ার জন্য ভালো লেখা ছাড়া আর যা যা গুণ থাকে তার কোনটাই মায়ের নেই। এও জানি, প্রায় ষাটের ঘরে পৌঁছে বছর দশেক ধরে একক চেষ্টায় যখন নিঃশব্দে দান্তের ডিভাইন কমেডির বাংলা গদ্যে অনুবাদ করে যাচ্ছেন তখন স্বাভাবিকতই অন্য লেখা কমে আসায় লেখক মহলে একটা অপপ্রচার ঘটেছিল যে মা নাকি লেখা ছেড়ে দিয়েছেন। কে বা কারা এই কাজ করেছেন আমার জানা নেই, তবে যাঁরা জানেন যে মা লেখা ছাড়েননি তো বটেই বরং দুরূহ একটি কাজ করছেন বাংলা সাহিত্যে তাঁরাও এর কোন বিরোধিতা করেননি। মা বলেছেন, আমি আর কী করতে পারি বল, লিখে যাওয়া ছাড়া। হ্যাঁ মা শুধু লিখেই গেছেন। সেই ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি উনুনে মাছের ঝোল চাপিয়ে প্রথম উপন্যাস লেখা বা চোখের জল ফেলতে ফেলতে সেই উনুনেই নিজের লেখা জ্বালিয়ে দেওয়া। এখনও লিখেই যান। সত্তর পেরিয়ে গেছে বেশ কয়েকবছর। কোমর ভেঙেছে, ডান হাত ভেঙেছে, হাই সুগার প্রেশার, স্কিনের অসুখ, অস্টিওপোরেসিস। কিন্তু মা লিখেই যান। ডান হাত ভাঙলে বাঁ-হাতে, চোখের ছানি কাটার পর্ব চলাকালীন একেকবার অন্য চোখটা দিয়ে দেখে। সত্যি বলতে কী মোবাইলে লেখার আইডিয়াটা মায়ের থেকেই নেওয়া। দান্তেকে কিছুদিন তুলে রেখে আবার একটা উপন্যাস শেষ করেছে্ন। গল্পও বেশ কয়েকটা এদিকে ওদিকে আবার বেরিয়েছে। ফাল্গুনীদার ওয়েব পত্রিকায় কবিতাও দিয়েছেন।

লিখতে লিখতে লিখতে লিখতে... আমি বুঝেছি আমার দ্বারাও মায়ের মতো লেখক হওয়া হবে না। তবু লিখতেই থাকব। ইদানীং হাতের গাঁটে গাঁটে ব্যথা হচ্ছে। ভয় করে, লেখা বন্ধ হয়ে যাবে না তো কোনদিন। ভীষণ ভয় করে আজকাল যখন সকালে উঠলে পুরো শরীর আড়ষ্ট হয়ে থাকে। লিখতে পারব তো? এই একটাই ভয় আমার।


কারণ শেষ পর্যন্তই আমি লিখে যেতে চাই। মানে লিখতে লিখতে লিখতে লিখতে...

No comments:

Post a Comment