বিছানায় শুয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ। ওই আর কী খই ভাজা।
ছোট
থেকেই বছরভর জীবনে আমার একটাই উৎসব - বইমেলা। তার জন্যই দিন গোণা। নতুন জামার চেয়েও
আদরণীয় নতুন বই। শেষদিনে বিজয়া দশমীর চেয়েও মনখারাপ। উনিশ বছর আগে ওই শেষদিনটাতেই
বই পড়ুয়া দুজনে একসঙ্গে চলাটাও শুরু করেছিলাম। যদিও আমাদের ততোধিক বই পড়ুয়া কন্যার
মন্তব্য,
বেশ কয়েকটা বিয়ে তো দেখলাম ইদানীংকালে, তোমাদের ছবি দেখলে মনেই হয় না যে তোমরা আদৌ বিয়ে করেছিলে।
কী সব কাগজে সইটই করছিলে, তা বইমেলায়
গিয়েই তো করতে পারতে সেটা! বলি, তুই তো ছিলিস না, এখন হলে তাই-ই করতাম। তা এবার সেই শেষদিনেও যেতে পারলাম না।
তবে
বইমেলা যা দেখলাম, যেটুকু দেখলাম
তাতে সর্বত্রই সদ্য ঘটে যাওয়া অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের থুড়ি নোট বদলের দীর্ঘশ্বাস
চোখে পড়ল বেশি করে। শুয়োরের খোঁয়াড়ের কিছুটা উন্নতরূপের ঢাকা দেওয়া ক্ষুদ্র
ক্ষুদ্র স্টলগুলোতে হাঁপিয়ে উঠছিলেন প্রকাশনার লোকজনই। প্রতি বছরের চেনা স্টল
খুঁজে পাচ্ছিলেন না পাঠকেরাও। বিক্রি মার খাচ্ছিল উভয়তই। 'ট্রাভেল ছুটি', 'জল-জঙ্গল'-এ কিছুক্ষণ কাটানোয় বোঝা গেল এই
ছবি। বই সাজাতে গিয়ে র্যাকটাই কিমকর্তব্যবিমূড়ের মতো খসে পড়েছিল সে কথা হাসতে
হাসতে বলছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্মি। এবারে নিজেদের মতো স্টল সাজাতে পারেনি
বলে উর্মি, দেবলীনা সবারই বেশ মনখারাপ ছিল
শুরুতে। তবে শেষবেলায় যখন বইয়ের বাক্স ঘাড়ে নিয়ে সকলের প্রিয় টিনটিনদা ফিরছিল, ফেসবুকে হাসিমুখ ছবিটা দেখে মনে হল, সব ভালো যার শেষ ভালো। মেশিন বিগড়েছিল একদিন 'ফ্যামিলি বুকশপ'-এ। মাসের শেষে মেয়ের পছন্দের বই না নিয়েই ফিরতে হয়েছিল সেদিন। পরে একদিন 'গাংচিল'-এর ওখানেও মেশিন
বিগড়েছে দেখলাম। নোটকাণ্ডে বিক্রি যে মার খাবে সে আশংকা কিছুটা হলেও সত্যি অধীরদার
কথাতেই বুঝতে পারলাম। যদিও নিজের বইয়ের কপি চেয়ে বার দুয়েক বকুনি খেয়েছি। তো কী আর
করি,
বাড়িতে থাকা নিজের বইয়ের একমাত্র কপিটাই বয়ে বয়ে বইমেলায় 'ট্রাভেল রাইটার্স ফোরাম'-এ রতনদাকে দিয়ে এলাম। আরে স্বয়ং রতনলাল বিশ্বাস যখন তাকের মাথায় 'অবলা বসুর ভ্রমণকথা' দেখিয়ে বলেন, তুমি অসাধারণ
কাজ করেছ দময়ন্তী, তখন তো 'আমাদিগের ভ্রমণবৃত্তান্ত' নাচতে নাচতে দিতেই হয়। চেনা নামের মধ্যে বইমেলায় এবার একেবারেই অনুপস্থিত 'স্বর্ণাক্ষর' আর 'পরশপাথর'। 'কালান্তর'-এর স্টলে
দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলে আসাটা সেই চাকরি জীবন থেকেই আমার কেমন জানি অভ্যেস।
বাংলা
বই-পত্রিকার জগতে গোষ্ঠী ব্যাপারটা চিরকালই খুব চালু। এ যাবত একেকটা প্রিন্ট
মিডিয়াকে ঘিরে গোষ্ঠী, কিছু প্রতিষ্ঠিত
প্রকাশনাকে ঘিরে গোষ্ঠী এবং লিটল ম্যাগাজিনের ছোট-বড় নানান গোষ্ঠী ছিল। মূলত:
গোষ্ঠীর লোকজন পরস্পরের বই কেনেন, পিঠ চাপড়ান।
আবার কেউ কেউ পত্রিকার নামে অথবা নিজ গুণেই গোষ্ঠীর বাইরে বৃহত্তর পাঠকের কাছে
পৌঁছে যান। গোষ্ঠী সাহিত্যে এ বছরের নতুন সংযোজন ফেসবুকের বেশ কিছু গ্রুপ ও তাদের
প্রকাশনা। এই সূত্রেই আরও একটি বিষয় যা চোখে পড়ল যে, অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের এই বাজারেও বেশ কিছু সম্পূর্ণ নতুন প্রকাশনা দামী
কাগজ-কভারে ঝকঝকে প্রোডাকশন নিয়ে বাংলার মরে আসা বাজারে নেমেছে। তাহলে কি কলেজ
স্ট্রিট বই মার্কেটের আপাত যে ভগ্ন দশাটা আমরা লেখক-পাঠক দেখতে পাই, যার জন্য প্রাপ্য টাকাটা চাইতেও দোনামোনা করি তার সবটা ঠিক
নয়?
এইসবই
ভাবছিলাম ঝিমোতে ঝিমোতে। আসলে আমাদের মেয়েরা যখন বড় হবে, বাংলা সাহিত্যের জগতটা তখন ঠিক কোথায় পৌঁছাবে, কেমনই বা হবে সেই বাঙালি পাঠক, ভাবছিলাম। ওই যে খই ভাজা।
No comments:
Post a Comment