Tuesday, July 11, 2017

রবীন্দ্রনাথ একলা ভেজেন আমাকে ভেজান


ছোটবেলায় গীতবিতান পড়তাম রোজ গল্পের বইয়ের মতো। প্রায় সব গানই মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। খুব ছোট্ট থেকে রেডিও বা কিছু পরে টেপ রেকর্ডারে যাঁদের গান শুনতাম তারমধ্যে দেবতোতো বিশ্বাস প্রধান। যদিও পরে প্রিয় হয়ে ওঠেন সুচিত্রা মিত্র। আজও আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলে ফিরে ফিরে আসি এই দুজনের কাছে।

গান শিখেছি একমাত্র মায়ের কাছেই। তাও এলোমেলো। অন্য অসুস্থতা বাদ দিলেও সেপটিক টনসিল ছিল বড় বাধা। রেওয়াজের ধৈর্যও সেরকম না। চিরকালই সর্ব ঘটে কাঁঠালি কলা।

সারা বছর তো তাঁকে মনেই পড়ে সুখে-দুঃখে। একসময় ছেলেবেলায় রবি ঠাকুর আর বিভূতিভূষণই ছিলেন প্রিয় বন্ধু, অমলের ঠাকুরদাদার মতো। আর তো কেউ ছিল না আমার অসুখ সারাতে। আজ অবশ্য একেকসময় রবি ঠাকুরও আর পারেন না। তবু তাঁকে মনে পড়ে, বর্ষা এলে আরও মনে পড়ে। রবি ঠাকুর-ছেলেবেলা-বর্ষা-মা সব যেন মিলেমিশে যায়।

তবে আমার এখন আবার সত্যিকারের বন্ধু আছে। যারা অসুখ করলে নার্সিং হোমে হাজির হয়, না পারলে রোজ ফোন করে। এরাই তো আমার স্বজন। এরমধ্যে এক বন্ধু ফোনে বলল, তুমি যে আগে গান গেয়ে পাঠিয়েছিলে তোমার সেই গলা আর কথা বলার গলা আলাদা তাই না? বলি, ওই তো মুশকিল আমার দুটো গলা। আর কোনটাই আমার বলে লোকে বোঝে না। ফোনে কথা বললে ভাবে বুঝি আমার মেয়ে কথা বলছে আর অমায়িক গলায় গান গাইলে তো আরও চিত্তির। এই বলে ভারী দুঃখের কথা শোনাই তাকে।

আমি একটা বিশেষ কারণে মঞ্চে গান গাইতে চাইনা। কিন্তু হস্টেলের বন্ধুরা সেসব শুনবে কেন? দিলো আমার নাম লিখিয়ে অন্য কলেজের ফেস্টের একটা গানের প্রতিযোগিতায়। আমি আবার হারমোনিয়াম বাজাতে পারিনা। খোলা গলায় মাইকের সামনে দাঁড়িয়েই গাইলাম, যেমন গাই সর্বত্র বাথরুম থেকে ছাদ কিম্বা বেডরুম। মাইক ছাপিয়ে অমায়িক গলা বেরোলো। অনেকেই গানের মধ্যেই আক্ষরিক অর্থে আওয়াজ দিল, সুচিত্রা মিত্রকে নকল করছে, সুচিত্রা মিত্রকে নকল করছে। প্রচণ্ড খারাপ লাগল। তারপর থেকে পারতপক্ষে কখনও মঞ্চে গাইতে চাইনা। এখনও ঘর থেকে সারা পাড়ায় যখন গলা শোনা যায়, একাধিকবার ফাংশানে ডাক পেয়েছি। সেদিনটা আর বাড়িতেই থাকিনা তাই। আর ভালোও লাগে না এখন। না চর্চায় ছোটবেলার সেই গলাও নেই, শরীরে দম পাই না, বেশিক্ষণ গাইলে চোয়ালের ব্যথা বেড়ে যায়। অথচ নিজের এই গলাটা এতই প্রিয় আমার যে একাধিক ডাক্তার বারবার বলা সত্ত্বেও টনসিল অপারেশন করিনি। এখন তো বাড়তি ফ্যারেঞ্জাইটিস। সেও অনেকদিন।

প্রথম হোস্টেলে রাতে বাথরুমে গান ধরলে হস্টেল শুদ্ধু মেয়ে কমপ্লেন করত ঘুমাতে দিচ্ছিস না বলে। ঘরে বসে গাইলে তো আরও সর্বনাশ। কিন্তু কলকাতায় পড়তে বন্ধুরা ডেকে ডেকে শুনতো। আজ কুড়ি বছর পর যোগাযোগ হওয়ার পর একটি বন্ধু বলল, শুধুমাত্র গানের জন্য সে আমাকে ভোলেনি। এটা যে কতটা আনন্দের লেগেছিল সে আমিই জানি। আর এক ছিল আমার এক জেঠীশাশুড়ি তিনতলার ছাদে গান গেয়ে একতলায় নেমে এলে সবসময় বলতেন, তুই বড় ভালো গাইছিলিস রে।

শরীর খারাপ হলে আর গাইতে পারি না। তারপর একটু সারলে যেই দেখি গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে আজও বুঝি এইবার সেরে উঠছিই। আর অমনি দেবব্রত বা সুচিত্রার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গেয়ে উঠি অথবা একা একা। সুচিত্রার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগটা আমার এইটুকু মাত্র। আর মা একসময় ছিলেন সুচিত্রা মিত্রের ছাত্রী। একেকদিন গানের ভুত চাপলে একের পর এক গেয়ে যাই আপনমনে।

কী যায় আসে, আমার কন্ঠ থেকে গান যদি কেড়ে নেয় সময়। কী যায় আসে...

আমার হারিয়ে যাওয়া দিন, আর কি খুঁজে পাব তারে, বাদলদিনের আকাশপাড়ে ছায়ায় হল লীন...




No comments:

Post a Comment