Tuesday, February 2, 2016

ওঠো হে

ছোটবেলা থেকেই অদৃশ্য অসুখে ভোগার একটা বাজে স্বভাব আছে আমার। এই বয়সেও তা গেলো না। যা বুঝছি দৃশ্যমান জগতে যতদিন থাকব ততোদিন অদৃশ্য অসুখ আমাকে তাড়া করে বেড়াবে। তাদের নাম আর ওষুধগুলো শুধু বদলে বদলে যাবে। ছোটবেলায় হিস্টিরিয়া-এপিলেপ্সি ছিল আর থাইরয়েডের সমস্যা। কথা জড়িয়ে যেত, মুখ দিয়ে লালা পড়ত, তোতলামি ছিল মুখে আর লিখতে গিয়েও। সেইসময়ে আমার কোনও বন্ধু ছিল না, গাছপালা, আকাশ-মাটি ছাড়া। আমার খুব অসুখ করলেও কেউ কোনওদিন খোঁজ করেনি। অথচ আমাদের সঙ্গে ইলেভেন-টুয়েলভে একটি হ্যান্ডিক্যাপড ছেলে পড়ত, তাকে বন্ধুরা, শিক্ষকেরা খুবই সাহায্য করত। ও ফার্স্ট হত আর আমি সেকেন্ড। স্বাভাবিকভাবে ওকে ভারি হিংসে করতাম। ছোট ছিলাম যে।

সাংবাদিক হওয়ার চেষ্টা কোনওদিন করিনি। বাবা বলেছিল, সাংবাদিকতা আমার দ্বারা হবে না। দেবেশমামাও তাই বলেছিল। সেইজন্যই বোধহয় আমার পেশা আর নেশা হল সাংবাদিকতা এবং লেখালেখি। সাংবাদিকতার বিভিন্ন দিকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালোলাগে ইন্টারভিউ নিতে। আমি খুব অলস সাংবাদিক। সে আর কী করা যাবে। আমাদের ছুটি পাঁচে পড়ল বলে। আর মেয়ের বয়স সতেরো। দুটোকে মানুষ করার চেষ্টা করছি তো একসঙ্গে।

তিনবছর আগে ধরা পড়েছিল ফাইব্রোমায়ালজিয়া, চিকিৎসা করাইনি, সেটা আমারই গাফিলতি। আজ আবার নতুন করে ডায়াগনোসিস হল, চিকিৎসাও শুরু করলাম। মাস ছয়েক আগে বাইপোলার ডিসঅর্ডার ধরা পড়েছে, চিকিৎসা হচ্ছে। এইসবই চলবে বাকি জীবনটা। ভাবছি এসব ডিঙিয়ে এবারে আর কী কী করা যায়। সুগার আর প্রেসারকে নাহয় আব্বুলিশ ধরলাম। ও তো এখন প্রায় সবারই থাকে।

আপাতত নিজেকে কিছুটা উৎসাহ দেওয়া যায় বৈকি। হস্টেলের বন্ধুদের গ্রুপটা ভারি উৎসাহ দেয় আমায়। আগে ওরা জানতোই না, কলেজে পড়ার সময়, এখন বলি। আসলে তখন নিজেকে অসুস্থ বলতে খুব প্রেস্টিজে লাগতো। শুধু রুমমেট একজনকে বলেছিলাম, যার হাতের কাছেই সুইচবোর্ড ছিল, রোজ সকালে আমার জ্বর আসে, পাখা বন্ধ করিস, নাহ্‌ সে একদিনও করেনি। সে অবশ্য আমাদের এই গ্রুপে নেই। খুব ছোটবেলার দু-একজন বন্ধুও সাহস যোগায়। আজকাল বড্ড বন্ধুনির্ভর হয়ে পড়েছি আমি। প্রেস্টিজের বালাইটালাই আর রাখিনা। মেয়ে আর তার বাবাও ওই বন্ধুদের মধ্যেই পড়ে।

তবে শেষপর্যন্ত নিজেকে সবচেয়ে উৎসাহ দিতে হয় নিজেকেই।

ওই যে মা বলেছে, দরজা জানলা খুলে সময়ের ঝুঁটিটা শক্ত মুঠোয় ধর, ওঠো হে

আপাতত একদিন করে বাঁচি। কাল কী হবে কে জানে!
রোজ সকালে ঘুম ভাঙে আর ব্যথায় উঠতে পারি না।
নিজেকে কেবল বলি, ওঠো হে
কাজ করতে বসি আর ওষুধের ঠেলায় আর অসুখের জেরে ক্লান্ত লাগে, ঘুম পায়, মাথা অস্থির হয়ে যায়।
নিজেকে হেঁকে বলি, ওঠো হে

নিজেকে বলি, ওহে ছোটবেলায় তো দিব্যি পারতে একা একাই, তুমি কিন্তু বড্ড বুড়ো হয়ে যাচ্ছ।
নিজেই বলি, বললেই হল, আমার বয়স এখন কমতির দিকে। ফের যদি বুড়ো বুড়ো করবি তো তোর একদিন কী আমার একদিন।
এই না বলে ঝটপট উঠে বসে আমাদের ছুটি-র তথ্য সংযোজন করতে শুরু করি। পত্রিকা বেরোবে যে এই কয়েকদিনের মধ্যেই।
তারপরেও অনেক কাজ। কত কী পেনডিং রয়ে যাচ্ছে।
অতএব, ফের ওই ওঠো হে
আপাতত বেগুন ভাজতে যাই উঠে।


No comments:

Post a Comment