ছেলেবেলার খারাপ অংশগুলো লিখতে
খুব খারাপ লাগে। তবু একেকসময়ে মানুষ বাধ্য হয় লিখতে।
আমার বাবারা সাত বোন দুই ভাই। আরেক
ভাই খুব ছোটবেলায় মারা যায়। পাঁচ বোনের বিয়ে বাবাই দিয়েছিল। ছোটবেলায় দিনের পর দিন
দেখেছি মাকে বঞ্চিত করে বাবা পিসিদের আর ঠাকুমার জন্য করেছে। মায়ের পরনের শাড়ি-শায়াও
জোটেনি। গয়নাগাটি তো দূরের কথা। এরপরেও কলকাতায় কাকার বাড়ি গেলে মায়ের কপালে কাকা-কাকিমার
কাছ থেকে অপমানই জুটত। কাকা-কাকিমা বা কোনো পিসিরাই হাতে করে কোনোদিন আমাদের কিছু দেয়নি,
বরং একটা জমি বাবার নাম থেকে নিজের নামে করে নেওয়ার জন্য একবার মাত্র কাকা আমাদের রূপনারায়ণপুরে
এসেছিল। ছোটপিসির বিয়ের সময় মাকে দেওয়া ঠাকুমার বালা পিসির গয়না গড়াতে দিয়ে দেয়। সেই
বিয়ের সমস্ত খরচ দিয়েছিল আমার বাবা। অথচ বিয়ের সময় মায়ের সস্তা শাড়ি আর শুধু শাঁখা-পলা
পরা হাত আমার বড়লোক পিসিদের হাসি-ঠাট্টার বিষয় হয়ে উঠেছিল। আর পিসির বিয়ের পর বোনের
বিয়ে দিয়ে উদ্ধার হলেন এমনই ঘোষণা করেন কাকা। যিনি একটা পয়সাও খরচ করেছিলেন কী না আমার
সন্দেহ আছে। কারণ বাবার নিজস্ব বইয়ের আলমারি এবং অন্যান্য সমস্ত জিনিস কাকা না বলে
দখল করেছিল বাবা কলকাতা থেকে চলে আসার পরেই। তারপরেও আমার বাবা-মা কিন্তু এদের জন্যে
করেই গেছে।
আমাদের ছোটবেলায় বাবার প্রথমবার
হার্ট অ্যাটাকের সময় মাসি ছাড়া কেউ কিছু করেনি। স্টেশনের কাকারা, বাবার ছাত্র, পরিচিতরাই
পাশে ছিলেন। আমার দীর্ঘ অসুস্থতায় নাহ্, কেউ কোনোদিন কুশলটুকুও জানতে চায়নি। আমাদেরই
সমবয়সী এক পিসির মেয়ের খালি টার্গেট ছিল জানার ও বেশি ভালো রেজাল্ট করল না কী আমরা?
তার মা, মানে সেই পিসি কয়েকমাস আগে ফোনে নিজের নাতির সিবিএসই রেজাল্টের কথা গর্বভরে
আমার মাকে জানিয়ে আমার মেয়ের রেজাল্টের খোঁজ নিচ্ছিল। কী দুঃখের কথা আমার না পড়াশোনা
করা মেয়ে ঢের বেশি নম্বর পেয়েছে। আহা ফোনের ওপারে তার মুখের চেহারা ভেবে আমার বড্ড
হাসি পেয়েছিল সেদিন।
এইতো বাবার মৃত্যুর পরও বড়পিসিকে
খবর দেওয়ায় মাকে ফোনে কী সব যা তা কথা বলল। বাবার মৃত্যুর দিন মৃত বাবার শিয়রের কাছে
বসে ছোটপিসি আমাকে আমাদের প্রেমকাহিনির কথা জিজ্ঞাসা করছিল। না, বাবার মৃত্যুতে আমি
একটুও কাঁদিনি। বরং যারা মানে ওই আত্মীয়েরা নাকি কান্না কাঁদছিল সেদিন তাদের প্রত্যেকের
গলা টিপে দিতে ইচ্ছে করেছিল আমার। এক বা একাধিকজনকে ধমকও দিয়েছিলাম, চুপ, একদম চুপ।
আমি এদের সঙ্গে বাবা বেঁচে থাকাকালীন
ভদ্রতার খাতিরে যতটুকু সম্পর্ক না রাখলেই নয়, রেখেছি। আমার বাড়ির অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ
জানাইনি। আমার পক্ষ থেকে মা, বাবা, দাদা বাদে চিরকাল এসেছে ঝুমলা দিদি, বুবুন দাদারা।
কবি অমিতাভ দাশগুপ্তের ছেলেমেয়ে। হ্যাঁ, ওদের আমি আত্মীয় বলে মনে করি। পার্ট টু পরীক্ষার
আগে বাবার রিটায়ারমেন্টের জন্য হস্টেল ছেড়ে দিই। ঝুমলাদিদির বাড়িতে থেকে পরীক্ষা দিয়েছিলাম।
আমার বিয়ের সময় এদের কাউকে নিমন্ত্রণ
করাতেই আমার তীব্র আপত্তি ছিল, কিন্তু তারপরেও বাবার জন্য মেনে নিতে হয়েছিল। কী ভাগ্যিস
বিয়েতে কোনো উপহার নিইনি আমরা। ওদের দেওয়া জিনিস তো ঘেন্নায় ছুঁতে পারতাম না। বাবা
বেঁচে থাকতে একবার কাকার বাড়িতে নেমন্তন্নে যেতে হয়েছিল, খুব অনিচ্ছার সঙ্গেই গিয়েছিলাম।
একবার খুব অনিচ্ছার সঙ্গে বাধ্য হয়ে প্রায় একমাস আমাকে এক পিসির বাড়িতে থাকার নরক যন্ত্রণা
সহ্য করতে হয়েছিল, সেও বাবার জন্যই।
গতবছর দাদার মেয়ের জন্মদিনে দেখি
কাকা, পিসিরা সব সপরিবারে। আমার এত ঘেন্না করছিল কথা বলতে এমনকী ওদের মুখ দেখতে যে
রাতে বাড়ি ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। মাকে বলেছি আর কোনোদিন ওরা যেখানে উপস্থিত থাকবে
আমায় যেন ডাকা না হয়। ছি, ছি, ছি...আমার মাকে যারা দিনের পর দিন অপমান করেছে তারা আমাদের
বাড়ির অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত। মাকে এত বড় অপমান বোধহয় তারাও করেনি।
ভেবেছিলাম বাবার মৃত্যুর সঙ্গে
ওই আত্মীয়তা ঝাড়েবংশে শেষ হয়েছে। কিন্তু বাড়িতে যখন বাইরে থেকে কেউ এসে বাড়ির লোকের
পছন্দের বিরুদ্ধে গিয়ে দিনের পর দিন অপমান করে বাড়ির লোককেই তখন বাংলা সিরিয়ালের নায়িকাদের
কথা মনে পড়ে আমার। ওই যে যারা ভাইয়ে ভাইয়ে অশান্তি ঘটায়। আসলে আত্মীয় তারাই হয় যারা
বিপদের দিনে, প্রয়োজনের দিনে পাশে দাঁড়ায়। মুখে বড় বড় কথা বললে আর দরকারের সময় অপমান
করলে আর যাইহোক সে আত্মীয় হয় না।
আর মুখে বড় বড় কথা বললেই কেউ খুব
সহৃদয় হয়ে যায় না। একটা গরীব মানুষের পাশে দাঁড়াতে একটু মন লাগে, একটু ভালোবাসা, হোক
না সে অনাত্মীয়। বিপদের দিনেই তো আত্মীয়-অনাত্মীয়, আপন-পর, গরীব-বড়লোক এই তফাতগুলো
ভালো বোঝা যায়।
মানুষকে ঘৃণা করতে খুব খারাপ লাগে
আমার, কিন্তু কিছু কিছু মানুষ নিজেরাই চিরকাল ঘৃণার পাত্র হয়ে ওঠে ঈর্ষা এবং লোভের
থেকে।
মাকে বলেছি তুমি মারা গেলে কেবল
আমার বড়ভাই আনন্দ দাদাকে খবর দেব। আর কাউকে না। দেহ পুড়িয়ে দেব, বেঁচে থাকতে অনেকের
জন্য অনেক করেছ, বাবার মতো দেহদানে দরকার নেই, মরে অন্ততঃ কেউ আর কাটা-ছেঁড়া না করুক।
শ্রাদ্ধ তো বাবার ক্ষেত্রেও করিনি, মায়ের স্মরণসভাটুকুও করার ইচ্ছা নেই। মায়ের সঙ্গে
এবিষয়ে রীতিমতো আলোচনাই হয়েছে আমার। মাকে বলেছি, তুমি আমার মনেই থেকো, পারলে কোনদিন
তোমার জীবনী লিখব। কিন্তু তাতে হাটে এত হাঁড়ি ভাঙবে যে সেটাই মুশকিল।
আত্মীয় বলতেই আমার কেবল স্টেশনের
কাকাদের কথা, টুকুন দাদাদের কথা, ঝুমলাদিদিদের মত কত কত মানুষের কথা মনে পড়ে যায়। ভাগ্যিস,
এরা ছিল, আর ভাগ্যিস এরা কেউ আমার তথাকথিত আত্মীয় নয়।
No comments:
Post a Comment