যেচে
পরের মানে অপরের দায়িত্ব নেওয়া এবং যেচে গালে চড় খাওয়া অনেকটা সমার্থক। অনেকসময়
চড়টা নিলেও খেতে হয় আবার না নিলেও। অন্ততঃ আমার নিজের অভিজ্ঞতাটা একেবারেই তাই।
বর্তমান
-
আমার
ঠিক পরপরই শঙ্করীদির ভাইরাল জ্বর ইত্যাদি হয়েছিল। আমি বারবার ডাক্তার দেখাতে
বলেছিলাম তিনি দেখাবেন না। প্রথম কদিন কিনে খেয়েই চলল। আমার নিজের প্রায় বছরখানেক
ধরে টানা একের পর এক এবং গত কয়েকমাস ধরে প্রায় প্রতিদিন ভুগে যে অবস্থা তাতে খুব
বাধ্য না হলে রান্না করার মতো অবস্থায় নেই। এর আগে হয়েছে, যখন উনি আমাদের বাড়িতে
থাকতেন না, আমার অসুখ করলে মেয়ে আর মেয়ের বাবা মিলে সামলে নিত। এখন উনি কাউকে কাজ
করতেও দেবেন না, আবার সামান্য কিছু করতে বললেই উদয়াস্ত আমাকে মুখ করে যাচ্ছেন।
একবারও মনে পড়ছে না যে উনি মাত্র কয়েকদিন অসুস্থ আর আমার টানা চলছেই। কারণ আমি
মুখে কষ্ট হচ্ছে বলতে পারছি না, তাই ওনার ধারণা আমি দিব্য সুস্থ। উনি সারাদিন এই
করে যাচ্ছেন আর আমি নিজেরই বাড়িতে চোরের মতো দিন কাটাচ্ছি। একবার রান্নার কথা
বলেছিলাম, তো বললেন আমি নাকী অনেক বাসন করি, যেন আমি বাসন মাজতে পারব না। কী যে
জ্বালা, পাছে ম্যালেরিয়া,ডেঙ্গু হয় তাই মায়ের জন্য রাখা বিছানা-মশারিও ছেড়ে
দিয়েছি। তারপরেও গাল খেয়ে বেঁচে আছি।
এখন
প্রায় বাড়ি থেকে পালাতে পারলে বাঁচি গোছের অবস্থা আমার।
অতীত
-
এতো
তাও অল্পের ওপর দিয়ে যাচ্ছে, এর আগে তো দায়িত্ব না নেওয়ার জন্য প্রায় এক
ভদ্রমহিলার আত্মহত্যার চার্জ ঘাড়ে পড়েছিল বা এখনো পড়ে আছে। আমার এক অতি বড়লোক ননদ
ছিলেন যিনি সামনে লক্ষ টাকার হীরের হার দেখাতেন তাঁর মধ্যবিত্ত আত্মীয়স্বজনকে।
শুনেছি ভাইয়ের বউ খুব খারাপ হওয়ায় ভাইয়ের কপালের কথা ভেবে অনেক চোখের জলও নাকী
ফেলেছেন। বাড়িতে আমার থেকেও বেশি দায়িত্ব নিতে হয় অবশ্য আমার এক জা-কে। সম্প্রতি
দায়িত্ব নেওয়ার ক্রমাগত চাপে বেচারি কিছুদিন হল মানসিক অসুস্থই হয়ে পড়েছে। যাইহোক
আমার অনেক সৌভাগ্য যে এই ননদ কখনো আমার বাড়িতে থাকেনি। কারণ ওই জায়ের কাছেই শুনেছি
তাদের বাড়িতে কী কী কান্ড করেছে। সে বছর আমার জায়ের ছেলের মাধ্যমিক ছিল। তারমধ্যে
শ্বশুরবাড়ির সবচেয়ে বড় জেঠিশ্বাশুড়ির এখন-তখন অবস্থা। এই ভদ্রমহিলা অল্পবয়সে যৌথ
সংসারে এসে চিরকাল লাঠি ঘুরিয়ে গেছেন। এমনকী আমার ওই জায়ের ওপর চিরকাল অকথ্য
অত্যাচার করে গেছেন। নিজের সন্তান ছিল না বলে অন্যদের সন্তান সহ্য করতে পারতেন না।
অথচ বাড়ির সকলেই দেখেছি বিস্তর ভক্তিশ্রদ্ধা করত। কারণ এই পরিবারটা যখন বাংলাদেশ
থেকে চলে আসে তখন নাকী তাঁরা স্বামী-স্ত্রীই সব করেছিলেন। কিন্তু এরজন্য তৃতীয় পুরুষ পর্যন্ত সবাই কেন হাতজোড় করে থাকবে
তা আমার মোটা মাথায় ঢোকেনি। আমি ছোট থেকেই মায়ের কাছে শুনেছি মায়ের দাদু ডঃ
বেণীমাধব বড়ুয়ার বাড়িতে পার্টিশনের আগে পরে প্রচুর আশ্রিত ছিল। কিন্তু সেটা খুব
স্বাভাবিক হিসেবেই তখনকার দিনে মনে করা হতো। দৈবক্রমে এদের বড়জেঠুও ছিলেন বেণীমাধব
বড়ুয়ার তেমনই একজন আশ্রিত। এবং তাঁর চাকরিবাকরি করে কলকাতায় থাকা সবই হয়েছিল আমার
মায়ের দাদুর কল্যাণে। একথা তিনি আমাকে নিজের মুখেই বলেছিলেন। তাই ভাবলুম এদের বরং
আমার মায়ের দাদুর প্রতিনিধি হিসেবে আমার ওপরে কিঞ্চিৎ কৃতজ্ঞতা থাকা উচিত। কিন্তু
দেখলাম না কোনদিনই। তবে আমার ওই জা-টা বড্ড বোকা, তাই চিরকাল পড়ে পড়ে মার খেল।
আমাকেও কোনদিন বলেনি, তাহলে আজ ওর এই অবস্থা হতো না। যাইহোক, সেই জেঠিশ্বাশুড়ি তো
এসে পড়লেন শেষ অবস্থায় আমাদের কাছে। মরণাপন্ন রোগী বাড়িতে ওদিকে আমার মেয়ের
অ্যানুয়াল পরীক্ষা চলছে।
এদিকে
তার কয়েকমাস আগে থেকে আমার সেই ননদ প্রতিদিন ফোন করছেন তাঁর দাবী যে স্বামীর
মৃত্যুর পর ছেলে তাঁর ওপর অত্যাচার করছে তাই ভাই তাকে উদ্ধার করুক। প্রায় মাস
তিন-চার ধরে দিনে চার-পাঁচবার কয়েক ঘন্টা করে ফোন চলছে। সে একেবারে থ্রিলার গল্পের
মত। ছেলে সম্পত্তি কেড়ে নিয়েছে, এখন মেরে ফেলতে চায় ইত্যাদি। যতদিন অর্থ ছিল ততদিন
অবশ্য আমাদের বিশেষ খোঁজটোঁজ করতেন না। কলকাতার দুটো ফ্ল্যাট বেচে তার তিনগুণ
সাইজের দুটো ফ্ল্যাট কিনেছিলেন বাঙ্গালোরে, আর বেনারসে নিজেদের বাড়ি। যত দায়িত্ব
যথারীতি আমাদের দুই পরিবারের। তবে এতদিনে আমার ওই জায়ের মাথায় বিন্দুমাত্র বুদ্ধি
খুলেছিল, আমায় বলল, এনে বৃদ্ধাশ্রমে রাখুক, খরচা দিক সে যাইহোক, বাড়িতে রেখো না।
তুমি যেরকম, কিছুদিন পরে তোমাকেই বাড়ি থেকে বার করে দেবে। তাই ছেলেমেয়ের পরীক্ষার
ইত্যাদি বলে আমরা দুজনেই একটা বিষয়ে চুক্তি করলাম যে কিছুতেই বাড়িতে রাখব না,
একদিনের জন্যও না। বাড়ির অন্যদের চোখে দায়িত্ব নিতে না চাওয়ায় খারাপ তখন আমরা হয়েই
গেছি, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ তো মরিয়া হয়েই যায়। তারমধ্যে বাড়িতে একজন মারা
যাচ্ছে, কী ভয়ানক অবস্থা।
বড়
জেঠিমা মারা গেলেন। সেই খবর পেয়ে ওই ননদ নাকী খুব কান্নাকাটি করেছিল, স্বাভাবিক
মায়ের মতো তো। যাইহোক তাঁকে জানানো হোলো যে আমরা কেউ তাঁকে এক দিনের জন্যও বাড়িতে
থাকতে দিতে রাজি নই। পরেরদিন তাঁর বন্ধ ঘর থেকে সিরিয়াস অবস্থায় উদ্ধার করা হয়,
হাসপাতালে মারা যান। এটা তাঁর ছেলের বয়ান। আমরা রাজি হলে হয়তো বেঁচে যেতেন তাই
বুঝলাম আমরা দুজনে। এটা হত্যা না আত্মহত্যা জানিনা, দায়ী কে তাও না? তবে তালিকায়
আমাদের দুই জায়ের নাম আছে তা বুঝেছি।
আর
ওই বড় জেঠিমা তাঁর সম্পত্তির কানাকড়িও শ্বশুরবাড়ির কাউকে দিয়ে যাননি। আমি অবশ্য
চিরকাল শুনে এসেছি আমার মেয়ের বাবা নাকী তাঁর নিজের ছেলের মতো! তা শেষসময়ে সেটা
নিজের চোখেও দেখলাম। আর যে মেয়েটা সারাজীবন মার খেল তার ভাগ্যেও কিছু জুটবে না
সেটা বেচারী সহ্য করতে না পেরে অসুস্থই হয়ে পড়ল এই অসম্মানে। তাঁর পরেও সেই জেঠিমা
নিত্য পুজিত।
বাব্বা
যৌথ পরিবারের খুড়ে খুড়ে নমস্কার।
ভবিষ্যত
-
এখনও
আছেন এক মাসি। তিনি বিয়ে করেননি। নিজের টাকা প্রচুর এবং যথেচ্ছ নয়ছয় করেন। আমার
অসুখের সময় এসে ফোঁস ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে গেলেন আমি তো একাই থাকি, আমাকে
কে দেখে। অথচ যখনি দরকার-অদরকার হয় বউমা আজ থাকব। কী মুশকিল, আমি কি ওনাকে বিয়ে
করে ছেলেপুলে হতে বারণ করেছিলাম? আমাকে লোকে যদি একটু যত্ন-আত্তি করে তারজন্য কম
পরিশ্রম তো করিনি, বিয়ে করেছি খেটেখুটে, মেয়ে হয়েছে। কষ্ট না করলে কেষ্ট পাওয়া
সোজা নাকী?
এনার
শেষসময়ে আমার হাল কী দাঁড়ায়, কতটা দাগী আসামী তাই ভাবি মাঝে মাঝে!
হরি
দিন তো গেল, সন্ধ্যা হল, পার করো আমারে...
No comments:
Post a Comment