রাজনীতি কিছু
বুঝিনা। যা মনে হয় তা লিখি। তাই সব কথা সর্বজনের ভালোলাগবেনা বা পলিটিকালি কারেক্ট
হবেনা সেটাই স্বাভাবিক। ইন্টেলেকচুয়াল নই। একেবারেই সাধারণ মানুষ। যা কিছু লিখি, অভিজ্ঞতা
থেকে যা আহরণ করেছি তার থেকে লিখি। যা কিছু লিখি, যা শিক্ষা পেয়ে বড় হয়েছি তার
থেকেই লিখি।
চিরকাল
দেখে এসেছি মিথ্যাকে মা খুব ঘৃণা করত। আমিও করি। আরও যখন দেখি মিথ্যার ওপর ভিত্তি
করেই যাবতীয় কিছু চলছে তখন যারপরনাই বিরক্ত এবং অসহায় লাগে। আমাদের একমাত্র সন্তান
সেও একটি ডাঁহা সত্যবাদী। আর সেইজন্যই বন্ধুদের কাছে অনেকসময় মিথ্যেবাদী আখ্যা পায়
আর বাড়ি এসে কান্নাকাটি করে। ওকে বলি, এখন মিথ্যে ব্যাপারটাই এত সহজ আর
স্বাভাবিক যে তুই যখন সত্যি বলছিস কেউ সেটা বিশ্বাস করতে পারেনা। তারা ওভাবেই বড়
হয়েছে, ওদের দোষ নেই। তুই যদি সত্যবাদী থাকতে চাস জীবনে অনেক ঘা খেতে হবে, সেভাবেই
মনটাকে তৈরি কর এখন থেকে। একদিন আমাদের দুজনের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল যে, অপ্রিয়
সত্য বলা উচিত না মিথ্যে। এবিষয়ে ও দেখলাম আমার সঙ্গে একমত। অপ্রিয় হলেও সত্য বলব,
মিথ্যে বলব না। আমার মনে হয়, অপ্রিয় বলে আমি যদি কারোর কাছে সত্য গোপন করি আর সে
যদি অন্য কারোর কাছ থেকে সেটা শোনে তাহলে সেটা তার কাছে আরও বেশিই আঘাতের হবে। তাই
অপ্রিয় হলেও সত্য বলা উচিত।
তবে যেমন
আদর্শ নিয়ে বাবা-মা বড় করেছিলেন, তেমন আদর্শ কিছু আর আজ খুঁজে পাইনা, তাই সে
শিক্ষা দিতেও যাইনা। যুগটা স্বার্থপরের, যুগটা আত্মকেন্দ্রিকতার। যদি অন্য কিছু হও
তবে পদে পদে আঘাত খাবে। এইটুকু সাবধান শুধু বারবার করি। এছাড়া আর কী বা করার আছে?
ভালো হতে না বলতে পারি, খারাপ হতেও তো বলতে পারিনা একটা আপাদমস্তক ভালোমানুষকে।
কেবল সাবধানটুকুই করতে পারি যে, অনেক আঘাত খাবি সেইমতো মনকে প্রস্তুত করে রাখ।
কিন্তু তারপরেও সবটুকু পারে না। সেটাই তো স্বাভাবিক। সতেরো বছরে আর কতটুকু বড় হয়
মানুষ? কিন্তু পরিস্থিতি এমনই যে হয়ে যেতে হয়।
নিজের জীবনে একটা জিনিস বুঝেছি, শিক্ষাটা যেদিন ভাত ডাল খাওয়ার মতো জরুরি করা
যাবে, একমাত্র সেদিন কোনও পরিবর্তন সম্ভব। যারা পরিবর্তন বলতে অন্য কিছু বোঝেন এবং
শিক্ষিতদের গাল দেন, আমার তাঁদের কিছু বলার নেই। তাঁরা নিজেরাই শিক্ষিত নন, এবং
সেইজন্য নিজেদের আমজনতার সঙ্গে একাসনে বসিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। আমজনতার সঙ্গে
একাসনে বসা তো খুব ভালো কথা। তবে তাঁদের শিক্ষিত করে একাসনে বসাই ভালো নয় কি? নিম্ন
মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি। বাবা বলতেন, তোদের আর কিছুই দিয়ে যেতে পারলাম না
শিক্ষা ছাড়া। কথাটা একেবারে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। পড়াশোনাটা ইচ্ছেমতো করতে পারিনি
ঠিকই, কিন্তু ভাগ্যিস, শিক্ষাটা
পেয়েছিলাম। এই শিক্ষাটা জরুরি। একটা সময় বাঙালির মধ্যে এই শিক্ষাটাই মূলধন ছিল।
গ্রামের সাধারণ মানুষের ভেতর থেকেই উঠে আসতেন ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ত্বেরা। ঊনবিংশ
শতক নিয়ে পড়াশোনা করতে করতে আমার এ কথাই মনে হয়েছে। প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে নম্র
করে, ভদ্র করে।
নিজে
সরকারি শিক্ষায় বড় হয়ে বুঝেছি সে শিক্ষা অন্তঃসারশূন্য। তাই মেয়ের ক্ষেত্রে
বেসরকারি শিক্ষা মাধ্যমের কাছ থেকে শিক্ষা কেনা ছাড়া অন্য উপায় দেখিনি। আর্থিক
কারণে খুব ছোটবেলায় ওকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে দিতে পারিনি। একটু বড় হওয়ার পর থেকে
খুব সাধারণ মানের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলেই পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গে যে তিনটি বোর্ডের
মাধ্যমে স্কুলশিক্ষা হয় তারমধ্যে সবথেকে কঠিন মনে হয়েছে আই সি এস সি-কে। তুলনায় সি
বি এস সি এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ডের সিলেবাস অনেক কম এবং সহজ। তবে আই সি এস সি
বোর্ডে তুমুল ফাঁকিবাজ ছেলেটিও বাধ্য হয়ে যেটুকু জানে, তা অন্য বোর্ডের খুব মনযোগী
ছাত্রটিও হয়ত জানেনা। হয়ত বলার অর্থ অনেকেই সিলেবাসের বাইরেও প্রচুর পড়াশোনা করে।
সে তো জানবেই। আমার মেয়ের যেমন পড়াশোনা একেবারেই ভালোলাগে না। কিন্তু অধিকতর সহজ
সি বি এস সি বোর্ডে যেতে সে কিছুতেই রাজি হয়নি ইলেভেনে – ওদের নাকি সেক্সপিয়ার নেই।
সেক্সপিয়ার না থাকলে আর ইংরেজি পড়ে লাভ কি? আমাদের সময় ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ডে
নম্বরই উঠত না। সেইসময়ে কলকাতার স্কুলগুলিই মূলতঃ প্রথম দিককার স্থানগুলো দখল করত।
হঠাৎ রাতারাতি যেন চিত্রটা বদলে গেল। মফঃস্বল থেকেই অধিকাংশ ভালো রেজাল্ট এবং ঝুড়ি
ঝুড়ি নম্বর! কিন্তু তারপরে তাদের আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না। আসলে শিক্ষা সবসময়েই
রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সেটা আমাদের কেরালা রাজ্য বা প্রতিবেশি ছোট্ট
দেশ ভুটানকে দেখলে বোঝা যায়।
কিন্তু শিক্ষায় যখন রাজনীতির রঙ লাগে তখন তার চেয়ে
খারাপ আর কিছু হয় না। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গ। আগামী দিনে একথা আরওই বোঝা
যাবে। আর এর শিকার হয় জেনারেশনের পর জেনারেশন সাধারণ মানুষ। তৈরি হয় একটি সম্পূর্ণ
অশিক্ষিত জাতি। এতটাই অশিক্ষিত যে শিক্ষার অভাব তার মনে লজ্জা নয়, গর্ব তৈরি করে।
শিক্ষার অভাব তাকে ঈর্ষায় নীল করে দেয় শিক্ষিতদের প্রতি। এই অশিক্ষাই জন্ম দেয়
মিথ্যা, স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, ধর্মান্ধতার মতো বৈশিষ্ট্যগুলির। আর একবার
অশিক্ষা মজ্জায় ঢুকে গেলে তাকে শিক্ষিত করা খুব কঠিন। শিক্ষাকে গ্রহণ করার মতো
মানসিকতা আর থাকে না। শিক্ষা তখন তার কাছে একটি বর্জনীয় পদার্থ। আর এরই সুযোগ নেয়
আবার রাজনীতি। ‘এরা যত বেশি জানে, ততো কম মানে’। এটা বড় সত্যি কথা।
অশিক্ষিতকে সহজে বোঝানো যায়, সহজে ভোলানো যায়, সহজে অধীনত করা যায়। শিক্ষা বড় শক্ত
জিনিস। হজম না করতে পারলেই বদহজম হয়ে যায়। নিজেকে শিক্ষিত বলে দাবী করে যেসব
লেখাপড়া জানা অশিক্ষিতেরা তারা আরও ভয়ঙ্কর সমাজের পক্ষে।
ভেবে
দেখেছি রাজনীতি বড় বিশ্রী ব্যাপার। ওর ধারেকাছে আমার না ঘেঁষাই ভালো। বুঝিও না ঠিক
ওটা খায় না মাথায় দেয়। আমি বরং ঊনবিংশ শতকেই ফিরি। সেই সময়েও সমাজে নানা কিছু
নেতিবাচক দিক ছিল। তবু বাঙলা এবং বাঙালির স্বর্ণযুগ সেটা শিক্ষা এবং আদর্শে। আমার
ওখানে নিজেকে অন্তত ইনসিকিওরড লাগেনা।
No comments:
Post a Comment