সকাল সাড়ে আটটায় সময়। সোয়া আটটা থেকে গিয়ে বসে আছি। শুরুতেই
রিশেপশনে জানালো আরেকজনের চলছে একটু অপেক্ষা করুন। বলি, তাহলে ফাস্টিং-এর ব্লাডটা
নিয়ে নিন, একটু চা-বিস্কুট খেয়ে নিই। ব্লাড দিয়ে সামনের দোকান থেকে চা খেয়ে ফিরে
আসি। তারপরেও অপেক্ষা করতেই থাকি। অপেক্ষা করতে করতে মোবাইলের নোটে আস্ত একটা গদ্যই
লেখা হয়ে যায়। এবং খিদেতে কাহিল। মানে সকাল হলেই আমার বড্ড খিদে পায় কিনা, আর তখন
তো প্রায় দশটা বাজে। খিদের আর দোষ কি? উঠে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি, কত দেরি? শুনি এখনও
অনেক দেরি আছে। বলি, তাহলে একটু খেয়ে আসছি। বেরিয়ে আবার চায়ের দোকানে যাই। ডিম-পাঁউরুটির
অর্ডার দিই। তারপর প্লেটটা হাতে নিয়ে যেই না এক কামড় দিয়েছি, অমনি ফোন, আপনার
টার্ন এসে গেছে। যাব্বাবা, আমার মুখ ভর্তি পাঁউরুটি, টার্ন এলেই হল? কোনওমতে জল
দিয়ে কোঁত কোঁত করে গিলে ঘুগনীর দিকে সতৃষ্ণ নয়নে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে
ডায়গনোস্টিক সেন্টারে ফিরে এসে শুনি আরেকজনের এম আর আই শুরু হয়েছে। আরও মাত্র
পঁচিশ মিনিট বসতে হবে। তা বসি, বসেই থাকি। ছোটবেলা থেকে ডাক্তারের চেম্বার আর
ডায়গনোস্টিক সেন্টারে গিয়ে গিয়ে এসব বিষয়ে আমার ধৈর্য অনন্ত। কিন্তু আধ ঘন্টা বাদে
যখন আমার পরে আসা আরও একজনকে ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে দেখি, অসীম ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। রিশেপশনে
গিয়ে বলি, দুঘন্টার ওপর বসে আছি, আর কতক্ষণ? আমার মেজাজ দেখে সে ভেতরে পাঠায়।
ভেতরে আরেক মহিলা মধুর হেসে আমাকে ড্রেস চেঞ্জ করে দু মিনিট বসতে বলে। ইতিমধ্যে
একজন বেরিয়ে এলে, আরেকজনকে ঢোকায়। আমি আপত্তি জানালে আবারও মধুর হেসে বলে, ‘জাস্ট দুমিনিট’। অপেক্ষায় থাকি, দু মিনিট
কতক্ষণে শেষ হয়। জিজ্ঞাসা করি, এস আই জয়েন্ট কোথায়? বলে, কোমরে। মনে মনে ভাবি
কোমরে তো গুচ্ছের জয়েন্ট আছে, সেই কবে ফিজিওলজি পড়েছিলাম, ভুলে মেরে দিয়েছি। তবে
আর কথা বাড়াই না। আবারও মধুর হেসে সে বলে, ‘আপনার
ফোনটায় পছন্দের গান বেছে দিন, হেডফোনে লাগিয়ে দেব’। (মনে মনে দাঁত কিড়মিড় করি, আমি কি ছেলেমানুষ
যে ভোলাচ্ছ?) কানে হেডফোন দিয়ে গান শোনা আমার একেবারে পোষায় না, কিন্তু এবারেও কথা
বাড়াই না।
অতঃপর সেই ‘দু মিনিট’ শেষ হলে ঢুকে পড়ি। এম আর আই-এর
পূর্ব অভিজ্ঞতায় জানি অত ছোট জায়গায় দম আটকানোর মতো একটা কষ্ট হয় বটে, তবে চোখ
বুজে থাকলে সে ব্যাপারটা ম্যানেজ হয়ে যায়। কিন্তু ভয়ানক আওয়াজের কথাটা বেমালুম
ভুলে গিয়েছিলাম। যাইহোক শুয়ে পড়ে কানে বড় একটা হেডফোন লাগালে মাথাটা কিছুতেই বেডের
ঠিক জায়গায় খাপে খাপে ঢুকতে চায়না। তো সেই ‘মধুর’ মেয়েটি এসে কোনওমতে ম্যানেজ করে লাগিয়ে দিয়ে মাথাটা চেপেচুপে
ঢুকিয়ে দেয়। তার ওপর দিয়ে আবার একটা গোল ধরণের চাপা দিয়ে দেয় যাতে আমি আর মাথা
তুলতে না পারি। হেডফোনও আমার দুকানে বেশ চেপেই বসে। এবং তা দিয়ে আবার মধুর
কন্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘ভয় পাবেন না,
আমি আপনার সঙ্গেই আছি’। (মনে মনে
ভাবি, আ মোলো যা, খামোখা ভয় পেতে যাব কেন!)
ওদিকে তো হেমন্ত বেজে ওঠেন, “কি গাবো আমি কি শুনাব...” ঘ্যাঁ ঘ্যাঁ...ঘড়ড়ড়...বুঝি আরম্ভ হয়েছে। আহা,
ভেবেছিলুম রবীন্দ্রজয়ন্তী, কানে নাহয় রবীন্দ্রনাথই বাজুক। বাজছেন তিনি হয়তো
অন্তরে, “মরণেরও মুখে রেখে...” ঘড়ড়ড়...। মনে পড়ল মেট্রোতে যখন
রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজতো তখন অনেকটা এভাবেই শুনতে হতো। যাইহোক নিজেকে আশ্বস্ত করি,
রবি ঠাকুর বাজছেন তো ঠিক, সে আমি শুনতে পাই আর না পাই...। ওদিকে কানে মধ্যে ক্রমশ
চেপে বসছে হেডফোন। কানের ব্যথা ঘাড়ে আর মাথায় ছড়িয়ে পড়ছে। ক্রমশ যে করেই হোক
হেমন্তের হাত থেকে মুক্তি পেতে আমি বদ্ধ পরিকর হলাম। মাথা সামান্য
এগোনো-পেছোনো...ঘ্যাঁগা ঘ্যাঁগা ঘ্যাঁগা...অবিকল মনে হচ্ছে মাথার মধ্যে কে ‘বাবা, বাবা...’ বলে যাচ্ছে। যদিও আমার অবস্থা তখন বাবারে
মারে ছেড়ে দে রে। এম আর আই নিয়ে আমার আর মাথা ব্যথা নেই। সমস্ত ব্যথা কেন্দ্রীভূত
হয়ে দুকানের হেডফোনে। কিছুতেই ম্যানেজ করা যাচ্ছে না। ওদিকে প্রবল আওয়াজের ফাঁকেই
হেমন্ত বেজে উঠছেন, “অচেনাকে ভয় কি
আমার ওরে...”। হাত দুটোকে
স্লো মোশানে ওপরে ওঠাচ্ছিলাম যাতে কেউ টের না পায়, কিন্তু ওঠাতে না ওঠাতেই দেওয়ালে
গেল আটকে। হেমন্ত, ঘ্যাঁ কোঁ কো সব পেরিয়ে এবারে জোরে চেঁচাই সেই ‘মধুর’ উদ্দেশ্যে – হেডফোনে
কানে লাগছে ভীষণ, খুব কষ্ট হচ্ছে...। হেমন্তকে পজ করে মধুর কন্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘আর মাত্র সাতমিনিট, একটু কষ্ট
করুন’। অতএব ‘একটু কষ্ট’ করে সেই ‘সাত মিনিট’-এর অপেক্ষা করি। হেমন্ত একেবারে কানে কানেই
জানান, “হায় গো, ব্যথায় কথা যায় ডুবে যায়
যায় গো...” – গানের বাকি অংশ আবারও ডুবে যায় আওয়াজে -
ঘড়ড়ড়...। এবার মাথাটা ওপরের দিকে তোলার চেষ্টা করি, যদি দুকানের থেকে দৈবাৎ খুলে
আসে হেডফোন। সামান্য তুলতে না তুলতেই আটকে যায়, মনে পড়ে ওপর দিয়ে আরও একটা তো
পরানো আছে। ওভাবেই মাথাটা ঝুলিয়ে রাখি...ঘাড় দিয়ে ব্যথা উঠে মাথা যন্ত্রনায় ছিঁড়ে
যাচ্ছে... ‘সত্য মরিয়া গিয়াছে – পঞ্জাব মেলের সঙ্গে দার্জিলিং
মেলের কলিশন – রক্তারক্তি
-পিসীমা –’ – খুব বিপদে পড়লে রবি ঠাকুরের পরেই
হয় শিবরাম নয় পরশুরামকে মনে পড়ে আমার। ওই আর কী রাম নাম জপা। ঘড় ঘড় থেমে যায়
আচমকাই আর সুযোগবুঝে হেমন্তও গেয়ে ওঠেন, ‘এ পথে
আমি যে গেছি বারবার...’ আমাকে টেনে বার
করে আনে। আমিও আর্তনাদ করে উঠি এবার, হেডফোন, হেডফোন খুলুন, তাড়াতাড়ি...।
সব গুছিয়ে বেরোনোর আগে মোবাইল নিতে গেলে আবার মধুর হেসে
জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনার কি দুটো
পয়েন্টেই ব্যথা?' বলি, সব, সব জায়গায় ব্যথা যেখানেই চান। আমার তখনও কান-মাথা সব ঝনঝন
করছে...
হেডফোন তো কখন খোলা হয়ে গেছে, তবু হেমন্ত যেন মাথার মধ্যে
বেজে যান, ‘বরষ ফুরায়ে যাবে, ভুলে যাবে, ভুলে
যাবে, ভুলে যাবে জানি...।’ ভাবি,
ভাগ্যিস!
No comments:
Post a Comment