Friday, April 8, 2016

কাঙাল হরিনাথ ও তাঁর গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা –এই রূপকথা আজ কেন আর সত্যি হয় না?

পুরোনো পত্রপত্রিকা এবং সেইসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করাটা আমার একটা স্বভাবে দাঁড়িয়েছে। গতকাল সারাদিন ধরে যে দুটো বই পড়লাম তার মধ্যে মুনতাসির মামুদ সম্পাদিত দুই শতকের বাংলা সংবাদ-সাময়িকপত্র-এর লেখাগুলি ভারী চমৎকার লাগল। এই বইয়ে আবুল আহসান চৌধুরী লিখিত উনিশ শতকের গ্রাম নির্ভর সংবাদ-সাময়িকপত্র লেখাটিতে কাঙাল হরিনাথ সম্পাদিত গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা-র কথা পড়তে গিয়ে মনে হল আজকের দিনেও এমন পত্রিকা এবং তার এমন সম্পাদক বিরল। ক্ষমতার আসনের নামগুলো শুধু বদলে গেছে। বদলায়নি মফঃস্বল আর গ্রাম-বাংলার এই চিত্র। আজকের দিনেও এমন একজন হরিনাথ মজুমদারের এই মুহূর্তে বড় প্রয়োজন। আর তাই আমার পড়ার মুগ্ধতাটুকু ভাগ করে নিতে ইচ্ছে হল। তথ্যের পুরোটাই ওই লেখাটি থেকে নেওয়া। কিছু বাক্যের অদলবদল বা যোগবিয়োগ করেছি মাত্র।

ঊনবিংশ শতকে তুলনায় বড় এবং জনপ্রিয় অনেক পত্রপত্রিকাই যেখানে ইংরেজ সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, সেখানে বাংলাদেশের এক অখ্যাত গ্রামে বসে জনৈক হরিনাথ মজুমদার তাঁর প্রতিষ্ঠিত এবং সম্পাদিত গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় জমিদার এবং ইংরেজ সরকারের শোষনকারী এবং অত্যাচারী প্রকৃত চেহারাটা তুলে ধরতেন তাঁর স্বল্প আর্থ-সামাজিক ক্ষমতার মধ্যেই। এই পত্রিকাটি ১৮৬৩ সালের এপ্রিল মাসে কুমারখালি গ্রাম থেকে প্রকাশিত হয়। হরিনাথ মজুমদার বা কাঙাল হরিনাথের সাহিত্য এবং সমাজসেবীর বিস্তৃত পরিচয় ছাপিয়ে ওঠে তাঁর এই সাময়িকপত্র সম্পাদনার লড়াই। প্রাথমিকভাবে তিনি ঈশ্বরগুপ্ত সম্পাদিত সংবাদ প্রভাকর-এর সংবাদদাতা হিসেবে কিছুদিন কাজ করেছিলেন। গ্রামবার্ত্তা প্রকাশের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে হরিনাথ তাঁর দিনলিপিতে লিখছেন,আমি ইতিপূর্বে নীলকুঠিতে ও মহাজনদিগের গদিতে ছিলাম, জমিদারের সেরেস্তা দেখিয়াছিলাম এবং দেশের অন্যান্য বিষয় অনুসন্ধান করিয়া অবগত হইয়াছিলাম; সেখানে যত প্রকার অত্যাচার হয়, তাহা আমার হৃদয়ে গাঁথা ছিল। দেশীয় সংবাদপত্রের অনুবাদক রবিন্সন সাহেব যখন অনুবাদ-কার্য্যালয় খুলিলেন, আমিও সেই সময় গ্রামবার্ত্তা প্রকাশ করিলাম। তিনি আরও লিখেছেন, গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা সংবাদপত্রিকার দ্বারা গ্রামের অত্যাচার নিবারিত ও নানা প্রকারে গ্রামবাসীদের উপকার সাধিত হইবে...

পত্রিকাটি প্রকাশের পর উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য নিয়ে সম্পাদক লিখছেন, এ পর্য্যন্ত বাঙ্গলা সংবাদপত্রিকা যতই প্রচারিত হইতেছে তাহা কেবল প্রধান প্রধান নগর ও বিদেশীয় সম্বাদাদিতেই পরিপূর্ণ। গ্রামীয় অর্থাৎ মফঃস্বলের অবস্থাদি কিছুই প্রকাশিত হয় না। তজ্জন্য গ্রামবাসীদিগের কোন প্রকার উপকার দর্শিতেছে না। যেমন চিকিৎসক রোগীর অবস্থা সুবিদিত না হইলে তাহার প্রতিকারে সমর্থ হন না, তদ্রূপ দেশহিতৈষী মহোদয়গণ গ্রামের অবস্থা, ব্যবসায় রীতি, নীতি, সভ্যতা, গ্রামীয় ইতিহাস, মফঃস্বল-রাজকর্ম্মচারীগণের বিচার, এবং আশ্চর্য্য ঘটনাদি প্রকাশিত হয় তাহাই এই পত্রিকারপ্রধানোদ্দেশ্য”। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এই পত্রিকা মাসিক, পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক হিসেবে কয়েক পর্যায়ে মোট বাইশ বছর চলেছিল।

কৃষক-তাঁতি, রায়ত-প্রজাসহ শ্রমজীবী মানুষের সমস্যা ও অধিকার সম্পর্কে গ্রামবার্ত্তা সচেতন ও সক্রিয় ছিল। এদের দুঃখ-দুর্দশার কথা বলতে কোনও দ্বিধা বা শঙ্কাবোধ করত না। এসব বর্ণনায় রায়ত-প্রাজাদের প্রতি সহানুভূতি, জমিদারের শোষণ-নিগ্রহের স্বরূপ উন্মোচন এবং সরকারি ভূমিকার সমালোচনারও ঈঙ্গিত থাকত। অনেকক্ষেত্রেই সরকারের দায়িত্ববোধের ঔদাসীন্য সম্পর্কে বেদনা এবং অভিযোগ জানিয়ে কর্তব্যবোধ জাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে। দেশীয় শোষক-জমিদার বা বাক্‌-সর্বস্ব তথাকথিত দেশদরদির সমালোচনা বা নিন্দাও করা হয়েছে প্রকাশ্যে।

দেশ নষ্ট কপটে, প্রজা মরে চপটে, কি করবে রিপোর্টে শীর্ষক এক প্রতিবেদনে নিরুপায় কৃষক-প্রজার দুঃখ-দুরবস্থার প্রধান কারণ হিসেবে পুলিশ, গো-খোঁয়াড়, আদালত, জমিদার ও মহাজনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, - সর্বক্ষণই যাদের ...প্রজার শোণিত পান করিতে...লালা ক্ষরিতেছে। পুলিশ সম্পর্কে পত্রিকার মন্তব্য, বিকারগ্রস্ত রোগীর হিক্কা উপসর্গের ন্যায়, পুলিশ প্রজার উপসর্গ হইয়াছে। আদালতের আমলাদিগের হাত পাতা রোগ এর কারণে মূলত দরিদ্র প্রজারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। এরপর আছে জমিদারের শোষণ-কৌশল-অবাধ প্রজাপীড়নের প্রয়োজনে রাজকর্মচারি, পুলিশ ও আদালতকে উৎকোচ দিয়ে বশে রাখা। সরকার-প্রণীত বিধি-আইনও প্রজার রক্ষাকবচ না হয়ে বরং তার অস্তিত্ব সংকটের সহায়ক হয়েছে। এইসব বিষয়ে আলোচনা করে গ্রামবার্ত্তা পরামর্শ দিয়েছে,...যদি প্রজা রক্ষা ও প্রজার প্রতি অত্যাচার নিবারণ করিতে গবর্মেন্ট আন্তরিক সংকল্প করিয়া থাকেন, তবে প্রজাগণ কি কারণে অত্যাচারিত হইতেছে অগ্রে তাহার গোপনানুসন্ধান করুন, পরে যে নিয়ম করিবেন তাহাতেই কার্য্য হইবে। অন্যথায় কেবল আড়ম্বর।

দেশীয় শিল্পের উন্নতি ও বিকাশে সবসময়েই কামনা করেছে গ্রামবার্ত্তা। পাবনার প্রজা বিদ্রোহেও গ্রামবার্ত্তার সমর্থন প্রজাদের দিকেই ছিল। রায়ত-প্রজাদের ওপর জমিদারের অন্যায় অত্যাচারই এর কারণ বলে তিনি এর ব্যাখ্যা করেছিলেন। বাংলাদেশের জমিদার-সম্প্রদায়ের প্রজাহিতকর কর্মোদ্যোগের অন্তরালে ছিল তাঁদের শোষণ সম্পর্কে অন্যের দৃষ্টি-বিভ্রান্তির চেষ্টা এবং রাজ-সম্মানলাভের আকাঙ্খা। জমিদারের স্বরূপ উন্মোচনে গ্রামবার্তা জানিয়েছে, জমিদারদিগের দ্বারা যত বিদ্যালয় স্থাপিত হইয়াছে, রাজদ্বারে সম্মান লাভেচ্ছাই তাহার অধিকাংশের কারণ।...মফস্বলের এক একজন জমিদার দাতব্য ডিস্‌পেনসারি ও বিদ্যালয়াবরণ দিয়া, আমেরিকা দেশের ভাম্পাইয়ার বাদুড়ের ন্যায় প্রজার রক্তপান করেন। হাকিমেরা মফস্বলে আসিয়া স্কুল ও ডিস্‌পেনসারি দেখিয়া ভুলিয়া যান, প্রজার ক্রন্দন কিছুই শুনেন না।...যোড়াসাঁকোনিবাসী শ্রদ্ধাস্পদ জমিদার শ্রীযুক্ত বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এদেশের অদ্বিতীয় ধার্ম্মিক।...সম্প্রতি একটা কথা শুনিয়া দুঃখিত ও বিস্মিত হইয়াছি। তিনি শিলাইদহের স্কুল হইতে ইংরেজী শিক্ষা উঠাইয়া দিয়াছেন।কৃষক-প্রজার সন্তান ইংরেজি শিক্ষা লাভ করে যাতে অধিকার-সচেতন হয়ে উঠতে না পারে ও অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিকারের সাহস ও সুযোগ না পায়, সে-জন্যই জমিদার তাঁর স্বার্থবুদ্ধির কারণেই যে জনকল্যাণবিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এই ইঙ্গিত এখানে অস্পষ্ট নয়।

হরিনাথের গ্রামবার্ত্তা রাজশক্তিরও দ্বিধাহীন সমালোচনা করত। পল্লীবাসীর নিদারুণ জলকষ্টে সরকারের উদ্যোগহীনতাকে তীব্র ভর্ৎসনা করে লেখে, এতৎ প্রবন্ধে কর্ত্তৃপক্ষ-সমীপে এই মাত্র বক্তব্য, গবর্ণর জেনারেল প্রভৃতির সিমলার বিহারের নিমিত্ত প্রতি বর্ষে রাজকোষ হইতে সাড়ে চারি লক্ষ টাকা ব্যয় হয়, গ্রাম ও পল্লীবাসীর দরিদ্র প্রজাদিগের নিমিত্ত কিঞ্চিৎ ব্যয় কি রাজধর্ম বিরুদ্ধ! প্রশাসন-যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের ত্রুটি-বিচ্যুতি-স্খলনকেও গ্রামবার্ত্তা রেহাই দেয়নি। পাবনার ইংরেজ ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট একবার এক দরিদ্র বিধবার একটি দু্গ্ধবতী গাভী জবরদস্তি করে কেড়ে নিলে, হরিনাথ তার পত্রিকায় গরুচোর ম্যাজিস্ট্রেট নামে সংবাদ প্রকাশ করেন। প্রকৃতপক্ষে রাজকর্ম্মচারীদের অসচ্চরিত্রতাই প্রজাদের মনোভঙ্গের কারণ বলে গ্রামবার্ত্তা মনে করেছে।

জীবনের ঝুঁকি নিয়েও হরিনাথ নির্ভীক ও সৎ সাংবাদিকতার একটি আদর্শ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শাসক-সরকার, আমলা, পুলিশ-গোরাপল্টন, নীলকর, জমিদার মহাজন প্রমুখ কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করার জন্য তাঁকে যথেষ্ট ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে। শুধুমাত্র পীড়িত-অপদস্থ-বিপন্নই নয়, কোনও কোনও সময়ে তাঁর জীবন-সংশয়ও দেখা দিয়েছে। নির্ভীক ভূমিকার জন্যে তাঁকে জেলার ম্যাজিস্ট্রেট এবং পরগণার জমিদার উভয়েরই বিরাগভাজন হতে হয়। কিন্তু সাহস ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে এইসব প্রতিকূলতার মোকাবিলা করেছেন, কিন্তু কর্তব্যকর্ম থেকে কখনও বিচ্যুত হননি। তাঁর নিজের কথায়, আমরা এতদিন সহ্য করিয়াছি, আর করিতে পারি না। সকল কথা প্রকাশ করিয়া কর্ত্তব্য সম্পাদন করিতে ত্রুটি করিব না। ইহাতে মারিতে হয় মার কাটিতে হয় কাট, যাহা করিতে হয় কর, প্রস্তুত আছি।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের জমিদারি ছিল কুষ্টিয়ার নিকটবর্তী বিরাহিমপুর পরগণায়। শিলাইদহে ছিল তার সদর দফতর। ঠাকুর-জমিদার এলাকায় প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমল থেকেই প্রজা-পীড়নের অভিযোগ ছিল। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় এই পীড়ন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। খাজনা বৃদ্ধি, নানারকম কর আরোপ, জুলুম করে প্রজার ভিটেমাটি উচ্ছেদ, অনাবৃষ্টি-অতিবৃষ্টিতে বিপন্ন রায়ত-প্রজার থেকে বলপূর্বক খাজনা আদায় ইত্যাদি ঘটনার কথা হরিনাথ নির্ভীকভাবে গ্রামবার্ত্তায় প্রকাশ করতেন। এর পাশাপাশি জমিদারের অনীহা এবং ঔদাসীন্যের সংবাদও প্রকাশিত হত। গ্রামবার্ত্তার এই জমিদার-স্বার্থবিরোধী ও তাঁদের চরিত্রের স্বরূপ উন্মোচনকারী ভূমিকা অনুমোদন করা ঠাকুর-জমিদারের পক্ষে সংগত কারণেই সম্ভব হয়নি। ঠাকুর-জমিদারের পক্ষ থেকে প্রথম পর্যায়ে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে হরিনাথকে বশ করার চেষ্টা করা হয়। এই চেষ্টা ব্যর্থ হলে লাঠিয়াল লাগিয়ে খুন করার চেষ্টা হয়। জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীর হাত থেকে বিপন্ন বন্ধুকে রক্ষার জন্যে তাঁর দলবল নিয়ে এগিয়ে আসেন বাউল সাধক লালন ফকির।

হরিনাথের সাহিত্য-শিষ্য অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়কে লেখা একটি চিঠিতে হরিনাথ লিখেছিলেন, জমিদারেরা প্রজা পরিত্যাগ করিয়া আমার প্রতি যতদূর সাধ্য অত্যাচার করেন। কিন্তু উপকৃত পল্লীবাসী হরিনাথের বিপদ ও সংকটে নিস্পৃহ ও উদাসীন থাকায় মর্মাহত হরিনাথ ওই পত্রেই আক্ষেপ করে লিখেছিলেন,জমিদারেরা যখন আমার প্রতি অত্যাচার করে, এবং আমার নামে মিথ্যা মোকদ্দমা উপস্থিত করিতে যত্ন করে, আমি তখন গ্রামবাসী সকলকে ডাকিয়া আনি এবং আত্মাবস্থা জানাই। গ্রামের একটি কুকুর কোন প্রকারে অত্যাচারিত হইলেও গ্রামের লোকে তাহার জন্য কিছু করে, কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, ও আমার এতদূরই দুর্ভাগ্য যে, আমার জন্য কেহ কিছু করিবেন, এরূপ একটি কথাও বলিলেন না। যাঁহাদের নিমিত্ত কাঁদিলাম, বিষাদ মাথায় করিয়া বহন করিলাম, তাঁহাদিগের এই ব্যবহার!

সমাজে যে এই পত্রিকার একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল তা সম্পাদকের নিজের বক্তব্যেই আমরা জানতে পারি, ...পূর্ব্বের অনেক ধনবানাদি সবল লোকেরা দূর্ব্বলের প্রতি প্রকাশ্যরূপে সহসা যে প্রকার অত্যাচার করিতেন, এক্ষণে যে তদ্রূপ করিতে সাহসী হইতেছেন না...গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকাই তাহার কারণ। জলধর সেন এই পত্রিকাটি সম্বন্ধে লিখেছেন, নদীখাল প্রভৃতি পয়ঃপ্রণালী সংস্কারপূর্ব্বক জলকষ্ট নিবারণ, পুলিশ-বিভাগের সংস্কার, গো-ধন রক্ষা, রেলপথ দ্বারা জল নিঃসরণের পথ বন্ধ হওয়ায় এদেশ যে অস্বাস্থ্যকর ও ম্যালেরিয়ার আকরভূমি হইতেছে, পোষ্টাফিসের মনিওর্ডার প্রথা প্রচলন প্রভৃতি অনেক প্রয়োজনীয় বিষয় সম্বন্ধে হরিনাথ লেখনী পরিচালনা করিয়া রাজা ও প্রজা উভয়েরই হিতাকাঙ্খী বলিয়া পরিচিত হইয়াছিলেন। জলধর সেনের এই মন্তব্যটিও যেন টেকনিকালি কারেক্ট বা নিজের গা বাঁচিয়ে লেখা। সেইসময়ের শিক্ষিত বাঙালির একটা বড় অংশই তা করতেন। গ্রামবার্ত্তা থেকে ইংরেজিতে খবরগুলির অনুবাদ করে ইংরেজ সরকারের গোচরে আনতেন বাংলা গবর্ণমেন্টের বাংলা সংবাদপত্রের অনুবাদক মিঃ রবিন্সন।

যাইহোক চোখ থাকতে চোখের মর্যাদা যেমন মানুষ বোঝে না, ঠিক তেমনি পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর হাহাকার পড়েছিল সেই গ্রামবাসীদের মধ্যেই, যাঁরা হরিনাথ বা তাঁর পত্রিকা কারোরই পাশে দাঁড়াননি। বোধহয় নিশ্বাস ছেড়ে বেঁচেছিলেন ইংরেজ সরকার বাহাদুর আর ঠাকুর-জমিদারের মতো মানুষেরা। মীর মশাররফ হোসেন-এর হিতকরী পত্রিকায় পল্লীবাসী প্রজার পরিচয়ে প্রকাশিত একটি চিঠিই বরং হরিনাথের গ্রামবার্ত্তার প্রকৃত রূপটিকে আরও স্পষ্ট করেছে।

আজ কয়েক বৎসর হইল গ্রামবার্ত্তার কন্ঠ নীরব হইয়াছে। গ্রামবার্ত্তার সতেজ লেখনি প্রভাবে এ অঞ্চলের পুলিশ, বিচারক, হাকিম, মিউনিসিপ্যাল কমিশনার, জমিদার প্রভৃতির অত্যাচার শান্তভাব ধারণ করিয়াছিল। গ্রামবার্ত্তার জীবন এই সমস্ত অত্যাচার কাহিনী প্রকাশ করিয়া অনেক সময় নানা বিপদে পড়িতে হইয়াছিল যে তাহার আর উল্লেখের প্রয়োজন নাই; এ প্রদেশের সকলেরই অন্তরে তাহা জাগরিত রহিয়াছে। ...তাই আমাদের নিবেদন গ্রামবার্ত্তার কন্ঠ নীরবের পর যখন হিতকরীর অভ্যুদয় হইয়াছে, তখন আমরা পল্লীবাসী আমাদের দুঃখের কথা গ্রামবার্ত্তায় যেমন তীব্রভাবে আলোচিত হইয়া রাজার গোচর করিত, সেইরূপ আলোচিত হইয়া আমাদের দুঃখ  দূর করিতে চেষ্টা করুন। ...পূর্ব্বে যখনই দুঃখ পাইতাম তখনই গরীবের দুঃখের দুঃখী, কান্নাই সমভাগী গ্রামবার্ত্তার দ্বারে গিয়া কতবার কাঁদিতাম। সকরুণ স্বরে আমাদের জন্যে কত কান্নাই সম্পাদক রাজার নিকট, জমিদারের নিকট না কাঁদিয়াছেন; কিন্তু এখন কাহার কাছে যাইব?


নাহ্‌, গ্রামবার্ত্তার অভাব সেকালে কেন, আজও আর কেউ পূরণ করতে পারেনি। অথচ কত সমসাময়িক রয়ে গেছে গ্রাম বাংলা আর মফঃস্বলের সব সমস্যাই।

No comments:

Post a Comment