সুমনের গান আমার সবসময়েই প্রিয়। এমন কী রবি ঠাকুরের গানের
পরেই সুমনের বহু গানকে কালজয়ী বলে মনে হয় আমার। এতকাল তবু সামনাসামনি শোনা হয়ে
ওঠেনি আমার কেন জানি। যদিও কলেজজীবন থেকেই কলকাতাতে থাকি। প্রথম যেবার দোলে
শান্তিনিকেতন যাই, স্থানীয় এক ভদ্রলোক বলেছিলেন, আপনি তো আসল উৎসবটাই দেখতে পেলেন
না, এবছরই আশ্রমের মাঠ থেকে মেলার মাঠে বসন্ত উৎসব সরে এসেছে। আমি কী দেখলাম তা
আমিই জানি। চোখে কি আর সব দেখা যায়? দেখে তো মানুষ অনুভবে। তেমনই আমাদের অল্পবয়সে
সুমন যখন হৈ হৈ করে গান গাইছেন, আর সেই গানে প্রাণের মধ্যে মোচড় দিচ্ছে, স্বপ্ন
দেখাচ্ছে তখন সুমনের অনুষ্ঠান দেখা হয়নি আমার। মনে আছে দাদা তখন কলকাতায় থাকত, আমি
হায়ার সেকেন্ডারি পড়ছি, রূপনারায়ণপুরেই। সুমনের অনুষ্ঠান দেখে দাদার খুব
ভালোলেগেছিল, ‘তোমাকে চাই’ ক্যাসেটটা কিনে বাড়িতে এনেছে।
আমরা শুনছি। একে তো দাদা যা বলে যা করে সব আইডিয়াল আমার। তার ওপরে আবার সেইসময়ের
সুমনের গান।
গতকাল সুমনের গান প্রথম সামনাসামনি শোনা। আমারও প্রথমবার,
মেয়েরও। মেয়ে আবার ইংরেজি গান শুনেই অভ্যস্ত। ধুতি-পাঞ্জাবী পড়া বয়স হয়ে যাওয়া
সুমনের আবির্ভাব মনে কিছুটা ধাক্কা দেয়। আসলে ‘তিনি বৃদ্ধ হলেন’ এটা যেন সুমনকে ঠিক মানায় না। বরং যখন গলা
খুলে গেয়ে ওঠেন, ‘আমারও তো বয়স
হচ্ছে রাতবিরেতে কাশি, কাশির দমক থামলে কিন্তু বাঁচতে ভালোবাসি’ তখন ঠিক লাগে। বেশ কয়েকটা না
শোনা গান গাইলেন সুমন। তারমধ্যে ‘জন হেনরী’ গানটার অন্যরকম কথা ও সুর মনে
দাগ কাটলো। হেমাঙ্গ বিশ্বাস কৃত গানটি আমার ভীষণ প্রিয়। ছেলেবেলায় মায়ের সঙ্গে
একসঙ্গে কত গেয়েছি। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হত গানটার শব্দে ও সুরে। চেনা গানের মধ্যে
সকলের চিরকালীন প্রিয় ‘তোমাকে চাই’ গানটা অত না ভেঙ্গে গাইলেই ভালো
হত। শহীদ কাদরীর কবিতা অবলম্বনে ‘তোমাকে
অভিবাদন প্রিয়তমা’ আমার অসম্ভব
প্রিয় গান। প্রেমের এত ভালো গান সত্যিই হয় না। ‘ভালোবাসা শত যুদ্ধেও জেতা যায় না’ এই গানে আমার সবচেয়ে ভালোলাগে ‘একা মেয়েটার নরম গালের পাশে
প্রহরীর মতো রাত জাগে ভালোবাসা’ এই অসম্ভব
সুন্দর দৃশ্যায়ণটি।
ইদানীংকালে যাঁরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছেন তাঁদের মধ্যে যে
কয়েকজনের গানে সত্যিকার অনুভূতিটা পাওয়া যায়, অর্থাৎ রবীন্দ্রসঙ্গীত বলে শোনা যায়,
সুমন তাঁদের অন্যতম। যদিও ‘সুমনের
গান’ শুনতে গিয়ে একের পর এক
রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে ঠিক ভালোলাগছিল না। আর ভালোলাগে না সুমনের মুখে রাজনীতির
কথা। যখন সুমন কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না, তখন যেটা মানাত, এখন সেটা মানায়
না। তৃণমূল সমর্থক সুমন যখন কেন্দ্রের কাজের সমালোচনা করেন, মনে হয় চালুনি বলে
সূঁচ তোর পিছনে কেন ছ্যাঁদা? তাও সমালোচনার বিষয় কেন পান্নালালের নামে কোথাও কিছু
হয়নি? সে তো কতজনের জন্যই কতকিছু হয়নি। পান্নালাল তো গান গেয়েছিলেন, আর অবলা বসুর মতো
ব্যক্তিত্ত্ব যিনি সারাজীবন বাংলার মেয়েদের শিক্ষার জন্য কত কাজ করে গেছেন, তার
স্বীকৃতি বাঙালিই দেয়নি, না এপার বাংলা, না ওপার বাংলা। পান্নালালের চেয়ে আরও অনেক
সাম্প্রতিক বিষয় ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনাই যদি করতে হয়, তার জন্য। আমার মনে
হয়, গান আর ব্যক্তিগত রাজনীতিকে সুমন যত আলাদা রাখবেন শ্রোতাদের জন্য ততোই মঙ্গল।
আমি আগে কম্যুনিস্ট ছিলাম - একথা তাঁর গানের সঙ্গে খাপ খায় না। আমার তো মনে হয়
এখনও সুমনের গানের একটা বড় অংশের শ্রোতাই বাম মনস্ক, এবং সুমন নিজেও তাই। নাহলে ওই
গান লেখা বা গাওয়া যায় না। আমি কিন্তু বামপন্থী বলিনি। বামমনস্ক এবং বামপন্থীর
মধ্যে তফাত আছে।
সবমিলিয়ে বেশ ভালোলাগল। যদিও বিরতির পর দ্বিতীয় পর্বে গানে
গানে মিশ্রণ বা রবীন্দ্রসঙ্গীত আর একটু কম হলে ভালো হত। এমন কী তার বদলে কিছু
পুরোনো অন্য গান গাইলেও চলত। তবে সুমনের অনুষ্ঠান মানুষ দেখতে যায় বা যাবে,
শুধুমাত্র ‘সুমনের গান’ শুনবার জন্যই। এই কথাটা মাথায় রাখলে অনুষ্ঠান
আরও আকর্ষণীয় হবে।
দীর্ঘজীবী হোন সুমন। আমরা আরও নতুন নতুন গানে কাশির দমক থামলে
বাঁচতে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখতে থাকি।
No comments:
Post a Comment